তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-২১+২২

0
619

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২১.
স্নিগ্ধ বাতাস, কালো চাদরে জড়ানো আকাশ আর পাশে প্রিয় পুরুষ! অন্তি চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করে। এই যে দিহান তার হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে আছে, সে ব্যথা পাচ্ছে, তবু ও নড়চড় নেই। ঐ শক্ত হাতের ছোঁয়ার মাঝেই ভালোবাসা খুঁজতে ব্যস্ত সে।
দিহান দূরত্ব ঘুচিয়ে আরো কিছুটা নিকটে টেনে নেয় অন্তিকে। অন্তির নাকে পুরুষালী গন্ধ ধাক্কা খায়। তড়িৎ চোখ মেলে চায় সে। চাঁদের অল্প আলোতে দিহানের মুখটা খুব ভালোভাবে দেখতে পায়। লোকটার চাহনি শক্ত। মুখে দারুন কঠিনতা এটে রয়েছে। এমন প্রেমময় পরিবেশেও কি লোকটা একটু পাগল প্রেমিকের মতো আচরণ করতে পারে না? সবসময় শক্ত খোলসে আটকে রাখে নিজেকে। অন্তি ভিষণ ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে,

‘একটু হাসবেন?’

ছোট্ট একটা আবদার, কিন্তু কত ব্যাকুলতায় ভরা! চোখ ভরা কৌতুহল মেয়েটার। প্রেমিক পুরুষটিকে শক্ত খোলস থেকে বের করতে কত অস্হিরতা তার! কিন্তু তাকে ভিষণ দুঃখি করে দিয়ে তার পুরুষটি কাঠকাঠ গলায় বলে ওঠে,

‘ছেলেটা কে ছিলো? এ মহল্লায় তো আগে কখনো দেখিনি!’

হতাশ চিত্তে বড় শ্বাস ফেলে অন্তি। দিহানের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে দাঁড়ায় মেয়েটা। মনে উথলে ওঠা প্রেমকে জলাঞ্জলি দিয়ে থমথমে দৃষ্টি ফেলে সামনে। রাগে পুড়ে ওঠা কাঠকাঠ গলায় শুধায়,

‘কি দরকার? হবে কেউ একজন। আপনার কেন জ্বলে?’

দিহান দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয়,

‘অন্যকারো জ্বলার কথা বুঝি?’

অন্তি কম কিসে? ঘুম থেকে জাগিয়ে ছাদে এনেছে এসব ছাইপাশ কথা শোনার জন্য! অসভ্য লোক। ক্লাস টু এর বাচ্চারাও এর থেকে ভালো বুঝে, হোয়াট ইজ প্রেম! কিন্তু এই লোক বুঝলো না। অন্তি ঝাঁঝালো জবাব দিলো,

‘অন্যকারো জ্বলার হাজার কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আপনার জ্বলার কারণ কি?’

অন্তির হঠাৎ এমন ফুঁসে ওঠা ব্যাপারটা দিহানকে অবাক করে। এইতো মেয়েটা দিব্যি আদুরে গলায় কথা বলছিল। এখন কি হলো? দিহান নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। বড়ো করে শ্বাস ফেলে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। গলার গম্ভীরতা ঢেকে নরম গলায় অন্তিকে ডাকে।

‘মেয়ে কাছে আসো।’

অন্তি চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। এক চুল ও নড়ে না জায়গা থেকে। দিহান আচমকা হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নেয়। দূরত্ব ঘুচিয়ে নেয় পুরোপুরি ভাবে। হঠাৎ টান সামলাতে দিহানের বুকের কাছে শার্টের অংশ আঁকড়ে ধরে অন্তি। হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসে তার। ধুমধাম শব্দে লাফাতে থাকে খাঁচায় আটকে থাকা হৃদযন্ত্রটা। চোখ আটকায় দিহানের এলোমেলো হয়ে যাওয়া সিল্কি চুলগুলোতে। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে দি সুন্দর দুলছে। অন্তির মন চায় হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু তার হাত দিহানের শার্টের অংশটুকু ছাড়তে নারাজ। অন্তি হাল ছাড়লো। দৃষ্টি নামিয়ে চোখ বারবার থামতেই দিহানের শান্ত দৃষ্টিতে জমে গেলো দৃষ্টি। অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করে নড়ে উঠতেই বাঁধন শক্ত হলো। অন্তি কিছু বলতে নিলেই তার পূর্বে দিহান তার মুখ খুললো। কিছু বলতে নিলে তার পূর্বেই অন্তি নাক মুখ কুঁচকে নেয়। বিরক্ত গলায় বলে,

‘সিগারেট খেয়েছেন? কড়া স্মেল পাচ্ছি।’

‘ওটা আমি সবসময় খাই। সেটা তুমি‌ জানো।’

‘অভ্যাস বদলানো যায়না? এখন থেকে….’

অন্তির মুখ চেপে ধরে দিহান। কথা শেষ করতে পারেনা সে। দানবিয় হাতের আড়ালে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় মেয়েটার। দিহান কড়া শাসনের গলায় বলে,

‘ভুলেও এটা বলবে না যে, তুমি আর সিগারেটের মধ্য থেকে একটা বেছে নিতে হবে আমায়। জানে মেরে ফেলবো। দুটোই চাই আমার। কথা মাথায় ঢুকেছে?’

অন্তি দ্রুত উপর নিচ মাথা নাড়ায়। দিহান ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। বাঁধন মুক্ত হতেই বড়ো করে শ্বাস ফেলে অন্তি। চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে অশ্রুকণা। রাগে লাল হয়ে ওঠে মুখ। এই লোককে আদেও প্রেমিক বলা চলে? পাষাণ লোক। একটু হলেই দমবন্ধ হয়ে মরতে যাচ্ছিলো!
দিহান সেদিকে কেয়ার করলো কম। গমগমে গলায় পুনরায় বলে উঠলো,

‘উত্তর দাও রূপ। তোমার প্রেমিক মোটেই ভালো মানুষ নয়। এবার উত্তর না পেলে ভয়ংকর কোনো শাস্তি পেতে চলছো। আমি মোটেই তোমার উপর জুলুম করতে চাইছি না। কে ছিলো ছেলেটা? আমি জানি ওর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জাস্ট ছেলেটা কে সেটা জানতে চাইছি। তোমায় সন্দেহ করছি এ ধরনের চিন্তা যেন ভুলেও মাথায় না আসে।’

অন্তি দুঃসাহসীকতার কাজ করলো। দিহানের হুসিয়ারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে জেদ ধরে চুপ করে রইলো। সে ও দেখতে চায় এই লোক ঠিক কতটা কঠিন হতে পারে তার সাথে। অন্তির চাল ঠিক বুঝলো দিহান। এই মেয়ের নাকের ডগায় জেদ। এতটুকু পুঁচকি মেয়ে এত জেদ পায় কোথায়? দিহান বাঁকা হেসে এক হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অন্তির কোমর। অন্যহাতে অন্তির খোঁপা করা চুল খুলে দিয়ে হাত বুলায় চুলের গভীরে। অন্তি দিহানের প্রতিটা কাজ দক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। যতক্ষনে সে বুঝতে পেরেছে সরে যাওয়ার পূর্বেই আটকা পড়ে যায় দিহানের শক্ত বাঁধনে।

এরপর?

এরপর অন্তি জীবনে প্রথমবারের মতো দীর্ঘ এক চুম্বনে আবদ্ধ হয়। দমবন্ধকর দীর্ঘ এ চুম্বনে ভালো অনুভূতির তুলনায় খারাপ লাগার পরিমাণটা একটু বেশিই ছিলো। দিহান তার নিষ্ঠুরতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে চুমুকেই বেছে নিয়েছিল।
প্রথম দিকে অন্তি দূরে সরবার জন্য ছটফট করলেও পরে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। লম্বা চুম্বন শেষে দিহান অন্তির কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। বুড়ো আঙুল দিয়ে অন্তির গাল গড়িয়ে পড়া চোখের পানিটুকু পরম যত্নে মুছে নেয়। ছোট করে একটা‌ চুমু খায় লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগায়। কোমল গলায় শুধায়,

‘এটা শাস্তি ছিল। আমার অবাধ্য হওয়ার চেষ্টা করবে না। তুমি আমার বাধ্য থাকলে দ্বিতীয় সবকিছু ভালোবাসা দিয়ে হবে। প্রমিস!’

অন্তি জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে দিহানের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। দুর্বল শরীর টেনে নিজ ভরে দাঁড়াতে চায়। দিহান আঁটকে দেয় তাকে। ফিসফিস করে বলে,

‘এভাবেই থাকো। আমি আর অল্পকিছুক্ষণ আছি।’

অন্তি বাধ্য মেয়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়। দিহান তা দেখে ঠোঁট টেনে হাসে। বুক ভরে আসে। বিধাতার নিকট বারবার শুকরিয়া জানায়। এই মেয়েটা ছাড়া তার জীবন একদম চলবে না। দিহান মুখ নিচু করে অন্তির কানে ছোট করে বলে,

‘ধন্যবাদ রূপ।’

অন্তি ঘাড় উঁচু করে দিহানের পানে চায়। কথা না বললেও চোখের ইশারায় কারণ জানতে চাইলে দিহান বলে,

‘কিছুনা। এখন সোজা রুমে চলে যাও। আমি তোমাকে যেতে দেখে ফিরে যাব।’

____________

অন্তির ঘুম ভাঙে বেলা করে। মাথার উপর যান্ত্রিক ফ্যানটা শব্দ করে ঘুরছে। অন্তির সমপরিমাণ বয়স ফ্যানটার। এজন্য শব্দ করলেও অন্তি ফ্যানটা বদলাতে দেয়না। একটা মায়া কাজ করে। হামি ছেড়ে উঠে বসে অন্তি। ঘড়িতে চোখ পড়তেই আতকে ওঠে। বারোটা বিশ বাজে। বালিসের তলা থেকে ফোন বের করতে সেখানে তন্নির বিশটা কল উঠে রয়েছে। কল ব্যাক করতে নিয়েও ফোন পূর্বের জায়গায় রেখে থম মেরে বসে রইল। গতরাতের ঘটনা মনে পড়তেই গাল গরম হয়ে ওঠে। কি ভয়ংকর কান্ড! লজ্জা লজ্জা! অন্তি দ্রুত পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ঠোঁট লাল হয়ে ফুলে আছে। অতিরিক্ত ঘুমের ফলে ফোলা ভাবটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। এই মুখ নিয়ে মানুষের সামনে কিভাবে যাবে সে? এ চিন্তা ছোট্ট মাথায় হানা দিতেই দিহানের উপর আক্ষেপে ফেটে পড়ে মেয়েটা।

সবার নজর থেকে বাঁচতে অন্তি সর্বক্ষণ রুমে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। দুপুরের খাবারটাও সে নিজ রুমে বসেই খেলো। নাহার জিঙ্গাস করলে উত্তর হিসেবে সে জানিয়েছে শরীর খারাপ করছে। নাহার গায়ে কপালে হাত দিয়ে চেক করতে গেলেই অযথা রাগ দেখিয়ে রুমের দরজা লাগিয়েছে। কি একটা বিশ্রি অবস্থা। এই অবস্থার জন্য অন্তি দিহানকে দোষারোপ করে চলছে। বিকেলে স্যার পড়াতে আসলেও অন্তি দরজা খুললো না। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে স্যারকে ফেরত পাঠিয়েছে। মেয়ের ব্যাবহারে নাহার অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে স্যারকে বলেছেন,

‘মেয়েটা সকাল থেকে অদ্ভুত আচরণ করছে। সারাদিন বাহিরে আসেনি। দুপুরের খাবারটাও নিজের ঘরে বসে খেলো। শরীরটা বোধহয় ভালো নেই। আপনি কিছু মনে করবেন না।’

ভদ্রলোক রাগ করেছে কিনা তা বোঝা গেলো না। কিন্তু গম্ভীর ভাবে বললেন,

‘ও ব্যাপারনা। এমন হয়। অল্প বয়সের তো!’

স্যার চলে যেতেই নাহার ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো হামলে পড়েছেন মেয়ের ওপর। দরজা বন্ধ থাকায় তার সবকথা অন্তির কান অব্দি না পৌঁছালেও এটুকু বুঝেছে আজ বাবা ফিরল বিচার বসবে। বড় করে তপ্ত শ্বাস ফেলে মোবাইল হাতে নেয় সে। দিহানের নম্বরে চট করে একটা ম্যাসেজ পাঠায়।

‘এই যে প্রেমিক!
আপনার শাস্তির দরুন বাড়িতেও শাস্তি পেতে চলছি। এটা তো ফেয়ার নয় তাই না? তাই জরিমানা হিসেবে আপনার
জন্যও শাস্তি ধার্য করা হয়েছে। আপনি রাজি কিনা‌ বলুন?’

প্রায় সাথে সাথেই জবাব আসলো।

‘শাস্তি হিসেবে যদি রূপবতী কন্যার নরম ঠোঁটের তপ্ত ছোঁয়া পাওয়া যায়, তবে আমি দিহান বারবার শাস্তির জন্য তাহার নিকট মাথা নোয়াবো।’

ম্যাসেজ পড়া মাত্র অন্তির কাঁশি উঠে যায়। কি সাংঘাতিক মাত্রায় অসভ্য লোক। গম্ভীরতার আড়ালে লোকটার এই অসভ্য রূপটা ঢেকে ছিল এতদিন। আস্তে আস্তে খোলস মোচন হচ্ছে যেন!

চলবে……….

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২২.
চোখের পলকের মাঝেই যেন সময় কেটে যেতে লাগলো। বাড়তে লাগলো ভালোবাসায় ঘেরা পাগলামি গুলো। অন্তি মাঝে মাঝেই দিহানের ভিন্ন রূপ দেখে হতবাক হয়, মনে হয় লোকটাকে চিনতে তার এখনো বহু বাকি। তাদের কথা হয় খুব কম। দেখা হয় হুটহাট। তবুও অনুভূতি যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হুরহুর করে বেড়ে চলছে।
রাস্তায় লোকটা তাকে খুব করে এড়িয়ে চলে। অপরিচিতর মতো আচরণ করলেও সেই আচরণ অন্তিকে আঘাত করতে পারেনা কখনো। রাস্তা পার হওয়ার ব্যাপারেও কি সূক্ষ্ম নজরদারি! দূর থেকেও যত্ন নেওয়া যায় এই কথাটার প্রমাণ অন্তি দিহানের থেকেই পেয়েছে। একটা মানুষ এতটা পর্ফেক্ট কিভাবে হতে পারে?

এখন নভেম্বর মাস বিদায় নেওয়ার পথে। ঠান্ডা পড়েছে খুব। অন্যবছরের তুলনায় এবার শীতের প্রকোপ কিছুটা বেশি। বর্ষপঞ্জিকার হিসেবে আজ নভেম্বরের ২৯ তারিখ। এখন ভোর ছয়টা। বাহিরে কুয়াশারা কুন্ডলী পাকিয়ে পাক খাচ্ছে চারদিকে। কাছের জিনিস ও কেমন ধোঁয়াশা মনে হয়। এই শীতের সকালে যেখানে বাড়ির সকলে লেপের ওমে শান্তির ঘুম দিচ্ছে, অন্তি সেখানে পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে রান্নাঘরে হাজির। উদ্দেশ্য হালকা কিছু রান্না। আজ তার প্রিয় পুরুষটির জন্মদিন বলে কথা।

রান্নাঘরের ছোট্ট জানালাটা‌ খুলে দেওয়া। হুরমুর করে শীতল বাতাস প্রবেশ করছে চিকন লোহার বেদ পেরিয়ে। জানালার পাশেই এ বাড়ির সবথেকে পুরোনো সজনে গাছটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যার বিস্তার ডালপালা থেকে হলদে রঙের পাতা গুলো ঝরে ঝরে পড়ছে। জানালা গলিয়ে আসা বাতাসে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও অন্তির ভালো লাগছে। ভালোলাগার সময় গুলোতে বোধহয় বিষ ও মধুর মনে হয়!

ইউটিউব থেকে সিলেক্ট করা রেসিপিটা প্লে করে সামনে রেখে রান্নায় মনোযোগ দিলো অন্তি। রেসিপিটা হোমমেড নুডুলসের। রান্নার সবথেকে প্রয়োজনিয় উপাদান হচ্ছে ময়দা। কিন্তু সমস্যা হলো প্রয়োজন ব্যাতীত সখের বসেও কখনো রান্নাঘরে পা ফেলা হয়নি তার। রান্নার উপকরণ কোনটা কোথায় আছে তা সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা নেই তার। একটা ডিম ভাজতে কতটুকু লবণ লাগে তার হিসাব না জানা অন্তি এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভাবতেই সে অবাক। বলতেই হবে তার সাহস আছে! অনেক খুঁজে তাকের উপরে সে তার কাঙ্খিত জিনিস দেখতে পেল। কিন্তু এখানেও শান্তি নেই। পাশাপাশি দুটো বোয়ামে রাখা সাদা বস্তু দেখে চেনার উপায় নেই কোনটা ময়দা কোনটা আটা। কপাল বরাবর ভাঁজ ফেলে বিচক্ষণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেও কোনো সুরহা না হলে রান্নাঘরের পাশের ছোট কক্ষে হামলা চালায়।
এ বাড়িতে সবার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষ রয়েছে। এ কক্ষটি কাজের মেয়ে পারুর জন্য বরাদ্দ। দরজায় ধুমধাম আঘাতে পারু বিরক্ত হয়েই কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার সামনে অন্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার বিরক্তির মাত্রা আরো এক কাঠি উপরে উঠে যায়। বড়োলোক বাড়ির ন্যাকা ধরনের মেয়ে মানুষ তার পছন্দ না। এরা নিজের জামাটাও ধুয়ে গায়ে জড়াতে পারে না। শুধু পারে উঠতে বসতে হুকুম জারি করতে।

‘সকাল সকাল আপনের কি লাগবে আবার? শীতের দিন সাতটার আগে আমি উঠবার পারতাম না, আগেই জানাইছি।’

‘উঠতে হবে না। দু সেকেন্ডের জন্য রান্নাঘরে আয়। ময়দার বোয়াম কোনটা বললেই তোর ছুটি।’

পারু না বোঝার মতো করে বলে,

‘কি কন?’

অন্তি বিরক্ত জবাব দেয়,

‘ময়দা লাগবে আমার। বোয়ামটা দিয়ে যা।’

পারুল এবার কন্ঠে কৌতুহল ধরে বললো,

‘ময়দা কি করতেন? রূপচর্চা?’

অন্তি চোখ‌ কটমট করে চাইতেই পারু থেমে যায়। তার মুখ সর্বদা তার আগে দৌড়ায়। মুখ বন্ধ হলেও পারুর কৌতুহল দমে না। আজ এ ব্যাপারে তদন্ত করে দিহানকে গরম গরম নিউজ দিবে সে। দুশো টাকা বাড়ায়ে চাইবে। ঘুম রেখে তদন্ত করার জন্য দুশো টাকাতো বাড়তি লাগবেই! না দিলে সে ও কাজে না করে দিবে। তদন্তর কাজ অত সহজ নাকি?

_____________

গতকাল রাত থেকে দিহানের কোনো খোঁজ নেই। হঠাৎ করেই যেন নিরুদ্দেশ হয়েছে মানুষটা। মোবাইল ফোনও বন্ধ বলছে। রেহানা সারারাত ছেলের চিন্তায় দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। পুরোটা রাত কেটেছে সোফায় বসে অপেক্ষা করতে করতে। ভয়ে মুখ ফুটে ছেলের বাড়িতে না ফেরার কথা স্বামীকেও জানাতে পারেনি। আবার নতুন কোনো অশান্তির ভয়ে মুখ বন্ধ রাখলেও সকাল দশটা পেরুলে ভয়ে বুকটা ধক করে ওঠে। স্বামীকে না জানিয়ে ভুল করলো কি? রেহানার বুক শুকিয়ে আসে। মনের ভেতর কেমন কু ডাকছে। কোনো বিপদ হলো না তো? এই তো সকালে গতকাল সকালে নাস্তা শেষে কত হাসিখুশি ভাবে ঘর থেকে বের হলো তার ছেলেটা।
এদিকে নুহাশকে কল করলেও যথাযথ কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। নুহাশকেও সমপরিমাণ চিন্তিত মনে হয়েছে। রেহানা দিক শুন্য হয়ে বড়ো ছেলেকে কল করলেন। রেহানকে এসময় কল করলে কখনোই ফোনে পাওয়া যায়না। থানার নম্বরে কল করলে তাকে পাওয়া যেতে পারে। অফিস আওয়ারে পার্সোনাল ফোন ইউজ করেনা সে। রেহানার কাছে রেহানের থানার নম্ব নেই। ফোনে পাবেনা জেনেও পরপর দুবার কল করলো। ফলাফল পরিবর্তন হলো না। রেহানা দুশ্চিন্তায় কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ঘরের কাজের মহিলা মিনু দৌড়ে আসেন।

‘আপা কাইন্দেন না। ভাইজানরে জানাই?’

রেহানা ফোন এগিয়ে দেয়। মুখে আঁচল চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। মুখে বলে,

‘দিহানের বাপকে কল কর। বাসায় আসতে বল তাকে।’

মিনু বেগম সম্মতি জানায়। তৎক্ষণাৎ মুঠোফোন হাতে কল করে রেজওয়ান মির্জাকে। কিন্তু সময় কিংবা ভাগ্য কোনোটাই তাদের সাথে ছিলো না। রেজওয়ান মির্জার ম্যানেজার কল রিসিভ করে জানান তিনি বর্তমানে জরুরি কোনো মিটিং এ রয়েছেন। ঘন্টা খানেক সময় বাদেই তিনি ফ্রি হবেন। মিনুর মুখ শুকিয়ে আসে। ফোন কাটার পর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। রেহানার কান্না‌ দেখে তার ও কান্না পাচ্ছে।

‘তোর ভাইজান কি বললো মিনু?’

মিনু জবাব দেয়না। তার শুকনো মুখ দেখেই রেহানা বুঝতে পারে এখানেও কাজ হয়নি। চোখের পানি বাঁধ ভাঙে। মিনু ব্যর্থ শান্তনা দিতে চেষ্টা করে।

‘দিহান বাবা ছোট না আপা। চিন্তা করবেন না। পোলা মানুষ, আছে হয়তো বাইরে কোতাও। বাড়িতে আসলে এবার আপনে একটু কঠিন হবেন। আপনে কঠিন না হলে পোলা সোজা হইবে না।’

_____________

অন্তি আজ ভয়ংকার এক কান্ড ঘটিয়েছে। তন্নিদের বাসায় যাওয়ার কথা বলে সে সরাসরি মিরপুর থেকে গুলশানে চলে এসেছে। হাতে তার ছোট একটা বাগ। তার মধ্যে রয়েছে তার হাতে রান্না করা নুডুলস। এই সামান্য নুডুলস নিজ হাতে প্রিয় পুরুষটিকে খাইয়ে দিতেই তার মিরপুর থেকে গুলশান অবদি আসা। মিরপুরের আনাচে কানাচে সর্বত্রে দিহানের পরিচিত লোকের সমগম। কোনো‌ এক অঙ্গত কারণে দিহান সবার থেকে অন্তিকে আড়াল করে রাখতে চায়। এর কোনো সঠিক কারণ অন্তির জানা নেই। তবে একটা চাপা কৌতুহল বোধ তাকে সর্বদা তাড়া করে বেড়ায়। প্রেমের এতদিন হয়েগেলেও দিহানের সাথে অফিসিয়ালি তার কখনো মিট করা হয়নি। হাত হাত রেখে হাঁটা হয়নি। পাশাপাশি বসে গল্প করা হয়নি। যা হয়েছে সব ভীষণ গোপনে।‌ নিভৃতে!
এজন্য পরিচিত জায়গা থেকে‌ দূরে আসা। উদ্দেশ্য কেবল প্রিয় মানুষটার সাথে কিছু মুহূর্ত কাটানো। অন্যসব প্রেমিক যুগলদের মতো কফি খেতে খেতে গল্প করা। সুযোগ পেলেই আলতো হাতে হাত ছুঁয়ে দেওয়া! এছাড়া আর কি? এইতো তার চাওয়া! অন্তি নিজ মনে হাসে। সে বড্ড লোভী হয়ে পড়েছে। ভীষণ রকম নির্লজ্জতা তকে ঘিরে ধরেছে। এইযে সে এসব ভাবছে তা কি তার প্রেমিক পুরুষটা জানে? জানলে কি সে অবাক হবে? বিস্ময় ঘেরা গলায় বলবে,

‘তুমি তো ভীষণ ভয়ংকর রূপ! দিনে দুপুরে আমাকে লুট করার ছক কষছো! মায়া হয়না তোমার?’

অন্তি হাসে। ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে। এগারোটার বেশি বাজে। তার হাতে এখনো পুরো সাত ঘণ্টা সময় রয়েছে। আসার পূর্বে দিহানকে টেক্সট করে এসেছে। সাহেব নিশ্চই কিছুক্ষণের মাঝেই হাজির হবেন। দেরী করার অভ্যাস নেই তার!
বুক ভরে শ্বাস নেয় অন্তি। এটাই তার‌ প্রথম একা এতটা পথ পারি দেওয়া। এটাই প্রথম বাড়িতে মিথ্যা বলে বের হওয়া। তার কি অনুশোচনা হওয়া উচিত? পরিবারকে ধোঁকা দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? পরক্ষণে অন্তির মন শক্ত ভাবে জবাব দেয়,

‘অবশ্যই উচিত‌ নয়। আমি তাদের কখনোই ধোঁকা দিতে চাইনি। তারা আমাকে বাধ্য করেছে এ পথকে বেছে নিতে।’

নিজ মনের শক্ত জবাবে কিছুটা অপরাধ বোধ ম্লান হলেও বুকের কোথাও একটা ভার অনুভব হয়। সাথে কিছুটা অস্বস্তি বোধ। আশপাশে এত এত মানুষের ভীড়ে একা দাঁড়িয়ে থাকতে কিছুটা আশঙ্কিত হয়। অহরহ গাড়ির হর্ণের শব্দে মাথা ভারী হয়ে আসতে চায়। অদ্ভূত এক ধরণের অনুভূতি তকে কাবু করে আনে। ঝকঝকে দিনটাকেও তার কাছে কেমন অন্ধকারে ঘেরা এক মন খারাপের দিন বলে মনে হচ্ছে। এমন তো হওয়ার কথা নয়! সামান্য পথ পাড়ি দিতে এতটা আতঙ্ক তাকে কাবু করার কথা নয়! তবে কেন? অন্তি বারবার ফোনের স্ক্রিনে নজর বুলিয়ে বিরবির করে,

‘দিহান দ্রুত আসুন। আমি ভয় পাচ্ছি!’

অন্তি বেছে সুন্দর গোছানো নিরব পরিবেশের একটা কফিশপে ঢুকেছে। ঢোকার পথে সুন্দর করে শপের নামটা দিহানকে টেক্সট করে দিয়েছে। বাহিরের ধুলাময় পরিবেশের তুলনায় এখানে নিরবে বসে থাকাটাই তার কাছে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে। অন্তি এক কাপ কফি অর্ডার করে জানালা থেকে বাহিরে নজর দেয়। এই রেস্টুরেন্টটা তৃতীয় তলায় অবস্থিত। তৃতীয় তলার উপর থেকে রাস্তার ভিউটা বেশ ভালো লাগছে। অন্তি আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ক্লান্তহীন চোখ দুটো শতশত মানুষের ভীড়ে পরিচিত পুরুষটিকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়। ছুটতে থাকা গাড়িগুলোতেও দৃষ্টি আটকে পড়ছে। এই বুঝি সে এলো! ধোঁয়া ওঠা কফি ঠান্ডা হয়ে আসে। অন্তির চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে আসে। তবুও পরিচিত মুখটার দেখা মেলে না। অন্তি ক্লান্ত ভঙ্গিতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। শপের এক সাইডে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা বুকসেল্ফ দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। চোখ আটকায় হুমায়ূনের ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসের উপর। কেন যেন তার এই মুহূর্তে এই উপন্যাসটাই খুব করে টানছে। হয়তো এই উপন্যাসের এই নামটার বদৌলতেই!

চলবে……..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ❤️)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে