প্রীতিকাহন পর্ব-১৬+১৭

0
519

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৬

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

আম্বরখানা পয়েন্ট শাহজালাল রহঃ এর মাজারের গেইটের সাথে। নবাব একবার ভেবেছিল মাজার পরিদর্শন করবে কিন্তু পরক্ষণেই মত বদল করে সিএনজি স্টেশনে চলে এসেছিল।

“আচ্ছা, হাদারপার বাজারে তো অনেকগুলো নৌকার ঘাট আছে।” নবাব সিএনজি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো, “জি।”

নবাবের বয়সী ড্রাইভারকে চোট করে সে কী সম্বোধন করবে বুঝতে পারছিল না। তাই সম্বোধন বিহীন কথোপকথন চালালো, “তাহলে যেখানে নৌকার ভাড়া কম আমাদের সেখানেই নিয়ে চলুন।”

“ঠিক আছে।” অতি সংক্ষিপ্ত বাক্যে ড্রাইভার কথোপকথনে ইতি টানলো।

নবাব সিটে হেলান দিতে গিয়ে মিষ্টির দিকে একবার তাকালো। নিশ্চুপ হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। মিষ্টি যতটা শৃঙ্খল এবং শান্তশিষ্ট, ওর জীবন ঠিক উল্টো; বিশৃঙ্খল আর ঝামেলাযুক্ত। নবাব ওকে ডাকতে গিয়েও চুপ করে রইলো। হালকা হেসে ফোন বের করে তাতে মত্ত হলো আর সেই ফাঁকে একটু বিড়বিড় করলো,

“আমি দৃষ্টিগোচর হলে যদি
তোমার হৃদয় করে আমায় স্মরণ।
তবে দু’জনার দুর্বোধ্য এবং সুপ্ত অনুভূতিতে
সৃষ্টি হবে অমোঘ প্রীতিকাহন।”

.

হাদারপার বাজারে এসে সিএনজি থামিয়ে ড্রাইভার নবাবের উদ্দেশ্যে বললো, “এই ঘাটে নৌকার ভাড়া কম। আপনারা যান।”

সৌজন্যের হাসি হেসে নবাব বললো, “ঠিক আছে।” এরপর মিষ্টিকে বললো, “এসো।” মিষ্টি নিঃশব্দে সিএনজি থেকে নেমে নবাবকে অনুসরণ করতে শুরু করলো।

মাঝির সাথে সবকিছু বলে কয়ে নিলো নবাব যেন একসাথে বিছানাকান্দি, পান্থুমাই আর লক্ষণছড়া ঘুরে দেখা যায়। কিন্তু মাঝি জানালো এতে অনেক সময় ব্যয় হবে হয়ত রাত হয়ে যেতে পারে। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নবাব সিদ্ধান্ত বদল করে শুধু পান্থুমাই যাওয়ার জন্য মনস্থির করলো।

নদীতে স্রোত তেমন নেই তবে নৌকা দুলছে। নবাব প্রথমে নৌকায় উঠলো এরপর মিষ্টিকে বললো, “উঠে এসো।”

দুলতে থাকা নৌকার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি বললো, “ভয় করছে।”

“ভয় নেই।… ঠিক আছে, হাত দাও।”

হাত দাও– এই শব্দযুগলে স্তম্ভিত হলো মিষ্টি। যেন মাঝ নদী থেকে রুই মাছ ভেসে উঠার মতো লজ্জা ভেসে উঠলো ওর চোখে। মূহুর্তেই লজ্জায় চঞ্চল হলো চোখ আর স্তব্ধ হলো মিষ্টির নির্বাক কন্ঠ ও মন।

“কী হলো? জলদি এসো।” নবাব তাড়া দিতেই মিষ্টি এবার বাধ্য হলো মিষ্টি। মেহেদী রাঙা হাতখানা সে রাখলো নবাবের শক্ত-পোক্ত হাতে। আর মূহুর্তেই নবাব মিষ্টিকে টানলো নিজের দিকে। নৌকার উপর রাখা ডান পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে নবাবের খুব কাছাকাছি এসে থামলো। এত কাছ থেকে সে নবাবকে আগে দেখেনি তাই অস্বস্তি হতে শুরু করলো। কিন্তু নবাবের মাঝে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না মাস্ক পড়ে থাকায়। মিষ্টির হাত ছেড়ে সে সাধারণ কন্ঠে বললো, “এবার বসে পড়ো।”

মিষ্টি বসে পড়লো নৌকার একপাশে আর বিপরীত পাশে নবাব বসলো। নৌকার মাঝি তার নিজ কাজে ব্যস্ত হলো। ইঞ্জিন চালিত নৌকা ধীরে ধীরে নদীর বুকে ভাসতে শুরু করলো তীব্র শব্দে।

ছোটবেলায় একবার ইঞ্জিন বিহীন নৌকায় চড়ে ভ্রমণে গিয়েছিল মিষ্টি। এরপর আর কখনও নৌকায় উঠার সৌভাগ্য হয়নি তার। তবে আজকে নৌকায় উঠতে পেরে কিঞ্চিৎ ভালো লাগছে তার।

টলমল করা পানির দুইপাশে সবুজ সমারোহ। আকাশে হালকা রোদ আর স্রোতের বিপরীতে ছুটছে মৃদুমন্দ বাতাস। প্রকৃতির নিজস্ব ঘ্রাণে মাদকতা খুঁজে পাচ্ছে। এমন নেশায় যখন মত্ত সে, তখন হুট করে নবাব এসে তার পাশে বসলো। এতে খানিকটা চমকে সে নবাবের মুখের দিকে তাকালো। এখন নবাবের মুখে মাস্ক নেই। তাই হাড় ভাসা মুখের প্রশন্ন হাসি দেখতে পেল মিষ্টি।

“এই মিষ্টি, কী এতো ভাবছো?” পূর্ণ দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে মিষ্টি নবাবের দিকে। ওর প্রতি নবাবের সম্বোধন আগের মতোই আছে। আগে ডাকতো ‘এই আপু’ বলে আর এখন ‘এই মিষ্টি’ বলে। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের পরিবর্তন হলেও ভালোবাসা হয়ত এক জায়গায়ই স্থির থাকে। যদি সেই ভালোবাসা প্রকৃত হয় তবে যুগের পর যুগও তাতে ভাঁটা পড়ে না।

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলো মিষ্টি, “কিছু না।”

“বললেই হলো? এমন সুন্দর একটা জায়গায় এসেও মুখ ভার করে আছো। কীসের চিন্তায় যেন বিভোর হয়ে আছো।”

“তুমি সাহিত্য পছন্দ করো?” মিষ্টির হঠাৎ করা প্রশ্নে নবাব একটু বিস্মিত হলো। হাসবার চেষ্টা করে জানতে চাইলো, “হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করছো?”

“বিদেশে থাকো অথচ তোমার কথাবার্তায় সেই ভাবটা আসে না। মনে হয় যেন বাংলাদেশ থাকো আর বাংলা বিষয়ে পড়াশোনা করেছো।”

নৌকার বেঞ্চে হেলান দিয়ে দুইহাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে নবাব বললো, “বিদেশে থাকলেই ঠাশঠাশ ইংরেজি বলতে সেটা তোমায় কে বললো?”

“এমনি জানতে চাইলাম।” স্পষ্ট জবাব দিলো মিষ্টি।

“ওহ… সাহিত্য পছন্দ কি-না জানি না। তবে উপন্যাস, কবিতা এসব মোটামুটি পড়া হয়েছে।” মিষ্টি উত্তর না দিয়ে আবারও চিন্তায় মত্ত হলো। বিষয়টা নবাবের ভালো লাগছে না বিধায় সে সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে এমন দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। কী হয়েছে তোমার?” নবাবের আদুরে গলায় মিষ্টি চোখ ছলছল করতে শুরু করলো। ও চোখে তাকিয়ে মিষ্টি বললো, “আমার খুব ভয় করছে নবাব, খুব ভয় করছে।”

“হয়ত এই অনেক বছর পর নৌকায় উঠেছো বলে।”

“তোমাকে নিয়ে ভয় হচ্ছে আমার।” এই বলে মুখ ফিরিয়ে কাঁদতে শুরু করলো মিষ্টি। হঠাৎ ওর এমন কথা এবং কর্মে ঘাবড়ে গেল নবাব, “এই মিষ্টি, কাঁদছো কেন?” বৃথা হাসিতে নিজেকে এবং মিষ্টি সামলে নেওয়ার চেষ্টায় নবাব বললো, “আরে আমার কী হবে? তুমি শুধু শুধু ভাবছো।”

চকিতে মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে। মিষ্টির চাহনি নবাবকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, মিষ্টির ভাবনা হয়ত মিথ্যা নয়। তাই অচিরেই নবাবের হাসি বিলীন হলো। মনের খচখচানিতে চোখ আপনা থেকে নেমে গেল। মিষ্টি বিষয়টা লক্ষ্য করে বললো, “তোমার নিজের কথার ওপর নিজেরই ভরসা নেই, তাই না?”

চোখ তুলে নবাব বললো, “বিষয়টা তা নয়।”

“বিষয়টা যে কী সেটা তুমিও জানো আর আমিও।… শোনো না, আমি বলি কি? তুমি বিদেশে ফিরে যাও। ওখানে দুই-তিন বছর থেকে এসো। আমাকে নিয়ে তো আর ভয় নেই। তাই আমি বাবা-মায়ের কাছেই থাকতে পারবো।”

“দুই-তিন বছর পরে কি আমি আমার মিষ্টিকে এমনই পাবো?” মুখ ফিরিয়ে নিলো মিষ্টি। নবাবের প্রশ্নের উত্তর নেই তার কাছে। কারণ বাড়ি ফেরার পর অনেক কিছুই হতে পারে। তার বাবা-মা তাকে ডিভোর্স করিয়ে বিয়ে দিতে পারে, নবাবের জেল হতে পারে তাকে অপহরণ করে বিয়ে করবার জন্য, এমনকি ঐ দানবরূপী মানুষের হাতে নবাবের প্রাণও যেতে পারে।

“চুপ করে কেন গেলে মিষ্টি? তোমার কাছেও বুঝি উত্তর নেই?”

“নবাব, একটু বোঝার চেষ্টা করো। কালকে আমি মাঝরাতে স্বপ্ন দেখেছি। তোমার সামনে ঘোরতর বিপদ আছে আর…” মিষ্টি নবাবকে বোঝাতে চাইলো কিন্তু নবাব ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “ঐসব দুঃস্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না।” হঠাৎ কিছু মনে পড়তে নবাব বললো, “তারমানে ঐ স্বপ্ন দেখে তুমি আমাকে সারা রাত পাহারা দিলে আর সকাল থেকে ভাবনায় অস্থির হচ্ছো?”

কাঁধ নাচিয়ে মিষ্টি আবার নবাবকে বোঝাতে চাইলো, “আমি কারোর বউ হতে পারি না নবাব। আমার মা বাবা আমাকে বিয়ে দেওয়ার যত চেষ্টাই করুক না কেন? আমার কপালে সেই বিধবা হওয়াই লেখা আছে।”

“কিন্তু আমি তো চাই না তুমি আমার বউ হও।”

“মানে?” মিষ্টির কন্ঠে স্পষ্ট বিস্ময় ভেসে উঠলো।

“মিষ্টি, বিয়ে যদিও একটা পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন। কিন্তু বিয়ের পর সম্পর্কগুলো চোখের পলকে বদলে যায়। ভালোবেসে বিয়ে করলেও বিয়ের পর সেই ভালোবাসা আর দেখা যায় না। দু’টো মানুষ সংসারধর্ম পালন করে ঠিকই কিন্তু সেটা দায়ে পড়ে। বিয়ের প্রথম প্রথম বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আর এরপর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে। দায়িত্ব, দায় আর মেনে নেওয়ার মাঝেই বাকি জীবন পার হয়ে যায়। অথচ বিয়ের আগে একে অপরের প্রতি যে ভালোবাসা থাকে, সম্মান থাকে সেটা আর যেন খুঁজেই পাওয়া যায় না; এ যেন কেবল দায়বদ্ধতার ভিড়ে নিশ্বাস ফেলা। আর পিতামাতার পছন্দে বিয়ে করলে তো আরও বেশি দায়বদ্ধতার পথে হাঁটতে হয়। হ্যাঁ, কিছু সম্পর্ক ব্যতিক্রমও হয় আর সেই ব্যতিক্রমী সম্পর্কটাই আমি চাই।”

“আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

হালকা হেসে নবাব আবার বলতে শুরু করলো, “মিষ্টি, আমি এমন কোনও সম্পর্কে জড়াতে চাই না যেখানে ঠেকায় পড়ে মানুষ জীবন কাটাবে। বরং এমন একটা সম্পর্ক চাই, যেখানে ভালোবাসার গভীর সমুদ্র থাকবে, একটু মান অভিমান থাকবে, তীব্র ঝগড়ার মাঝেও সুপ্ত মায়া জড়ানো থাকবে। আমি মনের সুখের ঝগড়া করে বিছানায় পড়ে থাকলেও সে যেন আমার চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। নির্ঘুম একটা রাত যেন সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে পার করতে পারে, আমাকে খাওয়ানোর জন্য যে নিজে খেতে পারে; এমন আরও অনেককিছুই আছে।” নবাবের কথা শুনে মিষ্টির নিজের করা কর্ম মনে পড়ে গেল। আর এতে লজ্জার জালে সে আবদ্ধ হলো কিন্তু নবাব বলে চলেছে, “ছোট্ট বেলা থেকে এখন অবধি তোমার সাথে আমার সম্পর্ক যেমন ছিল, তেমন সম্পর্ক আজীবন থাকুক সেটাই আমি চাই। তোমাকে আমার বউ হিসেবে নয়, রানী হিসেবে দেখতে চাই। তবে আমি রাজা নয়, নবাব হিসেবেই থাকতে চাই। তোমার সেই ছোট্ট নবাব।” শেষ কথাগুলো বেশ মজা নিয়ে বললো নবাব।

গম্ভীর ভাব এনে লজ্জায় ধরে আসা গলা উপেক্ষা করে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “তুমি সত্যিই সাহিত্য পছন্দ করো না?”

মৃদু শব্দে হেসে নবাব বললো, “হাসালে মিষ্টি। আমার কথাগুলো কি সাহিত্যিকদের মতো শোনাচ্ছে?”

“এমন কথা সাহিত্যেই যথোপযুক্ত, বাস্তবে নয়।”

“চাইলে বাস্তবেও সম্ভব।” হঠাৎ নবাব মিষ্টির দিকে ঝুঁকে আসতে মিষ্টি আঁতকে উঠলো। মিষ্টি পিছনে একটু হেলে গিয়ে চোখ পিটপিট করলো আর নবাব বললো, “প্রমাণ চাও?”

কাঁপা স্বরে মিষ্টি জানতে চাইলো, “কীসের?”

“প্রীতিকাহন-এর।”

…চলবে

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১৭

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

কালো হিজাবের ফাঁকে দৃশ্যমান নয়নে বিস্ময় ভাসিয়ে কপাল কুঁচকালো মিষ্টি, “প্রীতিকাহন? এটা আবার কী?” নবাব ওর উপর ঝুঁকে আছে বিষয়টা এখন ভালো করে চোখে লাগতে, মিষ্টির কপালের ভাঁজ এবার দ্বিগুণ হলো,”তার আগে সোজা হয়ে বসো।”

ভ্রু নাচিয়ে নবাব জানতে চাইলো, “কেন?” এই বলে আরও ঝুঁকে আসতে মিষ্টি পিছিয়ে গেল। কিন্তু বেশি পেছানোর আগে নবাবের বুকে দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে রেগেমেগে বললো, “আশ্চর্য! এভাবে কি কথা বলা যায়? আর তুমি ওখান থেকে আমার পাশে এসে কেন বসলে?”

ধাক্কা খেয়ে কিঞ্চিৎ সরে বসলেও নবাব মিটিমিটি হাসছে৷ ওকে হাসতে দেখে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে আমি বুঝতে পারি না কেন?”

চোখে বিস্ময় আর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে নবাব বললো, “বুঝতে যেও না। নবাবের ভালোবাসায় পড়লে আর রক্ষে থাকবে না।” এমন কথা নবাব আগেও বলতো কিন্তু মিষ্টি হেসে উড়িয়ে দিতো। আজকে মিষ্টির হাসি এবং রাগ কোনওটাই প্রকাশ পাচ্ছে না। নবাবকে ঝুঁকে আসতে দেখে রাগটা যেমন এসেছিল, আচম্বিতে তেমনই মিলিয়ে গেল।

“বললে না তো প্রীতিকাহন কী?” মায়া জড়ানো কন্ঠ শুনে নবাব অবাক হলো, “এসব তুমি শুনবে?”

মাথা নুইয়ে মিষ্টি বলতে শুরু করলো, “জানি না। আমার না নিজেকেও কেন যেন ভীষণ অপরিচিত লাগে। এতসব হয়ে যাওয়ার পরও কত নিশ্চুপ আমি। তোমার অন্য একটা রূপ দেখেও শব্দহীন আমি। আমার তো উচিত ছিল তোমাকে গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। তোমাকে প্রচন্ড রকমের ঘৃণা করা। সবকিছু বুঝেও যেন অবুঝ সেজে বসে আছি।”

ইঞ্জিনের শব্দে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। কিন্তু তীব্র শব্দ উপেক্ষা করেও মিষ্টির কথাগুলো একে একে ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে নবাবের কানে। মায়া জড়ানো মিষ্টির কথাতে নবাবও ওর প্রতি অন্য এক মায়া অনুভব করলো। তাই একটু এগিয়ে এসে আদুরে গলায় বললো, “তোমার যা ইচ্ছে হয় করতে পারো। আমি কখনও আপত্তি করবো না কিন্তু তিক্ত রাগে আমার হৃদয় দগ্ধ করো না। তোমার রাগ ব্যতীত আমি সব গ্রহণ করতে রাজি। যদি আমার হৃদয় চাও তবে সেটাও তোমার হাতে তুলে দিবো।”

ফিকে হেসে মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে, “সাহিত্য গুরু, আপনার সাহিত্য সমাচার অন্যদিন না হয় শুনবো। এখন প্রীতিকাহন নিয়ে বলো। এই নিয়ে তিনবার জানতে চাইলাম। এবার না বললে কিন্তু…” মিষ্টির কথার মাঝেই নবাব বললো, “আজকে থাক অন্য কোনওদিন বলবো।”

“কেন?” অবাক হলো মিষ্টি।

“এটার বিশ্লেষণ করলে তোমার মনে হবে আমি সত্যিই সাহিত্যিক হয়ে গিয়েছি। তাই অন্য কোনওদিন বলবো।”

“তবে এখন কি নিরবতা পালন করবে?”

“নাহ, তা কেন করবো? এসব ছাড়াও তো কতকিছু করার আছে। এই যেমন ধরো, নৌকায় আমি তুমি ছাড়া কেউ নেই। মাঝি আছে কিন্তু আমাদের আশেপাশে বিরক্ত করতে আসবে না।”

“তো?” আঁড়চোখে তাকাতেই নবাব ঘাবড়ে গিয়ে হালকা হাসবার চেষ্টা করলো।

“না মানে…” নবাব আমতা-আমতা করতে শুরু করলে মিষ্টি বললো, “পানিতে ডুবে মরতে চাও?” প্রশ্ন করে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো মিষ্টি। ওর চেহারায় হালকা রাগ ভাসছে। নবাব বুঝতে পারছে মিষ্টি তার ইশারা বুঝেছে বলে রাগ প্রকাশ করছে। সব বুঝেও নবাব পাত্তা না দিয়ে বললো, “আশ্চর্য! আমি কি অন্যায় কিছু বলেছি?”

“নাহ, আপনি অনেক ন্যায় কিছু বলে ফেলেছেন কিন্তু ভবিষ্যতে এমন ন্যায় কিছু বলতে শুনলে খুব খারাপ হবে।” এই বলে মিষ্টি মুখ ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। আর এতেই নবাব ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করলো, “ভালোবাসি বলাটা যদি অন্যায় হয়। তবে এই অন্যায় করতে আমি হাজারবার রাজি। আমার তোমাকেই চাই মিষ্টি, তোমাকেই চাই। এই তোমার জন্যই তো আমি নিজের জীবন রেখেছি বাজি।”

.

বিছানাকান্দি না গিয়েও হোটেলে ফিরতে রাত হয়ে গেল মিষ্টি আর নবাবের। দুপুরে খাবারে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি বলে শরীরও বেশ দূর্বল লাগছে। আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে যখন নবাব সিএনজি ভাড়া করেছিল, তার আগে কিছু শুকনো খাবার কিনে নিয়েছিল। সেগুলো দিয়েই মধ্যাহ্নভোজ শেষ করেছিল।

রুমের দরজা বন্ধ করে পরিশ্রান্ত মুখে নবাব বললো, “আমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসি।”

“ঠিক আছে।” মিষ্টি জবাব দিলো।

নবাব তোয়ালে এবং কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। এদিকে মিষ্টি বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো। ক্লান্ত হাতে ধীরে ধীরে হিজাব এবং বোরকা খুলে পাখার হাওয়ায় গা জুড়োতে লাগলো। হঠাৎ ওর পাশে থাকা নবাবের ফোনে দৃষ্টি পড়তে চমকে উঠলো। শব্দ বিহীন ফোনে আলো জ্বলছে। মিষ্টি কৌতূহল বশত ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো অর্ষা নামের একটা মেয়ে কল করেছে।

সাত-পাঁচ না ভেবে মিষ্টি কল রিসিভ করলো কিন্তু হ্যালো বলার আগেই শুনতে পেল, “থ্যাঙ্ক গড। আমি তোমাকে এই যে কল করি তুমি রিসিভ করো না কেন নবাব?… যাক, এখন কল রিসিভ করেছো আই অ্যাম সো হ্যাপি।” এতোসব কথা শুনে মিষ্টি অবাক হওয়ার পাশাপাশি ক্ষুব্ধ হলো। থমথমে গলায় সে বললো, “হ্যালো।”

মেয়েলি কন্ঠের হ্যালো শব্দ কানে পৌঁছানো মাত্র অর্ষার হাসিখুশি কন্ঠে বিষন্নতা ভিড় করলো, “কে আপনি?”

“সেটা হয়ত আপনার না জানলেও চলবে।” কাটকাট করে জবাব দিলো মিষ্টি।

“আপনি নবাবকে ফোন দিন।”

“আপনার পরিচয়?” দাঁতে দাঁত চেপে মিষ্টি প্রশ্ন করলো।

বেশ ভাব নিয়ে অর্ষা জবাব দিলো, “আমি ওর এক্স।” মূহুর্তেই মিষ্টির চোয়ালের পেশী টানটান হলো। রাগের তীব্রতায় চোখ বুজে এলো কিন্তু হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। চোখ মেলে মিষ্টি সেদিকে তাকিয়ে দেখলো নবাব দাঁড়িয়ে আছে।

তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বের হতে গিয়ে থমকে গেল নবাব। নিজের ফোন মিষ্টির হাতে দেখে সে থতমত খেল। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো মিষ্টির রাগী মুখ দেখে।

নবাবকে দেখে মিষ্টি তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়লো। নবাবের চোখে চোখ রেখে যথেষ্ট রাগ নিয়ে অর্ষাকে জবাব দিলো, “যেখানে সম্পর্কের ছিটেফোঁটা নেই, সেখানে নির্লজ্জের মতো এমন শব্দ উচ্চারণ করতে মুখে বাঁধেনি?” এই বলে ফোনটা বিছানায় ঠাশ করে রেখে দিলো মিষ্টি। এরপর কাপড়চোপড় নিলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। নবাবকে পাশ কাটিয়ে যখন ওয়াশরুমে ঢুকলো, তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেক কিছু বুঝিয়েছিল সে নবাবকে। কিন্তু নবাব বুঝতে পারেনি এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল।

শব্দ করে যখন মিষ্টি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করলো, তখন দরজার দিকে লক্ষ্য করে নবাব বলে উঠলো, “বাব্বা! রেগেমেগে তো ফায়ার দেখছি। কিন্তু ফোন ধরার জন্য তো আমার রাগ হওয়ার কথা।… কার সাথে কথা বলছিল মিষ্টি?”

বিছানার ওপর তোয়ালে রেখে ফোন হাতে নিলো নবাব। স্ক্রিন ওপেন হতে দেখলো অর্ষার নাম ভাসছে এবং এখনও কলে আছে। একটা চাপা বিরক্তিতে ভ্রুকুঞ্চন হলো নবাবের। সেই সাথে নবাবের মুখ বিকৃত হয়ে নিসৃত হলো ছোট্ট একটা ইংরেজি শব্দ, “Bitch.”

…চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে