উধয়রনী পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
111

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৩||

১৯।
তাজওয়ার হতাশ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আর আহি মনোযোগ দিয়ে আলু ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছে। তাজওয়ার আহির উপর বিরক্ত। তারা এসেছে শহরের দামি রেস্টুরেন্টে, আর আহি খাচ্ছে আলু ভর্তা দিয়ে সাদা ভাত। দামি রেস্টুরেন্টে আহির পছন্দের এই খাবার না থাকায় তাজওয়ারের আদেশে ম্যানেজার খাবার তৈরীর জন্য কিছু সময় চেয়ে নেন। এরপর প্রায় এক ঘন্টা পর খাবার আসতেই আহি হাত দিয়েই ভাত মেখে খাওয়া শুরু করলো। খাওয়ার মাঝখানে সে আঙ্গুলগুলোও চেটেপুটে খাচ্ছে। তাজওয়ার আহির খাওয়া দেখে নিজের খাওয়ায় ভুলে গেছে। আহি তাজওয়ারের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো আর মনে মনে বলল,
“ভালো করে খাও তুমি। আজকের দিনটা যদি মাথায় থাকে, ভুলেও কখনো আমাকে নিয়ে বের হওয়ার কথা চিন্তা করবে না। মিস্টার খান, এভাবেই আমি তোমার রেপুটেশন ধুলোয় মিশিয়ে দেবো।”

আহি আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এবার সে খুব যত্ন নিয়েই খাচ্ছে। একদম আফিফের মতো করে। আফিফের প্রিয় খাবার গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা। এক্সিডেন্টের পর আহি একবার তাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল। সেদিনই সে জেনেছিল আফিফ আলু ভর্তা খুব পছন্দ করে। এরপর আহি বাসায় এসে মুনিয়া খালাকে বলে ভর্তা আর ভাত নিয়ে হাসপাতালে গেল। কিন্তু সেদিনই আফিফ রিলিজ পেয়ে যায়। আর তাই আফিফের সাথে তার দেখা হয় নি। আর সেদিনের পর থেকেই আহির যখন খুব রাগ উঠতো সে নিজেই আলু ভর্তা বানিয়ে খেতো। কারণ আফিফের প্রিয় কাজগুলোর মাঝেই সে আফিফকে খুঁজে পায়। আর যখন সে আফিফকে অনুভব করে, তখন তার রাগ, কষ্ট সবকিছুই প্রশমিত হয়ে যায়।

(***)

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই রাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাজওয়ার আর আহি দু’জনই অবাক হলো। রাদ আহিকে দেখে বলল,
“এতোক্ষণ লাগে তোর খেতে?”

তাজওয়ার আহিকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রাদের মুখোমুখি এসে বলল,
“এক্সিকিউজ মি, তুমি এখনো এখানে কি করছো?”

“আমি আহির সাথে যাবো।”

“আমি ওকে নিয়ে এসেছি, আমি-ই ওকে নিয়ে যাবো।”

আহি রাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার রাদের সাথে একটা কাজ আছে। আজই আমাদের দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু তোমার জন্য এখানে আসতে হলো।”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি কাজ?”

রাদ উত্তর দিলো,
“ভর্তির ব্যাপার নিয়ে। আমরা মাস্টার্সে ভর্তি হচ্ছি।”

তাজওয়ার গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। রাদ একটা রিকশা থামিয়ে আহিকে উঠতে বলতেই তাজওয়ার বলল,
“আহি, তুমি রিকশা করে যাবে?”

আহি তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠে বলল,
“আমার রিকশায় চড়তে ভীষণ ভালো লাগে।”

তারপর রাদের হাত ধরে তাকেও রিকশায় উঠতে বললো। তাজওয়ার আহি আর রাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি তাজওয়ারের দৃষ্টি অনুসরণ করে একনজর তাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? রাদ আমার বন্ধু। অন্তত মিস ফার্জিয়া আর তোমার বন্ধুত্বের চেয়ে আমাদের বন্ধুত্বটা অনেকটা শালীন।”

আহির কথায় তাজওয়ারের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে ভাবছে, আহি ফার্জিয়ার কথা কীভাবে জানলো? ফার্জিয়া তার বর্তমান প্রেমিকা। এই মেয়েটাই তার টাকার পেছনে পড়ে আছে।
রিকশা চলে যেতেই তাজওয়ার ফোন হাতে নিয়ে ফার্জিয়াকে কল করলো। আজই এই মেয়ের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করবে সে। সে সব ছাড়তে পারবে, কিন্তু আহিকে ছাড়া তার চলবে না।

(***)

রাদ আর আহি পাশাপাশি বসে আছে। রাদ হঠাৎ রিকশা থামিয়ে নেমে পড়লো। আহি রাদকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রাদ রাস্তার ওপাড়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর হাতে দু’টো ঝালমুড়ির প্যাকেট নিয়ে ফিরলো। আহি ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে বলল,
“তোর এখনো মনে আছে?”

রাদ রিকশায় উঠে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? তোরা চারজন প্রতিদিন স্কুল ছুটি হলেই ঝালমুড়ি কিনে মাঠে বসে বসে খেতি। আর আমি কতোবার চাইতাম, কিন্তু তোরা ভাগ দিতি না। ভীষণ হারামি ছিলি তোরা।”

আহি হাসলো। রাদ মুগ্ধ হয়ে আহির হাসি দেখছে। আর মনে মনে ভাবছে,
“আহি, সেদিন থেকেই আমার তোকে ভালো লাগতো। কিন্তু আজও এই কথা তোকে বলতে পারলাম না।”

রাদের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আনমনে বলল,
“যাকে আমি ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসে না। আর সে যাকে ভালোবাসে, তার মনে আমার ভালোবাসার মানুষটার জায়গা হয় না। কি অদ্ভুত প্রেম লীলা!”

(***)

আহি বাসায় এসে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আর তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“দরজা খোলা আছে।”

চুনি এক কাপ চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে আহির পাশে এসে দাঁড়ালো। আহি ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ চুনির দিকে তাকিয়ে রইলো। আহির তাকানো দেখে চুনি লাজুক হেসে মেঝেতে বসে চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখলো। আহি পা ভাঁজ করে চুনির দিকে ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কেন এসেছো? আমি তো চা খেতে চাই নি।”

চুনি দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“বেশি খুশি লাগতাছে আফা মণি।”

“কেন?”

“আপনের বিয়া হইবো। আমি নাচমু, শাড়ি পরমু। আমারে একখান শাড়ি কিন্না দিয়েন আফা।”

“আমার বিয়ে হবে এই কথা তুমি কোথায় শুনেছো?”

“মিছামিছি কথা কই না আমি। আজকেই ম্যাডাম আম্মারে কইলো। আপনের তাজওয়ার স্যারের লগে বিয়া।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“তা আমার বিয়ে হবে শুনে তুমি খুব খুশি, তাই না? আমাকে আসতে না আসতেই বিদায় করে দিতে চাও?”

চুনি গালে হাত দিয়ে বলল,
“ছি! আফা। কি কন এসব? আমি আর আম্মা আপনারে খুব ভালোবাসি। জানি আপনে এই বিয়াতে রাজি না। কিন্তু তাজওয়ার স্যাররে দেখছেন? কি সুন্দর একখান মুখ! রাজকুমারের মতো চেহারা।”

“সুন্দর চেহারার মানুষগুলোর মন সুন্দর হয় না। অগোছালো মানুষগুলোই বেশি সুন্দর হয়।”

আহি কথাটি বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। চুনি আহির হাত স্পর্শ করে বলল,
“আফা, আপনে বিয়া না করলে ম্যাডাম হইতো উল্টাপাল্টা কিছু করবো।”

“তুমি ভয় পেও না, চাঁদনি। মিসেস লাবণি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না। বেশি হলে কিছু শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। কিন্তু আমার সয়ে গেছে, চাঁদনি। পৃথিবীর সব যন্ত্রণা আমার মনের যন্ত্রণার কাছে তুচ্ছ। আমি ঠিকই এই দিনগুলো কাটিয়ে উঠবো। কিন্তু তাদের কাছে মাথা নত করবো না।”

এরপর আহি চুনির থুতনি ধরে বলল,
“তোমাকে আমি খুব সুন্দর একটা শাড়ি কিনে দেবো। আমার বিয়ে হওয়ার অপেক্ষা করতে হবে না।”

চুনি গালে হাত দিয়ে আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আফা, আপনে কাউরে ভালোবাসেন?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“একজন রাজাকে ভালোবেসেছিলাম। তার রানী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে প্রজা বানিয়ে ছেড়েছে। তার রাজ্যে আমি কোথাও নেই।”

চুনি চাপা স্বরে বলল,
“ওই পোলাডা, যার ছবি আঁকছিলেন?”

আহি বলল,
“তুমি এখন যাও। আর শোনো, মিসেস লাবণি আর বাবা কাল বাইরে গেলেই গ্যারেজ থেকে আমার ছবিগুলো নিয়ে এসো।”

চুনি মাথা নেড়ে চলে গেলো। সে চলে যেতেই আহি বালিশে মাথা ফেলে দিয়ে বলল,
“পাওয়া না পাওয়া হয়তো আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু এআর, তোমাকে ভালোবাসা আমার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আমি তোমাকে ভালোবেসে বেহায়া হয়েছিলাম। তারপরও ভালোবেসেছিলাম। আমি তোমাকে ভালোবেসে পাগল হয়েছি, তারপরও ভালোবাসতে ভুলি নি। এবার না হয় মৃত্যুও চলে আসুক। তখনো আমি তোমার উন্মাদ প্রেমিকা হয়েই থাকবো। তোমার সেই অজ্ঞাতনামা ভক্ত, যার মনে এখনো দ্বিতীয় কোনো পুরুষ স্থান পায় নি। আমিই সেই যে তোমার স্পর্শ না পেয়েও কলঙ্কিত হয়েছি। তোমাকে ভালোবাসার মতো সুন্দর কলঙ্ক আমার হৃদয়ে লেপ্টে আছে। আর এই কলঙ্ক নিয়েই আমি নিজেকে সম্পূর্ণ মনে করি।অন্ধকার আকাশের গায়ে আলো ছড়িয়ে দেওয়া সেই চাঁদের মতো আমারও ভীষণ অহংকার। কারণ আমার মতো কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না। আমার এই অহংকার কখনো কেউ ভাঙতে পারবে না।”

২০।

সকালে আহির আঁকা পুরোনো ছবিগুলো আবার তার রুমে ফিরিয়ে আনা হলো। আহি ঠিক আগের মতো করে তার রুমটা গুছিয়ে নিলো। দুপুরের দিকে রুম গোছানো শেষে আহি তার রুমের একপাশে মৃত পড়ে থাকা কাঠের গোল স্ট্যান্ডের উপর বসলো। তারপর চোখ বন্ধ করে আলতো হাতে স্ট্যান্ডটির উপর হাত বুলালো। এই কাঠের স্ট্যান্ডটির উপর দাঁড়িয়ে ছিলো তার প্রিয় মানুষটির প্রতিকৃতি। সেই প্রতিকৃতিটা তো এখন আর নেই। আছে শুধু তার দাঁড়িয়ে থাকার সেই ভিত্তিটি।

……………………..

দুই বসন্ত পেরিয়ে গেছে। আহি এখনো তার মনের কথা আফিফকে জানাতে পারলো না। তবে সেই বেনামী পত্রগুলো আফিফের ঠিকানায় ঠিকই পৌঁছে যায়, যেখানে আহি তার অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছে। তবে আফিফ তার অজ্ঞাতনামা প্রেয়সীকে না চিনলেও আফিফের প্রিয় জিনিসগুলো আহিকে ভালোভাবেই চিনে ফেলেছে। শুধু তাদের বলার ক্ষমতা নেই। নয়তো তারা আহির উন্মাদনার কথা আফিফকে জানিয়ে দিতো।

আফিফ প্রায়ই সাদা শার্ট পরতো। আহি আফিফের পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে জানার পর ভেবেছিল, তার হয়তো ভালো জামা নেই। কিন্তু পরে বুঝলো সাদা রং আফিফের ভীষণ প্রিয়। আফিফের পিছু নিতে গিয়ে অনেক বার সে খেয়াল করেছিল আফিফ ভ্যানগাড়ির সামনে দাঁড়ালে সাদা রঙের টি-শার্টগুলোই খুঁজে বের করে। আর এটা জানার পর থেকে আহির প্রিয় রঙ হয়ে গেলো সাদা। এরপর সে প্রতি সপ্তাহে সাদা জামা পরেই চারুশিল্পে যেতে লাগলো, যাতে আফিফের নজরে পড়ে। কিন্তু আফিফ আহির দিকে ভালোভাবে তাকায় না। হঠাৎ তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলে আফিফ চোখ সরিয়ে নেয়। তবে সেদিনের পর থেকে আহি সাদা রঙটায় তার হৃদয়ে জড়িয়ে নিয়েছিল। রং যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে আফিফকে বলতো,
“দেখো আফিফ। মেয়েটা তোমার জন্য বেরঙিন হয়েছে। তুমি কি তার জীবনটা রাঙিয়ে দিতে আসবে না?”

(***)

একদিন রাস্তার পাশে ফুল গাছের ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। আফিফ সেই ভ্যানের সামনে গিয়ে অনেকক্ষণ ফেরিওয়ালার সাথে কথা বলে চলে গেলো। আফিফ চলে যেতেই আহি সেই ভ্যানের সামনে এসে লোকটাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, আফিফ না-কি অলকানন্দা ফুল খুঁজছিল। আহি ভাবতে লাগলো, যেই ফুল ভ্যানে নেই, সেই ফুল খোঁজার অর্থ নিশ্চয় সেটা আফিফের প্রিয় ফুল। ব্যস, আহি সেদিনই নার্সারীতে গিয়ে অনেকগুলো অলকানন্দা ফুলের চারা এনে তার বারান্দা সাজিয়ে ফেললো। এখনো আহির প্রিয় ফুলগুলোর মধ্যে অলকানন্দার উপস্থিতি আছে। আগে আহি এই ফুল চিনতোই না। কিন্তু এখন রোজ অলকানন্দাগুলো আহির অনুভূতির সাক্ষী হয়। তারা যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে ফিসফিসিয়ে আফিফকে গিয়ে বলতো,
“দেখো আফিফ, মেয়েটা তোমার মাঝে এতোটাই ডুবে গেছে যে তোমার প্রিয় ফুল স্পর্শ করেই সে তার সকালটা শুরু করে। তুমি কি তার সকাল দেখার সঙ্গী হবে না?”

এই দুই বসন্তেই আহি আফিফের কাছে না এসে তাকে যতোটুকু চিনেছে, ততোটুকু কেউ আদৌ তাকে চিনতে পেরেছে কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

(***)

চারুশিল্পে ক্লাস করতে এসেই আফিফকে সপ্তাহে মাত্র দু’দিন দেখাটা আহির কাছে খুব কম মনে হচ্ছে, তাই সে আফিফকে আরো জানতে শুরু করলো। যাতে তাকে আহি আরো বেশি সময় ধরে দেখার সুযোগ পায়। মোটামুটি স্কুলের বিষয়গুলোর বাইরে আহির ব্যক্তিগত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ালো আফিফের ইতিহাস।
এরপর ধীরে ধীরে আহি জানতে পারলো আফিফ বয়সে তার চেয়ে বড়জোর তিন বছরের বড়। ক্লাস হিসেবেই তা আহি আন্দাজ করেছে। কারণ আহি এখন দশম শ্রেণিতে, আর আফিফ ইন্টার পরীক্ষার্থী। আহি চেয়েছে, সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে আফিফের কলেজের সামনে গিয়ে তাকে দেখে আসবে। কিন্তু আফিফ সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়েই সে জানলো, আফিফ গ্রামের কলেজে পড়ে। আর তারা গ্রামেই থাকতো। কিন্তু কয়েক বছর আগেই আফিফের বড় বোন চয়ন কাজের সূত্রে শহরে এসেছিল। চয়নের বিয়ে হয় নি। সে কলেজ পর্যন্ত পড়েছিল। তার বয়স ছিল মাত্র বাইশ। গ্রামের এক চাচার সাহায্যে সে একটা মার্কেটে কাজ নিয়েছিল। আর সেখানেই সে মেয়েদের শাড়ি-পোশাক বিক্রির দায়িত্ব পেয়েছিল। এরপর হঠাৎ চয়ন কাজ ছেড়ে দেয়। মেয়ে কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর পরই আফিফা বেগম সেলাই কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি আফিফ টিউশন করাতো। কিন্তু গ্রামের কলেজে পড়ে শহরে ভালো টিউশন পাওয়া দুষ্কর ছিল। শহরের অভিভাবকরা ভালো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই তাদের সন্তানদের জন্য গৃহশিক্ষক হিসেবে নির্বাচন করতে চান। তাই আফিফের জীবিকার উপায় হয়ে দাঁড়ালো তার শখ। আফিফ ছবি আঁকতে ভালোবাসে। রং-তুলি তার স্বপ্ন। আফিফের খুশির জন্যই চয়ন তাকে চারুশিল্পে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বলেছিল, জীবনে সে কিছু হোক না হোক, অন্তত একজন ভালো চিত্রশিল্পী হয়ে যাতে বের হয়। আফিফ বর্তমানে ছোট ছোট বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখায়। এতেই সে ভালো আয় করতে পারছে। এই প্রতিযোগিতার শহরে আফিফের ছবি আঁকতে পারার দক্ষতা তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এরপর কয়েক মাস আগেই চয়নের মৃত্যু হয়। মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। চয়ন আত্মহত্যা করেছিল। আফিফ সম্পর্কে এতোটুকু তথ্যই আহি নিতে পেরেছে। কিন্তু চয়নের আত্মহত্যাটা আহির কাছে রহস্য হয়ে গেলো। তবে আহি এতোটুকু বুঝে গেছে আফিফ তার জীবনে প্রচুর কষ্ট করছে। এই মুহূর্তে সে যদি আফিফকে তার ভালোবাসার কথা বলে, তাহলে হয়তো আফিফ তাকে দূরে সরিয়ে দেবে। কোথায় আহির বাবা দেশের প্রভাবশালী মানুষ, আর কোথায় নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের শান্ত ছেলে আফিফ। আহি তো সত্যটা মেনে নিয়েই আফিফকে ভালোবেসে যাচ্ছে। কিন্তু আফিফ যদি সত্যটা মানতে না চায়। তাই আহি সিদ্ধান্ত নিলো, এখন সে তার ভালোবাসার কথা জানাবে না। আরেকটু সময় নেবে। চয়নের মৃত্যুর ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে আফিফের হয়তো আরো কিছু মাস সময় লাগবে। কিন্তু এতোদিন আহি আফিফকে নিজের কাছ থেকে কীভাবে দূরে সরিয়ে রাখবে? এখন তো তার ভালোবাসা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। তার এই বাড়াবাড়ি প্রেম প্রশমিত করার একমাত্র ওষুধ আফিফকে কাছে পাওয়া। আফিফকে তার চোখের সামনে বসিয়ে রাখা। কিন্তু কীভাবে সে আফিফকে তার সামনে বসিয়ে রাখবে। দ্বিমাত্রিক ছবিগুলো আহিকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। একের পর এক ছবি এঁকেও যেন আহি তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এবার তার সম্রাট শাহজাহান হতে ইচ্ছে করছে। সম্রাট তার প্রেমের সাক্ষী রূপে বানিয়েছিলেন তাজমহল। আর আহি ভালো কারিগর দিয়ে বানিয়েছে আফিফের ভাস্কর্য। হুবহু আফিফের প্রতিরূপ নিয়ে এসেছে সে। ভাস্কর্যটি দাঁড় করানোর জন্য দামী কাঠ দিয়ে একটা গোল স্ট্যান্ড বানিয়েছে আহি। ভাগ্যিস আহি নিজের ঘরে নিজের মতো থাকতো। ভাগ্যিস তার ঘরে তার অনুমতি ব্যতীত কেউ আসতে পারতো না। নয়তো সালমা ফাওজিয়া অনেক আগেই আহির এই অতিমাত্রার পাগলামো কমানোর একটা ব্যবস্থা নিয়ে ফেলতেন।

যেদিন ভাস্কর্যটি বাসায় আনা হয়েছিল, সেদিন রিজওয়ান কবির আর সালমা ফাওজিয়া বাসায় ছিলেন না। আহি তার ঘরে ভাস্কর্যটি নিয়ে আসে। এরপর তার বিছানার মুখোমুখি সেটা দাঁড় করিয়ে রাখলো। তারপর সে তার কৃত্রিম আফিফের জন্য সাদা শার্ট আর প্যান্ট কিনে এনে সেটিকে পরিয়ে দিলো। আর বুক পকেটে গুঁজে দিলো তার বাগানের সেই অলকানন্দা ফুল। এরপর ভাস্কর্যটির হাত ছুঁয়ে দিয়ে আহি বলল,
“তোমাকে স্পর্শ করার এটাই একমাত্র সুযোগ ছিল। এআর, এখন তুমি শুধু আমার। তোমাকে স্পর্শ করার অধিকার শুধুই আমার।”

………………………….

অতীত স্মৃতি হাতড়ে ভালোই নয়ন ভেজালো আহি। চোখ খুলতেই তার অশ্রুসিক্ত লাল চোখ দু’টি দৃশ্যমান হলো। সে কাঠের স্ট্যান্ড থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। অলকানন্দা ফুলগুলো এখন আর নেই। গত চার বছর সে এখানে ছিল না। তাই ফুল গাছগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আহি ছাড়া এ বাসায় আর কারো ফুল গাছের শখ নেই। এই বাড়ির মানুষগুলো টাকার গাছ খুঁজতে এদিক-ওদিক ছুটে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এআর, চার বছর ধরে তোমাকে দেখি না। তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। দূর থেকে দেখলেই আমার চলবে। এমনিতেই তোমার কাছে যাওয়ার সাহস নেই আমার। এই মুখ নিয়ে তোমার সামনে কীভাবে দাঁড়াবো? তুমি নিশ্চিত ঠাট্টা করবে! হাসবে আমার উপর। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার কাছে আমি বেহায়া হলেও, আমার কাছে এটাই বেঁচে থাকার সম্বল। তোমাকে ভালোবাসি বলেই তো এখনো আমি বেঁচে আছি। নয়তো এই হিংস্র মানুষগুলো অনেক আগেই আমার প্রাণ নিয়ে নিতো।”

(***)

বিকেলে তাজওয়ার আহিদের বাসায় এলো। মিসেস লাবণি আর রিজওয়ান কবির এখনো বাসায় ফেরেন নি। আহি এই মুহূর্তে তাজওয়ারকে দেখে ভীষণ বিরক্তবোধ করছে। কিন্তু এই অসভ্য লোকটাকে সহ্য করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই।
এদিকে তাজওয়ার আহিকে দেখে বলল,
“ইউ আর লুকিং ভেরি বিউটিফুল!”

আহি দাঁত কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি তোমার এই অসভ্য কমেন্ট নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখো।”

“তুমি তো দেখছি আমার সাথে অসভ্য শব্দটা ব্যবহার না করে কথায় বলতে পারো না।”

“কারণ এই শব্দটাই তোমার সাথে মানানসই।”

“আর তোমার পাশে আমার মতো এই অসভ্য মানুষটাকেই বেশি মানায়।”

আহি চোখ-মুখ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার আহির মুখশ্রী দেখে বাঁকা হেসে তাকে টেনে বাগানের দিকে নিয়ে গেলো। আহি তাজওয়ারের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আর ইউ ক্রেজি?”

তাজওয়ার হেসে বলল, “অনলি ফর ইউ।”

তাজওয়ার পকেট থেকে সিগারেট বের করে সেটা ধরিয়ে বাগানের বেঞ্চে বসে পড়লো। আহি বিরক্ত মুখে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে যেতে নেবে, তাজওয়ার তার হাত ধরে তাকে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। আহি চেঁচিয়ে বলল,
“তুমি কি এখন আমাকে জোর করে সিগারেট খাওয়াবে?”

তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“খাওয়াবো না। কিন্তু অভ্যাস করতে হবে। তোমার পাশে বসে আমি রোজ রাতে সিগারেট ধরাবো, আর তুমি এই ধোঁয়া হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখবে। ভীষণ চমৎকার একটা দৃশ্য! তুমি নিশ্চিত উপভোগ করবে।”

তাজওয়ার আহির দিকে ফিরে ধোঁয়া ছাড়তেই আহি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। তাজওয়ার হাসলো। আহি গম্ভীরমুখে বলল,
“তোমার এই স্বভাবটাই আমি ঘৃণা করি। আর মনে রেখো, রোজ রাত কেন? তুমি কোনো রাতেই তোমার এই কুৎসিত স্বপ্ন পূরণ হতে দেখবে না।”

আহি কথাটি বলেই হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। এরপর ঘরে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে সে বার কয়েক মুখে পানির ঝাপটা দিলো। তারপর ভেজা মুখ নিয়ে আয়নার সামনে তাকাতেই তার মনে পড়লো সেই দিনটির কথা।

………………………

সেদিন বাসের জন্য আফিফ রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ একটা লোক তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। আর ওমনি আফিফ কাশতে শুরু করলো। ধোঁয়াটা একদম আফিফের কাছেই ছেড়েছিলো লোকটা। আহির ইচ্ছে করছিলো, সেই মুহূর্তেই লোকটাকে গণপিটুনি খাওয়াতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। তাই সে তার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আফিফের দিকে এগিয়ে দিলো। আফিফ পানি খেয়েই আহিকে ধন্যবাদ দিলো। আহির চোখাচোখি হতেই সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে ছিল আফিফ। সে হয়তো ভাবছে, এই মেয়েটা এখানে কি করছে? তাহলে কি এ-ই সেই মেয়ে যে তার পিছু নেয়? আহি আফিফের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সরাতে স্বাভাবিক মুখে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে আফিফের আগেই একটা বাসে উঠে পড়লো। বাসে উঠেই আহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আফিফকে একনজর দেখে নিলো। আফিফ হয়তো এখন ভাববে এটা ইচ্ছেকৃত সাক্ষাৎ নয়। এটা হঠাৎ দেখা হওয়া।
এরপর বাস একটু সামনে যেতেই আহি বাস থেকে নেমে আনমনে রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। আর মনে মনে সেই লোকটাকে ধন্যবাদ দিলো। সিগারেটের ছলে সে জানতে পারলো, সিগারেটের ধোঁয়ায় আফিফের সমস্যা হয়। উলটো তার বোতলটিও আফিফের স্পর্শ পেলো। উপরন্তু আফিফের ধন্যবাদও পেলো। তার ইচ্ছে করছে এই দিনটা ফ্রেমে তুলে সাজিয়ে রাখতে।

………………………

ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ফোনে টুংটুং শব্দ তুলে একটা মেসেজ এলো। ফোন হাতে নিলো আহি। দেখলো রাদের মেসেজ এসেছে। মাস্টার্সে ভর্তির জন্য একটা ভালো ভার্সিটি খুঁজে পেয়েছে সে। কালই ফর্ম ছাড়বে। আহিকে কাল দেখা করতে বলেছে। ভার্সিটির নামটা দেখেই আহির অস্থিরতা বেড়ে গেলো। এটা তো সেই ভার্সিটি! এই ভার্সিটিতেই আফিফ পড়তো। ফোনটা রেখে আহি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বুকে হাত রেখে জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমিও না, কি ভাবছি! এআর তো অনেক আগেই গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে বের হয়ে গেছে।”

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৪||

২১।
চারুশিল্পের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। তার চোখ দু’টি ভিজে যাচ্ছে। আজ কতো বছর পর আবার এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সে। এই স্থানটি ঘিরে কতো মিষ্টি মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল তার জীবনে। সবুজ গেটটি এখন বিভিন্ন রঙে মিশে গেছে। সিমেন্ট খসে পড়া দেয়ালে এখন কারুশিল্পের ছাপ। আহি ভেতরে ঢুকতেই সেই চেনা-পরিচিত অনুভূতিটি তার হৃদয় স্পর্শ করে গেলো। চারুশিল্প প্রতিষ্ঠানটি এখন অনেক উন্নত হয়েছে। পাশে একটা আর্ট গ্যালারি খোলা হয়েছে। শিল্পীদের আঁকা বাছাই করা ছবিগুলো এই আর্ট গ্যালারিতে স্থান পায়। কারো ইচ্ছে করলে কিনে নিয়ে যায়। তবে আহি যখন চারুশিল্পে পড়তো তখন এই জায়গাটি উন্মুক্ত ছিল। প্যান্ডেল বেঁধে এখানে এক্সিভিশনের আয়োজন করা হতো। আহির জন্য সেই দিনটি ছিল সবচেয়ে চমৎকার একটা দিন। সেই দিনটি ছিল আহির জীবনের প্রথম ও শেষ এক্সিভিশন। যদিও সেই এক্সিভিশন তার ছিল। কিন্তু মুহূর্তটা তারই ছিল। আর সেদিনই সে আফিফের কাছ থেকে মিষ্টি একটা সাড়া পেয়েছিল।

…………………………..

আড়াই বছর পার হয়ে গেছে। আহি এখনো আফিফের সামনে এসে দাঁড়ায় নি। লিনাশা বার-বার আহিকে বলছে আফিফকে ভালোবাসার কথা সামনা-সামনি গিয়ে জানাতে। বেশি দেরী হয়ে গেলে হয়তো আহি আফিফকে হারিয়ে ফেলতে পারে। তবে চিরকুট আর ছবি আঁকা এখনো বন্ধ হয় নি। কয়েক মাসে কতো শত চিরকুট সে আফিফকে দিয়েছিল। আহি দূর থেকে দেখতো, আফিফ সেই চিরকুট পড়ে মিষ্টি হাসি হাসছে। কি মনোমুগ্ধকর সেই হাসি! আফিফ নিজেও আহির চিরকুটে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। যদিও সে কখনো ফিরতি চিরকুট লেখে নি। লিখেই বা কাকে দেবে? দেওয়ার তো কোনো ঠিকানা নেই। বেনামী পত্রগুলো সে পড়েই নিজের বুক পকেটে রেখে দিতো। আর আহি দূর থেকে তা দেখে মনে মনে বলতো,
“তুমি মানো বা না মানো, আমি তোমার অন্তরালেই তোমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছি। আমি জানি, তুমিও আমাকে ভালোবাসো।”

(***)

পৌষ মাসের শুরুতেই চারুশিল্পে এক্সিভিশনের জন্য হুড়োহুড়ি লেগে গেলো। উচ্চতর বিভাগে যারা পড়ছে, তারা সবাই এক্সিভিশনে ছবি দিচ্ছে। আহি আর আফিফ এখনো মাধ্যমিক বিভাগের শেষ সেশনে। হয়তো তাদের ছবি বাছাই নাও হতে পারে। তবুও আফিফকে স্যার একটু বেশিই পছন্দ করেন। তিনি ক্লাসে এসেই এক্সিভিশনের লিফলেটটি আফিফকে দিয়ে বললেন,
“হাতে এক মাস সময় আছে। একটা ভালো ছবি আঁকো। যদি ছবিটা বাছাই হয়ে যায়, তুমি একটা চমৎকার সুযোগ পেতে পারো। দেশের ভালো ভালো আর্টিস্টদের আমরা ইনভাইট করেছি। তাদের যদি
তোমার আঁকা ছবি পছন্দ হয়ে যায়, মনে করবে তোমার লাইফ সেট হয়ে গেছে।”

আফিফ স্যারের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। স্যার আফিফের কাঁধে হালকা চাপড় মেরে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। এদিকে আহি মনোযোগ দিয়ে আফিফকে দেখছে। এতো বড় সুযোগ পেয়েও আফিফ ওতোটা খুশি হয় নি, যতোটা খুশি হওয়া দরকার ছিল। এর পরের সপ্তাহের শুক্রবার ক্লাস শেষ হতেই আফিফ একপাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ স্যারের সাথে কথা বললো। আহি দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। স্যার কিছুক্ষণ পর পর আফিফকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আফিফও একটু পর পর শার্টের হাতায় চোখ মুছছে। এসব দেখে আহির সবকিছুই কেমন যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছিল। আফিফ ধীরে ধীরে তার কাছে একজন রহস্যময় পুরুষে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল। যেই রহস্য ভেদ করা আহির কাছে এতোটা সহজ মনে হচ্ছে না।
আফিফ স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতেই আহি সেই স্যারের কাছে গেলো। হুট করে আফিফের কি হয়েছে তা জিজ্ঞেস করা সম্ভব না। তাই সে বলল,
“স্যার, আমাদের সেশন থেকে কেউ এক্সিভিশনে ছবি দেবে না?”

স্যার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আফিফকে বলেছিলাম। কিন্তু ও তো পারছে না।”

“কেন?”

“কিছু সমস্যা আছে হয়তো!”

আহির খুব ইচ্ছে করছিলো স্যারকে জিজ্ঞেস করতে কি সমস্যা তার এআরের? তাকে একবার বললে সে সব সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু আহি জানে সে যদি স্যারকে জিজ্ঞেসও করে বসে, তবুও তিনি বলবেন না। উলটো স্যারের কাছে এমন প্রশ্ন বেখাপ্পা মনে হবে। তাই সে আর বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটলো না।

(***)

আফিফের প্রতিমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহি। আলতো হাতে মূর্তিটির হাতের মুঠোয় নিজের হাত পুরে দিলো। তারপর সেই মূর্তিটির কপালে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলল,
“এক্সিভিশনে তোমার ছবি আসবে। যদি সত্যিই তুমি আমাকে একটু হলেও অনুভব করো, তাহলে আমি তোমার তুলিতে জায়গা করে নিতে পারবো।”

এরপর আহি লিনাশাকে নিয়ে চলে গেলো শপিংয়ে। দোকান ঘুরে একটা সাদা শাড়ি কিনলো। শাড়ির সাথে মিলিয়ে কালো চুড়ি, কালো ঝুমকো জোড়া কিনে বাসায় চলে এলো। সেদিনই বাবার কাছ থেকে তার দামী ক্যামেরাটা ধার নিলো। তারপর চলে গেলো সবুজ বনানীর ভীড়ে। মোজাম্মেল চাচাকে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল তার এমন একটা জায়গা লাগবে যেখানে সবুজ জঙ্গল থাকবে আর একটা শক্ত ডাল-পালাযুক্ত গাছ লাগবে। মোজাম্মেল চাচা আহিকে সেখানেই নিয়ে গেলেন। তারপর আহি মোজাম্মেল চাচার সাহায্যে সেই গাছে একটা দোলনা ঝুলিয়ে দিয়ে, সেই দোলনাটির সাথে লতা গাছ পেঁচিয়ে দিলো। ব্যস, আহির প্রাথমিক কাজ শেষ হতেই সে লিনাশার বাসায় গিয়ে সেই সাদা শাড়ির সাথে মিলিয়ে কালো চুড়ি, আর ঝুমকো জোড়া পরে নিলো। তারপর হাতে-পায়ে গাঢ় করে আলতা লাগিয়ে খোলা চুলে কয়েকটা অলকানন্দা ফুল লাগিয়ে নিলো। লিনাশা আহিকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“এআর তো তোকে দেখেই প্রেমে পড়ে যাবে।”

আহি লাজুক হেসে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। লিনাশা আহির হাত ধরে বলল,
“আহি একটা কথা বলি? তুই সত্যিই ওকে না পেলে পাগল হয়ে যাবি। দেরী করিস না দোস্ত। ওকে জানিয়ে দে। তুই ওর জন্য যা যা পাগলামো করছিস, আমার তোর জন্য ভীষণ মায়া লাগছে। যদি দিনশেষে ছেলেটা তোর না হয়ে অন্য কারো হয়ে যায়?”

আহি লিনাশার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আর কাঁপা কন্ঠে বললো,
“এমন দিন আসবে না লিনু। আমি আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে তাকে চেয়ে নিচ্ছি। আমার বিশ্বাস ও আমারই হবে। উনি কখনো আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেন না।”

“প্র‍্যাক্টিকাল কথা বল, আহি। সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা মাঝে মাঝে আমরা বুঝি না। হয়তো আমাদের ভালোর জন্য তিনি এমন কাউকে আমাদের জীবনে আনবেন, যাকে আমরা চাই নি। তখন মেনে নিতে পারবি তো?”

আহি থমথমে কন্ঠে বলল,
“ও আমার এআর। আমি ছাড়া ওর জীবনে কেউ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এটা যদি আমার আশা হয়, তাহলে তা-ই। মানুষ কিন্তু স্বপ্ন দেখেই বাঁচে।”

“সব স্বপ্ন সত্য হয় না, আহি।”

আহি দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“এআরকে আমি শুধু ভালোবাসি নি, ওকে আমি গভীরভাবে ভালোবেসেছি। সূক্ষ্মভাবে অনুভব করেছি। আমার হৃদয়টা যদি ভাগ হয়ে যায় তার এক অংশ জুড়ে সে থাকবে। বাকি অংশেও সে-ই থাকবে। আমার জীবনে তার চেয়ে প্রিয় কেউ নেই। তুই তো জানিস, আমার বাবা-মার সম্পর্ক কতোটা জটিল। তাদের দেখলে ভালোবাসা, অনুভূতি সবকিছুই আমার কাছে কেমন এলোমেলো মনে হয়। আমার এই অনুভূতির সৃষ্টি সেই মানুষটাকে ঘিরেই হয়েছে। আমি ভালোবাসতে শিখেছি তাকে দেখেই। এখন বল, এআরকে না পেলে আমি কেমন থাকবো? তাকে পাওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেলে, আমি স্বপ্ন দেখাই ভুলে যাবো। ও আমার পাশে থাকলে, আমি সব জয় করতে পারবো। ও আমার একমাত্র প্রেরণা।”

(***)

এক সপ্তাহ কেটে গেলো। এক্সিভিশনের জন্য আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। আহি যদি আজ আফিফকে ছবিটা দিতে না পারে, তাহলে তার পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাই আজ সে একটু আগেভাগেই চারুশিল্পের জন্য বেরিয়ে পড়লো। ক্লাসে পৌঁছেই আফিফের খাতা খুঁজে বের করে সেখানে ছবি আর চিরকুটটা রেখে বেরিয়ে গেলো। এরপর আফিফ ক্লাসে ঢুকতেই সেও ধীর পায়ে ক্লাসে ঢুকে পড়লো। আফিফ ডেস্ক থেকে তার খাতাটা যত্ন করে বের করলো। সে জানে এই খাতার ফাঁকে আজও কোনো না কোনো চিরকুট থাকবে। খাতাটা নিয়ে নিজের বেঞ্চে বসে পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়েই চমকে উঠলো আফিফ। আজ শুধু চিরকুট নেই, একটা ছবিও আছে। আফিফ ছবিটা দেখেই থমকে গেলো।
ঘন জঙ্গলের মাঝখানে একটা দোলনা ঝুলছে। সেই দোলনায় পা উঠিয়ে সাদা শাড়ি পরা একটা মেয়ে বসে আছে। তার আলতা রাঙা হাত আর চুলের ফাঁকে অলকানন্দা ফুলগুলো আফিফের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। ছবিটা দেখেই আফিফ হুট করে উঠে দাঁড়ালো।
ব্যস্ত হয়ে এদিক-ওদিক সেই আলতা রাঙা হাতটি খুঁজতে লাগলো। আহি আফিফকে কিছু খুঁজতে দেখেই একটা বই খুলে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর আফিফকে তার বেঞ্চে বসে যেতে দেখে আহি আবার তার দিকে তাকালো। আফিফ এবার চিরকুটটা হাতে নিলো। চিরকুট খুলতেই আফিফের ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠলো। চিরকুটে লেখা-
“প্রিয় অলকানন্দ,
ফুলের নামটা তোমার সম্বোধনে বেমানান। তাই তুমি আমার কাছে অলকানন্দ। আমি না হয় তোমার অলকানন্দা হয়েই থাকবো। শোনো না, তোমার পছন্দে নিজেকে সাজাতে ভালো লাগে। তাই আজ প্রথম তোমার পছন্দে সেজেছি। কি ভাবছো, আমি এতোকিছু কীভাবে জানি? আমার মতো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তোমাকে কেউ ভালোবাসবে না অলকানন্দ। এই প্রিয়, শোনো না, কেন আঁকবে না ছবি? আগামী সপ্তাহে তোমার রং-তুলি ফিঁকে হোক, আমি চাই না। অন্তত আমার এই ছবিটার সৌভাগ্য হোক। কবে তোমার সামনে বসবো, কবে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, তারপর ছবি আঁকবে, সেই অপেক্ষায় থাকতে পারছি না। আমি আজ তোমার কাছে খোলা প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদই তো একটি বই কেনার প্রথম আকর্ষণ হয়, তাই না? আমিও ঠিক তেমনি তোমার শিল্পী হওয়ার প্রথম আকর্ষণ হতে চাই। আমি তোমার মাখানো রঙের ফাঁকে আটকে থাকতে চাই। সাদা শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি আর আলতা রাঙা হাত এসব ছাড়া না-কি কোনো নারী প্রেয়সী হয় না। আর আজ আমি তোমার প্রেয়সী হয়েছি। এখন আমার প্রেম গল্প কি তোমার ক্যানভাসে তুলবে না, প্রিয়?”

এতো চমৎকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের সাধ্য কারো নেই। আফিফেরও হয় নি। সে পরের সপ্তাহে এক্সিভিশনের জন্য সেই ছবিটিই আঁকলো।

(***)

এক্সিভিশনের দিন আফিফের আঁকা ছবিটি প্রথম সারিতে রাখা হয়েছিল। আফিফ দূরে বসিয়ে রাখা চেয়ারে বসে তার ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, আজ অন্তত মেয়েটাকে সে চিনে নিতে পারবে। এতো ছবির মধ্যে নিজের ছবি দেখলে যে কারো অনুভূতি তার চোখে প্রকাশিত হবে। আফিফ সেই মুহূর্তটির অপেক্ষা করছিল। আহি দূর থেকে আফিফকে লক্ষ্য করছে। আফিফ যে তাকে হাতে-নাতে ধরার পরিকল্পনায় আছে, তা সে ভালোভাবেই বুঝে ফেলেছে। আজ অন্তত সে আফিফের মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় না। এখন আহি আফিফের চোখের আড়াল হয়ে ছবিটা কীভাবে দেখবে? তাই লিনাশাকে ফোন দিয়ে আসতে বললো আহি। লিনাশা এসেই আহির কথামতো ছবিটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছবিটির দিকে তাকিয়ে লিনাশা হাসলো। আফিফ দূর থেকে লিনাশাকে হাসতে দেখে চমকে উঠলো। সে উঠে দাঁড়াতেই লিনাশা ফোন হাতে নিয়ে আফিফের আঁকা ছবিটি তার ফোনে ধারণ করে নিলো। বাঁধাই করা ছবিটিতে হাত রাখতেই আফিফ লিনাশার সামনে এসে দাঁড়ালো। লিনাশা আফিফকে দেখেই চিনে ফেলেছে। সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি এই ছবির মেয়ে নন। তাহলে আপনি কি তাকে চেনেন?”

লিনাশা আমতা-আমতা করে বলল, “কার কথা বলছেন?”

“যার ছবি আমি এঁকেছি।”

“কার ছবি এঁকেছেন?”

আফিফ লিনাশার ফোনটা দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“ছবি কেন তুললেন?”

“ছবিটা দেখতে সুন্দর তাই।”

“এর চেয়ে সুন্দর ছবি এখানে আছে। নিশ্চয় আপনি তাকে চেনেন?”

লিনাশা আফিফের কথায় ঘাবড়ে গেলো। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি এটা কিনে নিতে চাচ্ছি।”

আফিফ ছোট একটা কাগজ লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা বিক্রির জন্য নয়।”

লিনাশা আফিফের গম্ভীর কথাবার্তা শুনে সেখান থেকে পালিয়ে চলে গেলো। আফিফ পিছু নিতে গিয়েও নেয় নি। তার ধারণা সঠিক ছিল। মেয়েটা হয়তো এই ছবির মেয়েটিকে ভালো করেই চিনে। লিনাশাকে আজ আফিফ প্রথম দেখেছে। এই মেয়েটা কখনোই ছবির মেয়েটি হবে না। কারণ যে আফিফকে চিরকুট দেয়, সে চারুশিল্পেই ক্লাস করে।

(***)

লিনাশা আহির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, ছেলেটা তোর অপেক্ষায় বসে আছে। ছেলেটা নিশ্চিত তোর সাথে কথা বলতে আগ্রহী। দেরী করিস না। গিয়ে জানিয়ে দে।”

আহি লিনাশার ফোনে আফিফের আঁকা নিজের ছবিটা দেখে মুচকি হাসলো। ছবির নিচে কিছু একটা লেখা আছে। আহি ফোনে তোলা ছবিটি ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখেও বুঝলো না। লেখাটা ফোনে ঝাপসা হয়ে গেছে। লিনাশা আহিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“বাদ দে। যখন প্রেম শুরু হয়ে যাবে, তখন জিজ্ঞেস করে নিস। হয়তো তোর জন্য কোনো মেসেজ ছিল।”

………………………………..

আহি আর্ট গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাদের ঝাঁকুনিতে আহি তার দিকে তাকালো। রাদ আহির চোখে অশ্রু জমতে দেখে বলল,
“যে তোর নেই, তাকে নিয়ে আর কতো ভাববি, আহি?

আহি মলিন মুখে বললো,
“এখান থেকেই তো আমার প্রেমের গল্পটা শুরু হয়েছিল। আমি ভুলে যাওয়া শিখি নি। তাই ভুলতে পারি না। এই জায়গা, ওখানে বসে থাকা, এই পথ ধরে তার হেঁটে যাওয়া, আমি সব অনুভব করতে পারি। শুধু ওকে স্পর্শ করতে পারি না।”

রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আজ আমার জন্মদিন, আহি। তুই অন্তত আমাকে কষ্ট দিস না।”

“আমি ওর কথা বললে তুই কেন কষ্ট পাবি?”

রাদ মলিন হাসলো। মনে মনে বলল,
“তোকে ভালোবাসি বলে অন্য কারো প্রতি তোর ভালোবাসা দেখলে কষ্ট পাই। আমাকে যদি এভাবে ভালোবাসতি, সব সুখ তোর নামেই লিখে দিতাম।”

আহি রাদের দিকে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাদ বলল,
“এখানে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট খুলেছে। ভেবেছি দেশে আসলে প্রথম জন্মদিনে তোকে আর লাবীবকে সেখানে ট্রিট দেবো। আগে যদি জানতাম রেস্টুরেন্টটার পাশেই সেই তেলাপোকার বাসা, কখনো তোকে এদিকে নিয়ে আসতাম না।”

আহি রাদের হাত ধরে বলল, “সরি।”

রাদ হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“যা ভাই। তোর সাথে কথাই বলবো না।”

আহি কান ধরে বলল,
“সরি। ওর কথা আর বলবো না। এখান থেকে বেরিয়ে যাই, চল। এখানে থাকলে আমারও কষ্ট বাড়বে, তোরও মন খারাপ হবে।”

রাদ আহির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“এই যে আমার কারণে তুই ওই তেলাপোকাকে মাথা থেকে নামিয়ে দিস, ভীষণ ভালো লাগে রে। মনে হয় তোর উপর আমার অধিকার পাকাপোক্ত হচ্ছে।”

আহি রাদের কথায় হাসলো। রাদ আহির হাত ধরে তাকে চারুশিল্পের বাইরের নিয়ে এলো।

২২।

লাবীব আর আহি রাদকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিতেই রাদ কেক কাটলো। তারা একসাথে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে বসেছে। লাবীব চেয়ার্স বলতেই আহির ঠোঁটের হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। দেশে আসার পর প্রথম তারা তিনজন কোথাও বসে আড্ডা দিচ্ছে। কয়েক বছর আগে আহির আড্ডা জমতো পদ্ম, লিনাশা আর পুষ্পের সাথে। কিন্তু আজ আহির জীবনে তাদের তিনজনের স্থান ব্লক লিস্টে। হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে জানালার বাইরে তাকালো।
দু’তলা রেস্টুরেন্ট। কাচের জানালা দিয়ে ব্যস্ত রাস্তা দেখা যাচ্ছে। আহি সেদিকেই তাকিয়ে আছে। পলি আপু গ্রুপটা এখন জীর্ণশীর্ণ হয়ে আছে। কোথায় তারা একসাথে বসে আড্ডা দেওয়ার কথা ছিল, এখন কি হয়ে গেলো! আজকে এমন একটা দিন আসবে তারা হয়তো কখনোই ভাবে নি। হঠাৎ আহি কি মনে করে ফোনটা হাতে নিলো। নতুন একাউন্ট খুলেছে সে। পুরোনোটাতে ঢুকতে ইচ্ছে করে না তার। গত চার বছরে ঢুকেও দেখে নি। কিন্তু পাসওয়ার্ডটা তার এখনো মনে আছে। সেই পাসওয়ার্ডটা টাইপ করতে কষ্ট হবে বলেই ঢুকে নি। কিন্তু আজ একবার সেই ফেইসবুক একাউন্টটাতে ঢুকতে ইচ্ছে করছে। আহি তার এই ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখলো না। পাসওয়ার্ড লিখলো, এআরের অলকানন্দা হতে চাই। সাথে সাথেই লগ ইন হয়ে গেলো। লগ ইন হতেই আহির ভেতরটা হুঁহুঁ করে উঠলো। ইনবক্সে ঢুকতেই সামনে ভেসে উঠলো তিনটা ইনবক্স। উপরেই পুষ্পের মেসেজ। তিন বছর আগে শেষ মেসেজ দিয়েছিল সে। মেসেজগুলো দেখতেই আহির চোখ ভিজে উঠলো। পুষ্প লিখেছিল,
“আহি তুই এভাবে আলাদা হয়ে গেলি কেন? পদ্ম অনেক বার তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে। ও নাকি তোকে খুঁজে পায় না। লিনাশার সাথে তোর কি হয়েছে? ওকে কতোবার জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু ভীষণ রেগে আছে তোর উপর। কি করেছিস তুই? সেদিন দেখা হলো, বললো তুই নাকি সব নষ্টের মূল। কেন আহি? তোদের সম্পর্ক তো এমন ছিল না। আহি অন্তত আমার সাথে যোগাযোগ করিস। ভুলে যাস না যেন। লিনাশা বললো, তুই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিস। হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”

আহি মলিন হাসলো। পরের মেসেজটি এসেছিল লিনাশার কাছ থেকে। শেষ মেসেজ দিয়ে সে লিখেছিল,
“তোকে শেষ একটা কথায় বলবো, আফিফকে ভুলে গেলেই তোর জন্য ভালো হবে। এককালে বন্ধু ছিলাম, তাই বলছি। এখন আর তোর সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

সেদিন আহিকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দেয় নি লিনাশা। সে নিজেই ব্লক করে দিয়েছিল আহিকে। শেষ মেসেজটি ছিল পদ্মের। সে লিখেছে,
“সেদিন যে চলে গেলি, আর কথাও বললি না। লিনাশা বললো, তুই না-কি সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলি। বাড়িতে থেকে যেতে পারতি। মা তো ছিল।”

আহি নিজেই মেসেজটা দেখে পদ্মকে ব্লক করে দিয়েছিল। এরপর আহি ঢুকলো পলি আপু গ্রুপটিতে। তাদের চারজনের গ্রুপ। লিনাশা সবার আগেই সেই গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে লিখেছিল,
“এতোটুকুই হয়তো আমাদের বন্ধুত্বের যাত্রা ছিল।”

পুষ্প আর পদ্ম সেই মেসেজের উত্তরে অনেক প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু লিনাশা সেই যে গ্রুপ ছাড়লো, আর ঢুকে নি। আহি সেই গ্রুপে কোনো মেসেজ দেয় নি। সেও বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখনো আর্কাইভে মৃত পড়ে আছে সেই গ্রুপটি। সেদিন তারা কি অদ্ভুত কাজটাই না করেছিল! ফলস্বরূপ তাদের ছোট বেলার বন্ধুত্বটা এখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্লক লিস্টে স্থান পেয়েছে। এভাবে কি বন্ধু হারিয়ে যায়?

হঠাৎ আহির কানে ভেসে এলো একটি গান। আহি বুঝতে পারছে না, রেস্টুরেন্টে হঠাৎ এই গানটিই কেন ছাড়লো?

“এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে
সকাল-বিকেল বেলা
কত পুরোনো-নতুন পরিচিত গান
গাইতাম খুলে গলা।
কত এলোমলো পথ হেটেছি দু’জন
হাত ছিলো না তো হাতে
ছিল যে যার জীবনে দু’টো মন
ছিল জড়াজড়ি একসাথে।
কত ঝগড়া-বিবাদ, সুখের স্মৃতিতে
ভরে আছে শৈশব
তোকে স্মৃতিতে স্মৃতিতে এখনও তো
ভালোবাসছি অসম্ভব।
কেন বাড়লে বয়স
ছোট্ট বেলার বন্ধু হারিয়ে যায়
কেন হারাচ্ছে সব,
বাড়াচ্ছে ভীড় হারানোর তালিকায়।
আজ কে যে কোথায় আছি
কোনো খবর নেই তো কারও
অথচ তোর ওই দুঃখগুলোতে
অংশ ছিল আমারও।
এই চলতি জীবন ঘটনাবহুল
দু’এক ইঞ্চি ফাঁকে
তুই তো পাবি না আমায়
আর আমিও খুঁজি না তোকে
কত সুখ পাওয়া হয়ে গেল,
তোকে ভুলে গেছি কতবার
তবু শৈশব থেকে তোর গান যেন
ভেসে আসে বারবার।”

গানটি শুনতে চাচ্ছিলো না আহি। তবুও কানে ভেসে আসছে। অসহ্য লাগছে তার। আজ রাদের জন্মদিন, কিন্তু তার কান্না পাচ্ছে। সে কাঁদতে চাচ্ছে না, তবুও বেহায়া অশ্রুগুলোকে থামাতে পারছে না সে। হঠাৎ আহির কানে একটা পরিচিত কণ্ঠের স্বর ভেসে এলো। আহি অশ্রু আড়াল করে রাদের দিকে তাকালো। দেখলো রাদ অবাক দৃষ্টিতে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। আহি রাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে পাশ ফিরে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো।

সেই পরিচিত কণ্ঠে তাকে আবার ডাকলো সেই পরিচিত মুখটি।

“আহি!”

আহি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রাদ আর লাবীবও উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটি আহির দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, তুই!”

আহি অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, “পুষ্প!”

(***)

দুই বান্ধবী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেলেন। যারাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে তাদেরকেই রাদ উত্তর দিচ্ছে,
“অনেক বছর পর দুই বান্ধবীর দেখা হয়েছে তাই কাঁদছে।”

পুষ্প আহির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? একটা কলও কি দেওয়া যায় না?”

আহি মলিন মুখে বললো,
“সরি রে। অনেক ভুল করে ফেলেছি।”

“দেশে কবে এসেছিস?”

“এই তো এই মাসেই এসেছি।”

“আবার চলে যাবি?”

“জানি না। বাবা যা ভালো মনে করেন।”

“চল না একটু বসি। কিছুক্ষণ কথা বলি।”

আহি রাদের দিকে তাকালো। রাদ চোখের ইশারায় বললো পুষ্পকে সময় দিতে। পুষ্প রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে আমি চিনি মনে হচ্ছে।”

রাদ হেসে বলল,
“রিদমাম, রোল ০৩।”

“আমাদের স্কুলের রিদমাম?”

“হ্যাঁ।”

পুষ্প আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওকে কোথায় পেয়েছিস তুই?”

রাদ বলল,
“আমার সাথে ওর কথা হতো। ওর নানার বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি। এরপর ইউকে গিয়ে বন্ধুত্বটা আরো জমলো।”

লাবীব পুষ্পের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমাকে চিনেছো?”

পুষ্প লাবীবের হাতের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“না, কে আপনি?”

লাবীব বিষ্ময়ভরা কন্ঠে বললো,
“রাদকে তুমি, আর আমাকে আপনি? আমিও সেই স্কুলেই পড়তাম।”

“নিশ্চয় ব্যাকবেঞ্চার। ব্যাকবেঞ্চারদের কেউ মনে রাখে না।”

পুষ্পের কথায় রাদ আর আহি মুখ চেপে হাসলো। আর লাবীবের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই পুষ্প আহিকে বলল,
“চল, তোর সাথে অনেক কথা আছে।”

(***)

“লিনাশার সাথে কথা হয় না তোর?”

আহি পুষ্পের প্রশ্নে মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“পদ্মকে তুই ব্লক করে দিয়েছিস কেন?”

“এমনিতেই।”

“কিছু একটা তো হয়েছে।”

“জানাতে পারবো না, তাই তো ব্লক করে দিয়েছিলাম।”

“আমাকে তো করিস নি।”

“সবাইকে করে দিলে যদি পরে কাউকে খুঁজেই না পাই!”

“খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাহলে?”

“হুম। তোদের কথা খুব মনে পড়ে। এখন তোর কি অবস্থা বল?”

“ভালো। অনার্স শেষ হলো, এখন মাস্টার্সে ভর্তি হবো।”

“আমিও তো।”

“সত্যিই! চল একসাথে ভর্তি হই। যদিও আমাদের আলাদা সাবজেক্ট, তাও অন্তত এক জায়গায় থাকবো। বিশ্বাস কর, আমি গত চার বছরে মনের মতো একটা বন্ধুও পাই নি। তোদের মতো কেউ হয় না রে। আমার মতো এলোমেলো মেয়েটাকে শুধু তোরাই বুঝেছিস।”

“বিয়ে করবি না?”

“আরেহ ধুর, এসব ঝামেলায় কে যাচ্ছে? বাসা থেকেও ওতো চাপ দেয় না। বাবা চায়, আমি আগে চাকরি ধরি। তারপর বিয়ে দেবে।”

“নিশ্চয় ঠিক করে রেখেছে।”

“হ্যাঁ, ওই, সেই ছেলেটা।”

আহি হেসে বলল, “তোর সেই ফুফাতো ভাই?”

“হ্যাঁ রে। সেই ভ্যাবলাটার সাথেই না-কি বিয়ে দেবে। কেন যে একটা প্রেমে পড়লাম না! অন্তত ভ্যাবলাটার হাত থেকে বাঁচতাম। এখন তো বলতেও পারছি না বিয়ে করবো না। অজুহাত দেওয়ার মতোও কোনো ছেলে হাতে নেই।”

আহি পুষ্পের কথায় নীরবে হাসলো। পুষ্প হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর এআরের খবর কি?”

আহি পুষ্পের প্রশ্নে চমকে উঠলো। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“জানি না। এসব কথা বাদ দে। বাকিদের কি খবর? লিনাশা, পদ্ম, কথা হয় ওদের সাথে?”

“হুম, লিনাশার সাথে প্রায়ই কথা হয়। দেখাও হয়। ওর বয়ফ্রেন্ডটা সে-ই স্মার্ট রে। হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ের দাওয়াত পাবো।”

আহি মলিন হেসে বলল, “ভালো। পদ্মের কি অবস্থা?”

“বলিস না ভাই। মেয়েটা ঝামেলায় আছে। ওর তো ইন্টারের পরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, মনে আছে?”

“হুম।”

“সংসার ভালো যাচ্ছে না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন? ওতো প্রেম করে বিয়ে করেছিল।”

“হুম, ছেলেটা ভালো। কিন্তু ছেলের মা ভীষণ খারাপ।”

“কি বলিস!”

“হ্যাঁ রে। পদ্ম মা হতে পারছে না। এতো বছরে একটা বাচ্চাও হয় নি। তাই মহিলাটা ঝামেলা করছে। ছেলেকে না-কি আরেকটা বিয়ে করতে বলছে।”

আহি মলিন মুখে বললো,
“মেয়েটা ভীষণ লক্ষী রে। তিনি হয়তো আসল হীরে চিনতে পারেন নি। সন্তান দিয়ে কি হয়? স্বামী-স্ত্রী সুখে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ ভালো মানুষগুলোকে সন্তান কেন দেন না বুঝি না। যারা সন্তানের মূল্য বুঝে না তাদের সন্তান দিয়ে, উলটো সেই সন্তানের জীবনটাও নরক বানিয়ে দেন।”

(***)

বাসায় ঢুকতেই আহি থমকে দাঁড়ালো। লাবণি হাসিমুখে আহির দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“আহি, দেখো দেখো কারা এসেছে!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ওরা এখানে কি করছে?”

“তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সামনের শুক্রবার তোমার আর তাজওয়ারের আক্দ।”

আহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহলে কি এবার কল্পনায়ও আর আফিফ জায়গা পাবে না? তার আত্মাও কি তার প্রিয় অলকানন্দকে হারিয়ে ফেলবে?

চলবে-

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৫||

২৩।
তাজওয়ার আহির পাশে এসে বসতেই আহি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালো। তাজওয়ার ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আজ আমাদের এনগেজমেন্ট, আহি। তুমি কি খুশি নও?”

আহি গম্ভীরমুখে বলল,
“তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস ছেলের সাথে বিয়ে হওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ হবে। আর নিজের দুর্ভোগ দেখে কেউ খুশি হয় না।”

“তুমি এখনো আমার গুরুত্বটা বুঝতে পারছো না। তবে একদিন ঠিকই বুঝবে। আর আমার এতো তাড়া নেই। এখন তো তুমি আমার পারমানেন্ট পার্টনার হতে যাচ্ছো।”

রেহানা খান তাজওয়ারের হাতে আংটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“বাবা, আহিকে পরিয়ে দে।”

তাজওয়ার আংটিটা হাতে নিয়ে আহির দিকে তাকালো। আহি নিজের হাতটা লুকিয়ে রেখেছে। তাজওয়ার আহির কান্ড দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। তাজওয়ারের হাসি দেখে আহির মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। মিসেস লাবণি আহির পাশে বসে তার হাতটা ধরে বললেন,
“তুমি যদি এই মুহূর্তে কোনো সিনক্রিয়েট করো, তাহলে এর ফলাফল তোমার মা আর তোমার বন্ধুরা ভোগ করবে।”

আহি অসহায় দৃষ্টিতে লাবণির দিকে তাকালো। লাবণি তাজওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি কেমন তুমি তো জানো। এভাবে হুট করে কোনো কিছুই ওর পছন্দ না। বিয়ে নিয়ে ওর কতো স্বপ্ন! তাই হয়তো ও একটু অভিমান করে আছে।”

তাজওয়ার লাবণির কথায় আংটিটা বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো আর বলল,
“তাহলে আহির মতো করে এই এনগেজমেন্টটা হবে। আমার বাগদত্তা খুশি হলেই আমি খুশি।”

তাজওয়ারের কথা শুনে রিজওয়ান কবির ও লাবণি অবাক হয়ে গেলেন। লাবণি বলল,
“আজ না হয় রিংটা পরিয়ে দাও। আহির ইচ্ছেমতো বড়সড় আয়োজন করে আবার না হয় পরাবে।”

তাজওয়ার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“খুব স্পেশাল মুহূর্তগুলো জীবনে একবার আসলেই ভালো। যেমন আহি আমার কাছে স্পেশাল একজন, তেমনি তাকে ঘিরে আমার প্রতিটা মুহূর্ত স্পেশাল। এমন ফিকে এনগেজমেন্ট আমিও চাই না। খুব শীঘ্রই আহির জন্য চমৎকার একটা সারপ্রাইজ নিয়ে আসবো। আর তখন আমাদের এনগেজমেন্টের দিনটা আহির কাছে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

তাজওয়ার আহির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে মিসেস লাবণির রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। আহির হাবভাব দেখে তাজওয়ার ও তার পরিবার যাতে কিছু মনে না করে, তাই লাবণি ওমন কথা বলেছিল। কিন্তু তাজওয়ার যে তার কথা শুনে আহিকে আংটি না পরিয়ে চলে যাবে, এটা সে ভাবতেও পারে নি। এদিকে রিজওয়ান কবির লাবণির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আহিকে বিদায় করার জন্য এই দম্পতি যে উঠেপড়ে লেগেছে তা দূর থেকে দেখেই ভালোভাবে বুঝতে পারছেন মুনিয়া খালা। তবে তিনি তাজওয়ারের ক্ষণকালের এই সিদ্ধান্তে মনে মনে খুশি হয়েছেন। এর মধ্যেই যদি আহির কোনো গতি হয়ে যায়, তাতেই হবে।

(***)

রাতের খাবারের আয়োজন করে ফেলেছেন মুনিয়া খালা। রিজওয়ান কবির বসার ঘরে বসে সিরাজ খানের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছেন। সেখানে বসেই রেহানা খান আর লাবণি গল্প করছেন। তাজওয়ার কারো সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। এদিকে আহি নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই দোয়েল তার পেছন পেছন এসে তাকে ডাকলো। আহি দোয়েলকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। দোয়েল আহির কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“তোমার আর তাজওয়ার ভাইয়ের বিয়ে হবে শুনে আমার অনেক ভালো লাগছে। আমি তো আজই এখানে আসার আগে জানলাম তোমাদের বিয়ে হবে।”

আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আর আমি গত চার বছর ধরে জানি কোনো একদিন এই ভয়াবহ দিনটা আমার জীবনে আসবে।”

“কি বলছো আহি? ভয়াবহ দিন! তাজওয়ার ভাই তোমাকে খুব ভালোবাসেন। তুমি অনেক সৌভাগ্যবতী।”

আহি দোয়েলের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“যেই মেয়ে জানে তার হবু শ্বশুড় বাড়ির পরিবেশ কোনো নষ্ট বাড়ির চেয়ে কম নয়, যেই মেয়ে জানে তার হবু স্বামীর শরীরে অনেক মেয়ের গন্ধ লেগে আছে, সেই মেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করবে, এটা নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক। আমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই ভাবী। আমার ভালোবাসার বয়স পার হয়ে গেছে। আমার এই মুহূর্তে যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়, সেটা হচ্ছে ভালো বন্ধু, সত্য সম্পর্ক আর নিরাপদ আশ্রয়। যার একটাও তাজওয়ার আমাকে দিতে পারবে না। তাহলে আমি কি করবো তার এই তথাকথিত ভালোবাসা দিয়ে? আমি তো সেটা চাই-ই না।”

“ভালোবাসা কে না চায়, আহি?”

“আমার কাছে আত্মসম্মানবোধ ভালোবাসার ঊর্ধ্বে। যার আত্মসম্মানবোধ নেই, সে এমন সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে চায়।”

আহি কথাটি বলেই সেখান থেকে চলে গেলো। আর দোয়েল মলিন মুখে সিঁড়ির কাছে যেতেই পাশের বারান্দা থেকে ফিসফিস শব্দ আসায় থমকে দাঁড়ালো। সে কিছু একটা ভেবে ধীর পায়ে বারান্দার কাছে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো। দেখলো সরওয়ার চুনির কোমড় জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর চুনি সরওয়ারকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। এই দৃশ্য দেখে দোয়েলের চোখে অশ্রু জমতে শুরু করলো। সে বারান্দার দরজায় ইচ্ছে করে ধাক্কা দিতেই সরওয়ারের হাত আলগা হয়ে গেলো। আর চুনি মুক্তি পেয়ে দৌঁড়ে নিচে নেমে গেলো। সরওয়ার দরজার কাছে দোয়েলকে দেখে রাগী স্বরে বলল,
“তুই আর আসার সময় পেলি না!”

কথাটি বলেই সরওয়ার দোয়েলকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়েই চলে গেলো। দোয়েল দরজা ধরে দাঁড়িয়ে মলিন হেসে বলল,
“এটাই আমার নিয়তি। তবুও এই মানুষটাকে ভালোবাসি বলেই তার ভালোবাসার কাঙাল হয়ে আছি। আর এই সংসার থেকে বের হয়েই বা কোথায় যাবো? বাবা-মার অভাবের সংসারে আমি অপয়া ছাড়া কিছুই নই।”

এদিকে চুনি আহির কাছে গিয়ে সরওয়ারের বাজে আচরণের কথা জানাতেই আহি ক্ষেপে গেলো। চুনি আহির রাগ দেখে তার হাত ধরে বলল,
“আফা, ওরা ডায়নিংয়ে বসে খাইতাছে। আপনে কিছু কইয়েন না৷ স্যার-ম্যাডাম আমারেই ভুল বুঝবো।”

আহি ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল,
“কে কি বুঝলো, বুঝলো না, ওটা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি আজ ওই খান বংশকে তাদের আসল যোগ্যতা দেখিয়েই ছাড়বো।”

আহি হনহনিয়ে নিচে নামতেই তাজওয়ারের মুখোমুখি হলো। তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“তোমাকে ডাকতেই উপরে উঠছিলাম।”

আহি তাজওয়ারকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“আমাকে পারছো না তাই আমাদের বাড়ির মেয়েকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছো?”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো?”

“তোমার ভাইকে জিজ্ঞেস করো, সে কি করেছে!”

তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে সরওয়ারের দিকে তাকালো। আহির কথা শুনে সরওয়ারের গলায় খাবার আটকে গেলো। সে কাশতে শুরু করলে দোয়েল তার দিকে পানি এগিয়ে দিতে যাবে তখনই আহি এসে পানির গ্লাসটা নিয়ে সরওয়ারের মাথায় ঢেলে দিলো। সরওয়ার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই রিজওয়ান কবির চেঁচিয়ে বললেন,
“আহি, এসব কেমন অভদ্রতা?”

আহি সরওয়ারের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“এই অসভ্য লোকটা চুনির সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। জোরজবরদস্তি করতে চেয়েছে।”

মিসেস লাবণি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন,
“কে বলেছে তোমাকে এসব কথা? ওই চুনি বলেছে?”

“হ্যাঁ।”

লাবণি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আর তুমি বিশ্বাস করেছো? এসব মেয়েগুলোকে আমার ভালোই চেনা আছে। বড় ঘরের ছেলেদের সাথে নিজেরাই ঘেঁষতে চাইবে, তারপর একটু স্পর্শ পেলেই ন্যাকা কান্না জুড়ে দেবে।”

মুনিয়া খালা নিজের মেয়ের নামে এমন কথা শুনে পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু আহি চুপ থাকলো না। প্রতিত্তোরে বলল,
“আরেহ হ্যাঁ, আপনি তো এসব মেয়েদের ভালোই চিনবেন। নিজেও তো একই কাজ করেছিলেন।”

রিজওয়ান কবির আহির কথা শুনে তার দিকে তেড়ে এসে সশব্দে তার গালে চড় বসিয়ে দিলো। তাজওয়ার আহিকে নিজের কাছে টেনে এনে রাগী কন্ঠে বলল,
“মিস্টার রিজওয়ান কবির, আপনি আমার সামনে আমার ফিয়োন্সের গায়ে হাত তুলেছেন কোন সাহসে?”

আহি গালে হাত দিয়েই তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার আহির গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“ওর উপর এখন আমার অধিকার। ওকে শাসন করতে হলে, আমিই করবো।”

এরপর তাজওয়ার সরওয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভাই, আমি তো জানি তুমি কেমন! তাই তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে নিজের গুণকীর্তন গাইতে হবে না।”

তাজওয়ার এবার রেহানা খানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মা, আজ সবার সামনে জানিয়ে দিচ্ছি। সরওয়ার খান যদি আমার আর আহির কোনো অনুষ্ঠানে আসে, তাহলে আমি খুব বাজে কিছু করে বসবো। আর এই বাড়িতে দ্বিতীয়বার যেন সে না আসে।”

তাজওয়ারের কথায় সরওয়ারের মুখটা লাল হয়ে গেলো। সে হনহনিয়ে আহিদের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। সরওয়ার চলে যেতেই তাজওয়ার লাবণিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মিসেস কবির, প্লিজ আহির কথায় কিছু মনে করবেন না। ও যা বলেছে ফ্রাস্ট্রেশন থেকে বলেছে। কিন্তু মন থেকে ও খুব সফট। একদম ফুলের মতো।”

আহি অবাক হয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে টেনে বাগানের কাছে নিয়ে গেলো। আহি সেখানে গিয়েই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য তুমি যে-কোনো কিছু কর‍তে পারো। ইন্টারেস্টিং!”

তাজওয়ার হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“তোমার আর নিজের প্রাণ নেওয়া ছাড়া আমি সব কর‍তে পারবো।”

“নিজের প্রাণ নিয়ে আমাকে উদ্ধার করলে বেশি ভালো হতো।”

“আই লাভ মাইসেল্ফ, আহি। আমি নিজেকে ভালোবাসি বলেই তো তোমাকে চাই। কারণ আমার ভালো থাকা তোমাতেই সীমাবদ্ধ। তুমি ছাড়া আমি শূন্য। আর আমি ছাড়া তুমি ধ্বংস।”

২৪।

আহি আর রাদ ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগেই তারা মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। এদিকে লাবীব আর পুষ্পের মধ্যে চলছে বাগবিতণ্ডা। ছোট একটা বিষয় নিয়েই তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি চলছে। রাদ আর আহি একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আহির চোখ গেলো ভার্সিটির গেটের দিকে। আর মুহূর্তেই তার পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। আহিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাদ তার কাঁধে হাত রাখতেই আহি তার শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। রাদ শক্ত করে আহিকে ধরে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে তোর!”

আহির শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার চোখের সামনে বার-বার সেই বর্ষার রাতটি ভেসে উঠছে। সে উলটো দিকে ফিরে রাদের শার্ট খামচে ধরে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আফিফ রাফাত।”

আফিফের নাম শুনে রাদ সামনে তাকালো। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। পরণে সাদা শার্ট। কাঁধে অফিস ব্যাগ। কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। রাদ চাপা স্বরে বলল,
“এটাই আফিফ।”

আহি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আহির চোখ দু’টি ভিজে যাচ্ছে। রাদ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আহিকে শক্ত করে ধরে বলল,
“আহি রিল্যাক্স। পাব্লিক প্লেসে এমন করিস না। শান্ত হো।”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার শরীরটা নিথর হয়ে যাচ্ছে, রাদ। আমাকে বাঁচা। ও কেন আমার সামনে এসেছে? আমি যদি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি, লোকে আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলবে।”

রাদ আহির গালে হাত রেখে বলল,
“পাগল না-কি তুই!”

“দেখ না, তাজওয়ার জোর করে আমাকে নিজের করে নিতে চাইছে। আর সবাই ওকে বলছে প্রেমিক পুরুষ। এমন ভালোবাসা না-কি সব মেয়েরাই চায়। তাহলে আমি একটু চাইতে গেলে সবাই আমাকে বেহায়া কেন বলে? আমি তো আফিফকে জোর করি নি। আমি তো ওকে শুধু নীরবে ভালোবেসেছি।”

রাদ আহিকে জড়িয়ে ধরতেই লাবীব আর পুষ্প তাদের দিকে তাকালো। পুষ্প গালে হাত দিয়ে বলল,
“বাহ, এদের তো দারুণ রোমান্টিক মুহূর্ত শুরু হয়েছে।”

লাবীব পুষ্পের দিকে তাকালো। সে নিজেই বুঝতে পারছে না হঠাৎ তাদের কি হলো। একটু পর রাদ আহিকে ছেড়ে দিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল,
“চল তোকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। আফিফকে আর দেখা যাচ্ছে না।”

আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“রাদ, ও এখানে কি করছে?”

রাদ গভীর ভাবনায় চলে গেছে। আহি আবার বলল,
“ওর তো অনেক আগেই বের হয়ে যাওয়ার কথা।”

রাদ অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
“হয়তো প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।”

আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“এভাবে বলিস না রাদ। আমি আর ও একই ডিপার্টমেন্টের। ও যদি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর হয়, তাহলে আমি কোথায় যাবো?”

রাদ আহির হাত নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলল,
“তুই একটু শক্ত হো। পৃথিবীটা গোল। একদিন না একদিন তোর আফিফের সামনে দাঁড়াতেই হতো। নিজেকে প্রস্তুত কর। ওর সামনে যাতে তোর দুর্বলতা প্রকাশ না পায়।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে