তুই শুধু আমার পর্ব-০৯+১০

0
1638

#তুই শুধু আমার
#Writer : মারিয়া
#Part : 9+10

চারিদিকে রিমঝিম আওয়াজ। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানির শব্দ। সেই যে বিকালের একটু আগে বৃষ্টি শুরু হয়েছে থামার নামই নিচ্ছে নাহ। সন্ধ্যা গড়িয়ে চারিদিকে এখন বেশ রাত। ওয়েদার টাই যেনো অন্যরকম। এমন আবহাওয়া তে কবিতা লেখা, গান গাওয়া বা শোনা, প্রিয় মানুষের পাশে বসে গল্প করা, একা একা বসে এক কাপ কফি হাতে কারো কথা ভাবা, আবার অনেকের কষ্ট জাগিয়ে তোলা, এক কথায় নিজেকে নিয়ে থাকার বা অন্যকে নিয়ে ভাবার সবথেকে ভালোসময় মনে হয় এইটাকেই বলে। সেরকম অনেকেই আজ এই অবস্থায় রয়েছে। একজন অন্য একজনের ভাবনায়।

আশফি বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে কানে ইয়ারফোন গুজে গান শুনছে। আর একজনের কথা ভাবছে, আর তার কথা ভাবতেই মনের মাঝে আলাদা প্রশান্তি কাজ করছে। তার কথা মনে আসতেই আলাদা ভালোলাগা কাজ করছে। তার কথা ভাবতেই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি, চোখ বন্ধ করলেই তার মুখ ভেসে ওঠা, আর বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজ। সব মিলিয়ে আশফির ভেতর অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। আশফি যাকে নিয়ে ভাবছে, সে আর কেউ নাহ, সে হলো নেহা। হ্যা, আশফি নেহাকে নিয়েই ভাবছে। নেহাকে প্রথম আমানের সাথে দেখে আশফিও ভেবেছিলাে আমানের গফ হতে পারে। কিন্তু পরে জানে যে আরসাল আর আশফির বান্ধবী নেহা৷ সেইদিন নেহাকে প্রথম দেখাতেই ভালোলেগে যায় আশফির। নেহার হাসি, তাকানো, কথা বলা, স্মার্টলি চলাফেরা আশফিকে যেনো আকৃষ্ট করে। তারপর থেকেই চোখ বন্ধ করলে শুধু নেহার চেহারায় আশফির চোখের সামনে ভাসছে। নেহাকে নিয়েই ভাবছে সবসময়। নিজেও বুঝতে পারছে নাহ কি হচ্ছে ওর সাথে। আগেও তোহ কত মেয়ে দেখেছে কই কখনো তোহ এমন হয় নিহ আশফির। আশফি মনে মনে ভাবতে থাকে,
–” কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? আমার কেনো বার বার নেহার কথা মনে পড়ছে? ওরে কথা ভাবতেই এতো ভালো লাগছে কেনো? নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগতেছে।”

এইসব ভাবতে ভাবতেই আশফি চোখ বন্ধ করে, আর তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে নেহার মুখটা। কিন্তু আশফি আর চোখ খুলে নাহ। নিজের কল্পনাতে নেহার ছবি দেখতে থাকে আশফি।

★★★
নেহা নিজের রুমে আয়নার সামনে বসে আছে। আয়নার সামনে বসে আয়নায় নিজেকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। হাত বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা আরসালের ফটো টাহ মুখের সামনে এনে তাতে চুমু একে দিয়ে, আবার সামনে ধরে বলতে শুরু করে,
–” I love you. I love you very much Arsal. কেনো বুঝো নাহ আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি? আমার যে শুধু তোমাকে চায়। তুমি শুধু আমার, শুধু আমার। কেনো আমাকে, আমার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিলে জানি নাহ। কিন্তু তুমি আমার ছাড়া আর কারো হতে পারবা নাহ। আজ হোক বাহ কাল তুমি শুধু আমার।”

আরসাল ছবি টাহ হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায় নেহা। চোখ মুখ শক্ত করে মনে মনে ভাবতে থাকে,
–” সেইদিন আরসালের সেহেরের দিকে তাকিয়ে গান গাওয়া আমার কাছে নরমাল মনে হয় নি। আরসাল শুধু আমার। আরসাল আর আমার মাঝে যদি কেউ আসার চেষ্টাও করে তাকে আমি শেষ করে দিতে দুইবারও ভাববো নাহ। আরসাল যদি আমার নাহ হয়, তাহলে সব কিছু শেষ করে দিবো আমি।”

নেহা এইসব ভাবছে আর তাকিয়ে আছে মেঘ ভরা আকাশের দিকে। নেহার চোখে আরসাল কে পাওয়ার ইচ্ছা তীব্র ভাবে দেখা যাচ্ছে।

★★★
আরসাল নিজের রুমের বারান্দায় ডিভানের উপর আধশোয়া হয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে বৃষ্টির শব্দ সহ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেইদিকে তাকিয়ে আরসাল মনে মনে ভাবছে,
–” কি করতে যাচ্ছিলাম আমি? কেনো সেহের কে দেখলে নিজের উপর কন্ট্রোল থাকে নাহ আমার? যেখানে আমি সেহের কে বার বার বলছি যে আমি ওরে ঘৃনা করি সেখানে আমি সেহেরকে। নাহ, কন্ট্রোল আরসাল কন্ট্রোল। এতোটাহ কন্ট্রোল হারালে চলবে নাহ।”

আরসাল উঠে বসে হাত দিয়ে মুখ ডলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর হাটুর উপর হাত ভাজ করে রেখে তারউপর মুখ রেখে বসে বাহিরের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই আরসালের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেহেরের বৃষ্টি ভেজা মুখ, ঠোঁট, চোখ। আরসাল তাড়াতাড়ি চোখ খুলে ফেলে। উঠে দাড়িয়ে বারান্দার কর্নারে এসে দাড়ায় আরসাল। বৃষ্টির পানি হালকা গায়ে এসে লাগছে আরসালের। আরসাল আবার মনে মনে ভাবতে থাকে,
–” আজও চোখ বন্ধ করলে তোকে দেখি। আজ একবারের জন্য হলেও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যদি আমি আজ ঐ রাস্তায় নাহ যেতাম, তাহলে কি হতো তোর সেহের। ওরা তোহ তোরে, নাহ আর ভাবতে পারছি নাহ। মাথায় পেইন হচ্ছে খুব।”

আরসাল আবারও তাকিয়ে থাকে বাহিরের দিকে, আরসালের মনে হতে লাগে মেঘ থেকে আসা আলোর ঝলাকানিতেও সেহেরের মায়া ভরা মুখ ভেসে উঠছে।

★★★
সেহের চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে বারান্দার কর্নারে। বৃষ্টির পানি হালকা ভিজিয়ে দিচ্ছে সেহেরকে। আর সেহের চোখ বন্ধ করে সেই বৃষ্টির হালকা পানি অনুভব করছে। হঠাৎ সেহের মনে আসে আরসালের কথা। আজ আরসাল তার কতোটা কাছে চলে এসেছিলো। যদি সেহের আরসালকে আটকানোর জন্য ডাক নাহ দিতো, তাহলে কি হতো? সেহের মনে মনে ভাবছে,
–” আচ্ছা ভাইয়া তোহ আমাকে ঘৃনা করে, তাহলে আজ আমার এতো কাছে কেনো এসেছিলো। আমার পায়ে হাত দিয়ে ব্যাথাটাও ঠিক করে দিলো কেনো? আজ যদি ভাইয়া সময়মতো নাহ আসতো তাহলে কি হতো আজ আমার? ওরা তোহ।”

এইসব কথা ভাবতেই সেহেরের ভয় লেগে উঠে। আসলেই আজ সেহেরের সাথে অনেক খারাপ হতে পারতো। সেহের আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার ভাবতে থাকে,
–” আমার কেনো জানি নাহ মনে হয়, ভাইয়া আজও আমাকে ভালোবাসে। অনেক ভালোবাসে আমাকে। কিন্তু তার রাগের কাছে ভালোবাসাটাহ ধূসর হয়ে আছে। নাকি, সত্যিই ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে নাহ আর। আচ্ছা আমি কেনো এইসব ভাবছি। ভাইয়া আমাকে ভালোবাসুক বাহ নাহ বাসুক তাতে আমার কি? আমি কেনো ভাবছি এইসব নিয়ে? ভাইয়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে মিশলে আমার রাগ কেনো হয়? আমি কেনো সহ্য করতে পারি নাহ ভাইয়াকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে? ভাইয়াও নাকি সহ্য করতে পারতো নাহ আমাকে অন্য কোনো ছেলের সাথে। কিন্তু তার তোহ কারন ছিলো, ভাইয়া আমাকে ভালোবাসতো জন্যই অন্য কাউকে সহ্য করতে পারতো নাহ। কিন্তু আমার তোহ কোনো কারন নেই। নাকি আমিও ভাইয়াকে, নাহ নাহ এইসব কি ভাবছি আমি। আমি ভাইয়াকে কখনো পসিবেল নাহ। ভাইয়াকে তোহ আমার ভয় লাগে। আমার লাইফের ডেভিল। আমার দ্বারা এইটা কখনোই সম্ভব নাহ।”

এইসব ভাবছে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে সেহের।

★★★
আমান তার রুমের বারান্দায় একটি চেয়ারের উপর মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। সামনে একটা কাচের ছোট্ট টেবিলে এক কাপ কফি রাখা। কফি ঠান্ডা হয়ে পানি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমানের যেনো সেইদিকে খেয়াল নেই। আমান তার ভাবনায় ব্যাস্ত। আমান মুখে হাত দিয়ে ভাবছে,
–” আমার সাথে এমন কেনো করলে জেরিন ( আমানের এক্স গফ )। আমার সাথে এইভাবে প্রতারনা কেনো করলে? কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার? আমার ভালোবাসা নিয়ে এইভাবে কেনো খেললে জেরিন। যন্ত্রনা দেয় তোমার সাথে কাটানো দিন গুলো। ভুলতে চায় তোমাকে, তাও পারছি নাহ। আশাকেও কষ্ট দিলাম আজ। কি করতাম আমি। আমি যে আজও জেরিনকে ভুলতে পারি নাহ। এই মুহুর্তে আশাকে মেনে নেওয়া মানে আশার প্রতি অন্যায় করা। মেয়েটা খুব কাদছিলো। ছেড়ে চলে এলাম তাও। কি করবো আমি, আশাকে যে মেনে নিতেও পারছিলাম নাহ আবার ওর কান্নাও সহ্য করতে পারছিলাম নাহ। এ কোন দোটানার মাঝে পড়লাম আমি। নাহ পারছি জেরিন কে ভুলতে, নাহ পারছি আশাকে মেনে নিতে, নাহ পারছি আশার কান্না সহ্য করতে আবার নাহ পারছি আশার কান্না মুছে দিতে। কি করবো আমি?”

আমান উঠে গিয়ে বারান্দার রেলিং ধরে দাড়ায়। বৃষ্টির হালকা পানি এসে গায়ে লাগে আমানের। কিন্তু এতে আমানের কিছু যায় আসে নাহ। আমানের চোখে তোহ শুধু আশার কান্নারত মুখ আর কানে ”আমি তোমাকে ভালোবাসি” কথাটাহ বাজছে।

★★★
বারান্দায় দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে আশা। কোনো দিকে খেয়াল নেই আশার। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে আশার। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে আজ যেমন মেঘ করে বিদ্যুৎ চমকিয়ে বৃষ্টি নামছে। আশারও সেই একই অবস্থা। আশার মনেও আজ মেঘ জমে বজ্রপাত হচ্ছে। চোখ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ধারা। আশা মনে মনে ভাবছে,
–” কেনো এতো ভালোবাসলাম তোমাকে? কেনো ফিরিয়ে দিলে আমাকে? ঐ মেয়েটা নাহ হয় তোমার সাথে বেইমানি করেছে। তাই বলে আমিও করবো নাকি, যে আমাকে ফিরিয়ে দিলে। আমি তোহ তোমাকে কখনো বলতেই চাই নি, যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আজ তোমাকে জানিয়ে তোমার কাছে থেকে ভালোবাসাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসাটা যেনো মেনে নিতে পারছি নাহ। অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। খুব ভালোবাসি তোমায় আমান। খুব বেশি ভালোবাসি।”

কথা গুলো ভেবে হাটুতে মুখ গুজে কান্না করতে লাগে আশা।

***সবাই আজ বারান্দায় দাড়িয়ে বৃষ্টির পানির সাথে নিজের কথাগুলো বলে যাচ্ছে। যাকে নিয়ে ঘর বাধতে চায় বা চেয়েছিলো তাকে নিয়ে ভাবছে। কি হবে এর শেষ পরিনতি। কে পাবে কার ভালোবাসা। কার কাছে গিয়ে কে পৌছাবে। কে বাহ জয় করে নিবে নিজের ভালোবাসা। কারো ভালোবাসা কি পূর্নতা পাবে নাকি কোনো অজানা ঝড় সবার এলোমেলো জীবনকে আরও এলোমেলো করে দিয়ে যাবে।

কেটে গেছে সাত দিন।
এই সাত দিনে আরসাল প্রতিদিন অফিস গেছে। নিজের মতো করে কাজ করেছে। নেহাকে নিয়ে দুইদিন ঘুরতে গেছে। পরিবারের সবার প্রতি একটু নরম হয়েছে। কিন্তু সেহেরের থেকে দুরত্ব বজায় রেখেছে।
সেহেরও এই সাতদিন ভার্সিটি গেছে। বাসায় দুর থেকে দেখেছে আরসালকে। আরসালের প্রতি কেমন যেনো দূর্বল হয়ে যাচ্ছে সেহের। আবার মাঝে মাঝে রেগে বমও হয়ে যাচ্ছে সেহের। যখন নেহা এই বাসায় আসে, বা আরসালের সাথে ঘুরতে বের হয় তখন সেহেরের মেজাজ একদম টপে উঠে যায়।
আশফি এই কয়েকদিনে নেহার সাথে বন্ধুত্ব করে নিয়েছে। নেহার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে আশফি। নেহাও কয়েকবার এসেছে এই বাড়িতে। সবার সাথে কথা বলেছে। মাঝে মাঝে আরসালের অফিসে গিয়ে আরসালের সাথে সময় কাটিয়েছে। আরসালের সাথে দুইদিন ঘুরতে বেরও হয়েছে। একদিন আমান সহ আর একদিন আমানকে ছাড়া।
আমানও এই সাতদিন মাঝে মাঝে আরসালের বাসায় এসেছে। আশাকে দেখেছে কিন্তু কিছু বলার আগেই আশা আমানের সামনে থেকে চলে যায়। এতে যেনো আমানের বুকের কোথাও ব্যাথা অনুভব হয়।
আশা এই কয়দিন ভার্সিটি যায় ঠিকই কিন্তু কথা কম বলে সবার সাথে। আমানকে দেখলেই সামনে থেকে সরে আসে। নাহলে আমানকে দেখলে তার প্রতি ভালোবাসার পরিমান যদি আরও বেড়ে যায়। কিন্তু এতে বিশেষ কোনো লাভ হয় নাহ। দিন শেষে রাতের বেলা চোখের পানি দিয়ে বালিশ ভেজায় আশা।

In morning…..

জিহাদ চৌধুরী ডাইনিং টেবিলে বসে পেপার পড়ছেন। মায়া চৌধুরী জিহাদ চৌধুরীর সামনে ব্রেকফাস্ট রাখতেই জিহাদ চৌধুরী বলে ওঠে,
–” মায়া শোনো, আজ সন্ধ্যায় সবাই যেনো বাসায় থাকে। সবাইকে বলে দিও। কথা আছে।”

–” হঠাৎ, কি হয়েছে যে এমন করে সবার সাথে কথা বলতে হবে।”

–” সেইটা তখনই জানতে পারবে। সারপ্রাইজ বলতে পারো।”

–” কি করতে চাচ্ছো বলোতো?”

–” সেইটা তখনই দেখতে পাবে।”

বলেই জিহাদ চৌধুরী ব্রেকফাস্ট করা শুরু করে। মায়া চৌধুরীও আর কিছু বলে নাহ।

এইদিকে,
আরসাল আজ অফিস যাবে নাহ। তাই রুফটপে এসেছে। সকালের এই প্রকৃতি আরসালের ভালোই লাগছে। হঠাৎ শুনতে পায় আশেপাশে কোথাও একটা আওয়াজ হচ্ছে।
আরসাল আশেপাশে উকি ঝুকি মেরে দেখতে থাকে। হঠাৎ একটা মাঝারি সাইজের গাছের পাশে যাহ দেখে তাতে কান্না করবে নাকি হাসবে আরসাল বুঝে উঠতে পারছে নাহ। আসলে সেহের গাছের পাশে উবুর হয়ে অন্য কোনো গাছ লাগানোর জন্য মাটি ঠিক করছে। কিন্তু সেহেরের পুরো মুখে মাটি লেগে গেছে এবং চুলে গাছের পাতা আটকে আছে। আরসালের কাছে সেহেরকে ঠিক একটা কিউট বিড়াল মনে হচ্ছে। আরসাল জোরে হেসে দেয়। সেহের কারো হাসির আওয়াজ পেয়ে উপরে তাকিয়ে দেখে আরসাল হাসতেছে। সেহের এই প্রথম মনে হয় আরসালকে এমন হাসতে দেখছে। আরসালের হাসিটাহ আসলেই খুব সুন্দর। সেহের একভাবে তাকিয়ে আছে আরসালের দিকে। আরসাল কোনোভাবে নিজের হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,
–” তোকে দেখতে দারুন লাগছে।”

কথাটাহ বলেই আরসাল আবার হেসে উঠে। আরসালের কথা শুনে সেহেরের ঘোর ভাঙে, কিন্তু আরসালের এতো হাসির কারন কি বুঝে উঠতে পারছে নাহ সেহের। তাই সেহের বলে ওঠে,
–” মানে, আর তুমি এতো হাসছো কেনো?”

–” ওয়েট, ওয়েট।”

আরসাল নিজের হাসি থামিয়ে ফোন বের করে সেহেরের একটা ফটো তুলে সেহেরের চোখের সামনে ধরে। সেহেরের ছবিতে নিজেকে দেখে চেচিয়ে উঠে। তাহ দেখে আরসাল আরও জোরে হেসে দেয়। আরসালের হাসি দেখে সেহেরের খুব রাগ উঠে। আর বলে ওঠে,
–” খুব হাসি পাচ্ছে, তাই নাহ। দাড়াও বের করছি তোমার হাসি।”

বলেই নিচে থেকে কিছু মাটি নিয়ে আরসালের মুখে মাখিয়ে দেয় সেহের। সেহের এমন কান্ডে আরসাল হতভম্ব হয়ে যায়। সেহেরের আরসালের দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে যখনই দৌড় দিতে যায়, আরসাল সেহেরের হাত ধরে টান দিতেই সেহেরের আরসালের কাছে চলে আসে। আরসাল একহাত দিয়ে সেহেরের কোমর পেচিয়ে একদম নিজের কাছে নিয়ে এসে বলতে শুরু করে,
–” এইটা কি করলি তুই?”

–” আমাকে দেখে হাসছিলে কেনো? তাই করেছি।”

–” তাই নাহ। এখন দেখ আমি কি করি।”

আরসাল সেহেরের মুখের যেখানে যেখানে মাটি ছাড়া ছিলো সেখানে সেখানে নিজের মুখে লেগে থাকা মাটি ঘসে লাগিয়ে দিতে শুরু করে। আরসালের খোচা খোঁচা দাড়ি মুখে লাগতেই কেঁপে উঠে সেহের। আরসালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেহের। আরসাল সেহেরের মুখে নিজের মুখ দিয়ে মাটি লাগিয়ে হেসে দিয়ে সেহেরের দিকে তাকিয়ে দেখে, সেহের একভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতোক্ষণে আরসালের খেয়াল এলো সে কি করছে। আরসাল আস্তে আস্তে সেহেরের কোমর থেকে নিজের হাত সরিয়ে, ২ পা পিছিয়ে যায়। আরসাল সেহের কে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সেহের রুফটপ থেকে নিচে নেমে যায়। আরসাল সেহেরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর মনে মনে ভাবতে থাকে,
–” এইটা কি করছিলাম আমি। কেনো নিজের উপর কন্ট্রোল রাখিস নাহ আরসাল? সেহের কি ভাবলো? কি ভাবছে সেহের আমাকে নিয়ে? উফ, অসহ্য, মাঝে মাঝে নিজের কাজে নিজের উপরই এমন রাগ উঠে।”
আরসাল এগুলো ভেবে নিচে চলে যায়।

In evening….

আরসাল নিজের রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখে আমান। আরসাল আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। আমান আরসালের পাশে বসে ফোন চালাতে চলাতে বলে ওঠে,
–” কি করছিস।”

–” দেখতেই তোহ পাচ্ছিস।”

–” ওহ হ্যা।”
আমান আবার কিছু বলতে যাবে তার আগে আবার দরজায় কেউ নক করায় আরসাল বলে উঠে,
–” ভেতরে এসো।”

একজন সার্ভেন্ট ভেতরে এসে বলে ওঠে,
–” ভাইয়া, বড় ম্যাম নিচে সবাইকে ডাকছেন।”

–” আম্মু ডাকছে, কেনো?”

–” তাতোহ বলতে পারবো নাহ। কিন্তু সবাইকে নিচে যেতে বলেছে।”

–” আচ্ছা তুমি যাও।”

সার্ভেন্টটি চলে যায়। আরসাল আবার নিজের কাজ শুরু করে দেয়। আমান তাহ দেখে বলে ওঠে,
–” কিরে, নিচে যাবি নাহ?”

–” নাহ, তুই যা। আমার কাজ আছে।”

–” মানে কি? আন্টি সবাইকে যেতে বললো আর তুই যাবি নাহ কেনো? চলতো।”

–” আমান।”

–” আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি নাহ। চল।”

আমান আরসালকে জোর করে নিচে ড্রইংরুমে নিয়ে আসে। নিচে আসতেই আমান আর আরসাল দেখে সবাই ড্রইংরুমে হাজির, শুধু জিহাদ চৌধুরী ছাড়া। আমানের চোখ যায় আশার দিকে, তাকাতেই আশা দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়, তাহলে কি আশা এতো সময় তার দিকে তাকিয়ে ছিলো? আরসালও সেহেরের দিকে তাকাতেই সেহেরেরও আরসালের দিকে তাকায়। আরসাল তাড়াতাড়ি নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে, মায়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আম্মু, কি হয়েছে? সবাইকে নিচে ডাকার কারন কি?”

–” আসলে তোর আব্বু কি যেনো বলবে সবাইকে তাই। তোর আব্বু চলে আসবে এক্ষুনি। ঐ তোহ চলে এসেছে।”

সবাই তাকিয়ে দেখে জিহাদ চৌধুরী চলে এসেছেন। জিহাদ চৌধুরী এসেই সোফার উপর বসে পড়েন। জিহাদ চৌধুরী বসতেই কবির চৌধুরী বলে ওঠে,
–” দাভাই, এইবার সবাইকে খবর টাহ দিয়ে দাও। আমরা তিনজন জানলেই তোহ হবে নাহ। বাকি সবারও জানা দরকার।”

–” হুম, আসলে, আমার বন্ধু সিরাজ রহমানের ছেলে সাইফ দেশে ফিরেছে কিছু দিন হলো। সিরাজ তোহ আমার বাসায় সবসময় যাওয়া আসা করে। তোমরা সবাই চিনো। তোহ সিরাজ আমার কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছে, কথাটা আমি কবির এবং আজিজ কে বলতেই ওরা বলে আমি যাহ বলবো তাই হবে। আর এই প্রস্তাবে আমি সহজে নাহ করতে পারছি নাহ। কারন সাইফ আসলেই অনেক ভালো একটা ছেলে।”

জিহাদ চৌধুরীর কথা শুনে মায়া চৌধুরী বলে ওঠে,
–” হ্যা, সব ঠিক আছে। কিন্তু কিসের প্রস্তাব?

জিহাদ চৌধুরী উঠে দাড়িয়ে আশার সামনে এসে মুচকি হাসি দিয়ে আশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,
–” সিরাজ, আশাকে তার ছেলে সাইফের বউ বানাতে চায়।”

কথাটা শুনে আশা চমকে জিহাদ চৌধুরীর দিকে তাকায়। আমানের যেনো মনে হচ্ছে তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আশার বিয়ে অন্য একজনের সাথে এইটা আমান যেনো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে নাহ। আর আশা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে নাহ। জিহাদ চৌধুরী আবার বলে ওঠে,
–” আগামীকাল সিরাজরা সবাই আমাদের বাসায় আসছে। আশা এবং সাইফ কাল যদি একে অপরকে পছন্দ হয়। তাহলে কাল সব কথা পাকা করা হবে।”

আশা কি বলবে বাহ কি বলা উচিত এইটায় বুঝে উঠতে পারছে নাহ। রুমের সবাই অবাক হয়ে গেলেও খুশিই হয়। সেহের দৌড়ে আশার কাছে এসে ফিসফিস করে বলতে শুরু করে,
–” আশা তোর বিয়ে। ওয়াও, আমি তোহ ভাবতেই পারছি নাহ। কত মজা হবে। ইয়ে, শোন আমরা অনেক অনেক শপিং করবো বুঝলি।”

সেহেরের কথা শুনে আশা সেহেরের দিকে তাকায়। সেহের আশার দিকে তাকাতেই সেহেরের হাসি মিলিয়ে যায়। কারন আশার চোখ পানিতে ভরে গেছে। সেহের আর কিছু নাহ বলে আশাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসে।
জিহাদ চৌধুরী নিজের রুমের দিকে যেতে গিয়ে থেমে যায়। আমানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” আমান।”

আমান যেনো এতোক্ষণ নিজের মাঝেই ছিলো নাহ। জিহাদ চৌধুরীর ডাক শুনে আমানের ধ্যান ভাঙে। আমান কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে জিহাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–” জি, আংকেল।”

–” আগামীকাল যেনো তোকে দেখতে পাই। আমার ভালো লাগবে।”

–” জি, আংকেল। আমি আসবো।”

–” হুম।”

জিহাদ চৌধুরী নিজের রুমে চলে যায়। আরসালও নিজের রুমে চলে যায়। আমান আর আরসালের কাছে যায় নাহ, সোজা বেরিয়ে যায় চৌধুরী ম্যানশন থেকে।

★★★
–” কি হয়েছে আশা? তুই ঠিক আছিস?”
আশার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে সেহের। আশার চোখ দিয়ে পানি বের হয়েই যাচ্ছে। সেহের আশাকে দুই হাত দিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করে,
–” তাকা আমার দিকে, বল কি হয়েছে তোর?”

আশা নিজের চোখ মুছে সেহেরের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
–” কিছু নাহ।”

–” কিছু নাহ বললেই হলো তাই নাহ। কি হয়েছে আমাকে বলবি নাহ?”

–” সেহের আমি এখন বিয়ে, কি করে পসিবেল। আমার স্টাডির কি হবে?”

–” আরে বোকা। এই জন্য কাদছিস তুই। একদম ভাবিস নাহ। তোর স্টাডির কোনো ক্ষতি হবে নাহ।”

বলেই সেহের আশার জন্য পানি আনতে চলে যায়। আশা উঠে দাড়িয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে মনে মনে বলতে শুরু করে,
–” কি করে বলি তোকে সেহের। ভালোবাসি আমি আমানকে। আমি কি করে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারি। কিন্তু আমান তুমি তোহ আমাকে মেনে নিবে নাহ, তুমি তোহ আমাকে ভালোইবাসো নাহ, তুমি তোহ এইটায় চাও যে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিই। বেশ তাহলে তাই হোক, আমি এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবো। দেখি কেমন সুখ পাও তুমি। তোমার সুখের জন্যই নাহ হয় নিজের ভালোবাসা কে খুন করলাম আমি।”

বলেই আশা নিজের রুমে চলে যায়।

এইদিকে,
সেহের আশার জন্য গ্লাসে করে পানি নিয়ে যাচ্ছিলো। একটু বেশি পানি ভরে ফেলেছে গ্লাসে। তাও সেইভাবে নিয়ে যাচ্ছিলো সেহের, দুষ্টুমি চাপলে যাহ হয় আরকি।
নিয়ে যেতে যেতে কারোর সাথে ধাক্কা লেগে সব পানি সামনে থাকা ব্যাক্তির গায়ের উপর পড়ে, সেহের কার উপর পড়লো তাহ দেখার জন্য সামনে যাকে দেখে, তাকে দেখেই সেহেরের মনে হলো তার প্রান পাখি ওড়ার জন্য রেডি হচ্ছে। সেহের ভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, কি হবে এখন সেহেরের।

চলবে……….🌹

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে