এক কুয়াশার সকাল পর্ব-০৭(শেষ পর্ব)

0
1216

#এক কুয়াশার সকাল
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#৭ম_পর্ব (শেষ)

আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি আবির ভাইয়া রেলিং এ নেই।
সে সত্যি সত্যি ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেছে।

আমি দৌড়ে আবির ভাইয়াকে দেখতে রেলিং এর কাছে যাই।
সাথে দাদা ভাই টাও।

দেখি আবির ভাইয়ার কিছুই হয়নি।
সে কিভাবে যেন ভেসে আছে।আর বলছে আমি কি মরে যাবো?ডুবে যাবো একবার বল?

আমি বললাম,
_আপনি কি আমার কথা শুনবেন?আপনি কি উঠে আসবেন?
নাকি আমিও লাফিয়ে পড়বো?
আমার জন্য একজন সুইসাইড করেছে এই অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
আর আপনিতো জানেন,আমি সাঁতার জানিনা।
পরলেই সাথে সাথে পোটল তুলে ফেলবো।

_না না আমি আসছি।
তুমি কিছু করোনা।

এই কথা বলে আবির ভাইয়া উঠে আসে কিছু ক্ষণের মধ্যে।

সে আসার পর আমি তাকে শুধু বলি,

_ভাইয়া কিছু কথা বলি?
_হুম বলো।
জোর করে কি ভালবাসা পাওয়া যায় বলেন?
আপনি এমন সীনক্রিয়েট করে যদি আমাকে বিয়েও করেন।
তাহলে কি আমার মন পাবেন?
আমি তো আপনাকে ভাই বলে জানি।
ভাই কে কিভাবে স্বামীর স্থান দিবো বলুন তো?
আমি কোন দিন আপনাকে মানতে পারবোনা।
প্লিজ ভাইয়া পাগলামো না করে বাইরে চলে যান।
কাজ করুন।
ভবিষ্যৎ ভালো হবে।

দাদাভাই ও আবিরকে বুঝিয়ে যান।
আমার বান্ধবীটাও চলে আসে আমাদের সাথে।

কিছু দিন পরই হঠাৎ একদিন আমার এক কাকী এসে আম্মুকে বলেন,

ভাবী, আবির বিয়ে করে বউ নিয়ে আসছে।
দেখতে যাবেন নাকি?

_কি বলো তুমি?
আবির এভাবে হুট করে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে?
এটা কিভাবে সম্ভব?
আরে ভাবী সম্ভব বলেইতো করেছে।
চলেন বউ দেখে আসি।

শুনে মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেল্লাম।
যাক একজন তো বিদেয় হলো।

পরে আস্তে আস্তে শুনতে পাই ওই যে ওই দাদাভাইটা সেদিনের ঘটনা নাকি আবির ভাইয়ার বাবা মাকে জানিয়ে দিয়েছিলো।
যাতে ছেলে আর এমন কদম না উঠায়।

এই কথা শুনে আবির ভাইয়ার মা একদিন প্ল্যান করে তার বোনের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যান আবির ভাইয়াকে।
খালার বাসায় ভাগ্নে বেড়াতে যাবে এটা স্বাভাবিক।
কিন্তু ওখানে গিয়ে আবির ভাইয়ার মা এমন সীন ক্রিয়েট করেন যে,এই মুহূর্তে আবির ভাইয়ার তার খালাতো বোনকে বিয়ে করতে হবে।
নইলে তার মা স্ট্রোক করে ফেলবেন হয়তো।
নয়তো নিজেই কিছু করে বসবেন।

আর তারপরই বিয়েটা হয়ে যায় আবির ভাইয়ার,তার খালাতো বোনের সাথে।

কোন মা ই চাইবেন না ছেলে ধুকে ধুকে মরুক।
তাই সে এই ব্যবস্থা নেয়াটাই জরুরি মনে করেছেন।
যেহেতু আমি রাজি না,আর আব্বুও না করে দিয়েছেন।

আবির ভাইয়ার বিয়ের খবরে আমি বেশ খুশি।
অন্তত একটা ঝামেলা তো বিদেয় হলো।

অসভ্য আমীরকে তো কোন দিন আমার পরিবার মানবেই না।
আর আমিতো জীবনেও মানবোনা তাকে।
তাকে দেখলেই এখন ঘৃণা লাগে।
মানুষটা ভালো মানুষীর আড়ালে কতই না জঘন্য ভাবে আমাদের জ্বালিয়ে গেলো।

আর তিথী ওর দুর্জয় ভাইয়াকে বলেছে,
নিধির সাথে একটা ছেলের রিলেশন আছে।যে কিনা আমাদের ক্লাসমেট কণার ভাই কল্লোলকে খুব মেরেছে।
শুধু মাত্র নিধিকে ছেলেটা পছন্দ করেছিলো বলে।
তুমি আর নিধির দিকে আগিওনা।
ও অন্য কাউকে ভালবাসে।

তিথী আরো কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলে ওর ভাইকে,যাতে ওর ভাই আর আমার দিকে না আগায়।
আর এই কথা ও সেদিনই ওর ভাইকে বলেছে,যেদিন আমীর কল্লোলকে মেরেছিলো।
কোন বোনই চাইবেনা,তার ভাইকেও কেউ এভাবে মারুক।

আর ওর এই কথা গুলো বিশ্বাস করে তিথীর ভাই দুর্জয় ও নিজে থেকে সরে যায়।
সে বিশ্বাস করে নেয় আমার সাথে আমীরের হয়তো সত্যি রিলেশন চলছে।

যাইহোক,আমিতো অন্তত বেঁচেছি।
আমীর বাদ,আবির ভাইয়ার চ্যাপ্টারও অফ,
দুর্জয় বাদ।

বাকি রইলো কল্লোল।
ও সেই মারামারির পর সুস্থ যে হয়েছে,আর আমার সামনে আসেনি।

যে মেয়ের জন্য মরণের পথ থেকে ফিরে এসেছে।
সেই মেয়ের সামনে না আসাই স্বাভাবিক।

কিছু দিন পর আমাদের নতুন বাসা কমপ্লিট হয়ে গেলো।

আমরা নতুন বাসায় উঠলাম।
কারণ এখানে থাকার ইচ্ছে টাই মরে গিয়েছিলো এত ঝামেলার কারণে।

আর আমি ডিসিশন নিয়েছিলাম নতুন বাসায় উঠেই বোরখা পরা শুরু করবো।
যাতে কেউ না দেখতে পায় আমায়।
আর না দেখতে পেলে সমস্যাও করবেনা কোন।

ফাইনাল এক্সামের ডেইট পরলো।
এক্সাম শেষ করলাম।

রেজাল্ট দিলো,আলহামদুলিল্লাহ পাশ করলাম।

নতুন বাসায়ও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
তেমন কোন মানুষ নেই পিন মেরে কথা বলার জন্য।
বা আমাকে বিরক্ত করার জন্য।

আশেপাশের মানুষ গুলোও ভালো।
কেউ কারো খুঁটিনাটি নিয়ে পড়ে থাকেনা।

কলেজে ভর্তি হবার ডেট পরলো।

কলেজে গেলাম,যেই কলেজে ভর্তি হবো আমি।

কলেজের কাউকে আমি চিনিনা।
একদম নতুন আমি কলেজে,
শুধু আমার সাথে যারা ভর্তি হতে গিয়েছে তাদেরই চিনি।

ভর্তির সব কাজ শেষ করে যেই না আমরা চলে আসতেছি,

ঠিক তখনই কে যেন আমায় নাম ধরে ডাকলো,

_নিধিইইই

আমি পেছন ফিরে তাকালাম,কিন্তু কাউকে দেখলাম না।

আমার ফ্রেন্ডরা সবাই বল্লো,এখানে তোকে আবার কে চেনে?

অন্য কাউকে ডাকছে হয়তো।

আমরা আবারো চলে আসার জন্য পা বাড়াই।

আবারো ডাক আসে একটা,

নিধিইইইইই এই যে আমি।

দু তলায় তাকাও।

আমি দু তলায় তাকাই তবে আমি বুঝতে পারছিনা কে সে।

তারপর দেখি কেউ একজন দৌড়ে দু তলা থেকে নেমে কলেজের গেইটের সামনে হাঁপাতে হাঁপাতে আসলো।

এসেই আমার হাত থেকে পানির বোতল টা নিয়ে ঢক ঢক করে পানি পান করতে শুরু করলো।

আমি বললাম আমার এটো পানি তো।মুখ লাগিয়ে খেয়েছি।উঁচু করে খাইনি।

সে তবুও খেয়ে নিলো।

_তারপর বলো কেমন আছো?
চিনতে পেরেছো আমায়?

_হুম চিনেছি।
_কিভাবে চিনলে?আজ তো মুখ ঢেকে আসিনি আমি।হা হা হা।

আচ্ছা,এভাবে মানুষ গায়েব হয় বলোতো?
বাসা চেঞ্জ করেছো,বাসার ঠিকানাটাও দাওনি কাউকে।কত খুঁজেছি।
ফাইনাল এক্সামের সময় কণার সাথে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি।
কিন্তু দেখিনি এত স্টুডেন্ট আর গার্ডিয়ান দের ভীড়ে।

কণার ক্লাসেও পড়েনি তোমার সীট যে খবর নিবো একটু।

পালিয়েছো নাকি হুম?

_পালাইনি।
সমস্যা তো সলভ হয়েই গিয়েছিলো।
যে যার মত থাকছে।
কেউ আর জ্বালাচ্ছেনা।
তবে আমি শান্তি খুঁজছিলাম।
এখন খুব শান্তিতে আছি।
ওখানে কেউ নেই আপনাদের মত পঁচা লোক।

_কয়দিন বের হয়েছো বাইরে?
_বের হওয়া হয়না।
কলেজে আসতে হতো বলে বের হয়েছি।

_তাহলে কিভাবে বুঝলে পঁচা লোক নেই?
আছে।হয়তো তোমায় দেখেনি এখনো।

আমার ফ্রেন্ডরাও কথা বল্লো কয়েক জন কল্লোলের সাথে।

জিজ্ঞেস করলো কিসে পড়ে কল্লোল।
উত্তর দিলো অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।

আমি আচ্ছা আসি,
ভালো থাকবেন বলে চলে আসছিলাম।
তখনই কল্লোল বলে,
যাও সমস্যা নেই।
তবে আমি বেঁচে থাকতে আর পিছু ছাড়ছিনা।
২য় বার যখন আল্লাহ আবার মিলিয়ে দিয়েছেন।
এবার হাতটা ধরেই ছাড়বো।

আমার ফ্রেন্ডরা বলে উঠলো ধরে আবার ছেড়ে দিবেন?

কল্লোল হেসে দিলো।
সবাই হাসাহাসি শুরু করলো।

_আরে আমি ধরে ছেড়ে দিবো বলেছি নাকি?
তোমরাও যা হয়েছো না।

_আচ্ছা আসি তাহলে।
ভালো থাকুন।

_কাল আমি কলেজের এইখান টায় থাকবো।
এসেই এখানে চলে আসবে হুম?

_আসবোনা।আসছি।
_তোমাকে আসতেই হবে।

আমি কোন কথা না বলে চলে আসি।

আম্মুকে বাসায় গিয়ে বলি আমি বোরখা পরবো।
আমাকে আজই একটা বোরখা কিনে এনে দিবা।

আম্মু অবাক হয়ে বল্লো,সত্যি?

উত্তর দিলাম হুম।

তারপর আম্মু আমাকে একটা বোরখা কিনে এনে দিলো।

আমি অনেক দিন আর কলেজে যাইনি।

যেদিন থেকে ক্লাস শুরু হয় সেদিন প্রথম ক্লাসে যাই আমি।তাও আবার বোরখা পরে।
সেই প্রথম শুরু হয় আমার বোরখা পরা।

মনে মনে বলতে থাকি এখন আর কেউ বিরক্ত করবেনা আমায়।
না মুখ দেখবে,না জ্বালাবে।
আর না কল্লোল চিনবে।

সেদিন দুই টা ক্লাস করে আমি বাসায় চলে যাচ্ছি,
আর সেই মুহূর্তে কল্লোল আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।

_এত দিন আসোনি কেন কলেজে?
কত ওয়েট করেছি জানো?
এত পাষাণী কেন তুমি?

_আপনি কে?
আপনাকে তো চিনিনা আমি।

_ওই মেয়ে,বোরখা পরলে আর মুখ ঢাকলেই আমি তোমাকে চিনবোনা ভেবেছো?

তোমার চোখ দেখলেই আমি বুঝি বুঝছো?
আর তোমাকে চিনতে আমার দুই মিনিট ও লাগবেনা।

তাই চিনিনা মিনিনা বাদ দাও।

_উফফ সবায় পিছু ছাড়লো,আপনি এখনো পড়ে রইলেন।
আপনি কবে ছাড়বেন পিছু?আপনি ছাড়লেই আমি মুক্ত।
_আমিতো ছাড়বোনা।
তোমাকে আমার বাহুডোরে বন্দি থাকতে হবে আজীবন।
_ধুর।
_হুর।
_হুর কি?
_হুর তুমি।
তুমি জানো হুর অনেক সুন্দর হয়।
_ধুর।
_হুর।
_ভাল্লাগেনা কিন্তু।

তখনই কল্লোল আমাদের পাশে থাকা একটা নাম না জানা ফুল গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে ধুপ করে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।

আর আমার সামনে ফুল টা এগিয়ে দিয়ে বলে।
আপনি কি আমার বোনের ভাবী হবেন?

_একটু বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছেনা?
আশেপাশে ছেলে মেয়েরা দেখছে দেখেছেন?
স্যার ম্যাডাম রা যদি চলে আসে কি হবে ভেবেছেন?

_কিচ্ছু হবেনা।
ফুল না নিলে আমি কিন্তু উঠবোনা।

আমি দৌড়ে গেইট এর সামনে গিয়ে বললাম,
আমি চলে যাচ্ছি,
আপনি সারাদিন বসে থাকেন।

_নিধিইইই তুমি কিন্তু কাজ টা ঠিক করলেনা।

রাজি না হলে এক কুয়াশার সকালে একদম তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলবো কিন্তু।

আমি হাসতে হাসতে চলে আসি বাসায়।

বাসায় এসে আম্মুকে বলি সব।

আম্মু বলে, বেচারা একবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরলো।
তবুও তোর পিছু ছাড়লোনা।
আমাকে একদিন দেখাস তো ছেলেটা কেমন।

_আম্মু তুমিও না।
কি করবা ওই ছেলেকে দেখে তুমি?
_দেখতাম আরকি,আমার মেয়েকে কোন ছেলেটা এত ভালবাসে।
_হুম হইছে হইছে।

এর দুই দিন পর আমি আমার ফ্রেন্ডরা কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ কল্লোল এসে আমাকে বলে,
নিধি আমি না আর তোমাকে প্রতিদিন বিরক্ত করতে পারবোনা।

_কেন ভাইয়া?হাঁপিয়ে গেছেন নাকি?
হাল ছাড়বেন না কিন্তু।
আরেকটু চেষ্টা করলেই আমাদের বান্ধবী পটে যাবে।
_সত্যি নিধি?
_ধুর
_হুর।

আমার ঢাকায় একটা জব হয়েছে নিধি।
জব টা খুব ভালো।
তাই হাত ছাড়া করতে চাচ্ছিনা।

_আচ্ছা, শুভ কামনা।
_আগামীকালই জয়েন করতে হবে।
তাই আজই বাসা থেকে বের হতে হবে।
_সাবধানে যাবেন।
_তুমি কারো প্রেমে পড়োনা কিন্তু।
আর আমি মাসে একদিন কলেজে এসে কলেজের খবরাখবর নিয়ে যাবো, ক্লাস করে যাবো আর তোমাকে দেখে যাবো।
তুমি ঠিক মত পড়াশোনা করো।

_আচ্ছা ঠিক আছে।
_তাহলে আসি।
_আচ্ছা।
_কণার কাছ থেকে তোমার খবর জানবো।তাই ভালো ভাবে চলাফেরা করো কিন্তু।আর আমার খবর জানতে হলে ওর কাছ থেকে জেনে নিও।

(কণাও আমার কলেজেই ভর্তি হয়েছে)

কল্লোল চলে যায়।

আমিও কিছু দিন আর কলেজে যাইনা।

কয়েক দিন পর কণা ফোন দেয় আম্মুর নাম্বারে।

আমি কলেজে যাইনা বলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কাছ থেকে আম্মুর নাম্বার নেয়।

কণা আমাকে চাইলে আম্মু আমাকে ফোন টা দেয়।

তারপর কণা বলে,ভাইয়া তোমার খবর জানতে বলেছে।
তুমি কলেজে আসোনা কেন?

_এমনি যাইনা।
_ভাইয়া জবে ঢুকে অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে।
নতুন জয়েন করেছে তো।
ছুটি নেই।
শুধু শুক্রবারে ছুটি।
শুক্রবারে নানান কাজ থাকে তাই আসতে পারছেনা।
_আচ্ছা।
তুমি কি আমার ভাইয়াকে একটুও পছন্দ করোনা?
ভাইয়া কিন্তু তোমার কথা আম্মুকেও বলেছে।
আমাদের ইন্টার শেষ হলেই আম্মু প্রস্তাব নিয়ে আসবেন।
তত দিনে ভাইয়াও নিজের পায়ে দাঁড়াক।

তাহলে ভালো আছো তো হুম?
_আলহামদুলিল্লাহ।
_তাহলে রাখছি হ্যাঁ।কলেজে আসলে দেখা হবে।
_আচ্ছা।ভালো থেকো।

_কি বল্লো তোর বান্ধবী?
কলেজে যাস না তাই কিছু বল্লো?
_হুম।

কেটে গেলো অনেক গুলো দিন।

আবার এসে গেলো সেই শীত কাল।

একদিন রাতে আম্মু আমাকে ফোন টা দিয়ে বল্লো,

তোর ক্লাসমেট ফোন করেছে।
এই নে।

_আমি ফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই শুনি,

_নিধি আমি কল্লোল।
_আপনি?
আপনি আমার ক্লাসমেট?আপনি কল দিয়েছেন কিভাবে?নাম্বার পেলেন কই?
_কণার কাছ থেকে নিয়েছি নাম্বার।
নিয়েছি আগেই তবে কল দেইনি।
কল দিলে,কথা বললে আর থাকতে ইচ্ছে হতোনা এখানে।
চলে আসতে ইচ্ছে হতো।
_এখন বলছেন যে?
_আগামীকাল ৭ দিনের ছুটিতে আসতেছি।চাইলেই দেখতে পারবো।
এবার বলো,কেমন আছো তুমি?
_হুম আলহামদুলিল্লাহ।
_আমাকে জিজ্ঞেস করবেনা?
_নাহ।
_আচ্ছা না জিজ্ঞেস করলে।
আমি আমার প্রথম স্যালারি দিয়ে আম্মুর জন্য,কণার জন্য,আর তোমার জন্য কিছু কিনেছি।
কাল পেয়ে যাবা।
কাল কলেজে আসবে কিন্তু।

_নাহ,আসবোনা।
_কেন আসবেনা?
_অনেক শীত পড়েছে।আর বাইরে অনেক কুয়াশাও পড়ে সকালে।
তাই আসবোনা।
_তুমি আসবে এবং আসবেই,আর সেটা আমার টানে,আর কুয়াশার সকালেই।
এখন ঘুমাও।
_আচ্ছা।
_নিধি,
_জ্বী।
_আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।
রাখছি।

তারপর কল্লোল ফোন টা রেখে দেয়।

সকাল হলো…

জানালাটা খুলতেই দেখি,আজ অনেক বেশি কুয়াশা পড়েছে।
চারিদিক অন্ধকার।
আর শীতও পড়েছে ভীষণ।
কম্বল টা ভালো ভাবে গায়ে জড়িয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।

কিছু ক্ষণ পরেই আম্মু আমার রুমে দৌড়ে এলো,
এসে বলে,

_দেখতো নিধি,কে যেন ফোন দিয়ে কি বলছে।
কে নাকি এক্সিডেন্ট করেছে।

_আমি ফোন টা কানে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে বললাম,কে?

অপর পাশ থেকে কে যেন চিৎকার করে কান্না করছে,কান্নার আওয়াজে ভয়েজ টা ঠিক মত বোঝা যাচ্ছেনা।

_নিধি, কল্লোল ভাইয়া আর নেই।
কল্লোল ভাইয়া রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।
শেষ বারের মত দেখতে চাইলে আমাদের বাসায় চলে আয়।

লাইন টা কেটে গেলো।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
আম্মু পাশ থেকে বলছে,
_নিধি এই নিধি,কার কি হয়েছে?
কে এক্সিডেন্ট করেছে?

_আম্মু,
_হুম,
_তুমি না কল্লোল কে দেখতে চেয়েছিলে?
যেই ছেলেটা কুয়াশার সকালে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো।
মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেও আমাকে ভুলেনি।

_হুম চেয়েছিলাম তো।
_চলো তাহলে আমার সাথে।ওকে শেষ বারের মত দেখে নিবা।
_কি বলছিস তুই?
_কল্লোল রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।
আর কাল রাতে যে ফোন দিয়েছিলো আমায়,ও কল্লোলই ছিলো।
আমার কোন ক্লাসমেট ছিলোনা।

আমার আম্মু কথা টা শুনে চিৎকার দিয়ে কান্না করে দিয়েছে।
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে আম্মুর কান্না দেখছি।

আম্মু বোরখা পরতেছে,তারপর আমাকে নিয়ে রওনা দেয় কল্লোলদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে।

আমি ঠিক চিনিনা কল্লোলদের বাসা।
আম্মু কণাকে ফোন দিয়ে বাড়ীর ঠিক ঠিক ঠিকানা টা জেনে নেয়।

আমরা যাচ্ছি,
রাস্তা যেন আর ফুরোয় না।
যেই এলাকা ছেড়েছি সেই এলাকায় আবার পা রাখতে যাচ্ছি।

অবশেষে আমরা পৌঁছাই।
আমি ও বাড়ীতে পা রাখতেই কণা আমাকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে
চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
কিছু ক্ষণ পর কল্লোলের মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আর বলতে থাকে,দেখ আমার কল্লোলের বউ আসছে।
আমার কল্লোলের বউ আসছে।

সবাই বলতেছে,কল্লোলের মা এসব কি বলো?
মানুষ কি বলবে?
মেয়েটার তো বদনাম হবে।

কল্লোলের মা উত্তর দেয়,আমার কল্লোল ওরে খুব ভালবাসে।
আমারে কত বার বলছে,আম্মু আমি কিন্তু ওকেই বিয়ে করবো।
তুমি কিন্তু ওকেই আমার জন্য তোমার ঘরে নিয়ে আসবা।

আমি আমার ছেলেরে কথা দিছিলাম।
আমি ওরেই আমার ঘরের বউ করে নিয়ে আসবো।
যেভাবেই হোক।

দেখছো তোমরা,আমার ছেলের বউ আসছে।

আমার আম্মু কল্লোলের মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
নিজেও চিৎকার করে কাঁদতেছে।

কল্লোলের বাবা নেই।
ওর মায়ের মত সাদাসিধে মানুষ দুনিয়ায় ২য় টি আছে কিনা আমার জানা নেই।
কল্লোল ই তার এক মাত্র সন্তান।
আর কণা তার পালিত সন্তান।

আমি কল্লোলের মাকে আমার বুক থেকে সরিয়ে ধীরেধীরে কল্লোলের কাছে যেতে লাগলাম।

কল্লোলকে ওদের উঠোনে শুইয়ে রাখা হয়েছে।

একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
আমি ওর সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম।
বসে আছি,বসেই আছি।
এত ক্ষণে আমার ফ্রেন্ডরাও সবাই চলে এসেছে।
অনেকে আমার আগেই এসেছে।

আমি একজন কে বললাম,একটু কাপড় টা সরাবেন?
আমি ওকে একটু দেখবো।
ওর বন্ধু কাঁদতে কাঁদতে কাপড় টা সরিয়ে দিলো।
আর বল্লো,
জানেন আপু,
কল্লোল আপনাকে অনেক ভালবাসতো।

আমি কল্লোলের মুখটা দেখে, কল্লোল বলে জোরে একটা চিৎকার দিলাম।
কিন্তু ও আমার ডাকে কোন সাড়া দিলোনা।

_দেখেন আমি এসেছি তো।
আপনি বলেছিলেন না আমি আপনার টানে আসবোই আজ।
এসেছিতো আমি।
আর কুয়াশার সকালেই এসেছি।
আপনি আমাকে দেখবেন না?

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমাকে টেনে উঠানোর চেষ্টা করছে।
আমাকে চিৎকার করে কান্না করতে না করছে।
কিন্তু আমিতো পারছিনা কান্না থামাতে।
আমার বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
আমি পাগলের মত চিৎকার করে কান্না করে যাচ্ছি।

_আপনি না আমাকে ভালবাসেন?আমার কান্না থামাবেন না?
এই যে আমি চিৎকার করে কাঁদছি।
আপনার কি আমার জন্য কষ্ট হচ্ছেনা?

আম্মু কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,মারে ওর জন্য দোয়া কর।
এখন দোয়াটাই ওর কাজে লাগবে।
এভাবে কাঁদিস না।

কণা কণার মাও আমাকে ধরে কাঁদছে।
আমাকে থামতে বলছে।কান্না করতে না করছে।
আর বলছে,
ও না আমার জন্য একটা শাড়ী,কণার জন্য একটা ড্রেস আর তোমার জন্য একটা মোবাইল ফোন কিনেছিলো।
মোবাইল ফোন টা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে আমার ছেলের মত।

এই বলে কণার মা আরো জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।

কল্লোল বাইকে করে আসতেছিলো।
কুয়াশার কারণে তেমন একটা কিছু দেখা যাচ্ছিলোনা।
একটা ট্রাক এসে সব কিছু শেষ করে দিয়ে যায়।

কল্লোল অবশেষে আমার পিঁছু ছেড়ে দিলো।
ও ওর কথা রেখেছে,ও বলেছিলো মরার আগ পর্যন্ত আমার পিঁছু ছাড়বেনা।
তাই মরে গিয়ে আমায় মুক্ত করে দিয়ে গেলো।

কিছু ক্ষণ পর ওকে দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হলো।
দাফন সম্পন্ন হলো।
চলে গেলো কল্লোল।

আজও ছিলো সেই কুয়াশার সকাল।
কল্লোলকে আমি এমনই এক কুয়াশার সকালে প্রথম দেখেছিলাম।
আর আজ এক কুয়াশার সকালেই শেষ বারের মত দেখে নিলাম।

এরপর আরো অনেক কুয়াশার সকাল আসে।
শুধু কল্লোলই আসেনা।
আমি আজো আমাদের পুরাতন বাসায় গেলে কুয়াশার সকালে সেই জায়গাটায় কল্লোলকে খুঁজি,যেখানে প্রথম আমি মাফলার দিয়ে মুখ ঢাকা ছেলেটাকে দেখেছিলাম।
কিন্তু দূর দূরান্তে শুধু কুয়াশাই দেখা যায়।
ভাসা ভাসা চোখ দুটো আর দেখা যায়না।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে