একটুখানি সুখ পর্ব-১৭+১৮

0
1062

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৭

কন্ঠস্বর এখনো কাঁপছে মোহের। এই বিয়ের প্রস্তাবটা স্বচ্ছের সামনে রাখা মোহের কাছে সহজ ছিল না। গত আধঘন্টা ধরে নিজেকে তৈরি করছিল সে। যখন নাফিসা বেগমের অসুস্থতার কথা শুনল তখন আর থামল না সে। স্বচ্ছ এখনো তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে চোখের পলক অবধি ফেলতে ভুলে গেছে। মোহে দিকে তাকিয়ে আছে সে। তার ভাবনার ঊর্ধ্বে গিয়ে শেষমেশ মোহ বিয়ে করতে চাইছে তাকে? কেন? স্বচ্ছ বিস্ময়ের সাথে বলল,
“বিয়ে? হঠাৎ বিয়ের কথা তুলছো কেন? তোমার শরীর ঠিক আছে? আমার মনে হয় তুমি ঠিক নেই।”

বলেই মোহের কপালে আলতো করে হাত ছোঁয়ায় স্বচ্ছ। খানিকটা কেঁপে উঠে মোহ তার হাত দিয়ে স্বচ্ছের হাত সরিয়ে খানিকটা যান্ত্রিক কন্ঠে বলে,
“আমি ঠিক আছি। আর বিয়ের কথা ওঠাতে চমকে যাচ্ছেন কেন? আপনি আর মামিও প্রস্তাবটা দিয়েছিল আমাকে।”

“আমার মনে হয় তুমি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছো মোহ। তুমি ইমোশনাল হয়ে ডিসিশন নিচ্ছো। ছোট ফুপি ঠিক হয়ে যাক তারপর এই বিষয়ে কথা বলব আমরা ঠিক আছে?”

“আপনি কি আমায় বিয়ে করতে চান না? যদি তাই হয় তাহলে সোজাসুজি বলুন।”

আগের মতোই থমথমে সুরে বলে মোহ। তার দৃষ্টি ফ্লোরেই স্থির। অন্য কোনো দিকে মনই নেই তার। সে কেমন একটা ভাবলেশহীন হয়ে গিয়েছে। যেন একটা রোবটের মতো জবাব দিয়ে চলেছে। স্বচ্ছ যেটা খেয়াল করলে মোহের গালে আলতো চাপড় দিয়ে খানিকটা জোরে বলে,
“এই মেয়ে? হুঁশে এসো। তুমি ঠিক নেই। বিয়ের কথাবার্তা বাদ দাও এখনো অনেক সময় আছে এসবের। তুমি বসবে চলো এসো।”

মোহ তবুও এক পাও নড়েচড়ে না। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে স্বচ্ছ। মেয়েটার কি হলো? অতিরিক্ত শক নিতে পারছে না সে। ফলস্বরূপ এমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে স্বচ্ছ নিজে মোহের হাত টেনে ধরে এনে তাকে বসিয়ে দেয় চেয়ারে। মোহ আবারও একই প্রলাপ বকে ওঠে,
“আপনি বললেন না তো! আপনি বিয়েতে রাজি কিনা?”

“হঠাৎ বিয়ে বিয়ে কেন শুরু করলে তুমি? বিয়ে পাগলি হয়ে যাচ্ছো নাকি স্বচ্ছ পাগলি? আই থিংক স্বচ্ছের ওপর ফিদা হয়ে গেছো। সেজন্যই আচমকা আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছো? ও মাই গড!”

স্বচ্ছের এমন কথায় কাজ হয়। মোহ এবার মাথা উঠিয়ে তাকায় স্বচ্ছের পানে। স্বচ্ছ চাইছিলই মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হক। সেকারণে ইচ্ছে করেই এমন কথা বলে উঠল সে। ধীর কন্ঠে বলল,
“আপনাকে বিয়ে ছাড়া আর কোনো অপশন খোলা রেখেছেন আপনি? কোনো অপশন নেই আমার কাছে। এখন আমি সিউর যে মিমি শুধু আমার ভবিষ্যতের চিন্তা করতে করতেই এভাবে অসুস্থ হয়ে গেছেন।”

স্বচ্ছ চমকে ওঠার ভান করে বলে,
“অপশন খোলা রাখিনি মানে? অনেক অপশন খোলা আছে আমার কাছে। কি কি অপশন জানো? ফার্স্ট অপশন হচ্ছে ওইযে ওই ডাফার আদিল মাহমুদের সাথে বিয়ে করতে পারো। তার নাকি একটা বউ আছে? সতিনের সংসার করতে পারবে ভাবতে পারছো? আজকাল সতিনের সংসার কেউ করে? তুমি সতিনকে বোনের মতো করে মেনে নিয়ে পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দেবে সতিনও বোন হয়। সুন্দর আইডিয়া না?”

“খুব সুন্দর আইডিয়া। আপনি যদি আমার সাথে বিয়ে করেন বিশ্বাস করুন পরে এসব ঝামেলার পর আমি আরেকটা বিয়ে করব। তারপর আপনারা দুজন ছেলে সতিন হয়ে যাবেন। তারপর দুজন ভাইয়ের মতো বসবাস করে ওয়ার্ল্ড গিনিস বুকে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম খোদাই করে নেবেন। সুন্দর না আইডিয়াটা?”

স্বচ্ছকে ভেঙিয়ে বলল মোহ। এবার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে তীক্ষ্ণতা। স্বাভাবিক অবস্থাতে ফিরে আসছে সে। মিটিমিটি হাসতে থাকে স্বচ্ছ। তারপর কিছুটা গম্ভীর মুখভঙ্গি করে বলে,
“আইডিয়াটা ভালো। কিন্তু আমি আবার নিজের বউকে কারো সাথে শেয়ার টেয়ার করতে পারব না। ইউ নো? আমার সম্পদ শুধুই আমার। ইভেন আমার বউয়ের একেকটা ঘামের ফোঁটাও আমার। তার মন থেকে শুরু করে তার চোখ, নাক, গাল, ঠোঁট আর… থাক আর গভীরে না যাই! সবই আমার। যদি কোনো সতিন বানিয়ে নিয়ে আসতে চাও তাকে এসব বলে নিয়ে আসবে। তাহলেই চলবে। ঠিক আছে?”

হতবাক হয়ে এবার তাকায় মোহ। স্বচ্ছ এতোকিছু ভেবে রেখেছে? কি ভয়ানক প্ল্যানিং তার। খানিকটা শুঁকনো ঢক গিলে চোখ ফিরিয়ে কেবিনের দিকে তাকায়। ডক্টরের চেকআপ করা কি এখনো শেষ হয়নি? মোহ ও স্বচ্ছের বিপরীত পাশে বসে আছে তৃণা। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদছে সে। মোহ উঠে দাঁড়ায়। গিয়ে বসে তৃণার পাশে। মোহকে পাশে দেখে কান্নার বেগ বেড়ে গেল তার। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“আমার মা ঠিক হয়ে যাবে তো মোহ আপু?”

“মিমির কিছু হয়নি। তুমি চিন্তা করো না। আর যা হয়েছে সেটা আমার জন্যই তো ঘটেছে। আমি তো তোমার আর তিহান ভাইয়ার(তৃণার ভাই) সামনে মুখ দেখাতেও লজ্জা লাগছে। আজ আমার চিন্তা করতে করতে মিমি অসুস্থ হয়ে গেল।”

কিছু বলতে পারল না তৃণা তার আগেই কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো ডক্টর। উনাকে দেখামাত্র সকলে এগিয়ে এলো অস্থির হয়ে। কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই ডক্টর নিজ দায়িত্বে বলে উঠলেন,
“চিন্তা করার কিছু নেই। কিন্তু হ্যাঁ পেশেন্ট মিনি স্টোক করেছে। উনি ঘুমের মাঝেই ঘোরে চলে গেছেন কিছু টের পাননি। হাই ব্লাড প্রেশার থাকার কারণে এমনটা ঘটেছেন। হয়ত কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত ছিলেন উনি। যার কারণে ব্লাড প্রেশার বেড়েছিল। পরের বার খেয়াল রাখবেন উনার যেন টেনশন না হয়। তাহলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আপনারা এখন দেখা করতে পারেন উনার সাথে।”

হাফ ছেড়ে বাঁচল সকলে। কিন্তু মোহের মাঝে কাজ করতে থাকল অনুতাপ। তার মিমির এই অবস্থা শুধুমাত্র তার জন্য এটাই ভেবে অনুতাপের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সে। আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে সবার আগে কেবিনে ঢুকে গেল সে।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে রয়েছেন মিসেস. নিরা। মুখটা ফ্যাকাশে। ঝড়ের গতিতে মোহ গিয়ে বসে মিসেস. নিরার পাশে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকান উনি। মোহ ফুঁপিয়ে কেঁদে দিয়ে বলে,
“আই এম সরি মিমি।”

“ধুর পাগলি সরি বলছিস কেন? তুই কেন সরি বলবি? তোর বয়সটাই এমন যে সঠিক মানুষকে বাছতে পারিস নি। আমি তো তোকে বলেছিলাম যে যদি মনে হয় আয়মান তোকে বিশ্বাস করে তাহলে হ্যাঁ করবি। বিশ্বাসঘাতক বের হলো তো সে? আমি তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। কি হবে তোর বলতে পারিস?”

দুর্বল কন্ঠে বলেন মিসেস. নিরা। মোহ সঙ্গে সঙ্গে নিজের কান্না গতি কমাতে থাকে। স্বচ্ছ আর তৃণা ধীর পায়ে প্রবেশ করে কেবিনে। তৃণা ছুটে এসে তার মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নাকাটি করতে থাকে।
“মা। ও মা? এভাবে কেউ করে? আর একটু হলে আমার জীবনটা বেরিয়ে যাচ্ছিল।”

“তুই আরেক পাগলি। আমার দুইটা পাগলি। দুজনেই একেবারে মাত্র ১ ঘন্টায় শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিস। কিছু খেয়েছিস?”

দুজনেই মাথা নাড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে একটা ছেলে। উজ্জ্বল শ্যামলা চোখেমুখে অস্থিরতার ছাপ একেবারে ফুটে উঠেছে। ব্রাউন কালার টিশার্ট পরিহিত ছেলেটি মিসেস. নিরাকে দেখে চিকন ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল হাসি। তৃণার উদ্দেশ্যে তৎক্ষনাৎ খিটখিটে হয়ে বলল,
“এই তৃণমূলের বাচ্চা সর সামনে থেকে। একাই আদর খাস না পেট ব্যথা করবে।”

বলে এগিয়ে এসেই তৃণাকে সরিয়ে দিয়ে বসে পড়ে তিহান। মোলায়েম কন্ঠে বলে,
“এখন কেমন আছো মা?”

“ভালো। তোরা এতদূর থেকে এসেছিস কিছু খেয়ে এসেছিস?”

তিহানও মাথা নাড়িয়ে বলে,
“জীবনে খাওয়াদাওয়া অনেক করতে পারব। তোমায় হারালে তো ফিরে পাব না তাই না?”
মিসেস. নিরা হাসেন। সকলের সাথে কথাবার্তা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

কেবিন থেকে বেরিয়েছে সকলেই। স্বচ্ছ আর মোহ পাশাপাশি হাঁটছে। স্বচ্ছের বাম পাশে হেঁটে চলেছে তৃণা। মেয়েটা জোরে জোরে স্বচ্ছের সাথে হাঁটার চেষ্টা করেও কূল পাচ্ছে না। তৃণা সবে ক্লাস টেনে পড়ে। সেই হিসেবে স্বচ্ছের থেকে বেশ ছোট সে। তাই পাশাপাশি চলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে মুখ ফুলিয়ে পিছু পিছু হাঁটছে সে। তিহান সামনে হাঁটছে। খানিকটা জোরে বলে,
“হসপিটালের সাথে একটা ক্যান্টিন আছে সেখানে খাবি সবাই?”

“ওখানে কি চিকেন বার্গার আর অ্যাপেল জুস আছে?”
শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে ওঠে স্বচ্ছ। মোহ কিছুটা চমকে ওঠে। পাশাপাশি হেঁটে চলা কালো শার্ট আর কালো ব্লেজার পরিহিত লম্বাটে লোকটার দিকে তাকায়। তাকানোর কারণ হচ্ছে খাবারের নামগুলো। প্রতিদিন সকালে চিকেন বার্গারের সাথে অ্যাপেল জুস পেলে খুশিতে নেচে ওঠে সে। এটা তার ব্রেকফাস্ট হিসেবে প্রিয় খাবার। মোহ এবার আগ্রহ দমাতে না পেরে বলে ওঠে,
“এসব খাবার দিয়ে কি করবেন?”

“কেন খাবার কি করে মোহ? অবশ্যই খাব।”

“আপনি খাবেন?”

“তো তোমায় খাওয়াব ভেবেছো?”
নাক ফুলিয়ে বসে হাঁটতে থাকে মোহ। তার প্রশ্ন করাই ভুল হয়েছে। সে থেমে মিনমিনে কন্ঠে বলে,
“শুনুন আমি খেতে যাব না এখন। আমাকে আপনার বাড়ি নিয়ে যাবেন প্লিজ?”

স্বচ্ছ পিছু ফিরে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কেন?”

“নানিমা অসুস্থ। আমি সেটা শুনেছি। নিশ্চয় মিমির খবরটা শুনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমায় নিয়ে চলুন।”

“বাবাহ! সবার মনের খবর জানো দেখছি। জ্যেতিষিবিদ্যা শিখেছো?”

দুষ্টু হেঁসে জিজ্ঞেস করে স্বচ্ছ। মোহ কড়া গলায় বলে ওঠে,
“এরজন্য জ্যেতিষিবিদ্যা শিখতে হয় না। মনের কথা চাইলেই বোঝা যায়।”

“হু শুধু একজনেরটাই বুঝতে পারো না।”
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বিড়বিড়িয়ে বলে স্বচ্ছ। মোহ ভ্রু কুঁচকাতেই স্বচ্ছ বলে,
“আমি খাবার নিয়ে আসছি তুমি বসো গাড়িতে। আমার খিদে পেয়েছে।”

“আমিও যাব তোমাদের সাথে।”
লাফিয়ে বলে ওঠে তৃণা। মোহ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“উঁহু, মিমির কাছে তোদের থাকতে হবে।”
মুখ কালো করে ফেলে তৃণা। তবুও কিছু বলে না মোহ। তৃণার গালে হাত বুলিয়ে গাড়িতে উঠে বসে সে।

নাফিসা বেগমের সামনে বসে আছে মোহ। মাথা নুইয়ে বসে আছে সে। নাফিসা বেগম গমগমে গলায় বলেন,
“তুই সত্যি স্বচ্ছকে বিয়ে করতে চাস?”

“জি নানিমা।”
নিচু করে উত্তর দেয় মোহ। নাফিসা বেগম অকপট ভাবে বলেন,
“তাহলে শোন আমার আর নিরার জন্যই বিয়ে করতে চাইলেই হবে না। স্বচ্ছও আমার নাতি। আমিও চাইব ও এমন কোনো বউ পেয়ে যাক যে তাকে ভালোবাসবে। তুই যদি সত্যি ওকে বিয়ে করতে চাস ওকে ভালোবাসতেও হবে। ওকে পূর্ণ স্বামীর অধিকারটা দিতে হবে। কারণ আমি যতই আগের যুগের মেয়ে হই না কেন! স্বামীর সেবা করতে হয় ভালোবাসা দিয়ে। ওকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারবি?”

চলবে…

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৮

“স্বামীকে কখনো দূরে ঠেলে দিতে নেই। আজকাল তোরা আধুনিক যুগে ভাবিস স্বামীকে ভালো না লাগলে তাকে মেনে নিবি না। তাকে ডিঙিয়ে চলবি। কিন্তু এটা কিন্তু ঠিক নয়। স্বামী কাছে ডাকলে তাকে টেনে নিতে হয়। তাই তাকেই নিজের জীবনসঙ্গী বানা যে তোকে অসম্মান করবে না আর তুই তাকে অসম্মান করবি না। তুই আমার নাতনি আর স্বচ্ছ আমার নাতি। দুজনেরই ব্যাপারেই আমাকে ভাবতে হচ্ছে। কারোর ভাবনা আমি ছাড়তে পারব না। দুজনকেই আমি ভালোবাসি।”

স্থির নয়নে নাফিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে মোহ। মাথায় আসছে না কিছুই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। চোখ বন্ধ করে আবার মেলে তাকায় সে। যেই মানুষটাকে সে সহ্য করতে সক্ষম হয় না যার সঙ্গে কোনো কথার মিল হয় তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেও একটা অসাধ্য ব্যাপার স্যাপার। একটা নিঃশ্বাস টানতেই নাফিসা বেগম জিজ্ঞেস করল,
“দোটানায় পড়ে গিয়েছিস? বিয়ে জিনিসটাকে একটা দায়িত্ব মনে করলে হয় না। একটা অংকের মতো হিসাব নিকাশ করে বিয়ে করতে চাইছিলি স্বচ্ছকে?”

মোহ উত্তর দেয় না। কারণ তার নানিমার কথা কোথাও না কোথাও গিয়ে মিলেছে। সে আসলেই অংকের মতো বিচার করে বিয়ে করতে চাইছিল। স্বচ্ছের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক এসব দিকে মাথা ঘামায়নি সে। এখন? এখন কি করা উচিত তার? একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে শান্ত সুরে মোহ বলে ওঠে,
“আই নিড টাইম। আমায় ভাবতে হবে নানিমা। আমি আরো একবার ভাবার সুযোগ চাই। তুমি কেন অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলে? আমি কিন্তু খবর পেয়েছি। কি হয়েছিল তোমার? এখন তো মোটামুটি ঠিক আছো।”

“তেমন কিছু না। তুই নিরাকে রেখে এখানে এসেছিস কেন? আমি তো ঠিকই আছি।”

“আমি স্বচ্ছ ভাইয়ের থেকে শুনেছি। মাথা ঘুরছিল তোমার। মোটামুটি জ্ঞান হারিয়ে শুয়ে ছিলে। কি হয়েছে বলবে না? নয়ত রাগ করে চলে যাব।”

বিষয়টা লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারে না নাফিসা বেগম। মেয়েটা মায়ের মতোই জেদি। যা জানতে চাইবে সেটা তাকে যেকোনোভাবে জানতে হবে। উনি মিনমিন করে জবাব দেন,
“আমাকে প্রতি সপ্তাহে যেই ইনজেকশন দেওয়া হয় সেটা দেওয়া হয়নি এই সপ্তাহে। তুই জানিস ওর মাধ্যমে আমার রক্ত তৈরির ক্ষমতা একটু হলেও বাড়ে। সেটা দেওয়া হয়নি এই সপ্তাহে তাই…!”

মেজাজটা বিগড়ে গেল মোহের। এই বাড়িতে সবাই এতোটাই দায়িত্বহীন? একটা অসুস্থ মানুষের খেয়াল রাখার জন্য কেউ নেই? ভাবতেই রাগটা তড়তড় করে বাড়তে লাগল তার। কিছু বলতে উদ্যত হতেই নাফিসা বেগম তার কথাতে বাগড়া দিয়ে বলে উঠল,
“একটু আগে ইনজেকশন দিয়েছে আমায়। স্বচ্ছ রাগারাগি করছে বিষয়টা নিয়ে। একমাত্র ওর জন্যই বাড়িতে যতটুকু আমার খেয়াল রাখা হয়।”

“বাবাহ! এতোটা ভালোমানুষ কবে থেকে হলেন উনি?”
আনমনে প্রশ্ন করে বসে মোহ। স্বচ্ছের কিছুটা প্রশংসা করায় মুখটা অলরেডি ফুলিয়ে বসে আছে মোহ। কিছুটা হিংসে করছে তার। তা বুঝে নাফিসা বেগম হেঁসে দুর্বল কন্ঠে বলেন,
“তোর কাছে ওকে কেমন লাগে জানি না। উগ্র, অগোছালো স্বভাবের ছেলে হলেও কিন্তু ও এমনভাবে মানুষকে যত্ন করতে ভালোবাসে যাতে সেই মানুষটা বুঝতেই না পারে সে ওই মানুষটাকে নিয়ে চিন্তা করে। স্বচ্ছকে কিন্তু আমি কোলেপিঠে মানুষ করেছি। তোর মামিকে তো জানিস। ছেলে নিয়ে তেমন কোনো হেলদোল ছিল না তার। সারাদিন দশ-বারোটা সার্ভেন্ট রাখলেই কি হয়? মাকে তো সন্তান সবসময় কাছে চায়। সেজন্য আমি ওর কাছে থাকতাম। ওর প্রতিটা আচরণ আমার জানা।”

মোহ এবার কিছুটা ভাবুক হয়ে পড়ে। কেন দেখিয়ে কারো জন্য ভাবলে কি জাত চলে যাবে নাকি? ভাবতেই নাফিসা বেগম কিছুটা নরম কন্ঠে বলেন,
“সকাল থেকে তো দৌড়ের ওপর আছিস। খাওয়াদাওয়া হয়েছে কিছু?”

“হয়েছে নানিমা। তোমার নাতি গাড়িতে খাবার দিয়ে ধমকিয়ে ধমকিয়ে কথা শুনিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে নিয়েছে আমায়।”

“মানে?”
হতবাক হয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চান নাফিসা বেগম। মোহ মুখটা বাংলায় পাঁচের মতো করে বলে,
“প্রথমে বলেছিলেন উনি নিজে খাওয়ার জন্য কিনতে যাচ্ছেন। সে ভালো কথা। কিন্তু গাড়িতে উঠে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ধরে থাকো। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। গাড়িতে এতো জায়গা থাকতে খাবার আমায় ধরে থাকতে হবে কেন বলো তো নানিমা? তাই আমি খাবারটা নিয়ে সামনের খালি জায়গায় রেখে দিতেই গাড়িটা এমন ব্রেক কষলেন যে সিট বেল্ট না থাকলে নির্ঘাত মাথাটা ফেটেই যেতো। আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা রাখতে বলেছি তোমায়? রাখলে কেন? শাস্তি সরূপ এটা তোমায়ই খেতে হবে খাও।’ আমি খাব না উনি ছাড়বেন না। এই বলে খাইয়ে ছেড়েছেন আমায়।”

নাফিসা বেগম হেঁসে ওঠেন এবার। কিছুটা লাজুক ভাব নিয়ে তাকায় মোহ। তার নানিমা হাসছে দেখে তার মুখেও হাসি ফোটে। মানুষটা কতদিন পর হাসছে। যাক স্বচ্ছের এই কান্ড বলাতে কিছুতো লাভ হলো! যেকোনো মানুষের হাসিতে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য লুকায়িত থাকে। হাসিটা যদি প্রাণখোলা হয় তাহলে হাসিটা তড়তড় করে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। নাফিসা বেগম হাসি থামিয়ে বলেন,
“দেখেছিস? কিভাবে যত্ন নিল আর তুই বুঝলিও না? এটাই হচ্ছে আহিয়ান স্বচ্ছ।”

চোখ বড় বড় করে তাকায় মোহ। আসলে বিষয়টা তার ভাবনাতেই আসেনি। নাফিসা বেগম আবারও বলেন,
“ওকে জিজ্ঞাসা করেছিস ও খেয়েছে কিনা?”

“খেয়েছেন হয়ত।”
নিচু সুরে বলে মোহ। নাফিসা বেগম মাথা নাড়ান। ক্ষীণ গলায় বলেন,
“না। ও খায় নি এখনো। সকাল ৭ টাই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। আর এতো সকালে সে খায় না। সকালে বাড়িতে না খাওয়াদাওয়া করলে কোথাও খায় না সে। তোর কি উচিত নয় ওকে এখন গিয়ে জিজ্ঞাসা করা যে ও খেয়েছে কিনা? বা কৃতজ্ঞতা সরূপ খাবারও তো নিয়ে যেতে পারিস।”

কথাটা ভুল বলেনি নানিমা। এটাই ভাবতে থাকে মোহ। তাছাড়া স্বচ্ছকে ফেক নিউজ ডিলেট করার জন্য আর ওই আদিলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এমনিতেও কিছু করা উচিত ওর। মোহ কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলে,
“বলছো? আমি যাব উনার ঘরে?”

“যা। এতে এতো জিজ্ঞেস করার কি আছে? ইচ্ছে থাকলে চলে যা।”
মোহ উঠে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।

ড্রেসিংটেবিলের সামনে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে বারবার পিঠের আঘাত করা জায়গায় এন্টিসেপ্টিক লাগানোর চেষ্টায় মগ্ন স্বচ্ছ। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ তার। বিরক্তির কারণ হলো সে পারছে না পিঠে ঠিকঠাক লাগাতে। না পেরে এন্টিসেপ্টিকটা চেপে ধরে একপাশে ফেলে দিয়ে রাগে কটমট করে বলল,
“ডিজগাস্টিং! দরকারই নাই এসবের।”

স্বচ্ছের ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। আরো মেজাজটা খারাপ হলো তার। চোখমুখ খিঁচে রাগে বলল,
“হোয়াট দ্যা হেল ম্যান? নিজের বাড়িতে নিজের কোনো প্রাইভেসি নেই? আসতে হবে…”

কথাটুকু সম্পূর্ণ না হতেই দরজা ঠেলে ঢুকে আসে মোহ। সরু চোখে স্বচ্ছের দিকে তাকায় সে। আবারও খালি গায়ে স্বচ্ছকে দেখে কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে চোখ বন্ধ করতেই স্বচ্ছ বলে ওঠে,
“তোমার ব্যাপার কি বলো তো? আমি যখনই খালি গায়ে থাকি তখনই দেখি তুমি কোনো না কোনো বাহানা দিয়ে ঠিক ঘরে ঢুকে আসো? তোমার মতলব কি? আমার মতো সরল সোজা ছেলের ইজ্জত কাঁড়তে চাইছো?”

“চুপ করুন তো। আমি তো নিজেই ভেবে পাই না যে কি করে আপনার ঘরে এমন সময়ই এসে পড়ি। ঘাট হয়েছে আমার। আপনার জন্য খাবার রেখে যাচ্ছি আপনি খেয়ে নেবেন।”

পাশের শোকেসের ওপরে খাবারের ট্রে রেখে দরজার দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় মোহ।
“বাবাহ! বিয়ের আগেই দেখি বউ বউ কাজকর্ম করছো। নট ব্যাড। এমন বউই তো লাগবে। একটু ছোট ছোট টাইপের পুতুল। যাকে যখন তখন রাগিয়ে দেওয়া যাবে। জানো তো? ছোটদের রাগ বেশি হয়। এদের বেশি করে ভালোবাসতে মন চায়। রাগ দেখলেই ভালোবাসতে মন চাইবে। এখনই দেখছি তুমি আমার সব গার্লফ্রেন্ডদের থেকে ব্রেকআপ করিয়ে ছাড়বে।”

চোখ রাঙিয়ে পিছু ফিরে মোহ। কিছু বলার জন্য দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে তার কিন্তু বলতে পারে না। সে কোনো শব্দই খুঁজে পাচ্ছে না। দম ফেলে বলে,
“আপনি থাকুন আপনার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আমি যাচ্ছি। নানিমা বলল আপনি খাননি অথচ আমি খেয়ে নিয়েছি সেটা ভেবেই খাবার এনেছি।”

“শোনো, আমার পিঠে একটু এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিতে হেল্প করবে?”
কিছুটা কাতর কন্ঠ শুনে আবারও পিছু ফিরে তাকায় মোহ।
“কি হয়েছে পিঠে?”

“উমম… তেমন কিছু না সামান্য এক্সিডেন্ট।”

তবুও সত্যি কথা না বলায় হতাশ হয় মোহ। কিন্তু স্বচ্ছের কথা প্রত্যাখান করতে পারে না সে। এগিয়ে যায় তার দিকে আর ভার কন্ঠে বলে,
“অন্য কাউকেও তো বলতে পারেন। আসার আগে শুনতে পেলাম ডিজগাস্টিং বলছিলেন। অন্যকারো থেকে হেল্প নিলে তো এমন হয় না। বাড়িতে তো অনেকেই কাজ করে দেখি।”

“অভিয়েসলি নট। আমি যাকে তাকে নিজের শরীরে হাত লাগাতে দেব নাকি?”

“তাহলে আমাকে দিচ্ছেন যে?”

“কারণ, কারণ, কারণ তুমি বউ বউ অধিকার ফলাচ্ছো তাই।”

বাঁকা চোখে তাকায় মোহ। ফ্লোরে এন্টিসেপ্টিক পেয়ে সেটা তুলে নেয় সে। ড্রেসিংটেবিলে থাকা তুলো দিয়ে এন্টিসেপ্টিক মাখিয়ে সেটা আলতো করে চেপে ধরে স্বচ্ছে ক্ষততে। হালকা কেঁপে ওঠে স্বচ্ছ। চোখ খিঁচে ফেলে সে। গলার রগ ফুটে ওঠে। নয়ত ব্যথা করছে তার। মোহ তুলো সরিয়ে নিয়ে বলে,
“ব্যথা করছে?”

“তা করছে। কিন্তু বড় বড় আঘাত সাড়াতো ছোট ছোট আঘাত তো পেতে হয়।”

“কি করেছেন পিঠের অবস্থা। সর্বত্র আঘাতের চিহ্ন। মনে হচ্ছে মারামারি করে এসেছেন।”

স্বচ্ছ হাসে। তবুও উত্তর দেয় না। একটু একটু করে মোহ পুরো পিঠে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিয়ে বলে,
“হয়ে গেছে।”

মোহ সরে আসে। কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে বলে,
“শুনুন, এসব করছি বলে ভাববেন না আপনার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি আছে। আমি শুধু কৃতজ্ঞতার জন্য করছি। আর…”

“আর?”

“আর খাবার দিয়েছি ওখানে একটা কাগজে কিছু লিখা আছে সেটা যেন ফেলে দেবেন না। খুলে দেখবেন।”
স্বচ্ছ তাকায় খাবারের ট্রে এর দিকে। মোহ তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। মোহের বেরিয়ে যাওয়া দেখে খাবারের ট্রে এর দিকে যায় স্বচ্ছ। একটা সাদা কাগজে একটা ভাঁজ দেওয়া। বেশ কৌতুহলী হয়ে কাগজ হাতে নিয়ে সুন্দর করে খুলে দেখে সে। বেশ ছোট ছোট করে লিখা কিছু কথা।

“যতটা নিমপাতা আপনাকে ভেবেছিলাম ততটাও আপনি নন। কিছুটা মধুরও ছিটেফোঁটা আছে। আর ধন্যবাদ আমার জীবন বাঁচানোর জন্য একটা বিবাহিত লোকের সাথে আমার বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য। আপনার জন্য একটা মানুষও চিনতে শিখেছি। তার জন্যও ধন্যবাদ।
আপনার কাছে কি #একটুখানি_সুখ হবে? বেশি কিছু না একটু সুখ চাই আমার। তবেই আপনার হৃদয় নিকটে উপস্থিত হবো আমি। আপনার স্ত্রী আর ভালো বন্ধুর রূপে।”

স্বচ্ছের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফোটে। মনে বইছে অনুভূতির জোয়ার।
“তোমায় #একটুখানি_সুখ নয়। তোমায় সুখের রাজ্যের রানী বানাতে চাই মোহময়ী রানি। সুখে সিংহাসনে তোমায় দেখতে চাই হাসিমুখে।”

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে