এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১+২

0
1859

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১+২
আমি আর অর্ক দুজন দুজন কে ভালোবাসি, আমরা বিয়ে করতে চাই, প্লিজ আপনি ওর জীবন থেকে সরে যান,

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলা কথা গুলো যেনো গরম লোহা ঢেলে দিলো অদিতির কানে, ফোন ধরা হাতটা থর থর করে কাঁপছে, শরীরটা দুর্বল লাগছে, এর পরে যে আরও কিছু বলছে মেয়েটা, সেগুলো ও আর শুনতেই পাচ্ছেনা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথাটা সম্পূর্ন খালি হয়ে গেছে ওর, ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো দিতি।

কেমন যেনো পাগল পাগল লাগছিলো অদিতির। এইতো মাত্র দুদিন হলো ও শ্বশুর বাড়ি এসেছে, অর্ক তো পরশুই ওকে এখানে রেখে সবে ফিরে গেলো! কি হলো একদিনের মধ্যে! সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ওর। প্রায় ঘন্টা খানেক একই ভাবে শুয়ে থাকার পরে মাথা টা একটু একটু কাজ করতে শুরু করছে এখন, এই ভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ঠিক নয় এই অবস্থায়, সবে মাত্র মাসখানেক হয়েছে, এই ভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ওর বাচ্চার জন্যে ক্ষতিকারক হতে পারে।

কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সোজা হয়ে খাটে উঠে বসলো দিতি, নিজেকে একটু শক্ত করলো। একটা অচেনা মেয়ের ফোনে ও অর্ক কে অবিশ্বাস করছে কেনো! আগে তো ওর অর্কর সঙ্গে সব কথা ক্লিয়ার করা উচিত! নাহ! অর্কর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে, জানতে হবে মেয়েটার কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য। এতদিন অর্কর সঙ্গে একসাথে থেকেও ও চিনতে পারলোনা ওকে!

একটু একটু করে মাথাটা ঠান্ডা হচ্ছিলো, প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে আস্তে আস্তে কিছুটা হলেও বাস্তব বুদ্ধি কাজ করতে শুরু করেছিলো অদিতির। এতক্ষনে খেয়াল হলো মেয়েটার নাম টুকুও জিজ্ঞেস করেনি ও, আরও কিছু বলছিলো মেয়েটা, সেগুলো না শুনেই ও ফোন টা কেটে দিয়েছে তখন। এবার একটু মনে মনে আফসোস হচ্ছে। কেনো যে ফোন টা কেটে দিলো তখন!

অর্কর সঙ্গে কথা বলতে গেলে এগুলো সব কিছু জানতে হবে আগে, মেয়েটার সঙ্গে ওকে আবার কথা বলতে হবে। নিজের মন কে শক্ত করলো দিতি। যদি সত্যি হয় কথাগুলো তাহলে ও কিছুতেই অর্ক কে ছেড়ে দেবে না। কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে কথা না বলে অর্কর সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই, বুকের ভেতরের কষ্টটা কে চেপে রেখে কাঁপা কাঁপা হাতে নতুন করে ফোনটা তুলে নিয়ে মেয়েটা কে ডায়াল করতে যাচ্ছিলো সবে,

কি হলো? শরীর খারাপ নাকি? ওই ভাবে বসে আছিস কেনো?

বলতে বলতেই রুমা ঘরে ঢুকে এলেন। সদ্য প্রেগন্যান্ট ছেলের বউ কে ফ্যাকাশে মুখে বসে থাকতে দেখেই অজানা আশঙ্কায় তাঁর মুখ শুকিয়ে গেলো। শাশুড়ি ঘরে ঢুকে এসেছে দেখেই ফোনটা ডায়াল না করেই, নামিয়ে রাখলো দিতি।

হ্যাঁ মা, শরীরটা একটু খারাপ লাগছে, আর একটু শুয়ে থাকি, ঠিক হয়ে যাবে,

অম্লান বদনে মিথ্যে বললো দিতি, যে করেই হোক শাশুড়ি কে এঘর থেকে সরাতে হবে এখন, আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না ও। মেয়েটার কাছ থেকে সব কিছু সঠিক ভাবে না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই ওর।

আচ্ছা আচ্ছা রেস্ট নে তুই, শরীরটা একটু ঠিক লাগলে এটা খেয়ে নিস,

কেটে আনা ফলের প্লেটটা সামনে রেখে বেরিয়ে গেলেন রুমা, শাশুড়ি বেরিয়ে যাবার পর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো দিতি, ছিটকিনি তুলে দিয়ে এসে খাটে বসলো। নিজেকে শক্ত করে গুছিয়ে নিলো একটু, প্রশ্ন গুলো কে জমা করলো এক জায়গায়, একটা প্রশ্নও মিস করলে চলবে না।

এমনিতে সুস্থ, সুন্দর দাম্পত্য জীবন ওদের, কতো বন্ধুদের শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে সমস্যা থাকে, কিন্তু ওর তাও নেই। অর্কর মা ভীষণ ভালো মানুষ, দিতির মা নেই কিন্তু সেই অভাব ও বিয়ের পরে আর বুঝতে পারেনি, নিজের মেয়ের মতন ভালো বাসেন উনি ওকে। পেশায় অধ্যাপক অর্কও যথেষ্ট সভ্য ভদ্র, প্রায় বছর দেড়েক বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত কোনো রকম বেচাল ও দেখেনি। আজ সেই ছেলে কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে আছে, তাকে বিয়ে করতে চায়! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ওর।

মেয়েটা কে হতে পারে? স্কুল বা কলেজের কোনো বান্ধবী? ছোটো বেলার বন্ধু? অর্ক তো কাউকে বাড়িতে ডাকেনা খুব একটা। একমাত্র মাঝে মাঝে ওর স্টুডেন্টরা আসে প্রয়োজনে। তাহলে কি কলেজে? কিন্তু কলেজে এতো লোকের মধ্যে কিভাবে হলো এসব, কেউ জানলো না!

নিজের মনের মধ্যেই যুক্তি তর্কের জাল বুনে চলেছে দিতি, ভাবতে ভাবতেই ফোনটা আবার তুলে নিলো হাতে। নম্বরটা খুঁজে বের করে ডায়াল করতে গিয়ে দেখলো, একটা ল্যান্ডলাইন নম্বর। একটু অবাকই হলো দিতি, বাড়ির ফোন থেকে করেছে! ও তো তাহলে ইচ্ছা করলেই মেয়েটার ঠিকানা খুঁজে বার করে নিতে পারে! এতো বোকামি করলো মেয়েটা! আর কেউ ছিলনা তখন নাকি বাড়িতে! নাকি ও ও চায় দিতি ওর ঠিকানা সহজেই খুঁজে পায় যেনো! এতো সাহস ও কোথা থেকে পেলো!

আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে ডায়াল করে ফেললো দিতি। ফোনের ওপ্রান্তে বাজতে থাকা প্রতিটা রিংয়ের শব্দ যেনো ওর বুকেও হাতুড়ি পিটতে লাগলো।বার দুয়েক বাজার পর একজন পুরুষ কণ্ঠে হ্যালো বললো কেউ, একটু অপ্রস্তুত হলো দিতি, কি বলবে ও এখন! কাকে চাইবে! ও তো নাম টাও জিজ্ঞেস করেনি তখন। ওর মনে হয়েছিলো মেয়েটাই ফোন ধরবে নিশ্চয়ই, অন্য কেউ বাড়িতে না থাকার সুযোগেই নিশ্চয়ই মেয়েটা ওকে ফোন করেছে। অন্য কেউ ধরলে কি বলবে সেটা তো ও একদম ভাবে নি!

একটু আগে এই নম্বর থেকে আমাকে একটি মেয়ে ফোন করেছিলো, আমি নামটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। গলা শুনে অল্পবয়সী মনে হয়েছিলো, ওনাকে একটু দেবেন প্লিজ,

একটু থতমত খেয়ে বললো দিতি, এর থেকে বেশি কিছু আর এই মুহূর্তে ওর মাথায় আসছিলো না। ওপ্রান্তে থাকা পুরুষ কণ্ঠ একটু চুপ করে থাকলো, তারপরে গম্ভীর গলা ভেসে এলো,

কি জন্যে ফোন করেছিলো আপনাকে?

একে কি বলা ঠিক হবে! মনে মনে ভাবতে ভাবতেই অধৈর্য্য গলায় ও প্রান্তের কণ্ঠ বললো,

কি হলো? বলুন?

দিতি নিজেকে সংযত করলো, একটু ঠাণ্ডা গলায় বললো,

সে আমাকে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলছিলো, যেগুলো আমি শুধু তার সঙ্গেই বলতে চাই!

ব্যক্তিগত কথা! কি রকম ব্যক্তিগত? এটা একটা দোকানের নম্বর ম্যাডাম, এখান থেকে কোনো মেয়ে আপনাকে কোনো ব্যক্তিগত কথা বলতে পারেনা, কারণ আমাদের দোকানে কোনো মহিলা কর্মচারী নেই!

খানিকটা বিদ্রুপের গলায় বললো লোকটা, মনে মনে একটু চমকে উঠলো দিতি। দোকানের নম্বর! কেউ ইচ্ছা করেই দোকান থেকে ফোন করেছে, যাতে দিতি বুঝতে না পারে! কার না মোবাইল আছে আজকের দিনে! মনের মধ্যে চাপা অশান্তি হতে লাগলো ওর, কি কথা বলবে এবার ও অর্কর সঙ্গে! ওর হাতে তো কোনোই প্রমাণ নেই!

দিতির এই কয়েক মুহূর্তের এলোমেলো ভাবনাগুলোর মধ্যেই ফোনটা রেখে দিলো ওপ্রান্তের পুরুষ কণ্ঠ। দিতির মনের মধ্যে অসম্ভব রাগ হতে লাগলো, বোঝাই যাচ্ছে লোকটা কিছু জানে। তাই জন্যেই দিতি কে আর বেশি কথা বলার সুযোগ দিলো না। কিন্তু ও এর শেষ দেখেই ছাড়বে! আবার ফোনটা তুলে ডায়াল করলো দিতি, উল্টোদিকের হ্যালো শুনেই একটু কড়া গলায় বললো,

কথা শেষ হবার আগেই ফোন রেখে দিলেন? আপনার দোকান কোথায়? আমি কি আপনাকে মিথ্যা কথা বলছি? কাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন? নিজেকে বেশি চালাক ভাবেন তাই না? আমি পুলিশে অভিযোগ জানাবো,

আরে! আরে! দাঁড়ান ম্যাডাম! এতো বেশি প্রশ্ন একসাথে করে ফেললেন তো! কোনটা ছেড়ে কোনটার উত্তর আগে দিই? আর পুলিশে কমপ্লেন করবেন যখন, তখন তাই করুন না। এতো প্রশ্নের উত্তর একদম পুলিশকেই দেবো তাহলে, আপনাকে দিয়ে আর সময় নষ্ট করি কেনো! যতোসব পাগলের দল! কাজের সময় বিরক্ত করে মারে!

বিরক্ত গলায় কথাগুলো বলেই ফোন রেখে দিল লোকটা। দিতি হতভম্ব হয়ে গেলো একদম। লোকটা উল্টে ওকেই পাগল বলে দিলো! এতো সাহস যে পুলিশে কমপ্লেন করতেও বললো! তাহলে কি লোকটা ঠিকই বলেছে, ওখানে কোনো মেয়ে নেই! নাহলে পুলিশে অভিযোগের ভয় দেখানো সত্বেও ও একটুও ভয় পেলো না কেনো! কিন্তু এতো ভুল তো হয়নি ওর! ও তো ইনকামিং নম্বরেই ডায়াল করেছে! লোকটা আদৌ সত্যি বলছে তো? এটা সত্যিই কোনো দোকানের নম্বর কিনা জানা দরকার।

দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো অদিতি, দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ড্রইং রুমে। শ্বশুর, শাশুড়ি দুজনেই চা নিয়ে বসে আছেন সোফায়, সামনে খোলা টিভি তে সিরিয়াল চলছে। ওকে দেখেই রিমোট হাতে নিয়ে সাউন্ড কমিয়ে দিলেন সমরেশ, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দুজনেই তাকালেন ওর দিকে।

মা, বাড়িতে টেলিফোন ডিরেক্টরি আছে? একটু দাও না প্লিজ,

রুমা একটু অবাক হলেন,

ডিরেক্টরি! না রে বাবা, সেসব তো কিছু নেই। আগে থাকতো, এখন আর ওসব কেউ রাখে নাকি! পুরনো দিয়ে যদি হয়, তবে আমার ঘরের ওপরের তাকে একটু খুঁজে দেখতে পারিস। তবে সে কিন্তু বেশ অনেক বছর আগের! সেসব নম্বর কি আর আছে! কে জানে! কিন্তু তুই এখন ওসব দিয়ে কি করবি?

আচ্ছা! তুই তো ডাউনলোড করে নিতে পারিস ওটা! এতো খোঁজাখুঁজির দরকার কি?

পাশ থেকে বলে উঠলেন সমরেশ, দিতি লজ্জায় পড়লো। ইস! এতো সহজ সমাধানটা ওর একটুও মাথায় আসে নি আগে! কি যে হচ্ছে ওর! এই ফোনটা ওর সব বুদ্ধি গুলিয়ে দিচ্ছে, একদম পাগল করে ছাড়বে ওকে!

থ্যাংক ইউ বাবা,

বলতে বলতে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেলো দিতি, পেছন থেকে রুমার স্নেহ মিশ্রিত গলা ভেসে এলো,

আরে! আস্তে! এতো ছোটা ছুটি করিস না এই অবস্থায়! পাগলি মেয়ে একটা!
ক্রমশ
#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ২
কালকের ওই ফোনটা আসার পর থেকেই অর্ক কে ফোন করতে শুরু করেছিলো অদিতি। রাত গড়িয়ে সকাল নটা বাজতে চললো একবারের জন্যেও ফোন ধরেনি ও, উল্টে অতোবার মিসড কল দেখা সত্বেও যখন রিং ব্যাক না করেই একটু বেশি রাতের দিকে ফোনটা একদম বন্ধই করে দিলো অর্ক, অদিতি মোটামুটি তখনই বুঝে গিয়েছিলো মেয়েটা একটুও ভুল বলেনি কিছু।

কিছু বুঝতে না দিয়েই যে কয়েক মাসের জন্যে ওকে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়ে অর্ক ফিরে গেছে সেটা এই মুহূর্তে খুব ভালো করে টের পাছে দিতি। দেড় বছর ধরে এক ছাদের নিচে বাস করেও ও একটুও চিনতে পারলো না অর্ক কে, এতো টা ভালো অভিনেতা ও! খুব আফসোস হচ্ছে এখন। ও যদি একটুও বুঝতে পারতো তখন, তাহলে অন্তত বাচ্চা নেওয়ার মতো মূর্খামি কিছুতেই করতো না!

কিন্তু মেয়েটা কে ধরবে কিভাবে ও! কি করে সবটা প্রমাণ করবে সবার কাছে! নিজের ছেলে কে ছেড়ে শ্বশুর, শাশুড়ি কি ওর কথা বিশ্বাস করবেন একটুও! ও তো কিছুই জেনে উঠতে পারে নি মেয়েটার সম্পর্কে, কাল ডিরেক্টরি ঘেঁটে দেখেও কিছু পায় নি। নম্বরটা সত্যিই একটা দোকানের, নাম দেখে যদিও বোঝার উপায় নেই কিসের দোকান, তাও ওটা যে দোকান সেটা বোঝাই যায়।

মাঝে মধ্যেই এরকম ফোন ধরে না অর্ক, তার জন্যে বিভিন্ন অজুহাত সব সময়ই রেডি থাকে ওর। কখনো ক্লাস নেওয়ার, তো কখনো না শুনতে পাওয়ার, মোটামুটি এই সব অজুহাতগুলোয় অদিতি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এখন। কিন্তু অন্য সময় সেগুলো কে সহজ ভাবেই নিয়েছে ও, বিশ্বাস করেছে অর্কর কথায়। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে কতো টা বোকা ও! এই দেড় বছর ধরে শুধুই অর্কর বাইরের ভালোমানুষ চেহারাটাকেই ও বিশ্বাস করেছে, ভেতরের অভিনেতা অর্ক কে বুঝে উঠতে পারেনি একটুও।

তাই আজ এতো সহজেই বোকা হয়ে গেলো দিতি! ও একটুও বুঝতে পারলো না যে অর্ক ওকে এখানে রেখে চলে গিয়েই এইরকম কিছু করতে পারে! এখান থেকে ফিরে গিয়েই বান্ধবী কে দিয়ে ওকে ফোন করিয়ে কথাটা বলে দিয়েই নিজের ফোন বন্ধ করে দিয়েছে ও। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর কি করণীয়, সেটা কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারছে না দিতি। যতই সব বুঝতে পারে না কেনো মন, তবু কেনো যেনো কোথাও দাঁড়িয়ে একটু চিন্তাও হচ্ছে অর্কর জন্যে।

একা ফ্ল্যাটে কোনো বিপদ হলো না তো! সত্যিই ও ইচ্ছে করে ধরছে না নাকি কিছু হলো ওর! নিজের ওপর নিজেরই রাগ হচ্ছিলো এবার অদিতির, ও কেনো এতো উতলা হয়ে পড়ে সব সময়! ওর এই নরম হয়ে যাওয়াটা বুঝতে পারে বলেই তো অর্ক ইচ্ছাকৃত ভাবেই এগুলো করে ওর সঙ্গে! প্রতিবারই তো যখন বিভিন্ন রকমের অজুহাতে ফোন ধরে না অর্ক, প্রথমে রাগ হয়ে যায় ঠিকই, তার পরেই এই সব উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় আসে ওর। আর কিছু হয়নি জানা সত্বেও অর্ক কে নিয়ে চিন্তা করে বসে ও। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই তো প্রতিবার ওকে সরি বলে ম্যানেজ করে ফেলে অর্ক।

কিন্তু সেগুলো সাধারণ মান অভিমান ছিলো, কিন্তু এটা অনেক বড়ো বিষয়। ওর বিবাহিত জীবন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে এখন, মেয়েটার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে কি করবে ও! বাচ্চা টারই বা কি হবে! অর্ক র বাবা , মা, ওর বাবা সবার কাছেই তো মুখ দেখাতে পারবে না ও। অর্কর মতো ছেলে যে কোনোদিনও এমন করতে পরে ও তো স্বপ্নেও ভাবে নি কখনো! ভেতরে ভেতরে টেনশন, ভয় সব এক হয়ে গিয়ে কেমন যেনো হতাশ লাগে দিতির, এতো সহজে ওর জীবন থেকে সব কিছু হারিয়ে যাবে! ও কিছুই করতে পারবে না!

একই শহরে বাড়ি হলেও কোনোদিনই বিয়ের আগে অর্ক কে দেখেনি ও। অর্ক আর ওর পিসতুতো দাদা ছোটবেলার বন্ধু ছিলো, সম্বন্ধ টা পিসিই এনেছিলো। মা মারা যাবার পর থেকেই বাবার পরে পিসিই দিতির সব কিছু। কিছুদিন আগেই পিসেমশাই চলে গেছেন, এখন ছেলে অফিসের কাজে বাইরে গেলেই পিসি ওদের বাড়ি চলে আসেন।

প্রথম যেদিন ওদের বাড়িতে এলো অর্ক, কথা বলে বেশ ভালই লেগেছিলো ওর। ভদ্র, সভ্য হ্যান্ডসাম অর্কর প্রেমে সেদিনই পড়ে গিয়েছিলো দিতি। তাই অর্ক যখন ওর কাছে ফোন নম্বর চেয়েছিলো, ওকে নম্বর টা দিতে একবারের বেশি ভাবে নি ও। দেখতে আসার পর থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত কিন্তু দিনে দুবার করে অদিতি কে ফোন করতে বা অদিতির ফোন ধরতে কোনোদিনই ভোলেনি ও।

বিয়ের পরেই আস্তে আস্তে ফোন ধরতে আর করতে দুটোই ভুলতে লাগলো ও, এই নিয়ে মাঝে মাঝেই রাগ করতো দিতি, কিন্তু অর্কর যুক্তিও অকাট্য ছিলো, যখন ওরা একসঙ্গেই থাকে তাই আগের মতো ফোনের আর দরকার কি! যুক্তি টা যে খুব বেশি ভুল নয়, সেটা মুখে না হলেও মনে মনে তো স্বীকার করেই অদিতি, তাই এই ঝগড়া গুলোর স্থায়ীত্ব খুব বেশিক্ষন হতো না। কিন্তু এবার তো তা নয়, এবার অর্ক ওকে রেখে একাই ফিরে গিয়েছে তাই ফোন তো ওর অবশ্যই ধরা উচিত ছিলো। এখন ওর কি শাশুড়ি কে ডেকে বলা উচিত, কাল থেকে ওকে ফোন করেনি অর্ক! নাকি এটা শুনলে উনি আরও টেনশন করবেন, মনস্থির করতে পারছিলো না দিতি।

হটাৎ করেই ওর চিন্তার মধ্যেই ফোন টা বেজে উঠলো, স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অর্কর নাম টা দেখেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না দিতি। কালকের থেকে জমা হওয়া রাগ, দুশ্চিন্তা, কষ্ট, মেয়েটার বলা কথা গুলো সব মিলে মিশে একাকার হয়ে প্রবল চিৎকারে পরিণত হলো,

আমি আর কোনোদিনও তোমার মুখ দেখতে চাইনা, আমার কোনো উপায় নেই তাই তোমার সঙ্গে থাকবো, কিন্তু কোনোদিনও আর তুমি আমার সামনে আসবে না, আর জেনে রেখো কিছুতেই ডিভোর্স আমি দেবো না তোমাকে।

আরে! আমার ফোন টা কাল থেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না…..

কথা গুলো অর্ক কে শেষ করতে না দিয়েই ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো দিতি, হাউ হাউ করে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো, আজই যদি সম্ভব হতো ও অর্ক কে ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতো! কিন্তু অসুস্থ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে শক্ত থাকতে হবে, বাবা যদি একটুও বুঝতে পারে ওর মনের অবস্থা, তাহলে আরও বেশি করে খারাপের দিকে যাবে শরীর। এখন কোনো মতেই ও বাবা কে আরো অসুস্থ করে দিতে পারবে না ওর ভালো থাকার জন্যে!

ছোটো থেকেই মা হারা অদিতির বড়ো হয়ে ওঠা বাবা কে ঘিরে, গত বছর ওর বিয়ের পর থেকেই বাবার শরীর টা খারাপ যাচ্ছিলো, ঠিক করে কিছুই বোঝা যাচ্ছিলো না। এখন তো সব সময়ই খারাপ থাকে, ছোটো খাটো একটা অ্যাটাক হয়ে যাবার পর থেকেই। ওর প্রেগন্যান্সির খবরে এখন বাবার মন বেশ ভালো, অর্কর বাবা মাও খুব খুশি, এই সময় কোনো হঠকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চারবার ভাবা দরকার।

এই মুহূর্তে ওর একটুও আর শ্বশুর বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছে না, বাবার কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাবার কাছে যাওয়া মানে, বাবাকেই বিপদে ফেলে দেওয়া, কিন্তু ওই বা কি করে শাশুড়ির সামনে স্বাভাবিক থাকবে সব সময়!

ফোন টা রেখে দিয়ে অবাক হয়ে বসে রইলো অর্ক, অদিতির রাগের কোনো কারণ ও খুঁজে পাচ্ছে না। হ্যাঁ, ওর একটা ভুল হয়েছে, ও কাল রাত থেকে ফোন টা খুঁজে পাচ্ছিলো না, অথচ ওর স্পষ্ট মনে ছিলো ও ওটা সোফার ওপরেই রেখেছিলো। তারপর আর মনে ছিলো না, রাতে অদিতি কে ফোন করতে গিয়ে আর ফোন টা খুঁজে পায় নি ও। ও জানতো অদিতি চিন্তা করবে, ও অপেক্ষা করে থাকবে ফোনের জন্যে, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না সেটা।

বাধ্য হয়েই শুয়ে পড়লো শেষে, কান খাড়া করে রেখেছিলো যদি বাজে ফোন টা কোথাও, কিন্তু সেটাও বাজেনি। তার মানে অদিতিও ওকে ফোন করেনি একবারও, তাহলেও তো ফোনটা খুঁজে পেতো ও, কাল থেকেই মনে হচ্ছিলো বারবার। অবশেষে সকালে উঠে চা করতে গিয়ে রান্নাঘরে খুঁজে পেয়েছিলো ওটা, সাইলেন্ট মোডে করা ছিলো। বোধহয় কলেজে ক্লাস করার সময় করেছিলো আর ঠিক করা হয়নি। ফোন টা খুলতে গিয়ে দেখলো চার্জ শেষ হয়ে ওটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে কখন কে জানে। চার্জ দিয়ে ফোন টা কে অন্ করার পর অদিতির অনেকগুলো মিসড কল দেখেই সঙ্গে সঙ্গেই ওকে ফোন করলো অর্ক।

কিন্তু ওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চিৎকার করতে লাগলো দিতি। ও তো জানে ওর ভুল হয়েছে, কিন্তু সেটা যে ইচ্ছাকৃত নয় এটা কোনোদিন বোঝেনা দিতি। ওর সব সময় ধারণা ইচ্ছে করেই ফোন ধরেনা অর্ক। কিন্তু সত্যি যে কাল থেকে ও ফোন টা খুঁজে পায়নি সেটা দিতি কে বোঝাবে কে! সব সময় রাগ দেখায় ওর ওপর। ওরও রাগ হচ্ছে এবার, কোনো কথাই বলতে দিলো না, জানতে চাইতেও তো পারতো কি হয়েছিলো, তা না করেই আগেই চিৎকার করতে লাগলো।

সামান্য ফোন করেনি বলে আর মুখ দেখতে চায় না, পাগল নাকি অদিতি, সন্দেহ হচ্ছে ওর এখন! কোনো সুস্থ লোক শুধু এই কারণে ডিভোর্সের কথা বলে, বিরক্ত হচ্ছিলো অর্ক। এতো জোরে চিৎকার করছিলো ও, যে মাও শুনতে পেতে পারে, এতো বোধের অভাব, যথেষ্ট বড়, বাচ্চা তো নয়, এবার নিজেরও রাগ হয়ে যাচ্ছে, রেগে গিয়ে ফোন টাই বন্ধ করে দিলো অর্ক।
ক্রমশ
চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে