অতঃপর দুজনে একা পর্ব-০২

0
1592

#অতঃপর দুজনে একা – [০২]
লাবিবা ওয়াহিদ

——————————
–“আয়ন্তি?”
আয়ন্তির পা জোড়া পুণরায় থমকে গেলো। এবার তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সত্যি-ই জানান দিচ্ছে যে মাহবিন তাকে ডাকছে। আয়ন্তি অনুভব করলো তার হৃদপিন্ডের তীব্র ওঠা-নামার শব্দ। আয়ন্তি ঘাড় বাঁকিয়ে পিছে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। নাহ, ভুল শুনেনি সে। সত্যি-ই মাহবিন দাঁড়িয়ে। আয়ন্তি একটু নয় বরং অনেকটা চমকে গেলো। মাহবিন কয়েক ধাপ এগিয়ে আয়ন্তির সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। হৃদপিন্ডের তীব্র ধুকপুক শব্দে আয়ন্তি নিজেই বিব্রত হয়ে পরছে। মুখ খুলে যে কিছু বলবে তারও উপায় নেই। গলায় যেন কেউ সিমেন্টের ঢালাই করে রেখেছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা, হতবুদ্ধিহীন আয়ন্তি বোকা চাহনি নিক্ষেপ করে রয় মাহবিনের পানে। মাহবিন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
–“ওয়াসিফ কানাডাতে বড়ো হওয়া ছেলে। প্রচন্ড বিঁগড়ে যাওয়া ছেলেও বলা যায়। তাই ওকে ভুল না বোঝার অনুরোধ। ওয়াসিফ এখনো বাঙালির ব্যবহার, চলাফেরা ধরতে পারেনি। সেটা ধরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তো তোমার, কারণ তুমি ওর ফিয়ন্সে। জীবনটাও তুমি কাটাবে ওর সাথে।”

আয়ন্তির মস্তিষ্ক মাহবিনের কথাগুলো নিতে ক্ষণিক সময় নিলো। যখন মাহবিনের কথাগুলো বুঝতে পারলো তখন আয়ন্তি যেমন রাগাম্বিত হলো তেমনই হতাশ। মাহবিনের পক্ষ থেকে অন্তত এরকম কথাবার্তা একদমই আশা করেনি। মাহবিন তো ওয়াসিফের চরিত্র সম্পর্কে অবগত, বরং আয়ন্তির থেকে বেশি তথ্য মাহবিনের নিকট আছে। তাহলে মাহবিন মেনে না নেয়ার কথা বলে কেন বলছে মানিয়ে নিতে? চোখ জোড়া ভিষণ জ্বালা করছে আয়ন্তির। ঘুমটা তো সেই কখনই পালিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে নাক টেনে উঠলো আয়ন্তি। নাক টেনে কান্না দমানোর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালালো৷ আয়ন্তি বেশ কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“উপকার যেহেতু করতে পারবেন-ই না সেহেতু বন্ধুর সাফাই গাওয়ার প্রয়োজন নেই!”

আয়ন্তি এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। মাহবিন পুণরায় পিছু ডাক দেয়। কিন্তু ফলাফল শূন্য, আয়ন্তির কান অবধি মাহবিনের গম্ভীর কন্ঠস্বর পৌঁছায় না।

সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো আয়ন্তি। দরজায় পিঠ লেপ্টে আয়ন্তি ধীরে ধীরে ফ্লোরে বসে পরে। চোখ-মুখ ভাবলেশহীন। কিছু সময়ের ব্যবধানে চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো। ক্রমশ পরতেই লাগলো। আয়ন্তি চুপ করে সামনের দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে রয়। সে আপাতত এমন একটি পরিস্থিতিতে আছে যেখানে কাউকে ভরসা করে মনের অব্যক্ত অনুভূতি, যন্ত্রণা, কষ্ট ভাগ করতে পারছে না। মুখ ফুটে বলতে পারছে না অব্যক্ত এক শব্দও! যখন সময় খারাপ থাকে তখন হয়তো সকলেই মুখ ফিরিয়ে নেয়৷ মাহবিনকে যতবার চোখের সামনে দেখে ততবার যেমন পুড়ে তেমনই দৃষ্টির তৃষ্ণা মিটে। অদ্ভুত এক ভালো লাগার মিশ্রণ এই মাহবিন। চমৎকার পার্সোনালিটির মানব। কিন্তু তার প্রিয় পুরুষটি-ই সবথেকে ঘৃণ্য পুরুষটির নামে সাফাই গায়।

মাহবিন দেখতে যেমন লম্বা, চওড়া! তেমনই তার দেহের আকর্ষণীয় গঠন। চেহারার মাঝে গাম্ভীর্য থাকলেও তার শুভ্র মুখশ্রীতে তা বেশ সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। মাহবিনের হাসিটাও অদ্ভুত সুন্দর, হাসলে তার গালে ভাঁজ পরে। অধরের কোণাতেও সূক্ষ্ম ভাঁজ। মাথায় ঘন কালো চুল। মাহবিন চোখে লাগা ফর্সা। আহামরিও নয় অবশ্য। সবসময় এক মিষ্টি, এট্রাক্টিভ পারফিউম ব্যবহার করে। সেই পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে বিঁধলে আয়ন্তি যেন ধরনীর সবকিছু ভুলে যায়। চাপ দাঁড়ির অধিকারী এই পুরুষ। আয়ন্তির স্বপ্নের পুরুষ সে। যার বর্ণনা দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
ওয়াসিফও আছে মোটামুটি। তবে ওয়াসিফের চেহারাতে বিদেশি ভাবটা একটু বেশি-ই ফুটে ওঠে। চুল তার গাঢ় বাদামী৷

আয়ন্তি ওয়াসিফকে নিয়ে ভাবতে চাইলো না। চোখ মুছে নাক টেনে উঠলো। দরজায় মাথা ঠেকিয়ে সিলিং ফ্যানটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আপনমনে বলে ওঠলো,
–“ওয়াসিফের জায়গায় আপনি হলে কী এমন দোষ হতো মাহবিন? কেন আমার সাথে এসব হতে হলো? আপনি কী আমায় শুনতে পারছেন মাহবিন? অনুভব করতে পারছেন আমার দগ্ধতা। অদৃশ্য আগুন যে আমায় জ্বালিয়ে ছাই করে দিচ্ছে মাহবিন, দেখতে পাচ্ছেন?”

———————–
–“দোস্ত প্লিজ। আইডিয়া দে, আমি আয়ন্তিকে টাচ করতে চাই৷ এই মেয়েটা তো টাচই করতে দেয় না!”
–“তোরে আমি কম বলিনি। এটা বিডি ভাই, নট কানাডা। এত অবুঝ হয়েছিস কেন? যা করার বিয়ের পর করবি!”
–“তুই আয়ন্তির হয়ে সাফাই গাইবি না একদম। আয়ন্তিকে তুই বোঝাবি, ব্যাস। শুধু বিয়ে, বিয়ে অর বিয়ে! ডিসগাস্টিং!”
–“তোর পাস্ট অর প্রেজেন্ট সম্পর্কে ওই মেয়ের ধারণা হলে তোর মুখ বরাবর জু’তা মারবে। সময় থাকতে শুধরে যা। গো টু হে’ল ননসেন্স!”

মাহবিন খট করে কল কেটে দিলো। মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে আছে তার। ফুঁসতে ফুঁসতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ওয়াসিফ কয়েকবার কল দিলো। মাহবিন ফোন ভাঙতে গিয়েও ভাঙ্গেনি। ফোন সাইলেন্ট করে পায়ের কাছে ফেলে রাখলো। রাগে মাথা ভনভন করছে তার। অদ্ভুত যন্ত্রণা লাগছে সব। কিছুক্ষণ বাদে দরজায় কড়াঘাত শুনলো। ওয়াসিফের কন্ঠস্বর। মাহবিন উঠে বসে। দরজার দিকে এগিয়ে না গিয়ে মাহবিন অগ্রসর হয় রুমে থাকা ছোট বেলকনিটার দিকে। আজকে আসার পর বেলকনিতে আসা হয়নি তার। বড়ো থাই গ্লাসটি নিঃশব্দে খুলে বেলকনিতে প্রবেশ করলো মাহবিন। বেলকনিটা একদম স্বাভাবিক। গ্রিল নেই। বেলকনি থেকে ছোট বাগানটা দৃশ্যমান। এরপরেই রাস্তা। ল্যাম্পপোস্টের কৃত্রিম আলোয় রাস্তা আলোকিত। রাস্তার ফুটপাত ধরে কিছু ছেলে হেঁটে যাচ্ছে৷ রিকশার ক্রিং ক্রিং শব্দও শোনা যাচ্ছে। মাহবিন চারপাশে নজর বুলাতে বুলাতে হঠাৎ চোখ পরলো পাশের বারান্দায়। মাহবিনের বেলকনির পাশাপাশি আরেকটি বারান্দা। তবে মাহবিনের বেলকনির মতো ছোট নয়, বরং অনেকটা বড়ো। ফুল, লতা-পাতায় ভর্তি একটি বেলকনি। মাহবিন ভ্রু-দ্বয় কুচকে নিবিড় ভাবে একটি হিসাব মেলানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
–“এনিহাউ, এটা আয়ন্তির বেলকনি?”

আপনমনেই বলে ওঠে মাহবিন। মাহবিন বেশ কিছুক্ষণ সবটা পর্যবেক্ষণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। আয়ন্তির রুমের লাইট বন্ধ৷ নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে গিয়েছে। মাহবিন বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালো বেলকনিতে৷ শীতল বাতাস তাকে ক্ষণিক পরপর ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডায় গা কাঁপুনি দিয়ে উঠলেও মাহবিন তোয়াক্কা করলো না। তার ভিষণ ভালো লাগছে এই ঠান্ডা মৌসুম। কুয়াশায় বেলকনির রেলিঙ ভিঁজে আছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তায় ধোঁয়াশা দৃশ্যমান। বেশ কিছুক্ষণ বাদে মাহবিন অনুভব করলো তার পা ভিষণ চুলকাচ্ছে। মাহবিন এক পা উঁচু করে চুলকালো। মশার প্রকোপ অনুভব করলো মাহবিন। শীতল পরিবেশে মশার উপদ্রব একটু বেশি-ই থাকে। নাহ, এখানে আর দাঁড়ানো ঠিক হবে না। একে তো ঠান্ডা বাড়ছে তার উপর মশার তীব্র অত্যা’চার! জ্যাকেট’টাও পরেনি যে শীত নিবারণ করবে।

মাহবিন উল্টো হয়ে বেলকনি হতে ভেতরে যেতে নিলে পাশের বেলকনিতে খুট করে থাই গ্লাস খোলার শব্দ হলো। অবশিষ্ট পা থেমে যায় মাহবিনের। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই দেখলো আয়ন্তি উম্মুক্ত চুলে বেলকনিতে আসছে৷ গায়ে তার মোটা শাল। শরীরের গঠন এবং উচ্চতা দেখে মাহবিনের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে এটাই আয়ন্তি। মাহবিন ভ্রু-দ্বয় কুচকে আয়ন্তিকে পর্যবেক্ষণ করছে। আয়ন্তি বিড়বিড় করে কিছু বলছে আর এদিক সেদিক তাকাছে। মুখশ্রী তার ভিষণ মলিন। বাগানের একপাশে ল্যাম্প আছে, সেই ল্যাম্পের কৃত্রিম আলোয় মাহবিন অনায়াসে আয়ন্তিকে পর্যবেক্ষণ করে গেলো।

আয়ন্তি ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো মাহবিন তার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ন্তি ভুলেই গেছিলো যে পাশের রুমের বারান্দা এবং তার রুমের বারান্দা পাশাপাশি। এতটাই কাছাকাছি যে এক বারান্দা হতে আরেক বারান্দা টপকে আসা-যাওয়া করা সম্ভব। আয়ন্তি এক মুহূর্ত দেরী করলো না। একপ্রকার ছুটে রুমে চলে গেলো। অসম্ভব হাঁপাচ্ছে আয়ন্তি। সুস্থ- স্বাভাবিক আয়ন্তি ভুলক্রমেও মাহবিনের সামনে পরলে অস্বাভাবিক হয়ে যায়। কেন, সেই উত্তর আয়ন্তির মন এবং মস্তিষ্ক দিতে ব্যর্থ। আয়ন্তি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সকল বিষাদ পাশে ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ঘুম ভাঙলেই নতুন দিনের সূচনা হবে, নতুন একটি বিষাদময় দিন হাতে ধরা দিবে। আয়ন্তি এই বিষাদ, বিধ্বস্ত দিনটিকে মেনে নিয়ে চোখ বুজলো এবং সময়ের ব্যবধানে ঘুমিয়েও পরলো।

———————-
দরজার কড়াঘাতের শব্দে আয়ন্তির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। একই সাথে বিকট শব্দে বাজছে ফোনের রিংটোন। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই আয়ন্তির ভ্রু-যুগল কুচকে গেলো। কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ বদ্ধ অবস্থায় বালিশ হাতড়ে ফোন খুঁজে নিলো। অতঃপর চোখ না খুলে আনুমানিক রিসিভ করার টাচে টান দিয়ে কানে ফোন রাখলো। ফ্যাচফ্যাচ কন্ঠে বলে ওঠে,
–“হ্যালো, কে?”
–“মাহবিন!”

আয়ন্তির ঘুম উড়ে গেলো। পিটপিট করে তাকালো আয়ন্তি। কান থেকে ফোন সরিয়ে আয়ন্তি ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালো। তাজ্জব বনে গেলো আয়ন্তি। আননোন নাম্বার৷ ভুল শুনেনি আয়ন্তি। হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসলো আয়ন্তি। এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে আটকে যাওয়া গলায় শুধায়,
–“আপনি? এই সাত-সকালে?”
–“সাত-সকাল কোথায়? বেলা দশটা বাজে। এছাড়া আমার প্রয়োজন ছিলো!”

আয়ন্তি দেয়াল ঘড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আসলেই দশটা বেজে গেছে। জিভে কামড় বসালো আয়ন্তি। আয়ন্তি আমতা আমতা করে আওড়ায়,
–“কিসের প্রয়োজন?”
–“তোমার এক কাজিন আমার রুম দখল করে বসে আছে। ব্যাপারটা বলতে খারাপ দেখালেও আমি বাধ্য হচ্ছি তোমাকে বলতে। আমার একদম পছন্দ না নিজের রুমে বাহিরের কারো আনাগোনা। কখন থেকে তোমার দরজায় নক করছি, বাট ইউ ডিডেন্ট রেসপন্স!”

মাহবিনের এরকম কথাবার্তায় আয়ন্তি যেমন চমকালো তেমন লজ্জিত হলো। আয়ন্তি ওড়না মাথায় পেচিয়ে কানে ফোন নিয়েই দরজা খুলতে ছুটলো। দরজা খুলতেই দেখলো মাহবিন বেশ বিরক্তির সাথে দরজার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। কপালে তার সূক্ষ্ম বিরক্তির ভাঁজ, মুখশ্রীও ভিষণ গম্ভীর। দরজা খোলার শব্দে মাহবিনও আয়ন্তির দিকে তাকালো। আয়ন্তি সেই দৃষ্টিতে কিছুটা বিব্রত হলেও দমে গেলো। মাহবিন হঠাৎ চুপসে গেলো। আয়ন্তির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নজর ঘুরিয়ে ফোন কান থেকে নামালো। আয়ন্তিও বাস্তবে ফিরে ফোন কান থেকে সরালো। আয়ন্তি আমতা আমতা করে বললো,
–“আপনি আমার রুমে বসুন। আমি দেখে আসছি!”

মাহবিন ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। আয়ন্তি সেই অবস্থাতেই মাহবিনের রুমে ঢুকলো। রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো নীলা অর্থাৎ আয়ন্তির চাচাতো বোন বিছানায় কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছে। গা জ্বালা দিয়ে উঠলো আয়ন্তির। কী বদ মেয়ে, বাড়িতে এসেই এই রুমে দখল শুরু করেছে। আয়ন্তি সর্বশক্তি দিয়ে কম্বল টান মেরে সরিয়ে ফেললো। নীলাও হন্তদন্ত ভঙ্গিতে উঠে বসলো। ভয়ও পেয়েছে কিছুটা! আয়ন্তিকে দেখতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর বললো,
–“ওহ তুই?”
–“ওহ তুই এর মানে কী?”
–“আমি তো ভাবলাম আমার রুমে দখল নেয়া ওই লোকটা এসেছে। কী যে ভয় পেয়েছি বলার মতো না। আরেকটুর জন্যে কলিজা বের হয়ে যাচ্ছিলো আমার। বাই দ্য ওয়ে ওই লোকটা কে?”

আয়ন্তি মুখ-ভঙ্গি গোমড়া করে বিছানা ঝাড় দেয়ার ঝা’টাটা এদিক সেদিক খুঁজলো। অতঃপর বিছানা ঝাড়ার ভঙ্গিতে নীলার কাছাকাছি ধু’মধাম শব্দে বিছানা ঝাড়তে লাগলো। নীলা ভয় পেয়ে বিছানা থেকে চট করে নেমে পরলো। নীলা ভ্রু-দ্বয় কুচকে বললো,
–“এমন করছিস কেন? বিছানা থেকে নামিয়ে দিলি?”
–“তো কী করবো? সবসময় তোর এই বিছানা এবং রুমে দখল থাকলেও আজ নেই। এখন অন্য কাউকে এই ঘরটিতে থাকতে বলা হয়েছে।”
–“যে-ই থাকুক না কেন? আমি এই রুমেই থাকবো। তুই জানিস আমি এই বাড়িতে আসলে এই রুম আমার মাস্ট লাগবেই। তাহলে অন্যদের ভাগ বসাতে দিলি কেন? আমি মানবো না আয়ন্তি!”
–” তুই তো বলেছিলি এঙ্গেজমেন্টে আসবি না, তাহলে তোর জন্য রুম রাখবো-ই বা কেন?”

নীলা জিভে কামড় দিলো। বুঝলো আয়ন্তি ভিষণ রেগে। নীলা আয়ন্তির রাগ ভাঙ্গাতে আসতে নিলে আয়ন্তি চট করে ঝাটা’টা নীলার মুখোমুখি দিয়ে বেশ শক্ত গলায় বললো,
–“নট এ ওয়ার্ড! তুই আমার সাথে থাকবি। এখন নিচে গিয়ে বাকিদের সাথে দেখা কর। যা!”

নীলা মুখ ভার করে চলে গেলো। আয়ন্তি ততক্ষণে আলমারি থেকে নতুন চাদর নামিয়ে বিছানায় বিছিয়ে দিলো। সবকিছু ঠিক-ঠাক করে আয়ন্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। পরমুহূর্তে মনে পরলো নিজের বিছানার কথা। আয়হায়! মাহবিনের বিছানা গুছাতে গিয়ে সে তো নিজের বিছানাই এলোমেলো করে এসেছে। আর সেই রুমেই মাহবিনকে বসতে বলেছে? কী লজ্জাজনক ব্যাপার। আয়ন্তি ঝা’টা ফেলে একপ্রকার দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নিজের রুমের দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সম্মুখেই আয়ন্তি শক্ত কারো সাথে ধাক্কা খেলো। কঠিন ধাক্কা। সেই ধাক্কায় আয়ন্তি বেসামাল ভাবে পেছনের দেয়ালে আঘাত পাওয়ার পূর্বেই এক বলিষ্ঠ হাত আয়ন্তির কোমড় আঁকড়ে কাছে টেনে নিলে নিলো। আয়ন্তি চোখ-মুখ শক্ত করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে এবং আল্লাহ্ কে স্মরণ করছে। যেন সে এই যাত্রায় বেঁচে যায়। যখন কোমড়ে শীতল স্পর্শ অনুভব করলো তখন আয়ন্তি পিটপিট করে তাকালো। সামনের মানুষটিকে দেখে লজ্জায় হতভম্ব হয়ে পরলো আয়ন্তি।
–“আর ইউ ওকে?”

মাহবিনের প্রশ্নে আয়ন্তির ধ্যানে ছেদ ঘটে। মাহবিন কিছুক্ষণ পূর্বেই আয়ন্তির কোমড় হতে হাত সরিয়ে নিয়েছে। আয়ন্তি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত কয়েক ধাপ পিছিয়ে পেছনের দেয়ালে লেপ্টে গেলো। কম্পিত স্বরে আওড়ায়,
–“আপনার রু..রুম খালি হয়েছে। আপনি যেতে পারেন!”

মাহবিন বিনাবাক্যে রুমে চলে গেলো। এদিকে আয়ন্তি নির্জীব পাথরের ন্যায় সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়। নিজের রুমে চোখ বুলিয়ে শক্ত করে চোখ বুজলো। কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে আপনমনে আওড়ালো,
–“কেন আপনি কাছাকাছি থাকলে নিজেকে হারিয়ে ফেলি অস্বস্তির রাজ্যে?”

আয়ন্তি নিজের এলোমেলো বিছানা ঠিক করে ওয়াশরুম চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায়। ডাইনিং এ এসে দেখে ওয়াসিফ আয়ন্তির সকল ভাই-বোন অর্থাৎ কাজিনদের নিয়ে খেতে বসেছে। গতরাতের মতোই ওয়াসিফের পাশের চেয়ারে জয়া বসেছে। ওয়াসিফের বাম পাশের চেয়ারটা খালি। সারা টেবিলে নজর বুলিয়েও মাহবিনকে দেখলো না আয়ন্তি। মনে কিঞ্চিৎ ভার অনুভব হলো। মাহবিন খেতে কেন আসেনি?

আয়ন্তিকে লক্ষ্য করতেই সোনিয়া হাসি-মুখে বলে ওঠে,
–“আরে দুলহান! আসো, এসে বসো। তোমহারা হি ইন্তেজার কার রেহিহু।”

আয়ন্তি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। তবে ওয়াসিফের পাশেরটায় নয়। নীলার সাথে বসলো। ওয়াসিফ আয়ন্তির দিকে কীভাবে তাকিয়ে খেতে মনোযোগ দিলো। খাওয়ার মাঝে নীলা আয়ন্তির কানে কানে বললো,
–“এখানে আসার পর থেকে দেখছি জয়া আপু একটু বেশি-ই ওয়াসিফ ভাইয়ার সাথে ঘেঁষছে। কী হচ্ছে বলো তো? অন্য গন্ধ নাকে বিঁধছে কেন?”

আয়ন্তি খাবার চিবানো বাদ দিয়ে নীলার দিকে তাকালো। নীলার মুখমন্ডলে একরাশ চিন্তা ভর করছে। যেন ওয়াসিফ এবং জয়াকে নিয়ে ইনভেস্টিগেট শুরু করেছে। আয়ন্তি অবশ্য বিষয়টা পজিটিভলি নিলো না। হালকার উপর ছেড়ে দিলো। ওয়াসিফকে নিয়ে ভাবতে মোটেও আগ্রহী নয় সে। হঠাৎ তানজিলা ওয়াসিফের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“তোমার ওই হিরো বন্ধু কই ভাইয়া? দেখছি না যে?”
–“অফিস গিয়েছে। খাওয়া-দাওয়া আগেই করে নিয়েছে দেখে দেখোনি!”
–“ও আচ্ছা।”
পুণরায় নিরব হয়ে গেলো সবাই।

বেলা বারোটা গড়াতেই ওয়াসিফ তার মাকে বললো,
–“মম, আমি আয়ন্তিকে নিয়ে শপিং করে আসি? সাথে একটু ঘুরেও দেখলাম সবটা!”
–“তো যাও। না করেছে কে? আমরাও এখন শপিং এ বেরুবো। আগামীকাল তো এঙ্গেজমেন্ট। কত কাজ!”

লিভিংরুমে বসেই আড্ডাতে মশগুল ছিলো আয়ন্তি। ওয়াসিফের প্রস্তাব শুনে খুক খুক শব্দে কেশে উঠলো আয়ন্তি। বিষ্ময়ে ঘেরা তার আঁখিপল্লব। এখন ওয়াসিফের সাথে তাকে বাইরে ঘুরতে যেতে হবে? এ কী করে সম্ভব?

——————————-
~চলবে, ইন শা আল্লাহ!”

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে