তুমি নামক সপ্তর্ষি মন্ডলের প্রেমে ২ পর্ব-৬+৭

0
1145

#তুমি_নামক_সপ্তর্ষি_মন্ডলের_প্রেমে💖
#দ্বিতীয়_খন্ড [ কার্টেসিসহও কপি করা নিষেধ ]
৬+৭.( The Final Mystery-2 )

‘ ইট মিনস তোমরা তখনই আলাদা হয়ে গেছিলে? তাহলে তুমি তাহরীমকে সম্পূর্ণ রূপে ভুলে কি করে গেলে যে ওর সঙ্গে ব্রেক আপ না করেই আমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালে ? ‘ আমার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে বললো আরাফাত।

‘ পুরো কথা না শুনেই কথা বলা তোমার পুরনো অভ্যাস তাইনা আরাফাত? ‘ আমি আরাফাতের এত প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে বিরক্তির সুরে বললাম ।

আরাফাত আমার কথায় আমার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালো। ও যে আমার এরকম রাগ দেখানোতে বিরক্ত হচ্ছে সেটা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি কারণ আগে ওই তো একমাত্র আমার উপর রাগ দেখাতো কিন্তু তখন পরিস্থিতি আলাদা আর এখনের পরিস্থিতি আলাদা।এখন আর আমি আগের আফরিন নেই যে সবসময় ভয়ে জর্জরিত ছিল।তাছাড়া আমাদের সম্পর্কও এখন আর আগের জায়গায় নেই যে আমরা একজন আরেকজন কে দেখলে কোনো ধরনের অনুভূতি অনুভব করবো সে হোক রাগ বা ভয়।

আমি আরাফাতের দিকে তাকিয়ে আবারও বলতে শুরু করলাম,
আফরিন: একমাস টানা বাড়িতে বন্দী ছিলাম আমি।বাবা তার কানেকশন কাজে লাগিয়ে আমার সম্পর্ক থাকার ব্যপারটা লুকিয়ে গেছে সবার কাছে।আমার তখন বেহাল দশা।ডাক্তার সাহেব আমার সঙ্গে একদিন লুকিয়ে দেখা করতে এসেছিলেন বলে বাবা উনাকে প্রায় শুট করতে নিয়েছিল,শুধু আমার কারণে পারেনি।

তখনকার যুগ এতটাও পুরনো ছিলো না তবুও ডাক্তার সাহেব একদিন পোষা কবুতর কে কাজে লাগিয়ে আমার কাছে ছোটো চিরকুট পাঠালেন যার সারমর্ম এই ছিল যে কাল ভোর ছয়টায় আমরা একসঙ্গে পালাবো তাই যেন ভোর ছয়টায় বাড়ির বাউন্ডারি টপকে বাইরে মেন রোডে চলে আসি।

এতদিন পর ডাক্তার সাহেবের হদিস পেয়ে আর নিজেকে এই বন্দী দশা থেকে মুক্ত করতে পারব জেনে সেই রাতটা নিদ্রাহীন ভাবে কেটে যায়। পরেরদিন তখন ভোর ছয়টা,আমি ডাক্তার সাহেবের কথা মত বাড়ির বাউন্ডারি টপকে মেন রোডের দিকে পা বাড়াই কিন্তু এইদিকে যে বাবা আমাকে বাড়ি থেকে পালাতে দেখে ফেলেছে সেটা আর আমার জানা হয়নি।

আমি আর ডাক্তার সাহেব তখন দুজনে রাস্তার দুপারে।এতদিন পর একজন আরেকজন কে দেখে যেন চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেছি।ডাক্তার সাহেব উনার জায়গায় স্থির হয়ে গেছেন আর আমি সম্মোহিতের মত এগিয়ে যাচ্ছি ডানে বামে না তাকিয়ে।অন্যদিকে ডাক্তার সাহেব কে উদ্দেশ্য করেই বাবার ঠিক করা একটা ট্রাক দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে শুধুমাত্র ডাক্তার সাহেবকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিবে বলে।

কিন্তু সৌভাগ্যবশত ট্রাকটা ডাক্তার সাহেবের অ্যাক্সিডেন্ট করতে পারেনি কারণ ডাক্তার সাহেব রাস্তার ধারে ছিলেন আর আমি ততক্ষনে রাস্তার মাঝে চলে এসেছি আর ফলশ্রুতিতে অ্যাক্সিডেন্ট টা আমার হয়। অ্যাক্সিডেন্টের আগে শুধু বাবার ঠোঁটের কোণে হাসিটা দেখেছিলাম যেটা লোকজোনের ভিড়ের মাঝে ছিল। তারপরই আমি জ্ঞান হারাই।

আমার অ্যাক্সিডেন্টের সাথে সাথে ডাক্তার সাহেব আমাকে হসপিটালে নিয়ে যান।আমার যে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে সেটা বাবা আগেই জানতে পেরেছিল কিন্তু কেউ যাতে বাবার উপর সন্দেহ করতে না পারে তাই আমার অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পাক্কা দুই ঘণ্টা পরে গিয়ে হসপিটালে হাজির হয়।ডাক্তার সাহেব কে আমার অ্যাক্সিডেন্ট করানোর মিথ্যা মামলায় একদিন এক রাত জেলে ঢুকিয়ে দেয়।আমার অ্যাক্সিডেন্টের কারনে এতটাই বাজে অবস্থা হয়েছিল যে আমার অপারেশন করতে হয়।

আমার অপারেশনের পর আমি এক মাস কোমায় ছিলাম।সেই একমাসে বাবা আমার পাসপোর্ট থেকে শুরু করে লন্ডনের ভিসা সবকিছু করিয়ে ফেলে যাতে আমি একটু সুস্থ হতেই আমাকে মামার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারে আর এর জন্য বাবাকে মামার হেল্প নিতে হয়েছে তাও ডাক্তার সাহেবের নামে মিথ্যা বলে।

এরপর আমার যখন জ্ঞান ফিরে মানে দীর্ঘ একমাস পর যখন কোমা থেকে ফিরে আসি তখন আমার অলরেডি মেমোরি লস হয়ে গেছে।বিগত দুই বছরের স্মৃতি আমি সবটাই ভুলে গেছি।এমনকি আমি যে hsc দিয়েছি সেটাও মনে ছিলনা আমার।আর বাবা সেটারই সুযোগ নিল।আমায় বলল যে আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তাই আমি বিগত দুই বছরে হওয়া সবকিছু ভুলে গিয়েছি কিন্তু এটা বললো না যে এই দুই বছরে আমার জীবনে ডাক্তার সাহেব নামক ভালোবাসার মানুষটাও ছিল।

ডাক্তার সাহেব যেহেতু হোস্টেলে থেকে উনার পড়ালেখা চালাতেন তাও সবটা একেবারে নিজের ক্ষমতায় তাই বাবার উনাকে একবার জেলে দেওয়ার পর উনি আমার সঙ্গে আর দেখা করতে আসেন নী তবে হ্যাঁ উনার বড় ভাই মানে তাহসান ভাইকে উনি আমাদের ব্যাপারে সবটা জানান আর তাহসান ভাইও সবটা জেনে আমাদের হেল্প করার প্রতিশ্রুতি দেন।ডাক্তার সাহেবের কানে যাতে আমার বিদেশে যাওয়ার খবরটা না যায় তার সব ব্যবস্থা বাবা করে রাখে যার কারণে ডাক্তার সাহেব জানতেও পারেন না আমার দেশ ছেরে যাওয়ার ব্যাপারে।যখন জানতে পারেন ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে কারণ আমি অলরেডি ফ্লাইট বোর্ড করে ফেলেছি।

দেখতে দেখতে পাচ বছর কেটে গেলো।এর মাঝে আমার দেখা হলো তোমার সঙ্গে আর তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হলো। দেখতে দেখতে সেটা ভালোবাসায় রূপ নিলো তবে সেটা শুধুমাত্র তোমার ক্ষেত্রে কারণ সত্যিকারের ভালোবাসা তো শুধুমাত্র একবারই হয়।তারপর তোমার সঙ্গে আমার ব্রেকআপও হলো আবার ফিরোজা বেগম কে দিয়ে বাবা মিথ্যা কথা বলালো যাতে আমি বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাই।আর বাবার ইচ্ছাই সত্যি হলো।তোমার কাছ থেকে পালাতে আর বাবার কথা ভেবেই আমি কাউকে কিছু না বলেই বাংলাদেশে ফিরে এলাম। বাংলাদেশে ফিরতেই ফিরোজা বেগম সবার আড়ালে আমার বিয়ে ঠিক করলেন অর্ণবের সঙ্গে কিন্তু বাবা সেটা জানত না। আমিও ভাবলাম একসময় না একসময় তো বিয়ে হবেই তাছাড়া তোমার সাথে সম্পর্ককালীন যে তিক্ত স্মৃতি ছিল সেগুলোও ভুলতে চেয়েছিলাম তাই রাজি হয়ে গেলাম।ভেবেছিলাম বিয়ে হলে পড়াশুনা আর সংসারের মাঝে থেকে সবটা ভুলে যাবো।কিন্তু অর্ণব বললেন আমার এমবিবিএস শেষ হলে যেন বিয়ে হয়।

অর্ণবের কথায় ফিরোজা বেগম দমে গেলেন আর এইদিকে আমি অর্ণবের ব্যবহারে এতটাই খুশি হলাম যে বলে বুঝাতে পারবো না।অর্ণব আমায় DMC তে ট্রান্সফার হতে বললেন তাই আমি ওখানে ট্রান্সফার হলাম।ওখানেই আমার দেখা হলো ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে।এভাবেই আরও দেড় বছর কেটে গেলো কিন্তু হঠাৎ একদিন এক অজানা কারণে অর্ণব বললেন উনি নাকি এখনই বিয়ে করতে চান।তাই ফিরোজা বেগম বাবার অনুপস্থিতিতে আমার বিয়ে দিয়ে দিতে চাইলেন আর তখনই ঘটলো আসল গন্ডগোল। কোথা থেকে জানি অর্ণব আমার ডাক্তার সাহেবের কিছু পুরনো ছবি পেয়েছিলেন যার কারণে বিয়ে ভেঙে দেন আর ফিরোজা বেগম রেগে গিয়ে ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন আমার। সেখান থেকেই শুরু হয় আসল গল্প।

ডাক্তার সাহেব কে প্রথম থেকেই ভীষণ চিনা চিনা লাগতো আমার,উনাকে দেখলে কিছু ছেড়া স্মৃতি ভেসে উঠতো মানসপটে।বিয়ের পর তা আরও বেড়ে গেলো আর বিয়ের পর তো ডাক্তার সাহেবও আমার সঙ্গে অদ্ভুত ব্যবহার করতে শুরু করলেন। কখনও ভালো তো কখনও খারাপ।এখন বুঝতে পারছি সেই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কি।ডাক্তার সাহেব আমার খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলেন যে আমার মেমোরি লস হয়েছে তাই হুট করে পুরনো স্মৃতি মনে পড়লে সেটার প্রেসারে আমার লাইফ রিস্কও হতে পারে তাই উনি আমার আগের কেয়ারিং, লাভিং ডাক্তার সাহেব থেকে রাগী বদমেজাজি ডাক্তার সাহেব হয়ে গেলেন।

তারপর আমাদের লাইফে আবারও আগমন ঘটলো আমার বাবা নামক ভিলেনের।বাবা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে আমার কাছে ভালো সাজতে চেয়েছিল আর এইদিকে বাবাকে দেখে ডাক্তার সাহেব চটে যাচ্ছিলেন।এরপরই আবার তুমি এলে।সত্যি বলতে আমার মন থেকে তোমার ভয় তখনও কাটেনি।তোমার হুমকি শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই আর তোমার কথা শুনতে রাজি হয়ে যাই কিন্তু আমি তোমার পিছনেও গোয়েন্দা লাগিয়েছিলাম যার কারণে তুমি ডাক্তার সাহেব কে যা বললে সবই আমার কানে এলো।

এইদিকে বাবা আমাকে আর ডাক্তার সাহেব কে আলাদা করার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল।ডাক্তার সাহেবের অনুপস্থিতিতে আমার কাছে আমার ডাক্তার সাহেবের ছবিই পাঠিয়েছিল এই বলে যে ডাক্তার সাহেব আমাকে ঠকাচ্ছেন অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করে।কিন্তু বাবার ধারণাকে একেবারেই উল্টে দেয় আমার মস্তিষ্ক।মস্তিষ্কের পুরনো,অবহেলিত নিউরনগুলো জেগে উঠে আর মনে করিয়ে দেয় চাকচিক্যের চাপে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাময় স্মৃতিগুলো।

ছবিগুলো দেখতেই আমার মনে পরে ডাক্তার সাহেব আর আমার সেই বহু পুরনো ভালোবাসা আর তখনই আমি প্রচন্ড প্রেসারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।জ্ঞান ফেরার পর আমি ডিটেকটিভ এর কাছ থেকে জানতে পারি যে এসবের পিছনে বাবা ছিল তাই নতুন করে ঘটনা সাজিয়ে ফেলি।এমন ভাব ধরি কেন বাবার দেওয়া ছবিগুলো আমি বিশ্বাস করে নিয়েছি তাই বাবার সঙ্গে এখন চলে যাবো।তারপর সবাইকে বলি যে আমি ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে শেষবারের মত কথা বলতে চাই।আমার কথা শুনে বাবা কোনো প্রশ্ন না করেই চলে যায় আর আমি সবার আড়ালে ডাক্তার সাহেবের কাছে সবটা বলি আর আমার ফেক অ্যাক্সিডেন্টের কাহিনীও সাজিয়ে ফেলি।

দেন আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয় আর আমি সবার কাছে মৃত ঘোষিত হই।আমি জানতাম আমার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর বাবা কিছু না কিছু করবে কিন্তু ভাবতে পারিনি ডাক্তার সাহেব কে অ্যারেস্ট করাবে।এরপর ডাক্তার সাহেবের পালিয়ে আসার ব্যবস্থা করি। এন্ড নাও আমরা এখানে।

আমার এত লম্বা কাহিনী শুনে আরাফাত একেবারে স্তম্ভিত।ওর মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না।হয়তো ভাবতে পারেনি একটা সহজ সরল মানুষও যে এত কাহিনী করতে পারে দুজন ভালোবাসার মানুষ কে আলাদা করার জন্য।আরাফাত আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তারপর বললো,
আরাফাত: তোমার মা যে কাগজ দিয়েছিল বইয়ের মধ্যে।সেটার কি হলো? কি লিখা ছিল ওটার মধ্যে ?
আমি আরাফাতের কথা শুনে হেসে উঠলাম।আরাফাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে বললাম,
আফরিন: আম্মু অনেক ট্রিকস জানত।ছোটো থেকেই আশেপাশে যা দেখত তাই এপ্লাই করতো।এরকম করে করেই আম্মু অনেক কিছু শিখেছিল আর সেগুলো আমাকেও শিখিয়েছিল।এগুলোর মধ্যে একটা ছিল ইনভিজিবল রাইটিং।কাগজে লিখার পরও সেটা না দেখা দেওয়া।আম্মু আমায় শিখিয়েছিল কিভাবে ইনভিজিবল রাইটিং কে ভিজিবল করতে হয় তবে আমার সেটা মনে ছিলনা।

হঠাৎ কাল পুরনো জিনিস ঘাটাঘাটি করার পর বইটা আবারও খুঁজে পেলাম। বইটা খুলে কাগজটা বের করলাম।সাদা কাগজের দিকে কিছুক্ষন আনমনে তাকিয়ে রইলাম।হঠাৎ মনে পড়ল মায়ের শিখিয়ে দেওয়া ট্রিকটা।সাথে সাথে এপ্লাই করলাম।আগুনের উপর ধরলাম কাগজটা আর সাথে সেখানে লেখা ভেসে উঠলো।

‘ তুবা অ্যান্টি ওয়াস কূয়াইট ইন্টেলিজেন্ট!তারপর কি হলো? কি লিখা ছিলো কাগজে?’ আরাফাত অবাক হয়ে বললো।

আমি আলতো হেসে বলাম,
আফরিন: আমার জীবনের সবথেকে বড় রহস্য।মিষ্টার আনসারী আমার বাবা নন।আমার বাবা অন্য কেউ আর সেটা কে সে তো মিস্টার আনসারীই বলতে পারবেন তাও আবার ধরা খেয়ে তার জন্য ফিরোজা বেগম কে তুলে আনতে হবে আমাদের। সো মিশন ফিরোজা বেগম স্টার্ট… ‘ আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললাম।
বিনিময়ে আরাফাতও বাঁকা হাসলো।

৭.( The Final Mystery-3 )

ধড়াম ধড়াম শব্দ করে তখন থেকে দরজা ধাক্কা দিয়ে চলেছে কেউ একজন।ফিরোজা রান্নাঘরে বাসনকোসন মাজছিল তাই সব ফেলে রেখে আসতে পারছিল না কিন্তু রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে বলার পরও যে দরজা ধাক্কাচ্ছে সে তো শুনতেই চাইছে না বলেই এভাবে ধাক্কা দিয়েই চলেছে।বাধ্য হয়ে ফিরোজা হাতের বাধন ফেলে হাত ধুয়ে উঠে শাড়ির কুচি উঠিয়ে দৌড় দিল।

দৌড়ে গিয়ে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই ওর চোখে পড়লো সামনে দাড়িয়ে থাকা কিছু কালো পোশাক পরিহিত লোক যাদের মুখ কালো রঙের মানকি ক্যাপের আড়ালে ঢাকা।ওদের কাধে বড় বড় বন্দুকও আছে।ফিরোজার আর বুঝতে বাকি রইলো না এরা কারা।ফিরোজা তাড়াতাড়ি করে দরজা লাগানোর চেষ্টা করলো কিন্তু তার আগেই লোকগুলোর মধ্যে একজন দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে দিল আর ভিতরে ঢুকে গেলো। ওই লোকের পিছন পিছন বাকিগুলো লোকও ঢুকলো।

ফিরোজা প্রচন্ড ভয়ে থরথর কাপছে। ও এই অপরিচিত লোকদের ব্যবহার আর বেশভূষায় বুঝে গেছে যে এরা ডাকাত আর এরা বাড়িতে ডাকাতি করতেই এসেছে।লোকগুলোর মধ্যে একজন এসে একটা রুমাল ভয়ার্ত মুখী ফিরোজার মুখে চেপে ধরলো আর সাথে সাথে ফিরোজা জ্ঞান হারালো।ফিরোজা জ্ঞান হারাতেই যেই লোকটা ওর মুখে রুমাল চেপে ধরেছিল সে তার মুখোশ খুলে ফেললো আর সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হলো লোকটার আড়ালে থাকা মুখ।লোকটা আর কেউ নয় বরং আরাফাত নিজেই। ও এখানে এসেছে আফরিনের করা প্ল্যান এক্সিকিউট করতে। আর আফরিনের প্ল্যান হলো পুরোটা ঘটনা এমনভাবে সাজাতে হবে যেন সকলে ভাবে যে ওরা ডাকাতি করতেই এসেছিল।

তবে এখন আরাফাত কে আফরিনের মায়ের ঘড় থেকে সেই আলমারিতে থাকা সিন্দুক বের করতে হবে তাও আবার আনসারি ফিরে আসবার আগেই।কিন্তু এই ঘটনা যেন ডাকাতি মনে হয় তার পুরো ব্যবস্থা করতে হবে।ফিরোজা কে অজ্ঞান করার কারণ হলো ঘটনা যেন আরও রিয়েলিস্টিক মনে হয়। আরাফাত ওর সঙ্গী সাথীদের বললো,
আরাফাত: তোমরা পুরো বাড়ির সবকিছু এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাও যেন দেখে মনে হয় এখানে আসলেই ডাকাতি হয়েছে।অ্যান্ড রীমেম্বার দেট বাড়ির প্রত্যেকটা দামী জিনিস উঠিয়ে নিবে,আলমারি থেকে টাকাও নিবে।

আরাফাতের কথা শুনে তার লোকেদের মধ্যে একজন বললো ‘ কিন্তু বস আমরা তো ডাকাতি করতে আসিনি। ‘
লোকটার কথা শুনে আরাফাত তার দিকে গরম চোখে তাকালো আর ধমকের সুরে বলল ‘ ডাকাতি করতে যে আসিনি সেটা আমিও জানি কিন্তু এই ঘটনাকে ডাকাতি করার মতো করেই সাজাতে হবে নাহলে সাথে সাথে ধরা খেয়ে যাবো। ‘

আরাফাতের কথা শুনে লোকগুলো আলতো মাথা নেড়ে নিজের কাজে লেগে পড়লো আর আরাফাত ওর আরও কিছু লোকের সাহায্য নিয়ে ফিরোজা বেগম কে গাড়িতে তুললো।ফিরোজা বেগম এখনও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ক্লোরোফর্ম এর প্রভাবে।কাজ শেষে আরাফাত ওর লোকদের কাছ থেকে কাজী বাড়ি থেকে তুলে আনা জিনিসগুলোর ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে রেখে দিল আর ওদের বললো চলে যেতে।ওরা চলে গেলে ফিরোজা বেগম কে নিয়ে আরাফাত রওনা দিলো আফরিনের বলে দেওয়া ঠিকানায়।

মুখের উপর পানি পড়তেই লাফিয়ে উঠলো অজ্ঞান ফিরোজা।এতক্ষণ ক্লোরোফর্মের কারণে অজ্ঞান থাকলেও আস্তে আস্তে ওষুধের প্রভাব কাটতে শুরু করেছিল তাই মুখের উপর পানি পড়তেই জ্ঞান ফিরলো ফিরোজার।চোখ খুলে সামনে আফরিন কে একটা চেয়ারে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো।তার থেকেও বেশি অবাক হলো আফরিনের পাশে দাড়িয়ে থাকা আরাফাত কে দেখে যাকে ও অনেকদিন আগে সেই হসপিটালে দেখেছিল। আফরিন বেচেঁ আছে আর ওর সামনেই জীবিত বসে আছে দেখে যেন ফিরোজা আকাশ থেকে পড়লো।

এমন নয় যে আফরিন কে জীবিত দেখে ফিরোজা খুশি হয়নি।কিন্তু হঠাৎ মৃত মানুষকে জীবিত অবস্থায় দেখলে কি রিয়েক্ট করা উচিত সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না ফিরোজা।ফিরোজা স্তব্ধের মত তাকিয়ে আছে আফরিনের দিকে। আসলে এখন আফরিন কে দেখে কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না।পরিস্থিতি ওর বোঝার বাইরে চলে গেছে।কাল শুনলো তাহরীম পালিয়েছে আর আজ দেখছে আফরিন বেচে আছে। একসঙ্গে এত শক ঠিক হজম হচ্ছে না।

‘ উনাকে একটু পানি দাও তো আরাফাত। বেচারি শক সামলাতে পারছে না। ‘ ফিরোজা বেগমের দিকে তাকিয়ে আরাফাত কে উদ্দেশ্য করে বললাম।
আমার কথা শুনে এবার ফিরোজা বেগম নড়েচড়ে বসলেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
ফিরোজা: তুই…আফরিন?
আমি ফিরোজা বেগমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
আফরিন: অবশ্যই আমি আফরিন….আমি আফরিন হবো নাতো কে হবে আফরিন?
ফিরোজা: কিন্তু কি করে সম্ভব? তুই তো অ্যাকসিডেন্ট এ…
আফরিন: মরিনি….আমি অ্যাকসিডেন্ট এ মরে গেলে আমার সাথে করা অন্যায়ের বিচার কে করবে?

আমার কথা শুনে ফিরোজা বেগম চমকে উঠলেন যেন এই কথা উনি শুনবেন সেটা আশা করেন নী।আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
আফরীন: আপনার স্বামী মানে আমার সো কল্ড বাবা আমার ভালোবাসার মানুষ কে আমার কাছ থেকে দূর করে দিয়েছিলেন।আমার ভালোবাসার মানুষ কে আমার থেকে দূরে রাখতে মানুষটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার জায়গায় আমি মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যাই তবে সেখান থেকেও ভালোবাসার জোড়ে আর আল্লাহর ইচ্ছায় ফিরে আসি।পাঁচ বছর আগে কোমা থেকে বের হওয়ার পর আপনি কেন বলেননী আমার আগে কেউ একজন ছিল?আপনি জানেন আপনার চুপ থাকার কারণে আজ আমি আমার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এতদিন দূরে থেকেছি।

আমার কথা শুনে ফিরোজা বেগম অতি সত্ত্বর উনার আঁখি জোড়া নামিয়ে নিলেন।ফ্লোরের মাঝে সীমাবদ্ধ উনার চোখ দুটি।চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু অশ্রু কনা।আমি উনার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমার মনে হচ্ছে উনি কিছু না কিছু একটা তো লুকচ্ছেন নাহলে আমার কথা শুনে কেন কাদছেন।উনার কাছে আমি আবারও আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো জানতে চাইলাম কিন্তু উনি এবারও চুপ।এবার আর উনার চুপ থাকা সহ্য হলো না।আমি উনার আর আমার মাঝে থাকা টেবিলের উপর হাত জোরে বারি দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললাম ‘ ডেম ইট কিছু তো বলুন… ‘

আমার চিৎকারে ফিরোজা বেগম ভয় পেয়ে গেলেন।উনার কান্না আরও বেড়ে গেলো।উনি এখন টিনেজার মেয়েদের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছেন।উনার জন্য আমার একটু খারাপই লাগলো।মানুষটা অতটা খারাপও নন যতটা ভেবেছিলাম।আমি আরাফাতকে ইসারায় বললাম বেরিয়ে যেতে আর আরাফাত আমার ইসারা বুঝে বেরিয়ে গেলো।আমি কিছুক্ষন ফিরোজা বেগমের দিকে তাকিয়ে থেকে তার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলাম।পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই ফিরোজা বেগম ছলছল চোখজোড়া তুলে আমার দিকে দৃষ্টি দিলো।তারপর আমার হাত থেকে গ্লাসটা বিয়ে ঢকঢক করে এক ঢোকে সবটা খেয়ে নিলেন।

‘ এবার বলুন…আমি সবটা শুনতে চাই যে মিস্টার আনসারী সবটা লুকালেও আপনি কেন লুকালেন আমার থেকে? ‘ শান্ত ভঙ্গিতে ফিরোজা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বললাম ।

আমার কথা শুনে ফিরোজা বেগম খানিকটা ধাতস্থ হলেন।খানিক চুপ থেকে নিজের চোখের জল মুছে বলতে শুরু করলেন…

সবে তোর অপারেশন হয়েছে।তোর বাবা এরকম পরিস্থিতিতেও প্রচন্ড শান্ত যেটা দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেছি।ভেবে উঠতে পারছিলাম না একটা লোক নিজের মেয়ের এরকম সিচুয়েশনে কি করে চুপ থাকতে পারে।আমি যখন উনাকে ঠান্ডা থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলাম তখন উনি বললেন তুই সুস্থ হতেই তোকে বাংলাদেশ থেকে অদূরে লন্ডনে তোর মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিবে যাতে তাহরীমের সঙ্গে আর কখনো কোনো ভাবে তোর যোগাযোগ নাহয় আর এক্ষেত্রে তোর মেমোরি লস হওয়াটা প্লাস পয়েন্ট।আমি উনার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম,একটা মানুষ কি করে মেয়ের অসুস্থতা কে কাজে লাগাতে পারে সেটাই ভেবে উঠতে পারছিলাম না।তোর বাবা আর আমি যখন থেকে তোর সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পেরেছি সেদিন থেকেই তোর বাবা তোকে আর তাহরীমকে আলাদা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

আমি নিজেও জানিনা উনি এরকম কেন করছেন তবে উনার এই কাজে আমি মোটেও সন্তুষ্ট ছিলাম না।তোর বাবা যখন আমায় বিয়ে করে আনেন তখন থেকে এত বছরে কখনোই আমাকে স্ত্রীয়ের মর্যাদা দেন নী। দিনের বেলাতে তোর সামনে ভালো সাজলেও রাতের আধারে প্রতি নিয়ত আমায় রক্তাক্ত করতেন।তোর মাকে উনি আজও ভুলতে পারেন নী আর তার ফলশ্রুতিতে উনি নিয়মিত সিগারেট খান আর রোজ ড্রিংক করেন আর তারপরেই আমায় মারেন।আমার হাতে পায়ে আজও উনার মারের দাগ আছে।তোর মায়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে উনি এসব করেন যেটা আমার মনে তোর আর তোর মায়ের প্রতি এক অবিচ্ছেদ্য ঘৃণা তৈরি করে।

আমি তোর বাবার কারণেই তোর মা আর তোকে ঘৃণা করতে শুরু করি আর সেই রাগ তোর উপর বের করতাম।তোর উপর রাগ করেই আমি চাইতাম তুই তাহরীমকে বিয়ে করে চলে যা যার কারণে অর্ণবের কাছে ছবিগুলো আমিই পাঠিয়ে ছিলাম ।অর্ণব তোকে খুব ভালোবাসলেও তোদের ছবিগুলো দেখে রেগে যায় আর ওই ছবিগুলো নকল নয় আসল ছিল।তোদের সম্পর্ক চলাকালীন ছবি।তোর বাবা তোদের পার্কে ধরার আগেই সব জানত শুধু হাতেনাতে ধরার অপেক্ষায় ছিল।

আমি প্রথম চেয়েছিলাম তোকে অর্ণবের সঙ্গে বিয়ে দিতে কিন্তু যখন তাহরীমকে তোর টিচার হিসেবে দেখলাম তখন প্ল্যান বদলে নিলাম। ঠিক করলাম তাহরীমের সঙ্গে তোর বিয়ে দিবো আর তাই হলো।তোর বাবা এর জন্যও আমায় মেরেছে।তোর বাবার মারের ভয়েই আমি কোনোদিন বলতে পারিনি যে তোর আগে সম্পর্ক ছিল তাহরীমের সঙ্গে।

আমি ফিরোজা বেগমের কথা শুনে উনার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি।স্মৃতি ফিরে আসার পর তো ওই ছবিগুলো যে আসল ছিল সেটা বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু তাই বলে যে ছবিগুলো ফিরোজা বেগম অর্ণব কে দিয়েছিলেন ভাবতে পারিনি।আমি চোখ দুটো বড় বড় করে বললাম,
আফরিন: আপনি আমার এত বড় সর্বনাশ করেছিলেন? আপনার জন্য আমার এত মানুষের সামনে চর খেতে হলো?

আমার কথা শুনে ফিরোজা বেগমের হাস্যজ্জ্বল মুখটা মলিন হয়ে গেলো। ম্লান মুখে বললেন,
ফিরোজা: দিয়েছিলাম তো তোর বিয়েটা ভাঙার জন্য কিন্তু অর্ণব যে তোকে থাপ্পড় মেরে বসবে বুঝতে পারিনি।তখন ইচ্ছা করছিলো অর্ণব কে চড়িয়ে লাল করে দিতে কিন্তু তোকে গালি দেওয়ার নাটক করতে হলো।

‘ ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে আপনার কি লাভ? ‘ আমি ফিরোজা বেগমের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম।

‘ তোকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে চাইছিলাম কিন্তু তুই যে বিয়ের পর এত কাহিনী করবি সেটা জানতাম না।জানলে বিয়েই দিতাম না। ‘ আমার দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে বললেন ফিরোজা বেগম।

‘ তবে আপনাকে এখন আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে সাক্ষী দিতে হবে কারণ সবকিছুর আড়ালে আরও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে যা একমাত্র মিস্টার আনসারীই বলতে পারবেন কেননা আমার আম্মু তো বেচেঁই নেই বলার জন্য। ‘ ম্লান হেসে বললাম আমি।

আমার কথা শুনে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ফিরোজা বেগম।উনার দৃষ্টি সবসময়ের মতই নির্বিকার।এই মানুষটা কোনোকিছু না করেও অনেক কিছু করেছেন আমার জন্য।উনি অর্ণবের সঙ্গে আমার বিয়েটা না ভাঙলে আর ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে বিয়ে না দিলে হয়তো এতদিনে কখনোই এত রহস্যের কুল কিনারা করতে পারতাম না।

~ চলবে ইনশাল্লাহ্

শব্দসংখ্যা: ৩০০০

মিফতা তিমু..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে