#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
১০.
রূপালি সুতায় সাজানো আকাশটা আজ কেমন বিষন্ন হয়ে আছে। কোথাও তার জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা উজ্জ্বল দ্যুতি নেই। চাঁদ মামা অবসর নিয়েছে আজ, সাথে তার পাশে জ্বলতে থাকা তারারাও। আকাশ পানে চাইলে শূন্য, অন্ধকার ব্যাতিত কিছুই নজরে আসে না।
অন্তি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে ছোট চুমুক বসিয়ে অদূর আকাশ পানে চায়। উদাস চিত্তে একাধারে চেয়ে রয়। নিজেকে পাগল মনে হয়। চোখ ছলছল হয়। কর্ণিশ বেয়ে নিরবে ঝড়ে যায় নোনতা পানির স্রোত। তার চাওয়ার মাঝে কি কমতি ছিলো? এমনটা কেন হলো? দিহান মানুষটাকে সে ভালোবাসে। সত্যিই ভালোবাসে। কেন মানুষটা বুঝলো না?
সন্ধ্যা থেকে তন্নির ফোনে নুহাশের কল আসছে। তন্নি ভুলেও তা রিসিভ করছে না। যা হওয়ার পরে হবে, কিন্তু সে কিছুতেই কল রিসিভ করবে না বলে শপথ করেছে। ফোন সামনে রেখে পা গুছিয়ে বসছ আছে সে। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ থাকলেও বুক ভরা সাহস নিয়ে এরূপ কাজ করছে সে। তখনি টুং করে নটিফিকেশন আসলো। ম্যাসেজ এসেছে।
‘দরজা খুলো বেবি!’
ম্যাসেজটা দেখে তন্নির চোখ কপালে। দরজা খুলো মানে? এই লোক কোথায়?
তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো। তন্নির মা তার রুমে এখন সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত। বড় আপু রুমের দরজা বন্ধ করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে প্রেম আলাপে ব্যস্ত। এখন বোমা হামলা করলেও সে দরজা খুলবে না। বাদ বাকি রইল কাজের মেয়েটা। সে ও মায়ের রুমে সিরিয়ালের ভিলেনদের গুষ্টির ষষ্ঠী করতে বসে পড়েছেন।
আবারো রিং হলো কলিং বেল। ওপাশ থেকে তন্নির মায়ের গলা এলো,
‘কে এলো দেখ তো।’
ফাঁকা ঢোক গিলে রুম থেকে বের হলো। ইতিমধ্যে আরো দুবার বেল বেজেছে। তন্নির এখন কান্না পাচ্ছে। কলটা রিসিভ করলেই হতো। এখন আর কল দিচ্ছে না খারাপ লোকটা। এক বুক সাহস নিয়ে দরজা খুলতেই দেখা গেল বাহিরে ডেলিভারি বয় দাঁড়িয়ে। তন্নি কপাল কুঁচকাতেই এক গাল হেসে বললো,
‘আপনার পার্সেল ছিল ম্যাম।’
তন্নি অবাক হয়ে বললো,
‘না তো!’
‘জ্বি ছিলো ম্যাম।’
‘আরে আজিব তো! আমি কিছু অর্ডারই করলাম না পার্সেল আসবে কোথা থেকে?’
আবারো ম্যাসেজ এলো।
‘পার্সেলটা নিয়ে নাও বেবি।’
তন্নি থামলো। এভাবে বেবি বেবি ডেকে লোকটা কি প্রমাণ করতে চায়? অদ্ভূত!
কথা না বাড়িয়ে তন্নি পার্সেল নিয়ে ধুম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। ধুম শব্দে ডেলিভারির ছেলেটা কিছুটা লাফিয়ে উঠলো। এভাবে দরজা বন্ধ করার কি আছে? পরক্ষণে মেয়েটার মানসিক সমস্যা আছে ভেবে সে প্রস্থান নিলো।
তন্নি পার্সেলটা খুললো না। কাবার্ডের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলো। ফোন থেকে সিম খুলে রাখলো। এখন থেকে সে খুব সাবধানে তার পা ফেলবে। ভুলেও ঐ ভয়ংকর লোকের সামনে সে যাবে না।
_____________
রেজওয়ান মির্জা আজ বাড়িতে। রেহান ও ছুটিতে ফিরেছে। তার পোস্টিং রাজশাহীতে। রেহেনা আজ নিজ হাতে সকালের সকল নাস্তা তৈরি করেছেন। কতদিন বাদে পরিবারের সবাই একত্রে খেতে বসবে!
রেহানের নামটা রেহেনার সাথে মিলিয়েই রাখা হয়েছিলো। রেজওয়ান মির্জা যখন রেহেনাকে বিয়ে করে আনলো তখন রেহেনার বয়স মাত্র ১৭। বিয়েরদিন তার দাদিমা তার কানে কানে বলেথিল, ‘বুবু তোমাগো নামের প্রত্তোম অক্কোর মিল্লা গেছে। দেখবা জামাই তোমারে মেলা ভালোবাসবে। চোখ্খে হারাইবে।’
কথাটা অবশ্য ভুল বলেনি। রেজওয়ান মির্জা তাকে ভালোবাসাথ চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। যখন রেহান হলো তখন তাদের নামের ‘র’ শব্দ দিয়েই নাম রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু পৃথক হলো দিহানের বেলায়। এজন্যই বোধহয় ছেলেটা সবার থেকে ভিন্ন ধাঁচের হয়েছে।
.
.
সকালের নাস্তায় আজ অনেক পদ করা হয়েছে। সবার আগে ডায়নিং এ এসে উপস্থিত হলো রেহান। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
‘দিহান কোথায় মা? আমি এসেছি ও জানে না?’
রেহেনার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। প্লেটে লুচি তুলে দিতে দিতে বললো,
‘খুব রাত করে ফিরেছে কাল। কথা হয়নি আমার সাথে। এখনো জানে না হয়তো।’
‘আমি যেয়ে ডাকবো?’
‘দরকার নেই। নিজে থেকেই আসবেনে। তুই বোস।’
রেহান আশপাশে তাকিয়ে ফের বলে,
‘বাবা কোথায়?’
‘বাসায় আছে। এখনি চলে আসবে।’
তখনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো দিহান। মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। চোখ মুখ ফুলে আছে। ভোর রাত থৈকে সকাল অবদি বৃষ্টি হয়েছে। ওয়াক আউটে যাওয়া হয়নি তাই। পরণের সাদা ফুল হাতার টিশার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে নেমে এলো সে। রেহানের পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
‘হঠাৎ আসলে যে? কোনো অঘটন ঘটিয়েছি বলে তো মনে করতে পারছি না!’
রেহান মুচকি হাসলো। ভাইয়ের প্লেটে নিজ হাতে লুচি তুলে দিতে দিতে বললো,
‘অনেকদিন অঘটন ঘটাচ্ছনা তো, তাই দেখতে এলাম বেঁচে আছো কি না।’
‘তোমার নীতিবান বাবার কাছে শুনলেই পারতে! তার তো আবার চর রয়েছে আমার খোঁজ খবর রাখার জন্য। ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট জানায়!’
তখন ডায়নিং এ উপস্থিত হলেন রেজওয়ান মির্জা। দিহানের কথায় মুখ কুঁচকে বললেন,
‘এতকিছু তুমি জানো কিভাবে? তুমিও আমার পেছনে গুপ্তচর লাগিয়েছ নাকি?’
দিহান খুব আয়েশে লুচির টুকরা গালে তুলে নেয়। রেহানা ছেলের প্লেটে কষা মাংস বেড়ে দেয়। রেহান আর রেজওয়ান দুজন উত্তরের আশায় দিহানের দিকে তাকিয়ে। দিহান এক পলক সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। রেহান সন্দিহান চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। তার পুলিশ মন কেবল এই মানুষটাকেই বুঝতে পারে না।
দিহান খাওয়া থামিয়ে সরাসরি তার বাবার চোখে তাকালো। মুচকি হেসে বললো,
‘দুঃখিত! কিন্তু প্রতি মাসে পকেট থেকে বিশ ত্রিশ হাজার টাকা খসিয়ে গুপ্তচর রাখার মতো অর্থ আর ঘিলু কোনোটাই নেই আমার। আপনার চর মজনু মিয়ার পকেটে পাঁচশ টাকা গুঁজে দিলেই সব তথ্য আপনাআপনি বেরিয়ে আসে।’
এ কথায় রেজওয়ান মির্জার হুস উড়ে গেলেও রেহান ফিক করে হেঁসে ফেলল। রেহানাও মুখ টিপে হাসছে। স্বামীর ভয়ে জোরে হাসতে পারলো না। রেজওয়ান গম্ভীর মুখ করে বললো,
‘তুমি আমার চরকে ঘুষ দিয়ে আমারই তথ্য নাও? এটা কেমন নীতি?’
‘আমি কেবল আপনার অপচয়কৃত টাকাকে কাজে লাগিয়েছি। সন্তান হিসেবে আপনার প্রতি একটা দায়িত্ব আছে না?’
রেজওয়ান মির্জা আর কোনো কথা বললেন না। কতবড় বজ্জাত ছেলে তিনি জন্ম দিয়েছেন ভাবতেই তার ঘাম ছুটে যাচ্ছে। এমন স্বৈরাচারী ছেলে দিয়ে সে কিভাবে কি করবে? তবে আজই মজনুকে পেছনে লাথি মেরে সে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবে। পাঁচশত টাকার জন্য বেঈমানি! আর সে যে মাস শেষে হাজার খানেক টাকা দিচ্ছে!
____________
রাতভর বর্ষনের জন্য পিচডালা রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে পানি জমেছে। আকাশে রোদ নেই। ঝিমিয়ে পড়া বিকেলের ন্যায় শান্ত হয়ে আছে প্রকৃতি। তবে রাস্তায় মানুষের আনাগোনা আগের মতোই রয়েছে। অন্তি বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুটা সামনে অপেক্ষা করছে তন্নির জন্য। ওদের বাড়ির এ পথটায় তিনদিকে তিনটা রাস্তা চলে গেছে। যার সোজা পথ ধরে যেতে হয় কলেজে, বা পাশের রাস্তা দিয়ে তন্নিদের বাসা। অন্তি বর্তমানে এই তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে। ব্যস্ত নজরে আশপাশে তাকাচ্ছে। যদি মানুষটাকে এক নজর দেখতে পায়! এত দিনের ভালোবাসা এভাবে চট করে কি ভুলে যাওয়া যায়? কাউকে ভালোবাসা যতটা সহজ, ভুলে যাওয়া ঠিক ততটাই কঠিন। যা অন্তি হারে হারে টের পাচ্ছে।
‘মেয়ে? দাঁড়িয়ে কেন?’
অনাকাঙ্ক্ষিত কন্ঠে চমকে ওঠে কিশোরী বুকটা। মলিন মুখটা আরো মলিন হয়ে আসে। ফুলে ওঠা চোখ গুলোতে পানি জমতে শুরু করে। ঠোঁট কামড়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। পেছনে তাকায় না। এতক্ষণ যে মানুষটাকে দেখার জন্য অস্থির হয়েছিলো মন এখন তার সন্নিকটে গুটিয়ে আসতে চাইছে যেন।
‘কথা বলো না কেন অভদ্র!’
দিহানের ধমকে কেঁপে ওঠে কিশোরী শরীর। অভিমান দৃঢ় হয়। লোকটা কখনোই তার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। এতটাই কি অপছন্দের সে! অন্তি মুখ ফুটে বলতে চায়, ‘ আমি আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবো না। আপনি আর আমাকে ধমকাবেন না।’
কিন্তু বলা হয়না। কন্ঠনালিতে যেন জং ধরেছে। কথা বের হয়েও হচ্ছে না।
দিহানের রাগ হয়। এতটুকুন মেয়ের এত জেদ কিসের? সে নিজে এসে কথা বলছে আর এই মেয়ে কিনা অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে! এই মেয়ের জন্য যে সে দীর্ঘ বিশ মিনিট যাবত অপেক্ষা করছে তা কি ডাফারটা জানে? দিহান ধৈর্য্য হারায়। বড় করে শ্বাস ফেলে। রাগ দমন করে ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
‘লাস্টবার বলছি রূপ; পেছনে ঘুরো? কথা আছে। এটাই লাস্ট কিন্তু।’
অন্তির চোখ থেকে টুপটাপ করে পানি গড়ায়। দোটানায় পড়ে মন। কি বলতে চায় দিহান? জানার জন্য অস্থির হয় চিত্ত। কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্ক তাকে জানায়, দিহান কখনোই তার সাথে প্রেমের আলাপ করতে কথা বলে না। হয়তো ধমকায় নয়তো তার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য বলে। আজ ও হয়তো একারণেই এসেছে! রাগ হয় ওর। চোখ মুছে পিছু না ফিরেই কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে,
‘কিছু বলার দরকার নেই ভাইয়া। এতদিন আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি আর কখনোই সেটা করবো না। আমাকে আর কিছু বলার দরকার নেই। আপনি আসতে পারেন।’
দিহান শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে খানিক সময়। কথা বলার সময় অন্তির গলা কাঁপছিল। দিহান খুব বুঝেছে মেয়েটা কাঁদছে। চোখ বন্ধ করে ছোট করে শ্বাস ফেলে বললো,
‘বেশ!…’
এরপর সবটা নিরব। সময় গড়ায় মিনিট খানেক। অন্তি হাঁসফাঁস করে ওঠে। মানুষটাকি এখনো দাঁড়িয়ে আছে? অল্প করে ঘাড় বাঁকায়। নাহ কেউ নেই। দিহান নেই ওখানে। চলে গেছে। তার এতগুলো কথার পিঠে লোকটা ছোট একটা জবাব দিয়েই চলে গেলো! পাষাণ লোক। হু হু করে কেঁদে ওঠে মেয়েটা। তখনি তন্নি চলে আসে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে অন্তিকে কাঁদতে দেখে অস্হির হয়ে ওঠে। ব্যস্ত হাতে আঁকড়ে ধরে অন্তিকে। নরম গলায় শুধায়,
‘এভাবে কাঁদছিস কেন পাখি? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?….’
দূর থেকে দিহান সবটা দেখে। পকেট থেকে লাইটার বের করে সিগারেট ধরায়। শূন্য চোখে চেয়ে থাকে সামনে। পাশ থেকে নুহাশ মেজাজ খারাপ নিয়ে বলে,
‘কি বা*ল শুরু করছিস? ভালোভাবে একটু ভালোবাসা দিয়ে কথা বলে তো বোঝাতে পারতি?’
দিহান জবাব দেয়,
‘আমার মুখে ভালোবাসা নেই। মুখ দিয়ে ভালোবাসতে পারবো না।’
নুহাশের মন চাচ্ছে ঠাটায়ে দুইটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু তেমন হলে তার কানটাই আগে ফাটবে তাই সেই কাজ থেকে বিরত থাকলো। কিন্তু কোনোদিন সুযোগ হলে এই অপরচুনিটি সে কিছুতেই মিস করবে না।
চলবে……..