তোমাকে বলার ছিল পর্ব-০১

0
2194

তোমাকে বলার ছিল…
প্রথম পর্ব
1.
-আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা
-বুঝতে না পারার মত তো আমি কিছু বলিনি তৃণা I ব্রেকআপ মানে ব্রেকআপ
– এক মিনিট I তুই বলতে চাইছিস তুই আর সুজনের সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চাস না ?
– না চাইনা
– কিন্তু কেন ? সব তো ঠিকই ছিলো
– এখন আর ঠিক নেই
– কেন কি করেছ ও ?
– কিছুই করেনি
– মানে ? কিছুই করেনি তাহলে সম্পর্ক ভাঙতে যাচ্ছিস কেন ?
– ওফ I এত কথা বলতে পারবোনা I তুই ওকে বলে দে আজ থেকে আমার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক নেই

তৃণার এবার সত্যি সত্যি মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে যায় I গত এক বছর ধরে নানান ধরনের নাটক করে হিয়া সুজনের সঙ্গে এ সম্পর্কটা করেছে আর এখন ছয় মাসের মাথায় বলছে সম্পর্ক শেষ I তাও যদি তৃনাকে এসবের মধ্যে না জড়াতো তবু একটা কথা ছিল I পুরো ব্যাপারটা মধ্যেই তৃণা জড়িয়ে আছে I ওই সুজন কে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল যে হিয়া ওকে কতটা ভালবাসে I এখন আবার ওকে বলতে হবে
যে সম্পর্ক শেষ ?

তৃণা বেশ বিরক্ত গলায় বলল

– তোর যা বলার নিজে গিয়ে বল I আমাকে এর মধ্যে টানিস না
হিয়া এবার নরম হলো I কাছে এগিয়ে এসে তৃণার হাত দুটো ধরে বলল
-এমন করিস না দোস্ত I

কথা হচ্ছিল টিএসসির করিডোরে বসে I তৃণা ঘড়ি দেখল I ওঠা দরকার I না হলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে I হিয়া বলল
– তোর নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে I চল কিছু খাই I

বেলা তখন প্রায় দেড়টা বাজেI তৃণা কে বাস ধরতে হবে I টিউশনিতে যেতে হবে I তিনটা থেকে পড়ানোর কথা I এখনো তৃণার খাওয়া হয়নি I পড়ানো শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায় I ততক্ষণে বাড়িতে সবার খাওয়া শেষ হয়ে যায় I মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে তৃণ দেখে পাতিলের কোনে তলানি একটু ভাত পড়ে আছে I কোন কোন দিন সেটাও থাকেনা I সবাই ভাবে তৃণা হয়তো খেয়ে ফিরবে I

স্টুডেন্টের বাসায় মাঝে মাঝে চা দেয়I কখনো কখনো চায়ের সাথে হালকা নাস্তা ও থাকে I কোন কোন দিন দিতে বড্ড দেরি করে ফেলে I মাঝে মাঝে আন্টি বাড়ি না থাকলে দেয় ও না I তৃণার ভীষণ খিদে পায় সে সময়ে তাই আজকাল যাবার আগেই কিছু খেয়ে নেয় I আজ এখন পর্যন্ত কিছু খাওয়া হয়নি I হিয়া ওকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে I তৃণার সত্যিই খিদে পেয়েছে কিন্তু এখানে এভাবে খেতে ইচ্ছা করছে না I তৃনা বললো
– না আমি এখন উঠবো
– এমন করিস না ভাই Iতুই জানিস না কি হয়েছে
– কি হয়েছে বল আমাকে I সুজন কিছু বলেছে তোকে ?
– আরে না I ও কি বলবে ?
– তাহলে সমস্যা কি ?
– আমার আর ওকে ভালো লাগছেনা
তৃণার এবার প্রচন্ড রাগ হল I কয়েকদিন আগেও হিয়া সুজনের জন্য মরে যাচ্ছিল I কান্না টান্না করে কি হুলুস্থুল অবস্থা I আর এখন ভালো লাগছেনা ?

সুজন ওদের ক্লাসের সবচেয়ে ভদ্র শান্ত এবং চুপচাপ ছেলে I ছাত্র ও সেইরকম ভালো I অনেকেই ওকে চলমান ডিকশনারি বলে I কারো কিছু বুঝতে সমস্যা হলে ওর কাছেই যায় I কোন রেফারেন্স বুক না দেখেই ও ঝটপট উত্তর দিয়ে দেয় I বুঝিয়ে ও দেয় সুন্দর করে I কখন ও বিরক্ত হয়না I দেখে মনে হয় ব্যাপারটাতে ও বেশ আনন্দ পায় I তৃণা বেশ কয়েকবার গেছে ওর কাছে পরিসংখ্যানের নানা ফর্মুলা বুঝতে I ফার্স্ট ইয়ারে পরিসংখ্যান ক্লাস এর জন্য অনেকেই দুই মাসের কোচিং করেছিল I তৃণা করতে পারেনি I 6000 টাকা দিতে হতো I তাই ও নিজেই চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষের দিকে এসে হাল ছেড়ে দিয়েছে I পাস ই করতে পারত না যদি না সুজন সাহায্য করত I সুজন অবশ্য আলাদাভাবে ওর জন্য তেমন কিছু করিনি I অনেকেই গেছিল ওর কাছে I সবাইকেই খুশিমনে সাহায্য করেছে ও I হিয়া ও ছিল ওদের মধ্যে I এই পড়ানোর সময়ই বোধহয় হিয়ার ওকে ভালো লেগে যায় I তারপর যখন রেজাল্টের পর দেখা গেল সুজন প্রথম হয়েছে তখন হিয়া হঠাৎ করেই ওর প্রেমে পড়ে যায় I কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করেই সুজনকে বলে বসে I সুজন ওকে কি বলেছিল কেউ জানে না কিন্তু এরপর হুলুস্থুল বাধে I হিয়া খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে তুলকালাম করে বাড়িতে I হিয়ার মায়ের ফোন পেয়ে তৃণা এসে দেখে ওর এখন তখন অবস্থা I

-কি হয়েছে ? তৃণা জানতে চাইল
– ও আমাকে মানা করে দিয়েছে I হিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল
– কে ?
– কে আবার সুজন
– তুই ওকে কখন বললি ?
– কাল
-তুই ওকে বলতে গেলি কেন ?
– আমি ওকে ভালোবাসি
তৃণা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I হিয়ারএই প্রথমবার নয় I ক’দিন পরপরই ওর কাউকে ভালো লাগে I কখন ও ফোনে কখনো বা ফেসবুকে I কিছুদিন বেশ চলে I তারপর ও খেই হারিয়ে ফেলে I কিন্তু হিয়া সুজনের মত ছেলেকে ভালোবাসবে এটা তৃণা আশা করেনি I তৃণা বলল
– তুই কি সিরিয়াস ? আরেকবার ভেবে দেখ I সুজন কিন্তু তোর টাইপের না
– তুই ও দেখি এই কথাই বললি ?
– মানে?
– সুজন ও এটাই বলেছে
– কি ? যে তুই ওর টাইপের না ?
– না
– তাহলে ?
– বলেছে ও নাকি আমার টাইপের না I কদিন পর আমার আর ওকে ভালো লাগবে না
– ঠিকই তো বলেছে I তুই আবার ভেবে দেখ I
– অনেক ভেবেছি I ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না I

তৃণা আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে I প্রতিবার একই ডায়লগ I তৃণা পাত্তা দেয় না I বাড়ি ফিরে যায় I
সে রাতেই হিয়া আত্মহত্যার চেষ্টা করে I এক বোতল ডেটল খেয়ে ফেলে I খুব ভোর বেলা তৃণার কাছে ফোন আসে I হিয়ার মা কাঁদতে কাঁদতে করে বলে
– তুই আমার মেয়েটাকে বাঁচা I ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই I
তৃণা যখন হাসপাতালে পৌঁছালো ততক্ষণ এ হিয়ার স্টমাক ওয়াশ করে বেডে দিয়ে দিয়েছে I হিয়ার মা তৃণা কে দেখে জড়িয়ে ধরলেন তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললেন
– তুই কিছু কর তৃণা , না হলে মেয়েটা আমার মরে যাবে
তৃণা হিয়াকে দেখে চমকে উঠলো I একদিনে কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার I তৃণা কাছে গিয়ে হিয়ার হাত ধরল I হিয়া ক্ষীণ স্বরে বলল
– ও কি আমার কথা জেনেছে ?
– না I
তৃণা হিয়ার হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে বলল
– আমি তোকে কথা দিচ্ছি আমি সব ঠিক করে দেবো

2.

রাত প্রায় সাড়ে দশটা I সুজন ওর ঘরের লাগোয়া বারান্দায় অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে I ওর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট I সুজন সচরাচর সিগারেট খায় না I আজ অসম্ভব অস্থির লাগছে I হাতের সিগারেট পুড়তে পুড়তে যখন আঙ্গুলে ছ্যাকা লাগলো তখন খেয়াল হল সুজনের I ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এগারোটা বাজতেছে আর পাঁচ মিনিট বাকি I কালকে হিয়া মেসেজ করে নি I আজও কি করবেনা ?

প্রতিদিন রাত এগারোটায় হিয়া ওকে একটা মেসেজ পাঠায় I খুবই অদ্ভুত মেসেজ I কোন সম্বোধন নেই I ভূমিকা উপসংহার কিছু নেই I কবিতার কয়েকটা লাইন থাকে শুধু I সেই প্রথম দিন থেকে এটাই হয়ে আসছে I এগারোটায় একটা এর ঠিক আধঘন্টা পর আরেকটা I এরপর বারোটায় আরেকটা আসে I শেষ মেসেজটা দেখে তবেই সুজন শুতে যায় I

কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি ও I বারবার মেসেজ চেক করছিল I হিয়া অফলাইনে ছিল I কোন সমস্যা হয়েছে কি ? ফোনটা ও বন্ধ I কিছুই বোঝা যাচ্ছে না I এত রাত না হয়ে গেলে তৃণা কে একটা ফোন করা যেত I ওর কাছ থেকে জানা যেত কি হয়েছে হিয়ার I

সুজন আবার ঘড়ি দেখল I 11:05 I সিগারেট ফেলে দিয়ে বারান্দায় রাখা দোলনায় বসল সুজন I বলতে গেলে এ বাড়িতে ও একাই থাকে I গেস্টরুমে মজিদ চাচা থাকেন I মজিদ ওদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় I এখানেই থাকে , বাড়ির দেখাশোনা করে I একটা কাজের লোক আছে প্রতিদিনে এসে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে রান্না করে দিয়ে যায় I সুজনের বাবা-মা থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ায় I ওর বড় বোন বৈবাহিক সূত্রে আমেরিকার নাগরিক I সুজনের চেয়ে প্রায় 9 বছরের বড় I বিয়ের পরপরই বাবা-মায়ের জন্য এপ্লাই করে I বেশ ক’বছর লেগে যায় নাগরিকত্ব পেতে I বছর চারেক আগে সব গুছিয়ে ওনারা পাকাপাকিভাবে আমেরিকায় চলে যান I সুজন কে ও নিয়ে যেতে পেয়েছিলেন কিন্তু ও রাজি হয়নি I তখন সামনে এইচ এস সি পরীক্ষা I তাই মজিদকে এখানে রেখে উনাদের যেতে হয় I মজিদ অবশ্য অনেক বছর ধরেই ওদের আরেকটা প্রপাটির কেয়ারটেকার হিসেবে আছে I অনেক পুরনো এবং বিশ্বস্ত লোক I এখনো সমস্ত প্রপার্টি দেখাশোনা করে আর রাতে এসে এখানে থাকে I কথা ছিল এইচএসসির পর সুজন ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাবে I ওখানে গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করবে I কিন্তু সুজনের স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার I তাই ওর পছন্দের সাবজেক্টে চান্স পাওয়ার পর ও আর যেতে রাজি হল না I

সুজন বরাবরই ভাল ছাত্র I পড়াশোনাটা ওর কাছে নেশার মত I পাঠ্য বই ছাড়াও প্রচুর গল্প-উপন্যাস পড়ে ও I তবে ওর সবচেয়ে প্রিয় কবিতা I প্রতিরাতে কবিতা না পড়লে ওর ভালই লাগেনা I ওদের ড্রইংরুমে বিশাল লাইব্রেরী I প্রচুর বইয়ের কালেকশন সুজনের I প্রতিবছর বইমেলা থেকে ও অনেক বই কেনে I ওর নিজের ঘরেও দুটো বইয়ের আলমারি ভর্তি বই I
সুজন আবারও ঘড়ি দেখল I 11:35 I নাহ , আজও বোধ হয় আর মেসেজ করবে না হিয়া I তবুও ফোন হাতে অন্যমনস্ক ভাবে বসে রইল ও I হিয়া ওকে খুব ছেলে মানুষের মত প্রপোজ করেছিল I একেবারেই পাত্তা দেয়নি সুজন I ওকে যে অনেক মেয়ে প্রেম নিবেদন করেছে তেমন কিছু নয় I তবে স্কুল কলেজে থাকতে ও প্রচুর চিঠি পেত মেয়েদের কাছ থেকে I এসব নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায়নি সুজন I ওর কল্পনার জগতে কবিতার মতো নির্মল কেউ একজন ছিল I তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিল এতদিন I হিয়া খুবই হালকা ধরনের , প্রাণোচ্ছল ছটফটে মেয়ে I একেবারেই সিরিয়াসলি নেয় নি তখন I এর তিন দিন পর ঠিক রাত এগারোটার সময় প্রথম মেসেজটা আসে I মেসেজ দেখে চমকে গিয়েছিল সুজন I শুধু কয়েক লাইন কবিতা আর কিছু নেই I

তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।
ইচ্ছে হলে দেখতে দিও, দেখো
হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিও, রেখো
অপূণতায় নষ্টে-কষ্টে গেলো
এতোটা কাল, আজকে যদি মাতাল জোয়ার এলো
এসো দু’জন প্লাবিত হই প্রেমে
নিরাভরণ সখ্য হবে যুগল-স্নানে নেমে।
থাকবো ব্যাকুল শর্তবিহীন নত
পরস্পরের বুকের কাছে মুগ্ধ অভিভূত।

সুজন তখন লোরকার একটা বই নিয়ে সবে বসেছে I প্রতিদিন রাতেই ঘুমাতে যাবার আগে কবিতা পড়ে ক I এরকম একটা কবিতা ও আশা করেনি হিয়ার কাছ থেকে I অবাক হলেও খুব একটা পাত্তা দেয়নি সুজন I বই বন্ধ করে ঘুমাতে চলে গেছিল I 11:30 এ আরেকটা এল I

তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই
এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;

সুজন একটু হাসলো I ভাবল হয়তো কোন খান থেকে কপি পেস্ট করে দিয়ে দিয়েছে I কিন্তু যখন তৃতীয় কবিতাটার এল সুজন ভুত দেখার মত চমকে গেল I কারণ তৃতীয় কবিতাটা ছিল লোরকার

Every song
is the remains
of love.

Every light
the remains
of time.
A knot
of time.

And every sigh
the remains
of a cry.

তবে কি হিয়া ওকে দেখতে পাচ্ছে ?

লেখনীতে
অনিমা হাসান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে