বেনিফিট অফ লাভ পর্ব-০২

0
497

#বেনিফিট_অফ_লাভ -২
Tahrim Muntahana

বিয়ে হয়ে গেছে। একটু আগের নিস্তব্ধতা আর নেই। এখন গমগমে পরিবেশ বিরাজ করছে‌। শাম‌উল গম্ভীর মুখে বসে আছে, একটু পর পর সদ্য বিয়ে করা ব‌উকে দেখছে আরেকবার মা কে দেখছে‌। তার মন চায়ছে আজ রাত এই বাড়িতে থেকে যেতে পারলে। কোনো ভাবেই আজকের রাত টা সে মিস দিতে চায় না। কিন্তু হক বাড়িতে গেলে যে তার প্রথম রাত বাসর থেকে বছর হয়ে যাবে; এটাই যেন বারবার আর্তনাদ করে মন বলছিল। এক বছরেও হয়তো ব‌উ কে কাছে পাবে না। শাম‌উলের আর্তনাদ যেন কথা বললো। এবার বেনিফিট খাজা নিজের ভেতরকার রাগ জেদ ও প্রখর চাটুকারিতা কে কাজে লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েই দিলেন। ফটোসেশন চলছিল, এর মাঝে তিনি গমগমে কন্ঠে বলে উঠলেন,

-“আমাদের হক পরিবারের ওয়ান ঐতিহ্য হেভ। ইয়ার ইয়ার তা পালন হয়ে আসছে। বেনিফিট খাজা কখনোই ঐতিহ্য কে অস্বীকার করেনা, সি যত‌ই মর্ডান হোক। এখন হক ফ্যামিলির ফার্স্ট সন শাম‌উল। তাকে দিয়েই আমার ডিউটি পালন করবো।”

মনসুর হক ব‌উয়ের দিকে ট্যারা চোখে তাকালেন। হক পরিবারের বড় সন্তান হয়ে তিনি কোনো ঐতিহ্যের কথা এ পর্যন্ত শুনলেন না; অথচ আজ মুহুর্তের মধ্যেই ঐতিহ্য এসে গেল? মনসুর হকের মাথা টাক, ফুল টাক না। কপালের উপর কিছু চুল, মাথার পেছনে কিছু চুল; মাঝখানে একদম টাক। দেখতে অবশ্য বেশী খারাপ লাগে না। তিনি টাক মাথা চুলকে ছোট ভাই চাঁন হকের দিকে তাকান। সে বড়‌ই নিরব ভূমিকা পালন করছে। তার একমাত্র কারণ ঘুম। টেবিলের এক কোণায় বসে চোখ বুজে ঢুলছেন। যখন তখন মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে পারেন। মনসুর হক নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন। গড়াগড়ি থেকে বাঁচাতে নয়, গিয়েই পেছন থেকে গাট্টা মারলেন‌। চাঁন হক একদম শিং মাছের মতো লাফিয়ে উঠলেন, বিকট শব্দ করে। সবার দৃষ্টি তখন চাঁন হকের দিকে। সবাই একটু হলেও ভয় পেয়ে গেছে। বেনিফিট খাজা চোখ গরম করে তাকালেন চাঁন হকের দিকে। এর মানে হলো, “হোম যাও ইউকে ঘুমের মধ্যে যদি গলায় দড়ি না ঝুলিয়েছি!” বড়সড় ঢোক গিলে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসলেন চাঁন হক। হাসির সিস্টেম এতটা হাস্যকর ছিল, চারদিকে হাসির শব্দে ছেয়ে গেল। ধমকে উঠলেন বেনিফিট খাজা। নিজের বক্তব্য ধরে রেখে বললেন,

-“হক ফ্যামিলির ঐতিহ্য হলো, ছেলে বিয়ের পর ওয়াইফের উইথ থাকতে পারবে নো, মানে ওয়ান ইয়ার ব‌উ তার ফাদার হোমে থাকবে। ফাদার ইন লো হোমে যেতে পারবে না।”

সিমা বেগম চমকে গেলেন রীতিমতো। এ আবার কেমন নিয়ম, কেমন ঐতিহ্য? পাড়ার লোকে কি বলবে? তার মেয়ের নামে দুর্নাম রটাবে। অসহায় ভঙ্গিমায় সিলভিয়ার দিকে তাকালেন তিনি। সিলভিয়া তা দেখেও দেখলো না। হাসি মুখে বেনিফিট খাজা’র দিকে এগিয়ে গেল। বুকে দু’হাত বেঁধে বললেন,

-“উফ মিসেস গাঁজা আই মিন খাজা আপনার ফ্যামিলর উইথ আমাদের এত মিল? আমাদের লস্কর ফ্যামিলির ওয়ান ঐতিহ্য আছে। ঐতিহ্য হলো, বিয়ের ওয়ান ইয়ার মেয়ে ফাদার হোমে থাকবে, ফাদার ইন লো হোমে যেতে পারবে নো। বাট ছেলে ফাদার হোমে আসতে পারবে। আর ইউদের ঐতিহ্যে এমন কোনো ইস্যু নেই ছেলে ফাদার ইন লো হোমে থাকতে পারবে না। তাহলে ওই কথায় হলো, ছেলে আমাদের হোমেই থাকবে। কারোর ফ্যামিলির ঐতিহ্য নষ্ট হবে নো!”

বেনিফিট খাজার মাথায় ইয়া বড় বো’মা ফাটলো মনে হলো। কান তালা লেগে গেছে যেন। তিনি মুখ হা করে তাকিয়ে রইলেন সিলভিয়া’র দিকে। মেয়ের এটিটিউট দেখে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিতাব, সাম্মাক একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। শিতাবের মুখশ্রী তে কিছুটা অসহায়ত্ব বোধ। এই মেয়ে তার মায়ের পিছু লাগছে কেন? কত বড় শেয়া’না মেয়ে। আবার ভেংচি কাটছে কথার। কিছুটা রাগ ও হলো। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

-“হেই মিস, আমার মম অনেক আগে থেকেই এই ভাবে কথা বলতে অভ্যস্ত। আপনি তাকে এইভাবে কথা বলে অসম্মান করতে পারেন না।‌”

সিলভিয়া মুচকি হাসলো। ঠোঁট চোখা করে কিছু ভাবলো। তারপরেই বলে উঠলো,

-“মেজো বাবু, তুমি হয়তো জানো না আমি তার সাথে সেভাবেই কথা বলি যে যেটাতে অভ্যস্ত।”

বাঁকা হাসলো শিতাব। নিজেও খানিক ঠোঁট চোখা করে ভেবে বললো,

-“রিয়েলি? আই সি! বিউটিফুল হেবিট!”

বাঁকা চোখে তাকালো সিলভিয়া। ছেলের মতিগতি ঠিক নেই। শিতাবের সাথে কথা বাড়ালো না সিলভিয়া। বেনিফিট খাজা কে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“ওহ হ্যা আরেকটা কথা মিসেস খাজা, এই একবছরে লস্কর বাড়ির মেয়ের শাশুড়ি একটুর জন্য‌‌ও লস্কর বাড়িতে পা রাখতে পারবে না। আমাদের উচিত পুরোনো ঐতিহ্য কে জিইয়ে রাখা। আপনার মতো মা আছে বলেই এরকম পুরোনো ঐতিহ্য গুলো এখনো বাংলার বুকে রয়ে গেছে। আপনাকে স্যালুট মিসেস গাঁজা আই মিন খাজা!”

নিজের খানিক প্রশংসা শুনে আটখানা বেনিফিট খাজা। এই মুহূর্তে সিলভিয়ার মতো ভালো যেন কেউ নেই। ঠিক তখনি তার ভালোলাগা কে বাংলাদেশ থেকে বাহির করতে সাম্মাক ফিসফিস করে বললো,

-“মম, গলে যেও না। তোমাকে পাম দিচ্ছে। তুমি ভাবো এই মেয়ে তোমাকে মাত দিয়েছে মম। তোমাকে হারিয়ে দিয়েছে। তোমার করা ঐতিহ্যের নাটক কে হারিয়ে দিয়ে ওই মেয়ে পাশ করে গেছে। রাগো মম, এই মেয়েকে আমাদের শিক্ষা দিতে হবে।”

পুরোনো ক্ষোভ আবার ফিরে এলো। বেনিফিট খাজা গর্জে কিছু বলবেন, শিতাব এসেই সামনে দাঁড়ালো। তার কথাকে বন্ধ করে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

-“মম, তুমি আবার এই বলদের কথা শুনছো? তোমাকে সবার সামনে কতটা সম্মান দিল ওই মেয়ে। এখন যদি তুমি প্রতিবাদ করো সবাই বুঝে যাবে তুমি নাটক করেছো। তখন তোমার সম্মান কোথায় যাবে মম? কিছু কিছু সময় চুপ থেকেও হিরো না হিরোইন হ‌ওয়া যায়। এই যেমন ধরো তুমি এখন ওই মেয়ের কথায় সাথ দিলে সবাই তোমাকে সম্মান করবে। আর তুমি ওই মেয়েকে ডিঙিয়ে হিরোইন হয়ে যাবে। যদিও আমার মম হিরোইন থেকে কম নয়, বিশ্বসুন্দরী আমার মমের কাছে কিছুই না।”

এবার বেনিফিট খাজা পুরোপুরি গলে গেলেন। হাতের এন্ড্রোয়েড ফোন মুখের সামনে ধরে নিজেকে দেখে নিলেন। কখনো ঠোঁট বাঁকা করে, কখনো চোখ উপর করে, কখনো হেসে, কখনো লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে। মায়ের আচরণে ভীষণ হাসি পেলেও হাসছে না শিতাব। এখন হাসলেই তার বলদ বোন মম কে উল্টাপাল্টা বুঝানোর সুযোগ পেয়ে যাবে‌। কোনো রকম নিজের হাসিকে নিয়ন্ত্রণে এনে দাঁড়িয়ে র‌ইলো। বেনিফিট খাজা হাসি মুখে মেনে গেলেন সিলভিয়ার কথা। শাম‌উল এতটাই খুশি হয়েছে লাফিয়ে সোফার উপর পা তুলে বসে পড়লো। পরক্ষণেই নিজের কাজে নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মা একবার বুঝে গেলে তার ইহজন্মের মতো বাসর করার স্বাদ মিটিয়ে দিবে। সিলভিয়া ছোট বোন জামাইয়ের খুশি দেখে এগিয়ে এলো। বোনের পাশে বসে বেনিফিট খাজা কে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,

-“তা বড় বাবু বিয়ের প্রথম রাত আই মিন বাসর সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে? নাকি মায়ের কাছ থেকে শুনবে, পারমিশন নিবে? আমাকে বলো আমি তোমাকে ডিটেলস বলে দিচ্ছি। বাবুদের তো শিখিয়ে পড়িয়েই নিতে হয়।”

শাম‌উল অসহায় চোখে একবার মায়ের দিকে তাকালো, আরেকবার ব‌উ তো আরেকবার সিলভিয়ার দিকে‌। অযহত তাকে এত গুলো কথা, অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। স্বামীর দুঃখ হয়তো ডেজি বুঝতে পারলো। বোন কে খোঁচা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

-“আপু কি সব বলছো‌ এত গুলো মানুষের সামনে?”

-“ভুল কিছু বলেছি? বাবুরা নিশ্চয়ই এসব জানে না। তো আমাদের দায়িত্ব শিখিয়ে দেওয়া। তো প্রথমে কি করবা বড় বাবু, প্রথমে ঘরে ঢুকে ব‌উয়ের ঘোমটা খুলবা, ব‌উ যখন লজ্জা লজ্জা ভাব ধরবে তখন তুমি লজ্জা টা বাড়িয়ে দিয়ে চুমু খাবে। তারপর কি করবে শুনো….”

এতটুকু বলতেই একে একে গেস্ট গুলো চলে যেত লাগলো। সিলভিয়া মুচকি হাসলো। শুরু থেকে মজা দেখে যাচ্ছে এরা, বিয়ে সেই কখন শেষ, বিদায় ও হয়ে গেছে ধরতে গেলে, এখনো নাটক দেখতে রয়ে গেছে‌। মুখ ফুটে সরাসরি বলতে গেলেও মুখ বেঁকাবে, এরা ইঙ্গিত ও বুঝবে না। যতদূর দেখা যায় দেখবে, আর সকাল থেকেই এ ওকে বলে মজা লুটাবে। বর্তমানে বরপক্ষের কণেপক্ষের কাছের লোক ব্যতিত কেউ নেই। সিলভিয়া কে যেন সহ্য হচ্ছে সাম্মাকের। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে গিয়ে এই মেয়ের মুখটা তুড়ি মেরে বন্ধ করে দিতে পারলে। শান্তি পেত সে, তবে তার তো আধ্যাত্মিক কোনো শক্তি নেই! মনের ভাবনা টা মনেই রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাম্মাক হক কখনোই হেরে যাওয়ার পাত্রি নয়। তার জীবনে শুধু জেতার মুকুট। নিজের বন্ধুদের ভিডিও কল দিল সাম্মাক। কিটকিটিয়ে হেসে এগিয়ে গিয়ে শাম‌উল কে উঠিয়ে নিজে বসলো। ডেজির সামনে ধরে বললো,

-“এই দেখ আমার বড় ভাবী, সুন্দর না? কিন্তু সুন্দর হলেও গাঁয়ের রংটা চাপা, আমার মতো ফর্সা নয়। ব্যাপার না ভাইয়ার সাথে মানাবে।”

হাসতে হাসতে খানিক অপমান করে যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে সাম্মাক। ডেজির কিছুটা মন খারাপ হলেও বড় বোনের ভয়ে হাসি মুখ করেই র‌ইলো। পছন্দ হলো না সিলভিয়ার। সে দাঁত বের করে হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো সাম্মাকের গালে। ফর্সা হাতে খানিক মেকাপের প্রলেপ পড়তেই আরো হেসে বললো,

-“এই দেখ তুমি মেকাপ দিয়েছো। তোমাদের দুজন কে যে কেউ দেখেই বলবে তুমি বেশী মেকাপ করে ভূত হয়েছে, আমার বোন কম মেকাপ করে কম সুন্দরী হয়েছে। ব্যাপার না চাম্মাক আই মিন সাম্মাক মনের ভালোলাগা, গর্ব টাই হচ্ছে বড়। চালিয়ে যাও!”

যোগ্য জবাব দিয়ে সিলভিয়া উঠে দাঁড়ায়। সাম্মাকের মুখটা দেখার মতোই ছিল। তার মন টা আরেকটু জ্বালিয়ে দিতে শিতাব হো হো করে হেসে উঠলো। চরম অপমানিত হয়ে ন্যাকা কান্না করতে করতে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সাম্মাক। বেনিফিট খাজা শিতাবের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই আপনাআপনি হাসি বন্ধ হয়ে গেল তার‌‌। সিলভিয়া আর সেসবে থাকলো না। ইন করা শার্টের ইন খুলতে খুলতে ভেতরের দিকে যেতে লাগলো। বেশী দূর যাওয়া হয়ে উঠলো না তার। পূর্বেই শিতাব সবার অগোচরে এগিয়ে এসে নাটকীয় কন্ঠে বলে উঠলো,

-“আসসালামু আলাইকুম বেয়ানসাব।‌”

সিলভিয়া তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়েই র‌ইলো। তারপর নাটকীয় অথচ গম্ভীর কন্ঠে বললো,

-“পকেটে সরকারি রিভলবার!”

চলবে…?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে