দ্বিতীয় ফাগুন পর্ব-১৩+১৪

0
528

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১৩
#লেখিকা_Esrat_Ety

এটা যেন নাটকের কোনো স্ক্রিপ্ট। দর্শক কে চমকে দিতে পরিচালক মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা স্ক্রিপ্টে ঢুকিয়ে দেয়। আমার গল্পেও ঠিক এমন হয়েছে। আমার ছোটো ভাই ভালোবেসে যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছে, অদ্ভুত ভাবে রোদেলা আমিন নামের ভদ্রমহিলা সেই মেয়েটির বড় বোন। সবার চোখে এটা কাকতালীয় ব্যাপার মনে হবে কিন্তু আমার চোখে এটা শুধুমাত্র কাকতালীয় কোনো ঘটনা না। ঢাকা শহরে এতো লোকের বসবাস,আমার ছোটো ভাই আদিল কেনো রোদেলা আমিনের ছোটো বোনকেই ভালোবেসে ফেলবে? অন্য কাউকেও তো ভালবাসতে পারতো। প্রকৃতি আমাকে আর রোদেলা আমিনকে জুড়ে দিচ্ছে কোনো না কোনো ভাবে। সে যাই হোক,আসল কথায় আসি। আমার গুণধর ছোটো ভাই তো নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছে, কিন্তু আমাকে ফেলেছে বিপদে। এতো কান্ডের পরে মায়ের শেষ আশা ভরসা হলাম আমি। আমার আবেগী মা এখন মনে প্রানে চাইবে আমার বিয়েটা ওনার পছন্দ মতো করাতে। এখন মাকে গিয়ে যদি বলি “মা আমি একজনকে ভালোবাসি,সে আর কেউ না,তোমার ছোটো ছেলের বৌয়ের বড়বোন ” তাহলে মা নির্ঘাত আমায় বলি দিয়ে দেবে। এই হচ্ছে আমার গল্পের চার নাম্বার সমস্যা। যেটা আজ সন্ধ্যা সাতটায় কাজী অফিসে জন্মগ্রহন করেছে‌। জানিনা আর কি কি সমস্যা আসতে চলেছে আমার সামনে।

নোট প্যাডে পূর্ববর্তী লেখার নিচে এই কথাগুলো লিখে ফেলে তাশরিফ। ফোন রেখে ঘড়ির দিকে চায় সে। রাত দুইটা বেজে তের মিনিট। মা,বাবা,আদিলের সব বন্ধু বান্ধবীরা ঘুমিয়ে গিয়েছে। আচ্ছা রোদেলা আমিন এখন কি করছে? রাগে,দুঃখে, প্রচন্ড ক্ষোভে নিশ্চয়ই এখন বসে বসে হাত কামড়াচ্ছে। তাশরিফ আনমনে হেসে ফেলে। মনে মনে ভাবে,আচ্ছা এখন ওনাকে একটা ফোন দিয়ে জ্বালাতন করলে কেমন হয়? ফোন দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলবে,”রোদেলা আমিন, আপনি অযথা চিন্তা করবেন না। আপনার বোনকে আর আমার ভাইকে আমি নিরাপদে তাদের বাসর ঘরে পৌছে দিয়েছি। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।”
কথাটি ভাবতেই তাশরিফ উচ্চশব্দে হেসে ফেলে। কয়েক মুহূর্ত হেসে নিয়ে নিজে নিজেকে শাসায়,”স্টপ ইট তাশরিফ। কেনো বেচারীর অনূভুতি নিয়ে মজা নিচ্ছো! বৃষ্টি যদি তোমার ছোটবোন হতো তাহলে এতো সহজে মানতে পারতে এসব?”
তাশরিফ বিছানা থেকে নামে। তার প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে । ঘরের দরজা খুলে ডাইনিং রুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে সে। আদিল একটা প্লেটে খাবার নিচ্ছিলো,ভাইয়াকে দেখে ঘাবড়ে যায়, লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”ও তখন রেস্তোরাঁয় বসে কিছু মুখে দেয়নি। এখন বলছে খুব খিদে পেয়েছে।”
তাশরিফের খুব হাসি পায় আদিলের কাঁচুমাচু মুখ দেখে। কিন্তু সে গম্ভীর হয়ে বলে,”মাকে ডেকে দেবো? মা ব্যবস্থা করে দেবে‌।”

আদিল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,”ওরে বাপরে! মাফ করো ভাইয়া। লাগবে না।”
বলেই আদিল প্লেট উঠিয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় লাগায়।

তাশরিফ সেদিকে তাকিয়ে হাসে। তার সেদিনের সেই ছোট্ট ভাই টা কেমন কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে দায়িত্বশীল স্বামী হয়ে গিয়েছে। দুজন অল্পবয়সী কপোত কপোতীর ভালোবাসায় ভরা পাগলামী গুলো দেখতে খুবই ভালো লাগছে তার।
এই ভালোবাসা যেনো দুজনকে আজীবন ঘিরে রাখে।

***
খুব ভোরেই তিনজন লোক খাটিয়ে ফ্ল্যাট থেকে সব মালামাল এক এক করে নামিয়ে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। বাসা ঠিক করা হয়েছে খুব কাছেই। এখান থেকে দুটো গলি পরেই । পাঁচ তলায় তিন রুমের একটা ফ্ল্যাট। ভাড়া তুলনামূলক কম হলেও পরিবেশ মোটামুটি ভালোই। অতশত দেখার সময়ও তো ছিলো না রোদেলার,জলদি জলদি যা পেয়েছে তাতেই হ্যা বলে দিয়েছে।

রুহুল আমিন বসার ঘরের সোফায় চুপচাপ বসে আছে। মেঘলা বাবার ব্লাড প্রেসারের ওষুধ নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
রোদেলা এবং আয়েশা সিদ্দিকা হাতে হাতে সব গুছিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় বাড়িওয়ালা দিদারুল ইসলাম ভেতরে ঢোকে।

রোদেলা উঠে দাঁড়ায়। দিদারুল ইসলাম এসে রুহুল আমিনের সামনের সোফায় বসে। কন্ঠে খুবই আফসোস নিয়ে বলতে থাকে,”অল্পবয়সী মেয়ে। জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা জন্মায়নি এখনো। মেনে নিন ভাই। আপনাদের তো আরো খুশি হবার কথা,শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে হয়েছে। শেষমেশ মেয়েটা কলঙ্কিত তো হয়নি।”

রোদেলা ঘরে ঢুকে একটা খাম এনে দিদারুল ইসলামের হাতে ধরিয়ে দেয়,”এই মাসের ঘর ভাড়া টা। নিন আর এখান থেকে যান।‌ আমরা দুপুর নাগাদ চলে যাবো।”

দিদারুল ইসলাম বিব্রত হয়ে খুক খুক করে কাশতে থাকে। তারপর উঠে চলে যায়।

রোদেলা আবারো গোছগাছের কাজে মন দেয়। মেঘলা রুহুল আমিনকে ওষুধ টা খাইয়ে দিয়ে চলে যেতে নিলে রুহুল আমিন বলে ওঠে,”একটা বার মেয়েটার খোজ পেলে মনে বড় শান্তি পেতাম রে মেঘলা।”

রোদেলা চেঁচিয়ে ওঠে,”এতো শান্তি দিয়ে কি করবে তুমি? এতো শান্তি রাখবে কোথায়? চুপ করে ওখানে বসে থাকো। এক জীবনে এতো শান্তি পেতে নেই।”

***
“আদিল। এই আদিল।”

বৃষ্টির ডাকে আদিল কোনো সাড়া দেয়না, বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। বৃষ্টি বিরক্ত হয়ে গায়ে হাত রেখে আদিলকে ডাকে। বৃষ্টির হাতের স্পর্শে আদিল আচমকা চোখ মেলে তাকায়,অবাক হয়ে দুমিনিট বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টি চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলে,”কি হয়েছে! কি দেখছো?”

আদিল চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,”আমি আসলে চমকে গিয়েছি তোমাকে দেখে। এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমাদের বিয়ে হয়েছে। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। এই আমাকে একটা চিমটি কাটো তো।”
আদিল হাত বাড়িয়ে দেয়। বৃষ্টি প্রচন্ড জোরে চিমটি কেটে দেয় আদিলের হাতে। আদিল যন্ত্রনায় “ওরে বাপরে” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। বৃষ্টি মুখে হাত চেপে হাসছে।

আদিল হাত টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চিমটি কাটা স্থানে হাত বোলাতে থাকে। অভিমানের সুরে বৃষ্টিকে বলে,”এখন আমি একটা দিলে তো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে।”

বৃষ্টি আদিলের কথা গায়ে না মেখে আদিলের দিকে এগিয়ে বসে। বৃষ্টির গা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। এতো কাছে এগিয়ে বসেছে,আরেকটু কাছে আসতে সমস্যা কোথায় ! নিজে থেকেও আসবে না, একটু জরিয়েও ধরবে না। আদিল কাছে যেতে চাইলেও তালবাহানা করছে। অদ্ভুত মেয়েমানুষ। বিয়েটা করেছে কেনো তাহলে ! চেহারা দেখার জন্য ?

বৃষ্টি ফিসফিস করে আদিলকে বলে,”আচ্ছা শোনো। ফ্রেশ হয়ে বসে আছি সেই কখন থেকে। আমার কি বাইরে যাওয়া উচিত? মা কি কিছু বলবেন? বকবেন আমায় দেখলে?”

আদিল একটু চিন্তা করে। তারপর বলে,”তা তো বলতে পারছি না। এখানে বসে থাকো চুপচাপ। কেউ ডাকতে এলে তবেই বেড়োবে।”

বৃষ্টি মাথা নেড়ে বসে থাকে চুপচাপ। আদিল বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত পরে বলে ওঠে,”তোমাকে একটা কথা কখনো বলিনি বৃষ্টি। আজ বলতে ইচ্ছে করছে খুব !”

_কি?
শুনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে বৃষ্টি।
_পৃথিবীতে আমার দেখা দ্বিতীয় সুন্দরী নারী তুমি। তোমার চেহারা দেখলেই আমার এখানে শান্তি লাগে।

আদিল নিজের বুকে হাত রেখে বলে।

বৃষ্টি চোখদুটো সরু করে বলে,”প্রথম সুন্দরী কে?”
_আমার মা।

বৃষ্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,বলে,”ও তাই বলো। আমি ভেবেছিলাম তোমার কোনো প্রাক্তন প্রেমিকা।”

আদিল হাসে। বৃষ্টির হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলে,”তোমার হাতে চুড়ি দুটো বেশ মানিয়েছে। এগুলো সবসময় পরে থাকবে। আমি তোমার হাতে একটা চুমু খাই?”

লজ্জায় লাল হয়ে যায় বৃষ্টি। চুমু খাওয়ার হলে খাবে। এখন এতো ভদ্রতা দেখাচ্ছে কেনো! ইচ্ছে করে বৃষ্টিকে লজ্জা দিতে চাইছে।

আদিল বৃষ্টির হাতে চুমো খেতে নিলে দরজায় টোকা পরে। বিরক্ত হয়ে উঠে যায় আদিল। গিয়ে দরজা খুলে দেখে তাহমিনা দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। তাহমিনাকে দেখেই আদিলের হাঁটু কাঁপতে শুরু করে। বৃষ্টি খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়,ভীত চোখে নিজের শাশুড়ির দিকে তাকায়।
তাহমিনা আদিলকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ঘরে ঢোকে। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”খিদে পায়নি?”
বৃষ্টি মাথা নাড়ায়। তার খিদে পায়নি।
তাহমিনা বৃষ্টিকে দেখতে থাকে। নাহ,তার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হয়। লম্বা চুল, গোলাকার মুখ,অসম্ভব সুন্দরী একটি মেয়ে।
বিছানার উপরে বসতে বসতে বলে,”শাড়ি পরার অভ্যাস নেই বোধ হয়। বিকেলে দর্জি আসবে,তার কাছে মাপটা দিও। সালোয়ার কামিজ গুলো বানিয়ে দেবে।”
বৃষ্টি এবারো মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়। তাহমিনা বলে,”বাবা কি করেন?”
_প্রথম জীবনে মালয়েশিয়ান প্রবাসী ছিলেন,তারপর দেশে এসে ঢাকাতেই একটা মোবাইলের দোকান নিয়েছিলেন, দু’বছর হয় স্ট্রোক করেছেন, পায়ে সমস্যা হয়েছে। এখন আর সেই ব্যাবসাও নেই।

_ওহহ। ভাই-বোন কয়জন?
_আমরা তিনবোন মা। আমিই ছোটো।

তাহমিনা মাথা ঘুরিয়ে আদিলের দিকে তাকায়। তারপর বলে,”এখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ফ্রেশ হয়ে তাশরিফের কাছে যা। তোকে ডাকছে।
তাশরিফ বাধ্য ছেলের মতো ওয়াশ রুমে ঢুকে পরে দ্রুত।
তাহমিনা বৃষ্টিকে বলতে থাকে,”এইচএসসি কোন কলেজ থেকে?”
_ভিকারুননিসা।
_ভিকারুননিসার মেয়ে ঢাকা কলেজের ছেলের সাথে যোগাযোগ হলো কিভাবে ?
_একই কোচিং সেন্টারে পড়তাম।

তাহমিনা আর কিছু বলে না, উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “খেতে এসো।”

বৃষ্টি একটা বড় নিশ্বাস ছাড়ে। ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। ভেবেছিলো তার শাশুড়ি তাকে কড়া কিছু শুনিয়ে দেবে,কিন্তু না শাশুড়ি শুধুমাত্র তাঁর ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলো।

***
খাবার টেবিলে সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। আদিল বারেবারে খাওয়া থামিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকায়। বৃষ্টি খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে শুধু। বৃষ্টির কি আবারও মন খারাপ হয়ে গিয়েছে! সবার সামনে আদিল কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। তাশরিফ খেতে খেতে আদিলের দিকে তাকায়। আদিলের দৃষ্টি অনুসরণ করে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”বৃষ্টি!”
বৃষ্টি মাথা তুলে তাশরিফের দিকে চায়, অস্ফুট স্বরে বলে,”জ্বি ভাইয়া।”
_খাওয়া শেষ করে একটু আমার কথা শুনে যেও।
বৃষ্টি মাথা নাড়ায়। আফতাব হাসান তাহমিনার দিকে তাকিয়ে বলে,”এখন কি করবে? দেশের বাড়িতে খবর দিতে হবে না? সবাইকে তো জানাতে হবে।”
_আরে দাঁড়াও,আগে নিজেরা হজম করে নেই বিষয়টা। বিয়েটা যখন করেই ফেলেছে, লুকিয়ে তো আর রাখতে পারবো না তাইনা।
আফতাব হাসানের কথার পিঠে বলে তাহমিনা।

_পাড়া প্রতিবেশীকে তো জানাতেই পারি।

_হ্যা হ্যা জানাও। এক কাজ করো, সারাদিন তো কিছুই করো না। একটা ঢোল নিয়ে এপার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলো,”তোমরা সবাই কে কোথায় আছো। দেখে যাও,আমার অপদার্থ ছোটো ছেলে ,যার এখনো দুধের দাঁত পরেনি সে বড় ভাইয়ের আগে বাড়িতে বৌ নিয়ে এসেছে। এসো এসো সবাই, মিষ্টি খেয়ে যাও।”
তাহমিনার কথায় মজা পেয়ে আদিলের বন্ধুরা উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। আফতাব হাসান বিরস মুখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে, দিন দিন অভদ্র হয়ে যাচ্ছে এই মহিলা। স্বামীকে একটুও মান দিয়ে কথা বলে না।

“ভাইয়া আমাকে ডেকেছিলেন?”
তাশরিফ অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো। বৃষ্টিকে দেখে বলে,”হ্যা। ভেতরে এসো।”
বৃষ্টি তাশরিফের ঘরে ঢোকে। তাশরিফ গলার টাই বেঁধে বৃষ্টিকে বলে,”মা প্রথম প্রথম একটু রাগী রাগী মেজাজে কথা বলবে,মানিয়ে নিও। পরে দেখবে তোমায় সে চোখে হারায়।”
বৃষ্টি মাথা নাড়ায়। তাশরিফ বৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”ও বাড়ির জন্য মন খারাপ?”
বৃষ্টি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হঠাৎ করে খুব কান্না পাচ্ছে।
তাশরিফ বলে,”আমি তোমাকে ডেকেছি একটা কাজে। আমি রোদেলা আমিনকে এখন ফোন করবো। তুমি কথা বলে নাও।”

বৃষ্টি দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে মেজো আপু তার সাথে কথা বলবে না।

তাশরিফ নিজেও সন্দিহান। পেঁচা মুখী তাকে নির্ঘাত কথা শুনিয়ে দেবে তবু সে রোদেলার নাম্বার ডায়াল করে।

দু’বার রিং বাজতেই ওপাশ থেকে রোদেলা ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলে। প্রিয় কন্ঠটি শুনতেই তাশরিফের বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে যায়। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,”আমি তাশরিফ হাসান।”

রোদেলা কয়েক মূহুর্ত চুপ থাকে। তারপর বলে,”স্যার আমি ছুটিতে আছি। আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছেন। এখন কোনো অফিশিয়াল ফোন কল রিসিভ করে কথা বলতে আমি বাধ্য নই।”

_রোদেলা আমিন এক মিনিট।
রোদেলা ফোনটা রাখতে গিয়েও রাখে না। তাশরিফ বলে,”এক মিনিটের জন্য একটু বৃষ্টির সাথে কথা বলুন। আপনি বা যে কেউ।”

রোদেলা চুপ করে থাকে। তাশরিফ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর বলে,”ঠিকাছে। কথা বলতে হবে না। শুধু শুনে রাখুন, বৃষ্টি ভালো আছে, সুস্থ আছে। এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না ওর।”

কথাটি বলে তাশরিফ ফোন কেটে দেয়। বৃষ্টি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তাশরিফের খুব খারাপ লাগে বৃষ্টির জন্য। আদিল গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়ায়,”কিছু হয়েছে ভাইয়া?”
_হু, রোদেলা আমিন কথা বলেনি ওর সাথে তাই কাঁদছে। ওকে ঘরে নিয়ে যা। আমি এখন অফিসে যাবো,এসে কথা বলছি।

তাশরিফ বেড়িয়ে যায়। বৃষ্টি চোখ মুছে আদিলের ঘরে চলে যায়। আদিলের ইচ্ছা করছে বৃষ্টির পিছু পিছু যেতে, গিয়ে ওকে শান্তনা দিতে। কিন্তু মা তার দিকে তাকিয়ে আছে, এই মুহূর্তে সে কিছুতেই যেতে পারবে না বৃষ্টির কাছে। সে পুনরায় এসে খাবার টেবিলে বসে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে থাকে।

কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে মেঘলাকে ডাকতে থাকে রোদেলা। মেঘলা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। রোদেলা মৃদু স্বরে বলে,”বাবাকে গিয়ে বলে দাও তার ছোটো মেয়ে ভালো আছে, সুস্থ আছে। ওখানে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।”
***

পাঁচতলার জানালা দিয়ে তাকালেই একটা বড় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মাঠ দেখতে পাওয়া যায়। বাচ্চারা মাঠে হৈচৈ করছে,খেলছে। মেঘলা জানালার পর্দা সরিয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পেছন থেকে রোদেলা ডাকে,”আপু‌।”

মেঘলা ফিরে তাকায়। রোদেলা বলে,”কেমন লাগছে নতুন বাসা?”

মেঘলা শুকনো হাসি হাসে,”ভালো লাগা দিয়ে এখন আর কিছু যায় আসে? হ্যা মোটামুটি ভালোই পরিবেশ। তবে বেলকনি দুটোতে যায়গা খুবই কম।”

_হুম,তা ঠিক। বৃষ্টি থাকলে নাক চোখ কুঁচকে ফেলতো। ওর সব ফুল গাছ আর ক্যাকটাস গুলো রাখার যায়গা হয়নি যে।

_ভালো কথা, বাকি গাছ গুলো কোথায় রেখেছিস?

_ছাদে। একটা পোর্চের নিচে। ছাদ পুরো ফাঁকা। বাড়িওয়ালার মায়ের থেকে পারমিশন নিয়েছি,সে বলেছে সমস্যা নেই।

কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দুই বোন বসার ঘরের দিকে যায়। মেঘলা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার বাইরে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে, বেশ লম্বা, চওড়া, বলিষ্ঠ শরীর। বয়স বেশি হলে আটত্রিশের কাছাকাছি। কানের কাছে দুয়েকটা চুল সাদা হয়ে গিয়েছে। সাদা পাঞ্জাবির উপরে মুজিব কোট পরা,গায়ের রঙ এককথায় খুবই কালো, কিন্তু লোকটি দেখতে বেশ সুদর্শন, চেহারার গঠন খুবই আকর্ষণীয়। সে দুই হাতে দুটো বাচ্চার হাত ধরে রেখেছে। বাচ্চা দুটির মধ্যে একজন ছেলে, একজন মেয়ে। তারা খুবই নড়ছে, দরজার বাইরে থেকে মেঘলাদের বসার ঘরে উঁকি দিচ্ছে।

মেঘলা তাকিয়ে আছে। ভদ্রলোক বলে ওঠে,”আমি সালমান সাদাফ, এই এপার্টমেন্টের মালিক।”
খুবই গম্ভীর কন্ঠের একজন পুরুষ। এই কন্ঠ নিয়ে জনসভায় ভাষণ দিলে লোকজন মনযোগী শ্রোতা হয়ে শুনবে।
মেঘলা সালাম দেয়। ভদ্রলোক সালামের উত্তর দিয়ে বলে,”ছাদে যে গাছ গুলো ছিলো ওগুলো কি আপনাদের?”

মেঘলা এবং রোদেলা উভয়ই মাথা নাড়ায়।

_দুঃখিত। কিছু মনে করবেন না। আমার বাচ্চা দুটো খুব দুষ্টু। ওরা সবগুলো গাছ ভেঙে ফেলেছে।

মেঘলা আর রোদেলা অবাক হয়ে বাচ্চা দুটির দিকে তাকায়। দুজনের বয়স খুব বেশি হলে ছয় থেকে সাড়ে ছয় বছর হবে। তারা মেঘলার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। বারো টা ফুলের টব ভাঙতে পারায় তাদের খুবই আনন্দিত লাগছে।

মেঘলা কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি হলে এতক্ষণে একটা বিকট চিতকার দিয়ে কান্না জুড়ে দিতো।

ভদ্রলোক আবারো বলতে থাকে,”চিন্তা করবেন না। আমি জরিমানা দিয়ে দেবো।”

চলমান……

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১৪
#লেখিকা_Esrat_Ety

“রোদেলা আমিন আপনাকে তাশরিফ স্যার তার কেবিনে একবার যেতে বলেছেন।”

ডেস্কটপ থেকে চোখ সরিয়ে রোদেলা তাশরিফের নতুন পিএ তনির দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,”আমাকে?”
_জ্বী।
তনি চলে যায়। রোদেলা মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। আজ সে পাঁচদিনের ছুটি ক্যানসেল করে তিন দিনের দিনই অফিসে এসেছে। এখনি তাশরিফের সামনে যেতে তার একদমই ইচ্ছা করছে না। কিন্তু তাকে যেতে হবে। বস বলে কথা।

“আসবো স্যার।”
_আসুন।
রোদেলার দিকে না তাকিয়ে জবাব দেয় তাশরিফ।
_বসুন।
রোদেলা বসে। সরাসরি তাশরিফের চোখের দিকে তাকায়। তাশরিফ ঘামতে থাকে,মনে মনে বলে,”এভাবে তাকিয়ে থেকো না পেঁচা মুখী। তুমি এভাবে তাকালেই আমার হার্ট লাফালাফি শুরু করে দেয়।”

_বলুন স্যার কেনো ডেকেছেন।
তাশরিফ গলা খাঁকারি দেয়। মনে মনে দোয়া করতে থাকে রোদেলা যাতে ক্ষেপে না যায়। রোদেলা আবারো বলে,”কিসের জন্য ডেকেছেন স্যার !”

তাশরিফ একটা খাম তুলে রোদেলার দিকে এগিয়ে দেয়। রোদেলা খামটা দেখতে থাকে। তারপর হাত বাড়িয়ে নেয়। তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা কি স্যার?”

_নিমন্ত্রনপত্র । আমার ছোটোভাই নতুন বিয়ে করেছে বুঝলেন। ভালোবাসার বিয়ে। তাদের জন্য একটা ছোটোখাটো রিসিপশন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি আগামীকাল। ঘরোয়া ভাবে হবে । অফিসের সবাইকেই বলেছি। আপনাকেও দিলাম। পরিবার নিয়ে আসবেন। এলে খুশি হবো।

রোদেলা কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থাকে খামটার দিকে। তাশরিফ তাকিয়ে থাকে রোদেলার দিকে তার থেকে উত্তরের অপেক্ষায়।

তারপর তাশরিফকে অবাক করে দিয়ে রোদেলা খামটা ছিঁড়ে ফেলে। তাশরিফ হতভম্ব হয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা চুপচাপ খামটার অসংখ্য টুকরো করতে থাকে।

***
“তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না মা।”
একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা মহিলা মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘলা মহিলাটিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে। বৃদ্ধা হলেও যথেষ্ট আধুনিক। একটা সাদা রঙের শাড়ি পরে আছে। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। মেঘলা অত্যন্ত নরম গলায় বলে,”আন্টি আমি আপনাদের পাঁচতলায় নতুন এসেছি।”

_ওও আচ্ছা আচ্ছা। এসো ভেতরে এসো।
ভদ্রমহিলা দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। মেঘলা ভেতরে ঢোকে। ভেতরের একটা রুম থেকে বাচ্চাদের চেঁচামেচির শব্দ আসছে।
ভদ্রমহিলা বলে,”বসো মা। চা দিতে বলছি।”

মেঘলা বলে,”না আন্টি তার দরকার নেই। আমি এসেছি ছাদের স্টোর রুমের চাবি আপনাকে দিতে। কেয়ারটেকার ভাইকে পেলাম না তাই।”

_হ্যা ও ছুটিতে গিয়েছে। তুমি বসো , আলাপ করি। যে মেয়েটি প্রথমদিন বাসা দেখতে এসেছিলো সে তোমার কে হয়?

_ছোটোবোন।

সেদিনের সেই বাচ্চা দুটি চিৎকার দিতে দিতে বসার ঘরের দিকে আসছে। ভদ্রমহিলা বলে,”আমার নাতী নাতনি। সিরাত আর সুহা,ওরা জমজ। ভারি দুষ্টু!”

মেঘলা হাসে। মেয়ে বাচ্চাটি ছেলেটাকে তাড়া করছে একটা কলম নিয়ে। চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”তুই দাড়া। তোকে এক্ষুনি ফুটো করে দিচ্ছি।”
ছেলেটি দৌড়ে এসে তার দাদীর পেছনে লুকায়। তাদের দাদী সিরাতকে আগলে নিয়ে সুহাকে চোখ রাঙানি দেয়,”কি হচ্ছে দাদুমনি তুমি এভাবে ভাইকে তাড়া করছো কেনো?”

_দাদু ও আমার বার্বির হাত ভেঙেছে,ওকে আমি মারবো।

সুহা কলম দিয়ে সিরাতকে আক্রমণ করতে যায়। ভদ্রমহিলা বাচ্চা দুটোর সাথে পেরে ওঠে না। মেঘলা গিয়ে সুহাকে ধরে,আদুরে কন্ঠে বলে,”তুমি কলম টা আমায় দিয়ে দাও বাবু। তোমার ভাইয়ের চোখে লেগে যাবে।”

সুহা দেয়না। চোখ মুখ শক্ত করে মেঘলার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘলা পুনরায় বলে কলমটা দিয়ে দিতে। সুহা মেঘলাকে হতভম্ব করে দিয়ে মেঘলার গায়ে থুতু মেরে কলমটা ছুড়ে ফেলে দৌড়ে ভেতরে যায়।

মেঘলা ভদ্রমহিলার দিকে তাকায়। ভদ্রমহিলা অপরাধী গলায় বলে,”কিছু মনে করো না মা, মা নেই তো তাই এমন হয়েছে দুটো বাচ্চা। এতদিন ওদের ফুপু ছিলো,তার কথা শুনতো দুজন‌ । একমাস হয় তার বিয়ে হয়েছে। এখন আর এদের আমি একা সামলে রাখতে পারি না। দিন দিন পাজি হচ্ছে।”

মেঘলা কাতর চোখে সিরাতের মুখের দিকে তাকায়। তারপর নরম গলায় বলে,”ওদের মা নেই মানে?”

_মারা গিয়েছে। ওদের তখন তিন বছর বয়স।

মেঘলার প্রচন্ড খারাপ লাগে কথাটি শুনে। ভদ্রমহিলা বলতে থাকে,”ওদের বাবা যতক্ষন বাড়িতে থাকে সে একটু সামলাতে পারে দুজনকে, ওদের বাবাও তো ব্যস্ত মানুষ ‌। খুব বেশি সময় দিতে পারে না ওদের।”

_কি করেন ওদের বাবা?
মেঘলা জানতে চায়।

_ওদের বাবা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সে অত্র এলাকার সুপরিচিত একজন জননেতা। সালমান সাদাফের নাম শোনোনি বুঝি?

মেঘলা অবাক হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে,
_শুনেছি। কিন্তু আগে কখনো তাকে দেখিনি। গতকাল আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন ফুল গাছ ভাঙার জন্য বাচ্চাদের হয়ে সরি বলতে। তখন বুঝতে পারিনি এই সালমান সাদাফই সেই সালমান সাদাফ।

***
লাঞ্চ শেষ করে মাত্রই রোদেলা নিজের ডেস্কে ফিরে গিয়ে বসে পরেছে। অমনি খবর আসলো রাশেদুজ্জামান তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। রোদেলার ইচ্ছা করছে প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার দিয়ে রাশেদুজ্জামানকে কুৎসিত কিছু গালি শুনিয়ে দিতে। এটা এখন সে না পারলেও ভবিষ্যতে একদিন সে করবেই করবে। বিরক্ত মুখে জিএম রাশেদুজ্জামানের কেবিনের বাইরে গিয়ে দুমিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। ভেতরে ঢুকতে তার মন সায় দিচ্ছে না। অফিসের সবাই এখন ক্যান্টিনে। এরকম নিরিবিলি পরিবেশে রোদেলার সাহস হচ্ছে না ভেতরে যেতে।

“কি? সব হাওয়া বেড়িয়ে গেলো তো?”

রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। তাশরিফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আবার বলে,”এখন কাঁচুমাচু মুখ করে কোথায় যাচ্ছেন? আপনার সেই তেজ কোথায়? খুব তো তেজ দেখিয়ে এটা করতে পারেন,সেটা করতে পারেন,একে কথা শোনাতে পারেন,তাকে কথা শোনাতে পারেন। এই জিএম এর বেলায় আপনার তেজ কোথায় যায়? সারাদিন বাঘিনী রুপ ধারণ করে থাকা রোদেলা আমিন জিএম স্যারের ডাক পরলেই নেংটি ইঁদুর হয়ে যায় কেনো? এখন তেজ দেখাতে পারেন না? তেজ দেখিয়ে এই বদমাশ জিএম কে এক্সপোজ করতে পারেন না? ”

রোদেলা কোনো কথা বলে না। তাশরিফের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশরিফ রোদেলার দিকে এগিয়ে আসে। সে রোদেলার চোখে চোখ রেখে বলে,”আপনি একটা শিক্ষিতা আহাম্মক আপনি জানেন? কেউ বলেছে এর আগে আপনাকে?”
রোদেলা তাশরিফের কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। তাশরিফ বলতে থাকে,”যান গিয়ে জিএম স্যারের কাছ থেকে ফাইলের স্তুপ নিয়ে আসুন। প্রতিবাদ তো করতে পারবেন না। শিক্ষিতা আহাম্মকদের সাথে এমনটাই হওয়া দরকার।”

কথাগুলো বলেই তাশরিফ চলে যায়। সকালে খাম ছিঁড়ে ফেলার ঘটনার পর থেকেই রোদেলার উপর প্রচন্ড রাগ হয়েছিল তার। এখন এসে দেখছে জিএম স্যার ডাকা মাত্রই সুড়সুড় করে তার আদেশ পালন করতে যাচ্ছে অমনি রোদেলাকে কথা শুনিয়ে দেবার জেদ চেপে যায় মাথায়।

রোদেলা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে জিএম স্যারের কেবিনের দরজার নব ঘোরায়। রাশেদুজ্জামান বলে ওঠে,”কাম ইন।”

রোদেলা কেবিনে ঢোকে। জিএম স্যার খুশি খুশি গলায় বলে,”বসো রোদেলা।”

রোদেলা চোখ বড় বড় করে ফেলে।
আপনি থেকে তুমিতে নেমে গিয়েছে সম্বোধন ! অসভ্য ! বুড়ো বাঘডাশ একটা !
রোদেলা মনে মনে গালি দিতে থাকে জিএম কে।

চেয়ারে বসতে বসতে বলে,”বলুন স্যার কেনো ডেকেছেন?”

রাশেদুজ্জামান ফুরফুরে মেজাজে বলতে থাকে,”খুব লোনলি ফিল হচ্ছিলো। কথা বলার লোক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এই অফিসে তুমি ছাড়া আমার উপযুক্ত কাউকে পাইনা কথা বলার মতো। তাই ভাবলাম ডেকে একটু গল্প করি।”
রোদেলা চোখমুখ শক্ত করে ফেলে। জিএম বলতে থাকে,” কি বলো তো, আমার ওয়াইফের সাথে ডিভোর্সের মামলাটা অনেকদিন ধরে কোর্টে ঝুলছিলো, শেষমেশ ডিভোর্সটা ফাইনাল হয়েছে।”

রোদেলা চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখে বলে,”এসব আমাকে কেনো বলছেন স্যার।”

রাশেদুজ্জামান হাসে, তারপর বলে,”এমনি। তোমাকে বোঝাতে চাইছি আমি খুব লোনলি। কথা বলার মানুষ নেই। গল্প করার মানুষ নেই। ”

_গল্প শুনতে চান স্যার?
রোদেলা রাশেদুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটি করে। রাশেদুজ্জামান উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, গদগদ হয়ে বলে,”হ্যা অবশ্যই। তুমি বলবে আর আমি শুনবো না?”

রোদেলা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। তারপর বলতে থাকে,”এক অফিসের বস সবসময় তার মহিলা এম্প্লয়িদের বিরক্ত করে বেরাতো। নিজের ভাল্লুকের মতো চেহারা নিয়ে সবসময় মহিলা এম্প্লয়িদের কফি নয়তোবা চাইনিজ খেতে যাওয়ার প্রস্তাব দিতো। কেউ তার প্রতি ইন্টারেস্ট না দেখালে তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করতো। একটা মেয়েকে এভাবে বিরক্ত করতে করতে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলেছিল ওই লোক। প্রথম প্রথম কেউ মেয়েটির পাশে ছিলো না, পরেরদিন একজন তার পক্ষ নিলো,তার পরেরদিন আরেকজন,তার পরেরদিন আরেকজন। এভাবে সবাই যখন ঐক্যবদ্ধ হলো,সবাই মিলে ঠিক করলো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা দরকার। তারপর একদিন অফিসের মধ্যে ফেলে ওই বসের পশ্চাৎদেশে দোররা মারা হলো।”

রাশেদুজ্জামান রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে ক্রোধের আগুন। রোদেলা তা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মুচকি হেসে বলে,”আজ এই পর্যন্তই স্যার। অন্য কোনোদিন গল্পের বাকি অংশ শোনাবো না হয়। আমি উঠি?”

রোদেলা উঠে চলে যায়। রাশেদুজ্জামান রাগে কাঁপছে,বিরবির করে বলে,”তোকে তো আমার বিছানায় নিয়েই ছাড়বো।”

***
তাহমিনা ফ্রাইং প্যানে তেল ঢেলে আড়চোখে বৃষ্টির দিকে তাকায়। বৃষ্টি রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আজ সে একটি লাল রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। এইমাত্র গোসল সেরে এসেছে তাই চুল গুলো ভেজা।ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। তাহমিনা মুগ্ধ হয়ে যায়, সত্যিই ভারি মিষ্টি দেখতে।
_কিছু বলবে?
_আপনাকে সাহায্য করবো মা?
_তোমাকে আদিল পাঠিয়েছে এখানে? এসব করে আমার মন জয় করার জন্য?

বৃষ্টি মাথা নাড়ায়। কেউ তাকে পাঠায়নি। তাহমিনা বলে,”যা করার মন থেকে করবে। মন না চাইলে করার প্রয়োজন নেই।”

বৃষ্টি এগিয়ে আসে।
“মাছ গুলো ভেজে দেবো আমি?”
_ইচ্ছে হলে ভাজো।
তাহমিনা সরে দাঁড়ায়। বৃষ্টি একটা হলুদ লবণ মাখা রূপচাঁদা মাছ তুলে নিয়ে তেলে ছেড়ে দিতেই তেল ছিটকে বৃষ্টির হাতে লাগে। “মা গো” বলে চেঁচিয়ে ওঠে সে। তাহমিনা চুলা বন্ধ করে বৃষ্টির হাত ধরে,”কই দেখি। কোথায় লেগেছে? এভাবে কেউ তেলে মাছ ছেড়ে দেয়? একটু হলেই তো মুখে ছিটকে পরতো সব তেল।”

বৃষ্টি দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষণ জ্বলছে হাতটা, তাহমিনা দৌড়ে গিয়ে একটা মলম নিয়ে আসে, তারপর বৃষ্টির হাতে লাগিয়ে দেয়।

“আগে কখনো চুলার কাছে যাওনি বুঝি?”
বৃষ্টি মাথা নাড়ায়। তাহমিনা বলে,”ছেলে হোক বা মেয়ে সবাইকে এসব কাজ শেখানো উচিত। আমার তাশরিফ আদিল তো প্রায় সবকিছুই পারে, ওদেরকে শিখিয়েছি সব। কখন কোথায় ঠেকে যায় বলা তো যায় না।”

বৃষ্টি অস্ফুট স্বরে বলে,”আমিও শিখতে চাইতাম। আপুরা বকতো খুব। যেতেই দিতো না চুলার কাছে।”

_আর তোমার মা?
তাহমিনার প্রশ্নে বৃষ্টির চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তাহমিনা সেটা লক্ষ্য করে।‌ আবারো প্রশ্ন করে,”তোমার মা ও বুঝি শেখাতে চাইতো না?”

_আমার মা ছিলো না শেখানোর জন্য।

তাহমিনা অবাক হয়,”ছিলো না মানে? তোমার মা নেই?”
_আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়েছে আমি যখন দুই বছর বয়সী তখন।

বৃষ্টি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিনা তাকিয়ে থাকে বৃষ্টির দিকে। শেষ পর্যন্ত একটা ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া পরিবার থেকে বৌ নিয়ে এসেছে তার গুণধর ছেলে !

***
রাত প্রায় আটটা বাজতে চললো। এখনো রোদেলা ফেরেনি বাড়িতে। আজ সাপ্তাহিক বাজার করার কথা। তাই হয়তো দেড়ি হচ্ছে। রুহুল আমিন নিজের ঘরে শুয়ে আছে চুপচাপ। আয়েশা সিদ্দিকা রান্নাঘরে রুটি বানাচ্ছেন স্বামীর জন্য। মেঘলা কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুঁজে বই গুলো গুছিয়ে রাখছে বইয়ের তাকে। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে বসার ঘরের দিকে যায় মেঘলা। সম্ভবত রোদেলা এসেছে। দরজা খুলে দাড়িয়ে থাকে মেঘলা। দরজার বাইরে সালমান সাদাফ নামের ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে তিনি সুহাকে ধরে রেখেছে।
মেঘলা তাড়াহুড়ো করে কোমরে গুজে রাখা আঁচল উঠিয়ে ডান কাঁধে তুলে নেয়।

“আপনি বিকেলে আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন,তখন সুহা নাকি আপনার সাথে অভদ্র আচরণ করেছে শুনলাম। সুহা এখন আপনাকে সরি বলবে।”

মেঘলা অবাক হয়ে যায়। এতটুকু একটা বাচ্চা সরির কি বোঝে! সে সালমান সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ও তো বাচ্চা। বাচ্চারা একটু দুষ্টুমি করবেই! তাই বলে ওকে দিয়ে সরি বলাতে হবে !”

_বাচ্চাদের সবকিছু আমরা বাচ্চামি বলে এড়িয়ে গিয়ে ওদের আসলে ক্ষতি করি। এভাবে সব অন্যায় বাচ্চামি বলে এড়িয়ে যেতে নেই। আমি চাইনা আমার বাচ্চার কোনো আচরণে কেউ বিরক্ত হয়ে ওর প্রতি নেগেটিভ ধারনা রাখুক।
তারপর সুহার দিকে তাকিয়ে বলে,”সুহা সরি বলো আন্টিকে।”

সুহা কপাল কুঁচকে ফেলে। তারপর গম্ভীর গলায় বলে,”সরি।”

মেঘলা মুচকি হেসে সুহাকে টেনে নিজের কাছে নেয়। খুবই মিষ্টি দেখতে ভদ্রলোকের দুটো বাচ্চাই। গায়ের রঙ একেবারে বাবার মতো,কিন্তু খুব মায়া চেহারায়।
মেঘলা আদুরে গলায় বলে,”ইটস ওকে বাবু।”

সুহা মেঘলার থেকে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে সিঁড়ির কাছে যায়। সালমান সাদাফ নামের ভদ্রলোক মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”আসছি।”

***
“একটা ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া পরিবার থেকে বৌ এনেছে তোর ভাই, বলেছে তোকে সে কথা?”

তাশরিফ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকায়।
“মানে? কি বলছো বুঝতে পারছি না।”

_বৃষ্টির মা বাবার যে ছাড়াছাড়ি হয়েছে সেকথা জানিস তুই? তারা যে অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করছে জানিস?

তাশরিফ কিছুটা অবাক হয়ে যায়। সে তো জানেনা এসবের কিছু,তার জানার কথাও না।
তাহমিনা বলতে থাকে,”শেষমেশ এমন পরিবার থেকে মেয়ে আনলো তোর ভাই। যার বাবা মা-ই ঠিকমতো সংসার করতে পারেনি সে মেয়ের স্বভাব চরিত্র কেমন হবে? ”
তাশরিফ ল্যাপটপ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকায়,”মা এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। একজনের সাথে বনিবনা না হলে ডিভোর্স হতেই পারে। তাই বলে তাদের সন্তানদের এতো খাটো করে দেখবে?”

_বৃষ্টির বড়বোনেরও নাকি ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে, এখন বল ,আমি কিভাবে দেখবো বিষয় টা?

_মা তোমাকে দেখতে হবে না এতো কিছু। ওরা ওদের মতো ভালো থাকলেই তো হলো তাইনা? আমাদের আসল প্রায়োরিটি হচ্ছে বৃষ্টি। ওর পরিবার দিয়ে কি করবো?

_পরিবার সন্তানদের চরিত্র গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে,জানিস না? যাই হোক,যার বৌ সে বুঝে নেবে। শোন আমি এসেছি একটা কথা বলতে, তোদের অফিসের মেহেরিন বলে মেয়েটা ফোন দিয়েছিলো। তার একটা ননদ আছে,তার সাথে তোর বিয়ের কথা বলতে। ছবি পাঠিয়েছে আমাকে। মেয়েটি সুন্দরী। সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পরিবার খুবই ভালো। বাবা বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করতেন। রিটায়ার্ড করেছেন। আমি ভাবছি তার সাথে তোর বিয়ের কথা আগাবো।

তাশরিফ দুমিনিট চুপ করে থাকে,”মা আমি তো বলেছি তোমাকে আমার একটু সময়…”

_সমস্যা কি তোর?
তাশরিফকে থামিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে তাহমিনা।
_চাস কি তুই? আচ্ছা তোরা যে যার ইচ্ছা মতো চলবি? আমার কোনো কথা শুনবি না? একজন বড়ভাই বিয়ে করার আগে নিজে বিয়ে করে বসে আছে। ঘরে বড় ভাই অবিবাহিত আর সে সন্ধ্যে হতে না হতেই বাড়িতে এসে বৌকে নিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে। আর তার বড় ভাইয়ের বিন্দুমাত্র লজ্জা হচ্ছে না সেসব দেখে। চিরকুমার থাকার পরিকল্পনা করেছিস নাকি তুই?

তাশরিফ হাসতে থাকে। তাহমিনা রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

চলমান……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে