একটুখানি সুখ পর্ব-২১+২২

0
1094

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২১

শ্বাস-প্রশ্বাস আরো প্রগাঢ় হচ্ছে মোহ ও স্বচ্ছের। স্বচ্ছের চোখে তীব্রকর একটা ক্ষোভ আর মোহের চোখে হতভম্বতা। নিজেকে সামলাতে না পেরে স্বচ্ছের ঘাড়ে আচমকা হাত রেখেছে মোহ। নিঃশ্বাস ওঠানামা করছে তার। আর একটু হলেই যেন সে অস্বস্তিতে মারা যাবে। এমতাবস্থায় তার কপাল বেয়ে গাল দিয়ে থুতনিতে এসে ঘামের ফোঁটা পৌঁছালো। আরো ঘামছে সে। এমন স্পর্শ প্রথমবার পেয়েছে সে কোনো পুরুষের থেকে। এই স্পর্শ নাড়িয়ে দিয়েছে মোহের হৃদয়। লোম শিউরে উঠেছে তার। তার ওপর স্বচ্ছের বলা কথাতে হৃৎস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এসব বলার মানে কি ছিল? স্বচ্ছের মনে কোনো অনুভূতি আছে? কোনো তীব্র ভালোবাসার অনুভূতি? কোনো উন্মাদনার বীজ?

কিছু বলতে চেয়েও পারছে না মোহ। সে স্বচ্ছ নামক এই উগ্র স্বভাবের মানুষটির ধূসর বর্ণের চোখের মনির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় পাচ্ছে না সে। স্বচ্ছ হঠাৎ করেই ঠোঁটজোড়া সরু করে ফুঁ দিল মোহের চোখেমুখে। চোখটা খিঁচে বন্ধ করে ফেলে মোহ। স্বচ্ছ ফুঁ দেওয়া বন্ধ করলে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় সে। অনুভব করে স্বচ্ছ তাকে বাঁধন মুক্ত করে দিয়েছে। হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। স্বচ্ছ বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
“এতটুকু ডোজেই এই অবস্থা? বিয়ের পরে আমাকে সামলাতে পারবে তো? আমার এতোগুলো গার্লফ্রেন্ডও আমাকে সামলাতে পারে না। তুমি পারবে তো? ভেবে দেখো আরেকবার!”

“চুপ করুন তো আপনি। আপনার মতো বেশরম মানুষ আমি জীবনে কোনোদিন দেখিনি।”
খানিকটা চেঁচিয়ে বলল মোহ। তারপরেই মিইয়ে গেল। এমন কথাবার্তা আর এমন মানুষের সামনে টিকে থাকা মুশকিল। কোনো কথা তো এদের গায়ে লাগেই না বরং দুনিয়ার যত প্রকার বেশরম কথাবার্তা আছে সবকয়টা বলতে দক্ষ এরা। এবার স্বচ্ছ উচ্চস্বরে হেঁসে ওঠে। মোহকে ব্যঙ্গ করে বলে,
“যাও যাও। বাড়ি যাও। ভালো করে খাওয়াদাওয়া করো। আমার সামান্য কথাতে তুমি যে মাত্রায় শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছো! মনে হয় ১০ কেজি ওজন এতেই কমে গেছে তোমার। বিয়ের দিন আসতে আসতে যদি আমার এমন কথা লাগাতার শুনতে থাকো তাহলে বিয়ের দিন তোমায় দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। বাড়িতে যেয়ে আগেই খেতে বসবা। গো ফাস্ট!”

“মোটেই আমার ওজন কমেনি। আপনি কেন ওই কথাগুলো বললেন? প্রথমবার মি. আহিয়ান স্বচ্ছের মুখ থেকে এমন কথা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম এই যা।”

“খুশিতে পাগল হয়ে যাওনি তাও ভালো। একটু প্র্যাক্টিস করে নিচ্ছিলাম। আজকে সকালে একটা নিউজ দেখলাম ফেসবুকে। নিউজটা ছিল ‘স্বামী রোমান্টিক কথাবার্তা না বলায় তাকে ঠান্ডা জিনিস খাইয়ে খাইয়ে কন্ঠস্বর একেবারে গায়েব করে দিল স্ত্রী।’ আমিও সেসবেরই ভয় পাচ্ছি। বলা তো যায় না, আজকালকার মেয়ে তো এসব দেখেই শিখে তারপর শ্বশুড়বাড়ি আসে। আমার সুন্দর কন্ঠস্বর না হারানোর ছোট্ট প্রচেষ্টা।”

স্বচ্ছের এমন কথা শুনে তার কথার সঙ্গে পেরে না উঠে প্রায় কেঁদে দেওয়ার উপক্রম মোহের। একটা ছেলে মানুষ কি করে এতো উল্টাপাল্টা লজিক পায় ভাবনাতে আসেই না মোহের। একটা মেয়ে মানুষও বোধহয় একটা বিষয়কে টেনে টেনে এতো লম্বা করতে পারে না। দাঁতে দাঁত দাঁড়িয়ে থাকে সে। স্বচ্ছ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“বাই দ্যা ওয়ে, হঠাৎ আমার বাড়িতে তাও এখন? তোমাদের বাড়িতে তো মা-বাবা গিয়েছে। তোমার তো সেখানো থাকা উচিত। তার বদলে এখানে?”

মোহ এবার কথা খুঁজে পায় না। মাথায় জোর দিয়ে চেষ্টা চালাতে থাকে বিভিন্ন বাহানা খুঁজতে। কিন্তু পায় না। সোজাসুজি বলতেও পারবে না যে সে স্বচ্ছের হাতে লিখা চেক করতে এসেছে। সে স্বচ্ছের হাতের লিখার ধরণ দেখতে চায়। একবার যদি ধরন মিল পায় তাহলেই আর কোনো সন্দেহ থাকবেনা তার মনে। কারণ সেই আগন্তুক লোকটার হাতের লিখা অদ্ভুত রকমের। ছোট ছোট পেঁচিয়ে লিখে সে। যেন টাইপ করে পেঁচানো লিখা একেবারে সোজা। বেশ ইনিয়েবিনিয়ে মোহ তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠে,
“নানিমা! নানিমাকে দেখতে এসেছি।”

“তাহলে দাদিমার ঘরেই যেতে। ওপরে এলে কেন? সামথিং ইজ ফিশি!”
চোখ ছোট পরে মোহের দিকে হালকা ঝুঁকে পড়ে বলে স্বচ্ছ। তৎক্ষণাৎ ঘড়ির দিকে চোখ যেতে বলে,
“ইটস ঠু লেট। তোমার আর তোমার টিনএজার বোনের চক্করে পড়ে আমি ভুলেই গেছি আমার কাজ আছে। রেডি হতে হবে।”

“এখন আবার কোন গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ডেট করার মতলব আছে আপনার?”

স্বচ্ছ বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছিল। মোহের কথা শুনেই পিছু ফিরে তাকালো সে। ভ্রু উঁচিয়ে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে বলল,
“জেলাস? হাউ সুইট! বিয়ে হতে না হতে এমন জেলাসি দেখছি। বিয়ের পরে মনে হয় না কারোর সঙ্গে মিট করতে পারব বলে। ব্রেকআপ করে দিতে হবে বোধহয়।”

“জেলাস আর আপনাকে নিয়ে? বয়েই গেল আমার।”

“বলা তো যায় না! দেখা গেল একদিন না একদিন এই ঠিকই বয়ে যাবে। ঠিকই হিংসাত্মক অনুভূতি তোমায় শুষে নেবে? কিছুই বলা যায় না। সবই ভাগ্য!”
অদ্ভুত হাসি দিল স্বচ্ছ। মোহকে কিছু বলার সুযোগই আর দিল না সে। বারান্দা থেকে চলে গেল সেই মূহুর্তেই। মোহের কানে বারংবার বাজতে থাকল সেই কথা। সত্যিই কি কখনো বয়ে যাবে তার?

নাফিসা বেগমের সঙ্গে গল্পগুজব করে একটা বাহানায় ঘর থেকে বেরিয়ে এল মোহ। চোখেমুখে একটু ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। আশেপাশে দেখে পা টিপে টিপে হেঁটে গিয়ে স্বচ্ছের ঘরের সামনে পৌঁছাল সে। ঘরের দরজা হালকা ভাবে ভেজানো। কাঠ আর কাঁচের মিশ্রণের দরজা হালকা খুলতেই খট করে শব্দ হতেই জিহ্বায় কামড় দিয়ে বসল সে। মাথাটা ঢুকিয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিল চোরের মতো। স্বচ্ছ ঘরে নেই। মোহকে আর পায় কে? তড়তড় করে ঢুকে পড়ল ঘরে। বরাবরের মতো এতো এতো অগোছালো রুম থেকে নাক শিটকে ফেলে মোহ। মাথায় হাত দিয়ে আফসোসের সুরে বলে,
“আহা আমার সোনায় বাঁধানো কপাল! এই লোকের সাথে কি করে এডজাস্ট হবে আমার?”

বলেই মুখ চেপে ধরে মোহ। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ আসছে। কিছুটা কাশির আওয়াজ পেয়ে মোহের বুঝতে বাকি রইল না স্বচ্ছ ওয়াশরুমে। এই হচ্ছে তার সুযোগ। ঘরের আশেপাশে আরো ভালো করে চোখ বুলিয়ে মোহ খুঁজতে থাকে স্বচ্ছের স্টাডি টেবিল বা অন্যকিছু। না পেয়ে বেশ বিরক্ত হয় সে। মনে হয় লোকটার স্টাডি রুম আলাদা। সোফায় নজর যেতেই বেশ কয়েকটা কাগজ অগোছালো ভাবে পড়ে থাকতে দেখল সে। সাথে ল্যাপটপও আছে। ধীর পায়ে এগিয়ে সোফার কাছে গিয়ে হাতে তুলে নিল কাগজগুলো। ইংলিশে সব অফিসের কথাবার্তা লিখা। ফ্যাকাশে মুখে সেটা রেখে দিল সে। শেষ কাগজে চোখ গেল তার। বাংলায় বেশকিছু হিসেব-নিকেশ করা পাতাতে। তাড়াহুড়ো করে সেটা হাতে তুলে নিয়ে বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল লিখাগুলো। মনের ক্ষীণ আশা কোথাও একটা নিভে গেল। ফোঁস করে বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে কাগজটা রেখে দিল সে।

সেই আগন্তুক লোকটা আর স্বচ্ছের হাতের লিখার মাঝে আকাশপাতাল পার্থক্য। স্বচ্ছের লিখা ছোট ছোট হলেও পেঁচিয়ে লিখে না সে। একেবারে স্ট্রেট স্পষ্ট লিখা তার। আর স্বচ্ছের হাতের লিখা খুব ছোটও না। হালকা বড়। একই মানুষ তো আর দুরকম লিখতে পারে না। আর আগন্তুক লোকটা এমনভাবে পেঁচিয়ে লিখেছে যেন সে সেই লিখাতেই অভ্যস্ত। এবার সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েও স্বচ্ছকে বাদ দিতে ইচ্ছে করছে না মোহের। এতোসব ভাবনাতে মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়াতেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে ফট করে পিছন ঘুরে তাকায় মোহ। স্বচ্ছকে আবার বাথরোব পড়া অবস্থায় দেখে মাথা ঘুরে ওঠে তার। মনে পড়ে আবারও সেদিনের ঘটনা। শুকনো ঢক গিলতেই মোহকে দেখে স্বচ্ছও এবার চোখ বড় বড় করে বলে,

“তুমি আবার? তোমার মতলব কি সত্যি করে বলো? বার বার এসব সময়ই এসে বড় কেন তুমি মোহ? হুয়াই? আজকাল শাওয়ার নিতে বা ড্রেস চেঞ্জ ভয় লাগে। হুড়মুড়িয়ে তুমি ঢুকে পড়লে কি হবে আমার? সব লুটপাট হয়ে যাবে।”
মোহ আর দাঁড়ায় না এসব কথা শুনে। জোর করে একটা হাসি দিয়ে চোখের পলকে ভোঁ দৌড়ে গায়েব হয়ে যায় সে। তা দেখে হেঁসে দেয় স্বচ্ছ। মেয়েটা মাঝে মাঝে কি করে বসে নিজেই জানে না।

ঘাড় বাঁকিয়ে সোফার দিকে তাকায় সে। ল্যাপটপের ওপর কাগজপত্র অন্যভাবে পড়ে আছে। মৃদু হেঁসে এগিয়ে গিয়ে কাগজগুলো হাতে তুলে নিয়ে বলে,
“চোরকে ধরতে এসেছিলে? পেলে না? পাবেও না। এই আহিয়ান স্বচ্ছ যতদিন না চাইবে। তুমি আমার কাছে নিষিদ্ধ এক মানুষ। তোমার প্রতি আমার অনুভূতিও নিষিদ্ধ। কথায় বলে, নিষিদ্ধ জিনিসগুলোর প্রতি মানুষের বেশি আগ্রহ থাকে। তুমি আমার কাছে নিষিদ্ধ হলেও নিজেকে তোমাতে আবদ্ধ করতে চাই আমি। তাতে আমার প্রাণ চলে গেলে যাক।”

বাড়িতে ফিরল মোহ। মুখে নেই হাসি। আজকে পুলিশের কাছে যেতে পারেনি সে। গিয়ে হয়ত নিজেই ভাষা খুঁজে পেতো না বলার। সে কারণেই যায়নি। আরেকটা কারণ মিসেস. নিরা। উনি বার বার ফোন করে মোহকে বাড়ি আসতে বলছিলেন। যার কারণে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে মোহ। মাথা নুইয়ে ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই চেনা কন্ঠে ধ্যান ফিরে মোহের। মাথা উঁচিয়ে তাকায় সে।
“আরে মোহ এসে পড়েছে। এখানে এসো।”

হাসিমুখে বলেন মিসেস. রেবা। ইশারায় ডাকেন মোহকে। ভ্রু কুঁচকে বেশ সন্দিহান হয়ে তাকায় মোহ। এনার আবার কি হলো? আজ এভাবে ডাকছেন কেন? তবুও কোনোরকমে মিসেস. রেবার কাছে আসে মোহ। নেহাল সাহেব এবং মিসেস. রেবাকে সালাম দিতেই মিসেস. রেবা মোহের মুখে মিষ্টি পুরে দেয় আর হেঁসে উঠে বলে,
“খাও হবু বউমা। কি বলব! এতো খুশি হচ্ছে! কাছের মানুষের সাথে নতুন সম্পর্ক করতে পেরে ভালো লাগছে।”

কিছুটা বিষম খায় মোহ। কাশতে কাশতে মিসেস. রেবার দিকে তাকায় সে। যতদূর তার মনে পড়ে এই মহিলার সঙ্গে যতবার তার কথা হয়েছে ততবারই ঠেস দিয়ে কথা বলা ছাড়া কথা বললেন নি। আগের মামি আর এখনকার মামিকে মিলাতে কষ্ট হচ্ছে তার। তার কাশি দেখে সর্বপ্রথমই মিসেস. রেবাই পানি এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে চোখ বড় বড় করে পাকিয়ে দেখতে থাকে মিসেস. রেবা অর্থাৎ তার মামিকে। এখন মোহ উনাকে মামি বলবে নাকি অন্যকিছু সে বিষয়েও ভেবে পাচ্ছে না মোহ।

“বলছিলাম যে রেবা? রিং কি তুমি পড়াবে নাকি…”

“আমি পড়াব কেন? এখন সব তো আধুনিক হয়ে গিয়েছে। আমার ছেলেই না হয় পড়াবে।”
নেহাল সাহেবের প্রশ্নের জবাবে বলেন মিসেস. রেবা। একটু থেমে আবারও বলেন,
“শোনো নিরা, বলছিলাম যে বিয়ে আমি এতো জাঁকজমকভাবে দিতে চাইছি না। যদিও সাধ ছিল আমার কিন্তু সমস্যাটা আমার ছেলের। ওর এসব বিয়ে টিয়েতে জাঁকজমক হইচই ভালো লাগে না। কিন্তু হ্যাঁ রিসেপশন করব পুরো শহর জানিয়ে হইচই করে। এটাতে ছেলের কোনো কথা শুনবো না চিন্তা করো না।”

বিষয়টা তেমন কানে নিল না মোহ। বিয়ে নিয়ে বর্তমানে মাথাব্যথা নেই তার। সে বিয়ে করছে নামিমা আর তার মিমির জন্যই। এখন বিয়েটা যেমন করেই হোক তাতে কিছুই যায় আসে না তার। সে জোর করে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
“আমি আসি আপনারা কথা বলুন। ফ্রেশ হইনি। সবে বাহিরে থেকে এলাম।”

“আচ্ছা যা।”
মিসেস. নিরার সম্মতি পেয়ে সেখান থেকে চলে আসে মোহ। আসার সময় তার কানে আসে মিসেস. নিরার কথাগুলো।
“তাহলে আজকে থেকে ৫ দিন পরেই হচ্ছে মোহ আর স্বচ্ছের বিয়ে।”
মোহের কানে ঝনঝন করে বেজে ওঠে কথাগুলো। ‘মোহ আর স্বচ্ছের বিয়ে’ এতটুকু ভাবতেই অনুভূতিরা পাল্টে যাচ্ছে। এরপর কিনা সারাজীবন সেই স্বচ্ছ নামক অস্বচ্ছ মানুষটাকে জড়িয়ে তাকে কাটিয়ে দিতে হবে। ভাবা যায়?

চলবে….

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২২

বেডে বসে বালিশে ঠেস লাগিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে মাথার চুল চেপে ধরে বসে আছে সৌমিত্র। ফর্সা মুখ খানিতে লাল আভায় বর্ণিত। বিরক্ত লাগছে তার খুব। কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। বড় বড় চোখজোড়ার পলক পড়ছে না। মাথায় হালকা কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল ধরে টানছে সে। মিসেস. রেবা বসে বসে ছেলেকে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত। কিন্তু সৌমিত্র খাওয়া বাদ দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসেই আছে। এবার সে দৃষ্টি মায়ের দিকে রাখে। সৌমিত্রের দৃষ্টি সবসময় হিংস্রতা ছেয়ে থাকে। তার অদ্ভুতভাবে চোখ পাকানো দেখলে সাধারণত যে কেউ আচমকা ভড়কে যাবে। মিসেস. রেবাও ছেলের থেকে ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

“মম, এটা কি ঠিক হচ্ছে? বিয়েটা তো ভাইয়ার নামে হয়ে যাচ্ছে। আমার কিন্তু বিষয়টা ভালো লাগছে না। বিয়ে তো আমি করার কথা। তাহলে আমার নামের সাথে কেন মোহের নাম জুড়ছে না?”

মিসেস. রেবা এবার কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। ছেলেটার প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিতেও ভাবতে হয় তার। যদি এমন কিছু বলে ফেলে যেটা তার পছন্দ না তাহলে আর রক্ষে নেই। মোলায়েম সুরে বললেন,
“কেউ তো তোর কথা জানে না সৌমিত্র! আর মোহের সাথে তো তোরই নাম জুড়বে। তোর ভাইয়া তো তোর হেল্পই করছে।”

“কিন্তু বিয়েতে ওইযে কিসব রিচুয়ালস হয় না? গায়ে হলুদ, মেহেন্দি এসব কাজ তো ভাইয়াই করবে না? কেন ভাইয়া করবে এসব আমার করার কথা। দ্যাটস নট ফেয়ার মম। বিয়ের বর ঘরবন্দী হয়ে বসে আছে! ভাইয়াকে এসব করতে দেব না আমি। ভাইয়া যদি মত পাল্টে নিজে বিয়ে করে ফেলে তখন কি হবে?”

বেশ অস্থির ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সৌমিত্র মিসেস. রেবার দিকে। উনি কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বলেন,
“কেন এতো চিন্তা করছিস? আমি সব ব্যবস্থা করে রেখে এসেছি। কিছু হবেনা। ছোটো করে বিয়ের আয়োজন করবে শুধু। এসব অনুষ্ঠান কিছুই হবে না। আর তোর ভাইয়া থাকলে তো কিছু করবে? ওকে চট্টগ্রাম পাঠাচ্ছি কাজের বাহানায়। একেবারে ৫ দিনের মাথাতেই ফিরবে আর এসে দেখবে তোদের বিয়ে হয়ে গেছে।”

এবার বেশ কিছুটা ক্ষ্যান্ত হয় সৌমিত্র। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক স্মিত হাসি। সেখানেও রয়েছে কিছুটা হিংস্রতার ছোঁয়া। জেদ, মোহ, আকর্ষণ খুব খারাপ। এসবের মধ্যে কোনো একটা যদি মানুষের মনে চেপে বসে তাহলে মানুষের মস্তিষ্ক অচল করে দেয়।

কেটেছে পাঁচদিন। রাত-দিন, রাত-দিন করতে করতে পেরিয়ে গেল সময়টুকু। এসেছে কাঙ্ক্ষিত দিনটি। ভোরের সময়। চারিদিকে নিস্তব্ধ। আলোটুকুও ফোটেনি এখনো। ভোরের পরিবেশ স্নিগ্ধ হয় বড্ড। বাতাসে থাকে মিষ্টি ঘ্রাণ আর শীতলতা। তার ওপর রাতে হয়েছে বৃষ্টি। রাস্তাঘাট পানিতে ভেজানো। গাছের পাতায় পাতায় ফোঁটা ফোঁটা পানি। পরিবেশ যেন বলে দিচ্ছে আজকে অনেক কিছু পাল্টাবে। জীবনের সমীকরণটাও। কেউ পাবে নিজের কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। কেউ পাবে হতাশা, অসাফল্য।

কম্বল জড়িয়ে বিছানায় গুটিশুটি মেরে এক গভীর ঘুমে মত্ত মোহ। মাথাটুকু কম্বলে ঢুকিয়ে নিয়েছে সে। জানালা দিয়ে আসা শিরশিরে বাতাসে বড্ড ঠান্ডা লাগছে তার। যাকে নিয়ে এতো এতো আয়োজন সে ঘুমে বিভোর। এই পাঁচটি দিন বড্ড দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কেটেছে তার। মাঝে মাঝে না চাইতেও মনে হয়েছে স্বচ্ছ নামধারী মানুষটাকে কেন বাছল সে নিজের জীবনে? স্বপ্ন তো দেখেছিল অন্য কাউকে নিয়ে। সেটা পূরণ হলো না কেন? এ ছিল তার ভাগ্য? নিজের ভাগ্যের ওপর চরম বিরক্ত প্রকাশ করেছে মোহ সবসময়।

এই অসময়ে আচমকা ফোনটা বাজতে শুরু করে মোহের। হালকা নড়েচড়ে উঠে আবারও ঘুমটা গাঢ় হতে শুরু করে মোহের। কিন্তু রিংটোনের আওয়াজ তীব্র হতে থাকে। এবার ঘুমটা একেবারে হালকা হয়ে আসে তার। বিরক্তির মাত্রা বেশি হওয়ায় ‘চ’ প্রকৃতির আওয়াজ করে কম্বল থেকে মাথা বের করে চোখজোড়া বিরক্তির সাথে খুলে ফোনের দিকে উঁকি দেয় মোহ। তারপর দৃষ্টি যায় জানালার দিকে। এখনো রাতের রেশ কাটেনি আকাশের। নেই কোনো আলো। মানে এখনো ভোরই আছে। দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা হাতে ধরতে ধরতেই কেটে যায়। হাফ ছেড়ে ফোনটা নিয়ে আবারও চোখ বুজতেই ফোনটা নিজ ছন্দে আবারও বেজে ওঠে। এবার তিড়িংবিড়িং করে খানিকটা ফোন ধরে মোহ হাতে শক্ত করে। কে ফোন করেছে সেটা দেখার প্রয়োজনবোধ করে না সে। যেই করুক না কেন! তার মাথা ঠিক নেই নিশ্চিত! চোখ বুঁজেই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে নিজমনে ক্ষোভের সাথে বলে ওঠে,

“কি সমস্যা? মেয়াদ শেষ হওয়া গাঞ্জা খেয়ে ফোন দেওয়া হইছে? ভোরে কেউ ফোন দেয়? নিজের মাথায় বাড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আর আমায় থ্যাংকস জানাতে ভুলবেন না।”

“মদখোর পর্যন্ত বলেছো ঠিক আছে মেনে নিয়েছি। এখনো এগুলো হাতে ধরেই দেখিনি। তাতেই এসব খোর বানিয়ে দিচ্ছো?”

এবার চোখজোড়া আপনাআপনি খুলে যায় মোহের। তড়িঘড়ি করে দেখে নেয় ফোন নামিয়ে ফোন নম্বরটা। স্পষ্ট মোহ সেভ করে দেখে ‘অস্বচ্ছ ব্যক্তি’। আবারও কানে ফোন ধরে মোহ। আর অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“আপনি? এতো ভোরে? মাথা ঠিক আছে আপনার? আমার কত সুন্দর ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলেন।”

“জীবনে অনেক ঘুম পাবে। কিন্তু এই দিনটা তো পাবেনা। আমি আধঘন্টার মধ্যে তোমার বাড়ির সামনে পৌঁছাচ্ছি তুমি বাহিরে আসবে। এক মিনিটও দেরি হলে ভেতরে যেতে কিন্তু সময় লাগবে না গট ইট?”

হাই তুলে শোয়া থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে পড়ে মোহ। স্বচ্ছের কথা শুনে সে বর্তমানে বিস্ময়ের আকাশে ভেসে যাচ্ছে। চোখজোড়া কপালে উঠে যাচ্ছে। আবারও বাহিরে তাকায় সে। ঘড়ির দিকেও তাকায়। তারপর বিস্ময়ের সুরে কিছুটা জোরে বলে ওঠে,
“ভোর সাড়ে চারটার দিকে? লাইক সিরিয়াসলি? আমার কি মনে হচ্ছে বলুন তো আপনি ড্রিংক করে আমাকে ফোন করেছেন। আর এসব বকে যাচ্ছেন। একটা কাজ করুন। ঘুমিয়ে পড়ুন ফোনটা কেটে দিয়ে। সকালবেলা সব ঠিকঠাক লাগবে।”

“অলরেডি এক মিনিট কমে গিয়েছে। ইউ হ্যাভ টুয়েন্টি নাইন মিনিটস মিস. মোহ! উপস সরি… হবু মিসেস. আহিয়ান স্বচ্ছ। স্বচ্ছ লেট করা একদম পছন্দ করে না। সো আমি নিশ্চয় এটা এক্সপেক্ট করতে পারি যে তার স্ত্রীও অন্যদের মতো লেট করবে না? টাইম চলে যাচ্ছে। উড়ে পড়ো। ফ্রেশ হয়ে নাও।”

“কিন্তু আজকে তো বিয়ে!”

“আমি কি তোমায় বিয়ে বন্ধ করতে বলেছি? না তো? অযথা বন্ধ করো। আমি ফোন রাখছি। রিমেম্বার দ্যাট, ইউ হ্যাভ টুয়েন্টি এইট মিনিটস।”

ফোনটা কেটে গেল। মোহ রাগে ফোনটা অন্যদিকে ছুঁড়ে মেরে স্বচ্ছকে ভেঙ্গিয়ে বলল,
“রিমেম্বার দ্যাট, ইউ হ্যাভ টুয়েন্ট এইট মিনিটস। মামার বাড়ির আবদার পেয়েছে। এই ভোরে আমি উনার সাথে দেখা করব? আমার মাথা এতোটাও খারাপ না। তাছাড়া সকালের পর থেকে কি যে ধকল যাবে আমার ওপর দিয়ে। আমি কারো সাথে বের হতে পারব না। ইম্পসিবল।”
বলেই আবারও বড় একটা হাই তুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মোহ। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। ধীরে ধীরে আবারও চোখ লেগে এলো তার।

ভোরে রাস্তায় যানবাহনের আনাগোনা খুব কম। নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে শাঁ শাঁ করে একটা করে ট্রাক নয়ত বাস যাচ্ছে। তার মাঝে মুখ দিয়ে শিঁস ফুটিয়ে ড্রাইভ করছে স্বচ্ছ। জানালা দিয়ে আসছে হিম করা বাতাস। সাইড করে চুল ঠিকঠাক করে বের হলেও চুলের অবস্থা এলোমেলো তার। ফোন বাজতেই ব্যাঘাত ঘটে ড্রাইভ করাতে। পাশের সিটে রাখা ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে স্বচ্ছ নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে হাসে নিঃশব্দে। তারপর গাড়ি ব্রেক করে সাইডে। ফোনটা হাতে নিয়ে সাথে সাথে কানে ধরে বলে,
“হ্যালো মা?”

“হ্যালো, স্বচ্ছ? কোথায় তুই?”

“আমার কোথায় থাকার কথা? অভিয়েসলি চট্টগ্রাম। অদ্ভুত প্রশ্ন করো আজকাল। সন্দেহ করছো নাকি নিজের ছেলের ওপরে।”

ওপাশ থেকে মিসেস. রেবা বিরক্ত টেনে বললেন,
“তোকে সন্দেহ করব কেন? আজকে রাতে তোদের বিয়ে। সকাল সকাল রওনা দিস।”

“তুমি এতো সকালে উঠে বসে আছো যে? আমি তো কাজ করছিলাম। এখনো তো সকালের আলোও ফোটেনি। মনে হচ্ছে দুপুরের মধ্যেই বিয়ে টিয়ে সেড়ে ফেলবে!”
বাঁকা হেঁসে প্রশ্ন করে স্বচ্ছ। মিসেস. রেবা থতমত খেয়ে জবাব দেয়,
“তুই বুঝবি না ছেলের মাকে কতদিক সামলাতে হয়। ছেলের বিয়ে বলে কথা।”

“ঠিক আছে আমি রাখি?”
মিসেস. রেবা সম্মতি দিতেই ফোনটা কেটে দিল স্বচ্ছ। ফোন রেখে বড় শ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে নিজমনে বলে,
“যাকে তুমি এতোটা চতুর করে তৈরি করেছো তাকে তুমি এতো সহজে বোকা বানাতে চাইছো মা? সৌমিত্রের সঙ্গে মোহের দুপুরের মধ্যে বিয়ে সেড়ে ফেলে রাতে আমাকে চমকে দিতে চাইছো? চমকে আমি তোমাদের দেব। ভালোবাসা বড্ড বাজে মা। কারোর কথা শোনে না। কারোর না। এটা যতটা বিষাক্ত ততটা সুন্দর। পবিত্র ভালোবাসার বন্ধন ততটাই সুন্দর।”

ঘুম ঘুম চোখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে মোহ। ঘুমের চোটে মাঝে মাঝে চোখ কচলিয়ে যাচ্ছে সে। তবুও তার সামনে থাকা নির্দয় আর কঠোর লোকটা ভ্রুক্ষেপহীন। একটু আগেই ফোন দিয়ে মোহের ঘুম আবারও ভাঙিয়ে একপ্রকার ব্ল্যাকমেইল করে রাস্তা পর্যন্ত টেনে এনেছে স্বচ্ছ। এমনকি ফ্রেশ হবারও সুযোগ পায়নি মোহ। গায়ে শুধুমাত্র একটা চাদর জড়িয়ে রেখে। ঘুম সামলাতে না পেরে এবার কাঁদো কাঁদো মুখে তাকায় মোহ স্বচ্ছের পানে। ঠান্ডা পরিবেশ। গাছের পাতা দিয়ে টপটপ করে পড়ছে পানি। ভেজা রাস্তা। সোডিয়াম লাইট এখনো জ্বলছে রাস্তায়। মোহ কাতর সুরে বলে,
“এখন যাই?”

“উঁহু না।”
নির্বিকার সুর স্বচ্ছের। তার দৃষ্টি তখন থেকেই স্থির মোহের ওপর। দৃষ্টিতে রাজ্যের শীতলতা। মাতাল করা চাহনি। মোহের এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল, ফুলে থাকা চোখমুখ আর উল্টে রাখা ঠোঁটজোড়াতে মত্ত স্বচ্ছ। মোহ কিছু বলতে চাইতেও স্বচ্ছ বলে ওঠে,
“জীবনে যেন এই রুপে কারোর সামনে যেও না। তোমার মোহের আগুনে জ্বলে যাবে। আমি কিন্তু জ্বলে পুড়ে গিয়েছি। আমি চাই না তোমার এই রুপের নেশায় অন্যকেউ নেশাগ্রস্ত হক। কারণ এর অধিকার শুধু আমি পেতে চলেছি।”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে