অনুভূতির অন্তরালে পর্ব-১০

0
2512

#অনুভূতির_অন্তরালে
#পর্ব:১০
#Devjani

কলেজে ঢুকতেই বিরক্ত হয়ে যায় আরাদ্ধা। গতকাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় ভেজা মাটি খেয়াল করেনি।কাদায় পা মাখামাখি হয়ে গেছে। অদ্রিকে ডাকতে যাচ্ছিল।আজ ভীষণ খুশি লাগছে তার।মাথা হালকা।টেনশন মুক্ত। গতকাল শ্রেয়ান তাকে অনলাইনের মাধ্যমে সব পড়া বুঝিয়ে দিয়েছে।খুশির চোটে কাদা খেয়াল করেনি।যার ফলস্বরূপ কাদাযুক্ত পা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে।



ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সামনে এগোতেই শ্রেয়ান এসে জরিয়ে ধরে আরাদ্ধাকে।আরাদ্ধাকে চমকে উঠে।শ্রেয়ানকে ধাক্কা দিতে থাকে সরানোর জন্য। হঠাৎ খেয়াল করে কাঁধের দিকে জামাটা হালকা ভিজে গেছে।শ্রেয়ান কাঁদছে। কিন্তু কেন?আরাদ্ধা ধাক্কা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কাঁধে হালকা হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,আপনি কাঁদছেন কেন ভাইয়া?

শ্রেয়ান মুখ তুলে বলে, থাপ্পড় দিব আপনি করে বলবি তো! কেন চলে গিয়েছিলি আমাকে ছেড়ে। জানিস তোকে ছাড়া থাকতে কতো কষ্ট হয়েছিল।

আরাদ্ধা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় শ্রেয়ানের দিকে।শ্রেয়ানের হাতে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট।আরাদ্ধা শ্রেয়ানের কাছ থেকে রিপোর্টটা নিয়ে দেখা শুরু করে।
আরাদ্ধার হাত থরথর করে কাঁপছে।তার আর শ্রেয়ানের ডিএনএ মিলেছে।তার মানে সে আর শ্রেয়ান ভাইবোন।এটাও কি সম্ভব!আরাদ্ধা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায় শ্রেয়ানের দিকে। স্বপ্ন দেখছে। হ্যাঁ স্বপ্নই!আরাদ্ধা হাত উঁচিয়ে শ্রেয়ানের চোখে হাত রাখে।একি! চোখে তো পানি।যা হচ্ছে সত্যি তো!আরাদ্ধা শ্রেয়ানের চোখের পানিগুলো মুছে দেয়।

আরাদ্ধা অবিশ্বাসের সাথে বলে, বিশ্বাস করি না।এমনও হয় নাকি!

শ্রেয়ান শার্টের হাতায় চোখের পানি মুছে আরাদ্ধার হাত ধরে বলে,হয়না কেন?হয়েছে তো!

শ্রেয়ান আরাদ্ধার সামনে একটা ছবি ধরে।একটা বাচ্চা ছেলে হাসিমুখে একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়েছে।হয়ত ওজন সামলাতে পারছিল না।পাশ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ধরে রেখেছে যাতে পরে না যায়।

শ্রেয়ান মুখে হাসি টেনে বলে আমি,তুই আর আম্মু।ওই শ্রেয়াটাকে এই ছবিতে ঢুকতে দেইনি।ছবি তোলার সময় বেশি নড়াচড়া করে। সেজন্য ছবি নষ্ট হয়ে যায়।

আরাদ্ধা ছবিটা হাতে নেয়। সত্যিই ছবির বাচ্চা মেয়েটা সে। দুদিন আগেও রোদ্দুরের কাছে দেখেছে ছবিটা।তবে রোদ্দুরের কাছে ছবিটার তুলনায় এই ছবিতে সে অনেক ছোট।

আরাদ্ধা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,এটা আমি!

শ্রেয়ান হেসে বলে, হুম।কি কিউট!

আরাদ্ধা ছবিটা হাতে নিয়ে বলে,যদি তুমি আমার ভাই হও তো এখানের এই ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই আমার মা হবে তাই না? কোথায় উনি?আমি দেখবো!
আরাদ্ধার দু চোখে পানি টলমল করছে।

শ্রেয়ানের মুখটা হুট করে কালো হয়ে যায়।ধীর কন্ঠে বলে,তুই দেখবি ওনাকে?

— হ্যাঁ,দেখবো!

শ্রেয়ান আরাদ্ধার হাত ধরে গাড়ির সামনে যায়।দরজা খুলে দিয়ে বলে, গিয়ে বোস।নিয়ে যাচ্ছি তোকে ওনার কাছে।

আরাদ্ধা গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখে রোদ্দুর ওর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আরাদ্ধা দেখেও না দেখার ভান করে গাড়ীতে উঠে বসে।

☆☆☆

শ্রেয়ান একটা বড় এ্যাপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামায়।চারতলা এ্যাপার্টমেন্টটা।আরাদ্ধার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামায়। তিনতলায় গিয়ে কলিংবেল চাপতেই শ্রেয়া দরজা খুলে দেয়।
শ্রেয়ান শ্রেয়ার হাত ধরে বলতে লাগে,শ্রেয়া ও আরাদ্ধা।মানে আমাদের মোহন। আম্মুকে নিয়ে আয়।বল আম্মুর মোহ ফিরে এসেছে।

শ্রেয়া অবাক দৃষ্টিতে আরাদ্ধার দিকে তাকায়।হালকা মাথা নেড়ে ভিতরের রুমে চলে যায়।আরাদ্ধা অবাক হয়।শ্রেয়া তার বড় বোন। কিন্তু তাকে দেখে এভাবে চলে গেল কেন? অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ফিরে পাওয়ায় কি সে খুশি হয়নি?
শ্রেয়া গিয়ে আবার ফিরে আসে। মৃদু কন্ঠে বলে, আম্মু ঘুমাচ্ছে!মোহন তুই আমার সাথে চল।
আরাদ্ধা মাথা নাড়ে। শ্রেয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।শ্রেয়ার আরাদ্ধার হাত ধরে একটা ঘরে যায়।

রুমে ঢুকতেই আরাদ্ধার বুক ধক করে উঠে। বিছানার উপর একজন বয়স্ক মহিলা শুয়ে আছে।আরাদ্ধা সামনে গিয়ে মাথায় হাত রাখে।
পেছন থেকে শ্রেয়ান বলে, আম্মুর প্যারালাইসিস হয়েছে। আব্বু মারা গেছে তিন বছর আগে।

আরাদ্ধা ছোট ছোট চোখ করে মায়ের দিকে তাকায়।হুট করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। ভাবতেই অবাক লাগছে এটা তার আসল মা।যে তাকে জন্ম দিয়েছে।এবার আর কেউ তাকে এডোপ্টেড চাইল্ড বলতে পারবে না। রোদ্দুর তাকে বকতে পারবে না। সবাইকে বলবে,তার একটা পরিবার আছে।আর সবচেয়ে বড় কথা হলো দাদির কথাগুলো শুনতে হবে না।আর থাকবে না ওখানে।এবার তার দাদি থাকুক তার নিজের বাসা নিয়ে।সে তো থাকবে এখানে!তার নিজের বাসায়!

☆☆☆

শ্রেয়ানকে নিয়ে বাসায় ঢুকতেই দেখে দাদি সোফায় বসে পান খাচ্ছে।আরাদ্ধাকে দেখেই রুক্ষ কন্ঠে বলে,আজ এতো তাড়াতাড়ি! ব্যাপার কি? পাশের এই ছেলেটা কে?আমার অনুমতি ছাড়া একে বাসায় ঢুকালি কোন সাহসে?

আরাদ্ধা দাদির কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। সোজা গিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। মৃদু গলায় মাকে ডাকে।

কিচেনে কাজ করছিল তার মা।ডাক শুনেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে। অজানা ভয়ে বুক ধড়ফড় করছে তার।আরাদ্ধার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে। মমতা ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,কি হয়েছে তোর? চোখেমুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন?আর আজ এতো তাড়াতাড়ি এসে পড়লি যে!

আরাদ্ধা পানিতে টলমল চোখগুলো মুছে মাকে জড়িয়ে ধরে।শব্দ করে কেঁদে দেয়।বলে, আম্মু আমি পেয়ে গেছি। তাদের পেয়ে গেছি।জানো আম্মু আমি আমি মাকে ছুঁয়েছি।আসল মা।আসল ভাইয়া আর আপু!

আরাদ্ধা মা বুক ধক করে উঠে।।আরাদ্ধা কি পাওয়ার কথা বলছে?কি পেয়েছে?আসল মা,ভাই বোন মানে?দরজার ধারে শ্রেয়ানকে দেখে চোখে পানি চলে আসে।শ্রেয়ানের মুখটা একটু হলেও আরাদ্ধার সাথে মিল আছে।
জিজ্ঞেস করে,আরু মা কি বলছিস এসব?

আরাদ্ধা কান্নার মাঝেও এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে বলে, আম্মু ও শ্রেয়ান!আমার ভাইয়া।জানো আমাদের ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছে।

আরাদ্ধার মা অবাক হয়ে বলে,তুই ডিএনএ টেস্ট করেছিস? কোথায় আমি তো জানি না!

— সরি মা তোমাদের বলা হয়নি।

আরাদ্ধার মা হঠাৎ ধমক দিয়ে বলে, থাপ্পড় দিব বেয়াদব মেয়ে!বেশি সাহস বেড়ে গেছে তোর।আমাকে না জানিয়ে এসব করার সাহস হয় কি করে তোর।কোথা থেকে একটা ছেলে এসে বলল তোর ভাই ওমনে মেনে নিলি। ডিএনএ টেস্টে তো ভুলও আসতে পারে।যা রুমে যা।এসব ফালতু ব্যাপারে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। সামনে পরীক্ষা!

আরাদ্ধা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের কথা তার বোধগম্য হয়নি।

শ্রেয়ান এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার আরাদ্ধার মায়ের কাছে এসে বলে,আপনি মা। মোহিনীকে এতদিন ধরে মা হিসেবে বড় করেছেন।আপনার কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ডিএনএ টেস্ট ছাড়াও আমি যে ওর ভাই বা ওর সাথে আমার সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা নিশ্চয়ই আমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু ওকে হারানোর ভয়ে এসব কথা বলছেন। কিন্তু ভয় পাবেন না। মোহিনীকে কেউ কেড়ে নিচ্ছে না আপনার থেকে।ও এখানে আসবে।আর আপনিও যাবেন।

আরাদ্ধার মা এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়।শ্রেয়ানের সামনে হাত জোর করে বলে,তোমার কাছে হাত জোর করছি বাবা তুমি আমার আরুকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও না। প্রয়োজনে তুমি এসে ওর সাথে এখান থেকে দেখা করে যেও।

আরাদ্ধা মায়ের কাছে গিয়ে হাত নামিয়ে দিয়ে বলে, আম্মু আমি স্বেচ্ছায় যাচ্ছি।যেখানে থাকার মতো পরিবেশ নেই সেখানে থাকার কোনো মানে নেই।কথাটা বলে আড় চোখে দাদির দিকে তাকায়।নিরব দর্শক হয়ে এসব কান্ড দেখে যাচ্ছে।

আরাদ্ধার কথার মানে বুঝতে পেরে দাদি রেগে গিয়ে বলে, মেয়ে কি অকৃতজ্ঞ।আপনজন পেয়ে আমাদেরকে ইঙ্গিতে কথা শোনাচ্ছে।সব বুঝি আমি।

আরাদ্ধা হালকা মলিন হেসে বলে,তার মানে তুমি বলতে চাইছো তোমরা আমার আপনজন ছিলে না। আশ্রয় দিয়েছিলে।ভালো!চলে যাচ্ছি। আশ্রয় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

দাদি মুখ বেঁকিয়ে বলে, মেয়ের দেমাগ দেখে আমি অবাক!

আরাদ্ধা হাসে।মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আম্মু আব্বু লন্ডন থেকে ফিরলে দেখা করে যাব।আসি।
— মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস? করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরাদ্ধাকে প্রশ্ন করে তার মা।

আরাদ্ধা জড়িয়ে ধরে বলে, যাচ্ছি না তো।তোমার কাছেই আছি।আমি আসবো তো তোমার কাছে।আজ আসি।

শ্রেয়ান আরাদ্ধার হাত ধরে আরাদ্ধার মাকে বিদায় দিয়ে নিচে চলে আসে।আরাদ্ধা শ্রেয়ানের গাড়ির সামনে যেতেই হাতে টান পড়ে। পেছনে তাকিয়ে দেখে রোদ্দুর ওর হাত ধরে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আরাদ্ধা জিজ্ঞেস করে,রেগে আছেন মনে হচ্ছে!কি হয়েছে?
রোদ্দুর আরাদ্ধার হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে, কিছু বলছি না বলে বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।শ্রেয়ানের সাথে এতো,,,,,,

আরাদ্ধা থামিয়ে দিয়ে বলে, উনি আমার ভাইয়া হন।আসল ভাইয়া।হাত ছাড়ুন। মানুষ দেখলে খারাপ বলবে।কথাটা বলেই রোদ্দুরের কাছ থেকে হাত টান দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়।
একপলক দেখে শ্রেয়ানের গাড়িতে উঠে বসে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে