এক কুয়াশার সকাল পর্ব-০৫

0
841

#এক কুয়াশার সকাল
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_৫

চার কদম যেতেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।
আর ভাবতে লাগলাম,
এই একই কথা আমি কোথায় যেন শুনেছি…
কে যেন বলেছিলো,
আমার স্পষ্ট মনে আছে,এই একই কথা আমি এর আগেও একবার শুনেছি।

কিছু ক্ষণ ভাবতেই আমার মনে পড়ে গেলো,
আপনার মেয়েরে বইলেন,ও যেন ঘোমটা দিয়ে বের হয়।
ওরে কোন পোলা যেন না দেখে।

এই কথা টা সেদিন রাতে ওই অসভ্য টা বলেছিলো।
যে আমাদের এমন পেরেশান করে বেড়াচ্ছে।
আমাদের জ্বালাতে জ্বালাতে অতিষ্ট করে দিচ্ছে।

আর আজ একই ভাবে আমীর আংকেল বলছে যে,
আজ এবং এই মুহূর্ত থেকে ঘোমটা দিয়ে যাবা যেখানেই যাবা।
কোন পোলা যেন তোমাকে দেখতে না পায়।

সেই একি কথা আমীর আংকেল বলছে,আর সেদিন ওই অসভ্য টাও একই কথা বলেছিলো।

আমি এবার পেছন ফিরে তাকালাম।

আর আমীর আংকেলকে বললাম,

আংকেল শোনেন,

_হুম বলো।
_আপনি জানেন আংকেল,সেদিন রাতে না ওই অসভ্য টার সাথে আমার আর আম্মুর কথা হয়েছিলো।

ওই অসভ্য টা না ঠিক একই ভাবে এই কথা গুলো বলেছিলো।যেই অসভ্য টা আমাদের জ্বালায়।

_কোন কথা গুলো?
_এই যে আপনি এখন যেই কথা গুলো আমাকে বললেন,

যে আমি যেন ঘোমটা দিয়ে যাই।
আর কোন ছেলে যেন আমাকে না দেখে।

_তাই নাকি?ছেলেটা তোমার ভালো চায়।আর তোমাকে ভালবাসে বলে হয়তো এ কথা বলেছে।

_আপনি কিভাবে জানেন আংকেল?
ওই ছেলে যে আমাকে ভালবাসে?
আর সে যদি আমার ভালোই চাইতো,তাহলে কি আমাকে আর আমার পরিবারকে এই ভাবে জ্বালাতো?

এগুলো কি কোন মানুষের কাজ?
দেখলেন না,এলাকার মানুষ গুলোও কত চিন্তিত আমাদের নিয়ে।

আর আপনিও কত কষ্ট করলেন,ভাইয়া আর আপনি দুজন মিলে রাতে আমাদের বাসা পাহারাও দিলেন,রাত জেগে।ঘুম নষ্ট করে।

কত কষ্ট হলো আপনাদের দুজনের।
তবুও তো লাভ হলোনা, অমানুষ টা ঠিকই আমাদের জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

_কাউকে এইভাবে গালি দিতে নেই নিধি।
_ওহ আচ্ছা,তাই নাকি?
_হ্যাঁ,এবার তুমি যাও নিধি।
_আচ্ছা ঠিক আছে।

আমি কথা বলছিলাম,আর আমীর আংকেল চোখ দুটো নামিয়ে আমার সাথে কথা বলছিলেন এতক্ষণ।

আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে সেদিন বাসায় ফিরে গেলাম।

কিছুই ভালো লাগছেনা আমার।
আর আশেপাশে যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছেনা।

বাসায় গিয়ে শুয়ে আছি আমি।
আম্মু বুঝতে পেরেছে আমার ভালো লাগছেনা।
তাই আম্মু আর কিছু না বলেই আমাকে দেখে চলে যায়।

সারাদিন কেটে গেলো।

আমি জানি আজ রাতে অসভ্য টা ঠিকই আসবে।

আজ রাতে আমি আম্মুকে বললাম,আম্মু আমার সাথে একটু জেগে থাকো।
আর আমি যা বলবো বা করবো চুপ করে দেখবা আর শুনবা।
কোন কথা বলবা না।

আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
কি করবি আর কি বলবি?
আর কাকেই বা বলবি?

আমি বললাম,পরে বলবোনে সব।

আম্মু আমার সাথে জেগে আছে।

_কিরে আর কত ক্ষণ জেগে থাকবো?
আমার শরীর ভালো লাগছেনা।

_আচ্ছা তাহলে ঘুমাও।
দরকার হলে ডাকবোনে আমি তোমায়।

_তোর এখানেই শুই।
_হুম শোও।

কিছু ক্ষণ পরই অসভ্য টার আগমন।

সে টিনে বারি দিচ্ছে।

_এবার আমি বললাম,
অযথা এমন করে কি মজা পাচ্ছেন আপনি বলুন তো?

আপনার এই অসভ্যপানা করার কথা যদি একজন জানে তাহলে আপনার খবর আছে।

সে চিকন গলায় বল্লো,
_কে জানলে আমার খবর আছে?

আমি বললাম,নাম বলবোনা।
তবে তাকে যদি বলি আপনার এই জ্বালতনের কথা।
তাহলে আপনার আর রক্ষা নেই।

_কে সে?
তোমার প্রেমিক?
নাম কি ওর?
_কে সে,কি হয় আমার,বা নাম কি তা আপনাকে বলবো কেন?
আপনি জানবেনও না কে সে।
কিন্তু যা করার সে করে ফেলবে।

_হা হা হা নাম টা শুনি।
কে আমার কি করবে,তা জানতে হবেতো।
এত বড় বুকের পাটা কার যে আমার কিছু করবে।

_সময় হোক,বুঝতে পারবেন।
অযথা এসব করা বাদ দেন।
ও জানলে দিন দুনিয়া ভুলায় ফেলবে একেবারে।

_ওরে বাবা ভয় পাইছি আমি।
কে আমার দিন দুনিয়া ভুলায় ফেলবে,ওই পুচকে ছেলে?
যে কিনা কাপুরুষের মত কুয়াশা ভরা সকালে মুখ ঢেকে তোমার সামনে আসে?
যাতে কেউ চিনতে না পারে?
এক থাপ্পড় দিলে আরেক থাপ্পড় দেবার জায়গা নাই আর ও কিনা আমার কি করবে।ওই ছেলের নাম কল্লোল তাইনা?
চিনিতো।

_তাই নাকি আমীর আংকেল?কল্লোলকেও চিনেন আপনি?উফ কি অদ্ভুত ক্ষমতা শক্তি আপনার,আপনি ঘরে বসেই কিভাবে জেনে গেলেন,যে আজ কুয়াশার সকালে আমার সামনে কল্লোল এসেছিলো,তাও আবার মুখ ঢেকে।

ছেলেটা না হয় কাপুরুষ তাই কুয়াশার সকালে আমাকে দেখতে আসে।

আর আপনি কি করেন আমীর আংকেল?
এই রাতের বেলা আমি সহ আমার পরিবারকে পেরেশানিতে ফেলতে আসেন।
এটা কি পুরুষত্ব?

_এসব কি বলছো নিধি?
আমীর কে?

_আমীর আংকেল,আপনার নাটক এবার বন্ধ করেন।
অনেক হয়েছে ভালো মানুষীর নাটক।
আপনাকে আমার পরিবার কত ভালো জানতো,আর আপনাকে।
কিন্তু আপনি কিনা এমন করতে পারলেন?

আপনি আমাকে যেদিন প্রথম প্রপোজ করেছিলেন।
বলেছিলেন,আমাকে বিয়ে করবা?
তাহলে আজীবন তোমার স্যারের কাছে পড়তে পারবা।

আমার সেদিন আপনার কথা টা বিচ্ছিরী লেগেছিলো।
কারণ আপনি আমার চাচ্চু হোন।
আপনাকে আমি কোন দিন ওই ভাবে দেখিনি।

আমি সুন্দর ভাবে বলেছিলাম।
আংকেল,আমার এসব কথা ভালো লাগেনা।
আর কখনো এগুলো বলবেন না।

আপনি বললেন,যদি বলি?
তাহলে কি করবা?

আমি বলেছিলাম,তাহলে আমি স্যার কে বলে দিবো।

আপনি সেই থেকেই আমার পিছু নিয়েছেন তাইনা?

অথচ আমি এসব ভুলেই গিয়েছিলাম।

আপনিই আবির ভাইয়াকে বারি দিয়ে ফেলে দিয়ে পালিয়েছিলেন না?

অথচ আপনিই না কি সুন্দর ভাবে অভিনয় করে দুই চারদিন আগেই আবির ভাইয়ার সাথে আমাদের বাড়ী পাহারা দিয়েছেন।

আবির ভাইয়া সেদিন বল্লো আম্মুকে,
আমরা তাহলে চলে যাই কাকী।
কেউ তো আসলোনা আজ।
আপনারা ঘুমিয়ে পড়েন।আর যেই আসুক রাতে,দরজা খুলতে বললে খুলবেন না।

সে কি বোকাই না ছিলো সেদিন আমাদের মত।

সে কি জানতো?
তার সাথেই তো অসভ্য টা দাঁড়িয়ে আছে।
সে চলে যাবার পরই অসভ্য টা বিরক্ত শুরু করবে।

আর যে রাতে বারি দিয়ে ফেলে গেলেন।
সেদিনও বেচারা বুঝেনি।
তার সাথেই যেই মানুষটা পাহারা দিলো আমাদের।
সেই মানুষটাই তাকে আঘাত করে পালালো।
বেচারা পরে একা একাও আমাদের পাহারা দিয়েছে।
আর আমি কিনা ক্ষাণিক সময়ের জন্য তাকে ভুল বুঝতে বসেছিলাম।
আম্মু ঠিকই মানুষ চিনে।
আম্মু বলেছিলো আবিরকে আমি চিনি।ও তো জীবনেও এমন করবেনা

আর কি প্ল্যানই না ছিলো আপনার।
বিরক্তও করেন আপনি।
পাহারাও দেন আপনি।
যাতে কেউ সন্দেহ অবদি না করতে পারে।

প্লিজ চলে যান।
আপনার সব কিছুই ফাঁস হয়ে গেছে।
যদি চান এই সব অন্য কেউ না জানুক।
তাহলে প্লিজ আর বিরক্ত করবেন না।

আমীর আংকেল চুপচাপ আমার কথা গুলো শুনেছে এতক্ষণ।

তারপর তার নিরবতা ভেঙে বল্লো,
সরি।
কেউ যেন কিছু না জানে কিছু।
এমন কি ভাইয়াও না।
আসি।

চলে গেলো অসভ্য ওরফে আমীর আংকেল।

আম্মু অবাক হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ।

তারপর আমাকে বলে,
আমি ওকে অনেক ভালো জানতামরে।

আচ্ছা তুই এসব বললি কেন,
যে একজন জানলে ওর খবর আছে।
আরো কত কি।

_আম্মু,না হলে জানতাম কি করে যে এটাই আমীর।
_বুঝলাম না কিছু।
বুঝিয়ে বল।

_আরে আম্মু,আজ সকালে ওই ছেলে টা আবার এসেছিলো।
কুয়াশার মধ্যে মুখ ঢেকে আসা ছেলেটা।
আর তখনই আমীর আংকেল এসে পড়েছে ওখানে।

আমি তার তখনকার কয়েকটা কথায় আন্দাজ করেছিলাম,আমীর আর আমাদের জ্বালাতন করা ছেলেটা একই মানুষ।

আর সে ছাড়া কল্লোলকে,মানে কুয়াশায় মুখ ঢেকে আসা ছেলেটাকে কেউ দেখেনি আমার কাছে আসতে।

আমার মনে হচ্ছিলো,এমন ভাবে তাকে কিছু বললে,হয়তো তার মুখ ফসকে কিছু বেরিয়ে যাবে।

নয়তো সে কল্লোলকে খুঁজা শুরু করবে।
কারণ আজ সে আমায় তার সাথে দেখেছে।

আর কল্লোল ছেলেটা হয়তো পছন্দ করে আমায়।
আর অবশ্যই সে আমাকে দেখতে আবার আসবে।

আর তাকে এই আমীর খুঁজে বের করলে বা কিছু বললে,তা তখন কল্লোল আমাকে ঠিকই বলবে।

আর তখনই বুঝা যাবে উনিই সে কিনা।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সব প্রমাণ হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।

সে নিজেই নিজের ফাঁদে পড়ে গেলো আরকি।

_আচ্ছা বাদ দে,কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।আজ এবং এখানেই সব ভুলে যা।
এই জঘন্য অধ্যায় এখানেই বন্ধ করে দে।

_হুম আম্মু।
ঘুমাও এখন যাও।

পরের দিন আর পড়তে যাইনি।

লেইট করে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে চলে গিয়েছি।

ক্লাস করছি একের পর এক।

চার নাম্বার ক্লাস শেষ হবে মাত্র দুই তিন মিনিটের মত বাকি।
তারপরই টিফিন টাইম।

সেই মুহূর্তে একটা মহিলা কণা কণা কণারে বলতে বলতে কান্না করতে করতে ক্লাস রুমে ঢোকেন।
স্যার ও ক্লাসেই তখন।

আমার সামনের বেঞ্চে বসে থাকা আমার ক্লাসমেট কণা চমকে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

_কি হয়েছে কাকী?
এভাবে কান্না করতেছেন কেন?

_তখন ওর কাকী এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে তোর ভাইকে কে বা কারা যেন অনেক মেরেছে।
ও এখন হসপিটালে ভর্তি।
অবস্থা বেশি ভালোনা।
চল তাড়াতাড়ি চল।

কণা তখন চিৎকার দিয়ে বলে,কল্লোল ভাইয়া।কিভাবে হলো কাকী,কিভাবে হলো?

_আর তোর সাথে পড়ে,নিধি নামের নাকি একটা মেয়ে আছে।ওই মেয়েটাকেও নিয়ে চল।

কণা আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ওর কাকীকে জিজ্ঞেস করলো।
নিধিকে কেন?

_কল্লোল,বার বার বলেছে কণা আর নিধিকে আমি দেখবো।আমার কাছে ওদের একটু নিয়ে এসো।

তোর মা জিজ্ঞেস করেছে নিধি কে?
কল্লোল শুধু বলেছে কণার ক্লাসমেট।

স্যার কণার কাকীকে বলেন,যান নিয়ে যান কণাকে।
কিন্তু নিধিকে আমি যেতে দিতে পারবোনা।
কারণ নিধির কোন সম্পর্ক নেই আপনাদের সাথে।
আর যদি এরপর কোন সমস্যা হয় নিধির।
এই দায়ভার কে নেবে?

কণার কাকী দু হাত জড় করে স্যারকে বললেন,স্যার ছেলেটার অবস্থা বেশি ভালোনা।
মানুষের শেষ ইচ্ছে বলেও তো কথা আছে।
যেতে দিন স্যার ওকে।
কোন সমস্যা হবেনা ওর।আমি কথা দিলাম।

স্যার আমাকে বললেন তুমি যাবে?

কণার কাকী আমাকে বললেন,মা চলো।
হাতে ধরি তোমার আমি।
ছেলেটার অবস্থা খুবই খারাপ।একবার চোখের দেখাইতো দেখবে।
তারপর চলে এসো তুমি।

টিফিনের বেল পড়ে গেলো।
স্যার বললেন,আপনি হেড মাস্টারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসেন।
তিনি হেড মাস্টারের কাছে গেলেন কণাকে আর কণার কাকীকে।

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার দিকে তাকালো।
আমাকে ধরে বলতে লাগলো,তুই কেন এমন চুপ হয়ে গেলি?
কি হলো তোর?
আর কে এই কল্লোল?
তোকে কেন দেখতে চাইলো।
আমি তখনও চুপ।

এবার তিথী আমার কাছে আসলো,এসে বল্লো,আমার ভাইয়ের মত কণার ভাইও বুঝি তোকে পছন্দ করে?
আমার ভাই তোকে দেখতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে গেলো।
আর এই ছেলেকে কারা মেরে হসপিটালে পাঠালো।
আর কার কার ভাই তোকে পছন্দ করে হসপিটালে যাবে আমি এটা ভাবছি।

_তুই চুপ থাক তিথী।
আজাইরা কথা বার্তা বলা শুরু করেছিস।ওই নিধি,কণার ভাই তোকে কেন দেখতে চাইলো বল?
কণার ভাই কল্লোল কি কুয়াশার সকালের মুখ বেধে আসা সেই কল্লোল?
কথা বল।(আমার বান্ধবী)

আমি দু চোখ বন্ধ করে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে বললাম।
আমি যাবো দেখতে কণার ভাইকে।
চল আমার সাথে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে