অতঃপর দুজনে একা পর্ব-১৭

0
1214

#অতঃপর দুজনে একা – [১৭]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

—————————–
দিনটা সোমবার। আয়ন্তি প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত। অসময়ের বৃষ্টিতে ভেঁজার ফল এই জ্বর। আজ আয়ন্তির ভার্সিটি যাওয়া হয়নি। আয়ন্তির জন্যে নীলাও ভার্সিটি যায়নি। আয়ন্তি বিছানায় পরে আছে আর দব কাজ নীলা করছে। আয়ন্তির খেয়াল রাখার পাশাপাশি রান্না করা একদম সম্ভব না। তাইতো নীলা আয়েশাকে খাবার বানিয়ে পাঠাতে বললো। নীলাদের অপর রুমে র মেয়ে দু’জন ভার্সিটিতে। হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। নীলা ছিলো তখন রান্নাঘরে। উঁকি দিয়ে দরজার দিকে তাকালো সে। নীলা ভ্রু কুচকে বলে,
–“খাবার তো এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না। এছাড়া আমি তো চাচীকে বলে দিয়েছি ড্রাইভার আসলে যেন কল দেয়। মাস্ট ড্রাইভার আসবে না। তাহলে এই অসময়ে কে এলো?”
কিছু সময়ের মধ্যে আবারও কলিংবেল বেজে ওঠে। নীলা উপায়ন্তর না পেয়ে দরজা খুলতে চলে যায়। দরজা খুলতেই নীলা অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়। দুটো ছেলে, মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলা ভ্রু কুচকালো৷ দুজনের মধ্যে বিদেশী একটা ভাব আছে। বেশ মর্ডানও দেখাচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে নীলা দু’জনের একজনকেও চিনে না। ছেলেটা তো নীলাকে প্রথম দেখায় একদম গিলে ফেলে অবস্থা। নীলা পিটপিট করে তাকিয়ে বলে,
–“কী চাই? কাকে চাই?”
–“তোমাকে চাই। আসবে?”

নীলা যেন আকাশ থেকে পরলো৷ কোটর থেকে চোখ জোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম। মেয়েটি ছেলের কাঁধে এক চ’ ড় মেরে বলে,
–“আবারও ফ্লার্ট শুরু করেছিস? ভাই জানলে আস্ত রাখবে না তোকে।”
–“শাট আপ! ফ্লার্ট কই করলাম? জাস্ট কিডিং!”

নীলা বেকুবের মতো দু’জনের দিকে তাকালো। মেয়েটি ছেলেটিকে চোখ রাঙানি দিয়ে নীলার উদ্দেশ্যে বলে,
–“সো সরি। আমার ভাইয়ের কথায় মাইন্ড করবেন না প্লিজ।”
–“ইট’স ওকে। এবার দয়া করে পরিচয়টা দিন।”
–“বাহ। পরিচয় জানার এতই ইচ্ছে?”

নীলা এবার চোখ রাঙালো রিহাবকে। রিহাব এতে হাসলো। হাসি বজায় রেখে বলে,
–“সো সুইট।”

শায়লা এবার না পেরে রিহাবের পায়ে হিল দিয়ে চেপে দিলো। রিহাব চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। শায়লা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে,
–“আমি শায়লা আর ও হচ্ছে রিহাব। ব্রাদার কোথায়?”
–“সরি, ব্রাদারটা কে?”

ঠিক তখনই মাহবিন তার ফ্ল্যাট থেকে বের হলো। তিনজনই মাহবিনের দিকে তাকালো। মাহবিন রিহাব এবং শায়লাকে দেখে কিছুটা চমকালো। শায়লা একবার নীলার দিকে তো একবার মাহবিনের দিকে তাকাচ্ছে। বুঝতে আর সমস্যা হলো না যে তাঁরা ভুল জায়গায় চলে এসেছে। নইজের ভুল বুঝতে পেরে আড়ালে শায়লা ছোট করে নিজ জিহবায় কা’ মড় দিলো। অতঃপর নীলার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“এক্সট্রেমলি সরি। একচুয়ালি আমাদের বুঝতে সমস্যা হয়েছিলো আমাদের ভাইয়ের ফ্ল্যাট খুঁজতে। এনিওয়ে, নাইস টু মিট ইউ।”
–“ধুর! কিসের জন্যে সরি বলছিস? ভালোই হলো, ভুল করে হলেও সুন্দরীর দেখা পেয়ে গেলাম।”
–“আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন।”
–“নাহ, আমি আরও লাইন বানাচ্ছি।”

নীলা কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রিহাবের পানে। শায়লা কপট রেগে রিহাবকে ধমকালো,
–“রিহাব!”

শায়লা টেনে-হিঁচড়ে রিহাবকে মাহবিনের কাছে নিয়ে এলো। মাহবিন একপলক নীলার দিকে তাকিয়ে ভাই-বোনকে ভেতরে নিয়ে গেলো। মুখ-ভঙ্গি ছিলো তার বরাবরের মতোই গম্ভীর। নীলা ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়ে বললো,
–“এই অদ্ভুত মানুষ গুলো কারা? আজব তোহ।”
–“কী রে নীলা, কার সাথে কথা বলছিস?”

আয়ন্তির ডাকে নীলা দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে আসলো। ভেতরে গিয়ে দেখে আয়ন্তি ততক্ষণে উঠে বসেছে। আয়ন্তির মুখশ্রী ভীষণ ফ্যাকাসে। চুলগুলো এলোমেলো। চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। চোখের নিচেও কালচে ভাব সৃষ্টি হয়েছে। নীলা ব্যস্ত ভঙ্গিতে আয়ন্তির কাছে এসে বললো,
–“উঠছিস কেন? শুয়ে পর দ্রুত৷ নিজের অবস্থা দেখেছিস? জ্বরে গা পু’ড়ে যাচ্ছে।”
–“কে এসেছিলো?”
–“মাহবিন ভাইয়ের ভাই-বোন।”

আয়ন্তি যেন আকাশ থেকে পরলো। চোখ জোড়া বড়ো বড়ো করে বললো,
–“মানে কী? আমার জানামতে তো মাহবিনের কোনো ভাই-বোন নেই।”

কৌতুহলে নীলারও ভ্রু-দ্বয় কুচকে এলো। তবে প্রশ্ন করলো না সে।
–“হতেও পারে ভাইয়ার কাজিন ওরা।”
–“হ্যাঁ, তাও হতে পারে। বাদ দে, মা খাবার পাঠিয়েছে?”
–“দুপুরের আগেই খাবার চলে আসবে। চিন্তা করিস না।”
–“আমার জন্যে শুধু শুধু তুই পেরাসানিতে পরলি নীলা।”
–“ধুর। কিসের পেরাসানি? একসাথে থাকছি। দু’জন দু’জনের খেয়াল রাখতে না পারলে থেকে কাজ কী? আমার কাজ আমায় করতে দে। খবরদার আর যদি শুনেছি এসব।”

আয়ন্তি উত্তরে শুধু হাসলো। ঘুমে নেতিয়ে পরছে যেন তার চোখ জোড়া। তাই পুণরায় শুয়ে পরলো সে। যোহরের আযানের আগে দিয়ে আয়েশা ড্রাইভার দিয়ে খাবার পাঠালো। নীলা ড্রাইভারের ফোন রিসিভ করে নিজেই নিচে চলে গেলো। খাবারের হটপট হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে বিদায় করে নিজেও ভেতরে চলে আসলো। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পুণরায় রিহাবের মুখোমুখি হলো নীলা। নীলা এবার বিরক্ত হলো। রিহাব হাসি হাসি মুখ করে বলে,
–“হাতে ওটা কী?”
–“বি’ ষ! খাবেন নাকি?”
–“এত বড়ো পটে বি’ ষ আনলে যে? এত খেয়ে কাজ কী?”
–“আপনি খেতে চাইলে আপনাকেও দিচ্ছি।”
–“সত্যি দিবে? তাহলে তো ভালো হয়। তোমার হাতের বি’ ষ এখন আমার কাছে মধু। দাও তো দেখি।”

বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো নীলা। পাগল নাকি ছেলেটা? এভাবে নীলার পিছে পরে আছে কেন? আজ দিনটাই খারাপ যাচ্ছে নীলার। কার মুখ দেখে যে উঠেছিলো। সবশেষে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আপনার কথা শেষ হলে আমি যেতে পারি?”
–“জ্বী অফ কর্স। কাল আবার আসব জ্বালাতে। কেমন? বাই।”

বলেই নীলাকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে নীলার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। শায়লাকে আর নামতে দেখলো না। নিশ্চয়ই নিচে নেমে গেছে। নীলার ইচ্ছে করছিলো ফ্লাইং কিস ছুঁড়া হাতটা ভে’ ঙ্গে রিহাবের হাতে ধরিয়ে দিতে। এমন ব’দ এই ছেলে! নীলা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিতেই রিহাব তড়িঘড়ি ভঙ্গিতে নীলার সামনে চলে আসলো। নীলাও যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। বুকে থুঁ থুঁ মা’ রার ভঙ্গি করে চোখ বড়ো বড়ো করে রিহাবের দিকে তাকালো। অতঃপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–“আসল কথাই তো জানা হলো না।”
–“কী?”
–“নাম কী তোমার?”

জীবনে প্রথম এই প্রশ্নকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর প্রশ্ন লাগলো নীলার। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আর একবার জ্বালিয়েছেন তো মাহবিন ভাইয়ের কাছে আপনার নামে বিচার দিবো।”
–“গ্রেট! আই লাইক ইট। এবার নাম বলো, নয়তো যাবো না।”

নীলা নাম বলবে না। রিহাবও হার মানার পাত্র না। নীলার নিজেকে অসহায় লাগলো। বুঝে গেলো তাঁর চেয়েও বেশি জেদী হচ্ছে এই রিহাব। শেষমেষ বাধ্য হয়েই নাম বলে দিলো নীলা।

——————
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই আয়ন্তি চমকে উঠলো। লাফ দিয়ে উঠতে চাইলেও পারলো না। মাহবিন আয়ন্তির কপাল ধরে আবার শুইয়ে দিয়েছে। আয়ন্তি চোখ বড়ো বড়ো করে মাহবিনের পানে তাকিয়ে আছে। মাহবিন তার গম্ভীর কন্ঠস্বরে নম্রতা এনে শুধায়,
–“উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো।”

আয়ন্তি বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় লেপ্টে থাকে। নজর তার মাহবিনের মুখশ্রীতে। মাহবিন একপলক আয়ন্তির চোখ-মুখের দিকে চেয়ে আয়ন্তির কপালে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিলো। আয়ন্তি পরম আবেশে চোখ বুজে ফেললো। কপালের তাপ যেন মাহবিনের ওই বলিষ্ঠ হাত দিয়ে অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছে। মাহবিন আয়ন্তির তাপমাত্রা চেক করে বলে,
–“এত জ্বর হলো অথচ আমায় জানালে না?”

আয়ন্তি চোখ মেলে তাকালো। চোখে-মুখে ফুটে উঠলো একরাশ কৌতুহল। পিটপিট করে মাহবিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“বললে কী হতো?”
–“কী হলে তোমার ভালো লাগতো?”

পাল্টা প্রশ্নে আয়ন্তি থতমত খেয়ে গেলো। তার গলা দিয়ে টু-শব্দও বের হলো না। আসলে সে নিজেই জানাতে ইচ্ছুক ছিলো না। আয়ন্তি ভেবেছিলো অনেকদিন মাহবিন থেকে দূরে থাকবে। কিন্তু সম্ভব আর হলো কই? মাহবিনের উক্তিতে আয়ন্তির ধ্যান ভাঙলো,
–“ওষুধ নিয়েছো?”
–“সকালে নিয়েছিলাম।”
–“এখন ক’টা বাজে জানো?”
–“ঘুমিয়েছিলাম। বলতে পারি না।”

আয়ন্তি ভাঙ্গা কন্ঠস্বরে যেন মায়া ঢেলে দেয়া হয়েছে। এত মধুর লাগছে শুনতে। মাহবিন নিরবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো আয়ন্তির ফুলে যাওয়া মুখশ্রীতে। আয়ন্তি ইতস্তত বোধ করছিলো, তাই সে নজর নত করে রেখেছে। হৃদপিন্ড প্রচন্ড ঢিপঢিপ শব্দ করছে তার। দেহে এক শিহরণ খেলে গেলো তার। মাহবিন হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। পকেটে দুই হাত গুঁজে বলে,
–“খেয়ে-দেয়ে ওষুধ নিয়ে নাও। আমি আবার পরে আসবো।”

মাহবিন চলে যেতে নিলে আয়ন্তি পিছু ডাক দেয়।
–“শুনুন।”

আয়ন্তির ডাকে মাহবিন থমকে দাঁড়ায়। ঘাড় বাঁকিয়ে আয়ন্তির দিকে তাকায়নি। আয়ন্তি মাহবিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“নীলা বলছিলো আপনাকে খুঁজতে দু’জন ছেলে-মেয়ে এসেছিলো। কারা ছিলো ওরা?”
–“ভাই-বোন।” মাহবিনের সহজ স্বীকারোক্তি।
–“আপন?”
–“হু।”
–“আপনি না বলেছিলেন আপনার কেউ নেই?”

এবার কোনো উত্তর আসেনি মাহবিনের পক্ষ থেকে। আয়ন্তি তখনো উত্তরের অপেক্ষায় মাহবিনের পানে তাকিয়ে। কিন্তু আফসোস, তার প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। মাহবিন বিনা-বাক্যে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আয়ন্তি শুধু চেয়ে, চেয়ে দেখলো। মাহবিনকে আর পিছু ডাক দিলো না।

—————————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে