অনুভূতির মায়াজাল পর্ব – ০৭

0
1531

#অনুভূতির মায়াজাল
#নাজমুন বৃষ্টি
#পর্ব-৭

নীলাদ্রির কথা শুনে মাহতিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে জানে না, নীলাদ্রিকে এই মুহূর্তে কীভাবে সহানুভূতি জানাবে!

নীলাদ্রি কথা কাটিয়ে বলে উঠল,

-‘আপনিই তাহলে স্যারের ছেলে! বিয়ে করছেন না কেন! বাবাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ! শুধু শুধু যাকে পাবেন না তার জন্য অনুভূতি সব ঢেলে দিয়ে বাবাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ! উনার কী দোষ!’

-‘একজনের জন্য অনুভূতিটা লিখে দিয়েছিলাম অনেক আগেই। ভেবেছিলাম, দূরে গিয়ে ভুলতে পারবো কিন্তু আমার ধারণা ভুল! তাকে কী ভুলা যায়!’

মাহতিমের কথার উত্তর নীলাদ্রি কী দিবে ভেবে পাচ্ছে না, সে চুপ রইল। মাহতিম নীলাদ্রির দিকে এক ফলক তাকিয়ে বলে উঠল,

-‘অতীতটা ভুলে স্থানটা কী আর কাউকে দেওয়া যায় না, নীলাদ্রিতা?’

-‘দয়া দেখাচ্ছেন! আমি আর আগের নীলাদ্রিতা নই’ বলেই নীলাদ্রি উঠে চলে আসল। পেছনে রেখে গেল এক জোড়া সিক্ত চিকচিক আঁখি।

———–

দুইদিন পর লোকমান সাহেবকে দেখতে নেহাল আহমেদ আর রুবিনা বেগম এলেন। নীলাদ্রিকে কাজ দেওয়ার পর থেকে লোকমান সাহেবের সাথে নেহাল আহমেদের ফোনালাপ হয়। সেই সূত্রেই এই দুইবছরে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। মাহতিম আসার পর নীলাদ্রি আর তেমন আসে না। লোকমান সাহেবকে মাহতিম দুইদিনের মাথায় বাসায় নিয়ে আসে। তিনিও আর হাসপাতালে থাকতে চান না। নীলাদ্রি বাবা-মাকে লোকমান সাহেবের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজে ক্লাসে চলে গেল। সামনে পরীক্ষা, ভালোমতো পড়তে হবে।

লোকমান সাহেবের ব্যবসা এখন মাহতিম দেখাশোনা করে। সেও কথা দিয়েছে, বাবাকে ছেড়ে আর যাবে না। বাবা যেটা বলে সেটাই সে মাথা পেতে গ্রহণ করে নিবে।

নেহাল আহমেদ আর রুবিনা বেগম লোকমান সাহেবকে দেখতে আসায় তিনি তাদেরকে একটা কথা দিয়ে ফেললেন। তিনি বললেন, তার একমাত্র ছেলের সাথে নীলাদ্রিকে বিয়ে দিবেন।

নেহাল আহমেদ বলে উঠলেন, আমার মেয়ের অতীত হয়ত আপনি জানেন না ভাই সাব তাই হয়ত এরূপ অনুরোধ করছেন।

নেহাল আহমেদের কথা শুনে লোকমান সাহেব হাসলেন,
-‘আমি সব জানি। আর আমি এই দুইবছরে আপনার মেয়েকে দেখে আসছি। নীলাদ্রি আমারই মেয়ের মতো। তার মধ্যে খারাপ কিছু আমি দেখিনি। আমি এও দেখছি, সে কতটা কষ্ট করে স্ট্রাগল করেছে। আমি প্রথম দিনেই ভেবে নিয়েছি, নীলাদ্রিকে আমার ছেলের বউ করবো কিন্ত আমি জানতাম, নীলাদ্রি তখন রাজি হতো না কারণ সবে মাত্র সে একটা দাগ থেকে উঠে এসেছে। আর সে একজন ডিভোর্সি, সেটা আমি না বললেও সে নিজেই আগ-বাড়িয়ে বলে দিতো। সে সফল হয়েই রাজি হতো তাইই এখন বলছি। ওই ছেলেটা আসল হীরেকে চিনতে ভুল করেছে। আমি নীলাদ্রির ব্যাপারে সব জেনেই প্রস্তাবটা দিচ্ছি।’

নেহাল আহমেদ স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, আস্তে ধীরে নীলাদ্রির কাছ থেকে উত্তর জেনে বলবেন। এরপরই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

মাহতিম বাসায় ফিরতেই লোকমান সাহেব মাহতিমের বিয়ের ব্যাপারে কথা তুললেন। মাহতিম রাজি হতে না চাইলে তিনি বলে উঠলেন,

-‘আমি আর কয়দিনই বা বাঁচবো, বাবা! তোর কাছে বাবা হিসেবে আর কোনোদিন কিছু চাইবো না, আমি মেয়ে দেখে রেখেছি।’

বিয়ের কথা বলতেই মাহতিমের চোখে নীলাদ্রির চেহারাটা ভেসে উঠল। যেটার জন্য এতদিন বাবার কাছ থেকে দূরে ছিল, সেটাই শেষপর্যন্ত করতে হবে। অন্তত বাবার কথা রাখার জন্য হলেও। কিন্তু মাহতিম কী ভুলতে পারবে নীলাদ্রিকে! মেয়েটা চোখের আড়ালে ছিল তাও একটু ভুলতে পেরেছিল। যার জন্য দেশ ছেড়ে থেকেছে, দেশে আসতেই তাকেই পেল আবার অন্যরূপে। পাঁচবছর আগে যে স্থানটা একজনকে দিয়ে দিয়েছে, কিভাবে সেই স্থানে অন্য কাওকে বসাবে মাহতিম!

-‘আমি তোমাকে রাতে জানাবো, বাবা।’ বলেই মাহতিম বাবার রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

লোকমান সাহেব ছেলের কথা শুনে হাসলো। রাতে জানাবে মানে বিয়েতে রাজি হবে। তিনি জানতেন, তার ছেলে তার কথা রাখবে।

———–
রাতে খেয়ে পড়াশোনা শেষ করে শাড়ি নিয়ে বসলো নীলাদ্রি। এমন সময়, নেহাল আহমেদের কল পেয়ে, মোবাইলটি কানের পাশে ধরে সে সেলাইয়ের কাজে লেগে পড়লো।

-‘হ্যাঁ, বাবা!তোমরা পৌঁছে গিয়েছো?’

নেহাল আহমেদ জবাব দিলেন, তারা অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছে। নেহাল আহমেদকে আজ মোবাইল রাখতে না দেখে নীলাদ্রি ভ্রু কুঁচকালো,

-‘বাবা? তুমি কী কিছু বলতে চাচ্ছ? বলো?’

-‘আসলে,,,!’

নেহাল আহমেদকে আমতা আমতা করতে দেখে নীলাদ্রি হেসে বাবাকে আস্বস্ত করলো, বলার জন্য।
নীলাদ্রির হাসি শুনে নেহাল আহমেদ কথা বলার জোর পেলেন।

-‘আচ্ছা, কাল বলবো। এখন শুয়ে পড়। এতো রাত জাগিস না!’ বলেই তিনি তড়িঘড়ি করে মোবাইল রেখে দিলেন। কেন জানি, নীলাদ্রির ডিভোর্সের পর নেহাল আহমেদের সাথে মেয়ের কোথায় জানি একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরী হয়েছে! বিয়ের কথা বলতে গেলেই আগের ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। মেয়ের সাথে ভারী অন্যায় করে ফেলেছেন!

———

পরদিন সকালে উঠেই নীলাদ্রি ভাবলো, লোকমান সাহেবকে দেখে আসা উচিত। অনেকদিন দেখা হয় না,এখন হয়ত মাহতিম অফিসেই থাকবে তাই দেখা করতে পারবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। নীলাদ্রি চটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লো লোকমান সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

নীলাদ্রি লোকমান সাহেবের বাড়ি গিয়ে পৌঁছাতেই তিনি এতদিন পর নীলাদ্রিকে কাছে পেয়ে সব গল্পঃ একসাথে জুড়িয়ে দিলেন। নীলাদ্রি তা দেখে হাসলো। তিনি কথায় কথায় নীলাদ্রিকে মাহতিমের বিয়েতে রাজি হওয়ার ব্যাপারটা উৎফুল্ল হয়ে বলে দিলেন কিন্তু মেয়ে কে, সেই বিষয়টা চেপে গেলেন। নীলাদ্রি মাহতিমের বিয়েতে রাজি হওয়া শুনে কিছুসময় স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। কেন! এমন লাগছে তার! হয়ত অনেক বছর আগের অনুভূতিটা আবার তাজা হয়ে উঠছে!

লোকমান সাহেব খেয়াল করলেন, নীলাদ্রির মুখ পাংসুটে আঁকার ধারণ করেছে। তিনি মুচকি হাসলেন! তিনি ছেলে আসার পর পরই বুঝতে পারলেন হয়ত নীলাদ্রি-মাহতিম একজন আরেকজনকে আগে থেকেই চিনে। তাই এ পরিকল্পনা করেছেন।

নীলাদ্রি লোকমান সাহেবকে বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। এই তাহলে মাহতিমের ভালোবাসা! দুইদিন না যেতেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেল! নীলাদ্রি সোজা লোকমান সাহেবের অফিসে চলে গেল। এখন অফিসে আর লোকমান সাহেব আসেন না। মাহতিমই সব দেখাশোনা করে।

নীলাদ্রি ওয়েটিং রুমে বসে মাহতিমের অপেক্ষা করছে। মাহতিম গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ আছে তাই ডাকতেও পারছে না।

কিছুক্ষন পর নীলাদ্রির ডাক এলো, স্যার এসেছে। নীলাদ্রি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এরপর ক্যাবিনে ঢুকে বসতেই মাহতিম টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বসতেই তার সামনে বসা নীলাদ্রির দিকে দৃষ্টি যেতেই থমকে গেল। সেদিনের পর নীলাদ্রি আর মাহতিমের সামনে আসেনি। আজ আবার কতদিন পর দেখছে মেয়েটাকে!

নীলাদ্রি মাহতিমের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালো। পরনে সাদা রঙা শার্ট। এই রঙের শার্টটা মাহতিমের স্নিগ্ধ রূপটা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কপালের উপরে সিল্কি চুলগুলো লুটোপুটি খাচ্ছে,গালে খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়িগুলো ফর্সা চেহারার সাথে যেন একদম খাপে খাপ। সব মিলিয়ে মাহতিমকে আজ কেন জানি একদম সুদর্শন পুরুষ বলে মনে হচ্ছে। এতো বছর মাহতিমকে একবারও মনোযোগ দিয়ে দেখেনি নীলাদ্রি, আজ কী হয়েছে সে জানে না!

মাহতিম গলা খাঁখারি দিয়ে বলে উঠল,

-‘কী খাবে?’

নীলাদ্রি ‘কিছু না’ বলে চুপচাপ বসে রইল। এতক্ষন মনে মনে অনেক কিছু সাজিয়ে এসেছিল কিন্তু এখন কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না।

নীলাদ্রি কোনো ভনিতা ছাড়া মাহতিমের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-‘শুনছি, বিয়ে করছেন!’

-‘হ্যাঁ।’ মাহতিমের সহজ উত্তর।

নীলাদ্রি নিরাশ হলো।

-‘ওহ, শুভকামনা রইল।’ বলেই নীলাদ্রি চলে আসতে পা বাড়াতে নিলেই মাহতিমের কথায় থেমে গেল।

-‘একজনের জন্য অনুভূতিটা খোদায় করে দিয়েছিলাম। কেউ একজন বলেছিল, দয়া না দেখাতে। তাই রাজি হয়েছি।’

-‘আপনার সাথে আমার মিল হলেও মানুষ কথা বলতে পিছ পা হবে না। আমি ডিভোর্সি, এই কথাটা সবার উপরে থাকবে। আমি চায় না, আমার কারণে আপনি কথা শুনুন। আমি বড়ো হতে চায়।’

-‘তবে তাই হোক। তুমি বড়ো হও। তখনই না হয় আমাদের মিল হবে!’ বলতেই নীলাদ্রি পেছনে মাহতিমের দিকে তাকাতেই মাহতিম তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। নীলাদ্রিও মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল ক্যাবিন ছেড়ে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে