প্রেমাচ্ছন্ন প্রহর পর্ব-০৯

0
369

#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি

৯.
নাকে চোখে জল খাইয়ে সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলো। এতদিন বাদে নিয়মের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে মুক্ত শ্বাস ফেললাম। অক্টোবরের শেষ প্রায়। হালকা শীত শীত ভাব। পরীক্ষা শেষে দুদিন রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমিয়েছি। মাথার উপর ফ্যান আর গায়ে চাদর জড়িয়ে ঘুমাতে যেয়ে খাওয়ার কথা ভুলে বসেছিলাম। সাহিল ডেলিভারি ম্যানের সাহায্যে খাবার পাঠিয়ে দিত। আহ! কি শান্তি।
আমার ব্যস্ততা শেষ হলেও ব্যস্ততা শেষ হলোনা সাহিলের। দিন হোক বা রাত তাকে কল করলেই অত্যন্ত ব্যস্ত গলায় তিনি শুধান,

‘একটু ব্যস্ত আছি শুভ্রলতা! ফ্রি হয়ে কল করবো কেমন?’

কিন্তু মহাশয় আর ফ্রি হলোনা। এদিকে আমার মেজাজের অবস্থা তখন খাপছাড়া। সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে রাত কাটে সিনেমা কিংবা ড্রামা দেখে। একসময় এতেও অতিষ্ঠ আমি রাত তিনটায় কল করে বসলাম সাহিলকে। মহাশয় তখন কাজ শেষ করে কেবল ঘুমিয়েছে বোধহয়। কল রিসিভ করেই তিনি ঘুমঘুম কন্ঠে বললেন,

‘শুভ্রলতা! ঘুমাওনি?’

আমার মেজাজ আরো এক কাঠি উপরে উঠে গেল। নিজেকে শান্ত রেখে বললাম,

‘গাড়ি নিয়ে আমার হলের সামনে চলে আসুন। এই মুহূর্তে।’

সাহিল ঘড়ির কাঁটায় চোখ বুলিয়ে জবাব দিলেন,

‘রাত কত হয়েছে দেখেছ? ভোরের আলো ফুটলে আসি?’

আমি মানলাম না। জেদ ধরে রেখে বললাম,

‘না। এখন এই মুহূর্তে আপনার আসা চাই।’

আমার জেদের কাছে হার মেনে সাহিল সেই রাতেই চলে এলেন। হলের সামনে এসে কল করলেন। আমি চোরের মতো করেই হল থেকে বের হলাম। সাহিল বাসায় পরার ট্রাউজার আর ফুল হাতার গেঞ্জি পড়েই চলে এসেছেন। লোকটা তখনো ঘুমে ঢলছে। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে মিষ্টি করে হাসলো। শুধালো,

‘মিস করছিলে বুঝি!’

আমি জবাবে অভিমান নিয়ে বললাম,

‘তা জেনে আপনার কি? আপনার তো আর আমাকে দেখার সখ হয় না।’

উত্তরে সাহিল দুষ্ট হেসে বলেন,

‘এজন্য বলছি চলো বিয়ে করে ফেলি। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তুমিই তো রাজি হচ্ছো না।’

সাহিল নিরব জায়গা দেখে গাড়ি পার্ক করলো। সোডিয়ামের আলোতে দুটো কুকুরকে রাস্তার ধারে শুয়ে থাকতে দেখা গেলো। সাহিল ক্লান্ত চোখে চেয়ে বললেন,

‘তুমি আমায় দেখতে থাকো শুভ্র আমি ততক্ষণে একটু ঘুমিয়ে নেই।’

গড়ির ভেতরের সিটে আমার কোলে মাথা রেখে সটান শুয়ে পড়লেন সাহিল। জানালা গলিয়ে আসা স্বল্প আলোতে আমি তার দিকে চাইলাম। লোকটার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। রাত জেগে খাতা দেখতে হচ্ছে। সময় ও খুব বেশি নেই। তার আগেই খাতা দেখা শেষ করতে হবে। আমার মায়া হলো। হাত গিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিলাম তার ঘনচুল। সাহিল চোখ বন্ধ রেখে মুচকি হাসলো। ঘুম জড়ানো গলায় বললো,

‘তুমি আমার সাথে ভারী অন্যায় করছ শুভ্রলতা। কতগুলো রাত নির্ঘুম কেটেছে আমার। তুমি আমার বউ হয়ে থাকলে এভাবে তোমার কোলে মাথা রেখে আমি দিব্যি ঘুমোতে পারতাম। তুমি খুব পাষান শুভ্রলতা!’

আমি সাহিলের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। কিছু একটা ভেবে বললাম,

‘তবে চলুন বিয়েটা করেই ফেলি।’

সাহিল চট করে উঠে বসলেন। আমার দিকে প্রগাঢ় চেয়ে থমথমে গলায় বললেন,

‘বিয়ের ব্যাপারে আমি সিরিয়াস তনয়া। ডোন্ট মেক ফান!’

আমি সাহিলের চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে বললাম,

‘আমি ও তো সিরিয়াস ভাবেই আপনায় শান্তির ঘুম উপহার দিতে চাইছি শিক্ষক মহাশয়!’

____________

শান্তির ঘুমের সমাপ্তি ঘটেছে। আজ রেজাল্ট বেরহবে। সবাই যেখানে রেজাল্ট কি হবে সেই চিন্তায় মত্ত আমি সেখানে বসে ভাবছি বাবাকে ঠিক কি বলে বুঝ দিব। আমার এমন কান্ডে অন্তি ভিষণ বিরক্ত। নখ কামড়ানো বাদ দিয়ে আমার দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে বললো,

‘কোথায় দোয়া দুরুদ পড়বি তা না করে কিসব ভাবছিস? পরীক্ষা আমরা দিছি তাতে কি? পাশ ফেইল আল্লাহর হাতে। দেখা যাবে স্যার লিখছে শূন্যর পিঠে আট হয়ে গেল আট এর পিঠে শূন্য। এসব কিছু সম্ভব তার জন্য ইবাদত করতে হবে। পড় পড় দোয়া পড়।’

অন্তি আবারো মাথায় কাপড় টেনে দোয়া পড়তে বসে গেল। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে ভাবনায় মত্ত হলাম। যে মেয়ে শুক্রবার ছাড়া নামাজ পড়ে না আজ সেই মেয়ের মুখে ধর্মের বাণী। ইম্প্রেসিভ!
মিডে ফেইল করা সাবজেক্ট দুটোতে পাশমার্ক তোলার সাধ্য আমার হয়নি। হবে কিভাবে? আমি তো ফাঁকা খাতা জমা দিয়ে এসেছি। রেজাল্ট টিচারদের দিতে হবে না। আমার রেজাল্ট আমি ঢের জানি!

বাবাকে বলার জন্য কথা সাজিয়ে এনেছি প্রায় এমন সময় আমার অ্যাটেনশন ব্রেক করে সাহিল কল করলো। আমি সেদিকে ভ্রুকুচু করে তাকালাম। এই সময়ে এই লোকের কি চাই? তার না ভার্সিটিতে কাজ আছে! আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে কল রিসিভ করে কানে ধরলাম।

‘এটা কেমন কথা তনয়া? এটা তোমার থেকে আশা করা যায় না!’

সাহিলের কথায় আমি ভাবনায় হারালাম। কোন ব্যাপারে কথা বলছে সে? আমার কোনো ছেলে বন্ধু নেই যে ব্যাপারে সে এভাবে বলবে। আমি সোজা তাকে বললাম,

‘এভাবে না বলে সরাসরি পয়েন্টে আসুন। কি হয়েছে আর কোনটা আশা করেননি?’

আমার কথায় বড় করে শ্বাস ফেললেন সাহিল। বুঝলাম তিনি আমার কথায় প্রচন্ড রকম হতাশ। আমি নিজেও হতাশ। এত চেষ্টা করেও তার মতো সুন্দর মার্জিত কথা আয়ত্ত করতে পারলাম না। কি করার? চেষ্টা তো করেছি! সাহিল গম্ভীর গলায় বললেন,

‘তুমি দুটো বিষয়ে ফেইল করে বসে আছো। বাকি সাবজেক্ট গুলোতে পাশ করেছ বলে মনে হচ্ছে না। টিচাররা জোর করে পাশ করিয়ে দিয়েছেন। এত অবনতি কেন? কারণটা কি আমি তনয়া? আমার জন্যই কি লেখাপড়ার এমন বেহাল দশা?’

আমার বুক কেঁপে উঠলো। সাহিল ব্যাপারটা এভাবে ঘুরিয়ে তার দিকে টেনে নিবে বুঝতে পারিনি। লোকটার কন্ঠ নরম হয়ে এসেছে। আমি অশান্ত হলাম। কপালে‌পড়ে থাকা চুল কানের পাশে গুঁজে নিয়ে বললাম,

‘আপনি বিষয়টা জটিল ভাবে দেখছেন সাহিল। এমন কিছুই না।’

‘তাহলে কেমন কিছু তনয়া? সব শিক্ষকেরা আমায় কটাক্ষ করে কথা বলছেন। তাদের মতে আমার প্রেমে পরেই এই দশা তোমার।’

আমি নড়েচড়ে বসলাম। আলগোছে জিজ্ঞাসা করলাম,

‘শিক্ষকরা আমাদের ব্যাপারে জানে?’

সাহিল তপ্ত শ্বাস ফেলল। সময় নিয়ে বললো,

‘ভেবেছিলাম রেজাল্টের ঝামেলা শেষ হলে ছোট খাট অনুষ্ঠান করে তোমায় ঘরে তুলব। বিয়ের ব্যাপারটাতো আর কলিগদের থেকে আড়াল করা যায় না! এ জন্যই তাদের জানানো। সেই সুবাদে তোমার রেজাল্ট আমার কাছে পৌঁছেছে।’

অপমানে আমার মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। তার থেকেও খারাপ লাগাটা বেশি কাজ করছে। লোকটা নিশ্চই আমার জন্য টিচারদের সামনে লজ্জায় পরে গিয়েছিল। ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। এই প্রথম পড়াশোনা নিয়ে আফসোস হলো আমার। রাগে দুঃখে ফোন কেটে দিলাম। আমার সাথেই কেন এমন হয়? আমার সব রাগ আক্ষেপ গিয়ে পড়লো ডিপার্টমেন্ট হেডের উপর। তিনিই নিশ্চই ধেই ধেই করে সাহিলকে রেজাল্ট দিয়ে এসেছে। অসহ্য লোক। রাগ দুঃখ প্রকাশ করতে হল ছেড়ে গিয়ে উঠলাম অন্তির বাসায়। এই হলো আর এক বেদ্দপ মহিলা। আমাকে দেখতেই চিল্লায়ে আন্টি আংকেলের সামনের বলতে শুরু করল,

‘আমি তোকে বলেছিলাম তনয়া দোয়া পর ধর্মের পথে আয়। শুনলিনা আমার কথা। দেখ আমাকে পাশ করতে হয়নি পাশ আমাকে খুজে নিছে। সিজি ১.৬৭!’

আমি আড় চোখে আন্টির দিকে তাকালাম। আন্টি বড় বড় চোখ করে বললেন,

‘সেকি তনয়া তুমি পাশ করোনি? আমার অন্তির মতো গাধা মেয়েকিনা ১.৬৭ সিজি পেয়ে পাশ করেছে আর তুমি!’

আমি আগুন চোখে অন্তির দিকে তাকালাম। আমার সম্মানের ম টাও রইল না। কোথায় এলাম মাথা মন শান্ত করতে আর হয়ে গেল কি? এ মুহূর্তে আমার কেবল অন্তি নামক বেদ্দপ মহিলাটাকে আচ্ছামত থাপরাইতে মন চাচ্ছে।

চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে