তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৫+১৬

0
574

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৫.
চেনা পরিচিত মুখ গুলোকে হঠাৎ করে বদলে যেতে দেখলে বা ভিন্ন ধর্মী আচরণ করতে দেখলে যেকোনো ব্যক্তির মস্তিষ্ক স্বাভাবিকের তুলনায় বিপরীত প্রতিক্রিয়া করবে। উক্ত পরিবর্তনের রহস্য উন্মোচনে ব্যাকুল হবে। অন্তির ব্যাপারটাও তেমন। প্লেটে বাহারি খাবার থাকা সত্ত্বেও সে তা গালে তুলতে পারছে না। তার নজর দূরে খাবারের তদারকি করা দিহানের দিকে। লোকটা হঠাৎ করেই কেমন দায়িত্ববান পুরুষের ন্যায় আচরণ করছে। ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক ঠেকছে তার কাছে। কুকুরের লেজ হুট করে সোজা হয়ে যাওয়ার মতো কোনো প্রবাদ সে শোনেনি। তার মানে এটা দাড়ায় যে ব্যাপারটা অসম্ভব! তাহলে দিহান মির্জার মতো মানুষের লেজ কিভাবে সোজা হতে পারে?

‘দোস্ত লেগ পিস দিলো না কেন আমাদের? দেখ তুলির প্লেটে! বেছে বেছে বড় লেগ পিছটা দিছে। কেন রে? আমরা বুঝি টাকা দেইনি?’

অন্তি তার কথা শুনলো বলে মনে হলো না। বরং সে তন্নির হাত ঝাঁকিয়ে বললো,

‘দোস্ত তোর মনে হয়না কিছু একটা গোলমেলে হচ্ছে। মানে আই ফিল সামথিং ফিসি হিয়ার!’

তন্নি উৎসাহিত হয়ে বললো,

‘দ্যাটস ইট গার্ল! আমিও এটাই বলছিলাম। দেখলি তো কেমন অবিচার চলছে! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠেনের মতো জায়গায় যদি লেগ পিছ নিয়ে এমন রাজনীতি চলে তবে দেশের অন্য সব প্রান্তে কি চলছে ক্যান ইউ এভার ইমেজিন! আমি হাইলি ডিজাপয়েন্টেড!’

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল তন্নি। অন্তি কটমট করে চাইলো। এখানে এত বড়ো কিছু ঘটে যাচ্ছে আর এই মেয়ে পরে আছে লেগপিছ নিয়ে!

‘ওমনে তাকাস কেন?’

অন্তি চাপা শ্বাস ফেলে উদাস ভঙ্গিতে বলল,

‘দিহান মির্জাকে লক্ষ্য করেছিস? কেমন ঘাপলা লাগছে লোকটার ভেতর। ধমকা ধমকি বাদ দিয়ে আজ এত দায়িত্ববান পুরুষের রোল কেন প্লে করছে? মনে মনে নিশ্চই চুড়ান্ত কোনো ষড়যন্ত্র কষছে। এই লোকের শিরায় শিরায় খারাপি লুকিয়ে আছে!’

অন্তির এই ওভার থিংকিং ব্যাপারটা তন্নির ঠিক পছন্দ হলো না। সে বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো,

‘তোর জন্য কি মানুষ ভালো পথে চলতে পারবে না? আযব দুনিয়া! তুই না চাইতি সে ভালো হয়ে যাক, একদম মাম্মাস বয় টাইপের! তোর সেই দোয়ার প্রভাবে এমন চেঞ্জ। আরো কিছুদিন দোয়া কন্টিনিও কর ইনশাআল্লাহ সফলতা নিশ্চিত।’

অন্তির মস্তিষ্ক তন্নির যুক্তিকে পুরোপুরি ভাবে মেনে নিতে পারলো না। মাথায় চিন্তার ঘড়িটা টিক টিক করে বাজতেই লাগলো। মন বরংবার হুঁশিয়ারি বার্তা প্রেরণ করছে। কি চলছে লোকটার মাথায়?

___________

সাহেদ আজ অফিস আওয়ারেই বাড়িতে ফিরলো। নাহার তখন খিটখিটে মেজাজে কাজের মেয়েটার উপর ডিটার্জেন্ট ছাড়া ধুয়ে দিচ্ছে। এমনটা প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। সাহেদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,

‘আহ নাহার! এত রাগ করো কেন? কি হয়েছে?’

‘কি হয়নি তাই বলো? রোজ রোজ এক জিনিস আমার ভালো লাগে না। ওকে কোনোদিন আমি একবারে কোনো কথা শুনাতে পারলাম না।’

সাহেদ স্ত্রীর রাগ সম্পর্কে জানেন। একটুতেই রেগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিপি হাই কীনা! সে এগিয়ে এসে নাহারকে টেনে সোফায় বসালেন। তাকে শান্ত করতে বললেন,

‘বিশ্রাম নেও। এভাবে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমাকে বলো কি করেছে ও?’

স্বামীর এই ছোট মত্নে শান্ত হয়ে আসে নাহার। শরীর বয়স্ক হতে চললেও মন এখনো ষোড়শী কিশোরীর মতোই আদর যত্নের খোঁজ করে। স্বামী নামক ব্যক্তিটির যত্নে তৃপ্ত হয়ে আসে হৃদয়। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,

‘ওকে আমি দোকান থেকে এক কেজি ডাল আনতে বলেছি। সে ধেই ধেই করে এক কেজি চাল নিয়ে চলে এসেছে। ফেরত পাঠিয়ে বারবার করে বলেছি মুশুর ডাল আনতে, আর ও আনছে ছোলার ডাল। এমন উল্টাপাল্টা কাজ করলে আমি ওকে দিয়ে কি করবো?’

সাহেদ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখলো। মেয়েটার বয়স অন্তির মতোই হবে। বাংলা সিনেমার ভক্ত খুব। সারাদিন মুখে তার বিভিন্ন সিনেমার গান আর কাহিনী ঘোরে। সে ক্ষেত্রে এসব টুকটাক বিষয় ভুলে যাওয়াটা অস্বভাবিক নয়। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে আলাদা রকম ক্ষমতা থাকে। এই মেয়েটার মাঝে আছে কাজের বিষয়গুলো ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা। সাহেদ গম্ভীর স্বরে মেয়েটাকে বলে,

‘তুমিকি এখানে থাকতে চাও নাকি চলে যেতে চাও?’

মেয়েটা মাথা নিচু করেই জবাব দিলো,

‘থাকতে চাই সাহেব।’

সাহেদ ফের বললো,

‘তাহলে আমার মিসেসকে আর এভাবে জ্বালাতন করবে না কেমন? তোমাকে আমি একটা ডায়েরি আর কলম দিবো। কিছু বলার সাথে সাথে চট করে নোট করে ফেলবে। তাহলে আর ভুল হবেনা।’

‘জ্বি আচ্ছা সাহেব।’

‘লিখতে পারো তো? পড়াশোনা করেছো?’

‘জ্বি পারি সাহেব। ফাইপ পর্যন্ত লেকাপড়া জানি সাহেব।’

‘এখন যাও কাজে লেগে পড়ো।’

কাজের মেয়ে যেতেই সাহেদ স্ত্রীর দিকে ফেরেন। চিন্তিত স্বরে বলেন,

‘তোমায় এভাবে হাইপার হতে না করেছি না? এমনটা যেন আর কখনো না দেখি নাহার। তুমি এখন কিশোরী নেই। বুঝতে হবে তোমাকে।’

নাহার এক বাক্যে স্বামীর কথা মেনে নেয়। সাহেদ গলার টাই ঢিল করতে করতে বলে,

‘মেয়ে কোথায়?’

‘কোথায় আর কলেজে।’

সাহেদকে হঠাৎ চিন্তিত দেখায়। যেন হঠাৎ করেই কোনো একটা ব্যাপার তাকে খুব ভাবাচ্ছে। নাহার বতা লক্ষ্য করে কোমল গলায় ভলে,

‘কিছু হয়েছে?’

সাহেদ মাথা নাড়ায়।

‘মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ নাহার?’

নাহার চমকে তাকায় স্বামীর দিকে। অবাক গলায় বলে,

‘মেয়েটা এখনো ছোট। বিয়ের জন্য অনেক সময় বাকি আছে। এখন ওসব নিয়ে ভাবাভাবির দরকার কি?’

সাহেদ মাথা দুলিয়ে সার জানায়। বলে,

‘আমিও তাড়াহুড়ো করতে চাচ্ছি না। কিন্তু আজিমকে তো চেনো? আমার বন্ধু ডাক্তার আজিম। ওর ছেলেটা এবার মেডিকেল শেষ করে জব এ ঢুকলো। আজিমের হস্পিটালেই জয়েন হয়েছে শুনলাম।’

‘হ্যা তো?’

‘আজিম চাচ্ছে ছেলেকে বিয়ে করাতে। আরাবের মতো হীরের টুকরো ছেলেকে আমি মেয়ের জন্য বেষ্ট বলে মনে করি। মেয়েটাকে চেনা পরিচিতের মধ্যে দিতে পারলে বুকের উপরের ভার কিছুটা নামতো আরকি।’

নাহারকে চিন্তিত দেখালো। সাহেদের উপর তার ভরসা আছে। সাহেদ যখন বলেছে নিশ্চই ছেলেটা তাদের মেয়ের জন্য উপযুক্ত। তাছাড়া তার মেয়েটা যা দস্যি! ওমন মেয়েকে কোন ভালো ছেলে বিয়ে করবে? তাছাড়া মেয়েকে বিয়েতো দিতেই হবে। আজ হোক বা কাল! আহার স্বামীর কাঁধে হাত রাখলো। সাহেদ তাকাতেই বললো,

‘তুমি আজিম ভাইয়ের সাথে কথা বলো। আমি মেয়েকে দেখছি!’

___________

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। রক্তিম হয়ে উঠছে আকাশ। আজ পুরোটাদিন সূর্য তার প্রখরতা বিছিয়ে বেড়িয়েছে। অন্যদিনের মতো মেঘের দল এসে তাকে রুখে দেয়নি। অন্তি আর তন্নি কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আজ যেন রিকশা এ ধরণীর বুক থেকে ভ্যানিস হয়ে গেছে। কোথাও কোনো রিকশার খোঁজ নেই। ব্যাপারটায় অন্তি বিরক্ত হলেও তন্নি আকাশ সম উৎসাহ নিয়ে বললো,

‘দোস্ত ডোন্ট ইউ থিংক আমাদের একটা রিকশাওয়ালা বফ দরকার? চাইলেই যখন তখন রিকশা চড়ে ঘুরে বেড়াবো। আহ্! ভাবতেই সেই ফিল আসতেছে।’

আন্তি অতিষ্ঠ চিত্তে দাঁতে দাঁত চেপে খেকিয়ে ওঠে।

‘মুখা বন্ধ রাখ তন্নি। আর একবার মুখ খুলেছিস তো তোর জীবনের দা এন্ড ঘটাতে দু বার ভাববো না।’

তন্নি না চাইতেও দুঃখ প্রকাশ করে ফেললো,

‘তুই আর তুই নেইরে পাখি। দিহান ভাইয়ার মতো ডেন্জারাস হয়ে গেছোস। ভালোবাসার কি দারুণ ক্ষমতা!’

সত্যিই কি তাই? অবশ্য অন্তির ও আজকাল মনে হয় সে দিহানের মতো খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছে। একটুতেই কি রাগ তার! অন্তি নিজের এসব উদ্ভট আচরণের জন্য দিহানকেই দায়ী মনে করে। তার সকল খারাপ অভ্যাসের কারণ এই লোক।

ভাবনা থেকে সে বের হলো তন্নির কথায়,

‘দোস্ত! তোদের বিয়ে হলে তো দেখছি ঘোর বিপত্তি ঘটে যাবে! দুইয়ে দুইয়ে চার, মানে তোদের বাচ্চারা…… আমারতো ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।’

তন্নির এসব নাটকে অভ্যস্ত অন্তি জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। রিকশার ভরসায় থাকলে রাত ফুরিয়ে দিন হয়ে যাবে তাও রিকশা পাবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া তন্নির ভাবনা কেবল তার বাচ্চাদের কাছে পৌঁছেছে, আরো কিছুক্ষণ পর হয়তো নাতি নাতনির কাছেও পৌঁছে যাবে। বলা যায় না!

তন্নিও অন্তির পিছু পিছু চলতে শুরু করেছে। কিন্তু তার মুখ বন্ধ নেই। মাঝে মাঝে তার মুখ আউট অফ কন্ট্রোলে চলে যায়। ছুটতেই থাকে। হাজারবার ব্রেক কষলেও লাভ হয়না। আজ ও তেমন হয়েছে। সে চেয়েও তার মুখের শাটার টানতে পারছে না।

.

.

মোরে আজ ও দিহানের দেখা মিললো। জিপের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রেখেছে। মৃদু বাতাসের তালে ঘন চুলগুলো দোল খাচ্ছে। সাদা বলিষ্ঠ হাতে চকচকে কালো বেল্টের ঘড়িটা বড্ড মানিয়েছে। অন্তি আড় চোখে সবটা দেখলো। মন চাইলো লোকটা যেন একবার তার দৃষ্টি তুলে তাকায়। তার ভারী দৃষ্টিতে খানখান করে দিক কিশোরী হৃদয়। কিন্তু পুরুষটা যে বড্ড অবাধ্য। অন্তির মনের ব্যাকুলতাকে দূরে ছুড়ে ফেলে অন্তির দিকে একবার ও চাইলো না চোখ তুলে। জিপের দরজা খুলে চড়ে বসলো তাতে। দাম্ভীকতার সাথে প্রস্থান করলো জায়গা। পরপর তাকে অনুসরণ করে সাই সাই করে বাইক নিয়ে ছুটলো সবাই। মিনিটের মাঝে ফাঁকা হলে গেলো জায়গা।

দিহানের এমন ইগনোর করার ব্যাপারটা অন্তির পাহাড় সমান উঁচু ব্যক্তিত্বে আঘাত হানলো। নিজ মনকে দু চারটা কটু বাক্য শুনিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির পথে। দু পা এগোতেই পাশ ঘেঁষে একটা রিকশা এসে থামলো।

‘আপা ওঠেন।’

অন্তি রিকশাওয়ালার দিকে একবার তাকিয়ে পেছন ঘুরলো। রাস্তায় গাড়ি আর অপরিচিত লোকজন ব্যাতীত পরিচিত প্রিয় মুখের মানুষটাকে সে কোথাও দেখতে পেল না। তবুও অন্তির মন বলছে দিডহান আশপাশেই কোথাও আছে। নিরবে গোপনে তাকে দেখছে। এই রিকশাটাও তার ঠিক করে দেওয়া। তন্নিও হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। এজন্য অন্তির আগেই সে রিকশায় চেপে বসেছে। অন্তি বিনা বাক্যে বিষন্ন মন নিয়ে উঠে বসলো। দিহান নামক মানুষটার প্রতি তার অভিমান গাঢ় হলো। মানুষটা এমন কেন করছে? না তাকে কাছে টানছে আর না দূরে যেতে দিচ্ছে। শূন্যের মাঝামাঝি উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঝুলিয়ে রেখেছে তাকে। সে কি বোঝেনা এতে অন্তির কষ্ট হয়? নাকি তাকে কষ্ট দিতেই এত আয়োজন?

পুরোটা রাস্তা নিরবতায় কেটে গেলো। তন্নির গলার কাছে এতশত কথা এসে আটকে রইলো। অন্তির মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই নিজের মুখকে বন্ধ করে রেখেছে সে। অন্তিদের বাসার সামনের রাস্তায় এসে রিকশা থামলো। এবার কোনো রকম ভয় ছাড়াই একা একা নেমে দাঁড়ালো সে রিকশা থেকে। যদিও শাড়ি অনেকটা এলোমেলো হয়েছে। কুচিতে পা লেগে কুঁচি খুলে এসেছে অনেকটা। কোনোরকম তা আঁকড়ে ধরে বাকিটা রাস্তা হেঁটে বাসায় ঢুকলো। অন্তি গেট দিয়ে ঢুকতেই তন্নি ছোট করে শ্বাস ফেলল। সামনে ফিরে বললো,

‘মামা চলেন।’

তার মনটাও কেমন বিষিয়ে এসেছে। সে কি একবার দিহান ভাইয়ার সাথে অন্তির ব্যাপারে কথা বলবে? কিন্তু তার জন্য যে পর্যাপ্ত সাহস দরকার!

চলবে……..

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৬.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। অদ্ভূত মায়াজড়ানো মাদকতায় পূর্ণ সে গন্ধ। প্রকৃতি ভিষণ শীতল হয়ে পড়েছে। গায়ে পাতলা চাদর টানতেই ঘুমে চোখ দুটো বুঝে আসতে চায়। যেন কত বছরের নির্ঘুমতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে চোখ দুটো! বছর পর রকৃতির পরশ পেয়ে সকল ক্লান্তিকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। অন্তির রুমের জানালায় টাঙানো সাদা ধবধবে পর্দাগুলো চঞ্চল ছুটছে। বাতাসের তাড়নায় তারা স্থির থাকতে ব্যর্থ। রাতে জানালা বন্ধ করা হয়নি। বৃষ্টির ছিটে জানালার পর্দার অনেকাংশই ভিজে গেছে। পর্দার উড়ে চলার ফাঁকে ফাঁকে বাহিরের স্বল্প সতেজ দৃশ্য চোখে আটকায় অন্তির। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। সাথে আসছে চাল, ডাল একত্রে করে রান্না নরম খিচুড়ির ঘ্রাণ। অন্তি আলগোছে উঠে বসে। নাসারন্ধ্রে খিচুড়ির ঘ্রাণ প্রবেশ করা মাত্রই তার নিজেকে ভিষণ ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে। পেটের ভেতর অদ্ভুত সব শব্দ হচ্ছে। অগোছালো চুলগুলো হাত খোপা করে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায় সে। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং যেতেই দেখা যায় সেখানে আগে থেকেই তার বাবা বসে আছেন। আজ অফ ডে না হওয়াতেও সে বাসায়। এমনটা খুব কমই দেখা যায়। প্লেটে খাবার নিয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। খিচুড়ির পাশেই বড়ো বাটিতে রাখা মুরগির ঝাল মাংস। বেগুন ভাজি ও করা হয়েছে। এসব অন্তির পছন্দের খাবার। বৃষ্টির দিনে নরম খিচুড়ি খাওয়া অন্যরকম একটা আনন্দ। নাহার এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জলদি খেতে বোস। খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

সাহেদ মেয়েকে দেখে মুচকি হাসে। বলে,

‘আচার আছে মা? নিয়ে আসো তো।’

অন্তি মাথা নাড়িয়ে আচার আনতে রান্নাঘরে চলে যায়। পরিবারের প্রতিটা মানুষ কত স্বাভাবিক আচরণ করছে। যেন সব আগের মতো সাজানো গোছানো রয়েছে। ছোট্ট একটা সুখি পরিবার। যেখানে সব কিছুতে রয়েছে ভালোবাসার ছোঁয়া। কিন্তু আদেও কি তাই? এই সবটাই কি সত্যি নাকি কেবল অভিনয়? অন্তি গতকালের কথা মনে করে,

গতকাল সন্ধ্যায় সাহেদের সাথে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। সম্পর্কে তিনি সাহেদের ভিষণ কাছের একজন বন্ধু। অন্তি অবশ্য তার নাম কয়েকবার শুনেছে। ডা: আজিম খন্দকর। বেশ ভালোমানের ডাক্তার তিনি। ভদ্রলোক বেশ রসিক ধরণের। অন্তির তার সাথে কথা বলে তেমনটাই মনে হয়েছে। কথায় কথায় জানতে পেরেছে ভদ্রলোকের একটা মাত্র ছেলে রয়েছে। সে ও একজন ডাক্তার। ভদ্রলোকের ছেলের গল্প শুনে অন্তির এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আরাব নামের লোকটা অত্যন্ত রকমের সুপুরুষ। যার এত এত ভালো গুণ সে সুপুরুষ ব্যাতীত কি হতে পারে যানা নেই অন্তির। কথার এক পর্যায়ে ভদ্রলোক কৌশলে তার গুনধর ছেলের ছবিখানাও দেখিয়েছে অন্তিকে। বেশ সুদর্শন বলা চলে। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত এসে থামলেই চলত কিন্তু ব্যাপারটা তখনই খারাপের দিকে গেলো যখন ভদ্রলোক কথার ছলে অন্তির সামনে সাহেদকে বললো,

‘তোর মেয়ে ছোট তাতে কি? তোর মেয়েকে কি আমি বা তোর ভাবী অন্যসব শশুর শাশুড়ির মতো রান্নাঘরে আটকে রাখবো নাকি? আমার বউমা হবে আমার সন্তানের মতো। এখানে যেভাবে আছে আমার কাছেও সেভাবেই থাকবে।’

বন্ধুর কথায় ভরসা পায় সাহেদ। উজ্জ্বল হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘তাহলেতো সমস্যার আর কিছু দেখছি না।’

অন্তি শক্ত হয়ে বসে তাদের আলোচনা শোনে। তার কান অব্দি বাদবাকি কথা পৌছাতে পারলো না। বুকের ভেতরটা কেমন জমে এসেছে। কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে যেন। এমন বিপদের কথা তো সে কখনো ভাবেনি। তার বয়স সবে সতেরো। এত দ্রুত… কেন? অন্তির চোখ ভরে আসে। মাথায় হাজার চিন্তা দলা পাকাতে থাকে। কোনো কথা ছাড়া দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। রুমে যেতে নিলে আজিম সাহেব বাঁধা দিয়ে বলে ওঠেন,

‘মামনি বসো। আরো কিছুক্ষণ গল্প করি তোমার সাথে।’

অন্তির পা আবস হয়ে আসছে। সে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। দিহানকে ছাড়া অন্যকাউকে তার চাই না। সে ব্যক্তি যতই সুপুরুষ হোক না কেন অন্তির কেবল দিহানকে চাই।
আজিম সাহেবর কথায় খুব কষ্টে ঠোঁট টেনে স্বল্প হেসে সে বলে,

‘আমার শরীর খারাপ করছে আঙ্কেল। অন্য এক সময় কথা হবে।’

দ্রুত প্রস্থান করতে নিলে অন্তির মনে হয় তার পায়ে যেন পাথর বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সে কিছুতেই পা টেনে রুম অবদি যেতে পারছে না।
সাহেদকে চিন্তিত দেখালো। মেয়ের এভাবে চলে যাওয়াটা তার কাছে ভালো লাগলো না। চোখ ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাতে দেখা গেলো সেও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। অন্তি স্বভাবত চটপটে ধরণের। কথা বলার মানুষ পেলে তার মুখ ননস্টপ চলতে থাকে। এতক্ষণ পর্যন্ত সব তো ঠিক ছিল। বিয়ের কথা উঠতেই মেয়েটা…… !!
সাহেদের যতটুকু বোঝার সে বুঝে ফেললেন। এ বয়সের মেয়েরা বিয়ে করে নিজের স্বাধীনতা নষ্ট করতে চায় না। বিয়ে বলতেই তারা চার দেয়ালে বন্দি জীবন মনে করে। মেয়েকে বুঝিয়ে বললেই বুঝতে পারবে ভেবে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে।
আজিম সাহেব বিদায় নেন তার খানিক বাদেই। রাতে খাবার টেবিলে অন্তি না আসায় সাহেদ স্ত্রীকে বলেন,

‘মেয়েকে ডাকছো না কেন?’

নাহার প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে বলে,

‘তোমার মেয়েকে তুমি কেন ডাকছো না? দুবার ডেকেছি দরজা খোলেনি।’

স্ত্রীর এমন গা ছাড়া ভাব সাহেদের কখনোই পছন্দ হয় না। মেয়েটা না খেয়ে থাকবে নাকি রাতে? নিজেই উঠে এসে অন্তির রুমের দরজায় কড়া নাড়ে।

‘দরজা খোলো রূপন্তি।’

ভেতর থেকে জবাব আসে,

‘আমি খাব না। ক্ষুধা নেই।’

সাহেদের হঠাৎ করেই হাসি পায় খুব। পুরোনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ে। তার যখন বিয়ে হলো নাহার তখন বেশ ছোট। তাকে একটু আধটু বকলেই ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো। সব রাগ খাবারের উপর দিয়ে চলে যেত। মেয়েটাও হয়েছে তেমন। একদম মায়ের কপি।
কিন্তু এখন হাসলে চলবে না। মেয়ের ছোট্ট মনে নিশ্চই বাবার প্রতি অভিমান জন্মেছে। এই অভিমানকে ক্ষোভে রূপ নিতে দেওয়া যাবে না। তার পূর্বেই মেয়েকে বোঝাতে হবে তাকে। এই বয়সটা খারাপ। এ বয়সেই ছেলে মেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সে বাবা হয়ে মেয়ের বিন্দু ক্ষতি চান না।

ঘড়িতে দশটা বাজে। অন্তি বসার ঘরে এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই সোফায় বসে তার বাবা মা এবং বড় চাচা। বড় চাচার হঠাৎ এই রাতে এখানে আসার কারণটা অন্তির অজানা। সাহেদ মুশত মেয়েকে বোঝানোর জন্য এত রাতে বড় ভাইকে কল করে ডেকেছেন। বংশের মাথা তিনি। বাচ্চা থেকে বড় সকলেই বেশ মেনে চলেন তাকে। নিরবতা ভেঙে অন্তির বড় চাচা শাহিন রাশভারী গলায় বলেন,

‘এখানে এসে বোসো। আসামির মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কোনো অন্যায় করেছ তুমি?’

অন্তি দুদিকে মাথা নাড়ায়। সাহেদ মুচকি হাসে। সে উপযুক্ত লোককেই এনেছেন মেয়েকে বোঝাতে। অন্তি চুপটি করে সামনের সোফায় বসে।তার বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। ইতিমধ্যে তার সচেতন‌ মস্তিষ্ক বড় চাচার আসার কারণ উদঘাটন করে ফেলেছে।

‘সোজা কথায় আসি। আরাব ছেলেটার ছবি দেখেছো?’

চাচার কথায় মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। তার ধারণাই ঠিক। ঝেঁপে আসা কান্না চেপে রেখে অন্তি মাথা নাড়ায়। সে দেখেছে। শাহিন সাহেব পুনরায় বলেন,

‘ছেলেকে দেখে তোমার অপছন্দ হয়েছে?’

অন্তি মাথা নাড়িয়ে না জানায়। শাহিনের সাথে সাহেদ ও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। এ পর্যায়ে সাহেদ কথা বলেন,

‘বাবা তোমার খারাপ চায়না মা। আরাব ছেলেটা ভিষণ ভালো। আমি খোঁজ নিয়েছি। তাছাড়া এখন বিয়ে হলেই আমরা তোমায় দিয়ে দিব না ওদের কাছে। তোমার যাখন মনে হবে তুমি ওবাড়িতে যেতে প্রস্তুত তখন আমরা ব্যাবস্থা নিব।’

অন্তি বাবা চাচাকে সম্মান করে এবং ভয় ও পায়। কিন্তু তাই বলে নিজের মতের বিরুদ্ধে সে কারো কথাই চুপ করে মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে নয়। এবারো তাই হলো। সে বাবার মুখের উপর বললো,

‘আমি তাকে বিয়ে করতে চাই না বাবা। আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।’

‘কেন মা? খুলে বলো। না বললে বাবা বুঝবে কিভাবে?’

অন্তি এখানেই ভুলটা করে বসে। বাবার কাছে বায়না করলেই সব পাওয়া যায় সে চিন্তা থেকেই জীবনে প্রথম বারের মতো চুড়ান্ত বোকামিটা করে বসে সে। কিন্তু মেয়েটা যানেই না বাবার কাছে পুতুল চেয়ে আবদার করা আর জীবন সঙ্গী আবদার করা দুটোর মধ্যে মাইল মাইল পার্থক্য রয়েছে!
আবেগে আপ্লুত অন্তি কেঁদে কেঁদে ততক্ষনে হেঁচকি তুলে ফেলেছে।‌ মেয়ের এমন কান্না দেখে নাহার এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে চেষ্টা করে। সাহেদ অস্হির হয়ে ওঠে। তার ছটফটে চঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ করে এমন ভেঙে পড়লো কেন? শাহিনকেও চিন্তিত দেখালো। তার বংশের তারা এই মেয়েটা। নিজের মেয়ের থেকেও বোদহয় এজন্য ভাইয়ের মেয়েটার প্রতি এত স্নেহ তার।

নাহার মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত ছুঁয়ে দেয়।

‘কাঁদে না পাগল মেয়ে। তুমি চা চাইবে সেটাই হবে। বাবাকে বলো তুমি কি চাও।’

মায়ের পরম স্নেহে অশান্ত মন শান্ত হয়ে আসে। ভাবনা চিন্তা ছাড়াই মেয়েটা তার মনের অত্যন্ত গোপন তথ্য তাদের নিকট পেশ করে।

‘আমি দিহান মির্জাকে পছন্দ করি। আমি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমার দিহান মির্জাকে চাই বাবা।”

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে