এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-৫+৬

0
747

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৫+৬
গত দুদিন ধরেই ছেলের সঙ্গে দিতি র কিছু গন্ডগোল চলছে, বুঝতে পারছেন রুমা, কিন্তু নিজে থেকে না বললে এ ব্যাপারে দিতি কে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না বলেই ভেবে রেখেছেন। কাল ছেলে যখন তার মোবাইলে ফোন করে দিতি কেমন আছে, জানতে চাইলো, তখনই আরও ভালো করে বুঝলেন সেটা। রান্না ঘর থেকে রাঁধুনির বানানো চা নিয়ে, স্বামীর চা দিয়ে, নিজেদের চা নিয়ে দিতি র ঘরে ঢুকলেন। অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছে মেয়েটা, ঘুমোচ্ছে নাকি এখনও!

কি রে ঘুমাচ্ছিস নাকি! ওঠ চা এনেছি!

দিতি এপাশ ফিরতেই চমকে গেলেন রুমা, কাঁদছিলো মেয়েটা!

কি হয়েছে তোর?

গলাটা নিজের অজান্তেই একটু গম্ভীর হলো, ছেলের ওপর খুব রাগ হচ্ছে এখন, এই সময়েও গন্ডগোল না করলে চলে না! শাশুড়ি কে সামনে দেখেই নিজের চোখের জল মোছার চেষ্টা করছিলো অদিতি, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না। দুদিন ধরে নিজের ভেতরে এতো বড় একটা কথা চেপে রেখে, হাসিখুশি থাকা একটুও সম্ভব হচ্ছে না আর।

অর্ক কিছু বলেছে নাকি তোকে? কাল ফোন করেনি?

নরম গলায় বলা কথাগুলো যেনো আরও কষ্টটা বাড়িয়ে দিলো দিতির, শাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরে দুদিনের চেপে রাখা কান্নাটা কেঁদে ফেললো ও।

মা, অর্ক অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ওর,

একদম চমকে গেলেন রুমা, অর্ক অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে চায়! এতো বড় কথা! এতদিনে কিছু বোঝেন নি তিনি! হটাৎ করেই অদিতির জন্যে খুব খারাপ লাগছে তাঁর, ইস মেয়েটা কতো কষ্ট চেপে রেখেছে নিজের ভেতরে। কিন্তু যথেষ্ট পরিণত মস্তিষ্ক তাঁর, দিতির মতো অল্প বয়স নয়, তাই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ব্যাপার টা ভেবে নিলেন তিনি। ছেলে কে এক্ষুনি ডেকে পাঠাতে হবে!

মা তুমি ওকে কিছু বলবে না, আমি তোমাকে জানিয়েছি বলে!!

কাঁদতে কাঁদতেই বলছিলো অদিতি, রুমা চুপ করে শুনলেন কোনো উত্তর দিলেন না, দিতির কথা শুনলেন ঠিকই কিন্তু যা করার উনি করবেন, দিতি কে কিছু জানতে দেবেন না এখন।

তুই চা খা, আসছি আমি,

ঘর থেকে বেরিয়েই ছেলে কে ফোন করলেন,

কি করছিস? ঘুম থেকে উঠেছিস?

সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠে বসেছিলো অর্ক, মায়ের গম্ভীর গলায় একটু ঘাবড়ে গেলো,

কি হয়েছে মা? তোমার গলা টা গম্ভীর কেনো!

বাবার শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে কাল থেকে, পারলে আজই বাড়ি আয় একটু, তোকে দেখতে চাইছেন,

বাবার শরীর খারাপ!! তার মানে নিশ্চয়ই খুব খারাপ, নাহলে মাত্র দুদিন আগেই এসেছে জানা সত্বেও মা আবার আসতে বলছে! আজ তো রবিবার, এমনিও যেতে অসুবিধা নেই, কাল না হয় ম্যানেজ করে নেবে কোনো ভাবে,

আচ্ছা, বেরোচ্ছি একটু পরেই,

ফোনটা নামিয়ে রেখেই চটপট রেডী হতে শুরু করলো অর্ক, দিতির জন্যেও যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো এমনিতেই।

ফোন নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই, স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন সমরেশ,

কি এমন হলো যে আমার অসুখের মিথ্যে কথা বলে তুমি ওকে ডেকে পাঠালে?

রুমা একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন, এসব কথা আদৌ স্বামী কে জানানো ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই সমরেশ মাথা নাড়লেন,

এটা ঠিক করছো না রুমা, ওদের সমস্যা ওদেরই মেটাতে দাও, তুমি এর মধ্যে ঢুকতে যেও না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে!

রুমা মাথা নাড়লেন,

কোনো কোনো সময় ঢুকতেও হয় গো! ওরা দুজনেই ছেলে মানুষ, কি বলতে কি করে কে জানে! ওদের ভুল বোঝাবুঝি গুলো আমরা যদি মিটিয়ে না দি, তাহলে তো সমস্যা আরো বাড়বে বৈ কমবে না।

বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেলো, দরজার বেল দিতেই মা দরজা খুলে দাঁড়ালো গম্ভীর মুখে, একটু চমকে গেলো অর্ক, বাবা কি খুবই অসুস্থ!

দুপুরে স্নান করে খেয়ে উঠে, একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল দিতি, সকালে শাশুড়ির কাছে কেঁদে মন টা একটু হালকা লাগছে। গত দুদিন ধরেই মনের মধ্যে যে চাপা কষ্টটা ছিলো সেটাও একটু কমে এসেছে। কোনো কোনো সময় যে কারো কারো কাছে মনের কথা বলাটাও জরুরী, সেটা এখন বুঝতে পারছে।

দুদিন ধরে কতো কি ভেবেছে ও, এমনকি বাচ্চাটা রাখবে কিনা, এরকম কথাও মনে হচ্ছিলো কোনো কোনো সময়! বেলের আওয়াজ শুনে ঘুম টা ভেঙে গেলো, কে এলো এই ভর দুপুরে! ঘরে ঢুকে আসা গলাটা শুনে অবাক হয়ে গেলো দিতি, অর্ক! ও কখন এলো! ও ফোন বন্ধ করে রেখেছে বলে কি এখানে চলে এসেছে!

বাড়িতে ঢুকেই সামনেই বাবা কে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো অর্ক,

কি হয়েছে বাবা তোমার? তুমি এখানে বসে আছো? খুব শরীর খারাপ? মা ফোন করলো আমাকে!

নাহ! আমি ঠিক আছি! তোর মা ডেকেছে তোকে, ঘরে যা আগে, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নে, তারপর কিছু কথা আছে তোর সঙ্গে।

কি এমন কথা, যে এইভাবে মা ডেকে পাঠালো ওকে, ওর খুব টেনশন হচ্ছিলো,

না পরে খাবো, আগে বলো কি হয়েছে, দিতি র শরীর খারাপ?

প্রশ্ন টা করতে গিয়েই গলাটা একটু কেঁপে গেলো, নিজেই বুঝলো সেটা! মা এবার ঘুরে তাকালো,

ঠিক আছে, তুমি যদি না খেয়েই শুনতে চাও, চলো তবে! ঘরে চলো, যা বলার দিতির সামনেই বলবো!

দিতি কি তবে দুদিন ধরে ফোন না করার গল্পটা বলে দিয়েছে মা কে, যা চিৎকার করছিলো কাল, শুনে ফেলা টাও কিছু বিচিত্র নয়। এই জন্যেই মা ডেকে পাঠিয়েছে ওকে! ভীষণ রাগ হচ্ছে এবার ওর, দিতি বড্ড ছেলে মানুষ মতো, সব কিছুই কি মা কে বলে দিতে হয়!

ঘরে ঢুকেই অদিতির মুখের দিকে তাকিয়ে ও চমকে গেলো, কি অবস্থা হয়েছে দু দিনের মধ্যে! ও তো সুস্থ করার জন্যে রেখে গিয়েছিলো এখানে, এ তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে! মনটা আবার খারাপ লাগছিলো, একটু আগের হওয়া রাগ টা কমে আসছে, নিজের ওপর রাগ হচ্ছে এখন, ওই বা যে কেনো ফোনটা যত্ন করে রাখতে পারে না! সামান্য ফোন না করার জন্যে এইরকম চোখ মুখের অবস্থা, মেয়েটা সত্যিই পাগল!

অর্কর গলা শুনে ঘুম থেকে উঠে বসেই, খারাপ লাগছিলো অদিতির। অর্ক নিজেই এসেছে, নাকি ওর মা ডেকে এনেছে ওকে! ও এতো বার করে বারণ করলো তাও মা শুনলো না! নিজের শরীর একটুও ভালো লাগছে না ওর, এখন আর কোনো তর্ক বিতর্কের মধ্যে যেতে ইচ্ছে করছে না।

ঘরে ঢুকে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অর্ক, দেখেই খুব অভিমান হচ্ছিলো অদিতির, এই ছেলেটা অন্য মেয়ে কে বিয়ে করতে চায়! এতদিন ধরে ও একেই ভালোবেসে এসেছে পাগলের মতো, এতো বোকা ও! না চাইতেও চোখে জল চলে আসছে, মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো অদিতি।

তুই অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে চাস?

মায়ের সরাসরি করা প্রশ্নে একদম চমকে গেলো অর্ক,

কি বললে? আমি কাকে বিয়ে করতে চাই?

অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তোর?

কি বলছে মা এসব! অর্ক কোনো কিছুই ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারছে না।

কে বলেছে এসব কথা তোমাকে?

অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো ও, মা দিতি র দিকে তাকিয়ে আছে,

তুমি বলেছো?

দিতি র দিকে ঘুরে তাকালো অর্ক,

এখন মায়ের সামনে সাধু সেজে আছো তুমি? ভাজা মাছ উলটে খেতে জানো না তাই না?

কেঁদে ফেলে বললো অদিতি, ও অর্কর এই নাটক গুলো কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।

আমি তোমাকে কখন বলেছি এইসব কথা?

এবার সত্যিই রেগে গেলো অর্ক, যা খুশি বলছে ও, মায়ের কাছে এইসব বানিয়ে বানিয়ে বলেছে ওর নামে!

তুমি বলোনি, তোমার বান্ধবী কে দিয়ে বলিয়েছো, তুমি নিজেই তো বলতে পারতে, নাকি সেই সাহস টুকুও তোমার নেই!

চিবিয়ে চিবিয়ে বললো দিতি, এখন আর শাশুড়ির সামনে ও কিছুই লুকিয়ে রাখতে চায় না। অর্ক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে, বান্ধবী! কোন বান্ধবী এই কথা বললো, ওর বান্ধবী বলেই যে কিছু আছে তাই তো মনে পড়ছে না।

তোকে অর্ক বলেনি? কে বলেছে তবে এই কথাগুলো?

এবার রুমা এগিয়ে এলেন, নিজেরও এখন একটু অস্বস্তি হচ্ছে, সব কিছু না জেনেই কি তাড়াহুড়ো করে ফেললেন! তিনি তো ভেবেছিলেন অর্কই কথাগুলো বলেছে দিতি কে!!

একটা মেয়ে ফোন করেছিলো আমাকে, এবার সব কিছুই কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেললো অদিতি। অর্ক অবাক হয়ে শুনছিল, ওর একটু একটু সন্দেহ হচ্ছে এখন। মাঝে মাঝেই টুকটাক ফোন না ধরা বা বন্ধ রাখা নিয়ে ঝামেলা হয় বটে দিতির সঙ্গে, কিন্তু তাই বলে এতো সন্দেহ বাতিক ও। সব কিছুই কি বানিয়ে বলছে ও।

মায়ের দিকে তাকালো এবার অর্ক,

মা, তুমি ওর কথায় এখানে ডেকে নিয়ে এসেছো আমাকে? বাবার কিছুই হয়নি তাহলে?

চিৎকার করে উঠলো অর্ক, কিছুতেই মাথা টা ঠান্ডা রাখতে পারছে না ও। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে প্রায় পাগলের মতো দৌড়ে এসেছে ও, আর এসে কি শুনছে! ও বিয়ে করতে চায় অন্য কোনো মেয়েকে! অদিতি তো পাগল, তা বলে মাও!

তোমার মনে হচ্ছে ও একটুও সুস্থ? ওর কথা শুনে তুমি ডেকে আনলে আমাকে! তোমার একবারও মনে হলো না আমি এরকম করতে পারি কিনা! ও সব বানিয়ে বলছে মা, কেউ ফোন করেনি ওকে। কিছু অন্তত বলতে বলো ওকে, নাম, ফোন নম্বর? ও কিছুই বলতে পারবে না। সব মনগড়া ওর, শুধু অহেতুক সন্দেহ। তোমার ইচ্ছে হয় তুমি শোনো বসে বসে, আমার সময় নেই। আমি জানি ও এগুলো কেনো করছে!

রুমা অবাক হয়ে তাকালেন,

কেনো করছে মানে? ইচ্ছে করে করছে নাকি!

হ্যাঁ, ইচ্ছে করেই করছে, শুধু আমাকে সবার সামনে অপদস্থ করার জন্যে, কেনো জানো? আমার একটাই অপরাধ,আমি আমার ফোনটা কাল খুঁজে পাচ্ছিলাম না, অন্যমনস্ক ভাবে রান্না ঘরে ফেলে এসেছিলাম, তাই ওকে ফোন করতে পারিনি। শুধু সেই জন্যেই সবার সামনে ও আমাকে ছোট করতে চায়, আর সেটা করতে গিয়ে যে কি মারাত্মক অভিযোগ ও করছে সেটা ও নিজেও বোঝেনি বোধহয়। ও পাগল হয়ে গেছে, আর তুমি সেই পাগলের কথা বিশ্বাস করে ওখান থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছো! কতটা টেনশন নিয়ে আমি ছুটে এসেছি তুমি ভাবতেও পারবে না সেটা! আর এক মুহুর্ত ও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার, এসব পাগলামি তুমি সহ্য করো,

আমার কাছে নম্বর আছে,

কাঁদতে কাঁদতে বললো অদিতি,

ঠিক আছে, ফোন করো তাহলে আমার সামনে! কথা বলাও আমার সঙ্গে! দেখি কে বলেছে এ কথা!!

অদিতি চুপ করে গেলো! ওর কাছে সত্যি কোনো প্রমাণ নেই!

দেখলে তো মা!! ও চুপ করে আছে দেখো! এখন আর কিছুই বলছে না!

হিংস্র চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলেই পিঠে ব্যাগটা তুলে নিয়েই মা কে আটকানোর সুযোগ না দিয়েই খালি পেটে আবার বেরিয়ে গেলো অর্ক।

বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো, ইতিমধ্যে মায়ের অনেকগুলো মিসড কল হয়েছে, ইচ্ছে করেই ধরেনি ও। অদিতি র সঙ্গে আর থাকতে পারবে না ও, রাস্তায় আসতে আসতে ঠিক করেই নিয়েছে, ভালোই হয়েছে মা নিজের চোখেই দেখেছে সব কিছু। ওকে আর ডিভোর্স দেবার জন্যে কোনো কারণ মা কে অন্তত বলতে হবে না। ও কি ভেবে গিয়েছিলো, আর কি হলো!

এই দুদিন আগে ও অদিতি কে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারতো না, আর এই মুহূর্তে আর কোনো দিনও একসঙ্গে থাকার কথা ভাবতে পারছে না। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সম্পর্কটাই একটা প্রশ্ন চিন্হ র মুখে এসে দাঁড়িয়েছে! এতো নোংরা মানসিকতা ওর, শুধু ফোন করেনি বলে নিজের সুবিধার জন্যে মায়ের কাছে ওকে ছোটো করতে গিয়ে, অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছে! এতো ছোট মন ওর, এইরকম মেয়ের সঙ্গে ও কি করে সারাজীবন কাটাবে! অদিতির এতো ভালো মানুষী ব্যাবহারের আড়ালে থাকা এতো নোংরা মন টা কে গত দেড় বছর ধরে একসঙ্গে কাটিয়েও চিনতে পারলো না ও, শুধু মুখোশ টাই দেখে গেছে এতদিন!

পেটে খাবার পড়ার পরেই মাথাটা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হচ্ছে, ফোন টা হাতে তুলে মা কে ডায়াল করলো অর্ক,

পৌঁছে গেছি, সরি রাগ হয়ে গিয়েছিলো তখন,

খেয়েছিস কিছু? এরকম রাগ দেখিয়ে না খেয়ে চলে যায় কেউ?

মায়ের কথায় মন খারাপ হচ্ছিলো ওর,

হ্যাঁ, অর্ডার করে দিয়েছিলাম, খেলাম এক্ষুনি, রাখছি এখন,

ফোন টা ইচ্ছে করেই রেখে দিলো তাড়াতাড়ি, না হলে মা হয়ত এক্ষুনি দিতি র সঙ্গে কথা বলতে বলবে। ওর সঙ্গে আর কোনোদিনও কথা বলবে না একদম ঠিক করেই নিয়েছে ও। রান্নার দিদি কে ছুটি দিয়েছিলো সকালে, তখন তো আর জানতো না, আজই ফিরে আসতে হবে। রাতের ডিনার হয়ে গেছে, তাই শুয়ে পড়লো ও, আজ সারাদিন খুব ধকল গেছে!

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শরীর টা খারাপ লাগছিলো, কাল থেকে মনের ওপর তো কম চাপ পড়েনি! আজ আর কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না, খানিকটা রিলাক্স হয়েই শুয়ে রইলো খাটে। রান্নার দিদি চা দিয়ে যাবার পর খাটে উঠে বসলো ও,

কাল চলে এলে দাদা? থাকলে না বাড়িতে?

না আমার কলেজ আছে তো, থাকার উপায় নেই,
হেসে বললো ও, যদিও আজ যাবেনা বলেই ঠিক করে নিয়েছে।

বৌদি ফোন করেছিলো দুদিন আগে,

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাকালো অর্ক, দিতি ওকে ফোন করেছিলো!

ঠিক করে সব কিছু তোমার করে দিচ্ছি কিনা জানতে চাইলো আমার কাছে, আমি বলেছি তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিতে,

ওর তাকানো দেখে উৎসুক গলায় বললো দিদি, ও হাসলো একটু, যাক! তাও খোঁজ করেছিলো, সন্দেহ করা ছাড়াও আরো কিছু করে তাহলে! দিদি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পরে একটু খারাপ লাগছে এখন, দিতি র জন্যে না হোক, বাচ্চাটার কথা ভেবেও ওর একটু খবর নেওয়া উচিত বোধহয়। কিন্তু ওকে ফোন করলেই আবার ওই একই জিনিষ শুরু করবে নতুন করে, তার থেকে মায়ের কাছে খবর নিয়ে নেওয়াই ভালো, সকাল বেলা থেকেই অশান্তি ভালো লাগে না একদম!

রেডি হোসনি এখনও? বাবা এসে গেছে তো,

বলতে বলতে বেয়াই কে সঙ্গে নিয়েই ঘরে ঢুকে এলেন রুমা, দিতি অবাক হচ্ছিলো। বাবা হটাৎ এখানে!! নিশ্চয়ই শাশুড়ি কালকের ঘটনার পরে বাবা কে খবর দিয়ে এনেছে!! ইস! বাবার শরীর খারাপ এমনিতেই, এখন এসব জানলে যে কি হবে কে জানে!! কিন্তু শাশুড়ি কোথায় যাবার কথা বলছেন সেটাই তো ও বুঝে উঠতে পারছে না!!

তাড়াতাড়ি তৈরি হ, অর্ক ফোন করেছিলো, ও আবার কলেজে বেরিয়ে যাবে, ডুপ্লিকেট চাবি আছে তো তোর কাছে?

তারমানে, বাবা কে নিয়ে অর্কর কাছে শাশুড়ি ওকে পৌঁছে দিচ্ছে!! মুখটা একদম শুকিয়ে গেল দিতির, ও এখন কি করে! বাবা কি সব জেনে গেছে, কিন্তু মুখ দেখে তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না, আর ও তো কিছুতেই অর্কর সঙ্গে থাকবেনা ঠিক করেই নিয়েছে। কিন্তু বাবার সামনে এগুলো কি করেই বা বলে এখন, এসব শুনলেই তো বাবা অসুস্থ হয়ে পড়বে!

যদি বাবা কে কিছু না জানতে দিতে চাস, তাহলে রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে একদম চুপ করে গাড়িতে বসে পড়,

ফিসফিস করে শাশুড়ির বলা কথাগুলোর মর্মার্থ ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিলো। মা তার মানে বাবা কে সামনে রেখে ওকে অর্কর কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে। কিন্তু ওরও তো এখন কিছুই করণীয় নেই আর, বাবা কে তো কিছুই বলতে পারবে না। তাই প্রবল অনিচ্ছা সত্বেও ও ব্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

ভাগ্যিস আপনি ছিলেন দাদা, নাহলে তো রাতে এতটা পথ একা ফেরা একটু মুশকিল হতো আমার পক্ষে। অর্কর বাবা যেতে পারলে কোনো অসুবিধা ছিলো না, কিন্তু ও তো যেতে চাইলো না, অগত্যা আপনিই ভরসা,

দিতি কে শুনিয়েই যে শাশুড়ি কথা গুলো বললো সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছিলো, ওখানে পৌঁছেও ওকে মুখ বন্ধ রাখতে হবে, কারণ বাবা তার মানে আবার শাশুড়ির সঙ্গেই ফিরবে, ওর আর ফেরার কোনো উপায় থাকবে না। কিন্তু অর্কর সঙ্গে ও কি করে থাকবে ওখানে কে জানে!

লিফট থেকে বেরিয়ে ব্যাগ থেকে ডুপ্লিকেট চাবিটা বার করতে গিয়েই দেখলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, তার মানে অর্ক কলেজে যায়নি আজ। এই সময়ে কলেজে না গিয়ে বাড়িতে কি করছে! আজ কি ও শাশুড়ির সামনেই হাতে নাতে ধরতে পারবে অর্ক কে! কে আসে ওর বাড়িতে, দিতি না থাকলে, কার জন্যে কফি বানায় অর্ক, আজ সব কিছুই ও প্রমাণ করে দেবে। কিন্তু ও কি সত্যি প্রমাণ করতে চাইছে! তাহলে ওর হাত পা কাঁপছে কেনো? কেনো মনে হচ্ছে ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় যেনো!

শাশুড়ি কে বেলে হাত না দিতে দিয়েই চাবি টা দরজায় লাগিয়ে ফেললো ও, বেল বাজিয়ে ওকে সতর্ক হতে দেওয়া চলবে না একদম। দরজা টা খুলে ভেতরে পা দিতে দিতেই বেড রুমের দিকে চলে গেলো চোখটা, ওই তো বিছানায় শুয়ে আছে অর্ক, সঙ্গে কে আছে ওর, জানতেই হবে আজ! প্রায় দৌড়েই বেড রুমে ঢুকে পড়লো দিতি, পেছন পেছন ঢুকে আসা বাবা আর শাশুড়ির কথা ও ভুলেই গেছে এই মুহূর্তে!

অদিতি কে ঘরে ঢুকে আসতে দেখেই প্রায় ভুত দেখার মতন উঠে বসলো অর্ক, দিতি! ও কি ঠিক দেখছে! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না ও।

তুমি ! এখানে!

গত দুদিনের ঝগড়া ভুলে চেঁচিয়ে উঠলো অর্ক, ও ঠিক দেখছে তো! দিতির চোখ এদিক ওদিক ঘুরছিলো তখন, নাহ! আর তো কেউ নেই! একটা অদ্ভুত শান্তি হচ্ছে মনটার মধ্যে, এটাই তো এতক্ষন ধরে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিলো ও। মিথ্যে হয় যেনো ওর ধারণা!

এখানে আসার জন্যে কান্না কাটি করছিলো, কি আর করা, ওখানে থাকতে না পারলে! এই অবস্থায় কান্নাকাটি ভালো নয় তাই না! তাই বাধ্য হয়েই দাদা কে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেলাম,

মায়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো অর্ক, ও সবটাই বুঝতে পারছে, কিন্তু দিতির বাবার সামনে কিছু বলার উপায় নেই। অসুস্থ মানুষ, এতদূর কষ্ট করে এসেছেন, তাই চুপ করেই থাকলো ও। রাতের খাবার বোধহয় করেই এনেছিলো মা বাড়ি থেকে, সেগুলো টেবিলের ওপর রাখলো।

একটু বসেই ওরা বেরিয়ে গেলো তাড়াতাড়ি, অর্কও আর আটকাতে চাইলো না, বাবা বাড়িতে একা আছে, তাছাড়াও অনেকটা রাস্তা ফিরতে হবে, মা বেরিয়ে যাবার পরে সোফায় এসে বসলো ও। মা জোর করে দিয়ে গেলেই যে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে না, এটা কি মা বুঝতে পারেনি! যে সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতাই নেই, সেই সম্পর্ক কোনো দিনও টিকে থাকে না।

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ৬
সামনের মাসে শান্তিনিকেতনের প্ল্যানটা ফাইনাল করনা প্লিজ!!

কলেজের ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিতে দিতে বললো শ্রেয়া, সবাই তৎক্ষণাৎ অনির্বাণের দিকে তাকালো। অনির্বাণ আজ সকাল থেকেই একটু চুপ চাপ, বন্ধুদের তাকানো দেখেই দ্রুত মাথা নাড়লো,

আমাকে জড়াস না প্লিজ!! আমি বাবার কাছে গাড়ি চাইতে পারবো না!!

তিয়াসা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, অনির্বাণটা যা, এক্ষুনি যে হ্যাঁ বলে দেয় নি তাই রক্ষ্যে। বার দুয়েক ওর গাড়িতে গেছে ওরা, গাড়িতে যাওয়া মানেই তো ওদের ড্রাইভারটা হা করে লুকিং গ্লাসের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে থাকবে ওদের দিকে, মাঝে মাঝে এমন বিরক্তি লাগে না!! ক্ষমতা থাকলে ও চোখটাই গেলে দিতো, বেশ কয়েকবার অনির্বাণ কে বলেছেও সে কথা। অনির্বাণ ভয় পায়,

বাবার কাছে কেস খাওয়াবি নাকি!! ওই বুড়োটা বাবার রিপোর্টার জানিস না?

অনির্বাণের সরাসরি না বলে দেওয়াতে প্ল্যানটা একটু ধাক্কা খেলো, তিয়াসা তৎক্ষণাৎ রিয়ার দিকে তাকালো,

একবার তোর গাড়ি নিয়ে চল না!! প্রতিবারই তো অনির্বাণের গাড়ি নিয়েই যাওয়া হয়!!

রিয়া মাথা নাড়লো, শুকনো মুখে বললো,

বাবা কে না জানিয়ে কি করে নিয়ে যাবো বল তো? গাড়ি নিয়ে গেলেই তো বাবা সব জানতে পেরে যাবে!! তখন মাঝখান থেকে মাও বকুনি খাবে, চল না ট্রেনেই যাই।

তিয়াসা বিরক্ত মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো, সব সময় অনির্বাণের গাড়ি নিয়েই যাওয়া হয়। রিয়ার মুখে শুধু বড়ো বড়ো কথা!! খরচা করার সময় সবচেয়ে আগে ওই পিছিয়ে যায়!! শ্রেয়া এতক্ষন চুপ করেছিলো, প্ল্যান প্রায় ভেস্তে যাচ্ছে দেখে এবার মুখ খুললো,

চল, ট্রেনেই যাই না হয়!! তবু চল তো! আর কয়েক মাস পরেই তো পরীক্ষা, তারপর কে কোথায় যাবো কে জানে!!

কথা শেষ হবার আগেই কৌশিক ঢুকলো, সবার দৃষ্টি কৌশিকের দিকে ঘুরল, রিয়া ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

তুই যাবি তো?

কৌশিক একটু থতমত খেলো, কি প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে বুঝতে না পারলেও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। কৌশিক কে মাথা নাড়তে দেখে তিয়াসা একটু শ্লেষের গলায় বললো,

বাবা! কিছু না জেনেই হ্যাঁ বলে দিলি, হেব্বি প্রেম ভাই!!

কৌশিকের মুখে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠলো, নিজেকে সামলে নিয়ে সংযত গলায় বললো,

তুই এতো সব ব্যাপারেই কিছু মানে খুঁজে নিস কেনো বলতো? এটা তুই যদি বলতিস না, তাহলেও আমার উত্তর হ্যাঁ ই হতো!! অতো ভেবে চিন্তে কথা বলিনা তোর মতো!!

তিয়াসা প্রায় জ্বলে উঠলো,

আমি কি এমন ভেবে কথা বলি রে?

বলিস না ? আচ্ছা, আমারই ভুল হয়েছে তবে!! শুনতে তো পাই অনেককিছুই, কে কার সঙ্গে যাবে, কে কার গাড়িতে যাবে, কে কোথায় নামবে, সব কিছুই নাকি তুই আজকাল দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করছিস!!

অনির্বাণ দীপের দিকে তাকালো, সেদিনের মেট্রোর ওদের কথোপকথন তাহলে জায়গামতোই পৌঁছে গেছে! শ্রেয়া মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছিলো, দীপটা আবার ওর নাম নিয়ে কিছু বলে নি তো! তিয়াসার যা মুখ!! আর এগোতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো শ্রেয়া,

আমার একটু লাইব্রেরী যাওয়ার আছে, দীপ চল না প্লিজ!

দীপ এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো, কৌশিক যে এরকম হাটে হাঁড়ি ভেঙে ফেলবে, এটা ও একদম ভাবতে পারে নি, তাড়াতাড়ি শ্রেয়ার পিছু ধরলো,

হ্যাঁ, চল।

পরিস্থিতি একটু জটিল হয়ে গিয়েছিলো, দীপ আর শ্রেয়া বেরিয়ে যাওয়ার পরেই কৌশিক, রিয়া কে ডেকে নিয়ে ওদের পিছু ধরলো, ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে অনির্বাণ একটু রাগের গলায় বললো,

ঠিক করেছিস!

তুই তো বেশি আদিখ্যেতা দেখাস! কতোবার বলেছি তোকে, ওদের গাড়িতে চড়ানোর, বাড়িতে ডাকার কোনো দরকার নেই। তবু তুই ডাকবি!!

আর কোনো দিনও ডাকবো না!! যা করেছে না!! বাবা হেব্বি খোচে আছে ভাই!! সেদিন গিয়ে ওদের মধ্যে কেও একটা নিচে আমাদের দোকান থেকে নাকি কোনো এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে ফোন করে ইয়ার্কি মেরেছে, যা তা কান্ড!

তুই কি করে জানলি? কে দেখেছে ফোন করতে?

একটু অবাক গলায় প্রশ্ন করলো তিয়াসা, অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

আরে, কেও দেখেনি! ওটাই তো আসল সমস্যা! বাবা নাকি কিছুক্ষনের জন্যে দোকান থেকে ওপরে এসেছিলো, সেই সময় যে দুটো ছেলে থাকে দোকানে, ওরাও ছিলো না। বাবা যদিও ভদ্রমহিলা কে উল্টে থ্রেটনিং দিয়েছে, কিন্তু উনি নাকি বলেছেন যে উনি ইনকামিং নম্বর দেখেই রিং ব্যাক করেছেন। এবার বাই চান্স যদি পুলিশের কাছে সত্যি চলে যায়, তাহলে আমাদের দোকানের রেপুটেশন পুরো নষ্ট হয়ে যাবে।

কিন্তু ওরাই যে এটা তুই কি করে সিওর হচ্ছিস? দেখে তো নি কেউ!

অনির্বাণ ঘাড় নাড়লো,

সেখানেই তো প্রবলেম, তাই তো ডাইরেক্ট কিছু বলতে পারছি না। বাবা তো আর জানতো না যে তোরাও নিচে নেমেছিলি, বাবা তাই বোন কে সাসপেক্ট করছিলো, ও ছাড়া আর তো বাড়িতে অল্পবয়সী মেয়ে কেউ নেই। আমি তো তারপর তোদের সঙ্গেই স্যারের বাড়িতে চলে গিয়েছি, জানিই না কখন এসব হয়েছে! এসেও শুনি নি আর কিছু। কাল সকালে দেখি মা বোন কে খুব বকাবকি করছে, তখন বোনই বললো, যে বাবা যে সময়ের কথা বলেছে তখন নাকি তোরাও বাড়িতে ছিলি!! ও নাকি তোদের সবাইকেই বার দুয়েক নিচের দিকে যেতে দেখেছে,

তুই আমাকেও সন্দেহ করছিস নাকি? ইস! আমার খুব খারাপ লাগছে!! বিশ্বাস কর, আমি কিন্তু এরকম কিছু করিনি, নিচে নেমেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেটা জাস্ট এমনই।

অনির্বাণ তাড়াতাড়ি তিয়াসার হাতটা ধরে ফেললো,

আরে ধুর! তোকে সন্দেহ করলে আর তোকে বলতাম নাকি! তুইও পারিস! আমার তো শ্রেয়া কে সন্দেহ হয়, ওই এরকম উল্টোপাল্টা ইয়ার্কি মারে সব সময়!! ফার্স্ট ইয়ারে একবার কৌশিকের ফোন থেকে কোন একটা রান্ডম নম্বরে ফোন করে একটা মেয়ের গলা শুনে কৌশিক কে ফাঁসিয়ে ছিলো, মনে আছে?

তিয়াসা মাথা নাড়লো, একটু অন্য মনস্ক গলায় বললো, রিয়াও হতে পারে। ও ও কিন্তু প্রচুর মিথ্যে কথা বলে, আমি লক্ষ্য করেছি। দীপ সেদিন ঠিকই বলেছিলো, ও যদি সত্যিই বড়লোক হতো, তাহলে মেট্রোয় যেতো না!

ছাড়! এখন চুপ করে থাকা ছাড়া অন্য কোনো অপশন নেই! প্রমাণ ছাড়া কাউকে ব্লেম করা যায় না! সমস্যা একটাই, যদি ভদ্রমহিলা সত্যিই পুলিশে চলে যান, তাহলে কি হবে কে জানে! বাবার সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে তখন, যেই করুক না কেনো, আফটার অল ফোনটা আমাদের দোকানের নম্বর থেকেই তো গিয়েছে!

পুলিশে যেতে পারে মহিলা? এতোটা বাড়াবাড়ি করবে! সামান্য একটু ইয়ার্কি মারার জন্যে!

শুকনো গলায় বললো তিয়াসা, অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

যায় না কেউ সাধারণত, তবে ভদ্রমহিলা যেতে চাইছিলেন! জানি না কেনো! বলেছেন ওনাকে নাকি কিছু ব্যক্তিগত কথা বলেছে কেউ!

রান্ডম নম্বরে কল করলে কেউ ওনাকে কিভাবে চিনবে যে, ব্যক্তিগত কথা বলবে?

বিস্মিত গলায় বললো তিয়াসা,

সেটাই তো অবাক লাগছে! তারমানে কেউ চেনা নম্বরেই কল করে ইয়ার্কি মেরেছে! কি বলেছে সেটা জানতে পারলে ব্যাপারটা অনেকটা ক্লিয়ার হতো, কিন্তু সেটা উনি বলতে চান নি।

তাহলে এই মুহূর্তে তো অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই! তুই এই অবস্থায় কাকুর কাছে গাড়ি চাইতে যাস না কিন্তু কিছুতেই, সে ওরা তোকে যতোই বার খাওয়াক!

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

পাগল! কেউ চায় নাকি আর! আমাকেই বাড়ি ছাড়া হতে হবে তাহলে!

কি হলো? ক্লাস শেষ না তোর? বাড়ি যাবি না? নাকি বউ নেই বলে আর বাড়িতে ঢুকতে চাইছিস না,

টিচার্স রুমের চেয়ার টেনে অর্কর পাশে বসতে বসতে হেসে বললো অরিন্দম, অর্ক মাথা নাড়লো,

অদিতি চলে এসেছে রে!

অরিন্দম একটু চমকে উঠলো,

চলে এসেছে! কেনো? এই তো দুদিন আগেই তুই দিয়ে এলি। বললি যে মাস খানেক থাকবে এখন! শরীর খারাপ নাকি?

ফাঁকা টিচার্স রুমের চারপাশটা দেখে নিয়ে অর্ক মাথা নামালো, নিচু গলায় বললো,

বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না! অদিতি পুরো পাগল হয়ে গেছে, কি সব উল্টোপাল্টা বলেছে মা কে! আমি নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই! ওকে নাকি কেউ ফোন করে বলেছে! লাইফটা একদম হেল হয়ে গেছে!

অরিন্দম অবাক হয়ে তাকালো,

মাসীমা বিশ্বাস করলেন এসব কথা?

কে জানে! প্রথমে তো করেছিলো, এখন বোধহয় একটু একটু বুঝতে পারছে, তাই নিজেই এসে দিয়ে গিয়েছে কাল!

অদিতি তো এরকম ছিলো না! হটাৎ এরকম করলো কেনো? কেউ ওকে সত্যিই ফোন করে কিছু বলে নি তো?

একটু চিন্তিত গলায় বললো অরিন্দম, অর্ক প্রায় জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো,

তুইও! কে এসব বলবে বলতো? কার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? ঘটনাটা অন্য! আমি ওকে একরাত ফোন করিনি তাই! দেখিস নি আগে এটা! ফোন না ধরলেই কি রকম চিৎকার চেঁচামেচি করতো!

সে ওর টেনশন হতো তাই! তাই বলে এরকম কথা বলবে? আর তুই বা করিস নি কেনো ফোন? এতো ইরেস্পন্সিবল না তুই! অহেতুক ঝামেলা তৈরি করিস!

আরে! ইচ্ছা করে করিনি নাকি! ফোনটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না ভাই! তারমধ্যে কখন আবার সাইলেন্ট করে দিয়েছিলাম কে জানে!

অর্কর উত্তরে বিরক্ত হলো অরিন্দম,

তো সেটা কে কি বলে? ইরেস্পনসিবলই তো? নিজের বাড়িতে ফোন হারিয়ে ফেললি? আর এই সাইলেন্ট মোডে রাখা নিয়ে তো তোদের আগেও ঝামেলা হয়েছে, তাও রাখিস কেনো? ক্লাস শেষ হলে ঠিক করে নিতে পারিস না!

অর্ক চুপ করে থাকলো, খানিকক্ষন পরে মনমরা গলায় বললো,

বিশ্বাস কর, শুধু বাচ্চাটার জন্যে! না হলে আমার সত্যি আর অদিতির সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে না!! ভুল করেছি এটা মেনে নিয়েও বলছি, একটা ফোন না ধরার শাস্তি কখনই এতো বড়ো অপবাদ হতে পারে না! বাবা, মা সবার সামনে এমন সিন ক্রিয়েট করলো না! একদম ছোটো লাগছে নিজেকে!

শোন! ভুল তো দুজনেই করেছিস! আর এটা নিয়ে টানিস না! বাচ্চাটার কথা ভেবেও তো তোদের গন্ডগোল মিটিয়ে নেওয়া উচিত! আমার একজন খুব ক্লোজ বন্ধু আছে, খুব ভালো কাউন্সিলিং করে! একবার কথা বলে দেখতে পারিস, ফোন করি?

কাউন্সিলর! কাউন্সিলর কি করবে? অদিতি এসব ইচ্ছা করে করছে!

বিরক্ত গলায় বললো অর্ক, অরিন্দম ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটু চিন্তিত হয়ে বললো,

কিন্তু কেনো করছে সেটাও তো জানা দরকার, তাই না? এতদিন তো এরকম কিছু করে নি! একবার কথা বলে দেখতে ক্ষতি কি!

অর্ক কে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নম্বরটা ডায়াল করে ফেললো অরিন্দম। উল্টোদিকের কথা শুনতে না পেলেও অরিন্দমের বিস্তারিত বিবরণ শুনলো অর্ক, প্রায় মিনিট পনেরো কথার পরে ফোনটা নামিয়ে রেখে অর্কর দিকে তাকালো অরিন্দম,

শোন! সাথী মানে আমার বন্ধু বললো, দুটো ব্যাপার হতে পারে! হয় সত্যিই কেও ওকে ফোন করেছিলো, অথবা ওর মানসিক সমস্যা হচ্ছে, প্রেগন্যান্সি তে নাকি কারো কারো হয় এগুলো। আমি কথা বলে নিয়েছি, দু একদিনের মধ্যেই অদিতি কে নিয়ে চলে যা! যদি সত্যি মানসিক সমস্যা হয়ে থাকে প্রেগন্যান্সির জন্যে, তাহলে কিন্তু অবশ্যই কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলা উচিত। না হলে পরে আরো বাড়তে পারে!

প্রেগন্যান্সির জন্যে মানসিক সমস্যা হতে পারে! অর্কর হটাৎ করেই খুব খারাপ লাগলো অদিতির জন্যে, ও কিছু না ভেবেই সত্যি খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে! তাড়াতাড়ি চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো অর্ক, ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে!

অরিন্দমও উঠে দাঁড়ালো, ওর ক্লাসও শেষ হয়ে গিয়েছিলো, দুজনে একসঙ্গে মেট্রোর দিকে এগোলো। মেট্রো থেকে নামার আগে অর্কর দিকে তাকিয়ে বলে গেলো অরিন্দম,

কি হলো জানাস কিন্তু, একটু বুঝিয়ে বলিস অদিতি কে। ও রাজি হলে কালই চলে যাস সাথীর কাছে।

অর্ক মাথা হেলাল,

হ্যাঁ, জানাচ্ছি তোকে!

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে