অনুভূতির মায়াজাল পর্ব – ০২

0
1706

#অনুভূতির মায়াজাল
#নাজমুন বৃষ্টি
#পর্ব-২

বাসায় ঢুকতেই নীলাদ্রির মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কেঁদে উঠল।
উনার কান্না দেখে নেহাল আহমেদ বিরক্তি-সূচক শব্দ করে ধমকে উঠল।

-‘আহঃ, রুবিনা! মেয়েটি সবেমাত্র ঘরে ঢুকলো আর তুমি তোমার প্যাচ প্যাচ শব্দ তুলে কেঁদেই যাচ্ছ।’

রুবিনা স্বামীর কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো।

-‘তুমি চুপ করো তো। তোমার কারণেই আজ আমার মেয়ের জীবনে কলঙ্কের দাগ লেগে গেল।’

নীলাদ্রি চুপচাপ রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। মা-বাবার এই খুনসুটি-গুলো আগে ভালো লাগলেও এখন আর ভালো লাগছে না।

তারা ঝগড়া থামিয়ে মেয়ের রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে রইল অপলক দৃষ্টিতে।

রুমে ঢুকেই নীলাদ্রি ওয়াশরুমের কল ছেড়ে দিয়ে ‘দ’-আকারে হাঁটুমুড়ে বসে পড়লো। মুখের উপর হাত চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার জীবনটা এমন কেন হলো! কী দোষ ছিল তার! সমাজে এখন তার উপর কলঙ্কের দাগ লেগে গেল! কেন তার জীবনটা এতো কষ্টের হলো! সে তো চেয়েছিল সবকিছু ভুলে আরিয়ানের সাথে আবারও পথ চলতে! কিন্তু মানুষটা এমন কেন করলো! একটুও কী ভালোবাসা যায় না নীলাদ্রিকে!নীলাদ্রি তো ভালোবেসেছিল!

——–

আরিয়ান বাড়ি ফিরেই দরজা খুলতেই একরকম নীরবতা আবছা অন্ধকার দেখে বুক চিনচিন করে উঠল। সবসময় বাড়িটা আলোতে ভরে ছিল। নীলাদ্রি সবসময় জানালার পর্দা সরিয়ে রাখতো। আর আজ সব বদ্ধ। আরিয়ান গিয়ে সব জানালা’গুলো খুলে পর্দা সরিয়ে দিতেই সম্পূর্ণ বাড়ি আগের মতো আলোয় ঝিলমিল করে উঠল।

আরিয়ান রুমে গিয়ে ফ্রেস হওয়ার উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে পা বাড়ালো। ওয়াশরুম থেকে চুল মুছতে মুছতে বের হতেই মুখ ফসকে বলে উঠল,

-‘নীলাদ্রি, সকালে আয়রন করতে দিছিলাম সেই কাপড়টা 🥰কই রেখে…’ বলতে বলতেই থেমে গেল আরিয়ান। তার যে মনেই নেই, নীলাদ্রিকে সে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। সে আর আসবে না।

আরিয়ান আলমারি খুলতেই দেখলো সকালে আয়রন করতে দিয়েছিলো সেই কাপড়টা সহ বাকি আরও সব কাপড়গুলো তাক তাক করে গুছিয়ে রাখা। কাপড়গুলো নিতে গিয়ে নীলাদ্রিকে একটু মনে পড়লো আরিয়ানের। হয়ত এতদিন বাসায় ছিল তাই নীলাদ্রিকে মনে পড়ছে। আর আরিয়ানের সবকিছু নীলাদ্রিই করতো তাই প্রথম প্রথম নিজে নিজে এসব করতে একটু আধটু মনে পড়ছে! সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে ভেবে নিজেকে বুঝালো আরিয়ান।

ফ্রেস হয়ে শুয়ে পড়লো আরিয়ান । ক্ষুদায় পেট চৌ চৌ করছে কিন্তু এই মুহূর্তে উঠতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। রিয়াকে একটা কল দিতে হবে। মেয়েটার সাথে আজ সারাদিন কথা বলতে পারেনি। হয়ত রেগে আছে!

———

রাতে নীলাদ্রি নিজেকে উপরে শক্ত করে পরিপাটি হয়ে মা-বাবার সাথে খাওয়ার উদ্দেশ্যে টেবিলে গিয়ে বসলো।
নেহাল আহমেদ কিছুক্ষন অপলক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি এটা বুঝতে পারছে না যে হঠাৎ মেয়েটা এতো গুছালো কিভাবে হয়ে গেল! যায় হোক, তিনিও মনে-প্রাণে এটাই চান যে তার মেয়ে যেন সামনে এগিয়ে যেতে পারে।

নেহাল আহমেদ তাড়াতাড়ি করে তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাক ছাড়লো,
-‘কই গো! খাবার আনো তাড়াতাড়ি। আমার মেয়ের জন্য তার পছন্দের খাবারটা তাড়াতাড়ি গরম করে আনো।’

-‘আনছি, একটু অপেক্ষা করো।’ রান্নাঘর থেকে নীলাদ্রির মায়ের প্রতিত্তর আসলো।

নীলাদ্রি চুপচাপ ভঙ্গিতে টেবিলে বসে আছে। সে মূলত স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। আরিয়ানের সাথে তার এসব হয়ত কপালে লেখা ছিল! কিন্তু বাবাকে হয়ত মনে মনে অপরাধবোধ ঘিরে ধরেছে। হাজার হলেও তিনি একজন বাবা হিসেবে মেয়ের ভালোই চাইবে কিন্তু এটা হয়ত কপালের লিখন তাই নীলাদ্রি যথেষ্ট পরিপাটি হয়ে থাকার চেষ্টা করছে যাতে করে বাবা-মা যেন কষ্ট না পায়।

মা খাবার আনতেই তিনি আগে নীলাদ্রির প্লেটে খাবার তুলে দিল। আজ তিনি তার মেয়ের পছন্দের ইলিশ মাছ ভাজা করেছে।

রুবিনা বেগম নীলাদ্রির প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে মাছের কাঁটা বেছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মেয়ের প্লেটে হাত রাখতেই নীলাদ্রি থামিয়ে দিল।

-‘থাক মা, এখন আমি মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারি।’ বলেই নীলাদ্রি নিজে নিজে মাছের কাঁটা বাছতে লাগল।

মেয়ের কথা শুনে নেহাল আহমেদ আর রুবিনা একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো। তাদের মনটা নিমিষের মধ্যে খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা আগে মাছ বেছে খেতে পারতো না। রুবিনা বেগমের মাছ বেছে দিতে হতো তারপর নীলাদ্রি খেত। বিয়ের পর আরিয়ানের সাথে প্রথম প্রথম একবার এসেছিল, তখনও মাছ বেছে দিতে হয়েছিল। এরপর আর আসা হয়নি।

রুবিনা বেগমকে নেহাল আহমেদ চোখ দিয়ে ইশারা করে খেতে বসতে বলল। সে মলিন শ্বাস ফেলে বিপরীত পাশে চেয়ার টেনে খেতে বসলো।

নীলাদ্রির খাওয়া শেষ হতেই উঠে যেতে গিয়ে বাবার ডাকে থেমে আবার বসে পড়ল।

-‘হ্যাঁ, বাবা।’

নেহাল আহমেদ মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। আফসোস, মেয়ের সাথে কথা বলতেও এখন তার অপরাধবোধ ঘিরে ধরছে।

-‘তোর কোথায় গিয়ে জানি পড়তে ইচ্ছে ছিল!’

-‘থাক, বাবা। বাদ দাও।’

-‘আমাদের একটামাত্র মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করবো না? তুই বল।’

নীলাদ্রি একটা শ্বাস ফেলে প্রতিত্তর করলো,

-‘একটামাত্র মেয়ের ইচ্ছেটাকে যদি আর এক বছর আগে প্রাধান্য দিতে তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না আর তোমারও মেয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে অপরাধবোধ জেগে উঠতো না বাবা।’

নীলাদ্রির কথা শুনে নেহাল আহমেদ মাথা নিচু করে ফেলল। তিনি মেয়ের প্রতিত্তর কী দিবে ভেবে পাচ্ছে না। রুবিনা বেগমও চুপ হয়ে রইল।
নীলাদ্রির হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিল, বাবা-মায়ের সাথে খেতে বসে উনাদের অপরাধবোধটা দূর করিয়ে দিয়ে বুঝাবে যে এটা নীলাদ্রির নিয়তি ছিল কিন্তু উল্টো তাদের মনটা আরও খারাপ করে দিল। কী দরকার ছিল এসব বলার! নীলাদ্রি কিছুক্ষন চুপ থেকে বেশি উঠল,

-‘ক্যালিফোর্ণিয়া কিন্তু এখন আর যাবো না বাবা। তুমি পারলে এইখানে আশেপাশে কোথাও ভর্তি করিয়ে দাও।’

নেহাল আহমেদ মাথা তুলে বললেন,

-‘আমাদের মাফ করে দিস মা। আমি বুঝতে পারিনি, এর শেষ এতটা খারাপ হবে! ভেবেছিলাম, আসাদের মতো তার ছেলেও ভালো হবে আর ছেলে শিক্ষিত তাই তোকে ভালো রাখবে। কিন্তু বুঝতে পারিনি। আমরা চায়, তুই এখানে না থেকে বাইরে গিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছেটা তুই পূরণ কর।’

-‘এসব আর বলিও না বাবা। হয়ত আমার কপালে এটাই লেখা ছিল। তুমি আমাকে এই শহরের বাইরে কোথাও পড়াশোনার ব্যবস্থা করো, আমি হোস্টেলে থেকে পড়বো। তোমাদের মেয়ে এতটাই নরম নয় বাবা। আমি ঘুরে দাঁড়াবো। চিন্তা করিও না। আমি পারবো।’

-‘আচ্ছা, তুই রুমে গিয়ে শুয়ে পড় মা।’

নেহাল আহমেদের প্রতিত্তর পেয়ে নীলাদ্রি মাথা নেড়ে হেসে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

-‘কী দরকার ছিল তোমার এসব বলার! মেয়েকে এতো দূরে কেন পাঠাচ্ছ নীলাদ্রির বাবা! পড়তে তো এখানেও পারবে! কী দরকার আমার মেয়েটাকে আবার অতোদূরে পাঠানোর!” রুবিনা বেগম নীলাদ্রির যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে উঠল।

-‘বাইরে গিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা নীলাদ্রির অনেক আগে থেকেই ছিল, বলা যায় ছোটবেলা থেকেই এই ইচ্ছেটা কিন্তু মাঝখানে আমার দোষে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ও এখন অতোদূরে আর যাবে না। তাই এই শহরের বাইরে অন্য কোথাও ওকে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিবো। আর তুমি বুঝছো না, এই সমাজে থেকে আমার মেয়ে মানসিক ভাবে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সমাজে একজন মেয়ে একবছরের মধ্যে ডিভোর্সি মানে হচ্ছে মেয়েটাই খারাপ অথচ ছেলের হাজার দোষ দেখলেও কেউ এসব বলবে না। উল্টো মেয়েটা ভালোমতো চলতে গেলেই সবাই হেনস্থা করে। আমরা তো আর সবসময় ওর পাশে থাকতে পারবো না যে মানুষের জবাব দিতে! আমি চায় না, আমার মেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে রাস্তা-ঘাটে এসব বাধা আমার মেয়েকে আটকাক! তাই সব ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার।’

নেহাল আহমেদের কথায় রুবিনা বেগম চুপ হয়ে মলিন শ্বাস ফেলল। হয়ত সেও বুঝতে পেরেছে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে