প্রীতিকাহন পর্ব-১৪+১৫

0
583

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৪

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

রাতের খাওয়া-দাওয়া চুকে গেছে নবাব আর মিষ্টির। নৈশভোজে অতি সাধারণ খাবারের সমারোহ ছিল; ভাত, মুরগির মাংস, সবজি আর ডাল। কিন্তু তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে নবাব বলেছিল, “শেষ পাতে মিষ্টিমুখ করলে ভালো হতো।” তখন লবণের ছোট্ট কৌটা এগিয়ে মিষ্টি বলেছিল, “নোনতা দিয়ে কাজ চালাও।”

হা-হুতাশ করে নবাব বলে উঠেছিল, “হায়! জীবন বোধহয় ঝাল নোনতার স্বাদেই পার হবে।” মিষ্টি কেবল আঁড়চোখে তাকিয়ে ছিল আর নবাব সেটা উপেক্ষা করে মৃদু হেসে এক চিমটি নুন জিহ্বায় রেখেছিল।

“দাঁড়িয়ে আছো কেন?” ফোন স্ক্রোল করার এক ফাঁকে মিষ্টিকে দেখে প্রশ্ন করলো নবাব।

কাঠ গলায় মিষ্টি জবাব দিলো, “কারণটা কি খাতা কলমে বুঝাতে হবে?”

বিছানার ওপর পা ভাঁজ করে বসে আছে নবাব আর তার উপর মিষ্টির স্থির দৃষ্টি। কিন্তু এতে ভ্রুক্ষেপহীন জবাব দিলো নবাব, “ওহ…।” এরপর কিছু মূহুর্ত নিরবে পার হলো। মিষ্টি বিছানার পাশে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।

“তুমি বিছানায় ঘুমাও আমি চেয়ারে ঘুমাচ্ছি।” মিষ্টি কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর ভাবনার মাঝে নবাব বলে উঠলো। নবাবের কথা শুনে মিষ্টির কিছুটা স্বস্তি হলো মূলত এমন একটা বাক্য শোনবার জন্যই মিষ্টি আকুল হয়ে আছে। মিষ্টির চেহারায় স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে কৃতজ্ঞতা আর সেটা টের পেয়ে নবাব আবার বললো, “এই চলচ্চিত্রের সংলাপ আশা করছিলে আমার কাছ থেকে?”

“মানে?” বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে এলো মিষ্টির।

“তোমাকে তো আগেই বলেছি বিয়েটা নাটকীয়ভাবে হলেও বিয়ের পরবর্তী জীবনকে নাটকের রূপ দিবো না। তাই বিছানা ব্যতীত অন্য কোথাও আমি ঘুমাচ্ছি না। দরকার পড়লে তুমি চেয়ারে শুতে পারো কিংবা মেঝেতে, আই ডোন্ট মাইন্ড।”

অতিরিক্ত বিস্ময়ে মিষ্টি মুখ থেকে ইংরেজি শব্দ নিসৃত হলো, “হোয়াট?”

“হুম।” বলে নবাব মাথা নাড়ালো সামনে পিছনে।

“তোমার কি মাথা ঠিক আছে নবাব?”

“আপাতত তো ঠিকই আছে, কিন্তু খারাপ করে না দিলে হয়ত ভালো হবে।… চুপচাপ বালিশ নিয়ে বিছানার এককোণে শুয়ে পড়ো। রাত-বিরেতে তর্ক করার মতো শক্তি আমার নেই।”

“অসহ্য, কে বলে তোমায় ঝগড়া করতে? ঘুমাবো না আমি। সারারাত জেগে থেকে বাঁদর নাচ দেখবো।” মিষ্টির মাঝে রাগ ভাসলেও নবাব এতে কোনও তাল দিচ্ছে না। নির্লিপ্ত গলায় সে বললো, “তোমার ইচ্ছে।”

আরাম করে বালিশে হেলান দিয়ে ফোনে মগ্ন হলো নবাব। সেই দৃশ্য অবলোকন করে মিষ্টি দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো। নবাবের প্রতি আসা রাগের প্রকাশ করলো মিষ্টি মেঝেতে জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটতে গিয়ে। নুপুরে শব্দ তুলে মিষ্টি বেলকনিতে এসে ধপাস করে বসে পড়লো। এদিকে মিষ্টির এহেন কাণ্ডে নবাব শব্দহীন দুষ্ট হাসিতে মত্ত হয়ে আওড়াল, “পাগল একটা।”

গোমড়া মুখে বেলকনিতে বসে বারংবার মিষ্টি বিড়বিড় করে উঠছে, “এই উনার আমার প্রতি যত্ন করবার নমুনা? আমাকে এমন ঝড়-বৃষ্টির রাতে বেলকনিতে আসতে দেখেও কিচ্ছু বললো না। নিজে দিব্যি কাঁথা বালিশ নিয়ে বসে আছে যেন ডিমে তা দিচ্ছে। আর একটু বাদে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। হুহ।” মিষ্টির ভাবনার মাঝে আচমকা মেঘ গর্জে উঠলো মৃদু শব্দে। বিদ্যুৎ চমকানি স্পষ্ট দেখতে পেয়ে ভেতরে ভয় চেপে বসলো মিষ্টির।

ভয় জড়ানো চোখে বাইরে তাকিয়ে রাতের রিমঝিম বৃষ্টি দেখতে পেল সে। আর হঠাৎ তার মনে পড়লো একটা গান,

“এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না
বৃষ্টির ছন্দে বকুলের গন্ধে
আমায় তুমি ফেলে যেও না
এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না
এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি চলে যেও না।” এই গানটা মিষ্টির ছোট চাচার মেয়ে, লামিয়া প্রায়শই গেয়ে বেড়াতো। কোনো এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে মিষ্টির রুমে একা বসে লামিয়া গুনগুন করছিল বিধায় মিষ্টি জিজ্ঞেস করেছিল, “লামিয়া, কী হয়েছে তোর? ভয়ে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে অথচ গান গেয়ে চলেছিস রোমান্টিক ভাব নিয়ে।”

মিষ্টির চেয়ে ছয় বছরের ছোট লামিয়া তার পাতলা গড়নের ফর্সা মুখে ভাসমান ভয়ের কালো মেঘ সরিয়ে জবাব দিয়েছিল, “আপু, তুমি তো আমাকে একা ফেলে পানি আনতে গেলে। এদিকে ঘরে মোমবাতির টিমটিম আলো আর বাইরে মেঘ ডাকছে ভয়ংকর গলায়। তো এখন বাচ্চাদের মতো ভয়ে চিল্লাচিল্লি করলে এটা কেমন দেখায় না? তাই গান গেয়ে মেঘকে বুঝাচ্ছি আমি একটুও ভয় পাচ্ছি না।”

“এক মিনিট, পুঁচকে ছেমড়ি। তুই ক্লাস ফাইভে পড়ে বড় হয়ে গিয়েছিস? বাচ্চাদের মতো মানে কী? তুই তো বাচ্চাই আছিস।”

“উফ আপু, তুমি আমাকে বাচ্চা বলো না তো।” বিরক্ত হয়েছিল লামিয়া।

“এই ছেমড়ি, তাহলে কী বলবো তোকে?” মিষ্টি প্রায়শই লামিয়াকে ছেমড়ি সম্বোধন করে আর এতে লামিয়া কখনও আপত্তি করে না।

“লামিয়া বলবে নয়ত ছেমড়ি, বুঝলে? আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে না আমি তোমার ছয় বছরের ছোট পারলে ছয় বছরের বড় বলবে।” লামিয়া সর্বদা নিজেকে বড় সাজাতে ব্যস্ত এমনকি বয়স্ক মানুষদের সাথে সখ্যতা গড়তে সে খুব পছন্দ করে। মানুষ জাতি বড়ই অদ্ভুত। যখন ছোট থাকে, তখন বড় হতে চায়। আর যখন বড় হয়, তখন কঠিন বাস্তবতায় ছুরিকাহত হলে ছোট হওয়ার বাসনা মনে পুষে।

“কিহ!” খুব অবাক হয়েছিল মিষ্টি।

“হুম।… আচ্ছা আপু, জাহিদকে তোমার কেমন লাগে?” লামিয়ার প্রশ্ন শুনে মিষ্টি যখন চমকে গিয়েছিল, তখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠেছিল। এতদিন পর আজকেও এই ভাবনার মাঝে সিলেটের আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো খুব জোরালোভাবে। এতে মাত্রাতিরিক্ত ভয়ে কেঁপে উঠলো মিষ্টি। ওর এই মূহুর্তে অহেতুক ভয়ে মনে হচ্ছে বেলকনির ঐ জানালা ভেঙে বজ্রপাত পড়বে তার উপর। সাত-পাঁচ না ভেবে একপ্রকার দৌড়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল নবাব ঠোঁট টিপে হাসছে। নবাব এখনও ফোন নিয়ে পড়ে আছে কিন্তু মুখের হাসি স্পষ্ট বলছে, সে মিষ্টির উপর হাসছে।

“হাসছো কেন এভাবে?” কপট রাগ নিয়ে মিষ্টি জানতে চাইলো।

“হাসার জন্যই কি কারণ লাগে না-কি?”

“দেখো, আমার মোটেও এখন ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই।”

ফোন রেখে বালিশে মাথা রাখলো নবাব। বাম দিকে ঘাড় কাত করে শান্ত গলায় বললো, “বিছানা বেশ বড়। বাম পাশে শুয়ে পড়ো। ঘুমের মাঝে নড়াচড়া করার অভ্যাস আমার নেই সেটা তো জানোই।”

মিষ্টি ভেবেছিল নবাব তর্ক করবে কিন্তু এমন সব কথা শুনে সে অবাক হলো পাশাপাশি অপ্রস্তুত হওয়ার কারণে তার চোখ চঞ্চল হলো। মিষ্টি চুপ করে থাকলেও নবাব অনর্গল বলে গেল, “সারারাত জেগে থেকে বেলকনি পাহারা দেওয়ার মতো শক্তি আমার নেই। তার চেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো দুইজনের জন্যই উত্তম হবে।” এই বলে নবাব মিষ্টির দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলো।

“আমি বেলকনিতে ছিলাম বলে তুমি এতক্ষণ ফোন নিয়ে বসে ছিলে?” আনমনে নবাবকে প্রশ্ন করলো মিষ্টি। কিন্তু প্রশ্ন নবাবের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো তাই প্রশ্ন উত্তর বিহীন রয়ে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে এটা-সেটা চিন্তা করলো মিষ্টি। শেষে অন্য উপায় না পেয়ে হালকা আলোর একটা বাতি জ্বালিয়ে নবাবের বিপরীতে এসে গা এলিয়ে দিলো। গায়ে কাঁথা টেনে দিলেও নিজের মাঝে জড়তা-সংকোচ অনুভব করছে মিষ্টি। কত-শত চিন্তা আর সংকোচ নিয়ে ক্লান্ত চোখের পাতা সে বুজে দিলো দু’টো জলের মুক্তা বিসর্জন দিয়ে।

.

সদ্য হোটেলের বাইরে পা রাখলো মিষ্টি আর নবাব। হুট করে কোথা থেকে একটা কালো রঙের জিপ এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। শক্ত-পোক্ত দেহের অধিকারী কয়েকজন লোক এসে ঘিরে ফেললো তাদের। ঝাঁকড়া চুল আর দামী পোশাকে আবৃত একটা দেহ এসে দাঁড়ালো মিষ্টির সামনে। এতেই ভয়ে চুপসে গিয়ে সে কাঁপতে শুরু করলো। লোকটা পিস্তল বের করে নবাবের মাথায় রেখে দাঁতে দাঁত চাপলো, “পালায়ে কই যাইবা জাদু? ভাবছো সিলেটে আইলে তোমাদের হদিস পামু না?”

মিষ্টি ভয়ে কাঁপছে তবুও নবাবের মাথায় পিস্তল রাখতে দেখে সে রাগী কন্ঠে বললো, “ওকে ছেড়ে দিন।”

“ছাইড়া দিমু? ক্যান? আমার হবু বউরে নিয়া সারা বাংলাদেশে টই-টই কইরা ঘুরবে আর আমি হজম করমু?” এবার নবাবের উদ্দেশ্যে বললো, “এই শালা, তোর এতো সাহস ক্যান? আমার হবু বউয়ের দিকে যে নজর দিছোস, দিলে কি তোর ভয়ডর নাই?”

তাচ্ছিল্যের সুরে নবাব বললো, “ভয় পেলে কি আর তোর হবু বউকে নিজের বউ করতাম?” নবাবের এমন প্রশ্নের লোকটা শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগলো আর নিস্তব্ধ হোটেল হঠাৎ গুলির শব্দে আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

…চলবে

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৫

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

চোখের সামনে নবাবকে লুটিয়ে পড়তে দেখলো মিষ্টি আর মূহুর্তেই ওর গলা ফাটানো চিৎকারে হোটেলের বাতাস ভারী হলো, “নবাআআআআআব।”

তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে হাঁপাতে লাগলো মিষ্টি। তার মনে হচ্ছিল ঘুমের মাঝে কেউ হাত দিয়ে গলা চেপে ধরেছে। কুলকুল করে ঘামছে বিধায় গা থেকে কাঁথা সরিয়ে দিলো। কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ঘুমন্ত নবাবকে। কত নির্বিঘ্ন সে ঘুমিয়ে আছে সাদা বালিশের ওপর। একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো মিষ্টির হৃদয় থেকে ঘুমন্ত নবাবকে দেখে।

রাত গভীর। চারপাশ নিস্তব্ধ হলেও রাতের নিজস্ব আওয়াজ অনুভব করলো মিষ্টি। বাইরে এখন বৃষ্টি নেই তবে বৃষ্টির রেশ এখনও বিদ্যমান। মাথার ওপরে থাকা পাখার মৃদু বাতাস আর হিম প্রকৃতির ফলে মিষ্টি ঘাম ঝরায় ইতি পড়লো। কিন্তু হঠাৎ করে তার ঘুমটা উবে গেল। তাই বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসবার জন্য মনস্থির করলো।

ঘুমানোর আগে দেখেছিল নবাব ডানদিকে মুখ করে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। এখনও তার ব্যতিক্রম নয়। এমন একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর হঠাৎ-ই নবাবের প্রতি মিষ্টি একটা গভীর টান অনুভব করছে। সেই টান তাকে বারংবার বলছে, “একবার ছুঁয়ে দেখ না সে বেঁচে আছে। তোরই জন্য বেঁচে আছে।”

কখনও কখনও মানুষের নিজ মনের ওপরও অধিকার থাকে না। মন তার নিজের গতিতে চলে। তাই তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিষ্টির ডান হাত ধীরে ধীরে নবাবের মাথা স্পর্শ করলো। বাস্তব স্পর্শে মিষ্টির মন এবার বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো, “হ্যাঁ, নবাব বেঁচে আছে।”

মিষ্টি অনবরত মাথায় হাত বুলাচ্ছে বলে নবাব ঘুমের ঘোরে বাম দিকে মুখ ফেরালো আর ঘুম জড়ানো কন্ঠে আওড়ালো, “বিশ্বাস করো আমায়।”

হেসে উঠলো মিষ্টির হৃদয় আর সেটার বহিঃপ্রকাশ প্রকাশ ঘটলো ঠোঁট প্রসারিত হয়ে। পুনরায় নবাবের মাথায় হাত চালাতে শুরু করে চোখ বুজে দিলো মিষ্টি। হেলান দেওয়া অবস্থায় তার হাত চলছে নবাবের চুলের রাজ্যে আর মন বলছে, “হুম, বিশ্বাস করি তোমায়।”

.

আজকের আকাশ একদম ফকফকা পরিষ্কার। মেঘের বিপরীতে আকাশে ঝলমল করছে সূর্য আর এর মিষ্টি আঁচে মন হচ্ছে শিহরিত। ঘোরাঘুরি করবার জন্য আজকের দিনকে যুতসই মনে হলো নবাবের। তাই সকালের নাস্তা সেরে মিষ্টিকে বলেছিল, “খাওয়াদাওয়া তো শেষ। এবার বিছানাকান্দি যাওয়া যাক?”

মলিন মুখে মিষ্টি ছোট্ট জবাব দিয়েছিল, “ইচ্ছে নেই।”

“কেন?”

“কারণ নেই কোনও।”

“তাহলে তো না যাওয়ারও কারণ দেখছি না।… বেশি কিছু বলতে চাই না। তৈরি হয়ে নাও আধঘন্টা পর বের হবো।” মিষ্টির একটুও ইচ্ছে নেই হোটেলের বাইরে বের হওয়ার কিন্তু গম্ভীরমুখে বলা নবাবের কথাগুলো সে উপেক্ষা করতে পারেনি।

সকাল এগারোটা নাগাদ আম্বরখানা সিএনজি স্টেশন থেকে একটা সিএনজি ভাড়া করলো নবাব। আম্বরখানা থেকে হাদারপার নামক জায়গায় যেতে হবে। সিএনজি পাওয়া যাবে কি যাবে না এই ভেবে নবাব সারাদিনের চুক্তিতে সিএনজি ভাড়া করেছে।

সিএনজি চলতে শুরু করতেই নবাব ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মূলত ফোনে বিশেষ কিছু কাজ করতেই মত্ত সে। চটজলদি কাজগুলো সেরে ফোন পকেটে পুড়লো। ক্যাপ খুলে যখন চুলে হাত চালালো, তখনই তার সকালবেলার বিষয়টা মনে পড়লো।

সকালে নবাবের যখন ঘুম ভাঙে, তখন সে মাথায় কিছু একটা অনুভব করে। হাত দিয়ে চোখের সামনে এনে দেখলো তার মাথায় মিষ্টির হাত পড়েছিল। মেহেদী রাঙা হাতটা ঘুম জড়ানো চোখে দেখে বিছানার ওপর রেখে দিয়েছিল। কিন্তু উঠে বসতে গিয়ে দেখলো মিষ্টি বিছানায় হেলান বসে আছে ঘুম আঁকড়ে। প্রথমে নবাবের মনে হয়েছিল মিষ্টির হাত ঘুমের ঘোরে তার মাথার ওপর পড়েছিল কিন্তু পরে মনে হলো সে নিজ ইচ্ছায় মাথায় হাত রেখেছে। এমনটা ভাবতে গিয়ে নবাব অনুভব করলো মিষ্টি নামক সুখ ব্যথা।

বাতাসের তোরজোরে মিষ্টির বোরকা বেসামাল হচ্ছে বারংবার। বোরকা সামলাতে তার হাত দু’খানা এখন বড্ড ব্যস্ত। তবে কালো হিজাবের মাঝে ক্লান্ত চোখে চিন্তার রাজ্য। সিলেটের নৈসর্গিক সৌন্দর্যও ভ্রুর তলায় থাকা মিষ্টির চোখে শান্তি এনে দিতে পারছে না আর এতেই ব্যাকুল হচ্ছে নবাবের চিত্ত, “মিষ্টি?” নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে অজানা কারণে নবাবের গলা কেঁপে উঠলো।

নিশ্চুপ একজোড়া চোখ স্থির হলো নবাবের চোখের উপর। অতি সাধারণ এই চোখ জোড়ার এককোণে রয়েছে ছোট্ট একটা তিল। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো নবাবেরও ঠিক একই জায়গা একটা তিল রয়েছে। আর এটা নিয়ে সে একবার মিষ্টিকে বলেছিল, “আমাদের দু’জনের মাঝে কত মিল দেখেছো? স্বয়ং আল্লাহ আমাদের দু’জনের চেহারায় ঠিক একই জায়গায় ছোট্ট একটা তিল দিয়েছেন। তাহলে কি বলা যায় না, আমাদের এক হওয়ার মাঝে নিশ্চয়ই উনারা হুকুম আছে?”

সেদিন হাসির ছলে মিষ্টি নবাবের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “সবকিছুতেই তোমার শুধু রসিকতা।”

“হুম, হয়ত রসিকতা।” মুখে সেদিন রসিকতা বললেও নবাবের মন বলেছিল, “এটা রসিকতা না হয়ে যদি বাস্তব হয় তবে কি খুব বেশী বেমানান হয়ে যাবে?” সেদিন নবাব উত্তর পায়নি কিন্তু সেদিনের করা রসিকতা আজকে বাস্তবের রূপ নিয়েছে। আর এটা ভাবতেই নবাব নিজেকে ভালোবাসার যুদ্ধে জয়ী সৈনিক হিসেবে দেখতে পায়।

“কী হয়েছে তোমার?” মিষ্টিকে প্রশ্ন করলো কিন্তু এড়িয়ে যেতে মিষ্টি চোখ সরিয়ে নিলো, “কী হবে?”

“সেটাই তো জানতে চেয়েছি।”

নিষ্প্রাণ কন্ঠে মিষ্টি বললো, “কিছু হয়নি।”

“দৃষ্টির সীমানায় থাকতে যদি হও রাজি, আমি জিতে যাবো জীবন-মরণ বাজি।” হুট করে মিষ্টির কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো নবাব। সোজা হয়ে যখন বসলো, তখন বিস্মিত নয়নে মিষ্টি জানতে চাইলো, “মানে?”

মাস্ক পড়ে আছে বলে নবাবের হাসি মিষ্টি দেখতে পেল না। তবে কালো ক্যাপের তলায় থাকা চোখজোড়া প্রাণবন্ত হয়ে আছে। ও চোখ মিষ্টিকে বলে দিচ্ছে নবাবের চেহারা ও মনের সকল প্রতিক্রিয়া।

“রাত জেগে পাহারা দেওয়ার কথা ছিল আমার কিন্তু উল্টো তুমি আমাকে পাহারা দিলে। এমনটা কেন?” মূহুর্তেই মিষ্টি অপ্রস্তুত হয়ে আবারও চোখ সরিয়ে নিলো। লজ্জায় ধরে আসা গলায় বললো, “বেশি ভাবা এবং বুঝা বন্ধ করলে ভালো হয়।”

“ভাবনাটা কি ভুল?”

“দেখো, পথেঘাটে ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই আমার।”

“এমন মনমরা হয়ে থাকলে মঙ্গল গ্রহেও তুমি ঝগড়া করবে না।” একটু থেমে কন্ঠ নরম করলো নবাব, “কী হয়েছে তোমার? হঠাৎ করে এমন চুপচাপ কেন হয়ে পড়লে? আমার তো কিছু হয়নি তাহলে এতো ভেবে নিজেকে অসুস্থ করছো কেন?”

কাঠ গলায় জবাব দিলো মিষ্টি, “ভাবছে তো আমার মন। এখন মনকেও কি ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখবে?” নবাব কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু সিএনজি ড্রাইভারের সামনে আলোচনা না বাড়িয়ে ইতি টানলো।

…চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে