তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
735

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৮
Writer তানিয়া শেখ

থমথমে রাত। গহীন অরণ্যের মাঝে একদল নর -নারী হাঁটু ভেঙে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছে। সামনে বহু পুরোনো মদভর্তি বোতল, ক্রন্দনরত পাঁচটা শিশু আর ভীতবিহ্বল অর্ধ নগ্ন দুজন তরণী। প্রার্থনারত নর -নারীর মুখে অদ্ভুত শব্দ। অশুভ শক্তিকে আহ্বান করছে ওরা। অদূরে জ্বলছে তিনটে মশাল। সেই মশালের আলোতে অস্বাভাবিক ওদের চাহনী। রাত গভীর হতেই অশুভ শক্তির প্রতি আহ্বান আরো জাগ্রত শোনায়। অশুভ এক আবহাওয়া চারিদিকের ঘন কালো অন্ধকারে জড়িয়ে যায়। ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে নেকড়ের গর্জন। একটা দুটো এমন করে অসংখ্য নেকড়ের গর্জনে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। ধীরে ধীরে মানুষগুলোর দিকে অগ্রসর হয়। প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে থাকা নর-নারীরা কাঁপছে থরথর করে। শীতে নয়, আতঙ্কে। কিন্তু সেই আতঙ্ক চোখ ওদের পর্যন্ত পৌঁছাছে না। চোখে তখন কেবল লোভ আর লালসা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। চাপা গোঙানির শব্দ শুনতেই ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হলো ওদের।

“প্রভু, প্রভু।” আগের চাইছে জোর গলায় ডাকল ওরা। হঠাৎ অনেকগুলো কালো বাদুড় উড়ে এসে ঘিরে ধরল। তারপর সেই বাদুড় একটা মানুষের অবয়ব নেয়। দু-হাত শূন্য তুলে উঁচু গলায় পিশাচ বন্দনা করে। ঝুঁকে পড়ে মূর্তিটির সামনে। আবেগ ঢেলে পড়ল ওদের গলায়,

“প্রভু, প্রভু।”

আপাদমস্তক কালো আলখেল্লা পরা দীর্ঘদেহি এক মানব মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে। চোখ দুটো এবং নাক হুডির আড়ালে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওর রক্তিম ঠোঁটের দু’পাশের সাদা দাঁত। জ্বলন্ত বুভুক্ষু চোখে এক পাল নেকড়ে এসে থামল দু’পাশে। সদর্পে পায়চারি করতে করতে মূর্তিটি বলল,

“আমি খুশি হইনি তোদের কাজে। সন্তুষ্ট করতে পারিসনি আমাকে তোরা।”

রাগে ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করে। সামনে বসা এক মধ্যবয়সী নারী থুতনি তুলে সরাসরি চেয়ে বলে,

“খুশি হননি? আপন স্বামী-পুত্রের শেষ রক্ত পান করেছি আপনাকে সন্তুষ্ট করতে। গোরু- ছাগল, পাখি কিছুই বাদ রাখিনি। আর কী করব বলুন প্রভু। আর কী করলে অমরত্ব পাব আমি?”

আলখেল্লা পরিহিত মূর্তিটি এগিয়ে এসে রমণীর চোয়াল চেপে নিকটে এনে বলে,

“ব্যস এইটুকু! এখনো এই গাঁয়ে জীবন্ত মানুষের হাসি শোনা যায়, ঘরে ঘরে পবিত্র মানব শিশু জন্মায়, ঈশ্বরের আরাধনায় গির্জার ঘণ্টা বাজে। আমি চাই এসব বন্ধ হোক। গাঁয়ে জীবন্ত নয় জীবন্মৃতের হাসি শোনা যাবে, মানব শিশু জন্মাবে পিশাচের গোলামি করতে, গির্জায় ঘণ্টা ঈশ্বরের নয় আমার আরাধনায় বাজবে। তোরা সবকটা অকর্মা। তোদের দিয়ে এসবের কিছুই হয়নি। গোলামিটাও ঠিকমতো করতে পারিস না তুচ্ছ মানুষ। আবার অমরত্ব চাস? গোলাম, অমরত্ব নয় তোকে মৃত্যু দেবো।”

ঠোঁটের পাশের সাদা সুচালো দাঁত দু’টো মুহূর্তে নারীর নগ্ন কাঁধে গেঁথে যায়। অসহ্য যন্ত্রণা ছটফট করতে লাগল। খানিক পরে নারীর আর্তনাদ থেমে যায়। মাটিতে পড়ে গেল ওর নিথর, প্রাণহীন দেহ। বাকিরা আতঙ্কিত। নত মাথায় ক্ষমা প্রার্থনা করছে। কিন্তু ওরা জানে না, ক্ষমা শব্দটা পিশাচের অভিধানে নেই। এরা কেবল আপন স্বার্থে চলে। ওই নারীর মতোই দশা হয় বাকিদের। নেকড়েদের রাতের খোড়াকে পরিণত হতে হয়। ওদের আহাজারি, নেকড়ের গর্জন আর পিশাচটার পৈশাচিক হাসিতে কেঁপে ওঠে রাতের নির্জনতা। শিশু আর তরুণীদের তুলে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় পিশাচ মূর্তিটি। মুহূর্তে আবার সেই নিশুতি নিস্তব্ধতা।

গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন ইসাবেলা। গলা অব্দি কম্বল টানা। ঘুমের ঘোরে বা’কাঁত হলো। বন্ধ ঘরে আচমকা দমকা হাওয়া বইতে লাগল। জানালার পর্দা উড়ে একপাশে সরে যায়। বাঁকা চাঁদ আকাশে। চাঁদের আলো এসে পড়ল ঠিক ইসাবেলার শিওরে। মাথার কাছের জানালার ফাঁক গলে একটু একটু করে ঘরে ধোঁয়া ঢুকল। স্বরূপে আবির্ভূত হলো নিকোলাস। নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় ইসাবেলা মাথার পাশে। অনিমেষ চেয়ে আছে চন্দ্রালোকিত ইসাবেলার মুখশ্রীতে। এই নিস্তব্ধতার মধ্যেও একটা শব্দ ওর কানে এসে লাগল। ঢিপ, ঢিপ, ঢিপ। হাত রাখল বুকের বা’পাশে ওপর। শব্দটার উৎপত্তি এখান থেকে। শব্দ বেজে ওঠে কেবল এই ঘুমন্ত তরুণীর কাছাকাছি এলে। ও নিকোলাসের সব এলোমেলো করে দিয়েছে। ঘৃণা করে ম্যাক্স এবং তাঁর বংশধরদের। কিন্তু ইসাবেলাকে কেন ঘৃণা করতে পারছে না? মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এতদিন দূরে থাকার পরেও আবার এই মেয়ের সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে আসার পূর্বে পণ করেছিল ইসাবেলার খোঁজ নেবে না। দুদিন না যেতেই সে পণ ভেঙেছে। পাবে না জেনেও গিয়েছিল সেই জঙ্গলে আর লিভিয়ার বাড়িতে। কোথাও ছিল না ইসাবেলা। গত চারমাস মনকে বুঝিয়েছে ও ইসাবেলার পরোয়া করে না। যা করেছে তাতে একটুও অপরাধবোধ নেই। কিন্তু সেদিন ইসাবেলাকে না পেয়ে, ওর সাথে কিছু ঘটেছে এই ভয়ে পূর্বের সব কথা অর্থহীন হয়েছে। ওর নির্মমতা ওকেই শতগুণে আঘাত করেছে। ক্ষুব্ধ হয় নিজের ওপর। কেন এত নিষ্ঠুর হলো সে? কেন? ভেতর থেকে জবাব এলো,

“এই নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতাকে একদিন স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিস তুই। ধ্বংস ছাড়া এ স্বভাব থেকে তোর নিষ্কৃতি নেই।”

নিকোলাস জানে এ সত্যি। জানে বলেই নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি। ইসাবেলাকে বলেনি কতটা পছন্দ করে ওকে। অপ্রকাশিত অনুভূতি যত সহজে উপেক্ষা করা যায় প্রকাশ্যে এলে তা কঠিন হয়। তাছাড়া ম্যাক্সের বংশধরদের সাথে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় না। এই ম্যাক্স নাম নিকোলাসের ভালোলাগাকে ক্রোধে পরিণত করে। সেই ক্রোধের স্বীকার হয়েছে ইসাবেলা। বার বার এমনই হবে। কষ্ট পাবে ইসাবেলা। এই একজন মানুষকে কষ্ট দিয়ে শান্তি পায় না নিকোলাস। নিজের শান্তির জন্য হলেও ইসাবেলাকে কষ্ট দিতে নারাজ। এ নিয়ে স্বভাব আর মনে চলে তুমুল লড়াই।

“আমি তোমায় ব্যথা দিয়েছি বিনিময়ে ঘৃণা, ক্ষোভ আমার প্রাপ্য। এই প্রাপ্য আমি অস্বীকার করি না, বেলা। কিন্তু আজ যখন দেখেও মুখ ফিরিয়ে চলে গেলে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল আমার। অস্বীকার করতে ইচ্ছে হলো তোমার এই রাগ, ক্ষোভকে। বেলা, এখন কি তুমি আমাকে ঘৃণা করো? হয়তো করো। এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ, আমার মন চাইছে কিছু অস্বাভাবিক হোক। নিষ্ঠুর হওয়ার সাথে সাথে কেমন স্বার্থলোভীও আমি, তাই না বেলা?”

বিদ্রুপের হাসি নিকোলাসের ঠোঁটে। ইসাবেলার শিওর থেকে উঠে জানালার কাছে যায়। পেছন ফিরে শেষবার ওর মুখটা দেখল।

“জানি না, কোন তীব্র আকর্ষণ আমার সকল নিয়ন্ত্রণে ধ্বস নামায়! চঞ্চল হয় মন। আসব না, দেখব না ভেবেও গন্তব্য শেষ হয় তোমার দুয়ারে। আমি চাই না আবার চাই তোমায়, বেলা। এই চাওয়া না চাওয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্ব কোনোদিন শেষ হবে কি না জানি না, শুধু জানি তোমাকে ভুলে থাকা আমার দ্বারা আর হবে না। আমি চাইলেও সেটা এখন অসম্ভব। এই অনুভূতির যন্ত্রণা যদি কেউ বুঝত!”

যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে গেল নিকোলাস। মিনিট বাদে ইসাবেলা ডান পাশ ফিরল। ধীরে ধীরে সিক্ত চোখ মেলে তাকায়। বালিশের কোণাটা দুহাতে চেপে ধরে মুখ গুঁজে কান্নার শব্দ গোপন করার চেষ্টা করে। মনে মনে ভাবে, একি স্বপ্ন ছিল? নিকোলাস কি স্বপ্নে এসেছিল? যা শুনল সব কি ওর স্বপ্ন? কিন্তু সেই সোঁদা মাটির গন্ধ যে স্পষ্ট পেয়েছিল ও। নাক টানল আরেকবার। এখনো এই ঘরে গন্ধটার রেশ রয়ে গেছে। তবে সত্যিই এসেছিল ওর ঘরে নিকোলাস? ওই কথাগুলো স্বপ্নে নয় বাস্তবেই বলেছে? ইসাবেলার সর্ব শরীর অসাড় হয়ে এলো। অস্থির হয়ে ওঠে চিত্ত। নিকোলাসের মনের কথা জেনে কীভাবে প্রতিক্রিয়া করবে ভেবে পেল না। কাঁদতে কাঁদতেই হেসে উঠল, পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে হয়ে গেল। এভাবে বিক্ষিপ্ত মনে নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো ঘণ্টা পর ঘণ্টা। রাত ভোর হওয়ার পথে। ইসাবেলা আবার বা’পাশে ফিরে শোয়। সামনের অন্ধকারে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। একসময় জলে ভরে উঠল আঁখি।

“আপনাকে ঘৃণা করতে পারলে বুঝি ঠিক হতো, কিন্তু সেই ঠিক আজ আমার কাছে বেঠিক নিকোলাস। আপনাকে ঘৃণা করা ইহজীবনে আমার হবে না। পিটারকে আমি ভালোবাসতাম, ভেবেছিলাম এই অনুভূতি কখনো বদলাবে না। আজ দেখুন, ভালোবাসি কথাটা ভালোবাসতাম হয়ে গেল। বেঈমান, বেহায়া হলো আমার মন আপনার কারণে নিকোলাস।” দু-হাত বুকে জড়ো করে বলে,” ঈশ্বর, আর দেখিয়ো না তাঁকে। এ মন বড়ো দুর্বল। একবার একজন ভেঙেছে, জোড়াতালি দিয়ে বেঁচে আছি। এবার ভাঙলে যে আর বাঁচতে পারব না। যা আমার হবে না তাতে আর মন মিশিয়ো না। দয়া করো প্রভু, এই দুর্বল মনের ওপর করুনা করো।”

ইসাবেলার রাত ভোর হলো অশ্রু বিসর্জন দিয়ে। ভোরের দিকে আবার ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে মাতভেইর ডাকে। ঘুম জড়ানো চোখে দরজা খুলে আবার ফিরে এলো বিছানায়। কম্বল টেনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। মাতভেইর ক্রাচের ঠক ঠক শব্দ বিছানার পাশে এসে থামে। বিছানার একপাশ দেবে যায়। ইসাবেলার রাতের কান্না হঠাৎ ফিরে আসে। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে মাতভেই।

“বেল, কী হলো তোমার? কেন কাঁদছ?”

কোনো জবাব নেই। ফুঁপিয়ে কাঁদছে ইসাবেলা। মাতভেই আর প্রশ্ন করল না। ইসাবেলা ওকে নিজের জীবনের অনেক কিছুই বলেছে। নিজের পরিবার পরিজনের কথা, পিটারের কথা। অসুস্থতার কারণে বায়ুবদলে বাড়ি থেকে দূরে আসা। আততায়ীর হাতে ভ্যালেরিয়ার মৃত্যু তারপর সেখান থেকে পালিয়ে একের পর এক বিপদ কাটিয়ে এই পর্যন্ত লিভিয়ার আশ্রয়ে থাকা ইত্যাদি। মাতভেই বিশ্বাস করেছিল ওর কথা। মেয়েটার প্রতি করুণা জন্মেছিল। কথা দিয়েছে পা’টা চলার মতো ঠিক হলেই বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“বাড়ির কথা মনে পড়ছে, বেল?”

ইসাবেলা মাথা ঝাঁকাল হ্যাঁ সূচক। হাঁপ ছেড়ে আহত পায়ের দিকে তাকায় মাতভেই। পা’টা যে কবে ঠিক হবে! কবে পৌঁছে দেবে আপন দেশে মেয়েটাকে!
ক্যাম্প এবং যুদ্ধ স্থলের অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় পায়ের টিস্যু অকেজো হতে থাকে। অসহনীয় ব্যথা হতো। ওর সাথের কয়েকজন সৈন্যের মৃত্যু ঘটেছিল এই রোগে। মাতভেই মরেনি কিন্তু ওর ডান পা’টা প্রায় অকেজো হয়ে যায়। ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বলেছেন এ পা আর ভালো হবে না। পঙ্গু দিয়ে তো যুদ্ধ হয় না। ফিরতে হলো বাড়িতে ওকে। মাদাম আদলৌনা আশা ছাড়েননি। আধুনিক ঔষধ যা পারেনি ভেষজপাতা দিয়ে তাই চেষ্টা করছেন। আজকাল মাতভেই সামান্য অনুভব করে পায়ে। হতাশা ভুলে নিজেও মনে মনে আশা করে একদিন দুপায়ে দাঁড়াবে। ইসাবেলা সেই আশায় জোর বাড়িয়ে দিয়েছে। এই মেয়েটাকে দেওয়া কথা ওর মনোবলে শক্তি জোগায়। মাত্র পঁচিশ বছরের জীবন। কত কী দেখার, করার বাকি আছে। ওই যে মেয়েটা- যাকে মাতভেই মন দিয়ে বসে আছে। যে মাতভেইর জীবনের প্রথম প্রিয়তমা। পরপর দুটো রাতের সঙ্গীনি ছিল মেয়েটি। ওই দুই রাতই শ্রেষ্ঠ রাত মাতভেইর জীবনে। এরপর আর দেখা হয়নি, বলা হয়নি মনের কথা। ইসাবেলাকে রাশিয়া নিয়ে যাওয়ার পর সে আরেকবার ওই ক্লাবে যাবে। খুঁজবে মেয়েটাকে। প্রায় দু’বছর হতে চললো। এতদিনে মেয়েটার নিশ্চয়ই নতুন সঙ্গী হয়েছে? অথবা প্রেমিক? এখন কি মাতভেইকে চিনবে? মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে এসব ভেবে।

ইসাবেলা চোখ মুছে উঠে বসল। এতক্ষণ কেঁদে বড্ড হালকা লাগছে। মাতভেইর প্রশ্ন এড়াতে বিছানা ছেড়ে নেমে সোয়েটার পরে নেয়। অবিন্যস্ত চুলগুলোর ওপর স্কার্ফে পরতে পরতে বলল,

“নাস্তা করেছ মাতভেই?”

“না, একসাথে নাস্তা করব বলেই ডাকতে এলাম।”

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি রুমে গিয়ে বসো।”

“রুমে নয়, আজ লনে বসে নাস্তা করব।”

“লনে! মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? এত ঠাণ্ডার মধ্যে লনে বসলে পায়ে সমস্যা হবে তোমার।”

“হবে না। পায়ে একসাথে তিনটে গরম মোজা আর বুট পরে নেবো।”

“না।”

“প্লিজ বেল। একসপ্তাহ ঘরে বসে বোর হয়ে গেছি। শুধু আধঘণ্টা বসব।”

“মাদাম রাগ করবেন।”

“করবে না। আমি মানিয়ে নিয়েছি।”

“সত্যি?”

“শতভাগ।”

“আমার বিশ্বাস হয় না।”

মাতভেইকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল ইসাবেলা।

“এই না সেদিন বললে আমায় বিশ্বাস করো?”

“সে আলাদা কথা ছিল। এখন আমি মাদামের ঘরে গিয়ে নিজের কানে শুনে আসব।”

“অবিশ্বাসী নারী।”

মেকি ক্ষোভ প্রকাশ করে মাতভেই। ইসাবেলা চোখ পাকিয়ে মুচকি হেসে মাদামের ঘরে গেল। মাদাম আদলৌনা ঘরে নেই। নিচে খুঁজেও পেল না। মাতভেই প্রস্তুতি নিয়ে ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। লনের দিকে যাবে অমনি পেছন থেকে ওর সোয়েটারের টেনে ধরে ইসাবেলা।

“না, আর এক পা এগোবে না।”

“প্লিজ বেল!”

“মাদাম রাগ করবেন মাতভেই।”

“মা গির্জায় গেছে। আসতে দুপুর হবে। মাত্র আধঘন্টার ব্যাপারই তো। মা জানবে না।”

“আমি মাদামের থেকে কিছু লুকাব না। বাইরে কি পরিমাণ তুষার পড়েছে দেখছ? তোমার পায়ের জন্য লনে বেরোনো ঠিক হবে না এখন।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসার ঘরে এসে বসল মাতভেই। ইসবেলার খারাপ লাগল ওর বিমর্ষ মুখ দেখে। একটুখানি ভেবে কিচেনে গেল। ফিরে এলো প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে।

“চলো আমার সাথে।”

“না, এখানেই বেশ আছি।”

“বাব্বাহ! কী রাগ। ওঠো বলছি।”

জোরপূর্বক দাঁড় করিয়ে নিয়ে এলো পুর্ব দিকের বড়ো জানালার পাশে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের বরফ আচ্ছাদিত গাছ, বাড়ি সবই দেখা যাচ্ছে। অদূরের সাদা বরফে মোড়া জঙ্গলের খানিকটাও চোখে পড়ে। হিম বাতাস বইছে। মাতভেই জানালা ঘেঁষে হাত বাড়ায় বাইরে। তুষার বৃষ্টিতে ভিজে গেল ওর হাত। হাসি মুখে সামনে চেয়ে রইল। বন্ধ ঘরে বসে এই খোলা হাওয়া, শীতল বাতাস ও মিস করছিল। প্রাণভরে শ্বাস নিলো।

ইসাবেলা ভেতরের ঘর থেকে ছোট্ট টেবিল আর দুটো চেয়ার এনে রাখল। টেবিলের ওপর চকলেট রোল, গরম কফি, কুকিজ আর প্যান কেক দিয়ে সাজিয়েছে। মাতভেই বসল চেয়ার টেনে। ইসাবেলা বসার ঘরের ফায়ারপ্লেস থেকে কয়েক টুকরো উত্তপ্ত কয়লা একটা লোহার পাত্রে এনে মাতভেইর পায়ের নিচে রেখে হাত ঝাড়া দিয়ে বলল,

“শেষ।”

ঘুরে দাঁড়ায় মাতভেইর দিকে।

“এবার খুশিতো?”

সানন্দে মাথা নাড়ে মাতভেই। ইসাবেলা সবটা দেখে নিয়ে বলে,

“একমিনিট, আরেকটা জিনিসের অভাব। আমি যাব আর নিয়ে আসব।”

এক ছুটে দোতলায় উঠে গেল। কিছুক্ষণ পর নেমে এলো একটা বই হাতে। মাতভেইর সামনে নিবেদনের ভঙ্গিতে বইটা দিয়ে বলল,

“মহারাজ, আজকের এই ব্রেকফাস্টটা আরো একটু চমৎকার করতে কবিতার বইটা পাঠ করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।”

বইটা হাতে নিয়ে রাজার ভঙ্গিতে মাতভেই বলল,

“অনুরোধ রক্ষা করা হলো বালিকে।”

তারপর দুজনে হো হো করে হেসে ওঠে। ইসাবেলা মাতভেইর সামনের চেয়ারে গিয়ে বসে। একটুকরো প্যান কেক মুখে দিয়ে ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিতে দিতে বই থেকে কবিতার লাইন আওয়াতে লাগল মাতভেই। চকলেট রোল চিবুতে চিবুতে দুহাতের মাঝে গাল রেখে মুগ্ধ হয়ে শুনছে ইসাবেলা। ঠোঁটের হাসি দেখে কে বলবে এ কেবল নিজের মনকে ভুলিয়ে রাখার ছল।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৯
Writer তানিয়া শেখ

স্বামী যুদ্ধে শহিদ হয়েছে, একমাত্র পুত্র যুদ্ধাহত হয়ে ঘরে বসে আছে। মাদাম আদলৌনার সংসার বড়ো কষ্টে চলত একসময়। অর্থাভাবে রাঁধুনি হিসেবে কাজ নিলেন মেয়রের বাড়িতে। আগে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি সেখানে থাকতে হতো। এখন মাদামের শরীর ভালো যাচ্ছে না। মেয়র পত্নী ভালো মনের মানুষ। মাদাম আদলৌনার কর্মনিষ্ঠায় খুশি হয়েছে তিনি। মাস কয়েক হলো মাদামের স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে তিনবেলার জায়গায় দু’বেলা রান্না করতে বলেছেন। মাসের বেতন আগের মতোই রেখেছেন অবশ্য। মেয়র বাড়িতে দুবেলা রান্না করে কিছু অর্থ জমিয়ে পাঁচটা ভেড়ি কিনেছিলেন। ভেড়িগুলো এখনো দুগ্ধ দেওয়ার মতো হয়নি। ওর গায়ের পশম খানিক বেড়েছে। আরো কিছুদিন গেলে পশম ছাড়িয়ে নেবেন। তারপর সেগুলো দিয়ে বানাবেন সোয়েটার, কম্বল। এসব কাজে মাদাম আদলৌনা বেশ দক্ষ। এই ভেড়িগুলো নিয়ে মাদাম আদলৌনার স্বপ্ন অনেক। ভবিষ্যতে এদের সংখ্যা বাড়লে ফার্মটা বড়ো করবেন। দুধ বিক্রির সাথে সাথে মাখন, পনিরও তৈরি করে বাজারজাত করার চিন্তা ভাবনা আছে৷ তখন এতেই তাঁর সংসার ভালোভাবেই চলে যাবে। ততদিনে সৃষ্টিকর্তার কৃপা হলে মাতভেইও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে দাঁড়াবে। ভালো একটা মেয়ে দেখে ছেলেকে বিয়ে করাবেন। ছেলের জন্য ভালো মেয়ের কথা ভাবতেই ইসাবেলার মুখটা ভেসে উঠল। মেয়েটাকে মাদামের ভারি ভালো লাগে। ওদের দুজনকে একসাথে বেশ মানায়। ইসাবেলাকে নিয়ে ছেলের মনের ভাবনা কী মাদামের খুব জানতে ইচ্ছে করে। আজ ভাবলেন ছেলেকে একটু বাজিয়ে দেখবেন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে প্রথমে বাড়ির পেছনের ফার্মটা ঘুরে এলেন। ভেড়ি ছাড়াও তাঁদের একটি খয়েরী রঙের ঘোড়া আছে। ঘোড়াটি মাদামের স্বামীর পছন্দের ছিল। স্বামীর স্মৃতি মনে করে ওর গাঁয়ে মাঝেমাঝে হাত বুলিয়ে দেন। মৃত মালিকের কথা স্মরণ করে না আহ্লাদে, ঘোড়াটা কেমন একটা আওয়াজ তোলে। মাথা ঘষে মাদামের গাঁয়ে। আজ ঘোড়াটা ভিন্ন আচরণ করল। কাছেই ঘেঁষতে দিলো না। ভেড়িগুলোও এককোণে ঘাড় গুঁজে বসে আছে। যেন রাজ্যে ক্লান্তি ওদের চোখে। সকালে দেওয়া ঘাসগুলোও নেতিয়ে আছে সামনে। মাদামের মনটা কেমন করল। বাড়ির ভেতর ফিরে এলেন। কিচেনে তৈজসপত্র নাড়াচাড়ার শব্দ হচ্ছে। মাদাম আদলৌনা এগিয়ে গেলেন। বিটরুট স্যুপের সুগন্ধ পাচ্ছেন তিনি৷

“মাদাম, কখন এলেন”

চুলার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা।

“এই এখনই। রান্না কি শেষ? ঘ্রাণ কিন্তু বেশ আসছে।”

রান্না ও আগে থেকেই জানত কিন্তু এদেশের রান্না আবার একটু ভিন্ন। মাদাম আদলৌনার হাত ধরে সেটাও ও শিখছে। রাঁধতে ওর ভালোই লাগে। চুলা থেকে একটুখানি সরে বলল,

“দেখুন না কেমন হয়েছে।”

মাদাম আদলৌনা পাতিলের দিকে ঝুঁকে ঘ্রান নিয়ে চামচে নেড়েচেড়ে একটু টেস্ট করলেন।

“সব ঠিক আছে। বেশ দ্রুত শেখো তুমি ইসাবেল।”

“এক্ষেত্রে ক্রেডিট কিন্তু আপনারই। আপনি শিক্ষক হিসেবে ভালো।”

মাদাম আদলৌনা মুচকি হাসলেন। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তাঁর হাসি। কিচেনের দরজার কাছে এসে থামলেন। ডান পাশের জানালা দিয়ে ফার্মটা দেখা যায়। ভেড়িগুলোর ক্লান্ত মুখ তাঁকে ভাবনায় ফেলে। এই তো তাঁর ভবিষ্যৎ। এগুলোর কিছু হলে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নটা ভেঙে যাবে।
ইসাবেলা স্যুপের পাত্র চুলা থেকে নামিয়ে রাখে। রাতের খাবার ওরা আরো দেরিতে খায়। তখন স্যুপটা গরম করে নেবে। মাদাম আদলৌনার গম্ভীর মুখ দেখে ইসাবেলা বলল,

“কী হয়েছে মাদাম আদলৌনা? আপনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।”

“কিছু না।” হাঁপ ছাড়লেন শব্দ করে। বসার ঘরে এসে বসলেন। সামনে ফায়ারপ্লেসটা জ্বলছে। বেশ আরাম লাগছে উষ্ণতায়।

“মাতভেই কী করছে?”

ইসাবেলা বসার ঘরে আসতেই জানতে চাইলেন মাদাম। ইসাবেলা বলল,

“বোধহয় পড়ছে।”

মাদাম আদলৌনা খেয়াল করলেন ইসাবেলার মুখ মলিন হয়ে উঠেছে। এমনটা হয় মাতভেই ওকে রাগালে।

“আবার কী করেছে ও?”

“কিছু না তো।”

মাদাম জানেন এই জবাবই দেবে মেয়েটা। অনুযোগ অভিযোগ করেই না ও। কিন্তু ছেলেকে তো তিনি চেনেন। সারাদিন ঘরে বসে বোর হলে মেয়েটাকে এটা ওটা বলে রাগিয়ে মজা নেয়। মিল হতেও ওদের সময় লাগে না। মাদাম তাই তেমন গুরুত্ব দিলেন না। ইসাবেলা বই হাতে বসল তাঁর সামনের সোফাতে। দুজনের মধ্যে আর তেমন কথাবার্তা হলো না। মাদামের মনটা বড়ো বিচলিত হয়ে আছে ভেড়িগুলোর পরিবর্তনে। একটু পর উঠে নিজের রুমের দিকে গেলেন।

ইসাবেলার মনটা আজ ভীষণ খারাপ। মাতভেই আজ ওকে ধমকে দিয়েছে। দোষ কিছুটা ওরও ছিল, কিন্তু ওমন দোষ তো ও রোজ করে। আজ তবে ধমক দিলো কেন? ধমক দিয়েছে সেটাও সহ্য হয়।কিন্তু দুপুর থেকে সন্ধ্যা হয়ে এলো মাতভেই একবারো ডাকল না। অভিমানে ওর কান্না পাচ্ছে। মাদাম তখন মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করাতে ও প্রায় কেঁদেই ফেলত। সেটা চাপা দিতে বইটা খুলে বসেছে৷ বই খুললে কী হবে? একটা বাক্য যদি মাথায় ঢুকছে! সব গুলিতে যাচ্ছে। মনোযোগই দিতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে বইটা পাশে বন্ধ করে রাখল। অনেক হয়েছে। মাতভেই কথা না বললে ওর বইয়েই যাবে। ইসাবেলা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। মাতভেইর রুমের পরের রুমটা ওর। মাতভেইর দরজার সামনে এসে থেমে যায়। সারাদিন দরজাটা বন্ধ। একবারের জন্যও খোলেনি। এমনটা আগে হয়নি। এক একা মাতভেই ঘরে বসে থাকেনি এতক্ষণ। আজ কী হলো ওর? চিন্তা হচ্ছে ইসাবেলার। ও আর অভিমান করে থাকতে পারল না। ধীর পায়ে এগিয়ে দরজার লকে হাত দিলো। নিঃশব্দে খোলার চেষ্টা করল ওটা। দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দেয়। বিছানা শূন্য। চোখ বুলাল ঘরের ভেতর। খাটের একপাশে ছড়িয়ে আছে কাগজ। হঠাৎ ওর কানে ফুঁপানোর শব্দ এলো। খাটের মাথার দিকের সংকীর্ণ জায়গাটাতে একটা মাথা দেখা গেল। মাতভেই কাঁদছে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ইসাবেলা। রুমটাতে আবছা আঁধার। খোলা দরজা দিয়ে কড়িডোরের একফালি আলো ঢুকলো মাতভেইর রুমে। মাতভেই চমকে তাকায় পেছনে। ইসাবেলার উদ্বিগ্ন মুখে খানিক্ষণ সিক্ত চোখে চেয়ে রইল। আস্তে আস্তে ওর মুখটাতে অপরাধবোধ জেগে ওঠে। মুখ ঘুরিয়ে বসল আগের মতো। ইসাবেলা এগিয়ে যাবে তখনই চোখ পড়ল মেঝেতে পড়ে থাকা কাগজের ওপর। কয়েকটার ওপর কড়িডোরের স্পষ্ট আলো পড়েছে। একটা চিত্র ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ইসাবেলা জানত মাতভেই ভালো আঁকে। ইসাবেলার কয়েকটা ছবি ও এঁকে দিয়েছে। একদম জীবন্ত ওর হাতের ছবিগুলো। এই যে মেঝেতে পড়ে থাকা মানবীর চিত্র, এও কিন্তু জীবন্ত লাগল। কতদিন বাদে মুখটা আবার দেখল ইসাবেলা। কাঁপা হাতে একটা চিত্র তুলে নিলো। আশ্চর্যে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো,

“তাতিয়ানা!”

ওর মাথায় যেন কিছুই ঢুকলো না। নিজের পরিবারের কথা মাতভেইকে বলেছে। তাতিয়ানার কথাও বলেছে তবে তেমন করে না। বলেছিল, তাতিয়ানা নামে ওর একটা বড়ো বোন আছে। বোনের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। নাম তাশা। তাশাকে ও খুব ভালোবাসে। প্রচন্ড মিস করে। ব্যস! এই এতটুকু। দৈহিক কোনো বর্ণনা দেয়নি। না দেখে এমন নিখুঁত ছবি কেউ আঁকতে পারে? আর তাতিয়ানারই কেন? হঠাৎ ওর মাথাটা ঘুরে উঠল। মাতভেই ওকে বলেছিল ও একটা মেয়েকে ভালোবাসে। মেয়েটার বাড়িও রিগাতে। বন্ধুদের সাথে একটা বিশেষ প্রয়োজনে একবার রিগা যেতে হয়েছিল। ক্লাবে ও তেমন যায় না। বন্ধুরা জোর করাতে গিয়েছিল সেখানের একটি ক্লাবে। সেখানেই মেয়েটার সাথে পরিচয়। প্রথমবার দৃষ্টি বিনিময়ে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। মাতভেইর ক্ষেত্রে সেটা অবশ্য লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। সামান্য কথাবার্তা হয়। দুজনে ড্রিংক করেছিল। দৈহিক আকর্ষণকে ওরা কেউ এড়িয়ে যেতে পারেনি। রাতটা একই বিছানায় কাটে। সকালে ঘুম ভাঙলে মাতভেই মেয়েটাকে আর পায়নি। এরপরের আবারো দেখা হয়। সেদিন মেয়েটি নেশায় বুঁদ থাকলেও মাতভেই পুরোপুরি চেতনায় ছিল। মাতভেই চেয়েছিল কথা বলতে। কিন্তু কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না মেয়েটি। আগের রাতের মতোই সেদিনও একই বিছানায় কাটল। কেবল দেহের টান ছিল না সেদিন মাতভেইর। ভালোবেসে ছুঁয়েছিল মেয়েটিকে। ভালো লেগেছিল মেয়েটিকে ওর৷ ভেবেছিল সকালে ডেটের প্রস্তাব দেবে। কিন্তু আগের মতোই সকালে মেয়েটি ওর জেগে ওঠার আগেই চলে যায়। এরপর আর তাকে দেখতে পায়নি ওই ক্লাবে। পিতার মৃত্যুর খবরে রিগা থেকে দ্রুত ফিরে আসতে হয়েছিল। তারপর যুদ্ধে যেতে হলো। বছর কেটে গেলেও মেয়েটির স্মৃতি আজও মাতভেইর মন থেকে যায়নি। ওই স্মৃতি ভালো লাগা থেকে ভালোবাসার সৃষ্টি করেছে। ইসাবেলা জানত মেয়েটির প্রতি মাতভেইর ভালোবাসার গভীরতা, কিন্তু সেই মেয়েটি যে ওর আপন সহোদরা তা ও কল্পনাও করেনি। মাতভেই মাথা হেঁট করে বসে আছে। ইসাবেলা সামনে গিয়ে বসল। চিত্রটা এগিয়ে ধরতে মাতভেই হাত বাড়িয়ে নেয়। ওর চোখ থেকে দুফোঁটা জল পড়ল তাতিয়ানার ছবির ওপর।

“সকালে বালিশের পাশে যেই কাগজ ধরার কারণে তোমাকে ধমকেছি তা এই ছিল, বেল। এই মেয়েটির ছবি। আ’ম সরি, বেল। তোমার সাথে ওমন ব্যবহার করা আমার উচিত হয়নি।”

“এই মেয়েই কি সে? যার কথা বলেছিলে?”

“হ্যাঁ।”

“ওর ছবি দেখাতে চাওনি কেন?”

“জানি না। বোধহয় একপাক্ষিক ভালোবাসা বলেই কাওকে ওকে দেখাতে চাইনি।”

“একপাক্ষিক? তুমি ভাবো ও তোমাকে ভালোবাসে না?”

মাতভেই সে কথার জবাব দিলো না। এই প্রশ্নের জবাব ওর কাছে নেই। ছবিটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। ইসাবেলা মাতভেইকে দেখছে।

“মাতভেই?”

“হুঁ?”

“আমার দিকে একটু তাকাবে?”

ভুরু কুঁচকে তাকায় মাতভেই। ইসাবেলা ওর মুখ, চোখ ভালো করে দেখে বিস্ময়ে বলল,

“আমি আগে কেন খেয়াল করিনি?”

“কী?” মাতভেই প্রশ্ন করে। ইসাবেলা ওর চোখের দিকে চেয়ে বলল,

“তোমার চোখ। ওরও চোখের মণি তোমারটার মতো সবুজ। তারপর মুখের আদলেও তো কত মিল। হা ঈশ্বর!”

ইসাবেলা হাতে মুখ ঢাকল। মাতভেই ওর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত মুখে চেয়ে আছে।

“তুমি কী বলছ বলো তো? কার চোখের মণি আমার মতো? কার সাথে মিল?”

ইসাবেলার চোখ ভরে উঠল জলে। ঠোঁটে হাসি। আনন্দে হুট করে মাতভেইর গলা জড়িয়ে ধরে,

“বেল?”

“আমি আজ অনেক খুশি মাতভেই, অনেক।”

ইসাবেলার মুখ তুলে গলা থেকে মাতভেইর কাঁধে হাত রাখতে ব্যথায় হিস হিস করে উঠল মাতভেই।

“কী হয়েছে?” কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে প্রশ্ন করে ইসাবেলা। মাতভেই মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়।

“কিছু না।”

“না, কিছু তো হয়েছে। দেখাও কাঁধ।”

মাতভেই বাধা দেওয়ার আগে শার্টের গলাটা সরিয়ে ফেলে ইসাবেলা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুটো গর্ত হয়ে আছে কাঁধে। রক্ত জমে গেছে। এই গর্ত ইসাবেলার পরিচিত। রক্তশূন্য মুখে তাকাল মাতভেইর দিকে।

“এ-এ গর্ত __?”

মাতভেই শার্টের কলার টেনে ঢোক গিলল।

“এ কিছু না। একটুখানি ব্যথা পেয়েছিলাম।”

“ব্যথা! না, তুমি মিথ্যা বলছ।”

রেগে ওঠে মাতভেই।

“মিথ্যা! কেন মিথ্যা বলব আমি? অনেক বকবক হয়েছে। এখন যাও তো। একা থাকতে দাও একটু।”

“মাতভেই শোনো, আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো। আমরা তো বন্ধু তাই না? বলো না কীভাবে হলো এই ক্ষত? কেউ রাতে আসে তোমার ঘরে? এই যেমন কালো__”

ইসাবেলার কথা শেষ করতে দেয় না মাতভেই। বিরক্ত ঝেড়ে বলে,

“উফ! এত বকবক করতে পারো? আ-আর কে আসবে রাতে আমার ঘরে? কী সব আবোল তাবোল বকছ। যাও তো এখন আমার চোখের সামনে থেকে। যাও, প্লিজ।”

মাতভেইর ধমকে উঠে দাঁড়ায় ইসাবেলা। কিন্তু যায় না।

“মাতভেই প্লিজ বলো না।”

“ইসাবেলা, আমার রুম থেকে বেরোও বলছি। যাও।”

মাতভেই চেঁচিয়ে ওঠে একপ্রকার। বাধ্য হয় ইসাবেলা ওর রুম থেকে বেরিয়ে যেতে। ও বেরিয়ে যেতে দরজায় চেয়ে মাতভেই বলল,

“আমি বড়ো পাপ করে ফেলেছি, বেল। এই পাপ গোপন করতে তোমাকে ধমকেছি। ক্ষমা করো আমাকে। আমার ভালোবাসাকে আমি অপমান করেছি, বেল। তোমাকে আমি বলতে চাই, কিন্তু কী করে বলব? কী করে বলব গত রাতে ওই পিশাচিনীরা আমাকে বশ করে কী কী করেছে। আমি নিরুপায় ছিলাম, বেল। বড্ড নিরুপায় ছিলাম। আমার মতো দুর্বল, পাপীর মরে যাওয়া ভালো। মরণ হোক আমার।”

তাতিয়ানার ছবিটাতে হাত বুলিয়ে বলল,

“তোমার সাথে বুঝি আর দেখা হবে না প্রিয়তমা। মৃত্যুর আগে যদি একবার দেখতে পেতাম তোমায়? একবার বুকে জড়িয়ে নিতে পারতাম! মরেও বুঝি শান্তি হতো। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়।”

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪০
Writer তানিয়া শেখ

ইসাবেলা নিজের রুমে ফিরে এলো। ওর ভয়, অস্থিরতা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। এই শীতেও ঘামছে। মাতভেইর রুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওর শেষ কথাগুলো শুনেছে। পিশাচিনী! হ্যাঁ, তাই তো বলল ও। মাতভেইর বলা পিশাচিনীদের সাথে কি নিকোলাসের কোনো যোগসূত্র আছে? ইসাবেলার সন্দেহের তীর নিকোলাসের দিকে ছোটে। সেদিন রাতে নিকোলাস ওর রুমে এসেছিল। আর তারপরেই এসব ঘটনা! কাকতালীয় বলে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারে না। ওর মন আর মস্তিষ্কে বিবাদ শুরু হয়। মন বলে ইসাবেলাকে এরা সাহায্য করেছে জানার পর নিকোলাস মাতভেইর সাথে এমনটা করবে না। মস্তিষ্ক বলছে, পিশাচ ও। ওর মধ্যে মানবিকতা নেই। ও সব পারে। রক্তের নেশার কাছে সব তুচ্ছ। মস্তিষ্কের এই যুক্তি উপেক্ষা করতে পারে না ইসাবেলা, আবার মানতেও চায় না। মন মস্তিষ্কের এই বিবাদ একপাশে সরিয়ে তাশা আর তাতিয়ানার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে লাগল। পিতার ছায়া ছাড়া তাশার ভবিষ্যৎ সহজ হবে না। পদে পদে মানুষের কথা শুনতে হবে। তাশার জন্মের পর তাতিয়ানার উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অনেকটা শৃঙ্খলতা এসেছে। মাতভেইর ভালোবাসা হয়তো ওকে পুরোপুরি বদলে দেবে। সুন্দর একটা সংসার হবে তাতিয়ানার। আন্না মেরিও, ওলেগসহ বাড়ির সকলে খুশি হবে তাতিয়ানাকে সংসারি দেখে। মাতভেই ফিরে পাবে প্রিয়তমাকে। বেচারা জানেও না ওর একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান আছে। প্রিয়তমার গর্ভে নিজের সন্তান হয়েছে জানলে ও বুঝি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে। আর তাশা, সে বাবাকে পেলে কতোই না খুশি হবে। মাদাম আদলৌনা একমাত্র পুত্রের মুখ চেয়ে বেঁচে আছেন। ছেলেকে সুস্থ হতে দেখার স্বপ্নে প্রহর গুনছেন। মাতভেইর যদি কিছু হয়ে যায় তবে এতগুলো মানুষের জীবনের খুশিগুলো মুছে যাবে। তাশা কখনো বাবাকে পাবে না। মাতভেই জানবে না মেয়ের কথা। তাতিয়ানার জীবন স্বাভাবিক হবে না। মায়ের উচ্ছৃঙ্খল জীবনের প্রভাব পড়বে তাশার ওপর।

“আমার তাশার ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেবো না আমি। মাতভেইর কিছু হবে না। কিছু হতে দেবোই না আমি।”

“কী করবে তবে?” পরিচিত গলা শুনে পাশ ফিরে তাকায়। আগাথা বসে আছেন।

“আপনি? কেন এসেছেন আবার? বলেছি তো আপনার কথামতো কিছু করব না।”

ইসাবেলা রাগ মুখে উঠে দাঁড়ায়। আগাথা হতাশ গলায় বলেন,

“আমি জানি।”

“জানেন তবে কেন এসেছেন? নতুন করে মিথ্যা বলতে? আমার ইমোশন নিয়ে খেলা করতে?”

ইসাবেলার রাগ গলে অশ্রুজল জমে চোখের কার্নিশে। আগাথা বলেন,

“তুমি ভুল বুঝছ আমায় ইসাবেলা। আমি তো কেবল তোমাকে সাহায্য করতে চেয়েছি এবং চাচ্ছি।”

তাচ্ছিল্যভরে হাসল ইসাবেলা।

“তাই! মিথ্যা বলা, আমার অনুভূতি নিয়ে খেলা করা বুঝি আপনার সাহায্য আগাথা?”

“আমি তোমায় মিথ্যা বলিনি__”

“আচ্ছা? বলেছিলেন বিকেলের পরে ছাড়া আপনি পৃথিবীতে আসেন না। অথচ, সেদিন দুপুরের আগে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলাম খেয়াল থাকবে না সময়ের হিসাব। তারপর ম্যাক্সের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে এড়িয়ে গেলেন। এসবের অর্থ কী দাঁড়ায় বলুন আগাথা? আপনি জানেন ভ্যালেরি আমার হৃদয়ে কতখানি জুড়ে আছে। আর তাই ওর মৃত্যুকে হাতিয়ার করে আমাকে দিয়ে নিজের কাজগুলো করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, ঠিক না?”

আগাথার নিরুত্তর মুখে চেয়ে কাষ্ঠ হাসল ইসাবেলা।

“আমার মন সরল আগাথা, কিন্তু বোকা নই আমি।দেরিতে বুঝলেও অনেক কিছুই বুঝি। ভ্যালেরি মৃত্যু সামনে দেখেও আমাকে পালাতে বলেছিল। ও বলেনি প্রতিশোধ নিতে৷ কারণ আমার ভ্যালেরি আমাকে কোনোদিন বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চায়নি। আপনি নিজের স্বার্থে আমাকে বিপদের দিকে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন। আমার বাঁচা মরাতে আপনার কিছু এসে যায় না, তাই না আগাথা?”

“আমার সব কথায় এখন মিথ্যা মনে হবে। তাই জবাব আজ আর দেবো না আমি। একদিন আমাকে বুঝবে। এই নিরুত্তর থাকার কারণ সেদিন তুমি উপলব্ধি করবে ইসাবেলা। আজ শুধু মাতভেইকে বাঁচানোর কথা ভাবো।”

ইসাবেলা সরাসরি তাকাল এবার আগাথার দিকে।

“আপনি মাতভেইর ব্যাপারটা জানেন?”

“হ্যাঁ, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই এই ব্যাপারে। যদি তুমি রাজি হও।”

ইসাবেলা এই মুহূর্তে আর কোনো পথ দেখে না।

“কীভাবে বাঁচাব মাতভেইকে? ও যে আমাকে কিছুই বলছে না।” হতাশ মুখে বসল আগাথার পাশে।

“ওর বলার প্রয়োজন নেই। আজ রাতে আমি তোমাকে সব দেখাব। তৈরি থেকো।”

মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। আগাথা অদৃশ্য হবে তখনই বলল,

“বিনিময়ে কী চান?”

আগাথা বললেন,

“আপাতত বিনিময়ের কথা না হয় থাক। মাতভেইকে বাঁচাতে হবে আমাদের। ওটাই মাথায় রেখো। আসি।”

আগাথা চলে যেতে মাদাম আদলৌনা ডিনারের জন্য ডাকলেন। ইসাবেলা নিচে গেল। মাতভেইকে ডাকতে সে জানায় আজ নিজের রুমে খাবে। মাদাম আদলৌনা বেশ বুঝতে পারছেন ইসাবেলা এবং মাতভেইর মধ্যে গুরুতর কিছু একটা হয়েছে। নয়তো মাতভেই একা একা ডিনার করতে চাইবে কেন? ইসাবেলাও প্রতিবাদ করছে না। ইসাবেলাকে আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন ওদের মধ্যে কিছু হয়েছে কি না। আগের মতোই বলল, কিছু হয়নি। ইসাবেলার গম্ভীরতা দেখে আর বেশি প্রশ্ন করলেন না। খাবার আজ নিজেই নিয়ে গেলেন ছেলের রুমে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে চোখ মুদে ছিল মাতভেই। মাকে দেখে স্বভাবসুলভ মৃদু হাসল। মায়ের সাথে অন্যদিনের মতো স্বাভাবিক কথাবার্তা বলল। তবুও কোথাও একটা খটকা লাগছে মাদামের। মাতভেই স্যুপ খাচ্ছে। মাদাম ওর অসাড় পা’টাতে হাত বুলিয়ে বললেন,

“ইসাবেলাকে কিছু বলেছ তুমি? মেয়েটা মুখ ভার করে আছে।”

ঠোঁটের কাছে নেওয়া স্যুপভর্তি চামচটা থেমে গেল। মায়ের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা এড়াতে তাড়াতাড়ি আবার মুখে দিলো চামচ। শূন্য চামচ বাটিতে নামিয়ে হেসে বলল,

“তখন একটু মজা করেছিলাম তাতেই ওমন রেগে আছে। একটু পরে ডেকে মানিয়ে নেবো। চিন্তা করো না।”

মাদাম মাথা দোলালেন। চামচে স্যুপ নাড়াচাড়া করতে করতে একটুখানি ভেবে বলল,

“ও কী কিছু তোমাকে বলেছে মা?”

“কোন ব্যাপারে?”

মাতভেই মায়ের ভুরু কুঁচকে যাওয়া মুখটা দেখে জবাবটা বদলে ফেলল।

“ওর বাড়িতে চিঠি পাঠানোর ব্যাপারে?”

“চিঠি পাঠাবে না কি?”

“ভাবছিলাম আরকি।”

“ওহ! কিন্তু তা সহজ হবে না। জানোই তো লিথুনিয়া এখন জার্মানদের কব্জায়। ও দেশে চিঠি চালাচালি করছ টের পেলে ঝামেলা হবে। চিঠি পাঠানোও তো সহজ কাজ নয়। কে যাবে পোষ্ট অফিস?”

“আমিও সেকথা ভাবছিলাম। তবুও একটা চেষ্টা করে দেখব। এতদিন আপনজন ছেড়ে মেয়েটার কষ্ট হচ্ছে। কোনোভাবে রিগাতে পৌঁছে দিতে পারলেও ম,,মনে শান্তি পেতাম।”

“যাই করো সাবধানে। নতুন কোনো বিপদ আমি আর চাচ্ছি না বাবা।”

মাতভেই শেষ চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে মাথা নাড়ায় হ্যাঁ সূচক। মাদাম আদলৌনা ট্রে হাতে উঠে দাঁড়ান। তাঁর যাওয়ার পথে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ ভিজে এলো মাতভেইর। ঠোঁট চেপে কেঁদেই দিলো একসময়। মা বড়ো একা হয়ে যাবে ভাবতেই কান্নার জল বাড়ল আরো।

তখন প্রায় মধ্য রাত। আগাথাকে অনুসরণ করে মাতভেইর রুমের দিকে চলল ইসাবেলা। নিঃশব্দে ভেজানো দরজা আরেকটু ফাঁক করে। উঁকি দিলো দুজন রুমের ভেতর। করিডোরের আলো নিভানো। মাতভেইর রুম অন্ধকার। জানালার পর্দা টানা। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ইসাবেলা। আগাথা অদৃশ্য হয়ে যায়। হঠাৎ জানালার পর্দা উড়ে সরে গেল একপাশে। পূর্ণ চাঁদ আকাশে। সেই আলোতে মাতভেইর রুমটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার ইসাবেলার সামনে৷ দৃষ্টি থামল মাতভেইর বিছানার ওপর। নগ্ন দুটো নারীমূর্তি মাতভেইর ওপরে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ওরা। ইসাবেলা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে মাতভেইর চাপা গোঙানির শব্দ। নারীমূর্তি দুটির মুখ মাতভেইর গলায় ডুবে আছে। কিছুক্ষণ যেন শ্বাস ফেলতে ভুলে গেল ইসাবেলা। পিশাচিনীদের একজন মিহি হাসির শব্দ তুলে সরে এলো মাতভেইর গলার কাছ থেকে। ওদের মতো নির্বস্ত্র মাতভেই। চোখ নামিয়ে নিলো ইসাবেলা। এখন ও বুঝেছে কেন তখন মাতভেই সত্যি বলতে চায়নি। এই লজ্জা ঢাকতে এড়িয়ে গেছে সকল প্রশ্ন। আবার তাকাল সামনে। সরে আসা ডাইনিটা মাতভেইর কোলে বসেছে। কামনার সুখে ওর মাথাটা খানিক ঝুঁকে গেছে পেছনে। চাঁদের আলোয় ওকে চিনতে একটুও সময় লাগল না ইসাবেলার। নামটা মনে করার চেষ্টা করল।

“গ্যাব্রিয়েল্লা!” ক্রোধে ব্রম্মতালু জ্বলে ওঠে। ক্ষিপ্র গতিতে পা বাড়াতে কেউ টেনে ধরে। চেঁচিয়ে উঠতে গেলে মুখ চেপে ধরে পরিচিত হাতটা।

“বোকামি করো না। খালি হাতে লড়াইয়ে পেরে উঠবে না ওদের সাথে। ছিঁড়ে খাবে মুহূর্তে তোমাকে।”

আগাথার কথাতে নিজের ক্রোধের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনে ইসাবেলা। ফিরে তাকায় আরেকবার। দ্বিতীয় ডাইনিটা মাতভেইর ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে আছে। ওর মুখ ঠিক দেখতে পাচ্ছে না ইসাবেলা।

“ইভারলি।” আগাথা বললেন। ইসাবেলা দুহাতের মুষ্টি শক্ত করল। ওর সাধ্য থাকলে এক্ষুণি এই দুটোকে ও শেষ করে ফেলে। আগাথা টেনে নিয়ে এলো পাশের রুমে।

“নিকোলাস এর সাথে জড়িত?” রুমে ঢুকেই প্রশ্ন করল ইসাবেলা। মনে মনে একটু হাসলেন আগাথা। মুখটা স্বাভাবিক রেখে বললেন,

“হতে পারে আবার নাও পারে।”

“এতকিছু জানেন আর এটাতে দোনোমোনো?”

“নিকোলাসের আশেপাশে যাই না আমি।”

“কেন?”

আগাথা জবাব দিলেন না দেখে চাপা রাগটা বেরিয়ে এলো ইসাবেলার।

“এ কথারও জবাব দেবেন না? বাহ! চমৎকার। শুনে রাখুন, মাতভেইর সাথে যা হচ্ছে তাতে আপনার ছেলের সামান্যও যদি হাত থাকে ওকে আমি শেষ করে ফেলব।”

আগাথা জানালার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন৷ তাঁর ঠোঁটে ঝিলিক দিলো এক চিলতে হাসি। পেছনে দাঁড়িয়ে অধৈর্য হয়ে উঠল ইসাবেলা,

“বলুন কী করে ওদের শেষ করব আমি।”

“আমি ভেবেছি তুমি মাতভেইকে বাঁচানোর উপায় জানতে চাইবে।”

ইসাবেলা কপাল কুঁচকে বলে,

“কথা তো একই।”

“তুমি বললে তাই।”

“কী বলতে চাইছেন?”

“গ্যাব্রিয়েল্লাকে এই রূপে দেখে অবাক হয়েছে, না?”

“না, অবাক কেন হব? ও যে আপনার ছেলের রক্ষিতা ছিল তা তো আমি জানতামই৷ এখন আপনার ছেলের ভালোবাসার পিশাচী হয়েছে এতে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। আগে ইভারলি ছিল এখন গ্যাব্রিয়েল্লা যোগ হয়েছে। কদিন বাদে আরো মেয়ে হবে। আপনার ছেলের মতো পিশাচের কাছে এই তো আশা করা যায়। মোটেও অবাক হইনি আমি।”

ইসাবেলা বিছানার একপাশে গিয়ে বসল। দুহাতে শক্ত করে ধরল বিছানার কোণা। পা দুটো অস্থিরভাবে ফ্লোরে আঘাত করছে। আগাথা এসে বসলেন ওর পাশে। কাঁধে হাত রাখতে ইসাবেলা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল,

“মাতভেইকে আমি মরতে দিতে পারব না। আমার বোন, বোনের মেয়ের ভবিষ্যৎ জড়িত ওর সাথে। ওকে বাঁচানোর উপায় বলুন। আমি আজ ওয়াদা করছি এর বিনিময়ে যা বলবেন তাই করব।”

আগাথা হাসলেন,

“তুমি সত্যি দেখি আমাকে স্বার্থপর ভেবে নিলে ইসাবেলা। একদিন প্রমাণ করে দেবো যতখানি স্বার্থপর আমায় তুমি ভাবো ততখানি আমি নই। তোমার বাঁচা এবং মরা দুটোতেই আমার এসে যায়।”

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে