তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর পর্ব-২০+২১

0
1004

#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (২০)

বাকী রাত নিতুর কেটেছে চটপট করে। কে এই নবনী?কেনো তাহেরা বেগম নবনীর কথা বললেন?কি সম্পর্ক নবনীর সাথে এদের?
নিতু হিসেব মিলাতে পারলো না। তামিম এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিতু তামিমকে কিছু জিজ্ঞেস করার ও সুযোগ পেলো না।

বুকে ব্যথা আর চোখে জল নিয়ে নিতু ফ্লোরে বসে রইলো দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। জীবনের প্রথম ভালোবাসা কোনো ভুল মানুষের সাথে হয়েছে কি-না এটা ভেবেই নিতুর যতটা অস্থিরতা তার চাইতে বেশি জ্বালা পোড়া তার জন্য কারো স্বপ্ন ভেঙ্গেছে কি-না এটা ভেবে!
সারারাত নিতু এভাবেই বসে রইলো।

সকালে নিতু উঠে কিচেনে গেলো,মাথার ভেতর তার ফাঁকা ফাঁকা লাগছে,পুরো শরীর কাঁপছে । ভাত,ডাল,আলু ভর্তা করে রেখে এলো। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার রুমে এসেছে, বারবার এসে দেখে তামিম ঘুমাচ্ছে।উত্তেজনায় চটপট করতে করতে নিতু রান্না শেষ করলো।তারপর রুমে এসে দেখে তামিম ব্রাশ নিয়ে বের হচ্ছে। নিতু তামিমের হাত চেপে ধরে বললো, “আমি মরে যাবো তামিম,আমাকে সত্যি কথা বলো তুমি।নবনী কে? কি সম্পর্ক তার সাথে তোমার? দোহাই তোমার আমাকে মিথ্যে বলো না।”

তামিম এই ভয়টাই পাচ্ছিলো।নিতুর এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে বলে তামিম রাতে ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিল। ভেবেছিলো নিতু ভুলে যাবে এটা।নিতুকে সত্যি কথা বলার সাহস তামিমের নেই।নবনীকে হারিয়েছে সে,কিন্তু নিতুকে আর হারাতে চায় না।
তামিম এটুকু বেশ ভালো করে বুঝে যে নিতু যতোই মুখ চালাক নিতুর মনটা ভীষণ ভালো। তাহেরা বেগম নিতুকে আপন করে নিলে নিতু তাকে মাথায় তুলে রাখবে।

নবনী আর নিতু দুজন দুই রকম দুই মানসিকতার মানুষ। একজন চুপ করে সব শুনে যেতো মাথা পেতে অন্য জন অন্যায়ের কঠোর প্রতিবাদ করে। দুজনের মধ্যে একটাই মিল,দুজনেরই মন ভীষণ স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছ মন একজনের ভেঙেছে, দ্বিতীয় বার তামিম আর সেই ভুল করতে চায় না।

নিতু আবারও জিজ্ঞেস করলো নবনীর কথা।

তামিম হেসে বললো, “আরে বলো না।বাবার এক রিলেটিভের মেয়ে ছিলো। বাবা চেয়েছিলো ওকে বউ করতে কিন্তু মা তোমাকে পছন্দ করেছে।আর আমি তো বলেছি আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না।তাই মা এই কথা বলেছে।”

নিতু সন্দিহান হয়ে বললো,”সত্যি বলছ তো তামিম?এটুকুই শুধু?তাহলে তোমার মনে কিসের এতো কষ্ট তামিম?কেনো তুমি মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে আমাকে দেখলে চমকে যাও?
কেনো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তুমি অন্যের প্রতিচ্ছবি খোঁজ?
কেনো তুমি আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে গেলে ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠো?
তোমার মর্নিং টি দিতে এলে কেনো আমাকে দেখলে অবাক হয়ে যাও?
তামিম আমি সব কিছুই লক্ষ্য করি,কিন্তু আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই।বারবার নিজেকে এই বলে বুঝাই যে আমি এসব ভুল ভাবছি।সব আমার ভুল।
আমি নিজের সাথে আর নিজে এই অভিনয় করতে পারছি না।আমার গলায় ফাঁসের মতো লাগছে।আমি ঝগড়াঝাটি করি,সব কিছুকে এড়িয়ে চলি বলে এই না যে আমার মনে কোনো কষ্ট লাগে না।তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ঠিক কিন্তু বিশ্বাস করো,একটা দিন আমি তোমার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা খুঁজে পাই নি।আবেগ নিয়ে আমার দিকে তাকাতে দেখি নি।”

তামিম নিতুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো,”আমি সত্যি বলছি নিতু।আমাকে বিশ্বাস করো।আসলেই এসব তোমার মনের ভুল।তুমি সব ভুল ভাবছো,এরকম কিছুই না।”

নিতু কিছুক্ষণ তামিমের বুকে থেকে বললো,”তাই যেনো হয়।তা না হলে আমার যে কি হবে তামিম আমি জানি না।বাহিরে থেকে আমাকে যতোই শক্তিশালী দেখো সবাই ভেতরে আমি ততটাই ভঙ্গুর।এরকম কিছু হলে নিজেকে সামলাতে আমার ভীষণ কষ্ট হবে।”

নিতু চলে যেতে তামিমের যেনো ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেলো। নিতুকে ঠকাচ্ছে বলে ভীষণ অনুশোচনা হলো তার।কিন্তু উপায় নেই।একবার এক বউকে ছেড়েছে,এবার নিতুকে ছাড়লে তার লজ্জার আর সীমা থাকবে না।মনে যাই হোক,নিতুকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না কোনো কিছু।হুট করে আবারও তামিমের নবনীকে মনে পড়ে গেলো। নিতুর মতো স্ট্রং মেয়েটা যদি এরকম করে বলে নিজেকে সে সামলাতে পারবে না সেখানে নবনী কিভাবে নিজেকে সামলে নিলো?
নবনী তো আরো দুর্বল ছিলো।তবে কেনো নবনী চলে গেলো। কেনো থেকে গেল না?কি ক্ষতি হতো থেকে গেলে?
দ্বিধার দোলাচলে দুলতে লাগলো তামিম।

নিতুর মন কিছুটা হালকা হলেও একটা অস্পষ্ট খোঁচা অনুভব করতে লাগলো বুকে।ভেতর থেকে কেউ যেনো বলছে এসব কথার মধ্যে ও অন্য কথা বাকি রয়ে গেছে, নিতুর জানার বাকি।একটা গভীর শ্বাস নিয়ে নিতু ঠিক করলো সত্য উদঘাটন করবেই সে।

তামিম ব্রাশ করে এসে বললো, “আজকে কি খেয়ে অফিসে যাবো?নাশতা বানাও নি?”

নিতু বললো,”না আজকে তো নাশতা বানাই নি।শরীর কাহিল লাগছে খুব আমার। সারা রাত অস্থিরতা নিয়ে ছিলাম।”

তামিম কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো মা’কে আসতে দেখে।তাহেরা বেগম উঠে এসে গম্ভীরমুখে বললেন,”লুবনার জন্য পরোটা বানাও,ঘিয়ে ভাজবে।সাথে ডিম ভেজে দাও ওকে।আর দিশার খাবার রেডি করো একটু পরে এসে নয়তো তুলকালাম বাঁধাবে।আমার জন্য একটু স্যুপ করো চিকেন দিয়ে।”

নিতু সোজাসাপটা জবাব দিলো,”আমি এই বাসার কাজের মেয়ে নই মা যে জনে জনে গিয়ে সবার খাবারের মেন্যু জেনে নিয়ে সবার মন মতো খাবার বানিয়ে রাখবো।আপনার বউ মা দিশা ছোট বাচ্চা না যে আমাকে ওর জন্য নাশতা বানিয়ে ওর হুকুমের আগে নিয়ে হাজির হতে হবে।ওর বাবা ধনী হতে পারে কিন্তু তাতে আমার কোনো লাভ নেই।আমি ওর বাবার খাই না,পরি ও না যে ওর মর্জিমাফিক কাজ করে যাবো।আপনার মেয়ে লুবনা কচি খুকি না যে তার আহ্লাদিপনা দেখে খুশি হয়ে আমি তার পছন্দের খাবার বানাতে যাবো।
এক দিন তো দেখি নি এদের কাউকে কিচেনে উঁকি দিয়ে দেখতে।আপনি তো মহারানী আপনার কথা আমি বাদ দিলাম।”

তাহেরা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,”তোর সামনে এসব কথা বলছে আর তুই ভেড়ার মতো তাকিয়ে শুনছিস তামিম?”

তামিম কিছু বলার আগে নিতু জবাব দিলো,”কি বলবে আপনার ছেলে,ছোট ভাইয়ের বউয়ের জন্য ওকালতি করবে আমার কাছে? আমি সেটা সহ্য করবো?তাছাড়া
ছেলেকে তো বানিয়ে রেখেছেন ভেড়া,কি জানি আপনার স্বামীকে ও হয়তো এরকম ভেড়া বানিয়ে রেখেছেন বলেই,অথবা বানাতে চেয়েছেন বলে বেচারা অকালে চলে গিয়েছে। আপনার মতো টক্সিক মহিলার সাথে ভদ্রলোক কিভাবে এতো বছর সংসার করেছেন আমি সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি।আপনার ছেলে যদি মানুষ হতো তবে বিয়ের পর দিন সাত সকালে যখন আপনি গিয়ে আমাদের বেডরুমের দরজা নক করতে শুরু করে দিয়েছিলেন সেদিনই এসে আপনাকে বলতো এটা অভদ্রতা এই কাজ আর করবেন না।
আপনার ছেলে মানুষ হলে আপনি এসব নাটক করতে পারতেন না।এখন তো আমার মনে হয় আপনাদের এসব ড্রামার জন্যই আপনার ছোট ছেলে আমাদের বিয়েতেও আসে নি,এতোদিন হয়ে গেলো বাসায় ও আসছে না।সে-ই একমাত্র পুরুষ। ”

তাহেরা বেগমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো।তিনি ভেবেছিলেন বেতনের টাকা তার হাতে না দেওয়ার জন্য নিতুকে তিনি এভাবে মানসিক অশান্তি দিবেন যাতে নিতু শান্তির জন্য হলেও তাকে টাকা দেয়।কিন্তু তার দাবার চাল ভুল ছিলো তা বুঝতে পারলেন নিতুর কথা শুনে।এ যে বড় ত্যাঁদড় মেয়ে!
তার একটা কথায় সে হিস্ট্রি নিয়ে এসেছে।রাগে,ক্ষোভে,অপমানে তাহেরা বেগম দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,”ফকিরের ঘরের মেয়েকে বউ এজন্যেই করতে নেই।”

কথাটা সরাসরি নিতুর কলিজায় গিয়ে আঘাত করলো। ক্ষুব্ধ হয়ে নিতু বললো,”কাকে ফকিরের মেয়ে বলছেন আপনি?”

তাহেরা বেগম বুঝলেন এবার নিতুর গায়ে লেগেছে।তাই আবারও বললেন,”তোকে বলছি,তুই ফকিরের মেয়ে।ফকির বলেই তোর বাবা মেয়েদের বেতনের টাকার জন্য উৎ পেতে থাকে। ”

নিতু নিজেকে শান্ত করে বললো,” আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন,আমার মা নিজেও স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন।আমাদের দুই বোনের পরপর জন্ম হওয়ায় মা নিজে আর চাকরি কন্টিনিউ করেন নি বাবা অনেক বলার পরেও।আমার বাবা মা দুজনেই এডুকেটেড।আপনার যোগ্যতা কি আছে?
আপনার ব্যবহার দেখে তো মনে হয় স্কুলের পিছনে দিয়ে হাটেন নি জীবনে।
আর যদি লেখাপড়া করেও থাকেন,তা কিছুতেই সুশিক্ষা নয়।আর যতোই এডুকেটেড হয়ে থাকেন আপনি, আপনার মধ্যে আমি মনুষ্যত্বের ছিটেফোঁটা ও দেখি নি।আসলে শিক্ষিত হলেও সবাই মানুষ হয় না।আপনার মতো ও হয় কেউ।
নয়তো আপনি জানতেন ছেলে মেয়েতে কোনো ভেদাভেদ নেই। একজন ছেলের মতো একজন মেয়ের ও অধিকার আছে তার বাবা মায়ের খেদমত করার।আমার টাকা আমি কোথায় ব্যয় করবো তা আমার ব্যাপার। আপনার বাপের টাকা না ওটা যে আপনাকে কৈফিয়ত দিবো।
আর ফকির বললেন আমার বাবা মা’কে?
আসল ফকির তো আপনি। ফকির না হলে কয়েকটা টাকার জন্য মনে এরকম ক্ষোভ পুষে রাখতেন না।ছোট লোকের মতো টাকার জন্য এরকম হ্যাংলাপনা করতেন না।আর কখনো যদি আমার বাবা মা’কে নিয়ে একটা টুঁ শব্দ ও শুনি তবে বুঝবেন আমি নিতু কতো ভয়াবহ কান্ড ঘটাতে পারি।”

তামিমের আজ মনে আনন্দ হচ্ছে যদিও চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ বিরক্ত নিতুর উপর।নবনীকে হারানোর পর থেকে তামিমের কাছে মনে হচ্ছে তাহেরা বেগমের সব ভুল স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শুধু সাহসের অভাবে মা’কে কিছু বলতে পারছে না।যতো দিন যাচ্ছে নবনীকে হারানোর ব্যথা ততোই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আর ততোই তামিমের মায়ের উপর রাগ হচ্ছে।
এজন্য নিতুকে কিছুতেই বাঁধা দিলো না সে।

তাহেরা বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।ছেলেকে নিরুত্তর দেখে তাহেরা বেগম সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেলেন।বুঝতে পারলেন এই মেয়ে ছেলেকে বশ করে ফেলেছে।আক্রোশে তাহেরা বেগম নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।

তাহেরা বেগম যাওয়ার পর তামিম নিতুকে বললো, “মায়ের সাথে এরকম ব্যবহার করতে আমি তোমাকে নিষেধ করেছি নিতু,আমার এসব পছন্দ না।”

নিতু হাসতে হাসতে বললো,”গ্রামাঞ্চলে একটা কথা বলে মানুষ, জিংলা আনে চুলার মুখ,শাশুড়ি আনে বউয়ের মুখ।এটা আমার দাদী বলতেন।জিংলা মানে বাঁশের যেই চিকন চিকন সরু ডাল আছে,ওগুলোকে বুঝায়।
আমি তো নিজে থেকে কিছু বলি না তামিম।আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি মিলেমিশে থাকতে কিন্তু তোমার মা সেটা চান না।ঝগড়ার শুরু উনি করেন।তাই সমাপ্তি হয় আমাকে দিয়ে।আমার তো কারো জন্য কোনো খাবার বানাতে কোনো আপত্তি নেই,কিন্তু বাসায় এতোগুলো মানুষ থাকতে কেউ এগিয়ে আসে না আমাকে একটু সাহায্য করতে।

তার উপর একটা নাশতা সবার হয় না।একেক জনের পছন্দ একেক রকম। সেটা তখনই হয় যখন আমি রান্না করতে আসি।
বিশ্বাস করো ওদের সবার আলাদা পছন্দ অথবা কেউ আমাকে হেল্প করতে আসে না এটা নিয়েও আমার কোনো আপত্তি থাকতো না।আমার আপত্তি কেনো তুমি জানো?

তুমি খেয়াল করেছ,যখন হোটেল থেকে খাবার আনা হতো তখন দিশা,লুবনা সোনামুখ করে খেতো।দিশার তখন স্বাস্থ্য সচেতনতা আর থাকে না।তোমার বোনের এসব নখরা ও থাকে না।বরং ওরা বেশ আগ্রহ নিয়ে বাহিরের সব রকম খাবার খেতো।

আসলে ওদের মেইন উদ্দেশ্য হলো আমাকে দিয়ে কাজ করানোর।আমি একা কাজ করছি এতেই ওরা পৈশাচিক আনন্দ পায়।আমার আপত্তি ঠিক এখানেই তামিম।কেনো ওরা আমাকে আপন ভাবতে পারে না।কেনো এতো রেষারেষি আমার সাথে?
এই কারনেই আমি ওদের জন্য কোনো কিছু করতে চাই না।আমি যে ব্যাটারি চালিত পুতুল নই তা সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চাই।
আমার সাথে যে অন্যায় করে আমি তাকে ছাড় দেই না তামিম। সে যেই হোক।অন্যায়ের কোনো ছাড় নেই।জানো না,অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজনেই সমান অপরাধী। ”

তামিমের গলা শুকিয়ে গেলো। যদি নিতু সত্যি নবনীর কথা জেনে যায় তবে সেদিন কি করবে এই ভেবে তামিম চিন্তায় পড়ে গেলো।

তামিম খেয়ে নিলো,নিতু কিছুই খেলো না।অফিসে যাওয়ার জন্য দুজনে রেডি হয়ে বের হতে যেতেই শুনতে পেলো তাহেরা বেগম রুমে কোঁকাচ্ছেন ব্যথায়।নিতু আর তামিম দরজা ধাক্কাতে লাগলো। তাহেরা বেগম দরজা খুললেন না।

নিতু তামিমকে বললো,”তুমি অফিসে চলে যাও,আমি থাকছি।আমি দেখবো মা’কে। দুজনে একসাথে অফিস মিস দেয়ার কোনো মানে হয় না।”

তামিমের ইচ্ছে করলো নিতুকে বলতে তুমি ও চলো,কিছু হবে না মায়ের।এটা মায়ের পুরনো অভ্যাস।
যতো কিছু হোক,জন্মদাত্রী মা।চাইলেও তামিম কিছু বলতে পারলো না। তামিম চলে গেলো। নিতু দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে অনবরত ডাকতে লাগলো তাহেরা বেগমকে।
দিশা,লুবনা কেউ উঁকি দিয়েও দেখলো না।

নিতির অফিস ১০ টা থেকে।ঘড়িতে যখন ১০.৩০ বাজলো,তাহেরা বেগম রুমের দরজা খুলে বের হয়ে এলেন।সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ। একটু আগে ব্যথায় আর্তনাদ করার কোনো ছাপ তার মধ্যে নিতু দেখতে পেলো না।

তাহেরা বেগম নিতুকে যেনো দেখতেই পান নি এরকম করে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলেন দিশার রুমে।

কিছুক্ষণ পর বাহিরে থেকে খাবার এলো। নিতু সোফায় বসে দেখতে লাগলো কি অবলীলায় ৩ জন মিলে হেসে হেসে খাবার খাচ্ছে। নিতু যেনো এই বাসায় নেই-ই।

নিতু বুঝতে পারলো এসব নিতুকে শাস্তি দেয়ার একটা আয়োজন,নিতুকে অফিসে না যেতে দেওয়ার একটা চক্রান্ত। নিতু মনে মনে বললো,”এই দিন,দিন নয় আরো দিন আছে,এই দিনরে নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে।”

চলবে……
রাজিয়া রহমান

#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (২১)

অফিসে গিয়ে নবনী কিছুটা অবাক হলো। তার ডেস্ক পরিপাটি করে সাজানো। নবনী বিরক্ত হয়ে নিজের চেয়ারে বসলো। মেঘের এসব ব্যবহার নবনীর কাছে ভীষণ সস্তা কর্মকাণ্ড বলে মনে হয়। একটা মানুষ নিজের স্ট্যাটাস ভুলে এরকম করবে একটা মেয়ের জন্য এসব ভাবতেই নবনীর বিরক্ত লাগে।

কয়েকদিন ধরে প্রতি দিন সকালে ফ্ল্যাটের দরজা খুললেই একটা ফুলের তোড়া দেখা যায় দরজার সামনে। একটা কার্ডে লিখা থাকে নবনীতা।
নবনীর কাছে এসব ব্যবহার নিতান্ত বাচ্চামি লাগে।
এসব ফুল,গিফট,টেক্সট, ইমোশনাল কথা দিয়ে টিনএজ মেয়েদের পটানো যায় সহজে। কিন্তু জীবনে যে নবনীর মতো তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বীকার,যে জীবনের কঠিন রূপ দেখে ফেলেছে তাকে কি এসব দিয়ে ইমপ্রেস করা যায়?

অবশ্য মেঘের দোষ নেই।সে বেচারা তো জানে না যাকে সে এতো ভালোবাসে তার একটা তিক্ত অতীত আছে।মেঘ ভাবে তার এসব পাগলামি দেখলে নবনী ইমপ্রেস হবে।
নবনীকে ইমপ্রেস করতে অন্যের সাহায্য নিয়েও চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি।মেঘের রাগ হয় ভীষণ, বুকে ভীষণ ব্যথা হয়।
একটা মেয়ের জন্য নিজের ক্লাস ভুলে গেছে সে অথচ মেয়েটা তাকে পাত্তা দিচ্ছে না।চরম হতাশ হয়ে মেঘ রাত কাটায় অনিদ্রায়।

মেঘ আজ অফিসে এসেছে দেরি করে। বাসায় বসে ক্যামেরায় নবনীকে দেখছিলো।দেখতে দেখতে কখন যে বেলা ১২ টা বেজে গেলো মেঘ টের পেলো না।এতোক্ষণে নবনী একটা বার ও মাথা তুলে মেঘের কেবিনের দিকে তাকায় নি।মেঘের ভীষণ কষ্ট হলো।একটা মেয়ে এতটা নির্লিপ্ত কিভাবে হয়?
মুখোমুখি একটা মানুষ বসে যাকে চোখ তুলে তাকালেই দেখতে পায়।সে জ্বলজ্যান্ত মানুষটা আজকে নেই,একবার কৌতুহলী হয়ে ও তাকাবে না সে?

অফিসে এসে নবনীর দিকে না তাকিয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে বসলো। ভেতর থেকে কেবিনের পর্দা টেনে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বাহির নবনীকে দেখতে লাগলো ল্যাপটপে। জেদ চেপে গেছে তার,কতোক্ষণ নবনী তার কেবিনের দিকে না তাকিয়ে থাকে এটা সে দেখতে চায়।

লাঞ্চের সময় নবনী ক্যান্টিনে চলে গেলো। মেঘ ক্যান্টিনের ক্যামেরাতে এবার নবনীকে দেখতে লাগলো।
পাউরুটি আর ডিম খাচ্ছে নবনী।খাচ্ছে যেনো শুধু খাওয়া দরকার তাই বলে, খাবারের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই তার মূলত।

তামিম বসেছে নবনীর থেকে কিছুটা দূরে,নবনীর দিকে মুখ করে। নিতু বসেছে নবনীকে পেছন করে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তামিমের দৃষ্টি নবনীর দিকে ঘুরে যাচ্ছে।
মেঘের প্রেমিক হৃদয় তাতে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। নবনী কোনো মতে খাবার শেষ করে যেনো পালিয়ে এলো।এসে নিজের ডেস্কে মাথা গুঁজে বসে রইলো।
নিতু আর তামিমের থেকে পালাতেই নবনী তাড়াতাড়ি চলে এসেছে।কি পরম ভালোবাসা নিয়ে নিতু তামিমের জন্য কফি নিয়ে আসে,খাবার সময় পানি ঢেলে দেয়।নবনী তাকাতে চায় না তবুও তাকিয়ে ফেলে।বুকের ভেতর কাঁপতে থাকে।নিজেকে নিজের গালি দিতে ইচ্ছে করে।
মাঝেমাঝে নবনী ভাবে এরকম ছোট ছোট যত্ন নবনী করতে জানতো না বলেই হয়তো আজ তার জায়গায় নিতু।

দাঁতে দাঁত চেপে মেঘ দেখতে লাগলো সব।ভেতরে অভিমানের পাহাড় জমিয়ে রেখেছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, একবার শুধু তোমাকে পাই,বিশ্বাস করো ২৪ ঘন্টা তুমি শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।

সন্ধ্যায় অফিস ছুটি। বের হবার জন্য সব গুছাতে যেতে এই প্রথম বারের মতো নবনীর মনে হলো আজকে মেঘ একবার ও তাকে ডিস্টার্ব করে নি,কোনো কিছুর অযুহাত দিয়ে কেবিনে ডাকে নি,কাজ দেখিয়ে দেয়ার জন্য নবনীর পাশে এসে দাঁড়ায় নি।
ভাবতে ভাবতে নবনী মেঘের কেবিনের দিকে তাকালো।
কতোক্ষণ তাকিয়ে ছিলো?বড়জোর ৩-৪ সেকেন্ড!

এতেই কেবিনের ভেতর থেকে মেঘের আনন্দের সীমা রইলো না।ভেতরে জমে থাকা সব অভিমান নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো। এক পলক তাকাতেক মেঘের মনে হলো তার চাতকের মতো দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।

বাসায় যাবার পথে শিমলা কল দিলো নবনীকে। আগামীকাল নীড়ের জন্মদিন। নবনী মকে সকাল ৭ টার মধ্যেই শিমলাদের বাসাহ যেতে হবে।নবনী অফিসের কথা বলতেই শিমলা বললো,”তোমার ছুটি আমি মঞ্জুর করে রেখেছি।প্লিজ প্লিজ না করো না।আমার তো তেমন কেউ নেই তুমি ছাড়া। খুব ছোট করে আয়োজন করবো। প্লিজ নবনী। ”

নবনীর ইচ্ছে করলো বলতে যে সে যাবে না। কিন্তু কেনো জানি বলতে পারলো না। শিমলা তাকে এতো বেশি পছন্দ করে যে নবনীর পক্ষে শিমলার আবদার প্রত্যাখান করা সহজ হলো না।

আস্তে করে বললো,”ঠিক আছে যাবো,তবে প্লিজ আমাকে যাতে কেউ বিরক্ত না করে। ”

শিমলা বুঝতে পারলো নবনীর সমস্যা মেঘকে নিয়ে।শিমলা আশ্বস্ত করে বললো,”না তেমন কিছু হবে না।তুমি প্লিজ সকালে চলে এসো। আমাকে হেল্প করার মতো তো কেউ নেই আর।মেহমান আসবে সবাই সন্ধ্যা বেলায়।”

নবনী ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দিলো।তারপর একটা বাচ্চাদের খেলনার দোকানে গিয়ে নীড়ের জন্য কিছু গিফট কিনলো।

রাতে মেঘ কল দিলো না নবনীকে।নবনী অবাক হলো ভীষণ মেঘের কল না পেয়ে।সারা রাতে মেঘ একটা টেক্সট ও করে নি।
নবনী এবার ভীষণ অবাক হলো। সারাদিনেও মেঘ নবনীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে নি এখন রাতেও না।মেঘের কি শরীর খারাপ? আজ অফিসেও এসেছে দেরি করে। কি হয়েছে আজ?
তারপর নবনীর মনে হলো হয়তো মোহ কেটে গেছে মেঘের তাই আর আজ নবনীর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নবনী ঘুমিয়ে গেলো। সকালে উঠে হালকা নাশতা করে নবনী শিমলার বাসার জন্য রওয়ানা দিলো। গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে যেতেই নবনী ছোট খাটো একটা ধাক্কা খেলো যেনো।বিশাল প্যান্ডেল খাটানো হয়েছে। একপাশে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে আস লোকেরা স্টেজ সাজাচ্ছে,মরিচ বাতি,বেলুন,রঙিন নেট দিয়ে সব সাজানো হচ্ছে অন্য পাশে রান্নাবান্নার জন্য সব গুছানো হচ্ছে।

নবনীর মনে হলো ভুল করে সে হয়তো কোনো বিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।শিমলা যেনো নবনীর অপেক্ষায় ছিলো। ছুটে এসে নবনীকে জড়িয়ে ধরলো শিমলা।তারপর বললো,”আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি নবনী।”

নবনীর লজ্জা লাগলো শিমলার এরকম কথায়।কোথায় তার অবস্থান আর কোথায় শিমলার!
আজকাল কেউ নবনীকে আপন করতে চাইলে নবনীর ভীষণ ভয় হয়।মনে হয় ঠিকই একদিন তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবে।শিমলার এই উচ্ছ্বাস দেখে নবনীর আবারও তাই মনে হলো। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে এমনি এমনি ভয় পায় না।

শিমলার সাথে বাসার ভেতর ঢুকে নবনী আরেকবার চমকালো।বাসা ভর্তি মেহমান।দেখেই মনে হচ্ছে সবাই অভিজাত পরিবারের মানুষ। সেখানে নবনী কিছুই না।এতোক্ষণের লজ্জা অস্বস্তিতে রূপ নিলো।
সবাই নবনীর দিকে তাকিয়ে আছে। নবনী এখানে দুজনকে চিনে শুধু।একজন শিমলার মা আরেকজন শিমলার মামী,মেঘের মা।সেদিন শিমলা রাতে নবনীকে কল দিয়ে বলেছে মেঘের মায়ের কথা।

মাসুমা বেগম মুখে ফেসপ্যাক দিয়ে চোখে দুই অইস শসা দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে ছিলো।নবনীর নাম শুনতেই চোখ থেকে শসা সরিয়ে তাকালেন।টিয়া কালার শাড়ি পরা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মাসুমা বেগমের মন আনন্দে ভরে উঠলো। উঠে গিয়ে নবনীকে নিয়ে এলেন তার কাছে।সোফায় জায়গা খালি নেই কেউ শুয়ে আছে কেউ বসে আছে। মাসুমা বেগমের পাশে একটা মেয়েও মুখে ফেসপ্যাক দিয়ে শুয়ে ছিলো। মাসুমা বেগম খেঁকিয়ে বললেন,”এই এই মেঘলা,সর সর এখান থেকে। নবনী এসেছে। ওকে বসতে দে।”

মেঘলা নামের মেয়েটা চোখ থেকে শসা সরিয়ে নবনীর দিকে তাকালো।তারপর উঠে ফ্লোরে বসলো।
মাসুমা বেগম ফিসফিস করে বললেন,”আমার মেয়ে মেঘলা বুঝছো?ভীষণ ভয় পায় আমাকে।”

নবনী কিছু না বলে মুচকি হাসলো। মাসুমা বেগম দুনিয়ার সব কথা নিয়ে বসলেন। নবনী জিজ্ঞেস করলো,”আপনার ছেলে,স্বামী ওনারা আসবেন না?”

মাসুমা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”ওদের কথা আর বলো না।আমার কোনো সম্পর্ক নেই ওদের সাথে। আমার ছেলে না-কি ওর অফিসের একটা মেয়েকে ভালোবাসে,পছন্দ মানে যেই সেই পছন্দ না।একেবারে তোমাকে না পেলে মরে যাবো টাইপ পছন্দ বুঝলা।কিন্তু মেয়ে না-কি কিছুতেই পাত্তা দেয় না।ঠিকই তো করেছে মেয়েটা,ওর মতো ধলা বিলাইরে একটা শিক্ষিত মেয়ে কেনো পাত্তা দিবে বলো তো?আর ওর বাবা আছে না সাথে,নিজে তো ছ্যাঁকা খাওয়া মানুষ এখন সে চাচ্ছে তার পরিবারেও সে ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক,এজন্য ছেলেকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে সে।
তোমাকে একটা গোপন কথা বলি শুনো মা,সেদিন বেশি দূরে নেই যেদিন ওরা বাপ ছেলে একসাথে মিলে গান গাইবে ঘুমাতে পারি না সারারাত ধরে, বুকের ভেতর হাহাকার করে।”

বলতে বলতে মাসুমা বেগম হা হা করে হাসতে লাগলেন।

নবনীর ভীষণ লজ্জা লাগলো। উনি যদি জানে সেই মেয়েটা ও নিজেই তাহলে কি মনে করবে।

মাসুমা বেগম হাসি থামিয়ে বললেন,”শুনো মা,আমার ছেলে হচ্ছে উন্নত প্রজাতির উচ্চ শিক্ষিত গাধা।এর মাথায় একবার যেটা ঢুকে সেটা আর বের হয় না।নিজের লক্ষ্য না পূরণ হওয়া পর্যন্ত বাপের মতো হাল ছাড়ে না।
তবে গাধা হলেও মানুষ হিসেবে সে কিন্তু খারাপ নয়।”

নবনী কিছু বলতে পারলো না।

মাসুমা বেগম এবার ফিসফিস করে বললো,”এবার তোমাকে আরেকটা সিক্রেট বলি মা,ওই গাধা তো এই প্রেমে কিছুতেই সফল হতে পারবে না।আমি চক্করে আছি মেয়েটা কে সেটা জানার জন্য।আমি নিজে গিয়ে ওর প্রেমে ভাঙানি দিবো তাহলে। ওর বাপ আমারে থ্রেট দেয়
অল কিছু দিনের মধ্যে ওই মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিয়ে সে নাকি নাতি নাতনি থাকবে।আমাকে না-কি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিবে।ভাবতে পারছো তুমি? এই মাসুমা বেগকে নিয়ে ওই লোক এই কথা বললো!
আমি কি যেই সেই মানুষ?
আমি ও তাই ঠিক করেছি নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে আমি ছেলেকে বিয়ে দিবো।তারপর মেঘের বাবাকে দেখিয়ে দিব আমি মাসুমা বেগম কি চিজ!”

নবনীর সারা শরীর ঘামতে লাগলো এসব শুনে। কিছুক্ষণ পর শিমলা এসে নবনীকে নিয়ে গেলো নাশতা করার জন্য।নবনী উপরে উঠে শিমলার ঘরের দিকে যাবে সেই সময় শুনতে পেলো কোনো নারী কণ্ঠ বলছে,”প্লিজ মেঘ,প্লিইইইজ….আমাকে আর কতো দিন ঘুরাবি এভাবে। আমি সত্যি পারছি না আর তোকে ছাড়া। এবার একটু আমার দিকে তাকিয়ে দেখ না একবার। “বলতে বলতে মেয়েটা হাঁচি দিতে লাগলো।

মেঘ বিরক্ত হয়ে বললো,”তোর সাথে প্রেম কোনো মানুষ করবে?সারাদিন হাঁচির উপরে থাকিস,দেখা যাবে বিয়ের পর তোর সাথে আমি একান্ত সময় কাটাতে যাবো সেই সময় তুই হাঁচতে থাকবি।আমার যাবে মেজাজ বিগড়ে। এসব আমি সহ্য করতে পারবো না রুনা। ”

রুনা কিছুটা দমে গিয়ে বললো, “তুই তো জানিস আমার ডাস্ট অ্যালার্জির কথা।এজন্য আমার হাঁচি পায়, এজন্য তুই এভাবে আমাকে প্রত্যাখ্যান করবি?
তুই ভুলে গেলেও আমি ভুলি নি ছোট বেলায় পুতুল খেলার সময় থেকে আমি তোকে ভালোবাসি।তোর প্রেমে দিওয়ানা। সবসময় তুই এসব নিয়ে আমাকে কথা শুনাতি।তোর সব কথা শুনেও আমি তোকে ভালোবাসি বলে তোর পিছনে পড়ে আছি মেঘ।আমাকে ফিরিয়ে দিস না।”

মেঘ গম্ভীর হয়ে বললো, “আমি জানি রুনা তুই আমাকে ভালোবাসিস,কিন্তু তুই জানিস না আমি ও অন্য একজন কে ভালোবাসি।শুধু ভালোবাসি না রুনা,প্রচন্ড রকম ভালোবাসি।তাকে প্রথম দেখেছিলাম রাস্তায়,আমার গাড়ি থেকে কাদা ছিটকে গিয়ে তার সারা শরীর নোংরা হয়ে গেলো। লুকিং গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে আমার যে কি হলো আমি জানি না।কবিগুরুর মতো আমি ও ওর চোখে আমার সর্বনাশ দেখতে পেয়েছিলাম।যেই সেই সর্বনাশ না,একেবারে সর্বগ্রাসী সর্বনাশ।ওকে দেখার পর ১ সপ্তাহ আমার মাথা শুধু ঝিমঝিম করতো। তারপর থেকে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে,ইনসোমনিয়া হয়ে গেলো । এক সপ্তাহের মতো আমি জ্বরে ভুগেছি রুনা নবনীতাকে ভেবে ভেবে।জ্বরের ঘোরে আমি শুধু নবনীতাকে ডেকে গেছি।বারবার মনে হতো নবনীতা যদি একটা বার আমার কপালে হাত রাখতো তবে আমার জ্বর সেরে যেতো। কেউ জানে না মেঘলা ছাড়া। শুধু মেঘলা জানে আমার শরীর কতোটা খারাপ হয়ে গেছে। রাত ভরে মেঘলা আমার মাথায় পানি দিতো।লজ্জায় বাবা মাকে এসব বলতে পারি নি,জানতে পারলে ওনারা সবাই কষ্ট পাবে।

তুই জানিস না রুনা,আমার মতো এরকম একজন ইগো নিয়ে থাকা মানুষ রাতে বাসায় না এসে নবনীতার বাসার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি তাকে একবার দেখার জন্য। আমি খেতে পারি না রুনা,ঘুমাতে পারি না।আমার চোখের নিচে তাকিয়ে দেখ,কালি পড়ে আছে। আমার কাছে ধ্যান-জ্ঞান সব হয়ে গেলো নবনীতা। আমি ছ্যাচড়া ছেলেদের মতো আমি ওকে কল দিয়ে,মেসেজ দিয়ে ও ডিস্টার্ব করতে থাকি।ভালোবাসা মনে হয় এরকমই রুনা।
আমি মনে হয় পাগল হয়ে গেছি রুনা।নবনীতাকে না পেলে আমি একেবারে পাগল হয়ে যাবো।আমার অফিসের কাজে মন বসে না,নবনীতা ছাড়া আর কিছু মাথায় ঢুকে না।আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে রুনা।ওরা আমাকে ডাকে চণ্ডীদাস বলে। আমি ওসব গায়ে মাখি না।যার যা ইচ্ছে বলুক।তবুও আমার নবনীতাকে চাই।প্রেমে পড়লে মানুষ তার স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনা ও হারিয়ে ফেলে।লোক লজ্জা ভুলে যায়। আমি ও সব ভুলে গেছি।

আমি তোর ভালোবাসা বুঝতে পেরেছি,আশা করছি তুই ও আর কখনো আমাকে এসব নিয়ে কথা বলতে আসবি না।আমি তোর আবেগকে সম্মান করি।তুই আমার ফুফাতো বোন,সেই সম্পর্ক আজীবন অটুট থাকুক।এর বাহিরে আর কিছু মনে রাখিস না।”

নবনীর সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। শিমলা নবনীকে আসতে না দেখে আবারও নিচের দিকে যাচ্ছিলো, সিড়ির উপরে দেখলো নবনী দাঁড়িয়ে আছে অপ্রস্তুত হয়ে।

শিমলা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কোনো সমস্যা নবনী?”

নবনী মাথা নেড়ে বললো,”না,চলুন।”

নবনী নুডলস নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো,সেই সময় মেঘলা এলো উপরে। নবনীর পাশে বসে শসা খেতে খেতে বললো, “ভাবী,আমি জানি তুমিই যে আমার ভাইয়ার পছন্দ করা সেই মেয়ে।শুধু মা জানে না।ভয় পেও না,মা’কে আমি বলবো না কিছু।”

নবনীর চামচ নাড়াচাড়া বন্ধ হয়ে গেলো। মেঘলা ফিসফিস করে বললো,”আরেকটা কথা শুনো ভাবী,আমার মা একটু পাগলাটে টাইপের তো,এজন্য কাউকে তার ভালো লাগলে তার কাছে সব কথা বলে দেয়।আমার মা মনে মনে ভাইয়ার জন্য পাত্রী হিসেবে কাকে পছন্দ করেছে জানো?
তোমাকে।”

বলেই মেঘলা শসা নিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে গেলো। নবনীর মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো।

নবনী হতবিহ্বল হয়ে বসে আছে সেই মুহুর্তে মাসুমা বেগম এলেন।নবনীর পাশে বসে বললেন,”ঘটনা না তো একটা ঘটে গেছে। আমার গাধাটা নাকি আজকে সন্ধ্যায় গান গাইবে নীড়ের জন্মদিন উপলক্ষে। তার সাগরেদরা সবাই কলকব্জা যন্ত্রপাতি নিয়ে তো হাজির।আচ্ছা নবনী,কোন ব্রান্ডের তুলো ভালো হবে সবার কানে গুঁজে দেয়ার জন্য?
আমি অলরেডি এম্বুল্যান্সের জন্য কল দিয়ে রেখেছি,খোদা না করুক ওর ষাঁড়ের মতো গলার গান শুনে যারা অসুস্থ হয়ে যাবে তাদের তো হসপিটালাইজড করতে হবে ইমিডিয়েটলি। আমি অনুষ্ঠান শুরু হলে সবার কাছে আগেই ক্ষমা প্রার্থনা করে নিবো,আমার ছেলের গান শুনে কেউ বিরক্ত হলে যেনো নিজ গুণে ক্ষমা করে দেয়।মা হিসেবে ছেলের জন্য এটুকু তো আমি করতেই পারি তাই না।”

নবনী নিজের হাসি থামাতে না পেরে হাসিতে লুটিয়ে পড়লো।
মাসুমা বেগম আগ্রহ নিয়ে নবনীকে দেখতে লাগলেন।

চলবে……
রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে