নিভৃত পূর্ণিমা পর্ব-০৭

0
301

নিভৃত পূর্ণিমা – ৭
সোফিয়ার সাথে দেখা করার প্রায় এক সপ্তাহ পর এক রাতে ঘুমানোর আয়োজন করছিল নাদিমের খালাম্মা, এমনি সময় ফোন করল নাজমা।
— কী রে! কী খবর? শুয়ে পড়ে আলসেমি ভরা গলায় ফোন ধরল খালাম্মা।
— সপ্তাহ খানেক তো হলো, নাদিম ছেলেটার সাথে তোর কথা হয়েছিল? ফিরে যেয়ে তোকে কিছু বলেছে? অনেক আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল নাজমা।
নাজমার ফোন পেয়ে, প্রশ্ন শুনে মোটেই অবাক হলো না খালাম্মা।
— আমি নিজে থেকে নাদিমকে ফোন করেছিলাম। আন্তরিক গলায় জানাল খালাম্মা।
— সোফিয়ার সম্পর্কে কিছু বলেছে? ওর আগ্রহ কেমন? কিছু বুঝতে পারলি?
— সোফিয়ার সম্পর্কে ভালো বলেছে। দেখা করা পর্যন্ত সব কিছু তো পারিবারিক ভাবে হয়েছে। এখন বল, তোরা কী ভাবছিস?
— ছেলেটাকে আমার ভালো লেগেছে। আগ্রহ দেখিয়ে বলল নাজমা।
— বিয়ে তো তোর না। এত শান্ত গলায় মন্তব্য করল খালাম্মা যে একদম চুপ হয়ে গেল নাজমা। সোফিয়ার কী চায় সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
— ছেলেটা সম্পর্কে সোফিয়া মন্দ কিছু বলেনি। কোনো রকমে জবাব দিল নাজমা।
— ওরা নিজেরা কি কথা বলছে? সব জেনেও প্রশ্ন করল খালাম্মা।
— না, ওরা কথা বলছে না। ফোন নাম্বার দেয়া-নেয়া হয়নি।
— সোফিয়ার ইচ্ছে কী? কিছু জানিস?
— হ্যাঁ বা না কোনটাই বলেনি।
— একটা ছেলে মেরিল্যান্ড থেকে দেখে করতে এসেছিল। হ্যাঁ বা না কোনটাই না বলা মানে “না” এর দিকটাই বেশি ভারি। এটা আমি বুঝতে পারছি। এখন তোরা বুঝতে পারলে ভালো হয়।
— এরকম করে কথা বলছিস কেন?
— নাদিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ফোন নাম্বার চাওনি কেন? বলল, আগে চাকরি খুঁজব, পরে অন্য কাজ।
— ঠিক বুঝতে পারছি না কী বোঝাচ্ছিস? এবার হতাশ শোনাল নাজমার গলা।
— বলছি তোর আগ্রহ বেশি। আমার বা তোর আগ্রহে কিছু হবে না। ছেলেটা দেখা করতে এসেছিল, সম্পর্কটা একটু এগিয়ে রাখতে পারলে ভালো হতো।
সামান্য হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলল খালাম্মা, তারপর একদম চুপ করে গেল। নাজমা নিজেও বুঝতে পারছে না কী বলবে।
— বুঝেছি। দেখি কী করতে পারি।
মায়ের মন, সামান্য একটু আশা নিয়ে ফোন করেছিল, যদি নাদিম ফোন নাম্বার চেয়ে থাকে। কিন্তু তা হয়নি। আর কথা না বাড়িয়ে ফোন রাখল নাজমা।
ঘুমাতে যেতেই প্রশ্ন করল খালু, ওদের উপর রাগ করছ কেন? ছেলে-মেয়ে দেখা হওয়া মাত্র বিয়ে করতে রাজি না হলে ঘটকদের রাগ হয়। কমবেশি সব ঘটকদের এটাই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
— রাগ করব কেন? স্বামীর সাথে অযথা তর্ক করার ইচ্ছেই হলো না খালাম্মার। বলল, আফসোস লাগছে।
— তোমার আফসোস লাগার কি হলো?
— ছেলেটা দেশে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়েছে, এদেশে ব্যাচেলর্স করেছে। স্বভাব-চরিত্র ভালো ছিল। একে পছন্দ না করার কী কারণ থাকতে পারে? সোফিয়া এদেশের সিটিজেন, এ ছাড়া আহামরি আর কি আছে ওদের?
— যারা এই দেশে বড় হয়েছে, তারা বাংলাদেশের ছেলেদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি দেয় না। ওরা চায় এদেশে জন্ম, সেটেল্ড বাঙালি ছেলে।
— এদেশে জন্ম, সেটেল্ড বাঙালি ছেলেরা আরো কোয়ালিফাইড, আরো সুন্দরী চাইনিজ, ইন্ডিয়ান মেয়ে ডেট করে, ওদের কাউকে বিয়ে করে ফেলে। যার তকদীরে লেখা নেই, সে হেলায় এমন সুযোগ হারায়।
— কেন বলছ এই কথা?
— অনেক আগ্রহ নিয়ে এসেছিল ছেলেটা। নিশ্চয়ই “ক্লিক” করেনি। ফিরে গিয়ে আরো বেশি ডিটারমাইন্ড হয়েছে যে তাকে চাকরি পেতে হবে। নিউ ইয়র্ক এসেছিল, কোনো একটা অজুহাতে ছেলেটাকে চেনার চেষ্টা করতে পারত সোফিয়া। এই সুযোগটা হারালো।
— তুমি যেভাবে চিন্তা করো, এ দেশের ছেলেমেয়েরা সেভাবে চিন্তা করে না।
— তা করে না। সোফিয়ার হোম কোর্ট এডভান্টেজ আছে। এখনও যদি আগায় হয়ত কিছু একটা হবে। কিন্তু দেখবা চুপ করে বসে থাকবে। চোখের সামনে আরেকটা মেয়ে ছেলেটাকে নিয়ে যাবে। এদিকে বাবা-মা চিন্তায় ঘুমাতে পারে না।
এই মন্তব্যের জবাব দিতে পাড়ল না খালু। আর কথা না বাড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল খালাম্মা। কিন্তু ঘুম আসছে না। একটা ছেলেকে দেখতে আসতে রাজি করানো খুব সহজ কাজ না। তারপর যদি দেখা যায় নির্লিপ্ত ব্যবহার, তখন ভীষণ বিরক্ত লাগে।
***
লাইসেন্স পরীক্ষার জন্য কিছুদিন হিন্দি সিরিয়াল দেখা কমিয়ে দিয়েছিল সায়রা বানু। এখন সন্ধ্যা হলেই আবার টিভি নিয়ে বসে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে টেলিভিশনের দিকে চোখ ফেরায় নাদিম, কিন্তু মন থাকে ল্যাপটপে। হঠাৎ খেয়াল করল টেলিভিশনের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে। ফিরে তাকাল নাদিম। সিরিয়াল থামিয়ে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সায়রা বানু।
— তুমি পড়ালেখা খুব পছন্দ করো, না? জিজ্ঞেস করল সায়রা বানু।
— কেন জিজ্ঞেস করছ এই কথা? পালটা প্রশ্ন করল নাদিম।
— দুই বার জিজ্ঞেস করলাম, চা খাবে? শুনতে পাওনি।
— ওহ, সরি। পড়ালেখা পছন্দ করি না, কিন্তু এখন এ ছাড়া করার আর কিছু নেই।
— পড়ালেখা আমার একদম পছন্দ না। কিশোরীর মতো ঠোঁট উলটে অভিযোগের স্বরে বলল সায়রা বানু।
— কী করতে ইচ্ছে করে? মজা পেয়ে প্রশ্ন করল নাদিম।
— ঘর সংসার করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার আগে নিজের পায়ে দাঁড়াব। আলট্রাসাউন্ড টেকনোলোজিতে দুই বছরের ডিগ্রি নেব। কোনো ডাক্তারের অফিসে মেডিক্যাল এসিস্ট্যাট হবো। এলিকট সিটিতে অনেক ইন্ডিয়ান মহিলা ডাক্তার আছে।
— এই খবর কোথায় পাও?
— নিউ জার্সিতে মহিলা ডাক্তারের অফিসে কাজ করতাম। আমার কাজ দেখে এই উপদেশ দিয়েছিল।
এমনি সময় আম্মা ফোন করল। সায়রা বানুকে বলল, একটু আসছি। ঘরে বাইরে এসে ফোন ধরল নাদিম। হাঁটতে হাঁটতে গাড়িতে এলো।
— কী খবর আম্মা?
— তুই কোথায়?
— এই ঘরের বাইরে। কেমন আছো তোমরা?
— আমরা সবাই ভালো। তোর কী খবর?
— চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইন্টার্ভিউ দিচ্ছি। একটা কিছু হয়ে যাবে। আম্মাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল নাদিম।
— তোর জন্য সব সময় দোয়া করছি। খতমে খাজেগান পড়ছি। ইনশাআল্লাহ্‌ একটা উপায় হবে। নিউ ইয়র্কের মেয়েটাকে কেমন মনে হলো?
— দেখা হয়েছে কিন্তু কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম।
— কেন রে?
— মেয়েটা দেখতে শুনতে খারাপ না। ব্যবহার ভালো। কিন্তু ভাব দেখে মনে হলো জাস্ট দেখা করতে এসেছিল।
— প্রথম দিন এরকম তো হবেই।
— হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে খালাম্মা মেয়ে পক্ষের আগ্রহের কথা বাড়িয়ে বলেছে। যা বললে একটা ছেলে দেখতে যাবে, সেভাবে কথা বলেছে। এই জেনারেশনের ছেলেমেয়ের সাথে বাবা-মায়ের জেনারেশনের অনেক গ্যাপ আছে।
নাদিমের আম্মা চুপ করে থাকল। কথা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটা তেমন আগ্রহ দেখায়নি। অথচ নিউ ইয়র্ক থেকে নাদিমের খালা ভাব দেখিয়েছিল যে মেয়ের বিয়ের চিন্তায় বাবা-মা রাতে ঘুমাতে পারে না, হন্যে হয়ে একটা ভালো ছেলে খুঁজছে। নাদিমের চেয়ে ভালো ছেলে কারা? ঠিক বুঝে উঠতে পাড়ল না নাদিমের আম্মা।
দুজনেই চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।
— এখন রাখি, আম্মা? এক সময় মৃদু গলায় বলল নাদিম
— আচ্ছা, রাখ। বেশি চিন্তা করিস না।
— আচ্ছা। কথা শেষ করে, মেইল চেক করে ঘরে ফিরে এলো নাদিম। মেরিল্যান্ড মোটর ভেহিকল অফিস থেকে সায়রা বানুর চিঠি এসেছে। প্রথম দিন একটা কাগজ প্রিন্ট করে দেয়, ওটা সাময়িক লাইসেন্স। আসল লাইসেন্স পরে মেইল করে।
— আম্মা ফোন করেছিল। কিছু প্রাইভেট কথা ছিল, এই জন্য বাইরে কথা বললাম। সরি। ঘরে ঢুকে বলল নাদিম।
— না, না । ঠিক আছে। বলল সায়রা বানু।
— এটা তোমার। চিঠি এগিয়ে দিল নাদিম। দ্রুত খুলল সায়রা বানু। লাইসেন্স দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। বাড়ি থেকে বাইরে এসে, একা একা এই প্রথম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে।
নাদিম গল্প করার মুডে আছে দেখে প্রশ্ন করল, চা দেই?
— চা? দাও। আমি হেল্প করি?
— না, হেল্প লাগবে না। রান্না ঘরে গেল সায়রা বানু। কি যেন ভাজি করার শব্দ পাওয়া গেল। কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে এলো। সাথে চারটা সিঙ্গারা ভেজেছে। আমেরিকাতে বলে পাঞ্জাবী সমোসা।
— সমোসা কোথায় পেলে?
— ঘরে বানানো। রান্না করতে আমি খুব পছন্দ করি।
— অনেক, অনেক ধন্যবাদ। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল নাদিম। যত সহজে লাইসেন্স পেলে, তা দেখে বুঝতে পারছি টেকনিক্যাল ডিগ্রি নিতে বেশি কষ্ট হবে না।
— তুমি কী খুব ব্যস্ত? কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি? মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করল সায়রা বানু।
— না। বলো? ল্যাপটপ বন্ধ করল নাদিম।
— আমি এপার্টমেন্টের ভাড়া দেই?
— ভাড়া দিতে চাও? যদি আমাকে কথায় হারাতে পারো, তাহলে দিও।
— কেন ভাড়া দেব না?
— ভাড়া দিলে তোমার যত ভালো লাগবে, ভাড়া নিতে আমার তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগবে। বলেছি না, তুমি আমার গেস্ট? মনে করব তুমি সহজ হতে পারছ না।
— ঠিক আছে, এই কথা আর তুলব না। আরেকটা কথা, আমি না ইংরেজিতে খুব বেশি কাঁচা না। কাজ চালানোর মতো জানি।
কেন যেন হাসি পেলো নাদিমের। মৃদু হেসে বলল, তাহলে যে বলেছিলে, “স্পিক নো ইংলিশ, অনলি রাজস্থানি।“
একটু ম্লান হলো সায়রা বানুর মুখ। বলল, তোমাকে ওভাবে বলা ভুল হয়েছিল।
ম্লান মুখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলতে থাকল, একটা মেয়ের একা থাকতে গেলে অনেক অসুবিধা, অনেক ভয়। অযাচিত আলাপ এড়াতে হলে এই বুদ্ধি খুব কাজে দেয়। তখন তোমাকে চিনতাম না, ভয়ে ওই কথা বলেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি তুমি শিক্ষিত, ভদ্র ছেলে। তোমার মতো ভালো ইংরেজি বলতে পারি না। কিন্তু অত বেশি খারাপও না।
এবার হেসে ফেলল নাদিম। বলল, এক সময় আমার সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু কিছু বলিনি। ভাঙ্গা ইংরেজিতে কথা বলার অভিনয় শিখলে কোথায়?
এবার হেসে ফেলল সায়রা বানু। বলল, নিউ জার্সিতে এক কোরিয়ান মহিলা কাজ করত। ও বলত, “নো ইংলিশ, অনলি কোরিয়ান।“ আমরা অনেকে ওকে নকল করে কথা বলতাম। সত্যি কিছু মনে করোনি তুমি? আমি সরি।
— না, কিছু মনে করিনি। লাইসেন্স পরীক্ষার পর ধারণা হয়েছিল তুমি ইংরেজিতে ভালো। আমার সাথে কথা বলতে চাও না, তাই ইংরেজি না জানার ভান করো।
— না, সেটা কারণ না। প্লিজ, কিছু মনে করো না। আন্তরিক গলায় অনুরোধ করল সায়রা বানু।
— না। কিছু মনে করিনি। আর কোন কোন ভাষা জানো?
— রাজস্থানি, হিন্দি, উর্দু। লাজুক মুখ করে জবাব দিল সায়রা বানু।
— যাক, শুনে ভালো লাগল।
— তোমার মন খারাপ কেন?
— কে বলেছে আমার মন খারাপ?
— আমি দেখতে পাই না?
— সারাক্ষণ চাকরির চিন্তা করি। তুমি মনে করো মন খারাপ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এক সময় সায়রা বানু প্রশ্ন করল, ড্রাইভিং প্র্যাকটিস করার জন্য এখন কী করতে হবে?
— ওহ, তাই তো। তোমার ড্রাইভিং এর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
সায়রা বানুর লাইসেন্স ক্লাসে ভর্তির কথা সত্যি ভুলে গিয়েছিল নাদিম। গত শুক্রবার জুম্মা নামাজের পর গ্রেগ’স ড্রাইভিং স্কুলে গিয়েছিল দুজন। বাসার কাছে বাল্টিমোর পাইকের উপর অফিস। পাশে বার্গার কিং এর একটা রেস্টুরেন্ট। লোকজন বলে দিল, এখানে শুধু ইন-পারসন ট্রেনিং দেয়া হয়। অন লাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। সায়রা বানুকে নাদিম বলছিল, বাসায় যেয়ে ল্যাপটপে রেজিস্ট্রেশন করে দেব। কিন্তু বাসায় এসে ভুলে গেছে নাদিম। সায়রা বানু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল। সাতদিনের বেশি অপেক্ষা করে আজ কথাটা তুলল।
চা খাওয়া শেষ করে কাপ-পিরিচ কিচেনে রেখে এলো নাদিম। ল্যাপটপ খুলে গ্রেগ’স স্কুলের ওয়েব সাইটে যেয়ে সব ঠিক করে বলল, নাও, এবার তুমি ফর্ম ফিলআপ করে ফেলো।
নিজে নিজে রেজিস্ট্রেশন করল সায়রা বানু।
— কী করতে বলেছে? ল্যাপটপের কাজ শেষ হতে জিজ্ঞেস করল নাদিম।
— রেজিস্ট্রেশন ফি সাড়ে তিনশ ডলার। দশ দিন অন লাইন ক্লাস হবে, প্রতিদিন তিন ঘণ্টার ক্লাস। ইন-পারসন ট্রেনিং হবে তিন দিন। আমি গাড়ি চালানো শেখার পর ইন-পারসন ক্লাসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে।
— গাড়ি চালাতে হলে ইসুরেন্সে তোমার নাম যোগ করতে হবে। কাল সকালে ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে ফোন করব। আর কিছু?
— এখন আর কিছু করতে হবে না।
টেলিভিশন থেমে ছিল, আবার খুশি মনে সিরিয়াল দেখা শুরু করল সায়রা বানু। এবার নাদিমও যোগ দিল। গল্পটা রাজস্থানের জয়পুরের একটা পরিবারকে ঘিরে। বাড়ির মেয়েটা ডাক্তার হওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু পদে পদে নানা রকম বাধা পাচ্ছে। কিছুক্ষণ দেখে আবার ল্যাপটপে চোখ ফেরাল নাদিম।
রাতে যার যার সময় মতো ঘুমাতে গেল। পরদিন একই ভাবে সকাল হলো। প্রতিদিন ভোরে সায়রা বানু একই সুরা পড়ে।
নাস্তা করে ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে ফোন করল নাদিম। যে মেয়েটা ফোন ধরল, সে এত সুন্দর করে, এত মিষ্টি গলায় কথা বলে, ব্যবহার এত ভালো যে মনে হয় বিনা কারণে কিছুক্ষণ কথা বলি। স্পিকারে কথা বলতে থাকল নাদিম, যেন সায়রা বানু শুনতে পায়।
মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ, স্যার।
— আমার অটো ইনস্যুরেন্সে একজনকে অ্যাড করতে চাই।
নাম এবং ফোন নাম্বার নিয়ে নাদিমের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে, যাকে নূতন ড্রাইভার হিসাবে যোগ করা হবে তার নাম এবং লাইসেন্স নাম্বার দিতে বলল। স্পিকার মিউট করে সায়রা বানুর লাইসেন্স চাইল নাদিম। এক দৌড় দিয়ে বেডরুম থেকে লাইসেন্স এনে দিল সায়রা বানু।
নাম এবং নাম্বার পড়ল নাদিম। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল মেয়েটা। তারপর জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার সাথে তোমার সম্পর্ক কী?
থতমত খেয়ে গেল নাদিম। কী বলবে বুঝতে পাড়ল না।
— এটা বলতে হবে কেন? প্রশ্ন করল নাদিম।
— গার্ল ফ্রেন্ড বা ফীআনসে হলে সহজেই অ্যাড করা যায়। এটা একটা অলিখিত নিয়ম। আমি সরি, এই প্রশ্নটা করতে হচ্ছে।
— গার্লফ্রেন্ডও না, ফীআনসেও না। জাস্ট ফ্রেন্ড। বলল নাদিম।
ইনস্যুরেন্সের মেয়েটা চুপ করে থাকল। নিঃসীম নীরবতা নেমে এলো ঘরে। হয়ত সায়রা বানুকে ইনস্যুরেন্সে যোগ করা যাবে না।
কিছুক্ষণ পর প্রশ্ন করল ইনস্যুরেন্সের মেয়েটা, তোমরা কি একই এপার্টমেন্টে থাক? মানে একই ছাদের নীচে থাক?
— হ্যাঁ। আমরা একই ছাদের নীচে থাকি। বলল নাদিম।
— তাহলেও চলবে। আমি তোমার ফ্রেন্ডকে অ্যাড করছি।
— কোন অতিরিক্ত ফি দিতে হবে?
— না। লারনার্স পারমিটের জন্য ইনস্যুরেন্স রেট বাড়বে না। কিন্তু “ফুল ড্রাইভার” হলে তখন ইনস্যুরেন্স বাড়তে পারে।
শ্বাস ছাড়ল সায়ার বানু। ভেবেছিল ড্রাইভিং শিখতে বাধা আসছে বুঝি। এখন হালকা বোধ করছে।
সায়রা বানুকে ইনস্যুরেন্সে অ্যাড করে ফোন কেটে দিল নাদিম। ওয়েব পেজ থেকে নূতন ইনস্যুরেন্স কার্ড প্রিন্ট করল। এবার ড্রাইভারের লিস্টে নাদিম এবং সায়রা বানু, দুজনের নাম দেখাচ্ছে।
কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সায়রা বানু। নাদিম তাকেতেই চোখ ফিরিয়ে নিল।
— কী ভাবছ? প্রশ্ন করল নাদিম।
— ভাবছি না। দেখছি? মৃদু গলায় বলল সায়রা বানু।
— কেন?
— তুমি যতটা সম্ভব ধর্ম মেনে চলো। আমি থাকি বলে বেডরুমে যাও না, সোফায় বসো না। শুধু পড়ার টেবিলের আশেপাশে থাক। অথচ তোমার সাথে থাকছি বলে খালাম্মা বলছিল, আমি বংশের লজ্জা।
— এসব কথা বলে কী লাভ?
— আমার কাজিন, মানে খালাম্মার ছেলের গার্লফ্রেন্ড আছে, সে ড্রিঙ্ক করে। তখন বংশের লজ্জা হয় না?
— তোমার কাজিন, মানে যে তোমাকে নিতে এসেছিল?
— হ্যাঁ।
সায়রা বানুর কথায় অবাক হলো না নাদিম। এমন অনেক দেখেছে। জিজ্ঞেস করল, তোমার খালাম্মা জানেন?
— বাড়িতে গার্ল ফ্রেন্ড আনে না। কিংবা বাড়িতে ড্রিংক করে না। কিন্তু আমরা সবাই জানি। নিজের ছেলের বিষয় হলে চোখে পড়ে না। ।
— এগুলো নিয়ে ভেবো না। তোমার প্লান মতো এগিয়ে যাও। নিজের পায়ে দাঁড়াও।
কিছুক্ষণ পর মিশেল ময়নিহানের ইমেইল এলো। লিখেছে, একটা মুখোমুখি ইন্টার্ভিউ দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা সে চেষ্টা করছে। কোম্পানির নাম বুজ-অ্যালেন-হ্যামিল্টন। যে লোকটা হায়ারিং ম্যানেজার, তার নাম ডেভিড ওয়েব। লোকটার লিঙ্কড ইন আইডি পাঠিয়েছে। এই কোম্পানি এবং ডেভিড ওয়েব সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব পড়তে হবে, যেন ডেভিড এবং এই কোম্পানি কী ধরণের কাজ করে সে সম্পর্কে নাদিমের ভালো ধারণা থাকে।
একটা জিনিস খেয়াল করল নাদিম, মিশেল শ্বেতাঙ্গ প্রধান কোম্পানির সাথে কাজ করে। যেন শ্বেতাঙ্গ কোম্পানির নিজস্ব শ্বেতাঙ্গ রিক্রুটর আছে।
প্রবল উৎসাহ নিয়ে ড্রাইভিং এর অন লাইন ক্লাস শুরু করল সায়রা বানু। দেড় সপ্তাহের মধ্যে সবগুলো কোর্স শেষ করে ফেলল। এখন গাড়ি নিয়ে কোনো একটা পারকিং লটে প্র্যাকটিস করতে হবে। কোথায় যাওয়া যায় চিন্তা করতে থাকল নাদিম। খুব বড় এবং খোলামেলা জায়গা দরকার। যেন কোথাও গাড়ি ধাক্কা না লাগে।
এদিকে অনেক চেষ্টার পর নাদিমের ইন্টার্ভিউর ডেট পেলো মিশেল। অফিসটা এলিকট সিটির কাছে কলাম্বিয়া শপিং মলের পাশে। যেদিন সকালে স্যুট পরে বের হবে, কিচেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাদিমের টাই পরা দেখল সায়রা বানু। এরকম একটা ভদ্র, শিক্ষিত ছেলে এভাবে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে বিষয়টা তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। বলল, দাঁড়াও, নাদিম।
কাছে এসে কী সব দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে বলল, ফি আমানুল্লাহ। এবার যাও।
অনেক সময় নিয়ে ইন্টার্ভিউ নিল ডেভিড ওয়েব। নাদিমের অনেক প্রশংসা করল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বলল, ওদের যে রকম প্রজেক্ট, তাতে আরো অভিজ্ঞ লোক দরকার।
নাদিম অনেক করে অনুরোধ করাতে কতগুলো রেজুমে দেখিয়ে বলল, ওখান থেকে একটা নাও।
একটা টেবিলে সাত-আটটা বায়ো ডাটা স্তূপ করে রাখা ছিল। আন্দাজে একটা টেনে নিল নাদিম।
ডেভিড বলল, জাস্ট পড়ে দেখ কী রকমের লোকজন ইন্টার্ভিউ দিচ্ছে।
ভালো করে রেজুমেটা পড়ল নাদিম। পাঁচ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা লোকটার। কিন্তু এমনভাবে লিখেছে যে পড়লে মনে হয় সাইবার সিকিউরিটিতে জানে না এমন কোনো কাজ নেই। একটু হলেও “প্যাডেড” রেজুমে।
কি বলবে কথা খুঁজে পেলো না নাদিম। একে বাদ দিয়ে নাদিমকে নেয়ার প্রশ্নই আসে না।
নাদিমকে সামলে নেয়ার সময় দিল ডেভিড ওয়েব। তারপর বলল, এগুলো রিজেক্টেড রেজুমে। শর্ট লিস্টে আসেনি। আমি মিশেলের পছন্দের দাম দেই। ও ভালো ক্যান্ডিডেট পাঠায়। তোমার রেজুমে রেখে দিলাম। অনেক সময় তোমার লেভেলের লোক দরকার হয়, তখন ডাকব। আজ আমি সরি।
হতাশা নিয়ে বাইরে এলো নাদিম। সাথে সাথে ঘরে না ফিরে অনেকক্ষণ শপিং মলে বসে থাকল। মন একটু ভাল হলে ফিরতে হবে। এক সময় উঠল নাদিম। দমলে হবে না। মিশেলকে সব কিছু জানাতে হবে। মহিলা জান দিয়ে চেষ্টা করছে, তাকে আপটুডেট রাখতে হবে।
ওকে দেখেই বুঝতে পাড়ল সায়রা বানু। খবর ভালো না। কিন্তু ওই মুহূর্তে কিছু জিজ্ঞেস করল না। বলল, চলো, লাঞ্চ করি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
সহজ স্বাভাবিক থেকে লাঞ্চ করল নাদিম। কিন্তু গিলতে কষ্ট হচ্ছিল। উলটে আসতে চায়।
সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে সায়রা বানু বলল, মন খারাপ করো না, নাদিম। ধৈর্য রাখ, একটা না একটা কিছু হবেই।
কিন্তু কাজ হলো না। চুপ মেরে থাকল নাদিম। একটু পর বলল, একটা ভালো জায়গা পেয়েছি। আগামীকাল সকালে ড্রাইভিং শেখাতে নিয়ে যাব। কাল থেকে গাড়ি চালাবে তুমি। অন্তত একটা কাজ ঠিক মতো হোক।
“অন্তত একটা কাজ ঠিক মতো হোক” বলার অর্থ কী বুঝতে পাড়ল সায়রা বানু। একটু একটু করে বিষণ্ণতায় ডুবে যাচ্ছে নাদিম। বিষণ্ণতা কী জিনিস সায়রা বানুকে বোঝাতে হবে না। চুপ করে চা খেতে থাকল। শুধু বলল, শুকরিয়া।
পরদিন সায়রা বানুকে নিয়ে কলাম্বিয়ার রিগাল সিনেমা হলের পারকিং লটে এলো নাদিম। স্নোডেন স্কয়ারে এই সিনেমা হলের তিনটা বিশাল পারকিং লট আছে। কিন্তু দুইটা সব সময় খালি পরে থাকে। এত দর্শক কখনো হয় না। সব চেয়ে দূরের পারকিং যেয়ে প্রথমে ব্রেক এবং গ্যাস প্যাডল ব্যবহার করে আগানো, পিছানো, থেমে যাওয়া শিখল। তারপর স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ির দিক পরিবর্তন করল। এক ঘণ্টা প্র্যাকটিস করল সায়রা বানু। ফেরার আগে একবার পারকিং এর চারিদিকে চক্কর দিতে বলল নাদিম। একবার পুরাপুরি না চালালে সাহস হবে না। শুরুতে নিজের সম্পর্কে আস্থা কম থাকলেও ফেরার সময় বুঝতে পাড়ল সায়রা বানু, গাড়ি চালানো শিখতে বেশি দিন লাগবে না। অটোমেটিক গাড়ি, চালানো কঠিন কিছু না।
ফিরতে ফিরতে নাদিম বলল, কখন, কতক্ষণ প্র্যাকটিস করছ খাতায় লিখে রেখো। কমপক্ষে ষাট ঘণ্টা শিখতে হবে। এর মধ্যে দশ ঘণ্টা রাতের বেলায় হতে হবে।
— আচ্ছা। বলল সায়রা বানু। গ্রেগ’স স্কুলের ক্লাসে বলেছিল।
রাতে ডিনার করার সময় সায়রা বানু বলল, আসছে শনিবারে সন্ধ্যায় ভার্জিনিয়াতে একটা রাজস্থানি কালচারাল প্রোগ্রাম আছে। সিমা মিশ্রা লাইভ, যাবে? তোমার ভালো লাগবে। একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে মন ভালো হবে।
অবাক হলো নাদিম। ওর মনের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করছে সায়রা বানু! না করার কোনো কারণ নেই। বলল, চলো।
রাজস্থানি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় যাওয়ার জন্য শনিবার বিকেল থেকে তৈরি হতে থাকল সায়রা বানু। অনুষ্ঠান হবে ভার্জিনিয়ার আরলিংটনের একটা হোটেলে। যেতে দেড় ঘণ্টার মতো লাগবে। সায়রা বানু নিজে অন লাইনে টিকিট কেটেছে।
আমি কী পরব? জিজ্ঞেস করল নাদিম।
— আচকান-পাজামা হলে ভালো হতো। একটা ফর্মাল প্যান্ট-শার্ট পরলেই চলবে। বলেই বেডরুমে ঢূকে গেল।
কাপড় চোপড় পরা শেষ হতেই বেডরুম থেকে বের হয় এলো সায়রা বানু। চেনার উপায় নেই। আজ খুব উজ্জ্বল রঙের ঘাঘরা–চোলি পরেছে। ওড়নাতে হালকা লাল, হলুদ এবং কমলা রঙের বাহার। কানে, গলায় রুপার ভারী অলংকার। ঘাঘরা গোড়ালির সামান্য একটু উপরে উঠে আছে। এতে পায়ের অ্যাঙ্কেল ব্রেসলেট, রুপার চেইন দেখা যাচ্ছে। বাম হাতে কনুই পর্যন্ত চুড়ি। তাও কী, সাদা, লাল এবং কমলা রং এর চুড়ি। ওড়নার সাথে ম্যাচ করা। চোখে কাজল।
সবচেয়ে বেশি ছাপিয়ে একটা জিনিস বেশি চোখে পড়ছে। আজ সায়রা বানু ভীষণ খুশি। চোখে মুখে এত আনন্দ যেন আজ ঈদ।
একরাশ হাসি ফুটিয়ে সায়রা বানু বলল, চলো। চলো। দেরি হয়ে যাবে।
কিন্তু দেরি হলো না। সময় মতো হোটেলের বল রুমে পৌঁছল দুজন। কয়েক সারি পিছনে ওদের সিট পড়ল।
অনুষ্ঠানের প্রথমদিকে রাজস্থানের বেশ কয়েক রকমের গান এবং নাচ হলো। সব শেষে সেরা আকর্ষণ ঘুমোর নাচ। গানের সাথে সাথে নাচ হবে। আমেরিকান দর্শকরা যেন বুঝতে পারে এই জন্য একটা মেয়ে ইংরেজিতে বলল, এটা রাজস্থানের অরিজিনাল ঘুমর নাচ। গানের বিষয় হচ্ছে, একটা মেয়ে বড় হচ্ছে, তার বিয়ের বয়স হয়েছে। সে ‘কাজল-টিকি’ দিয়ে সাজতে চায়। মেয়েটা মা কে বলছে, সে একটা ভাল পরিবারে বিয়ে করতে চায়, যারা তাকে ভালবাসবে, সম্মান করবে। গানের কথাগুলো এই রকম, “ও রাজ-রি, ঘুমার রাম-বা মেয় যা-স-সা”। এটা সমবেত সঙ্গীত। একজন লিড সিঙ্গার থাকলেও সাথে অনেকে গাইবে। মেয়েরা ঘুরে ঘুরে নাচবে। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
ষ্টেজে ঢোল, তবলা ও সাপের বাঁশির মতো কিছু বাদ্য যন্ত্র নিয়ে কয়েকজন লোক বসল। মিউজিক শুরু হলো। প্রথমে চারজন এবং একটু পর আরো চারজন করে মোট আট জন মেয়ে ষ্টেজে উঠে নাচতে শুর করল। সবাই বিভিন্ন রকম উজ্জ্বল রঙের ঘাগরা, চোলি এবং ওড়না পরেছে। একেক জন একেক রকম রং, কোনো মিল নেই। সাথে অলংকার এবং নূপুর।
ফিসফিস করে সায়ার বানু বলল, রাজস্থান মানেই নানা রঙের জামাকাপড় এবং অলংকার।
— তোমাকে খুব হাসিখুশি লাগছে। এমন খুশি কম দেখেছি।
— আমি রাজস্থানের মেয়ে। সিমা মিসরা’র অনুষ্ঠানে আসতে পেরে খুব ভাল লাগছে। তোমারও হাসিখুশি থাকা উচিত।
এমন সময় গান শুরু হলো। রাজস্থানের ভাষা, নাদিম কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু কী যে মিষ্টি গলা! কী যে মিষ্টি সুর। গানের মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হয়। মনে হয়, তার যেন খুব ভালো বিয়ে হয়। নাচের তালে তালে ঘুরতে ঘুরতে মেয়েরা স্টেজের এক দিক থেকে আরেকদিকে চলে যাচ্ছে। এত সমন্বিত নাচ যে কেউ কোথাও ভুল করছে না। পাঁচ মিনিটের একটু বেশি সময় ধরে হলো নাচ।
শেষ হতেই প্রচণ্ড করতালিতে গমগম করে উঠল হল ঘর।
মুগ্ধ হয়ে পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করল সায়রা বানু। গাড়িতে উঠে নাদিমকে জিজ্ঞেস করল, তোমার ভাল লাগেনি?
— খুব ভাল লেগেছে। এরকম অনুষ্ঠান আগে কখনো দেখিনি।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই সায়রা বানু বলল, তবু তোমাকে মন মরা লাগছে। কী হয়েছে বলো তো?
— কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে।
— একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
— অবশ্যই।
— তোমাকে কারো সাথে কথা বলতে দেখি না যে?
সায়রা বানু কী প্রশ্ন করল নিমিষে বুঝতে পাড়ল নাদিম। বলল, নিউ ইয়র্কের কথা জিজ্ঞেস করছ? ওখানে কিছু হবে না।
মনে মনে অবাক হলো সায়রা বানু। “মেয়েটা” উচ্চারণ করল না নাদিম, বলল কিনা “নিউ ইয়র্ক”।
— তোমরা একই দেশের না?
— হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের চাওয়া-পাওয়া আলাদা।
এই বিষয়ে আর একটা প্রশ্ন করল না সায়রা বানু। আবার রাজস্থানের কথায় ফিরে গেল। বলতে থাকল, সে রাজস্থান খুব মিস করে। আজকের এই অনুষ্ঠানে এসে এত ভাল লেগেছে বোঝাতে পারছে না।
— গান এবং সাথে ঘুমোর নাচটা অপূর্ব ছিল। বলল নাদিম
— এই জন্যই তো তোমাকে নিয়ে এসেছি। মৃদু হেসে বলল সায়রা বানু। অন্য কালচার সম্পর্কে একটু ধারণা হোক।
কিছুটা ক্লান্ত ছিল, বাকি সময় চুপচাপ গাড়ি চালাতে থাকল নাদিম
এলিকট সিটি আসতেই সায়রা বানু বলল, ব্যাংক অফ আমেরিকার কোনো এটিএম মেশিনের সামনে দাঁড়াতে পারবে? হাতে ক্যাশ নেই।
— আচ্ছা। থামব।
একটা ব্যাংকের সামনে গাড়ি রাখল নাদিম। সায়ার বানু এটিএম মেশিন থেকে ক্যাশ আনতে গেল। রাত বলে বাইরে এসে দাঁড়াল নাদিম। টাকা তুলে দ্রুত গাড়িতে ফিরে এলো সায়রা বানু। নাদিম খেয়াল করল রিসিট প্রিন্ট হয়েছে, কিন্তু দ্রুত ফিরে আসায় রিসিট ফেলে এসেছে। এক দৌড় দিয়ে রিসিট নিয়ে এলো নাদিম। সায়রা বানুর হাতে দিল। ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাগে রাখল সায়রা বানু।
মনে মনে আশ্চর্য হলো নাদিম। সায়রা বানুর দিকে তাকাল। রাজকন্যার সাজে লাল, হলুদ এবং কমলা রঙের ওড়না মাথায় পাশের মেয়েটা কে?
সায়ার বানুর চেকিং একাউন্টে পঁয়ষট্টি হাজার তিনশ ডলার এবং কিছু ভাংতি জমা আছে। চাইলে সায়রা বানু নিজে এপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে পারে। নাদিমের সাথে থাকার কোনো দরকার নেই। তবু কেন ওর সাথে থাকছে?
(চলবে)
লেখক – হাসান মাশরিকী,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে