এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১৯+২০

0
775

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৯+২০
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার পরে ভদ্রমহিলা, কৌশিক এবং অরিন্দম কে নিয়ে একটা উবের বুক করে অর্ক বেরিয়ে পড়লো, রাস্তায় যেতে যেতে রিয়ার মা কে বললো,

শ্বশুর বাড়িতে খবর দিয়েছেন?

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন,

দিয়েছি স্যার, ওর বাবা কে ফোন করে দিয়েছি। আসবে না হয়তো, ওই মহিলা আসতে দেবে না ওকে, তবু সম্পর্কটা তো আর অস্বীকার করতে পারি না! তাছাড়া মেয়ে বাবা অন্তপ্রাণ, যদি পরে জানে বাবা কে খবর দিই নি , তাহলে বাড়িতে বিরাট অশান্তি বাধবে! আসা না আসা ওর ব্যাপার! আমি আমার কর্তব্য করেছি! যদিও বুঝতেই পারছি, বাবার সঙ্গেই কিছু গন্ডগোল হয়েছে আজ! তাও বলে দিলাম! সারাজীবন তো দোষের ভাগী ই হয়েছি সবার কাছে! শাশুড়ি, ননদ বলে স্বামী কে আটকে রাখতে পারিনি, মেয়ে বলে তোমার জন্যে আমাকে ঠাম্মা, পিসিকে ছেড়ে আসতে হয়েছে! হাসব্যান্ড বলে আমি নাকি বিলো স্ট্যান্ডার্ড! আজ যদি এই খবর টা না দি, শেষ পর্যন্ত আমার ওপরেই দোষ পড়বে!

রিয়ার মা নেমে যাওয়ার পরে কৌশিক কে থ্যাংকস জানালো অরিন্দম, অর্ক দুজনেই,

খুব ভালো একটা কাজ করলে কৌশিক, একটা মানুষের জীবন বাঁচানো! এর থেকে ভালো কিছু আর হতেই পারে না!

কৌশিক মাথা নাড়লো,

অতো ভেবে কিছু করিনি স্যার! সেই মুহূর্তে মাথায় যা এসেছে, তাই করেছি! তবে অনির্বাণের কাছে অ্যাড্রেস না পেলে কিছুই করতে পারতাম না! একটা থ্যাংকস ওরও প্রাপ্য!

তুমি রিয়া কে পছন্দ করো কৌশিক? সরি! একজন টিচার হয়ে হয়ত এই কথাটা তোমাকে জিজ্ঞেস করা আমার শোভা পায় না, তবু এই জন্যেই জানতে চাইলাম, কারণ একমাত্র তোমাকেই ও মেসেজটা করেছে! তার মানে তোমাকেই একমাত্র বন্ধু বলে মনে করে!

করি স্যার! কিন্তু ও বলে ওর বাবা আমাকে মেনে নেবে না!

অরিন্দম এর প্রশ্নে মাথা নামিয়ে নিয়ে বললো কৌশিক।

প্রথমে অরিন্দম তারপরে কৌশিক, দুজনকে পর পর নামিয়ে অর্ক যখন বাড়িতে ঢুকলো তখন প্রায় রাত দুটো। রিয়ার সুইসাইড করার চেষ্টার কারণ যে ও নয় ওর বাড়ির অশান্তি এটা ভেবেই মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিলো ও, বেল বাজাতেই অদিতি এসে দরজা খুললো,

মেয়েটা কেমন আছে এখন?

ভালো, কালকের দিনটা রেখে ছেড়ে দেবে হয়তো!

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো অর্ক, রাত অনেক হয়েছিলো, তাই অদিতি আর কথা বাড়ালো না। অর্ক হাত মুখ ধুয়ে এসেই শুয়ে পড়লো, ঘুমোতে অনেক দেরি হওয়ায় সকালে উঠতেও দেরি হলো। অদিতি চা নিয়ে এসে অর্ক কে ঘুম থেকে ওঠালো,

ওঠো, কলেজের দেরি হয়ে যাবে!

উঠে বসেই মাথায় হাত দিলো অর্ক,

মাথাটা ধরে আছে খুব, আজ আর কলেজে যাবো না!

চা খেয়ে কৌশিক কে ফোন করে রিয়ার খবর নিয়ে, অরিন্দম কে কলেজে না যাওয়ার কথা জানিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লো ও। অদিতিও ছেলে কে সমরেশের কাছে দিয়ে এলো, যাতে অর্কর অসুবিধা না হয়। বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ দরজার বেল বাজলো, অদিতি দৌড়ে এসে দরজা খুললো, দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে একজন আধুনিকা অল্প বয়সী মহিলা, অদিতি কে দেখেই হাত তুললেন,

নমস্কার, মিস্টার মিত্র আছেন?

অদিতি একটু অবাক হলো, প্রতি নমস্কার জানিয়ে ভেতরে সোফার দিকে ইঙ্গিত করলো,

বসুন, ডেকে দিচ্ছি! শরীরটা একটু খারাপ ওর, ঘুমাচ্ছে!

ভদ্রমহিলা ঘাড় নাড়লেন,

স্বাভাবিক! যা চলছে আপনাদের! এই অবস্থায় মানুষ আর সুস্থ থাকবে কি করে!

অদিতি অবাক চোখে তাকালো,

মানে? কি চলার কথা বলছেন আপনি?

এই পিংকি মানে রিয়ার কথা বলছি! শান্তিতে থাকতে দেয় কাউকে! আমার জীবনটাও তো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করছে একদম!

রিয়া কে আপনি চিনলেন কি করে?

ভদ্রমহিলা হাসলেন,

বলতেও খারাপ লাগে, তবু সম্পর্ক তো অস্বীকার করতে পারিনা কিছুতেই! সুবোধ আমার খুব ক্লোজ, একসঙ্গেই থাকি আমরা। যতোই হোক সুবোধের মেয়ে তো! আমার মেয়ে বলেও মনে করি আমি! কিন্তু ও আমাকে মায়ের জায়গা দেয় কই আর!

দিতি তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিলো মহিলা কে,

আপনি একটু বসুন, আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি!

ঘরে গিয়ে দেখলো অর্ক খাটে এপাশ ওপাশ করছে, সম্ভবত বেলের আওয়াজ এই ঘুম ভেঙে গিয়েছে। ওকে দেখেই বললো,

কার সঙ্গে কথা বলছিলে? এই সময় কে বেল বাজালো?

শোনো না! একজন মহিলা এসেছেন! কথা শুনে মনে হলো তুমি বলেছিলে না রিয়ার বাবা একজন মহিলার সঙ্গে থাকেন! ইনিই সম্ভবত সেই মহিলা!

নিচু গলায় বললো অদিতি, অর্ক লাফ দিয়ে খাটে উঠে বসলো,

এখানে! কি করতে!

দ্রুত পাঞ্জাবি পাজামা গলিয়ে ড্রইংরুমে এসে অর্ক দেখলো, ভদ্রমহিলা বসে আছেন, ওকে দেখেই নমস্কার জানিয়ে হাসলেন। উল্টোদিকের সোফায় বসতে বসতে গম্ভীর গলায় বললো অর্ক,

আপনি আমার বাড়ি চিনলেন কি করে?

মহিলা হাসলেন,

আপনি স্টুডেন্টদের মধ্যে যথেষ্ট পপুলার স্যার, আপনার ঠিকানা পাওয়া খুব কঠিন নাকি!

বলুন কি জন্যে এসেছেন?

অর্কর গম্ভীর গলা বোধহয় মহিলার নজর এড়ালো না, মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। অর্কর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

কিছুটা আমার প্রয়োজনে, বাকিটা আপনার!

অর্কর ভ্রু কুঁচকে গেল, দিতি চা করতে যাবে কিনা মনস্থির করতে না পেরে এক গ্লাস জল টেবিলে রাখলো। ভদ্রমহিলা জলের গ্লাস তুলে চুমুক দিলেন, গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন,

শুনেছি প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারছেন না আপনারা!! কল টা রেকর্ড করে রাখেন নি তো তখন! আমাকেও ফোন করে মাঝে মধ্যেই উল্টোপাল্টা কথা বলে অপমান করে ও! আমি সব কল রেকর্ড করে রাখি, আপনি চাইলে আমার রেকর্ডগুলো দিতে পারি, আপনি ওগুলো পুলিশ কে দিয়ে বলতে পারেন যে এই জিনিস ও আরো অন্যের সঙ্গেও করেছে!

শুনেছেন! কার কাছে শুনেছেন? আর এতে আপনার লাভ?

অর্কর কথায় মহিলা মাথা নাড়লেন,

এসব খবর কি আর চাপা থাকে! বাতাসে ছড়ায়! তবে লাভের কথা বলছিলেন না? নাহ! লাভ কিছু নেই! জাস্ট খারাপ লাগা থেকে হেল্প করতে চাইছি বলতে পারেন!! আসলে এই অপমান তো আমিও সহ্য করি রোজ, তাই আপনাদের কেমন লাগছে বুঝতে পারছি!!

আপনি পুলিশে যান না কেন?

যেতে তো চাই! কিন্তু ওই যে সুবোধ! মেয়ে অন্ত প্রাণ! শুধু মেয়ে মেয়ে করেই তো এতো বছরেও ডিভোর্স দিতে পারলো না বউ কে! অথচ বউ কে দেখুন, ওকে পাত্তাই দেয় না! ওর টাকা নিতে ঘেন্না লাগে, নিজের মুখে বলে গেছে আমার ফ্ল্যাটে এসে! তারপরেও মেয়ের হাতে লুকিয়ে টাকা দিয়ে আসে! আর মেয়েও তেমনি, বাবার সঙ্গে থাকে না, কিন্তু টাকা, পয়সা নিতে ছাড়ে না! মায়ের আর কতো টাকা আছে! ওই তো একটা প্রাইভেট স্কুলের প্রাইমারি সেকশনের টিচার! সব আবদার তো বাবাই পূরণ করে! মাঝে মাঝেই দেখুন না বাবার কাছে গাড়ি চেয়ে পাঠায়, এককথায় ড্রাইভার সমেত গাড়ি দেয় বাবা, কোনোদিনও না বলে না!

অর্ক মহিলা কে থামিয়ে দিলো,

আপনাদের ব্যক্তিগত কথা আলোচনায় আমার কোনো রুচি নেই!

মহিলা মুখ শক্ত করলেন,

ব্যক্তিগত নয় এগুলো! আপনি পুলিশে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন, তাই বলছিলাম! এই যে আমাকে ফোনে এতো অপমান করে, তাও ওর বাবা কিছু করে না! আমার সহ্যেরও তো সীমা আছে বলুন! কাল দুপুরে এসে বলে কিনা বাবার সঙ্গে থাকবে! মায়ের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না, তো ঠাকুমার সঙ্গে থাক, তা না! আমার প্রাইভেসি বলেও তো কিছু আছে নাকি!! নিজের একটা মেয়ে আছে আমার, আবার আর একজনের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব বলুন? সুবোধ প্রায় রাজি হয়ে যাচ্ছিলো, আমি তখন আপত্তি করেছি! যে আমাকে প্রতি নিয়ত আজেবাজে কথা বলে ফোনে অপমান করে তাকে আমি কিছুতেই আমার কাছে রাখবো না! চলে যেতে বলেছি বলে সে তার কি রাগ! সুবোধ কিছু টাকা দিয়েছিলো, সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলো, ও নাকি আর কখনো বাবার টাকা ছোঁবে না!

এবার অদিতি এগিয়ে এলো,

এগুলো আপনার ব্যক্তিগত কথাই! আপনাদের সম্পর্কের জটিলতায় আমরা ঢুকতে চাই না! যার সম্পর্কে এই কথাগুলো বলছেন, সে যে কাল সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলো সেটা জানেন নিশ্চয়ই! জেনেশুনেও মেয়েটার ওপরে আপনার কোনো সিম্পথী আসছে না! এতদিন আমার রিয়ার ওপরে সত্যি খুব রাগ হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো সত্যি ওর শাস্তি চাই! কিন্তু আজ আপনাকে এখানে দেখে ওর জন্যে খারাপ লাগছে! একটা অল্পবয়সী মেয়ে, যার জীবনে এখনো অনেক কিছু করার আছে, সে কতো কষ্ট পেলে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে সেটা এখন বুঝতে পারছি!

মহিলা মাথা নাড়লেন,

আপনাদের অভিরুচি! তবে আর একটা ছোট্ট প্রস্তাব ছিলো, ফ্ল্যাট টা খুব ছোটো আপনাদের, বাবা, মাও তো সঙ্গে থাকেন দেখছি! ছেলে বড়ো হচ্ছে, এবার ওরও একটা ঘর লাগবে, এতো লোক একসঙ্গে থাকতে অসুবিধা হয় নিশ্চয়ই। আমার ভগ্নিপতির প্রমোটিং এর বিজনেস, যদি চান তাহলে একটা বড়ো ফ্ল্যাট অনেকটা সস্তায় করে দিতে পারি, বাইপাসের ওপরে বড়ো একটা কমপ্লেক্স করছে ও!

রাগে গা রি রী করে উঠলো অদিতির, মহিলা সরাসরি ঘুষ দিচ্ছে!

ফ্ল্যাট কেনার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে, এ ব্যাপারে অন্যের সাহায্যের দরকার নেই! আপনি সম্ভবত আমাদের ঘাড় ভেঙে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চাইছেন, যে কাজটা আপনি ওর বাবার জন্যে করতে পারেন নি এতদিন সেটা আজ এই সুযোগে আমাদের দিয়ে করিয়ে নিতে চাইছেন, তাই না? আর ঠিকই বলেছেন, আগের বার কল রেকর্ড করে রাখিনি বলেই কিছু প্রমাণ করতে পারিনি আমরা, কিন্তু আজ আর সে ভুল করিনি। আপনার সব কথাই ভিডিও করে রেখেছি আমি, আপনি যে আমাদের ফ্ল্যাটের লোভ দেখিয়ে একটি বাচ্চা মেয়ে কে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন এটাই পুলিশে অভিযোগ জানানোর জন্যে যথেষ্ট, হাতের মোবাইল টা মহিলার দিকে তুলে ধরে বললো অদিতি।

মহিলা চুপ করে গেলেন, ভয়ে, অপমানে মুখ লাল হয়ে উঠলো, অর্ক সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত জোড় করে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললো,

আমার স্ত্রী কি বলেছেন সেটা বুঝতে পেরেছেন আশাকরি! রিয়া আমার ছাত্রী, ব্যক্তিগত ভাবে ওকে না চিনলেও একজন স্টুডেন্ট হিসেবে গত তিন বছর ধরে চিনি! যথেষ্টই হাসিখুশি মেয়ে, ওর জীবনে এতো জটিলতা আছে আগে কোনোদিনও বুঝিনি! এতো কিছু জানার পরে একজন শিক্ষক হিসেবে ওর আর কোনো ক্ষতি করতে চাই না। ভবিষ্যতে আপনি এরকম কোনো প্রস্তাব নিয়ে আর আমার বাড়িতে আসবেন না আশা রাখি, যদি আসেন তাহলে এই ভিডিও টা আমরা পুলিশের কাছে দিতে বাধ্য হবো!

ভদ্রমহিলা থমথমে মুখে বেরিয়ে গেলেন, এতক্ষনে সমরেশ আর রুমাও বেরিয়ে এসেছিলেন কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনে, অদিতি ধপ করে সোফায় বসে পড়লো,

কি সাংঘাতিক মহিলা! নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে কোথা থেকে অ্যাড্রেস নিয়ে এখানে চলে এসেছে! মেয়েটা কে ফাঁসাতে চায়! কি অদ্ভুত এই দুনিয়া, তাই না! আমার এখন রিয়ার জন্যেই খারাপ লাগছে! বেচারা মেয়েটা জানেও না ও আর একটু হলেই কতো বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছিলো! এই যাহ! মহিলার নামটাই তো জানা হলো না!

ছাড়ো তো! ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করিনি! ওই রকম নোংরা একজন মহিলার নাম জানার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই!

অর্ক পাশ থেকে বলে উঠলো, রুমা মাথা নাড়লেন,

সত্যিই নোংরা মহিলা! একটা সন্তান সম মেয়ের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে! নাই বা হলো নিজের, তাই বলে একটা বাচ্চা মেয়ের জন্যে কোনো ফিলিংস থাকবে না! আর বাবা, মায়ের সম্পর্কের জটিলতা কিভাবে সন্তানদের ওপর প্রভাব ফেলে দ্যাখ! রিয়া একটা বাচ্চা মেয়ে, কোথায় হেসে খেলে আনন্দ করে বেড়াবে, তা নয়, উল্টোপাল্টা কাজে সময় নষ্ট করছে! কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না! কার দোষ দেবো! বাবা, মায়ের!! নাকি সন্তানের!!

সমরেশ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

দোষ কারো নয় রুমা, দোষ পরিস্থিতির! বাবা, মায়েরও হয়ত নিজেদের মতো বাঁচার অধিকার থাকে! কে ভালো, কে মন্দ এগুলো তো তর্ক সাপেক্ষ! আমরা তার বিচার করার কেউ নই! কিন্তু খারাপ লাগা একটাই যে ওরা কেউই হয়ত ভালো নেই! মেয়ের এই ডিসিশন নেওয়ার কথা জানার পরে মায়ের মতো বাবারও তো খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই! তিনিও যে মেয়ে কে যথেষ্টই স্নেহ করেন সেটা তো এই মহিলার কথা থেকেই পরিষ্কার!

অর্ক সায় দিলো,

ঠিকই বলেছো বাবা, বাঁচার অধিকার সবারই আছে হয়তো! এবং সেটা তো রিয়ারও আছে! এরকম পরিস্থিতি যে হতে পারে সেটা হয়ত ওনারা বুঝে উঠতে পারেন নি! তবে মেয়ে যে খুব উদ্ধত, কথা শোনে না, এগুলো কিন্তু কাল ওর মা নিজেই বলছিলেন আমাদের! এগুলো দেখেও তো ওনাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো তাই না! আজ ক্ষতি হয়নি মানেই যে ভবিষ্যতে এরকম আবার করার চেষ্টা করবে না তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই!

হ্যাঁ,রে, ওর একটা কাউন্সিলিং করা উচিত তাই না?

রুমার প্রশ্নে অর্ক ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, করাই তো উচিত! দেখা যাক ডক্টর কি বলেন! আর আমরা চাইলেই তো হবে না, ওর বাবা, মা কি ঠিক করেন সেটার ওপরেই সবটা নির্ভর করছে! যা সম্পর্ক দুজনের! এ ডাইনে গেলে ও বাঁয়ে যায়!

মোটেই না! ভদ্রমহিলার কথা শুনে তো আমার রিয়ার মা কে ভালোই লেগেছে! যে কোনো আত্মসম্মান সম্পন্ন মহিলা এরকমই ডিসিশন নেবে! হাজব্যান্ডের অবৈধ রিলেশন আছে জেনেও তার সঙ্গে থাকবে!

নিশ্চয়ই না! তুমি একশ শতাংশ ঠিক কথা বলেছো, আমি সেকথা বলিনি! আমি বললাম মেয়ের ব্যাপারেও ওনারা সহমত হবেন কিনা সন্দেহ আছে!

দিতি র কথার উত্তরে বললো অর্ক। বেলা হয়ে গিয়েছিলো, অর্ক উঠে পড়লো,

চলো খেয়ে নিই, বিকেলে একবার হসপিটালে যেতে হবে আমাকে!

মহিলা কে যা দেখলাম, সত্যিই রিয়ার বাবা তো কোনো দায়িত্ব নেবে না মনে হয়!

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ২০
খাওয়া দাওয়া মিটতে মিটতে বেলা হয়ে গেলো, একটু রেস্ট নিয়ে, যখন উবের নিয়ে হসপিটালের উদ্যেশ্যে বেরোলো অর্ক, তখন সাড়ে চারটে বেজে গেছে। খানিকটা এগোতেই একটা বড়ো রাজনৈতিক মিছিল, রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে রেখেছে, বারবার ঘড়ির দিকে দেখছিলো অর্ক, ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয় ছটাতে, ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারবে তো ও! খানিকটা অন্তত মেট্রোতে গেলেই হতো এখন আফসোস হচ্ছিলো, শরীরটা ভালো লাগছিলো না বলেই উবের নেওয়ার ডিসিশন নিয়ে ছিলো তখন, এখন মনে হচ্ছে ভুল হলো সেটা।

রাসবিহারী মোড়ে এসে সিগনালে দাঁড়িয়ে গেলো উবেরটা, মিছিল ততোক্ষনে অন্য দিকে ঘুরে গেছে, কিন্তু সামনে লম্বা গাড়ির সারি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে, কি করবে ভাবতে ভাবতে হটাৎ মেট্রোর গেটের দিকে চোখ গেল ওর, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সকালের সেই ভদ্রমহিলা! সম্ভবত অটোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন! রিয়ার মা বলেছিলেন উনি আলিপুরে থাকেন, মনে পড়লো অর্কর, একটু অন্য মনস্ক হলো ও। ইতিমধ্যে সিগন্যাল খুলে গেছে, উবের যখন মেট্রো গেটের পাশ দিয়ে এগোচ্ছে, তখন মেট্রোর গেট দিয়ে তিয়াসা কে বেরোতে দেখলো ও, ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখার চেষ্টা করলো অর্ক, তিয়াসা যেনো ওই ভদ্রমহিলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো! ভদ্রমহিলা তিয়াসা কে হাত নেড়ে কিছু বলছেন, দেখতে দেখতেই উবের টা এগিয়ে গেলো।

হসপিটালে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সময় শেষ হয়ে এসেছিলো, ওকে দেখেই কৌশিক দৌড়ে এলো,

স্যার, ভেতরে যাবেন নাকি? এই যে কার্ড,

দৌড়ে কার্ড হাতে লিফটে উঠে যখন বেডের সামনে এলো তখন রিয়ার মা নেমে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন, অর্ক রিয়ার দিকে তাকালো,

কেমন আছো?

রিয়া কোনো কথা না বলেই চুপ করে তাকিয়ে থাকলো। ওর মা লজ্জিত হলেন, অর্কর দিকে তাকিয়ে বললেন,

ভালো আছে স্যার! কাল সকালে ছেড়ে দেবে বলেছে!

সময় শেষ হয়ে গিয়েছিলো, দুজনে লিফটে করে নিচে নেমে আসছিলো যখন, তখন অর্ক জিজ্ঞেস করলো,

আপনার হাজব্যান্ড এসেছিলেন?

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন,

আসেনি, জানতামই আসবে না!!তবে মেয়েও বাবার কথা বলছে না একবারও!

নিচে নেমে এসে দেখলো অনির্বাণ, দীপ, শ্রেয়া সবাই এসেছে ওখানে, ওকে দেখেই সবাই উঠে দাঁড়ালো, অর্ক ওদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো

তিয়াসা আসে নি?

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

না স্যার, ওর বাবার শরীরটা একটু খারাপ, তাই বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না আজ,

অর্ক মনে মনে চমকে উঠলো একটু, বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না! কিন্তু ও তো রাসবিহারী তে দেখলো তিয়াসা কে!

রিয়ার মা কে নেমে আসতে দেখে বাকিরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গিয়েছিলো, এই সুযোগে অনির্বাণ কে সাইডে সরিয়ে আনলো অর্ক,

তোমাকে বলেছিলাম অনির্বাণ, কৌশিক কে রিয়ার বাড়ি যাওয়ার কথা না বলতে! কৌশিক বললো ও তোমার কাছ থেকেই অ্যাড্রেস পেয়েছে! যদিও সেটা আল্টিমেটলি ভালো হয়েছে, তবুও আমি আশা করেছিলাম তুমি কথা রাখবে।

অনির্বাণ মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,

স্যার, আমি বলতে চাই নি! তিয়াসা জোর করলো, বললো বন্ধু হিসেবে কৌশিকের সামনে রিয়ার স্বরূপ প্রকাশ পাওয়া উচিত। এতো কিছুর পরেও ও রিয়া কে ভালোবাসে স্যার!

তিয়াসা কে ফোন করো, বলো আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই!!

অনির্বাণ ফোন বার করে ডায়াল করার কিছুক্ষন পরে তিয়াসা ফোন তুললো, উল্টোদিকে হইচই এর আওয়াজ, অর্ক ওর সঙ্গে কথা বলতে চায় জানিয়ে অনির্বাণ ফোন দিলো,

রিয়া কেমন আছে স্যার? আজ কিছুতেই যেতে পারলাম না, বাবার খুব শরীর খারাপ!

শুনলাম অনির্বাণের কাছে! তুমি কোথায় থাকো? খুব হইচইয়ের আওয়াজ আসছে!

তিয়াসা হাসলো,

গড়িয়া তে স্যার, বাবার ওষুধ আনতে এসেছি বাজারে!

গড়িয়া তে ওষুধ পাওনি বুঝি, তোমাকে একটু আগে কালীঘাট মেট্রোর সামনে দেখলাম!

ঠান্ডা গলায় বললো অর্ক, অনির্বাণ চমকে তাকালো, উল্টোদিকে তিয়াসার চমক বোঝা না গেলেও কোনো কথার আওয়াজ এলো না। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পরে অর্ক আবার বললো,

যে ভদ্রমহিলার পাশে তুমি দাঁড়িয়েছিলে ওনাকে আমি চিনি! আজ সকালেই আমার বাড়ি এসেছিলেন, তুমি ওনা কে কিভাবে চেনো?

আমি কারোর পাশে দাঁড়াই নি স্যার, আমি এমনই দাঁড়িয়েছিলাম। আমার রিয়ার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে নেই স্যার, তাই অনির্বাণ কে বলেছিলাম বাবা অসুস্থ,

অর্ক হাসলো,

যাক তাও ভালো! অন্তত এটুকু তো স্বীকার করলে তুমি রাসবিহারী তে ছিলে একটু আগে! কি জন্যে এসেছিলে?

আমার কিছু পার্সোনাল কাজ ছিলো স্যার!

কাজটা সম্ভবত বুঝতে পারছি! তবে বন্ধুর ওপরে রাগের বদলা এই ভাবে নিতে নেই, হয়তো রিয়া অনেক ভুল কাজ করেছে, কিন্তু তুমি যা করলে সেটাও খুব খারাপ কাজ, এটা মনে রেখো!

ফোনটা অনির্বাণের হাতে দিয়ে ওর দিকে তাকালো অর্ক,

কোনো কোনো সময় নিজের বুদ্ধিও ব্যবহার করতে হয়! কৌশিকের ভালো চাইতে গিয়ে হয়ত রিয়ার খারাপ করে ফেলছো! বন্ধু তো সবাই, তাই না? আর এটা জানার পরেও তো কৌশিকের কোনো পরিবর্তন হলো না, ও তো সেই রিয়ার পাশেই থাকলো, ভবিষ্যতে এরকম করো না কখনো আর! আর তিয়াসা কেও বুঝিয়ে বোলো, বন্ধুর পাশে বিপদে না দাঁড়াক ক্ষতি করার চেষ্টা যেনো না করে!

স্যার, আমি অনেকবার ওকে আটকেছি স্যার, রিয়া যে স্টেশনে ম্যাম কে মিথ্যে বলেছিলো সেটা ও রিয়া কে বলতেও যাচ্ছিলো, আমিই তখন সেটা আটকে ছিলাম,

তাড়াতাড়ি বললো অনির্বাণ, অর্ক হাসলো,

যাক! আর এসব আলোচনায় কাজ নেই! তিয়াসা যখন বেশি উদ্যোগ নিয়ে এসব করছিলো তখনই বোঝা উচিত ছিলো আমার, কাকে আর বিশ্বাস করি বলো! সম্ভবত তোমার বোন রিয়াকে ফোন করতে দেখেছে, এটা তিয়াসাই তোমায় রিয়া কে বলতে বলেছিলো তাই না?

অনির্বাণের নিচু করে নেওয়া মাথা অর্কর কাছে ঘটনার সত্যতা জানান দিলো!

রিয়ার ওপর তিয়াসার রাগের কারণ টা কি অনির্বাণ?

জানি না স্যার! কখনো বলেনি কিছু! ও রাসবিহারী মোড়ে কার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলো স্যার?

উনি রিয়ার বাবার সঙ্গে থাকেন, আজ আমার বাড়িতে এসেছিলেন, আমি চাইলে রিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশে কমপ্লেইন করতে হেল্প করতে চাইছিলেন!

কি! তিয়াসা ওনার সঙ্গে কথা বলছিলো!

হ্যাঁ, আমি দেখলাম ও ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে! তবে ও তো ওনাকে চেনে বলে স্বীকার করলো না! তুমি মহিলা কে চেনো?

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

না স্যার, চিনি না! আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার, তিয়াসাও চেনে না ওনাকে! আমরা আজ পর্যন্ত রিয়ার বাবাকেই দেখিনি কেউ, আর ওই ভদ্রমহিলা!

ওকে বোলো ও রিয়া কে মিথ্যেবাদী বলছিলো সেদিন! আজ একই কাজ ও ও করেছে! শুধু আমার সঙ্গে নয় কিন্তু তোমার সঙ্গেও, ভবিষ্যতে মনে রেখো সেটা!

ওদের কথোপকথনের মধ্যেই কৌশিক এসে গেলো,

স্যার, আমার টিউশন আছে, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি,

তুমি কোন দিকে যাবে কৌশিক?

চেতলার দিকে স্যার,

অর্ক ওকে থামালো,

দাঁড়াও! আমি উবের নেবো, তোমাকে রাসবিহারী তে নামিয়ে দিচ্ছি,

তুমি রিয়ার বাবা যার সঙ্গে থাকেন, সেই মহিলা কে চেনো?

উবেরে বসে জিজ্ঞেস করলো অর্ক, কৌশিক ঘাড় নাড়লো,

না স্যার! কোনোদিনও জানতামই না ওর বাবা অন্য কারো সঙ্গে থাকেন! সেতো আপনার মুখেই প্রথম শুনলাম! তারপরে ওর মেসেজে জানলাম আরো!

হুম! বেশ কিছু মিথ্যে বলেছে রিয়া!

স্যার, কি হয়েছে ঘটনা টা বলুন তো! আপনারা ওর বাড়িতে গিয়েছিলেন কেনো?

অর্ক নিজেকে সংযত করলো, ছেলেটি রিয়ার ঘনিষ্ঠ, বেশি কিছু বলা যাবে না!

কিছু কিছু মিথ্যে কথা ও বলেছে কৌশিক, তুমি তো জানো তার মধ্যে কিছু কিছু! সমর স্যার বলেছিলেন আমার স্ত্রীর সম্বন্ধে কিছু কথা কলেজে রটেছে, সেগুলো তুমিও নিশ্চয়ই জানো! এর মধ্যে এমন কিছু কথা আছে, যেগুলো রিয়া ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিলো না!

কৌশিক মাথা নিচু করলো,

স্যার, কথাগুলো রিয়া শুধু আমাকেই বলেছিলো আর কাউকে নয়! বিশ্বাস করুন স্যার আমি কাউকে বলিনি, আর ও আমি ছাড়া কারো সঙ্গে খুব বেশি কথা শেয়ার করে না! তারপরেও যে এগুলো কি করে ছড়িয়ে পড়লো আমি জানি না স্যার!

রাতে বাড়ি ফিরে সোফায় ধপ করে বসে পড়লো অর্ক,

কি যে বলি! তিয়াসাটাও কম যায় না জানো! ওর কথায় অনির্বাণ কাল রিয়ার বাড়িতে ওকে ওর বোন দেখেছে বলে মিথ্যে কথা বললো। আমি তখন ভেবেছিলাম ও নিজে বলেছে এগুলো, কিন্তু আজ বুঝলাম সবটাই তিয়াসার কান্ড।

রুমা অবাক হলেন,

ওমা! মেয়েটাকে তো বেশ ভালোই লেগেছিলো আমার, সে আবার কি কান্ড করলো!

আর ভালো! এখন তো বুঝতে পারছি ওর ইন্টারেস্ট টা কোথায়! রিয়ার ওপরে কোনো কারণে রাগ আছে ওর, তাই যেচে যেচে সব সময় আমাকে হেল্প করতে আসতো!

কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে?

অর্কর কথায় অবাক গলায় প্রশ্ন করলো দিতি,

ওই যে বলে না লাক! একদম তাই, নেহাত উবের টা হসপিটালে যাওয়ার সময়ে রাসবিহারীর মুখে সিগন্যালে দাঁড়ালো তাই তো ওকে দেখতে পেলাম। কালীঘাট মেট্রো থেকে বেরিয়ে এসে যেখানে দাঁড়ালো, সেখানে ওই সকালে যিনি এসেছিলেন আমাদের বাড়ি, সেই ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়েছিলেন।

উনি ওখানে তিয়াসার সঙ্গে কি করছিলেন?

বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো অদিতি, অর্ক হাসলো,

কি আর করবেন! নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ি যেমন প্ল্যান নিয়ে এসেছিলেন, ঠিক সেরকমই তিয়াসার সঙ্গে হাত মিলিয়ে রিয়াকে কিছু টাইট দেবার চেষ্টা করছেন!

কি কান্ড! এই সকালে এসেই মেয়ের মতো দেখি বলছিলেন,

হতাশ গলায় বললেন রুমা,

ছাড়ো তো! মেয়ের মতো! তোমার মনে হয়! যে মহিলা আমাদের হাতে প্রমাণ তুলে দিতে চাইছিলেন, তিনি ওর ভালো চান!

পাশ থেকে বিরক্তির গলায় বললো অদিতি, অর্ক সায় দিলো,

একদমই তাই! আমি অবশ্য তিয়াসা কে ছাড়িনি, ও যদিও স্বীকার করলো না ওর সঙ্গে কেউ ছিলো, তাও কড়া করেই বলেছি ওকে! অনির্বাণ কেও বলেছি, আর মনে হয় না কেউ এখানে আসবে বা ফোন করবে আমাকে, দুজনেই বুঝেছে আমি বিরক্ত হয়েছি খুব!

অনির্বাণের সঙ্গে তিয়াসার একটা সম্পর্ক আছে মনে হয়, ও যা বলে অনির্বাণ তাই করে! এই কথাটা কৌশিকও বলছিলো সেদিন!

অদিতির কথায় সহমত হলো অর্ক,

হুম! আমারও মনে হয়েছে সেটা! রিয়াও বলছিল অনির্বাণ কে সেদিন ওর বাড়িতে, তিয়াসার কথায় ওঠাবসা বন্ধ কর!

পরের দিন রিয়া কে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলো, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলো অর্ক, কৌশিক আর রিয়ার মা। ডাক্তার বাবু ওদের আলাদা করে ডাকলেন,

ওর একটু পার্সোনাল অ্যাটেনশন প্রয়োজন! সঙ্গ দিন ওকে, একা থাকতে দেবেন না। বেশি চুপচাপ থাকলে কাউন্সিলিং করান কিছুদিন, এই প্রবণতাটা ভালো নয়।

কৌশিক, রিয়া আর ওর মায়ের সঙ্গে বাড়িতে গেলো, অর্ক কলেজের দিকে। ছুটির সময় অরিন্দমের সঙ্গে মেট্রোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো সবটাই, অরিন্দম ভাবলো একটু,

সাথী কে বললে কেমন হয়? ওদের তো ফিনান্সিয়াল কন্ডিশন সেরকম ভালো নয় মনে হয়, অন্য কোথাও চাপ হয়ে যাবে। সাথী আমার রেফারেন্সে ফিজ কমিয়ে দেবে অনেক।

অরিন্দম সব ব্যাপারেই চটপটে সাথীর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেললো সাথে সাথেই। ওখানে দাঁড়িয়েই রিয়ার মা কে ফোন করলো, ভদ্রমহিলা রাজি হলেন এক কথায়। অর্ক হসপিটাল থেকেই কলেজে গিয়েছিলো, তাই রিয়ার খবর কারোর জানা ছিলো না, বাড়ি ফিরতেই রুমা এগিয়ে এলেন,

কেমন আছে মেয়েটা? ডাক্তার কি বললেন?

অর্ক মাথা নাড়লো,

ভালো আছে মা, আজ সকালেই ছেড়ে দিলো। তবে ডাক্তার কাউন্সিলিং করতে বলেছিলেন, তাই অরিন্দম সাথীর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়েছে।

পরের দিন সকালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো, রিয়ারা বেরিয়ে যাওয়ার পরে সাথী অরিন্দম কে ফোন করলো, অর্ক তখন ক্লাস শেষ করে টিচার্স রুমে ঢুকে ছিলো সবে, অরিন্দম বাইরে বেরিয়ে এসে ওকে হাতের ইশারা করে ফাঁকা জায়গায় ডেকে নিয়ে গিয়ে ফোন স্পিকারে দিলো,

অর্ক বাবু, মেয়েটি কিন্তু প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে আছে, কাউন্সিলিং এ হবে না, মেডিসিন লাগবে। আমি ওর মা কেও জানিয়েছি, সায়ক্রিয়াটিস্টের কাছে রেফার করেছি ওকে।

কথা বলে কি বুঝলি?

পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো অরিন্দম,

খুব খারাপ! অনেকগুলো ব্যাপার একসঙ্গে ঘটে গিয়েছে আসলে, বাবার বাড়িতে থাকতে না দিতে চাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না একদম! ওর বাবার বান্ধবী, আর মা দুজনের ওপরেই প্রবল রাগ বোধহয় অনেকদিন থেকেই ছিলো, তার সঙ্গে বাবার ওপরেও রাগ যোগ হয়েছে এর সঙ্গে।

ফোনের কথাটা কি স্বীকার করলো?

নাহ! কিছুতেই স্বীকার করলো না! বারবার বলছে ওটা ও করেনি! তবে বাকি কাজগুলো ওই করেছে, সেটা ওর কথা থেকেই পরিষ্কার। আসলে ও সবাই কে সব সময় দেখাতে চেয়েছিলো ও অন্য স্টুডেন্টদের থেকে আপনার কাছে কিছুটা স্পেশাল। ও ফোন করলে আপনি নোটস দেন, ওর চয়েসে বউয়ের জন্যে গয়না কেনেন, এক্সকার্শনে গিয়ে ও আপনার পাশে বসে গল্প করে, বাড়িতে গিয়ে আপনাকে কে কফি করে খাওয়ায়, এমন কি সোফায় আপনার পাশে ক্লোজ হয়ে বসে ক্লাস করে। আসলে ওর লোনলিনেস থেকে ও সব সময় পার্সোনাল অ্যাটেনশন খোঁজে, আপনার ব্যবহার, যেটা হয়ত অন্য প্রফেসরদের থেকে আলাদা, স্টুডেন্টদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশা এই জিনিসটা ওকে আপনার প্রতি অ্যাট্রাক্ট করেছে! ও সব সময় চেয়েছে যে ওকে কেউ আলাদা করে কেয়ার করে এটা প্রচার করে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে, ঠিক এই কারণেই কৌশিকের প্রপোজালেও ও সরাসরি না বলে নি কখনো। আপনি হয়তো ওর কিছু আবদার মেনে নিয়েছেন কোনো কোনো সময়, তাতে এই ব্যাপার টা আরো বেশি করে ওর মনে দৃঢ় হয়েছে! ওর বক্তব্য ওর বন্ধুরাও বলে ও স্যারের স্পেশাল স্টুডেন্ট, ও চাইলেই স্যার নোটস দেন!

অর্ক মাথায় হাত দিলো, সাথী শেষ কথা বললো,

অর্ক বাবু, আর ওর বাড়িতে যাবেন না প্লিজ, সেটা ওর জন্যেই ভালো হবে। ও যতো আপনাকে চোখের সামনে দেখবে ততো আরো পার্সোনাল অ্যাটেনশন চাইবে, ওর মনে হবে আপনি সত্যিই ওকে আলাদা চোখে দেখেন, তাই কলেজের বাইরেও ওর খোঁজ খবর রাখছেন। এমনিতেও ও বলেছে আমাকে, আপনি ওর জন্যে হসপিটালেও যাতায়াত করেছেন, তাই যোগাযোগটা একদম বন্ধ করে দিন।

আমি শেষ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, এগুলো কি কৌশিক বা ওর মা জানে?

না, কৌশিক নামের ছেলেটি আসে নি, তবে ওর মা কে তো বলতেই হতো। একটা কথা, কৌশিক কে কিছু বলার দরকারও নেই, একমাত্র ওকেই কিছুটা হলেও বিশ্বাস করে রিয়া। কৌশিক ওকে প্রপোজও করেছে কয়েকবার, কৌশিক কে পাছে সরাসরি না বললে ওর কাছ দূরে থেকে সরে যায়, তাই কখনো ও কৌশিক কে না বলে নি, সব সময় বাবার দোহাই দিয়েছে। আমাকেও রিকোয়েস্ট করেছে বারবার, কৌশিকের বন্ধুত্ব ও হারাতে চায় না! আসলে ও এতটাই লোনলি যে একটু ওকে কেউ নরমভাবে কেয়ার নিয়ে ডিল করলেই ও তাকে আগলে রাখতে চায়, হয়ত বেশ কিছু সময় যা অল্প হয়েছে তাকে কিছুটা বাড়িয়ে বলে তার কাছে ও কতটা মূল্যবান এটা অন্যের সামনে তুলে ধরতে চায়। এই কথাটা আপনারাও মাথায় রাখবেন প্লিজ, কৌশিক কে কোনোদিনও জানতে দেবেন না কিছু! কৌশিক কোনো কারণে ওর পাশ থেকে সরে গেলে ওর কোনো ইনফরমেশন ও হয়ত আর কাউকে শেয়ার করবে না। তাই এর পরে কিছু ঘটলে কেউই জানতে পারবো না আমরা।

অর্কর প্রশ্নের উত্তরে কথাগুলো বলে ফোন রেখে দিলো সাথী। ফোন রেখে দিয়ে দুজনেই হতভম্ভ হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষন, তারপর অর্ক কথা বললো,

এবার থেকে ওর মা কিছু বলার জন্যে ফোন করলে তুইই যোগাযোগ রাখিস, আমি আর ফোন ধরবো না। ওর মাও এই কথাটা জেনে গেছে যখন, তখন কিছু জিজ্ঞেস করলে সত্যিটাই বলে দিস!

বাড়িতে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো অর্ক, সাথীর কথাগুলো কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না! কোনোদিনও বোঝে নি ও, স্টুডেন্ট ছাড়া কিছু ভাবে নি কোনোদিনও, শুধু যেদিন ওর গায়ে লেপ্টে এসে বসছিলো, সেই দিন কেমন কেনো একটা অস্বস্তি হয়েছিলো প্রথম। অথচ মেয়েটা ভাবতো ও ওকে আলাদা গুরুত্ব দেয়! ভাবতে ভাবতে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়ে ছিলো একটু, তন্দ্রা ভাঙলো দিতির ডাকে,

ওঠো চা নাও,

চায়ের কাপ পাশের টেবিলে রেখে খাটে বসলো অদিতি।

সাথী কিছু বললো? কাউন্সিলিং হয়েছে রিয়ার?

অর্ক ইশারা করলো,

বসো এখানে, তোমার সঙ্গে কথা আছে!

দরজা বন্ধ করে এসে কৌতূহলী চোখে তাকালো অদিতি,

কি হয়েছে?

সাথী বললো একটু ভালো ব্যবহার যার কাছ থেকেই ও পায়, তাকেই ও ক্লোজ মনে করে। ওর আসলে ধারণা আমি ওকে অন্য স্টুডেন্টদের থেকে আলাদা চোখে দেখি, মানে ওকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিই। সেসবের কিছু কিছু প্রমাণ হিসেবেই ওই কথাগুলো তোমাকে ও বলেছে। এখন আমি বুঝতে পারছি এই যে ও আমাকে ফোন করে নোটস চেয়েছিলো, বা বন্ধুদের সামনে ও ভালো কফি করে কিনা বলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, এগুলো সবই নিজেকে গুরুত্বপূর্ন করে তোলার জন্যে! তবে ফোন যে ও করেছে সেটা স্বীকার করেনি কিছুতেই! সব কিছু মেনে নিলেও এই মিথ্যেটা আমি কিছুতেই মেনে নেব না। বাকি মিথ্যেগুলো খুব সাধারণ, সত্যি হয়ত ওইটুকু মিথ্যে বলাতে আমাদের কোনো ক্ষতি হতো না, কিন্তু ফোন করে যে মিথ্যেটা ও বলেছে সেটা অলমোস্ট আমাদের সংসার ভেঙে দিচ্ছিলো। যাইহোক সাথী ওর সঙ্গে আমাকে যোগাযোগ রাখতে বারণ করেছে, আমি ওর আর ওর মায়ের নম্বরটা ব্লক করে দেবো ঠিক করেছি।

অদিতি অর্কর হাতটা ধরলো,

ঠিক আছে! এতো কিছু ভেবো না এটা নিয়ে! কাউন্সিলিং হলে ভালো হয়ে যাবে নিশ্চয়ই! ওর ঐ ফোন যে আমাদের কতো টা ক্ষতি করতে পারতো সেটা সুস্থ হলে ও নিজেই বুঝবে নিশ্চয়ই!

জানিনা! বুঝলেই ভালো! সাথী বললো শুধু কাউন্সিলিংয়ে হবে না, মেডিসিন লাগবে! দেখা যাক কি হয়! আমি অরিন্দম কে বলে দিয়েছি সবটা, এবার থেকে যদি ওর মা আর কন্টাক্ট করেন তাহলে ওই যা করার করবে! আমার ওর জন্যে হসপিটালে যাওয়াটা কেও ও স্পেশাল অ্যাটেনশন দেওয়া বলে মনে করছে। অনেক হয়েছে, এবার একটু শান্তিতে কাটাতে চাই বাকি জীবনটা! গত বছরখানেক যা গেলো! সব শেষ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিলো একদম! কোনোদিনও যে এই ফেজটা কাটিয়ে উঠতে পারবো, একসময় ভাবতেও পারছিলাম না!

অর্ক হটাৎ করেই জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে এলো অদিতি কে, গাঢ় গলায় বললো,

বিশ্বাস করো, একসময় যখন গোটা কলেজে তোমার সন্দেহবাতিক হওয়ার কথা ছড়িয়ে গেলো না, সমর দা ওই ভাবে বললেন অরিন্দমের বিয়েতে, তুমি ফোন নিয়ে অশান্তি করতে লাগলে, তখন ভীষণ মনে হতো সব ছেড়ে চলে যাই! বাড়িতে অশান্তি, বাইরে অশান্তি, আর পারছিলাম না নিতে! মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়েছি কতদিন! শুধু ছেলেটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতো, মনে হতো এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবা হব আমি! এইটুকু শিশু কে একা ছেড়ে পালিয়ে যাবো! শুধু ওর জন্যেই ফিরে এসেছি বারবার!

অদিতির শরীরটা কেঁপে উঠলো ভয়ে, এতো কষ্ট অর্কও পেয়েছে তখন, অথচ কিচ্ছু বুঝতে পারে নি ও! শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ও অর্ক কে।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে