তুমি নামক সপ্তর্ষি মন্ডলের প্রেমে ২ পর্ব-৪+৫

0
1199

#তুমি_নামক_সপ্তর্ষি_মন্ডলের_প্রেমে💖
#দ্বিতীয়_খন্ড [ কার্টেসিসহও কপি করা নিষেধ ]
৪+৫.( A Night Of Love )

সেই সন্ধ্যে থেকে নিজেকে ঘরের মাঝে বন্দী করে রেখেছে আনসারী। আঁধারের মাঝে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে আর হাতে একটা আধখাওয়া সিগারেট।বেশি স্ট্রেস হয়ে গেলে সিগারেট খেয়ে আর মদ খেয়েই স্ট্রেস কমায় আনসারী।

তাহরীমের পালিয়ে যাওয়ার খবরটা পাওয়ার পর থেকেই আনসারীর মনে বারবার কিছু প্রশ্ন ঘুরছে, তাহরীম কি করে পালালো? কে ওকে সাহায্য করলো ওকে পালাতে? এসবের পিছনে আসল মাষ্টারমাইন্ড কে যে সবার আড়ালে থেকে আসল কলকাঠি নাড়ছে। চিন্তায় চিন্তায় আনসারীর বিপি বেড়ে যাওয়ার যোগাড়।বেশি সিগারেট খেয়ে ফেলার কারণে বারবার কাশিও আসছে।

বেশি স্মোকিং শরীরের জন্য ভালো না জানা সত্ত্বেও বারবার একই পথে হাঁটে আনসারী।এই সিগারেটই ওকে মনের শান্তি দেয় যা এত বছরে তুবা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে আর পায়নি। আনসারী তখন নিজের ভাবনার জগতে বিচরণ করছিল তবে ওর এই ভাবনা ভঙ্গ করে দিয়ে বেজে উঠলো ফোনটা।আনসারী ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ওর পার্সোনাল ডক্টর ফোন দিয়েছে।আনসারী কাল বিলম্ব না করে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো।ঐপাশ থেকে ডক্টর বৈদ্য বললেন,
ডক্টর: আর ইউ মিস্টার আনসারী?
আনসারি: ইয়েস ডক্টর…কিছু বলবেন? হঠাৎ এই সময় ফোন করলেন?
ডক্টর:আমি জানিনা মিস্টার আনসারী আপনি ব্যপারটা কে কিভাবে নিবেন তবে আমার কিছু করার নেই।আমায় যে আপনাকে বলতেই হবে ।

ডক্টরের কথা শুনে আনসারী ভ্রু কুঁচকে বলে,
আনসারি: এনি প্রবলেম ডক্টর?
ডক্টর: ইয়েস…আসলে আপনি কিছুদিন আগে আমার কাছে এসেছিলেন কারণ আপনার শরীর ভালো যাচ্ছিল না।আপনি আমায় বলেছিলেন প্রায়ই আপনার নাক দিয়ে রক্ত বের হয়, শরীর খারাপ লাগে, রাতে ঘুমনোর সময় ঘেমে যান। তো আপনার কথা শুনেই আমরা গেস করতে পেরেছিলাম যে আপনার কি হয়েছে তবুও শিওর হওয়ার জন্য টেস্ট করিয়েছিলাম। আর আজ সবেমাত্র রিপোর্টটা এসেছে। রিপোর্ট এখন আমার হাতেই।

‘ কি আছে রিপোর্টে? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো নাকি কোনো প্রবলেম আছে? ‘ খানিকটা গম্ভীর গলায় বললো আনসারী কারণ ডক্টরের এত কথা ওর ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।

‘ এভরিথিং ইজ নট ওকে মিস্টার আনসারী।অতিরিক্ত মাত্রায় সিগারেট খাওয়ার কারণে আপনার লিউকেমিয়া যেটা কে আমরা এক ধরনের ব্লাড ক্যান্সার হিসেবে জানি সেটা ধরা পড়েছে ।আপনি এখন ব্লাড ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছেন।আবার অত্যধিক ড্রিংক করার ফলে আপনার দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে।আপনার শরীরে এত রোগ বাসা বেঁধে আছে কিন্তু এতদিন তা প্রকাশ পায়নি। বুঝতেই তো পারছেন মানুষ ভেদে প্রকাশ পায়, কারোর আগে তো কারোর পরে। এখন চাইলেও আমরা কিছু করতে পারবো না।আপনি যদি আরও আগে এই সমস্যাগুলোর কথা আমাদের বলতেন তাহলে হয়তো বায়োপসিসহ আরও বিভিন্ন ধরনের ট্রিটমেন্ট করে আপনাকে সুস্থ করে তুলতে পারতাম তবে এখন সেটা একেবারেই অসম্ভব। ‘ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফোনের ওইপাশে থাকা ডক্টর বৈদ্য থামলেন। একটানা কথা বলার কারনে উনি রীতিমত হাপাচ্ছেন।

ডক্টরের মুখে এত কথা শোনার পরও খুবই শান্ত ভঙ্গিতে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে আছে আনসারী।তার দৃষ্টি স্থির জানালা ভেদ করে বাইরে থাকা বারান্দার সেই ফুলের টবে দিকে। আনসারী একদম স্বাভাবিক গলায়ই বললো,
আনসারি: আমার আর কয়দিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে ?
ডক্টর: শিওরলী বলতে পারছিনা তবে আর হয়তো কয়েক দিনের অতিথি আপনি।
আনসারি: এখন তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নিজের ট্রিটমেন্টের পিছনে টাকা খরচ করে কোনো লাভ নেই কারণ কয়েকদিন পরই মৃত্যুর দোয়ারে পৌঁছে যাবো তাইনা?

আনসারীর গলা শুনে ডক্টর বৈদ্য কেপে উঠল।ফোনের এপারে থাকা রুক্ষ, বদমেজাজি আনসারীর গলা আজ যেন শুনতে সাক্ষাৎ ঘুম থেকে ওঠা সিংহের মত যার এক গর্জনে সকলে কেপে উঠবে।ডক্টর বৈদ্য আলতো মাথা নেড়ে মুখে বললেন,
ডক্টর: হ্যাঁ…
আনসারি: দেন লেট মী টেল ইউ সামথিং।আমার যে ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে সেই কথা যেন পাঁচ কান নাহয়।আমি চাই এই কথাটা আমাদের মাঝেই থাকবে।যদি কেউ এই ব্যাপারে জানতে পারে তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

ডক্টর বৈদ্য আনসারীর হুমকি তে ভয় পেয়ে গেলেন আর পাওয়ারই কথা।ডক্টর বৈদ্যর আনসারীর পরিবারের সকলের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক তাই সেই সুবাদে সে আনসারীর স্বভাব সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত।আনসারী যে তার কথা না শুনলে কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা ডক্টর বৈদ্য ভালো করেই জানেন।ডক্টর বৈদ্য কোনমতে ভয়ে ভয়ে হ্যাঁ বলেন।

‘ আপনি রেগে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলে যে আপনার চেহারা বাঁদরের মত দেখতে লাগে সেটা কি আপনি জানেন? মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলে আপনাকে বাচ্চা বাঁদর মনে হয়। ‘ বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের চাঁদ দেখছিলাম আর তখনই পিছন থেকে কথাগুলো বললেন ডাক্তার সাহেব।

আমি ভালো করে জানি উনি আমাকে এসব বলে রাগিয়ে দিতে চাইছেন যেন আমি উনার সঙ্গে কথা বলি কিন্তু আজ যাই হয়ে যাক আমি উনার সঙ্গে কথা বলবো নাতো নাই।আমি আজ ভূমিকম্প হয়ে গেলেও উনার সঙ্গে কথা বলবো না নাহলে আমার নামও জান্নাতুল আফরিন মির্জা নয়….

‘ আজ তাহলে মিসেস মেহমাদ ঠিক করেই নিয়েছেন যে উনি আমার সঙ্গে কথা বলবে না তাইতো?ওকে আমিও জানি উনাকে কি করে কথা বলাতে হয়। ‘ আমার গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললেন ডাক্তার সাহেব।আমি উনার কথা শুনে উনার দিকে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে তাকালাম।আমি উনার ভাব গতি বুঝার চেষ্টা করছি যে উনি কি করতে চাইছেন।

‘ ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই,আপনি বুঝতে পারবেন না আমি কি করবো।আমি তো আজ মিসেস মেহমাদ কে কথা বলিয়েই ছাড়বো অ্যান্ড আই প্রমিজ দেট। ‘ আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে কথাগুলো বললেন ডাক্তার সাহেব।

উনি উনার কথা শেষ করতেই সাথে সাথে আমাকে সুরসুরি দিতে শুরু করলেন তাও আবার গলায় যেখানে আমার সবচেয়ে বেশি সুরসুরি লাগে।আমি না পারছি কিছু বলতে আর না পারছি উনাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে।আমি নিজের আওয়াজ আটকে রাখতে পারছিনা বিধায় মুখ চেপে ধরলাম হাত দিয়ে।ডাক্তার সাহেব যখন দেখলেন আমাকে কিছুতেই কথা বলানো যাচ্ছে না তখন সুরসুরি দেওয়া ছেড়ে দিলেন।

উফফ আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।মুখ থেকে হাত সরিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিতে লাগলাম।তারপর খানিকটা ধাতস্থ হয়ে ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বাকা হাসি হাসলাম।ডাক্তার সাহেব আমার হাসি দেখছেন তবে আমি বুঝতে পারছি উনার মনে কিছু একটা চলছে।এত ভাবাভাবি করে কি হবে, সেইতো পারবেন না আমাকে কথা বলাতে।আমি ডাক্তার সাহেবের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আঁখি জোড়া রাতের চাঁদের দিকে দিলাম।

শুনেছি রূপালী থালার ন্যায় এই চাঁদের গায়েও কলঙ্ক আছে।সৌন্দর্যের প্রতীক এই চাঁদের গাঁয়ে যদি কলঙ্ক থাকতে পারে তাহলে লোক চক্ষুর অন্তরালে আমাদের এই পবিত্র ভালোবাসার গায়েও তো কলঙ্ক আছে, অন্তত লোকে তো তাই বলে।সামাজিক ভাবে ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীয়ের মর্যাদা পাওয়ার পরও আজ মৃত হওয়ার নাটক করতে হচ্ছে। স্ত্রী থেকেও সমাজে স্ত্রীহীন পুরুষ ডাক্তার সাহেব শুধুমাত্র একটা মানুষের কারণে ।এই কলঙ্কিত ভালোবাসা কোনদিন কি পারবে সবার চোখে পবিত্র ভালোবাসা হয়ে উঠতে?

আমি আমার ভাবনার জগতে তখন বিচরণ করতে ব্যস্ত,হঠাৎ গায়ে প্রচন্ড শিরশিরানি অনুভব করলাম।শরীর কেপে উঠলো মানুষটার ওষ্ঠদ্বয়ের ঠান্ডা স্পর্শে।আমি ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলাম।আমার মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।ক্রমশ সেই স্পর্শ গভীর হয়ে এলো।আমি ভয়ে ট্রাউজার মুঠো করে ধরলাম।ডাক্তার সাহেব কে সরিয়ে দিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে বড় বড় চোখে ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকালাম। অতঃপর বললাম,
আফরিন: আপনি আমাকে কথা বলানোর জন্য সিডিউস করছিলেন ডাক্তার সাহেব? শেষে কিনা আর না পারতে আমার কাছে এসে আমায় দুর্বল করে দিচ্ছিলেন?

‘ আপনাকে কথা বলানোর জন্য আমার সিডিউস করার দরকার নেই।আপাতত আমি অনেক রোমান্টিক মুডে আছি তাই একটু রোমান্স করতে চাচ্ছি। ‘ কথাগুলো বলতে বলতে ডাক্তার সাহেব আমায় কোলে তুলে ঘরে চলে এলেন।

আমি উনার দিকে তাকিয়ে উনার কোল থেকে নামার জন্য হাত পা ছোড়াছুড়ি করে বলতে লাগলাম,
আফরিন: এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না ডাক্তার সাহেব।আমি স্টিল বাচ্চা…এসবের জন্য আমি প্রিপেয়ার নই।
ডাক্তার সাহেব আমায় বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমার দুই পাশে নিজের হাত দিয়ে ব্যারিকেট করে বললেন,
তাহরীম: ঠিক সময়ে আমাদের বিয়ে হলে আজ আপনি দুই বাচ্চার মা হতেন মিসেস মেহমাদ। আর পঁচিশ বছর হওয়ার পরও যদি আপনি বাচ্চা রয়ে যান তাহলে আমার আর কিছু করার নেই।আমাকে আপনার মত বাচ্চার সঙ্গেই রোম্যান্স করতে হবে কারণ আমার তো আর বউ নেই।নিজের জন্য খারাপ লাগছে,ঠিক নেই বাচ্চা বউ না আবার কাল আমায় বাল্যবিবাহ করার অপরাধে পুলিশে ধরিয়ে দেয়… কথাগুলো বলে উনি ফিচেল হাসলেন।

উনার কথা শুনে উনার দিকে সরু চোখে তাকালাম।বুঝতে পেরেছি উনি আমায় নিয়ে মজা করছেন।আমি উনার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।আচমকা ডাক্তার সাহেব আমাকে উনার দিকে ফিরিয়ে আমার ঠোঁটে উনার রুক্ষ ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলেন।

সকাল হয়েছে সেই কবে তবে আমার যখন ঘুম ভাঙলো তখন বাজে সকাল নয়টা।ঘুম ভেঙে নিজেকে ডাক্তার সাহেবের বাহুডোরে আবদ্ধ আবিষ্কার করলাম।একবার নিজেদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম।কাল রাতে ঘুমনোর আগে দিয়ে যেই টিশার্ট টা পড়েছিলাম সেটা আর আমার গায়ে নেই। টিশার্ট ছড়িয়ে আছে মেঝেতে আর আমার গায়ে ডাক্তার সাহেবের ইয়া লম্বা কালো রঙের টিশার্ট টা।

কাল রাতের কথা ভাবতেই আমার গাল দুটো রক্তিম হয়ে উঠলো।কালকের রাতটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত,আমার জন্য A Night Of Love. ডাক্তার সাহেব আমায় অনেক ভালোবাসেন সেটা আমি জানি তবে এবার তার প্রমাণও পেয়ে গেলাম। সিলিং থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ডাক্তার সাহেবের উপর দৃষ্টি স্থির করলাম।ডাক্তার সাহেব খালি গাঁয়ে আমায় এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবো।

উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ চোখ গেলো উনার গলার দিকে।সাথে সাথে গাল দুটো আরও রক্তিম হয়ে উঠলো।উনার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উনার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে গেলাম।ডাক্তার সাহেবের টিশার্ট আমার গায়ে মোটামুটি লম্বাই হয় যার কারণে উনার টিশার্ট আমার হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিতেই মাথায় বাজ পড়লো। একি সকাল নয়টা বাজে আর আমরা এখনও শুয়ে আছি।এখন তাড়াতাড়ি নিচে না গেলে তো দিশা আর বাকিরা আমায় নিয়ে মজা করতে ছাড়বে না।

ডাক্তার সাহেব কে উঠিয়ে নিচে নিয়ে যেতে হবে।তার আগে গোসলটা সেরে নেই। যেই ভাবা সেই কাজ।আলমারি থেকে একটা পিয়াজি কালারের সেলোয়ার কামিজ নামিয়ে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।তাড়াতাড়ি করে দশ মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে বেরিয়ে এলাম। বারান্দায় টাওয়েল মেলে দিয়ে ডাক্তার সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলাম।উনার পাশে বসে উনার গায়ে হালকা হাত দিয়ে উনায় ডাকতে লাগলাম।

ডাক্তার সাহেব আমার ডাকাডাকি তে ঘুমঘুম চোখে বললেন,
তাহরীম: কি হয়েছে মিসেস আফরিন?এত রাতের বেলা ডাকছেন কেন?
আফরিন: এখন রাত নয় বরং সকাল নয়টা বাজে।তাড়াতাড়ি উঠুন নাহলে বিচ্ছুর দল চলে আসবে আবারও মজা নিতে।উঠুন…উঠুন না…আপনার জন্য আমার রাতে ঘুম হলো না আর আপনি এখনও পরে পরে ঘুমোচ্ছেন।

আমার কথা শুনে ডাক্তার সাহেব আমার দিকে এক চোখ খুলে আর আরেক চোখ বন্ধ করে বললেন,
তাহরীম: আপনাকে ঘুমাতে দেইনি বলে এখন আপনিও আমাকে ঘুমোতে দিবেন না। প্রতিশোধ নিচ্ছে নাকি মিসেস মেহমাদ?
‘ ধরুন তাই…এখন কথা না বাড়িয়ে উঠুন।আমাকে আবার ঘর গুছিয়ে নিচে যেতে হবে। ‘ ঘরের এখানে ওখানে পরে থাকা জামাকাপড়গুলো তুলতে তুলতে বললাম ।

ডাক্তার সাহেব আমার কথা শুনে বিছানা থেকে নেমে এলেন।আমায় পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
তাহরীম: ভাবছি পিচ্চি বউয়ের সঙ্গে আরেকবার রোমান্স করবো…
আফরিন: মোটেই না…চুপচাপ গিয়ে গোসল সেরে আসুন আর হ্যাঁ আপনার এই খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো শেভ করুন।

আমার কথা শুনে ডাক্তার সাহেব আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন যার অর্থ হলো কেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
আফরিন: এভাবে তাকানোর মানে কি? আপনার কোনো খেয়াল আছে আপনার এই খোঁচা খোঁচা দাড়ি আমার গালে লাগলে আমার কত ব্যাথা করে।
তাহরীম: ও… কাল রাতে খুব ব্যাথা পেয়েছিলেন তাইনা? নো প্রবলেম শেভ করে ট্রাই করবো আর ব্যাথা করে কিনা।

‘ আপনি বড্ড অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার সাহেব।আগে কি সুন্দর একেকটা কথা ভেবে ভেবে বলতেন আর এখন মুখে যা আসছে তাই বলছেন। মানে লজ্জা বলে কিছু আছে কি নেই? ‘ ডাক্তার সাহেব কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম আমি।

‘ ওমা বউয়ের কাছে লজ্জা পেলে কি করে হবে? তাহলে জুনিয়র তাহরীম আর জুনিয়র আফরিন কি করে আসবে? ‘ আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বললেন ডাক্তার সাহেব।

‘ একেবারে অসভ্য… যান তো যান গিয়ে গোসল করে আসুন।আমি ততক্ষণে ঘরটা গুছাচ্ছি। একি দাড়িয়ে আছেন কেন? যান নাহলে আপনার সাথে আজ সারাদিনেও কোনো কথা বলবো না আর তখন সিডিউস করেও লাভ হবে না। ‘ উনার দিকে তাকিয়ে কটমট চোখে বললাম আমি।

‘ আরে আরে যাচ্ছি তো মিসেস মেহমাদ।রাগ করছেন কেন?এত রাগ করা ভালো না স্বাস্থের জন্য।নিজেকে কন্ট্রোল করতে শিখুন। ‘ জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বললেন ডাক্তার সাহেব। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসি দিয়ে বাথরুমের দরজা লাগিয়ে দিলেন।

‘ নিজে কন্ট্রোললেস হলে সমস্যা নেই আর আমি হলেই সমস্যা। ‘ বিড়বিড় করে বললাম আমি।

৫.( The Final Mystery-1 )

আমি আর ডাক্তার সাহেব সিড়ি দিয়ে নেমে আসতেই আমার চোখ গেলো বসার ঘরের দিকে।বসার ঘরে সবাইকে একসঙ্গে বসে ফুসুরফুসুর করতে দেখে আপনিতেই আমার ভ্রু কুচকে এলো।এরা কি এমন প্ল্যান করছে যে এরকম ফিসফিস করে কথা বলছে। নিশ্চই কোনো উদ্ভট প্ল্যান করছে নাহলে এরকম ফিসফিস করছে কেন?

‘ আমার আড়ালে কি এমন প্ল্যান করা হচ্ছে যে পুরো বাড়িতে কারোর কোনো সাড়াশব্দ নেই? ‘ সিড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে বসার ঘরে গিয়ে কোনার সোফায় বসে কথাটা বললাম আমি।

আমার কথা শুনে সকলে ভুত দেখার মত চমকে উঠলো।ডাক্তার সাহেব আমার পিছনে এসে দাড়ালেন।সকলে আমাকে দেখে এমন রিয়েক্ট করছে যেন ওদের চুরি ধরা পড়ে গেছে।আমি সবার দিকে স্পেশালি আরাফাতের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম।আরাফাত আমার দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দিল।আমি ওর এহেন ভাব দেখে বললাম,
আফরিন: এমন হাসি দিয়ে লাভ নেই। কি বলছিলে ফিসফিস করে আগে সেটা বলো…

‘ ওদের কথা তোর শুনতে হবে না আফরিন।আমি বলছি তুই শোন… ‘ আমার দিকে তাকিয়ে আলভী ভাইয়া বলল।

সবাই আলভী ভাইয়ার কথা শুনে ভাইয়ার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালো। বড় মামা বারবার নিষেধ করছে ইসারায় যেন ওদের গুপ্ত প্ল্যান আমাকে না বলা হয় কিন্তু আলভী ভাইয়া তো মামারই ছেলে তাই মামার থেকেও এক ধাপ উপরে।সে বড় করে এক নিশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
‘ সবাই এতক্ষণ প্ল্যান করছিল যে তোকে আর তাহরীম ভাইয়াকে হানিমুনে কোথায় পাঠাবে।এটা নিয়েই এতক্ষণ বাকবিতণ্ডা চলছিল। অলিভ বলছে যে তোদের প্যারিস পাঠাবে, দিশা বলছে সুইজারল্যান্ড আর আরাফাত বলছে তোদের সাজেক পাঠাবে।আবার নিহাদ মামা বলছে তোদের সিলেট পাঠাবে।এখন কেউ এটাই বুঝতে পারছে না তোদের কোথায় পাঠাবে।তুই এই মেটার টা সলভ করে দে। ‘

হানিমুনের কথা শুনে আমি ডাক্তার সাহেবের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম।উনি প্রথমে হানিমুনের কথা শুনে হকচকিয়ে গেলেও সবটা স্বাভাবিক হয়ে আসতেই উনার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। আই গেস উনি হানিমুনের কথা শুনে খুশি হয়েছেন ।

‘ এখন আমি কোথাও যাচ্ছিনা হোক সে হানিমুন বা অন্য কোথাও ‘ একেবারে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফোনের মাঝেই দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রেখে বললাম কথাগুলো।

আমার কথা কারোরই হজম হলো না।সবাই দুই মিনিটের জন্য নিরবতা পালন করলো।মিনিট দুয়েক যেতেই যখন সবার কাছে আমার কথাটা পরিষ্কার হলো তখন সকলে আমার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ডাক্তার সাহেবও আমার কথা ঠিক হজম করতে পারছেন না বলে আমার দিকে বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে আছেন। আরাফাত আমার দিকে তাকিয়ে গোলগোল চোখে বললো,
আরাফাত: মানে?

‘ না বোঝার কি আছে? বললামই তো আমি এখন কোথাও যাচ্ছি না। এসব হানিমুনের ঝামেলা আমি এখন পোহাতে চাই না। যা হওয়ার সব ডাক্তার সাহেবের নির্দোষ প্রমাণ হয়ার পর,আসল অপরাধী ধরা পড়া এবং আমার ডাক্তারি পড়া শেষ হওয়ার পর হবে। ‘ আমি আবারও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম।

‘ তাই বলে হানিমুন তুই এত বছর ফেলে রাখবি? তুই কি আদৌ মেয়ে তো আফরিন? ‘ আমার দিকে তাকিয়ে দিশা অবাক হয়ে বললো।

‘ আমি মেয়ে কিনা জানিনা তবে তুই যে নির্লজ্জ সেটা বুঝতে পারছি।তোর মত এত সাহস থাকলে আজ থেকে পাঁচ বছর আগেই আমার আর ডাক্তার সাহেবের বিয়ে হয়ে যেত। মানে তোর কত সাহস তাইতো তুই বড়দের সামনেও নির্লজ্জের মত কথা বলছিস? ছোটো আছিস ছোটর মত থাক, বড় হওয়ার চেষ্টা করবি না। ‘ দিশার দিকে তাকিয়ে আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম।

আমার কথা শুনে দিশা সবার দিকে তাকিয়ে হালকা জিভ কাটলো তারপর নিজেকে গম্ভীর করে বললো,
দিশা: এমন ভাব করছিস যেন তুই আমার থেকে কত বড়? উই আর সেম এজ…
আফরিন: সাত মাসের বড় আমি তোর…
দিশা: মাত্র সাত মাসের বড় হয়ে এত অ্যাটিটিউড দেখাচ্ছিস…আল্লাহ জানে কয়েক বছরের বড় হয়ে কি করতি?
আফরিন: সাত মাসের বড় হলেও বড় আমি।তোর থেকে সাত মাস বেশি দুনিয়া দেখেছি।আর অবশ্যই আমি তোর বড় কারন আমার বিয়ে হয়ে গেছে এন্ড ইউ আর স্টিল সিঙ্গেল…
দিশা: আইসে মিঙ্গেল ওয়ালা।আমি না তোর মত না।আমি একটা ফুলের মত পবিত্র মেয়ে যে আজ অব্দি একটা রিলেশনের ধারের কাছেও যায়নি।আর আমি ঠিক করেছি আজীবন সিঙ্গেল থাকবো…

আমি আর দিশার কথায় কথা বাড়ালাম না তবে আলভী ভাইয়া দিশার কথা শুনে আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।ওর এই অসহায় দৃষ্টির মানে কিছুই বুঝলাম না আমি।তবে আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি,
আরাফাত: আমার সঙ্গে স্টাডি রুমে এসো।কথা আছে… বলেই আমি সোজা সিড়ি দিয়ে বাম দিকের ঘরটায় চলে এলাম।

আফরিন উপরে চলে যেতেই সকলে আরাফাতের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।সকলেই জানে আফরিন আর আরাফাত মিলে আসল অপরাধীকে খুঁজছে যে এইসব স্ক্যান্ডালের পিছনে জড়িত কিন্তু আফরিন আর আরাফাতের কোনো প্লানই তাদের জানা নেই।তাই তারা আফরিন এর এরকম ব্যবহার স্বাভাবিক ভাবে নেয় তবে তাহরীমের মন খারাপ হয়।অবশেষে সুযোগ পেয়েছিল আফরিন কে কাছে পাওয়ার কিন্তু সেই সুযোগটাও হারালো।ওর কপাল এতটাই খারাপ যে ওদের ম্যারেজ লাইফ আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো হয়নি বরং আপদ বিপদ সবকিছুতে ঘেরা।ওদের জীবনে থাকা বিপদের কারনে আজ নিজেদের জন্য আলাদা করে সময়ও বের করতে পারছে না।

আরাফাত ঘরে ঢুকেই বললো,
আরাফাত: তাহলে আমাদের নেক্সট প্ল্যান কি?
আরাফাতের কথা শুনে আমি ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর বললাম,
আফরিন: কাজী বাড়ি থেকে ফিরোজা বেগম কে তুলে আনতে হবে…
আরাফাত: হোয়াট…

আরাফাত আমার কথায় যেন ভুত দেখার মত চমকে গেলো।হয়তো বাবার জন্মে শুনেনি কোনো মেয়ে তার বাবার বাড়িতে ডাকাতি করার কথা বলছে তবে আমার যে কিছু করার নেই।আসল অপরাধী আর সব রহস্যের কুল কিনারা করতে হলে এই ড্রাস্টিক স্টেপ যে আমায় নিতেই হবে।আমি আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বললাম,
আফরিন: জানো আরাফাত আম্মু আমায় আমার দশ বছরের জন্মদিনে প্রথমবারের মত একটা গিফট দিয়েছিল আর সেই গিফট কি ছিল জানো? শরৎচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের লিখা ‘ দেবদাস ‘। আমার জন্মদিনের পরের দিনই আম্মু হুট করে গায়েব হয়ে গেলো আর বলেছিলো যে সেই বইয়ের ভিতর থাকা কাগজটা যেন কোনোদিন কারোর হাতে না লাগে।ওই কাগজই আমায় নিয়ে যাবে আমার আসল ঠিকানায়।আজ অব্দি সেই কাগজ আগলে রেখেছি শুধুমাত্র আম্মুর শেষ স্মৃতি বলে।

আমার আর ডাক্তার সাহেবের বিয়ের পর যখন বাবা আমার প্রতি এক্সট্রা কেয়ার নিতে শুরু করলে আমার সেটা খটকা লাগে তবে বিশেষ পাত্তা দেইনি কিন্তু যেদিন ফিরোজা বেগম আমায় বাবাকে নিয়ে সাবধান করেন সেদিন আমি ফিরোজা বেগম কে মুখে অনেক কথা শুনালেও ফিরোজা বেগমের কথাগুলো যে একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো নয় সেটা আমি বুঝে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে বাবাকে নিয়ে অনেক রিসার্চ করতে শুরু করি,বাবার পিছনে সবার অগোচরে গোয়েন্দা লাগাই আর বেরিয়ে আসে সব রহস্য।বাবা যে কেন আমাকে আর ডাক্তার সাহেব কে আলাদা করতে চান তার আসল কারণ জানতে পারি গোয়েন্দার মাধ্যমে।বাবা পাঁচ বছর আগেও অনেকবার চেষ্টা করেছে আমাদের আলাদা করতে আর তার জন্য বাবা ডাক্তার সাহেব কে মেরেও ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত ঘটনার স্বীকার হই আমি।তখন সেই ঘটনার সুযোগ নিয়ে বাবা আমাদের সাময়িক ভাবে আলাদা করে দিলেও পারেনি আমাদের তকদির কে আলাদা করতে।হয়তো ডাক্তার সাহেব আর আমার তকদির একসঙ্গেই লিখা ছিলো তাইতো পাঁচ বছর পরে আমরা আবারও একসঙ্গে।

‘ পাঁচ বছর পরে তোমরা একসঙ্গে মানে? তাহরীমকে কি তুমি আগে থেকে চিনো? কি করে চিনলে? আমি তো জানতাম না? তোমাদের কি বিয়ের আগে সম্পর্ক ছিল? তোমার আর আমার সম্পর্কেরও আগে ছিল নাকি তোমাদের সম্পর্ক ? ‘ আমার কথায় অবাক হয়ে আরাফাত আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।

আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম আরাফাতের প্রশ্নে।আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
আফরিন: আরে আস্তে আস্তে…এত প্রশ্ন এক সঙ্গে করলে উত্তর কি করে দিবো? তুমি একটু নিশ্বাস নাও নাহলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরে নিজেই হার্ট এ্যাটাক করবে।তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো আমি।

আমার আর ডাক্তার সাহেবের প্রথম দেখা হয়েছিল যখন আমি সবে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।একদিন রাস্তার মাঝ দিয়ে আনমনে হাঁটছিলাম।রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটার কারণে অ্যাক্সিডেন্ট করবো এটাই স্বাভাবিক আর তাই হলো।কিন্তু সেই অ্যাকসিডেন্ট থেকে ডাক্তার সাহেব আমায় বাঁচিয়ে নিলেন।তখন আমি সবে সপ্তদশি যুবতী,মনে সবে প্রেমের রং ফুটেছে।

ডাক্তার সাহেব আমায় রাস্তার মাঝ খান থেকে টেনে নিয়ে এলেন রাস্তার ধারে। হঠাৎ টান দেওয়ায় ব্যালান্স করতে না পেরে ডাক্তার সাহেব কে নিয়ে উল্টে পরে গেলাম।আমি নিচে আর ডাক্তার সাহেব উপরে।ডাক্তার সাহেব নিজে উঠে আমায় টেনে তুললেন।তারপর যে কি ঝাড়টাই না দিলেন।তখন অবশ্য আমার কাছে উনার সব বকাই মধুর মত তাই আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম উনার দিকে।

সেদিন আমার সেই অদ্ভুত ব্যবহার দেখে উনি বলেছিলেন ‘ মিসেস পিচ্চি, আপনি আসলেই একটা স্টুপিড নাহলে কেউ নিজের পায়ে কুড়াল মেরে এভাবে গাড়ির নিচে মরতে আসে?বেশি মরতে ইচ্ছা করলে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিন নয়তো মাঝ দরিয়ায় ডুব দিন,তাহলে অন্তত অন্যদের দোষ হবে না। ‘ সেদিনের মত ওই কথাগুলো বলে চলে গিয়েছিলেন।

তারপর আমাদের আবার দেখা হলো যখন উনি আমাদের কলেজে এলেন হেপাটাইটিস বি এর টিকা দিতে।আমি জানতাম না উনি একজন জুনিয়র ডক্টর তবে সেদিন জেনেছিলাম।উনাকে দেখে একেকটা মেয়ে উনার গায়ে ঢোলে পড়ছিল তবে উনি সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলেন।সবার শেষে যখন আমার পালা এলো তখনই আমায় দেখে চিনে ফেললেন উনি।আমায় দেখে উনার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিমেষেই অমাবশ্যার রাতের মত কালো হয়ে গেলো।চেহারায় গাম্ভীর্য ভাব এনে আমায় টিকা দিয়ে দিলেন।

সবার প্রতি উনার এক ব্যবহার আর আমার প্রতি আরেক ব্যবহার দেখে আমি রাগে দুঃখে ধুপধাপ পায়ে চলে এসেছিলাম তবে আমার পিছনে যে মানুষটা আমার এমন কান্ড দেখে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন সেটা জানত কে।
এরপর থেকে শুরু হলো আমাদের নিয়মিত দেখা।প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে হলেও আমার উনার সাথে দেখা হতো তবে উনি কাজেই আসতেন।এভাবে করতে করতেই এক বছর কেটে গেলো।এরপর হঠাৎ একমাস উনার কোনো দেখা সাক্ষাৎ নেই।

এইদিকে আমি যে উনার দেখা না পাওয়ায় নিজেকে ঘরের মাঝে বন্দী করে ফেলেছি সেটা আর কে জানত।আমার দেখা সাক্ষাৎ নেই,বাবাও গেছে ব্যবসার কাজে বাইরে আর ফিরোজা বেগমও তখন আমায় দেখতে পারতেন না তাই আমার এভাবে ঘরে বন্দি থাকার কারণ জিজ্ঞেস করেন নী। হঠাৎ একদিন ফোন এলো একটা আননন নাম্বার থেকে।সেই কল রিসিভ করতেই একজন বললেন যে ডাক্তার সাহেব মানে ডক্টর তাহরীম মেহমাদ নাকি অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন।উনাকে পার্কে নেওয়া হয়েছে।

একেতো প্রথম ভালোবাসা তার উপর দিয়ে ভালোবাসার মানুষটা অ্যাকসিডেন্ট করেছে।খবরটা পেয়েই আমি দিক বেদিক হারা হয়ে ছুট দিলাম বাসার কাছে থাকা সেই পার্কের উদ্দেশ্যে।কিন্তু পার্কে গিয়ে দেখলাম কই অ্যাক্সিডেন্ট হইসে।বরং ডাক্তার সাহেব পার্কের মাঝে ফুল হাতে নিয়ে নিল ডাউন হয়ে বসে আছেন।আমি উনার কাছে যেতেই আমায় সেই অভিনব কায়দায় প্রপোজ করলেন।

আমি সেদিন আনন্দে আর প্রচন্ড ভয়ে কেঁদে দিয়েছিলাম।ডাক্তার সাহেবের অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে কতটা ভয় যে পেয়েছিলাম সেটা ডাক্তার সাহেবের ধারণার বাইরে।সেদিন আমি উনার প্রপোজ অ্যাকসেপ্ট তো করেছিলাম কিন্তু আমায় এভাবে ভয় দেখানোর জন্য টানা এক ঘন্টা কথা বলিনি।এক ঘন্টা! ব্যাপারটা বড়ই হাস্যকর।এক ঘন্টা সবার জন্য কম হলেও আমার আর ডাক্তার সাহেবের জন্য এক বছরের সমান।

‘ ইট মিনস তোমার লাইফে আমারও আগে তাহরীম এসেছে? তাহরীমের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছিল তাহলে আমার সঙ্গে কেন সম্পর্ক করলে? ‘ অবাক হয়ে বললো আরাফাত।

আমি আরাফাতের কথা শুনে বললাম,
আফরিন: ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে যে আমার সম্পর্ক ছিল সেটাই জানতাম না আমি তাহলে কি করে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক করার আগে ভাববো।
আরাফাত: মানে?
আফরিন: পুরোটা শুনো।আমাদের দিনগুলো ভালই যাচ্ছিল।সামনে আমার hsc পরীক্ষা যতই এগিয়ে আসছে ততই আমার ভয় বাড়ছে।সারাদিন চিন্তা হতো এ প্লাস পাবো কিনা কিন্তু আমার এই চিন্তা ডাক্তার সাহেব দূর করলেন। একজন ডক্টর হয়েও যতটা সাধ্য ছিল তার বাইরে গিয়ে আমায় পড়াশুনায় হেল্প করতেন। কখনও রেস্টুরেন্ট এ তো কখনো পার্কে বসে পড়াতেন।এভাবেই আমার hsc পরীক্ষা এগিয়ে এলো। ভালোভাবে পরীক্ষা দিলাম।পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তিন মাসের ছুটি পেলাম আর সঙ্গে বাবাকে বললাম যেন মেডিক্যাল অ্যাডমিশন কোচিং করার জন্য টাকা দেয়।

বাবা আমায় প্রচন্ড বিশ্বাস করতো তাই আমার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দিল। তো আমি বাবার থেকে টাকা তো নিলাম কিন্তু সেগুলো খরচ করলাম না কারণ আমি তো মেডিক্যাল অ্যাডমিশন কোচিং করবো না বরং ডাক্তার সাহেবের কাছে পড়বো।একটা ডাক্তার বয়ফ্রেন্ড থাকতে মেডিক্যাল অ্যাডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার দরকার কি?

তো টাকা জমিতে রাখতে লাগলাম।টাকা ওভাবেই ড্রয়ারে পড়ে থাকত আর আমি প্রতিদিন নিয়ম করে গিয়ে ডাক্তার সাহেবের কাছে একটা নির্দিষ্ট কোলাহলবিহীন রেস্টুরেন্টে বসে পড়তাম।পড়ার মাঝে আমাদের একটু চোখাচোখি, হাত ধরাধরি আর খুনসুটিও চলত।এভাবেই এক মাস কেটে গেল।আমি ততদিনে অনেকটা প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি।আমাদের দিনগুলো বেশি সুখের ছিল যেটা কপালে ছিলনা তাই দুঃখের হাতছানি লাগলো।

একদিন রেষ্টুরেন্টে বসে ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে পড়ার সময় বাবার কাছে ধরা পড়ে গেলাম।বাবা আমাদের দেখে দুই মিনিটের মধ্যে বুঝে গেলো যে আমাদের মধ্যে কি সম্পর্ক? বাবা ডাক্তার সাহেব কে শুধু একটা কথাই বলেছিলো যেন আমার থেকে দূরে থাকে তারপর আমায় টানতে টানতে ঘরে নিয়ে এসে আমায় বন্দী করে দিয়েছিল আর বলেছিলো আজ থেকে আমার বাইরে যাওয়া একেবারে বন্ধ।কোনো পড়াশুনা করতে হবে না,বছর যেতেই বিয়ে দিয়ে দিবে।

~ চলবে ইনশাল্লাহ

মিফতা তিমু….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে