নয়নাভিরাম পর্ব-০৪

0
1009

#নয়নাভিরাম (পর্ব-৪)

♡আরশিয়া জান্নাত

আজ বহুদিন পর আরশানের মনটা হালকা লাগছে। সকালের নতুন ভোরে সূর্যের মৃদু রশ্মিতে দাঁড়িয়ে সে ঠিক করলো সবকিছু ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করবে। মায়েদের কাছে বোধহয় সৃষ্টিকর্তা একটা বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন।সন্তানেরা যখন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে মায়ের কাছে সবটা খুলে বলে,তখন সবকিছু শান্ত হয়ে যায়।সকল নেগেটিভ এনার্জি যেন মায়েরা শুষে নিয়ে পজিটিভ এনার্জি সাপ্লাই করে। না হয় এতোদিন ধরে কষ্ট পাওয়া ছেলেটার আজ এতো ভালো লাগছে কেন?
আফরোজা আহমেদ ফজরের নামায পড়ে এখনো জায়নামাজে বসে আছেন। তাঁর এতো শক্ত ছেলেটা যে কি না ব্যথা পেলেও কখনো কাঁদেনি একটা মেয়ের জন্য এভাবে কাঁদলো! অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ঠিক করলেন নিপুণের চেয়ে হাজারগুণ বেস্ট একটা মেয়ে তিনি খুঁজে আনবেন তাঁর ছেলের জন্য। এমন একজন যে আরশানের মনের সকল ক্ষত দূর করে দিবে ভালোবাসার প্রলেপ দিয়ে। সেদিন নিশ্চয়ই আরশান বলবে, মা ভালোই হয়েছে নিপুণ চলে গেছে। এখন আমি অনেক ভালো আছি।
____________

বেডের উপর বসে ডোন্ট কেয়ার মুডে বই খুলে বসে আছি,আর আপু অস্থিরভাবে পায়চারি করছে।
একটু পরপর আমার দিকে চেয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছেনা।অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি কখন বলবে কিন্তু না এর থেকে সহজে কিছু বের হবেনা।আমি সিরিয়াস গলায় বললাম,শপিং মলের ছেলেটা কে ছিল আপু?
আপু দপ করে বসে গেল। নেতিয়ে যাওয়া গলায় বললো,তুই সব দেখেছিস তাই না মিমি!
–সেসব জেনে কি হবে? কতদিন ধরে চলছে এসব হু?
আপু ফের পায়চারি শুরু করলো কিসব ভেবে বললো,মিমি একটা সমস্যা হয়ে গেছে। এখন আমি কি করবো বুঝতে পারছিনা,,,,
–কি হয়েছে বলো তো?
–সেদিন যাকে দেখলি তাঁর নাম সাকিব।দুই বছর ধরে রিলেশন চলছে।অনেক মেধাবী ছেলে,জাপানে স্কলারশিপ পেয়েছে।কিছুদিন পর চলে যাবে তিন বছরের জন্য।
–বাহ! ভালোই তো। তো সমস্যা কি এখানে?
–সমস্যা কি বুঝতে পারছিস না? এই নিয়ে কতগুলি প্রপোজাল বাদ দিয়েছি দেখেছিস? এখন ও যদি তিন বছরের জন্য চলে যায় আমি এদিকে কিভাবে সামলাবো?
–উনাকে বলো যাওয়ার আগে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে যেতে। তাহলেই তো আর প্যারা নাই।
–ওর ফ্যামিলি রাজী হবে? এখনো স্টাবলিশ হয়নি। ওর ক্যারিয়ার নিয়ে সবাই খুব সিরিয়াস। এখন বিয়ের কথা বলা কিভাবে সম্ভব!
–তাহলে আর কি তাঁকে বলো ঢিংঢিং করে জাপান চলে যেতে, যাওয়ার আগে ব্রেকাপ করে নাও। ছেলেদের অপেক্ষা করা ঠিক না আপু। মুভিতে দেখো না বিদেশ গেলে ছেলেরা কেমন বদলে যায়? তখন আর দেশি মেয়ে ভাল্লাগেনা। তুমি বরং এসব বাদ দিয়ে বাবার পছন্দমতো বিয়ে করে আমার রাস্তা ক্লিয়ার করো।আমি বাপু তোমার জন্য এতো বছর কুমারী থাকতে পারবোনা।
আপু অবিশ্বাসী চোখে চেয়ে বললো, তুই আমার বোন মিমি?? এতো সহজে বলে ফেললি ব্রেকাপ করে অন্য কাউকে বিয়ে করতে! কোথায় বোনকে একটু সান্ত্বনা দিবি, বুদ্ধি দিবি তা না তুই তো সব শেষ করে দিতে এক্সপার্ট!
–বি প্র্যাকটিক্যাল বোইনা! তুমি এখন সাকিব ভাইয়াকে ফোন করে বলো হয় তুমি সম্পর্ক শেষ করে চলে যাও নাহয় বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নাও।আমি তিন বছর বিয়ে না করে মিমিকে বুড়ি হতে দিতে পারবোনা।
— এখানে তোর বুড়ি হবার কথা আসছে কেন? তিন বছরে তোর বিশেষ কি হবে?
— পিরিতের পেত্নিও ভালা। তুমি তোমার আশিকের কাছে ঠিকই এভারগ্রিন থাকবা কিন্তু আমার বয়স তো বসে থাকবেনা। আমি যদি তখন হৃতিক রৌশনের মতো কাউকে পেয়েও বেশি বয়সের জন্য রিজেক্ট হই আমার মন ভাঙবে না?
— তোর আজগুবি সব লজিক শোনার টাইম নাই আমার। সবকিছুতে নিজের লস টা ক্যালকুলেট করা তোর খুব জঘন্য স্বভাব। তুই খুব সেলফিস। ভুলেও কথা বলবি না আমার সাথে।

আপু রেগে আগুন হয়ে চলে গেল। আমি হাসতে হাসতে সাকিব ভাইয়ার আম্মুকে ফোন করে বললাম,আস্সালামু আলাইকুম আন্টি আপনারা কাল বিকালে আমাদের বাসায় আসেন, এড্রেস টেক্সট করছি।
(সাকিব ভাইয়ার আম্মু হচ্ছে সেদিন সকালের ঐ আন্টিটা যাকে আমি হেল্প করেছিলাম। আপুর ফোন চেক করতে গিয়ে সাকিব ভাইয়ার ফ্যামিলি ফটো দেখেই আমি আন্টির সঙ্গে মিট করেছি। আঙ্কেল আন্টির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে আগেই সব ঠিকঠাক করে এসেছিলাম। উনারা খুশিমনে রাজী হয়েছেন। এখন অফিশিয়ালি প্রপোজাল নিয়ে আসলেই হবে। বাবা-মা অলরেডি আপুর বিয়ে নিয়ে খুব টেনসড। আশা করছি এমন ভালো পাত্র পেলে অমত করবেনা।)
ওরে কত্তদিন পরে বিয়া খামু, উড়াধুরা নাচমু ,কত্ত মজা হবে ইয়েএএএ
______________

ঘুম থেকে উঠে দেখি 8:30 বেজে গেছে। এতো দেরি কিভাবে হলো আয়হায়। পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে বের হয়ে ক্লাসের সামনে গিয়ে পৌছাতে নয়টা বিশ বেজে গেছে।পাক্কা দশ মিনিট লেট,ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি আরশান স্যার ক্লাসে।পিছু ফিরে চলে যাবো ভাবতেই স্যার বললো,মিস রুমাইসা কাম ইন।
আমি না চাইতেও দোআ পড়ে ক্লাসে ঢুকে বললাম,গুড মর্নিং স্যার।স্যরি স্যার আসলে রাস্তায় জ্যাম ছিল তাই আসতে ,,,
স্যার হাসিমুখে বললো, ইটস ওকে মিস রুমাইসা।আপনি গিয়ে সিটে বসুন।
আমি চোখ গোল গোল করে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। কি হলো এটা স্যার আমার সঙ্গে হাসিমুখে স্বাভাবিকভাবে কথা বললো! এ ও কি সম্ভব??
সামনের বেঞ্চগুলোতে জায়গা থাকা সত্ত্বেও আমি যখন পেছনের দিকে যাচ্ছিলাম তখন স্যার বললো,সামনে খালি রেখে এতো পেছনে যাচ্ছেন কেন? বসুন সামনের দিকে।
আমি নীলার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বললাম,আজ স্যারের কি হয়েছে বল তো? এতো ভালো কথাবার্তা!
নীলা খাতায় লিখে দিলো, স্যার আজকে ক্লাসে এসেই তোকে খুঁজেছে। আমরা তো সবাই অবাক।
–হতে পারে ডিউরেশন শেষ হয়ে আসছে তাই!
–কি জানি।
ক্লাস শেষে স্যার বললো,মিস রুমাইসা ছুটির পর আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
রিমি এসে বললো,ব্যাপার কি রে স্যারের মন দেখি 180° এঙ্গেলে ঘুরে গেছে।কি ম্যাজিক করেছিস তুই?
–ব্ল্যাক ম্যাজিক করছি। তোর কাউরে করা লাগবো? খবর দিস পার তাবিজ 1001/-
রিমি বিরক্ত হয়ে চলে যেতে যেতে বললো, ঢঙ্গি একটা।
ফাহিম বললো,মিমি স্যার তোমাকে কেন ডেকেছে অনুমান করতে পারছো?
–আমারে তোর কি মনে হয় বল তো? স্যার তাঁর স্টুডেন্টকে ডাকতেই পারে। স্কুল হলে বলতাম পরীক্ষার খাতার বোঝা বয়ে নিতে ডাকছে। এখন কি বলতাম?
–তুমি কিন্তু কেয়ারফুলি থাকবা। বলা তো যায় না প্রপোজ টপোজ করে বসলে ,,
–আরেহ ধুরর। কিসব যে বলোস! আমারে প্রপোজ করতে যাবে কোন দুঃখে? তোর মাথা কি গেছে?
ফাহিম বিড়বিড় করে বললো,তোমার মতো মেয়েকে কেউ দুঃখে প্রপোজ করতে চাইবেনা বরং মনের সুখেই প্রপোজ করবে। কয়েক শতাব্দীতে তোমার মতো একজন জন্মে!
আমি বললাম,কিরে কি বলোস শুনিনা তো?
ফাহিম হেসে এড়িয়ে গেল।
সবার কথা লাপাত্তা মুড নিলেও মনে মনে আমি ঠিক ভয় পাচ্ছি। স্যার কোনোভাবে আমার নাম্বারটা চিনে ফেলেনিতো? চেনার তো কথা না। আর যদি চেনেও আমার কি? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি।
মনকে বুঝ দিলেও হাঁটু আমার ঠিকই কাঁপছে। এই হাঁটু কাঁপাটা কি কখনোই কন্ট্রোলে আসবেনা?
___________

হিজলতলায় দাঁড়িয়ে ভাবছি গেইটের দিকে যাবো নাকি টিচার্স রুমের দিকে। ছোটন বললো,এতো প্যারা নেওয়ার কিছু নাই তুই যা আমরা তো আছিই।
ফাহিম– মিমি আমি কি তোমার সঙ্গে আসবো?
— আরেহ তোরাও না আমি কাউকে ভয় পাই নাকি? আমিতো এখানে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম ক্লাসে কিছু ভুলে এসেছি কি না।
ইলহাম হেসে বললো, মিথ্যুক একটা। ভাঙবি তবু মচকাবি না।
— হ তোরে কইছে।
নীলা–তোরা অহেতুক পোক করতেছস। আরশান স্যার অতোটাও খারাপ না।
আমি–তোর কাছে হ্যান্ডসাম কোনো ছেলেই খারাপ না
নীলা–মুখ খোলাবি না মিমি।তুই যে প্রথম দিনই,,
আমি নীলার মুখ চেপে বললাম,চুপ থাক নীলু।
ইলহাম– ভীতুর ডিম মিমি হেহেহে
আমি–কে ভীতুর ডিম?
ইলহাম–তো যা না এখনো দাঁড়াই আছোস ক্যান?
আমি–যাচ্ছি যাচ্ছি।
টিচার্স রুমে যাওয়ার সময় পথেই আরশান স্যারের সঙ্গে দেখা।তিনি মুচকি হেসে বললেন,ওহ মিস রুমাইসা আমার খোঁজেই যাচ্ছিলেন নাকি?
–জ্বি স্যার।ছুটির পর দেখা করতে বলেছিলেন না?
–হ্যাঁ।আপনার জন্য গুড নিউজ আছে।আজকে আমার লাস্ট ডে ,আগামীকাল থেকে ফয়েজ স্যার জয়েন করবেন ইনশাআল্লাহ।
–আল্লাহ কি বলেন স্যার এটা গুড নিউজ হবে কেন? আপনার ক্লাস অনেক মিস করবো আমরা(ভদ্রতার মিথ্যা ডায়লগ)
—হাহাহাহা, ফর্মালিটি দেখাচ্ছেন! আমাকে আপনি মোটেও মিস করবেন না বরং বলুন আপনি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। এখন থেকে আর কেউ বকাঝকা করবেনা আপনাকে।
–না না স্যার কি যে বলেন?
— Anyway, Thank you Miss Rumaisa!
–কেন স্যার?
–সে আপনি ভালো করেই জানেন।আচ্ছা চলি, আল্লাহ হাফেজ ভালো থাকবেন।

আমি স্যারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই বিরক্তিকর লোকটা চলে যাওয়ার প্রতীক্ষায় তো ছিলাম এতোদিন। তবুও কেমন জানি মন খারাপ লাগছে, এটা কি কেবল বিদায়ের প্রভাব নাকি মনে থাকা সুপ্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ??
সাথে সাথে ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠলো,আমি ফোন হাতে নিতেই দেখি আরশান আহমেদ এর মেসেজ,
“আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ ছিল সেই অজ্ঞাত মানুষটা আপনি কি না।এখন সিওর হলাম,,,”

আমি দূরে তাকিয়ে দেখি সে পিছু ফিরে হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আচ্ছা এই পিছু ফিরে তাকানো শাহরুখ খানের কোন মুভির একটা অংশ ছিল যেন? এটা কি সেই পজিটিভ সাইন??
Ops high expectation……

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে