উজানের ঢেউ পর্ব-০৮

0
398

#উজানের_ঢেউ ( ৮)
কলমে #রেহানা_পুতুল
রাবু ঈষৎ হেসে বলল,
” আপা তোর বিয়ে। আব্বা ঠিক করেছে। আম্মাও রাজী। আমিও রাজী। নয়ন কে আমরা হিসেবে ধরিনা। রাজন তো ল্যাদা। তুই কি আব্বা আম্মার পছন্দকে ইগনোর করতে পারবি?সো বিয়ের সানাই বাজবেই। রাবু এবার নাচবেই। আগেতো পিচ্চি ছিলাম।কুদাকুদি করতে পারিনাই। এবার খেলা হবে।”

আমি বোকা বোকা স্তব্ধ চাহনিতে কেবল ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইলাম রাবুর দিকে।

জায়নামাজের বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। হাত লম্বা করে কষে এক চড় বসিয়ে দিলাম রাবুর বাম গালে। রাবু ভূত দেখার মতো চমকে গেলো অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটাতে। একহাত দিয়ে চড় খাওয়া গাল চেপে ধরলো। জলপূর্ণ টলমল চোখে চাইলো আমার পানে। নিরবে পা ঘুরিয়ে প্রস্থান নিলো আমার সম্মুখ হতে। ছোট বোনকে চড় মেরেছি। তা নিয়ে আমার মাঝে তেমন খারাপ লাগা কাজ করছেনা। বরং ক্রোধের দাবানলে জ্বলছি আমি। একশো চুল্লীর উত্তপ্ত অনলে জ্বলে পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাচ্ছে আমার অন্তরটা। কষ্টরা দলা পাকিয়ে আছে হৃদয়ের অন্তপুরে। চিনচিন ব্যথা করে উঠলো বুকের বাঁ পাশটা।

কথায় আছে ‘যাহা কিছু রটে কিছু না কিছু হলেও বটে।’ পারুল ভাবি বলল। রাবু বলল। তারমানে ব্যাপারটি আংশিক হলেও সত্যি। অভিমানী মনে ভিতর থেকে দরজা ভিড়িয়ে দিলাম। বিছানায় কাত হয়ে পড়লাম। সূক্ষ্ণভাবে চিন্তা করছি ও নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছি,

আমি কি বাবা মায়ের জীবনে বাড়তি বোঝা হয়ে গেলাম? আমাকে নিয়েই তাদের এত অশান্তি? আমার অনুমতির থোড়াই কেয়ার করে বাবা মা এত বড় সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে পারলো? কিভাবে? লাইফ আমার। ভালোটাও আমার। মন্দটাও আমার। তাহলে আমার মতামত এত গুরুত্বহীন হয় কিভাবে তাদের কাছে?

নিজেই আবার উত্তর মিলিয়ে নিলাম নিজের মতো করে। পরক্ষণেই ফের ভেবে উঠলাম, যত যাইহোক। আমার উপরে কারো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবেনা। এখনো ডিভোর্সই কার্যকর হয়নি। সেখানে কিসের বিয়ে? কার সাথে? বললেই হলো? আমি আগে স্বনির্ভর হবো। বলার মতো একটা পরিচয় তৈরি করবো। তার আগে অন্যকিছু আমার ভাবনায় আনতে রাজি নই আমি।

সন্ধ্যা বিদায় নিলো বহু আগেই। রাত বাড়ছে প্রকৃতির নিয়মে। পেটের ভিতরে ক্ষুধারা উৎপাত শুরু করে দিয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে। উঠে গেলাম ভাত খাওয়ার রুমে। হাত থেকে ভাতের প্লেট পড়ে গেলো। ঝনঝন আওয়াজ শুনে মা উঠে এলো।

বলল,
” আমি তোদের রুমের সামনে গেলাম। দেখলাম দরজা বন্ধ। তাই চলে এলাম। সে বাড়ির কি অবস্থা? ওই হারামি দেখছে তোকে? খাসনাই সেখানে কিছু?”

মায়ের সব জিজ্ঞাসার জবাব দিলাম অল্পবাক্যে চাপাস্বরে। মা বুঝে নিলো আমার মন খারাপ সেই বাড়ির পরিস্থিতির জন্যই। মা বলল,

” আচ্ছা ভাত খেয়ে নে। মন খারাপ করে কি আর হবে। কপালের লিখন যায়নাকো খন্ডন। এটা মুরুব্বিগণ বলছেন। সময় সব ঠিক করে দিবে। বাড়িতে আমাদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য আছে তেমন অর্থকড়ি না থাকলেও। তাই কেউ পিছনে কানাঘুঁষা করলেও আমাদের সামনে তেমন কিছুই বলার সাহস পায়না। নয়তো তেমন পরিবার হলে মানুষের কত টিপ্পনী শুনতে হতো। ”

মা চলে গেলো আমার সামনে থেকে। আমি ভাত খেয়ে উঠলাম। বিয়ের বিষয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পারিনি। কথাটা বারবার গলা অবধি এসে কাঁটার মতো আটকে গিয়েছে। কারণ এই ভেবে, মা যেহেতু নিজ থেকে বলেনি, আমি আগ বাড়িয়ে বলাটা ঠিক হবে না হয়তো।

ভাত খেয়ে উঠে নয়ন কে আমার রুমে ডাকলাম। নয়ন আমার আদরের একমাত্র আকাঙ্ক্ষিত ছোটভাই। এই কয়দিন সেই নয়নকে একবারও বুকে জড়িয়ে নিইনি।মমতার পরশ দিইনি। নিজের হাতে আগের মতো মুখে তুলে খাইয়ে দিইনি। নয়ন ও কেমন দূরে দূরে রয়েছে আমার থেকে। জীবনের উপর আকস্মিক আঘাত হানা পরিস্থিতিতে নিজের বিধ্বস্ত জীবনেরই বেহাল দশা। সেখানে ভাইয়ের দিকে ফিরে চাইবার জো ছিল না। নয়নের মাথায় ও পিঠে বোনের স্নেহমাখা পরশ দিতে লাগলাম। তার পড়াশোনার খবর নিলাম।

সবশেষে জিজ্ঞেস করলাম,

” রাবু বলল আমার বিয়ে। তুই কি এমন কিছু জানিস ভাই?”

নয়ন শুকনো মাটিতে হোঁচট খেলো যেনো। আমার চোখের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি ফেলল। অবুঝের মতো করে বলল,

” নাতো আপা। আমি এমন কিছুই জানিনা। আমি আর তুমি তো তোমার শ্বশুর বাড়িতেই ছিলাম সারাদিন।”

” তা ঠিক। তার আগে পরে এমন কিছু শুনেছিস ভাই?”

” আরেহ দূর। নাতো। আমি যাই। গেম খেলতেছি। তোমার জন্য আমি হেরে যাবো এখন।”

নয়নের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললাম,

” আচ্ছা যা। আর শোন, আমি যে একথা জিজ্ঞেস করছি তোকে। এটা কাউকেই বলবিনা। রাবুকেও না।”

নয়ন ঘাড় হেলে সম্মতি জানালো, আচ্ছা বলব না বলে।

আমি নানাভাবে বাবা মার কথোপকথন আড়িপেতে শোনার চেষ্টা করলাম। রাবুর বলা কথার সত্যতা যাচাই করতে। কিন্তু এমন কিছুই শুনলাম না। রাবুকে চড় মারলাম আমি। সে মায়ের কাছে সেটা নিয়ে নালিশ করল না আমার নামে। সব কেমন গোলমেলে লাগছে।

রাতে শুয়ে গেলাম রাজনকে ঘুম পাড়িয়ে। আমার মাথায় বর্তমানে কেবল একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে লাটিমের মতন। তা হলো আমার ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে। ফেসবুকে লগ ইন করলাম বহুদিন পর। আঞ্জুমানকে মেসেজ দিয়ে তার মোবাইল নাম্বার চাইলাম। নাম্বার পেয়ে রাতেই আঞ্জুমানকে ফোন দিলাম। মাঝরাত পর্যন্ত ওর সাথে কথা বললাম। সদ্য ঝড়ে তছনছ হওয়া জীবনের কাহিনী পুরোটাই বললাম পুরোনো ক্লাসফ্রেন্ডকে। লুকিয়ে লাভ কি। আজ নয় কাল সবাই জানবে। রত্না ডিভোর্সি। রত্না সিংগেল মাদার। আঞ্জুমান সব শুনে বিমূঢ় হয়ে গেলো।
আশ্বাস দিলো,

” আমি তোকে যেভাবে যা পারি হেল্প করব। গুঁড়িয়ে যাসনা দোস্ত। তুই নিজ থেকে তোর লাইফের সব বলাতে আমার ভীষণ ভালোলাগছে। অনেকে আছে,বলেনা। ভয় পায়। তুই সাহসী বরাবরই। স্যালুট তোকে।”

আমি বললাম,
” সত্য লুকানোর মতো ভীরু কাপুরুষ নয় এই রত্না।
“সত্যি অপ্রিয় হলেও সুন্দর। মিথ্যা প্রিয় হলেও কুৎসিত। সত্যের একটা নিজস্ব ক্ষমতা আছে। আলাদা সৌন্দর্য আছে। হোক না তা যতই করুণ। ”

আঞ্জুমানকে শুভরাত্রি জানিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। পরেরদিন সকালে বাবার সাথে দেখা করলাম দোকানে যাওয়ার আগে। মাও পাশে ছিলো।

” বাবা,আমি কি বিজনেস করবো ডিসাইড করছি।”

” খুব ভালো। তা কি করবি? ”

” বাবা রাতে আমার কলেজফ্রেন্ড আঞ্জুমানের সাথেও কথা বললাম। আমি পার্লার দিবো ঠিক করেছি। ”

” মন্দ নয় এটা। চৌরাস্তা শহরমুখী স্থান। চলবে ভালো সেন্টারমতে নিতে পারলে। তুই পারবি তো? টাকা পয়সার বিষয় কিন্তু মা?”

” ইনশাআল্লাহ পারব বাবা। অনার্সে পড়ার সময় শখ করে বিউটি পার্লারের কাজ শিখেছি না। এটাই আমার মন টানছে। এতে সিকিউরিটিও পাকাপোক্ত। লেডিস বিউটি পার্লারগুলোতে মেল পারসন নো এলাও। শুরুতে একজন বিউটিশিয়ান নিযুক্ত করবো। আঞ্জুমানের পরিচিত মেয়ে আছে নাকি। ও বলল। এছাড়া পাশাপাশি আমিতো বিউটিশিয়ানের কাজ জানিই। আর কি কি কিনতে হবে ডেকোরেশনের জন্য,তা ইউটিউব দেখে জেনে নিব। রাজনও আমার সঙ্গে থাকতে পারব। বাসার মতই হয় পার্লারগুলোর সিস্টেম। ”

” ঠিকাছে তুই প্রস্তুতি নে। এদিকে তিনমাস ঘনিয়ে আসছে। সেই টাকাগুলোও হাতে আসুক।”

” হুম। আমিতো এখনি বলছি না বাবা। রুম পেতেও তো সময় লাগবে। আঞ্জুমান রুম দেখবে আজ থেকেই। তুমিও খুঁজো। ”

” আচ্ছা। আমিও পরিচিত লোক লাগিয়ে দিবো মার্কেট প্লেসের পাশেই একটা রুম খোঁজার জন্য।”

বাবা চলে গেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক কি করবো সেটা ঠিক হয়ে গেলো। নয়তো অনেক নারীর বা মেয়েদের এই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয় বহুদিন। কিন্তু ভিতরে আবারও একটা ধাক্কা খেলাম। কই বাবাও তো বিয়ে নিয়ে কিছুই বলল না। তাহলে রাবু, পারুল ভাবি সিরিয়াস মুডে অমন কথাটা শুনালোই বা কেনো আমাকে।

কিন্তু সত্যি হলে তো মায়ের কাছে অভিযোগ দেয়ার কথা। এমন ভাবনায় আমার অনুভব, অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেলো। মস্তিষ্কে কোন কাজই করছে না। রাবু কলেজে চলে গেলো। আমার সাথে কথা বলেনা রাত থেকেই। মা খেয়াল করেনি। নয়তো জিজ্ঞেস করতো। ঠিক করলাম কলেজ থেকে বিকেলে আসুক রাবু। নিরিবিলি জিজ্ঞেস করবো বিষয়টা।

সেদিন অপরাহ্নের দিকে আমার মুঠোফোন বেজে উঠলো। অচেনা নাম্বার। হ্যালো বলে সালাম দিলাম,
ওপাশ থেকে নিরবতা ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা।

” কথা না বললে ফোন দেয়ার মানেটা কি? অভদ্র কোথাকার।”

হালকা মেজাজে বললাম।

” কারো কাছে সারাজীবন অভদ্র থাকতে চাই। সেই সুযোগটাওতো মুহূর্তের জন্যও পাইনি। কেবল বঞ্চিত করেই গেলো সে আমাকে।”

চকিতে বিষম খেলাম।
” মাহমুদ ভাই আপনি। চুপ করে ছিলেন কেনো?”

” মোবাইলে এই প্রথম তোর কন্ঠ শুনলাম। ভারী মিষ্টি! ভারী কোমল! যেনো সদ্য প্রষ্ফুটিত হওয়া রক্তগোলাপ। মাশাল্লাহ!”

আমি ইতস্তত বোধ করতে লাগলাম। মনে হলো মাহমুদ ভাই আমার লজ্জাবনত রাঙা অধরখানি দেখে মিটিমিটি হাসছে। ঠোঁট কামড়ে বললাম,

” কি বলবেন বলেন?”

” ভণিতা না করেই বলি। তোর সব আমি শুনেছি। তোকে নিয়ে আমার অনুভূতি একই কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। জনমভর তাই থাকবে। বিশ্বাস করানোর জন্য যে কোন শর্ত মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। ভাগিনা হিসেবে রাজনকে তো এমনিতেই অনেক স্নেহ করি। এখন তোদের মা ছেলের দায়িত্ব পেলে আমি নিজেকে সুখী মনে করবো। ”

আমি অতি আশ্চর্যন্বিত কন্ঠে বললাম,

” কি বলছেন এসব মাহমুদ ভাই? মাথা ঠিক আছে? নইলে হেমায়েতপুরে যান। ”

” প্লিজ পানকৌড়ি। একবার প্রসন্ন হও আমার প্রতি। পৃথিবীর সব পুরুষ এক নয়। যদি তাই হতো তাহলে তোর মা,আমার মা,কিভাবে যুগের পর যুগ একজন মানুষের ছায়ায় বেঁচে আছে? সুখে আছে?”

মাহমুদ ভাইয়ের এই কথার মমার্থ উদঘাটন করতে পারলাম সফলভাবেই। আসলেই তো তাই। জগতের সবাই যেমন ভালো নয়। তেমনি সবাই মন্দ ও নয়। তবুও দোনোমোনো শুরু করলাম।

” আমি এখন রাখছি মাহমুদ ভাই। ভালো লাগছে না ।”

” আচ্ছা সময় নে। আমি কাকার সাথে কথা বলব। মাকেও জানাবো। ”

” আমার সম্মতি ছাড়া?”

” হুমম তোর তোর সম্মতি ছাড়াই। ভালোবাসার মূল্য কেউ না দিলে জোর করে আদায় করে নিতে হয়। ন্যাড়া বেলতলায় একবারেই যায়। বারবার নয়।”

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ব্যক্তিত্বপূর্ণ কন্ঠে বলল মাহমুদ ভাই। এদিকে আমাকে প্রতিউত্তর দেয়ার সুযোগটুকুও দিলনা তিনি। চট করেই লাইন কেটে দিলো মোবাইলের।

আমি কেমন যেনো গোপনে শিহরিয়া উঠলাম। এই অনুভূতি আমার পরিচিত। অতি চেনা। বিয়ের পর রাজনের বাবার কথা শুনলে, স্পর্শ পেলে এমন হতো। তিরতির করে কাঁপতাম গাছের কচি শাখার ন্যায়। অবশ্য মাহমুদ ভাইয়ের কথা শুনেও দু একবার এমন হয়েছে। তখন ছিলো আমার বাড়ন্ত বয়স। দৃষ্টিজুড়ে যাই দেখতাম সবই ভালোলাগতো। কি মানুষ,কি ফুল,কি পাখি। সবই। দুরন্তপনায় মেতেছিলাম রাতদুপুর। থাক। সেসব রোমাঞ্চকর বেলা অবেলার কথা নাই বা বলি। নয়তো নষ্টালজিক হয়ে যাবো।

মুহূর্তেই নিজের মনকে ব্যস্ত রাখার জন্য নানা আয়োজন করি। যেনো মাহমুদ ভাইয়ের প্রস্তাবে টলে না যাই। অবাক করার বিষয় হলো মাহমুদ ভাইয়ের কথামতে, উনি এখনো কাউকে জানায়নি আমার কথা।

তাহলে রাবুর কথা সত্যি হলে, আমার বিয়ে কার সাথে ঠিক করলো বাবা, মা? কার সাথে?

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে