নিভৃত পূর্ণিমা পর্ব-০৪

0
272

নিভৃত পূর্ণিমা – ৪
ভ্যান গাড়িটার আরো কাছে যেতেই কী ঘটছে পরিষ্কার ভাবে দেখতে পেলো নাদিম। মাঝ বয়েসি একজন মহিলা সায়রা বানুকে জড়িয়ে ধরে আছে। দেখে মনে হতে পারে আপন কেউ আদর করে কাছে টেনে রেখেছে, হেঁটে হেঁটে গাড়িতে যাচ্ছে। কিন্তু সায়রা বানুর মুখের অসহায় দৃষ্টি বলছে অন্য কিছু। ওদের দুজনের একটু সামনে অল্প বয়েসি ছেলেটা হাঁটছে, যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা নাদিমের সম-বয়েসি, গায়ে টি শার্ট। নিয়মিত জিমে যেয়ে ব্যায়ামবীরের মতো মাসল তৈরি করেছে। সুস্বাস্থ্য দেখানোর জন্য টি শার্ট পরেছে। দ্বিতীয় পুরুষ লোকটা নিরীহ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, হয়ত গাড়ি চালিয়ে এসেছে।
বিনা দোষে হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়াতে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিল নাদিম। মনের মধ্যে চাকরি হারানোর রাগ তুষের আগুনের মত জ্বলছিল। একটা কিছু করার বা কারো উপর এই রাগ ঝারার অজুহাত খুঁজছিল। এই সময় সায়রা বানুর সাথে পরিচয় হওয়াতে জীবনে বৈচিত্র্য এসেছিল। ভিন্ন একটা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হওয়াতে চাকরি চলে যাওয়ার যন্ত্রণা কিছুটা হলেও উপশম হয়েছিল। আজ সায়রা বানুর টেক্সট পেয়ে ভীষণ রাগ হলো নাদিমের। ইচ্ছে হলো এই লোকগুলোর উপর সব রাগ ঝাড়বে। কিন্তু বুঝতে পাড়ল, এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি মাথা ঠাণ্ডা রাখা।
ওদের কাছ থেকে সায়রা বানুকে বাঁচাতে তিন চারটা উপায় থাকতে পারে। তার থেকে একটা বেছে নিল নাদিম। কিন্তু সবই নির্ভর করছে সায়রা বানুর ইচ্ছের উপর। কাছে যেয়ে ব্রেক চেপে গাড়ি থামাল নাদিম। পাশের সিট থেকে ফোন হাতে নিয়ে একটা ছবি তুলল। এখন সবাই নাদিমের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো দৃশ্যটা ক্যামেরায় ধরা পড়ল। কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কে কাকে ধরে আছে, কার মুখের অভিব্যক্তি কেমন, এই সব ছবিতে ফুটে উঠল। পর দুটি ছবি তুলল নাদিম। এরপর ভ্যানের নাম্বার প্লেট সহ আরেকটা ছবি তুলে রাখল। ছবিগুলো নিজের ইমেইলে এবং সায়রা বানুর ফোনে পাঠিয়ে দিল। কোনো কারণে হাতে ফোন না থাকলেও ছবিগুলো উদ্ধার করা যাবে।
এবার রাস্তার মাঝে গাড়ি থামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল নাদিম। দরজা খুলে বাইরে এলো, কিন্তু দরজা বন্ধ করল না। রাস্তা ব্লক হওয়াতে এখন আর ভ্যানের পক্ষে পারকিং থেকে বের হওয়া সম্ভব না। ড্রাইভারের দরজা খোলা থাকায় দৃষ্টিকটু একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকাতে এরকম দৃশ্য সৃষ্টি হলে লোকজনের নজরে পড়ে, কেউ না কেউ পুলিশে ফোন করে দেয়। যারা ভ্যান নিয়ে এসেছে, তারা বিপদ ঠিক টের পাবে। ভ্যানের রাস্তা বন্ধ, হইচই হলে পুলিশ আসতে পারে। পুলিশ এলে সবার আইডি চেক করবে, একটা রিপোর্ট ফাইল করবে, তারপর ব্যবস্থা নেবে। ভীষণ ঝামেলার সৃষ্টি হবে।
এই দিকটা পারকিং এর শেষ মাথায় হওয়াতে খুব বেশি গাড়ি আটকা পরেনি। কিছুক্ষণ গাড়ি রাস্তার মাঝে থাকলে খুব একটা অসুবিধা হবে না।
নাদিম বাইরে আসতেই নিজের ইচ্ছে শক্তি ফিরে পেলো সায়রা বানু। কেমন এক উচ্চারণে “না-দি-ম” বলে এক চিৎকার দিয়ে ভদ্রমহিলার হাত থেকে ছুটে নাদিমের পিছনে এসে দাঁড়াল।
খুব শান্ত ভাবে হাসি মুখে সায়রা বানুকে জিজ্ঞেস করল নাদিম, কী হয়েছে?
একটু দম নিয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে সায়রা বানু বলল, জবরদস্তি সে টেকিং মি নিউ জার্সি।
জিজ্ঞেস করার দরকার নেই, তবু জিজ্ঞেস করল, তুমি ওদের সাথে চলে যেতে চাও?
— না। বলল সায়রা বানু।
এবার ভদ্রলোক, এবং ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে নাদিম বলল, হ্যালো। মে আই হেল্প ইউ?
সম-বয়েসি ছেলেটার দিকে তাকালই না নাদিম।
ভদ্রলোক চুপ করে থাকল, মহিলা ইংরেজিতে বলল, আমি সায়রা বানুর আনটি। এরা আমার হাজব্যান্ড এবং ছেলে। সায়রা’র মা অসুস্থ, ওকে নিয়ে যেতে এসেছি।
নাদিম সায়রা বানুকে আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি যেতে চাও?
এরকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় লজ্জা পাচ্ছিল সায়রা বানু। মুখে কিছু বলতে পাড়ল না, কিন্তু কোনো রকমে ডানে-বামে মাথা নেড়ে বোঝাল সে যাবে না।
এবার উগ্র ভাব নিয়ে এগিয়ে এলো ছেলেটা। রুক্ষ স্বরে, ইংরেজিতে নাদিম কে বলল, ইট ইজ নান অফ ইয়োর বিজনেস, ম্যান। শি ইজ আওয়ার ফ্যামিলি। উই আর টেকিং হার হোম।
এবার মিষ্টি করে হাসল নাদিম। ইংরেজিতে বলল, ঠিক বলেছ, এটা আমার বিষয় না। কিন্তু সায়রা বানু এখন আমার গেস্ট। সে বলেছে, “জবরদস্তি সে”, এই শব্দটা মোটেই ভালো না। তার মানে জোর করে ওকে নিয়ে যাচ্ছ। ট্রান্সপোরটিং এ ফিমেল উইদাউট হার কন্সেন্ট ইজ এ ক্রাইম। তোমরা যদি এখুনি চলে না যাও, তাহলে আমি নাইন ওয়ান ওয়ান কল করে পুলিশ ডাকবো। পুলিশ আসুক, সব শুনে ঠিক করুক “জবরদস্তি সে” তোমরা সায়রা বানুকে নিয়ে যেতে পারো কিনা?
হাতে ফোন নিয়ে নাইন ওয়ান ওয়ান কল করার ভঙ্গি করল নাদিম। ওদের সবাইকে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করার সময় দিল, তারপর ডায়াল করবে। মুখ ভঙ্গী দেখে ওদের বুঝতে বাকি রইল না নাদিম সিরিয়াস।
ছোট একটা মোম বাতির উপর এক বালতি পানি ঢেলে দিলে যায় হয়, বয়স্ক লোকটার সে রকম প্রতিক্রিয়া হলো। ছেলেটা রেগে যেয়ে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, ভদ্রলোক তাকে থামিয়ে দিল। মহিলা এবং ছেলেকে কাছে ডেকে নিয়ে উর্দুতে কিছুক্ষণ কি সব বলল। কথা শেষ করে ড্রাইভারের সিটে বসল লোকটা। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে সায়রা বানুকে সাথে যেতে অনুরোধ করল। চুপ করে থাকল সায়রা বানু। অভদ্র ব্যবহার করল না, কিন্তু বুঝিয়ে দিল সে যাবে না।
হাল ছেড়ে দিয়ে এবার ছেলেকে টেনে গাড়িতে তুলল মহিলা। তারপর নিজে উঠে দরজা বন্ধ করে করল। নাদিম কয়েক পা এগিয়ে ড্রাইভারের সিটে বসা ভদ্রলোককে বলল, সায়রা বানুর আম্মুকে বলবেন, “সায়রা বানু ভালো আছে, নিরাপদ আছে। সে একজন মহিলা রুমমেট খুঁজছে, তেমন কাউকে পেলে নিজের এপার্টমেন্টে চলে যাবে।“
ভদ্রলোক শুনল, কিন্তু কোনো জবাব দিল না।
ফিরে এসে গাড়িতে উঠল নাদিম, এবার পার্ক করল। খোলা রাস্তা পেয়ে চলে গেল ভ্যান। যাওয়ার সময় সায়রা বানুর দিকে তাকালো না ভদ্রলোক।
গাড়ি পার্ক করে সায়রা বানুর কাছে এলো নাদিম। এখনো ভয়ে কাঁপছে। এত সহজে, এরকম একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সমাপ্তি হতে পারে, বিশ্বাস করতে পাছে না। আর কয়েক মিনিট এদিক ওদিক হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত। নিউ জার্সি নিয়ে ঘরে আটকে রাখত।
— ভিতরে এসো। মোলায়েম স্বরে বলল নাদিম।
— না, খোলা জায়গায় যেতে ইচ্ছে করছে।
— চলো তাহলে। ঘরের দরজা বন্ধ?
— বলতে পারবো না।
ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করল নাদিম। দরজা বন্ধ, কিন্তু লক করা না। ভিতরে এলো নাদিম। সায়রা বানুর জন্য এক সেট চাবি নিয়ে দরজা লক করে বাইরে এলো। রবিবার দুপুর, মেঘলা আকাশ, খুব একটা রোদ নেই। সায়রা বানুকে নিয়ে সেন্টেনিয়াল পার্কে এলো। পার্কের মাঝখানে বিশাল এক লেক। মাছ ধরার জন্য একটা প্লাটফর্ম বানানো হয়েছে। প্লাটফর্মে ছাউনির মতো করে ক্যানোপি বানিয়ে নিচে কয়েকটা বেঞ্চ দেয়া আছে।
বেঞ্চিতে বসল নাদিম। পাশে না বসে পানির কাছে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল সায়রা বানু। এই সব কী ঘটছে আমার জীবনে? তাই হয়ত ভাবছে। সায়রা বানুকে ওর মতো থাকতে দিল নাদিম। ফোনে মেসেজ দেখতে থাকল।
একটু পর বেঞ্চের কাছে এলো সায়রা বানু। বলল, কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ফিরে যেয়ে কী যে ঝামেলা পাকাবে, খুদা জানে।
— লাঞ্চের সময় হয়েছে। আগে খেয়ে নাও, এখন বেশি চিন্তা করো না।
— ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। কোথাও ঘুরতে যেতে পারি? কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ভুলে যেতে চাই।
চোখ মুখ দেখে মনে হয় এখনও ট্রমাটাইজড হয়ে আছে সায়রা বানু। কিছুক্ষণ চিন্তা করল নাদিম। চাকরি যাওয়ার পর ওর নিজেরও একটু রিলাক্স করা উচিত ছিল। সারাক্ষণ এরকম তটস্থ হয়ে চাকরি খুঁজতে থাকলে এক সময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে। বলল, ভালই হলো। চল, দুই একদিন বাঁধন ছাড়া ঘুরে বেড়াই।
— ব্যাগ গুছিয়ে নিতে হবে।
আবার বাড়িতে এসে একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিল দুজন।
— কোথায় যাবে? গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করল সায়রা বানু।
— পেনসিলভানিয়ার গ্যাটিসবার্গ মেরিল্যান্ডের খুব কাছে। একটু দেখে আসি।
— ঐতিহাসিক জায়গায় যাচ্ছ?
— আমেরিকার সিভিল ওয়ারের অনেক রকম স্মৃতি চিহ্ন আছে। এতদিন থেকেও যাইনি। প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে “গভর্নমেন্ট অফ দি পিপল, বাই দি পিপল, ফর দি পিপল” ভাষণ দিয়েছিল, স্কুল জীবন থেকে সে যায়গাটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। এ ছাড়া ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া যাওয়া যায়। পাহাড়ি এলাকা। তোমার পছন্দ থাকলে বলতে পার।
— না, আমার কোনো ইচ্ছে নেই। যেখানে খুশি যাও।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই সায়রা বানু প্রশ্ন বলল, তোমার সম্পর্কে একটু বলো। তুমি কি খুব ব্যস্ত? কী করছ? কী করবে? এই সব।
— গত বুধবার আমার চাকরি চলে গেছে। বস আমাকে ভালো জানতো, এই জন্য ফর্মাল টারমিনেশন লেটার না করে, তিন মাসের বেতন দিয়ে অফিস থেকে বিদায় করে দিয়েছে। টেকনিক্যালি এখনো আমার চাকরি আছে। তিন মাস শেষ হলে, চাকরি খোঁজার জন্য আরো তিন মাস হাতে পাব। এই ছয় মাসের মধ্যে চাকরি না পেলে হয় আমেরিকা থাকতে পারব না। এটাই ইমিগ্রেশনের নিয়ম। যেন একটা চাকরি পাই, বা এ দেশে থাকতে পারি, তার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া আর কোনো ব্যস্ততা নেই।
হাই ওয়েতে গাড়ি উড়ে চলেছে। কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকল সায়রা বানু। এক সময় বলল, আমি না প্রতিবাদ করতে শিখিনি। কিছুই বলতে পারলাম না। যদি আমাকে নিয়ে যেত, ঘরে বন্ধ করে রাখত। তারপর ছলে বলে কৌশলে ওই লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে ছাড়ত।
— তুমি এখানে আছো জানল কী করে?
— শুক্রবার দিন অনেক পরে মসজিদে যেয়ে খালাম্মা দেখে আমি নেই। ফিরে এসে আফ্রিকান আমেরিকান মেয়েকে ফোন করে জেনেছে, আমি একটা ছেলের সাথে চলে গেছি। এই সব শুনে আম্মিজান ভয় পেয়ে গত রাতে আমাকে ফোন করেছে। খালাম্মার ফ্যামিলি আম্মিজানের কাছ থেকে জানতে পেরেছে, আমি এলিকট সিটি থাকি। “আম্মিজান অসুস্থ”, “শুধু দেখা করতে আসব”, এসব বলে ঠিকানা নিয়েছে। তারপর জোর করতে শুরু করে, বলে রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়া ভাল মেয়ের কাজ না। আমি একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম।
— তোমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে ওদের কী লাভ?
— আমাদের যৌথ ফ্যামিলিটা খুব কঞ্জারভেটিব। যে লোকের সাথে বিয়ে দিতে চায়, ওদের ফ্যামিলির সাথে আন্টিদের বিজনেস আছে।
— ওহ, আচ্ছা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করল সায়রা বানু, আচ্ছা, তুমি কী বললে যে ওরা অত সহজে চলে গেল?
— এর উত্তর খুব সহজ। তোমার বয়স তো আঠারোর বেশি, এখন তুমি একজন পূর্ণবয়স্ক মহিলা। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে পারবে না। তোমাকে জোর করে নিয়ে গেলে, সেটা হবে কিডনাপিং। রিপোর্ট করলে ওদের জেল, জরিমানা হয়ে যেতে পারত। সবচেয়ে বড় কথা, আমি পুলিশ ডাকলে একটা রেকর্ড হয়ে থাকত, এটা ওরা চায়নি।
— সত্যি? আমি পুলিশ ডাকলে এরকম সাহায্য পাবো?
— হ্যাঁ, অবশ্যই পাবে। তুমি যদি বে-আইনি কিছু না করো, আমেরিকার আইন-কানুন তোমাকে রক্ষা করবে।
অবাক হয়ে শুনতে থাকল সায়রা বানু। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। নিজের দেশের সাপেক্ষে ভাবছে, পুলিশ ডাকলে ঝামেলা আরো বেশি হয় না? পরিবারের লজ্জা আরো বাড়ে না?
নাদিমের ইমেইল, টেক্সট, যোগাযোগের সব কিছু ফোনে লিঙ্ক দেয়া আছে। গাড়ি চালাতে চালাতে রঘুনাথ রেড্ডির টেক্সট পেলো। এক হাতে সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো, এখন ড্রাইভ করছে, রাতে কথা বলবে। জবাবে রঘুনাথ লিখল, সেই ভালো। রাতে ফাইনাল করলে, পরদিন সোমবার অ্যাপলিকেশন প্যাকেজ পাঠিয়ে দেয়া যাবে।
গ্যাটিসবার্গ পৌঁছে পারকিং এ গাড়ি রেখে একটু হাঁটতে হলো। লিঙ্কনের স্মরণে একটা স্মৃতিফলক বানানো হয়েছে। গ্যাটিসবার্গের ভাষণ স্মৃতিফলকে লেখা আছে। সেই সময় রাজনৈতিক নেতারা এক বা দুই ঘণ্টা ভাষণ দিত। লিঙ্কন খুব ছোট বক্তব্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল।
— এখানে ভাষণ দিয়েছিল? স্মৃতিফলক দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সায়রা বানু।
— সবাই ভাবে এখানে দাঁড়িয়ে বুঝি সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভাষণ দেয়ার জায়গাটা আরো তিনশ গজ উত্তরে সাধারণ সৈন্যদের কবরস্থানের কাছে।
বিকেল হয়ে এসেছিল, ভাষণ দেয়ার জায়গাটা, আশপাশটা ঘুরে দেখতে থাকল। চারিদিকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ইতিহাস ছড়িয়ে আছে। তখন সামনা সামনি, হাতাহাতি যুদ্ধ হতো। চারিদিকে শুধু কবর আর কবর। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রাজ্যের সৈন্যদের কবর।
গ্যাটিসবার্গ দেখা শেষ হতে আবার গাড়িতে উঠল দুজন। সায়রা বানুর চোখ মুখ দেখে ভালো লাগল। খাঁচার পাখি ছাড়া পেলে যেভাবে আকাশে উড়ে বেড়ায়, নাদিমের সাথে এসে সে রকম মজা পাচ্ছে। হঠাৎ করেই স্বাধীন জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করতে পারছে।
নাদিম বলল, এখন যাবো ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার রামনি শহরে। ওখানে রাত কাটিয়ে সকালে ঘুরতে বের হবো।
— কতক্ষণ লাগবে যেতে?
— আড়াই ঘণ্টার মতো।
গাড়ি চালাতে চালাতে রামনি শহরে সাউথ ব্রাঞ্চ ইন হোটেলে দুটা রুম রিজার্ভ করল। জানালা দিয়ে সূর্যাস্ত, সন্ধ্যার আভা দেখতে থাকল সায়রা বানু। এত স্বাধীন ভাবে এসব দৃশ্য দেখতে পাবে ভাবতে পারছে না।
পথে ভার্জিনিয়ার উইনচেষ্টার শহরে থেমে ডিনার করল। ঠিক হলো সব খরচ দুজনে মিলে অর্ধেক করে দেবে।
হোটেলে যখন পৌঁছল তখন সন্ধ্যা রাত হয়েছে। রুমে জিনিস পত্র রেখে লাউঞ্জে বসে আবার গল্প করতে চাইল সায়রা বানু। রাতের আলো-আঁধার, বাইরের পাহাড়ি দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছে।
লাউঞ্জে বসে রঘুনাথ রেড্ডিকে ফোন করল নাদিম। পাশে থেকে ওদের কথা শুনতে থাকল সায়রা বানু।
— হ্যালো, নাদিম। বলল রঘুনাথ রেড্ডি।
— হ্যালো, মিস্টার রেড্ডি। হাউ আর ইউ?
— আই এম ফাইন। থ্যাংক ইউ। রেজুমে, ফরওয়ার্ডিং লেটার পড়ে দেখেছ? সাইন করে দাও, আগামীকাল এমপ্লয়ারের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
— আমার একটু প্রশ্ন ছিল। একটু দ্বিধা নিয়ে বলল নাদিম।
— বলো কী প্রশ্ন?
— রেজুমেতে কিছু অভিজ্ঞতা লেখা আছে যেগুলো সত্যি নয়।
— যেমন?
— আমার সামার ইন্টার্নের অভিজ্ঞতাগুলো সত্যি নয়। কোনো কম্পিউটার সিস্টেমের “পেন টেস্ট” কিংবা “সিমুলেটেড এটাক” করার অভিজ্ঞতা আমার নেই। এগুলো কী জিনিস জানি, এই পর্যন্তই। অন্য এক জায়গায় লেখা আছে, সাইবার সিকিউরিটিতে আমার “অডিট” এবং “কমপ্লায়েন্স” পরীক্ষা করে দেখার অভিজ্ঞতা আছে। এটাও ঠিক নয়। এই রকম কিছু আমি লিখতে চাচ্ছি না। এছাড়া কয়েকটা রেফারেন্স দেয়া আছে যাদের আমি চিনি না।
খুব নরম গলায় কথাগুলো বলল নাদিম। অনেক কষ্ট করে এসব লিখেছে রঘুনাথ, ওকে আপসেট করতে চায় না।
— বুঝতে পারছি তুমি কী বলছ। রেফারেন্সে যাদের নাম দেয়া আছে, তাদের কাছে তোমার রেজুমে দেয়া হবে, খোঁজ নিতে কেউ ফোন করলে ওরা কনফার্ম করে দেবে। আজকাল রেজুমেকে “ইনফ্লেট” করা খুব সাধারণ কাজ, একশ রেজুমে দেখলে আশিটাই হয়ত “প্যাডেড” হবে।
আই টি সেক্টরে আমেরিকাতে কী হচ্ছে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করল রঘুনাথ রেড্ডি।
— দেড় বছর আগে আমি পাশ করেছি, বেশি “ইনফ্লেট” করলে বোঝা যাবে। যতটুকু সত্যি ততটুকু লিখতে চাই।
নাদিমের কথা শুনে এবার হাসল রঘুনাথ রেড্ডি। সহানুভূতির স্বরে বলল, তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু তুমি কম্পিট করবে এরকম “প্যাডেড” রেজুমের সাথে। অ্যাপ্লিকেশন সাবমিট করলে চাকরিটা খুব সম্ভব হয়ে যেত। একটু চিন্তা করে দেখ।
চুপ করে থাকল নাদিম।
আরো সহানুভূতি দেখিয়ে রঘুনাথ বলতে থাকল, শোন, আমেরিকা পঁয়ষট্টি হাজার এইচ ওয়ান বি ভিসা দেয়, তার সেভেনটি পারসেন্ট ইন্ডিয়ান সিটিজেনরা পায়। চায়না ডিসট্যান্ট সেকেন্ড, মাত্র দশ পারসেন্ট পায় চাইনিজ লোকজন। অ্যাপলিকেশন কীভাবে ফাইল করতে হয় আমরা জানি। তুমি সাইন করে দাও, কিছু হবে না।
তবু দ্বিধা করল নাদিম। তার বস জেমস ওয়ার্ড রেজুমেতে মিথ্যা লিখতে নিষেধ করেছিল। ভদ্রলোক রিপাবলিকান, ওবামা এডমিনিস্ট্রেশনের আউটসোর্সিং পলিসি মোটেই পছন্দ করত না। বলত, “এইচ ওয়ান বি ভিসার জন্য লটারি সিস্টেম করায় নানা রকমের করাপশন হচ্ছে। বেশ কয়েকটা ইন্ডিয়ান কোম্পানি করাপশন করে ধরা পড়েছে, বিশাল ফাইন দিয়েছে। গুগোল করলেই দেখতে পাবে। কখনো রেজুমেতে ফ্রড করো না।“
চিন্তায় পড়ল নাদিম। বলল, আমাকে একটু ভাবতে হবে। তোমাকে পরে জানাব।
— ঠিক আছে। ভেবে দেখ। ফোন রেখে দিল রঘুনাথ।
মন খারাপ করে বসে থাকল নাদিম। অ্যাপ্লিকেশন জমা দিলে হয়ত চাকরিটা পেয়ে যেত।
সায়রা বানু জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
— আমার যোগ্যতা সম্পর্কে একটু মিথ্যা লিখলে চাকরি পেতে সুবিধা হয়। কিন্তু আমি বাড়িয়ে লিখতে চাই না।
— মিথ্যা লিখ না। তুমি সে রকম না।
— থাক এসব কথা। কেমন লাগছে এখানে এসে?
— খুব ভালো।
— ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য কাল একটা ট্রেন রাইড নেব। পটোম্যাক ঈগল সিনিক ট্রেন রাইড। টিকিট বুক করতে কাউন্টারের মেয়েটা অনেক হেল্প করেছে।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে যে যার রুমে ঘুমাতে গেল। পরদিন আবার ব্রেকফাস্টে দেখা হলো।
— তিন ঘণ্টার রাইড, দশটা থেকে একটা পর্যন্ত। বলল নাদিম।
ট্রেন ষ্টেশন এবং আশপাশটা ভিউ কার্ডের ছবির মতো সুন্দর। ঝিক-ঝিক শব্দ করা ডিজেল ইঞ্জিনের লকোমোটিভ। ঢং ঢং করে বেল বাজিয়ে চলতে শুরু করল ট্রেন। রোড ক্রসিং এলে আগের দিনের মতো কু-উ-উ শব্দে হুইসল দিচ্ছে।
যার যার সিট রিজার্ভ করা। পাশাপাশি বসল দুজন। কখনো পাহাড়ের পাশ দিয়ে, কখনো পটোম্যাক নদীর উপর দিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। পাহাড়গুলো ঘন সবুজে ঢাকা।
মুগ্ধ হয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে থাকল সায়রা বানু। তিনঘণ্টা পর যখন রাইড শেষ হলো ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। সায়রা বানুর খুশি, উচ্ছলতা দেখে বুঝতে পাড়ল, এই আমেরিকাতেও অনেক মেয়ে ঘরে বন্দী জীবন যাপন করে। মুক্ত স্বাধীন জীবন কী এদের জানা নেই। গতকাল দুপুরে ভয়ে কাঁপছিল যে মেয়েটা, এখন সে সম্পূর্ণ দুশ্চিন্তা মুক্ত, স্বাধীন।
গাড়িতে এসে নাদিম বলল, এখন এপার্টমেন্টে ফিরে যাই?
— যাও। ভয় অনেক কমে গেছে।
গাড়ি হাই ওয়েতে উঠতেই সায়রা বানু বলল, একটা অনুরোধ করতে পারি?
— করো।
— আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে, মেহেরবানী করে আমাকে গাড়ি চালানো শেখাবে? আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।
এমন করে কেউ অনুরোধ করলে এড়িয়ে যায় কী করে? তবু নাদিম বলল, গাড়ি চালানো শেখা তো অনেক দিনের ব্যাপার। প্রথমে লারনার্স পারমিট নিতে হবে। তারপর একটা ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হতে হবে। কারো সাথে রাস্তায় গাড়ি চালাতে হবে।
— সামান্য একটু সাহায্য করলে আমি সব পারব। সপ্রতিভ ভাবে বলল সায়রা বানু।
— নিউ ইয়র্ক থেকে ঘুরে আসি, তারপর এই নিয়ে কথা বলি? কথা না দিয়ে ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখতে চাইল নাদিম।
— নিউ ইয়র্ক যেতে হবে কেন? একা একা আমার ভয় করে। মলিন মুখে বলল সায়রা বানু।
— ব্যক্তিগত কারণ।
— আমাকে সাথে নেয়া যাবে?
হাসল নাদিম। বলল, তোমার মতো আমার বিয়ের জন্যও কনে দেখা হচ্ছে। এই মেয়েটা বাংলাদেশি, কিন্তু আমেরিকান সিটিজেন। ওর বাবা-মা বাংলাদেশের ছেলে খুঁজছে। পছন্দ হলে পারিবারিক ভাবে কথা আগাবে।
— ওহ। মলিন মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল সায়রা বানু।
মলিন মুখ দেখে খারাপ লাগল। আর এড়িয়ে যেতে পাড়ল না নাদিম। বলল, ঠিক আছে, একদিন সকালে যাবো, সন্ধ্যায় ফিরে আসব। লারনার্স পারমিটের জন্য তুমি একটা এপয়েন্টমেন্ট করো। নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি করে দেব।
এবার ভীষণ খুশি হলো সায়রা বানু। বলল, আমার সাথে বন্ধুর মতো ব্যবহার করেছে এমন পুরুষ মানুষ কড়ে আঙুলে গোনা যায়। তুমি তাদের একজন। শুকরিয়া, বহত শুকরিরা, নাদিম।
— ইউ আর ওয়েলকাম।
সায়রা বানুর নাদিম উচ্চারণ আর সবার থেকে আলাদা। “দ” এর উচ্চারণ কেমন যেন। সায়রা বানু নাদিম ডাকলে নামটাকে ভীষণ রোমান্টিক লাগে।
বুঝতে পারছে আস্তে আস্তে সায়রা বানু ওর জীবনে জড়িয়ে যাচ্ছে। চাকরি থাকলে একটা অজুহাতে হয়ত না করে দেয়া যেত, কিংবা পাশ কাটিয়ে যাওয়া যেত, কিন্তু এখন হাতে অঢেল সময়। কিছুটা সময় সায়রা বানুকে দিলে কোনো ক্ষতি হবে না। এই সব ঘটনা বাড়িতে জানলে আব্বা-আম্মা চিন্তা করবে, হয়ত বিরক্ত হবে। কিন্তু অসহায় একটা মেয়েকে পথে ফেলে দেয়া নাদিমের পক্ষে সম্ভব নয়।
সায়রা বানু উর্দু উচ্চারণে নাদিম আখতার এত সুন্দর করে ডাকে যে বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। মনের কিছু পরিবর্তন নীরব অন্ধকারে টের পাওয়া যায়, গাড়ি চালাতে চালাতে উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু কাউকে বলে বোঝানো যায় না। এই ভালোলাগা একান্তই আপন, একান্তই নিজের উপলব্ধি। এমন হলে ভয় ডর কমে যায়। মনে হয় অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারব। একটি বারও ভাবার সময় হয় না যে “হ্যালো” কত সহজে “গুডবাই” হয়ে যেতে পারে।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে