তোর_শহরে_ভালোবাসা পর্ব-২১

0
2240

#তোর_শহরে_ভালোবাসা??
………{সিজন-২}
#ফাবিহা_নওশীন

পর্ব~২১

আদি সামুর ডান বাহুতে হাত রেখে বললো,
—–সামু কি হয়েছে? তোমাকে এমন লাগছে কেন?কিছু হয়েছে?আমাকে বলো?

সামু আদির হাত সরিয়ে দিলো।আদির বুক ধুক করে উঠলো।সামু ওর সাথে এমন কেন করছে?

আদি সামুর দিকে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়।
সামু ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
——কয়েকটা প্রশ্ন করবো আশা করি ঠিক উত্তর দিবেন।
আপনি বিয়ের দিন জুইকে টাকা দিয়ে সিন ক্রিয়েট করার জন্য এনেছিলেন?

আদি সামুর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে।সামু সব জেনে গেছে।সামু কি রিয়েক্ট করবে সেটা ভেবেই ওর কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে।
সামুর পরের প্রশ্ন জুইয়ের সাথে রাজ তখন রিলেশনে ছিলো না সেটা আপনি জানতেন?
জুইকে সিংগাপুর আপনি পাঠিয়েছেন?

আদি চুপ করে আছে।আদির নীরবতাই সামুকে সব উত্তর দিয়ে দিচ্ছে।আদি মাথা নিচু করে রেখেছে।এতোক্ষণ সামুর চোখে আগুন থাকলেও এখন সামুর চোখ ছলছল করছে।ওর মন বারবার বলছিলো রাজ মিথ্যা বলছে। কিন্তু আদির নীরবতা ওর হৃদয়টাকে ভেঙে চুরমার করে ফেলছে।

সামু তবুও আদির কাছ থেকে না উত্তর শোনার জন্য বললো,
—–আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।

আদি জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,
—–হ্যা এসব সত্যি।

সামু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।ওর মনে হচ্ছে আদির কথাগুলো ওর কানে হাজার বার করে বাড়ি খাচ্ছে।
সামু ফ্লোরে বসে পড়ল।তারপর ছলছল চোখে বললো,
—–এতবড় ধোকা?আপনি আমার সাথে এতবড় গেম খেলেছেন?
আপনি জানেন আজ আমি এই ঘরে কত স্বপ্ন নিয়ে,আপনাকে কতটা ভরসা করে
বিশ্বাস করে এসেছিলাম? ভেবেছিলাম আজ থেকে আমি নতুন করে বাচবো আপনার সাথে।আর আপনি আমায় এ ঘরে ধোকা দিয়ে আনলেন?
আপনাকে সেদিন বলেছিলাম আমি কাউকে আর বিশ্বাস করবোনা,অনেক বার ধোকা খেয়েছি।আপনি আমার হাতে হাত রেখে বলেছিলেন আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি।আপনি আমাকে কখনো ধোকা দেবেন না কিন্তু আপনি আমাকে সবচেয়ে বড় ধোকা দিলেন? কি ক্ষতি করেছিলাম আপনার?

আদি সামুর সামনে হাটু গেড়ে বসে বললো,
—–সামু আমি এসব করেছি কিন্তু কেন করেছি।

—–আপনি এসব করেছেন কারণ আপনি আমাকে হেট করতেন তাই।

—–না আমি এসব করেছি তোমার জন্য,তোমাকে পাওয়ার জন্য।কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসতাম।যেখানে আমি তোমার বিয়ে মেনে নিতে পারছিলাম না সেখানে রাজের মতো একটা ছেলের সাথে তো নয়।হ্যা আমি জুইকে এনেছিলাম বাট ব্রেকাপের কাহিনি মিথ্যা থাকলেও রাজ একটা ক্যারেক্টারলেস ছেলে।বিয়ের আগে মানুষের অসংখ্য রিলেশন থাকতে পারে,বিভিন্ন কারণে,পরিস্থিতির কারণে ব্রেকাপ হতেই পারে কিন্তু রিলেশনে থাকা কালীল সময়ে প্রতিটি মেয়ের সাথে ইন্টিমেট হয়েছে।ও রিলেশনের নামে সবাইকে জাস্ট ব্যবহার করেছে।এমন একটা ছেলের সাথে তোমার যায়না।

—–আর আপনার সাথে যায় তাই বিয়েই করে নিলেন।

—-সামু আমার জাস্ট বিয়ে ভাংগার প্ল্যান ছিলো।বিয়ে করার নয়।কিন্তু তোমাকে বিয়ে করার সুযোগ পেয়ে আর না করিনি।কে না চাইবে তার ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে নিতে।

সামু তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।
—–আমি কত বোকা দেখেছেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি রাগী,জেদি হলেও আপনার মাঝে কোনো প্যাচ নেই।আপনি যা বলেন যা করেন সব সামনাসামনি।কিন্তু না আপনারও অন্য রুপ আছে।আপনিও রাজের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।আপনাদের মধ্যে কোনো তফাত নেই।দুজনেই আমার কাছে ভালো মানুষের মুখোশ পরে আমাকে বোকা বানিয়েছেন।আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলেছেন।
আর ভালোবাসা এসব নাটক বন্ধ করুন প্লিজ।আর নিতে পারছিনা।

আদি সামুর দুগালে হাত রেখে বললো,
—–সামু নাটক নয় আই রিয়েলি লাভ ইউ।প্লিজ ট্রাস্ট মি।

—–ট্রাস্ট? আপনাকে? আর নয়।
সামু আদিকে ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিলো।

আদি এতোক্ষণ নরম থাকলেও এখন আর নিজের রাগটা কন্ট্রোল করতে পারছেনা।রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
আদির চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে।তাই চোয়াল শক্ত করে বললো,
——আমি রাজের হাত থেকে তোমাকে বাচিয়ে পাপ করে ফেলেছি?আমার জন্য তুমি বেচে গেছো।

—–আমাকে বাচানো যদি আপনার উদ্দেশ্য হতো তবে বিয়ের দিন এমন সিন ক্রিয়েট করে আমাকে অপমানিত করতেন না।সবার সামনে ছোট করতেন না।আগেই সবটা জানাতেন।

—–তোমাকে বললে তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে?কখনোই না।

সামু চোখের পানি মুছে বললো,
—–ওকে ফাইন।আমাকে না বললেও আপনার মা,বাবা,নিশিপুকে বলতে পারতেন।কিন্তু আপনি কাউকে বলেননি
তারা তো আপনাকে বিশ্বাস করতো তাইনা।

আদি আমতা আমতা করে বললো,
——আমি এসব বিয়ের দিন করেছি যাতে রাজের বিষয়টি সবার মনে দাগ ফেলে দেয়।যাতে রাজ তোমার লাইফে ব্যাক করার কোনো চান্স না পায়।ওর প্রতি তোমার ঘৃণা জন্মে যায়।
ও একটা ফ্রড।ও তোমাকে ডিজার্ভই করেনা।

সামু আদির দিকে শান্ত চাহুনি দিয়ে বললো,
—–আর আপনি করেন?

আদি সামুর এমন প্রশ্নে চমকে গেলো।ও কি সামু যোগ্য না।সামুকে তাই মনে করে না।
আদিকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো,
—–আপনার বাবার প্রচুর টাকা পয়সা আছে।আপনি বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন।ব্যাস।

আদি কি উত্তর দেবে।
—–আমি যাই হই রাজের মতো নই।টাকা পয়সা তোমার খুশিতে ম্যাটার করে না জানি।বাট আমি রাজের মতো ক্যারেক্টারলেস নই।ওর মতো ১০মেয়ের সাথে বেড শেয়ার করে আসিনি।আমার লাইফে তুমিই প্রথম মেয়ে।তুমি ছাড়া আমি অন্য কোনো মেয়ের কাছে কখনো যাইনি।হ্যা আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই,বাপের টাকা উড়াই,ড্রিংক করি কিন্তু আমার লাইফে আমি শুধু তোমাকে চাই।আর তোমাকে পাওয়ার জন্য এমন করেছি।প্রয়োজন পড়লে আবারো করবো।

সামু উঠে দাড়িয়ে বললো,
—–ব্যাস অনেক হয়েছে।অনেক।আমি আর এখানে এক মুহুর্ত থাকতে পারছিনা।আপনি আমাকে শেষ করে দিয়েছেন।

সামু নিজের জিনিসপত্র এক জায়গায় করছে আর চোখের পানি মুছছে।
আদি উঠে গিয়ে সব নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো।
সামু কেপে উঠলো।
আদি চিতকার করে বললো,
—–অনেক হয়েছে।রাজকে মনে পড়ছে তাইনা?ওকে বিয়ে করতে পারোনি বলে কষ্ট হচ্ছে?এতো ভালোবাসা?

সামু আদিকে ধাক্কা মেরে বললো,
—–ইউ নো হোয়াট? রাজ আমাদের মাঝখান থেকে কখনো যাবেনা।আপনি যেতে দিবেন না।ওকে আপনি অকারণে বারবার টেনে আনবেন।রাজ জাস্ট আমার ফ্রেন্ড ছিলো।
উনি জয় ভাইয়াকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো আর আমি হ্যা বলেছিলাম কেন জানেন আপনার জন্য।আপনার জন্য আজ আমার জীবন এখানে এসে থেমেছে।শুধু আপনার জন্য।

আদি অবাক হয়ে বললো,
—–আমার জন্য? আমার জন্য কেন?আমি তোমাকে বলেছিলাম বিয়ে করতে।

—–মানুষের জীবনের জন্য আত্মসম্মান অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।আর আপনি আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেন।আপনি আমাকে সেদিন যা নয় তা বলে অপমান করেছিলেন।আমি আপনাদের থেকে বেনিফিট নিচ্ছি।আপনাদের খাচ্ছি,পড়ছি,আপনাদের দয়াই আছি।এসব কথা শুনে কেউ পড়ে থাকতে পারেনা।তাই দূরে যেতে চেয়েছিলাম।এখন আমি না চাইতেও কোথাও যেতে পারবোনা।কেননা এটা আমার শ্বশুর বাড়ি।মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি থেকে যতই অত্যাচারিত হোক সেখানেই পড়ে থাকতে হবে।আমাকেও থাকতে হচ্ছে কিন্তু আপনার সাথে আমি থাকবোনা।

আদি সামুর দুবাহু চেপে ধরে বললো,
—–তুমি কোথাও যাবেনা।আগের বারের চলে যাওয়া মেনে নিয়েছি কিন্তু এবার নিবোনা।এ ঘর থেকে এক পা বাইরে দিয়ে দেখো কি করি আমি।তোমার পা ভেঙে আমি রেখে দেবো।
তোমার কাছে যখন আমি অপরাধী হয়েছি আরো অপরাধী হতে পারবো বাট তোমার চলে যাওয়া আমি মেনে নিবোনা।
এই মেয়ে কে তুই?কি তোর পরিচয় এগুলো আমি দেখতে গিয়েছি?দেখতে যাইনি।আমি জাস্ট তোকে ভালোবেসেছি।ভালোবেসে এসব করেছি।আমি শেষ বারের মতো বলছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভুল করেও ভাববিনা।তাহলে এর ফল ভালো হবেনা।সবাইকে এর ফল ভোগ করতে হবে।

—–আপনার মতো জঘন্য লোক আমি দুটো দেখিনি।

আদি বাকা হেসে বললো,
—–কারণ আমি আদি।আদির কপি হয়না।
ঘৃণা করো যাই করো আমার সাথেই থাকতে হবে।আমাকে খারাপ হতে বাধ্য করোনা।ওকে?
আদি ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

সামু মেঝেতে বসে কাদছে।ওর বুক ফেটে যাচ্ছে।
“আদি আমি মানতে পারছিনা আপনি এতটা নিচে নামতে পারেন।আপনি এসব করেছেন।আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা।বিশ্বাস করতে পারছিনা।নিজেকে সামলাতে পারছিনা।রাজের ধাক্কা আমি সামলে নিয়েছি।সেদিন এত কষ্ট হয়নি কেননা রাজকে আমি ভালোবাসিনি।ও আমার আপন ছিলো না।কিন্তু আপনার দেওয়া এই আঘাত আমি সামলে নিতে পারছিনা।আপনাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম, আপন ভেবেছিলাম।আপন মানুষের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বিধাতা আমাকে দেয়নি।আপনি যদি আরো আগে আমাকে বলে দিতেন তবে এতো কষ্ট পেতাম না।তিলে তিলে গড়া বিশ্বাস আপনি ভেঙে দিয়েছেন।জানিনা কখনো জোড়া লাগবে কিনা।”
“তোমার শহর রংগীন জীবন,
চোখ ধাধানো আলো
আমার শহর আমার মতোই
অন্ধকার আর কালো।”

আদি রাতের বেলায় বাড়িতে ফিরে নিজের রুমে আসে।পুরো ঘর অন্ধকার।আদি লাইট অন করে।তারপর সামুকে খোজতে থাকে।সামু টেবিলের উপরে মাথা রেখে কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আদি ওর পাশে গিয়ে বসে।ওর এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,
“জানি তুমি সত্যিটা জানার পর অনেক কষ্ট পেয়েছো।জানতাম মানতে পারবেনা তাই বলিনি।কিন্তু আমার যে এ ছাড়া কিছুই করার ছিলো না সামু।তুমি কবে আমার ভালোবাসাটা বুঝবে?”

আদি সামুকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো।সামু গভীর ঘুমে বিভোর।ও বিছানায় একটু নড়ে-চড়ে আবারো গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলো।ঘুমে মিনমিন করে বললো,
“আমার শীত লাগছে খুব।একটা চাদর দেওনা।”

আদি তাড়াতাড়ি চাদর নিয়ে ওর গায়ে দিয়ে দিলো।সামু চাদরটা আকড়ে ধরলো।আদি হাতটা সামুর মাথায় রাখলো।তারপর ভাবতে লাগলো ওরা কত সুন্দর সময় কাটিয়েছে,কত কথা,খুনসুটি,ঝগড়া কিন্তু আজকের মতো ঘটনা কখনো ঘটেনি।সামু সবটা কবে মেনে নিবে আদোও মেনে নিবে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে ওর মনে।
আদি সামুর কপালে ঠোঁট ছুইয়ে ওর গায়ের উপর হাত রেখে শুয়ে পরলো।
“আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা সামু।বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি।আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও।”

সামু সকালে ঘুম ভেঙে দেখে ও বিছানায় শুয়ে আছে।ওর গায়ের উপর আদির হাত।দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।হাত টান মেরে সরিয়ে দিয়ে উঠে গেলো।টান লাগায় আদি জেগে যায়।তারপর দেখে সামু বেড থেকে নামছে।

সামু রেডি হয়ে ভার্সিটির জন্য বেড়ুচ্ছে।বাড়ির বাইরে যেতেই আদি গাড়ি এনে সামুর সামনে দাড়ালো।তারপর অন্যদিকে সরে যেতে নিয়ে থেমে গেলো।গাড়ির দরজা খোলে আদির পাশে বসে সিট বেল্ট লাগিয়ে নিলো।আদি গাড়ি চালাচ্ছে।দুজনের কারো মুখে কথা নেই।আদি কিছু বলতে যাবে তখনই সামু কানে হেডফোন গুজে নিলো।
আদির মাথায় যেনো ধপ করে আগুন জ্বলে গেলো।
রাগে গজগজ করতে করতে ওর কান থেকে হেডফোন খোলে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিলো।
সামু চোখ বড়বড় করে আদির দিকে চেয়ে আছে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে