অতঃপর দুজনে একা পর্ব-১০

0
1245

#অতঃপর দুজনে একা – [১০]
লাবিবা ওয়াহিদ

————————-
–“নীলা, চল। আমরা ফুচকা খাই? অনেকদিন খাওয়া হয় না।”
–“তো চল। বলা লাগে?”
–“তাহলে তো ক্লাস বাঙ্ক দিতে হবে।”
–“দিলে দিলাম। দিলে তো সমস্যা নেই। চল, সবার আগে ইচ্ছে, আকাঙ্খা। ইচ্ছে একবার মরে গেলে এই ইচ্ছাশক্তি সহজে আসবে না।”
–“ঠিকাছে।”

আয়ন্তি এবং নীলা একসাথে রাস্তা পার হতে নেয়। আয়ন্তির হঠাৎ মাঝ রাস্তায় কল আসে যার ফলে সে অমনোযোগী হয়ে নীলার হাত ছেড়ে দেয়৷ ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে নিলে তার বাম পাশ থেকে গাড়ির হর্নের আওয়াজ মিলে। আয়ন্তি ঘাড় বাঁকিয়ে বামপাশে ফিরতেই আঁতকে ওঠে। একটি প্রাইভেট কার তার দিকেই আসছে। আয়ন্তি কোনদিকে যাবে সেই দিক-নির্দেশনা হারিয়ে ফেললো। হতবুদ্ধি হারিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো। গাড়িটা তার কাছাকাছি আসতেই আয়ন্তি আতঙ্কে চোখ জোড়া শক্ত করে বুজে ফেললো। গাড়িটা তাকে ক্রস করার পূর্বেই কেউ একজন আয়ন্তির হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো। আয়ন্তি সরে এসে হুঁমড়ি খেয়ে অজানার বুকে গিয়ে পরলো। ভয়ে প্রচন্ড কাঁপছে আয়ন্তি। থরথর করে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে পরিচিত পারফিউম আয়ন্তির নাকে গিয়ে বিঁধলো। আয়ন্তি থমকে গেলো৷ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গেলো তার। নিরবে পাঢ় পারফিউমের ঘ্রাণ অনুভব করতে লাগল। সে কী ভুল অনুভব করছে? স্বপ্ন? ভ্রম? ভ্রম হলে এতটা কেন অনুভব হচ্ছে? আয়ন্তি নিজের সন্দেহ দূর করতে ধীর গতিতে অজানার বুক থেকে মাথা উঁচু করে তাকালো। ভীষণরকম চমকালো আয়ন্তি। থমকালো। মুহূর্তের জন্যে বুঝি হার্টবিট তার মিস হয়ে গেলো। এতদিনের অপেক্ষার পর কাঙ্খিত সেই মানুষটি। ভুল দেখছে? নাহ! ওই তো, সানগ্লাস ভেদ করে সেই চিরচেনা চোখ জোড়া দেখতে পারছে, অনুভব করতে পারছে সেই চোখের ভাষা। এটা তো ভুল হওয়ার কথা নয়। সে স্পষ্ট দেখছে তাকে। পিটপিট করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো আয়ন্তি। মাহবিন আয়ন্তির বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
–“এই আয়ন্তি, ঠিকাছো?”

হুট করে জড়িয়ে ধরলো আয়ন্তি মাহবিনকে। মাহবিন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে আয়ন্তির দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে রয়। আয়ন্তি চোখ বুজে শব্দের সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,
–“এতদিন ঠিক ছিলাম না। এখন খুব ঠিক আছি।”

নীলা দ্রুত ওদের কাছে আসলো। আয়ন্তি মাহবিনকে জড়িয়ে ধরে আছে এটা দেখে নীলা হা হয়ে রইলো। মাহবিন আয়ন্তিকে ধরেনি বরং আয়ন্তি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। যেন বহু বছরের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে। নীলা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আয়ন্তিকে টেনে দূরে সরালো। হুঁশ ফিরে আয়ন্তির। এতক্ষণের করা কর্ম একে একে মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হতেই আয়ন্তি লাল হয়ে গেলো লজ্জায়। একরাশ লজ্জায় মাথা নিচু করে মাহবিনের উদ্দেশ্যে আমতা আমতা করে বললো,
–“স..সরি। আসলে ভয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছি, বুঝতে পারিনি।”

মাহবিন একপলক আয়ন্তির দিকে তাকিয়ে নৈঃশব্দে হাসলো। হাসি বজায় রেখে শুধায়,
–“প্রব্লেম নেই। বাট তুমি রাস্তা-ঘাটে ঠিকমতো চলাফেরা করো। সময় মতো না আসলে কী হতো, বুঝতে পারছো?”
–“সো সরি। একচুয়ালি কল এসেছিলো আমার। কী যে হয়েছিলো যে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলাম। আপনাকে ধন্যবাদ।”
–“আগামী থেকে খেয়াল রেখো। তা, তোমরা এখানে কী করছো?”

নীলা হুট করে বলে ওঠে,
–“ভার্সিটিতে এসেছি। এখন ফুচকা খাবো। আয়ন্তির এখন ফুচকা খাওয়ার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছে।”
আয়ন্তি বিরক্তিতে আড়ালে নীলার হাতে চিমটি কাটলো৷ সব কেন বলা লাগবে মাহবিনের সামনে? সামান্য কমনসেন্স নেই এই মেয়ের মাঝে। নীলা আয়ন্তির চিমটিতে কোনরূপ পতিক্রিয়া দেখায় না। মাহবিন হেসে বলে,
–“এঞ্জয়।”
–“আপনি কেমন আছেন ভাইয়া? অনেকদিন পর দেখা হলো।”
–“ভালো। তা তো অবশ্যই। তুমি কেমন আছো? আর আয়ন্তি?”

আয়ন্তি পুণরায় হার্টবিট মিস করলো। নিজেকে সামলে বলে,
–“আলহামদুলিল্লাহ।”
–“ভাইয়া আসুন, আমরা বসি। কথাও হলো আবার ফুচকাও খাওয়া হবে।”
–“আরে না, না। একটু কাজ আছে এখানে। অন্য কোনো একদিন হবে।”
–“দশ মিনিট সময় দিলে কিছুই হবে না ভাইয়া। আসুন না, প্লিজ।”

মাহবিন কিছু সময় পর রাজি হলো। আয়ন্তি এবং মাহবিন মুখোমুখী বসলো। নীলা আগেই ফুচকার অর্ডার দিয়েছিলো। এখন গেলো আরেক প্লেট অর্ডার করতে। মাহবিন চোখ থেকে সানগ্লাসটি খুলে নিবিড় ভাবে আয়ন্তির দিকে তাকালো। আয়ন্তি পরপর কয়েকবার কোণা চোখে তাকিয়েছে। মাহবিন ফিচেল হেসে বলে,
–“ভালো আছো?”
–“হুম। আপনি?”
–“আলহামদুলিল্লাহ। ওয়াসিফ যোগাযোগ করেছিলো?”
–“নাহ। আপনার বন্ধু তো সবসময় বিজি থাকে। এছাড়া আমার সাথে যোগাযোগ করবে কী কারণে?”
–“সেটাও ঠিক। তবে আমি ওর বন্ধু তো, তাই ওকে চিনি। ঠিকই তোমার সাথে একবার হলেও যোগাযোগ করবে।”
–“জয়া আপু থাকতে কেন যোগাযোগ করতে আসবে?”
–“সরি, জয়া কে?”
–“ওয়াসিফের উড বি।”

মাহবিন হাই তুললো। অতঃপর অধরে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–“পার্সোনালি বলি? ওয়াসিফের উড বি কবে রিয়েল হবে সেটা বলা দায়।”
–“তাহলে প্রথমদিকে আমায় কেন বিয়ে করতে নিষেধ করেননি?”
–“পরে করেছি না?”
–“কী ভেবে করলেন?”
–“তোমার কাজিনের সাথে ওপেন রিলেশনে ছিলো। ইভেন পার্সোনাল টাইমও লীড করেছে। ওসব মুহূর্তের পিকস অবধি দিয়েছিলো। তুমি কী মনে করবে ভেবে সেসব খোলাশা করে বলিনি।”
–“কানাডা থাকতেও এরকম ছিলো তাই না?”

মাহবিনের বুঝতে বাকি নেই আয়ন্তি ওয়াসিফ সম্পর্কে যেমন জেনেছে তেমনই দেখেছে। অপ্রস্তুত হলো মাহবিন। গলা ঝেড়ে বলে,
–“হুম।”
–“সরি।”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মাহবিন। ভ্রু কুঁচকে আয়ন্তির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“হোয়াই?”
–“সেদিন রিয়ন ভাইয়া আপনার সাথে মিসবিহেভ করেছে তাই।”
–“কে হয় ওটা তোমার?”
–“কাজিন।”
–“কাজিন হয়ে এত বাড়াবাড়ি কিসের?”
–“কিছু বললেন?”

মাহবিন জোরপূর্বক হেসে বলে,
–“কিছু না।”
–“আপনার মনে কোনো ক্ষোভ নেই তো?”
–“একদম না। আমি পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছি।”

আয়ন্তি নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রয় মাহবিনের দিকে। দীর্ঘ দশদিন পর দেখছে মাহবিনকে। কিন্তু এই দশটা দিন যেন দশ মাসের সমান। ভালোবাসলে বুঝি এরকমই হয়? এর মাঝে নীলা চলে আসলো। খুব কথা হলো৷ ফুচকাও আসলো। তবে মাহবিন খেলো না। ফুচকা আসতেই তার কল আসে। ইমার্জেন্সি। তাই মাহবিনকে উঠতে হয়।
–“সরি নীলা। সত্যি-ই ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে। আমার পক্ষে টাইম দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার একদিন হবে কথা।”
–“ওকে ভাইয়া। তা নাম্বারটা দিয়ে যান। নয়তো আপনাকে আবার হারিয়ে ফেলবো।”

মাহবিন এক নজর আয়ন্তির পানে তাকিয়ে বলে,
–“আয়ন্তির কাছে নাম্বার তো আছেই। ইচ্ছে হলে যোগাযোগ করিও। আসি। বাই!”

মাহবিন চলে গেলো। আয়ন্তি চাতক পাখির ন্যায় মাহবিনের চলে যাওয়া দেখতে লাগে। মাহবিন গাড়িতে ওঠার পূর্বে আয়ন্তির দিকে এক নজর তাকালো। অতঃপর চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।

–“তলে তলে এতকিছু?”
আয়ন্তি চমকে নীলার দিকে তাকায়। ভ্রু-দ্বয় কুচকে বললো,
–“মানে?”
–“মানে হলো গিয়ে, মাহবিন ভাইয়ের নাম্বার ছিলো তোর কাছে, আর তুই জানানোর প্রয়োজনবোধ করল না?”
–“আজব তো। জানিয়ে আমার কী?”
–“তাও ঠিক। আচ্ছা, মাহবিন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করা যাবে।”

আয়ন্তি উত্তরে কিছু বললো না। নিরবে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো।

——————-
রিয়ন হাতে ফাইল নিয়ে ওয়েটিং রুমে বসে আছে। আজ তার ইন্টারভিউর রেজাল্ট দেয়া হবে। রিয়ন তো ভীষণ এক্সাইটেড। সে যদি জয়েন হতে পারে তাহলে চাকরির প্রথম মিষ্টি সে আয়ন্তিকে খাওয়াবে। রিয়ন বারংবার টাইম দেখছে এবং এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। না জানি আজ তার কী হয়। রিয়নের অপেক্ষার অবসান করে ম্যানেজার এসে বলে,
–“কংগ্রেচুলিয়েশন। আপনি সিলেক্টেড।”

রিয়ন মুহূর্তের জন্যে থমকালো। পরমুহূর্তে তার অধর জোড়া প্রসারিত হলো। আনন্দের রেশ মুখশ্রীতে ফুটিয়ে বলে,
–“থ্যাঙ্কিউ।”
–“আপাতত অফিসের এগ্রিমেন্টে সাইন করুন।”
–“জ্বী, দিন। করে দিচ্ছি।”

রিয়ন অফিসের সকল রুলস ফলো করে এগ্রিমেন্টে সাইন করলো। এই এগ্রিমেন্টে অফিসে জয়েন হওয়ার পর্যাপ্ত কিছু নিয়ম-নীতি করা আছে। মিনিট বিশেক পর গিয়ে ম্যানেজার জানালেন বসের সাথে দেখা করতে হবে। রিয়নও সম্মতি জানিয়ে ম্যানেজারের পেছন পেছন ছুটলো। বসের রুমের সামনে আসতেই বললো,
–“মে আই কাম ইন স্যার?”
–“ইয়েস, কাম।”

রিয়ন সহ ম্যানেজার কেবিনে প্রবেশ করলো। রিয়ন বসকে সালাম দিতে বসের দিকে তাকাতেই থমকালো। রিয়ন বিষ্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে সামনে বসা মানুষটির দিকে তাকিয়ে রয়। মুহূর্তের জন্যে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে রিয়ন। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে