নয়নাভিরাম পর্ব-০২

0
1075

#নয়নাভিরাম (পর্বঃ২)

♡আরশিয়া জান্নাত

লেডিস ওয়াশরুমে ঢুকে মাথায় পানি দিচ্ছি আর পাশে নীলা দাঁড়িয়ে বাতাস করছে আর বলছে,শান্ত হ মিমি কুল ডাউন।
রাগে আমার মাথা দিয়ে আগুন বের হচ্ছে আমি ঠিক টের পাচ্ছি।বেশ খানিকক্ষণ পর মাথা মুছে হিজলতলায় গিয়ে বসলাম আমি আর নীলা।তখন ছোটন আইসক্রিম নিয়ে এলো।
“নে আইসক্রিম খেয়ে মাথা ঠান্ডা কর।নীলু একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা আজ ফার্স্ট ডে তেই স্যার কেন এমন বিহেভ করলো মিমির সাথে?”
“এখন এসব ছাড় না।দেখছিস না মিমি অলরেডি অনেক ক্ষেপে আছে।”
ইলহাম হাসতে হাসতে বললো,আল্লাহ ঠিকই বিচার করে বুঝলি ছোটন।মিমির সাথে এমন হওয়াই উচিত ছিল।আমাদের সত্যিবাদী তটীনি!
আমি ইলহামের চেয়ে দ্বিগুণ উচ্ছাসে হেসে বললাম,টিউবলাইট আল্লাহ যে ঠিক বিচার করে আজকে বুঝলি এটা?

ইলহাম বিরক্তস্বরে বলল,ভং ধরিস না।ডোন্ট কেয়ার মুডও দেখাইতে আসিস না।ভেতরে ভেতরে তোর যে জ্বলতেছে ঠিকই বোঝা যাচ্ছে।

“ওয়েএ আমার ভেতরে খবর জানা গল্টুটা।বেশি তেড়িবেড়ি করিস না শালা এমন ক্যাঁচালে ফেলমু পা ধইরা বইসা থাকবি।মিমিরে ক্ষ্যাপাইতে আসিস না।”
ইলহাম কিছুটা দমে গিয়ে বললো,পার্সোনালি নিস না দোস্ত।আমি তো ফান করতেছি,

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম,আরশান আহমেদ এর সব ইনফরমেশন কালেক্ট কর asap।তাঁরে আমি কি যে করমু আমি নিজেও জানিনা।

কিছুক্ষণ আগে,,,

প্রিন্সিপাল স্যার চলে যাওয়ার পর আরশান আহমেদ বললো,এই যে মিস ব্লু স্কার্ফ স্ট্যান্ড আপ।
আমি তখন খাতায় কাটাকুটি করছিলাম নীলা ধাক্কা দিয়ে বললো স্যার তোকে দাঁড়াতে বলছে।
আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি দুই হাত ফোল্ড করে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি উঠে বললাম,আমাকে বলেছেন?
–এখানে আর কেউ এমন কটকটে ব্লু স্কার্ফ পড়েছে মিস?
–স্যার এটা স্কার্ফ না হেয়ার ব্যান্ড।আর ব্লু কালার কটকটে হয় না।
–কার চোখে কেমন লাগবে তা কি এখন আপনি ডিসাইড করবেন ?
–সেটা বলিনি স্যার
–মুখে মুখে তর্ক করবেন না।সব কথার জবাব দেওয়া স্মার্টনেস না।
–তর্ক করলাম কখন আমিতো আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি কেবল।
–আপনি দেখছি প্রশ্ন ও বুঝতে পারেন না! Whatever নাম কি আপনার?
–রুমাইসা তেহজিব মিমি।
–মিস রুমাইসা আপনি কি দয়া করে লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসবেন?আপনার ড্রেসের কালারটায় আমার প্রবলেম আছে So please?
আমি হতভম্ব হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম এটা কেমন লেইম এক্সকিউজ সিট চেইঞ্জ করানোর! ইচ্ছে করছিল উচিত জবাব দিতে কিন্তু রেসপেক্ট দেখিয়ে কিছু না বলে ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে সরে লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।ঘটনা এখানেই শেষ হলে পারতো কিন্তু হয় নি।তিনি যে আমার সাথে জন্মের শত্রুতা বজায় রাখবেন তা বোঝা গেল তাঁর ভাবভঙ্গি দেখেই।কঠিন সব প্রশ্ন করে আমায় নাস্তানাবুদ করাই যেন তাঁর লক্ষ্য ছিল।ক্লাসের সবাই বেশ বুঝতে পারলো নতুন স্যারের সাথে আমার পূর্বশত্রুতা আছে।

বাসায় ফিরে দেখি আপুর টেবিলে কস্টেপ পেঁচানো বক্স।আমি বক্স নেড়েচেড়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ভেতরে কি আছে কিন্তু বোঝা গেল না।ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে বললাম,আম্মাজান প্রচুর ক্ষুধা লাগছে।কি আছে তাড়াতাড়ি দাও।
আম্মু–টেবিলে গিয়ে বস আমি খাবার আনছি।আর শোন টেবিলে রাখা বক্সটা ধরেছিলি?ওটা ভুলেও ধরিস না কিন্তু।তাশফী বারবার করে বলে গেছে মিমি যেন না ধরে।
–কেন কেন কি আছে বক্সটায় যে আমি ধরা নিষিদ্ধ?
–আমি কি করে বলবো ও তো যে সাবধানে এনে রেখেছে।
–এতোই যখন ইমপরট্যান্ট লুকিয়ে রাখলেই পারতো।ঢং
আমি খেয়েদেয়ে টিভিতে টম এন্ড জেরি দেখতে বসে গেলাম।
রাতে ছাদে বসে আকাশ দেখা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস।কানে ইয়ারফোন গুজে ভাবছি আরশান স্যারের ক্লাসগুলো আর এটেন্ড করবোনা।
আচ্ছা এটা করলে আমাকে ভীতু মনে হবে?হাবাজাবি কত কি ভাবছি তারার দিকে চেয়ে।
রুমে এসে দেখি আপু রেগে আগুন হয়ে বসে আছে।আমি ঢুকতেই বললো,মিমি তুই কি করেছিস এটা?আমি আম্মুকে বলে গেছি তোকে বারণ করতে তুই তাও শুনলি না কেন?
–আমি কি করছি?
–বক্সে ল্যাবের টেস্ট টিউব আর বিকার ছিল।তুই শুধু ধরোস নাই জোরে নাড়াচাড়াও করছোস।দেখ সব ফেটে গেছে!!!
–মিথ্যা কথা আমি ভাঙিনাই।আর এভাবে কেউ টেস্টটিউব আনে নাকি?পেপার মুড়িয়ে আনতে পারো নাই?আমি যখন নেড়েছি তখন তো কোনো শব্দ পাইনাই। তো ভাঙছে কেমনে ,,,,,
(বলেই জিভ কাটলাম ওপস)
আপু রেগে এমন এক চিৎকার দিলো আমার কানের পর্দা নির্ঘাত ফেটে গেছে।আমি দৌড়ে বড় ভাইয়ার রুমে চলে গেছি।এখন একমাত্র ভাইয়াই পারে এই ডাইনির হাত থেকে বাঁচাতে।এখানে আমার কি দোষ?একটু নাড়াচাড়া করতেই ফাটবে কেন! নিশ্চয়ই দুই নাম্বার কাঁচ ধরাই দিছে।

রাতে বাবা ফিরতেই আমি আগে আগে গিয়ে বাবাকে পানি এগিয়ে দিলাম।জুতো জোড়া খুলে দিলাম।বাবা আমার খাতির দেখে বললো,আজ আবার কি করেছিস?
আমি পায়ের কাছে বসেই কাঁদো গলায় বললাম,আব্বু জানো আপু আজকে কত বকা দিছে?তুমি আপুকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দাও তো।ছোটবোনে একটু ভুল করলে এভাবে বকতে হয়?জানো আরেকটু হলে আমার কানের পর্দা ফেটে যেত।পুরো জীবন আমি কালা হয়ে থাকতাম,,,
–কি হয়েছে খুলে বল তো?কিসের ক্ষতিপূরণ?
আমি পুরো ঘটনা খুলে বলতেই বাবা হেসে বললো,আমার ছোট্ট মায়ের কোনো দোষ নেই এখানে।
তারপর আপুর রুমে যেতে যেতে বললেন,তাশফী এই তাশফী এদিকে আয় তোর কত টাকার জিনিস নষ্ট হয়েছে বলে যা আমি দিয়ে দিচ্ছি।
আমি খুশিতে উঠতে গিয়ে চেয়ারের সাথে হোঁচট খেয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম।
এই পৃথিবীর সবকিছুই আমার শত্রু হাহ!
____________
ফার্স্ট ক্লাস না করার প্ল্যান করে ধীরে সুস্থে ভার্সিটির উদ্দেশে বের হয়েছি।মনের আনন্দে চারদিকে চেয়ে যাওয়ার সময় দেখি একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা জিম খিচে রাস্তায় বসে আছেন।তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি অসুস্থ।আমি তাঁর সামনে গিয়ে বললাম,আন্টি কোনো সমস্যা হয়েছে?
উনি আস্তে করে বললো,সুগার ফল করেছে।
আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ হাতড়ে ক্যাডবেরি খুলে তাকে খাইয়ে দিলাম।তিনি ততক্ষণে আমার গায়ে ঢলে পড়েছেন।বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি স্বাভাবিক হলেন।আমি তাকে পানির বোতল এগিয়ে দিতেই পানি খেয়ে বললেন,তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো।সকালে হাঁটতে বেড়িয়েছি।সবসময় আমার হাজবেন্ড আসেন।আজ তিনি আসতে পারেননি ,তুমি না আসলে বোধহয় এখানেই পড়ে থাকতাম।
–আপনি কেয়ারফুলি থাকবেন আন্টি।ঢাকা শহরে বিপদের তো সীমা নেই।আর ব্যাগে সবসময় মিষ্টি কিছু রাখবেন।
–হুম ।
–আন্টি আপনি কি একা যেতে পারবেন রিকশা ঠিক করে দেবো?
–হ্যাঁ পারবো সমস্যা নেই।তোমার ক্লাসের লেট হচ্ছে বোধহয় তুমি যাও বরং।আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন।
আমি তাঁকে রিকশায় তুলে দিয়ে ক্লাসে গেলাম।মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে,সকালটা শুরু হলো পরোপকার করে।আহ ব্যাপারটা দারুণ!
ক্লাসে গিয়ে মেজাজটাই খারাপ হয়ে যার ভয়ে ফার্স্ট ক্লাস মিস দিলাম তাঁর নাকি থার্ড ক্লাস আজকে!উফফ আজকে আবার অপমান করবে ভাল্লাগেনা।
আমি সবসময় ফার্স্ট বেঞ্চে বসলেও আজ আগে থেকেই লাস্ট বেঞ্চের মাঝে বসেছি যেন আমাকে স্যার দেখতে না পায়।
রিমি টিটকারী করে বললো,আরশান স্যার তোকে ভালোই জব্দ করেছে দেখছি।উনার ভয়ে বাঘিনী বিড়াল বনে গেছে।
ওর কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো।আমি তাঁদের হাসিতে যোগ দিয়ে বললাম,তুই যে স্যারের দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়েছিলি সে কি আমি দেখিনি?স্যারের উপর ক্র্যাশ খেয়ে বসে আছিস যে সেটা কি তোর জামাই জানে?
রিমি সিরিয়াস মুডে বললো,স্যারের পড়া বুঝতে হলে তাকিয়ে থাকতে হবেনা?এখানে ক্র্যাশ খাওয়ার কি আছে?
–তাই বুঝি?তাহলে টিচার্স রুমের জানালার সামনে দাঁড়িয়েছিলি কেন?ঐখানেও স্যার পড়া বুঝাচ্ছিল?
–তুই যা তা।কিসব বলোস
আমি থ্রেট দিয়ে বললাম,নেক্সট টাইম পিঞ্চ করবার আগে দুই বার ভেবে নিস।বাইক্কা প্যাঁচাল পাড়তে আসবিনা।
রিমি ভেংচি কেটে চলে গেল।
নীলা বললো,একদম ঠিক করেছিস মেয়েটা বেশি বেয়াদব হয়েছে।বিয়ের আগে যা ছিল বিয়ের পর যেন আরো বাজে হয়েছে।
–বাদ দে তো।তুই আমারে টেক্সট করে বলবিনা শিডিউল চেইঞ্জ হইছে? তাহলে আর আসতাম না ক্লাসে।
–তোরে ছাড়া ক্লাস করতে মজা লাগেনা।
–আজকে যদি আবার উল্টাপাল্টা কয় আমি সিওর স্যারের নাক ফাটাই দিমু।
–আরেহ কিছু হবেনা দেখিস।

স্যার এসে আজ স্বাভাবিকভাবেই ক্লাস নিলো।আমাকে কোনোপ্রকার প্রশ্নই করলোনা।তাঁর ভাগ্য ভালো বলতে হয় হুহ!
ক্লাস শেষে আমরা সবাই ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা দিতে বসেছি।ফাহিম গিটারে সুর তুলে গাইতে লাগলো,
যে পথে চলেছ বন্ধু
সে পথে হারাবে যে সত্ত্বা
মায়াবী আলোর প্রতারণায় মোহিত
আঁধারে তুমি
কত প্রেমের বসন্ত
কত বৃহৎ দিগন্ত
এত সুখের তাড়নায়
যে যাও হারিয়ে

কিভাবে ভুলেছো বন্ধু
পুরনো দিনের সেই কথা
অজানা মনের বেড়াজালে নিরাশায়
ছিলে যে তুমি
আমি ছিলাম পাশে যে
আগলে ছিলাম তোমাকে
কত বিপদ পেরিয়ে
এসে হাল ধরেছি…..

আমি–ফাটাফাটি হয়েছে মামা।
ফাহিম মুচকি হেসে বললো, It’s my pleasure Mam!
ইলহাম ব্যস্তভঙ্গিতে এসে বললো,স্যারের সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেছি।উনার বাসা মিরপুরে,বাবা-মা আর ছোট বোন নিয়ে 4নং রোডের ফ্ল্যাটে থাকেন।পিএচডির জন্য ইউকে তে এপ্লাই করে রেখেছেন,আপাতত এনজিও তে পার্ট টাইম জব করে।গার্লফ্রেন্ড আছে তাঁর সাথে রিলেশন ভালো যাচ্ছেনা হয়তো ব্রেকাপ এর পথে।
–ওহ আচ্ছা গফের প্যারায় আছে।এজন্য এমন খিটখিটে।
–তোরা মাইয়ারা বহুত প্যারাদায়ক।বফদের নাকানিচোবানি না দিলে তোদের হয় না।
— সেটা আমি বুঝি বইলাই তো তোর বোনের বফরে ভালা বুদ্ধি দিছিলাম।তখন তো ঠিকই চেতছোস।যাই হোক এটা বল ফয়েজ স্যার ফিরবে কবে?
–দুই সপ্তাহ পর।
–উফফ ভাল্লাগেনা।থাক তোরা আমি বাসায় যাই।

মার্কেটে গিয়ে অনেক খুঁজে দাদাজানের জন্য সুন্দর কারুকাজ করা একটা কাঠের বাক্স নিলাম।যা কেউ চাইলেও খুলতে পারবেনা।এখানে তাঁর জিনিসপত্র আগের মতোই সুরক্ষিত থাকবে।
ওখান থেকে বের হয়ে আমি লেকের সামনে গিয়ে বসলাম।বিকেলের সময় এখানে বসে কত রকম মানুষ দেখা যায়।সবাই যার যার মতো গল্প করছে,আমি বসে বসে সেসব দেখি।মানুষের কথা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে।একেকজনের একেক রকম কথা!
বাসায় ফিরে যখন দাদাজানকে বাক্সটা দিলাম উনার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করছিল,এতো খুশি বোধহয় দামী গিফট দিলে হতোনা।
আজকের দিনটা খুব তৃপ্তিময় তাই না?

ঐদিকে আরশানের জন্য আজকের দিনটা খুব জঘন্য।চার বছরের রিলেশনশীপ ভেঙে নীপুণ আজ অফিশিয়ালি ব্রেকাপ করেছে,,,,,,

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে