Sunday, October 5, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"তিমিরে ফোটা গোলাপতিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৬২+৬৩+৬৪

তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৬২+৬৩+৬৪

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬২
Writer তানিয়া শেখ

আন্দ্রেইর হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া যুবক স্থানীয় একটি সরাইখানায় বসে বসে মদ গিলছে। পুরো একটা দিন কেটে গেল। এখনও ওর বিশ্বাস হচ্ছে না নিকোলাস ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আততায়ী জেনেও বাঁচিয়ে দিয়েছে! কেন যেন ভয় করছে ওর। প্রতি মুহূর্তে এখন মৃত্যু ভয়ে ভীত ও।সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে প্রথমে মনিবের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। মনিব সরাসরি দেখা করেন না। তার এবং মনিবের মাঝে তৃতীয়, চতুর্থ পক্ষ থাকে। সেই তৃতীয়, চতুর্থপক্ষের দেখা এই সরাইখানায় এলেই মেলে। এদের একজন বলেছে মনিব শীঘ্রই ওর সাথে দেখা করবে, তবে নির্দিষ্ট দিন দেয়নি। এর অর্থ হলো যুবককে প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর সরাইখানায় থাকতে হবে। মনিব খুব সাবধানী লোক। যখন তখন হাজির হোন না তিনি। যুবকের ভাগ্য ভালো থাকলে আজও দেখা হয়ে যেতে পারে। হাতের মদের বোতলটার এক তৃতীয়াংশ খালি হয়ে গেল। মনিবের সামনে বসলে একটু আদব সহবতের প্রয়োজন পড়ে। প্রবল ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও মদের বোতলটা ঠেলে পাশে রাখল। পুরোটা না খেয়েও নেশা বেজায় চড়ে গেছে তার। চোখের পাতা দুটো ঢুলছে। সরাইখানায় চোখ বুলিয়ে নিলো। যুদ্ধের সময়েও এখানে বেশ ভিড়। মদের নেশা যুদ্ধের ভয়াবহতাকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেয়৷ বাইরের রাস্তা অবশ্য থমথমে। অনেকক্ষণ তাকালেও একটা মানুষ তো দূরের কুকুরও চোখে পড়ে না। রেডিয়োতে যুদ্ধের খবরের ফাঁকে ফাঁকে মৃদু আওয়াজে গান বাজছে।
যুবকের খিদে পেল। বাড়ি থেকে না খেয়েই বেরিয়েছে। মনিবের তরফ থেকে মদ কেউ একজন দিয়ে যায়। কিন্তু খাবারটা না চাইলে দেয় না। মনে মনে এইজন্য ভীষণ অশ্লীল একটা গালি দিলো লোকগুলোকে। গুপ্তচরবৃত্তি এবং মাঝে সাঝে টুকটাক খুনখারাবি করা তার পেশা। মনিবের কথাতেই এসব সে করে। বিনিময়ে মোটা অর্থ পায়। খাবারের জন্য দু’বার হাঁক দিতে একজন রসুইঘর থেকে বিরক্ত মুখে বেরিয়ে এলো। হাতের প্লেটে একটুকরো হাঁসের পোড়া রান আর দুটো পোড়া আলু। যুবক গপাগপ খেয়ে নিলো।
রাত অনেক হয়েছে। সরাইখানার ভিড়ও পাতলা হয়ে এলো। রসুইঘর থেকে একজন মুখ বের করে যুবককে ইশারায় বলে দিলো আজ মনিব দেখা করবেন না। যুবক হতাশ মুখে বেরিয়ে এলো সরাইখানার বাইরে।

এই স্থানটি মূল শহর থেকে অনেকটা ভেতরে বলে সৈন্যদের টহল খুব একটা চোখে পড়ে না। আগে এই সড়কে মধ্যরাত অব্দি লোকের পদচারণায় মুখর থাকত। যুদ্ধের কারণে বেশিরভাগ লোকই বসতি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। রাত হলেই ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা নামে পথে। যুবক অন্ধকার পথ ধরে হাঁটছে। হাতে নতুন একটা মদের বোতল। একটু পর পর চুমুক দিচ্ছে বোতলটাতে৷ কিছুপথ যেতে মাথার ওপর দিয়ে দুটো যুদ্ধ বিমান উড়ে যেতে দেখে থমকে দাঁড়ায়। এভাবে খোলা রাস্তা দিয়ে চলা বিপজ্জনক। যুবক টলতে টলতে কোনোরকমে পাশের নির্জন গলি দিয়ে হাঁটা ধরে এবার। মিনিট খানেক সময় পরে ওর মনে হলো কেউ যেন ওকে অনুসরণ করছে। থেমে উৎকর্ণ হয়। না, কোনো শব্দ নেই। তবে কী মনের ভুল ছিল? তাই ই হবে। আবার হাঁটছে সে। কয়েক কদম পরে আবার সেই শব্দ। না, মনের ভুল নয়। স্পষ্ট টের পাচ্ছে কেউ তাকে অনুসরণ করছে। নেশার চোটে যুবকের পা ঠিক ভাবে চলতে চায় না। তবুও সে দ্রুতপদে চলতে লাগল। তারপর দৌড়াতে শুরু করে। হঠাৎ কিছুতে বেঁধে মুখ থুবড়ে পড়ল পাশ্ববর্তী ড্রেনের ওপর। ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে চারপাশে তাকাল। জনমানবহীন গলি। একটুখানি স্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পায়। চকিতে ঘুরতে হামলা করে বসে ওর ওপর। যুবক চিৎ হয়ে পড়ে আছে গলির রাস্তায়। দমবন্ধ হয়ে এলো। ভয়ে ওর নেশা কেটে গেছে প্রায়। স্পষ্ট চোখে নিকোলাসকে নিজের বুকের ওপর দেখতে পাচ্ছে। গতকালের চেয়ে আজ যেন আরো বুড়ো, বিভৎস লাগছে ওকে। ওর গা থেকে আসা মানুষ পঁচা উৎকট গন্ধে যুবকের পেট গুলিতে এলো। নিকোলাস ওর বুকের ওপর হাঁটু তুলে বসে আছে। নিস্প্রভ চোখের চাহনি। বয়স্ক গলায় বলল,

“কে তোর মনিব?”

“বলব না।” যুবক জবাব দিলো। নিকোলাস হাঁপ ছেড়ে মুখ ভার করে বলে,

“গত পাঁচ মাসে আমি মানুষের রক্ত পান করিনি। দ্যাখো কী বেহাল দশা আমার। অবশ্য খারাপ লাগছে না। সত্যি কথা হলো, অসাড় বোধ হয় থেকে থেকে। আচ্ছা, তুমি প্রেম করেছ কখনো? ধুর! কী থেকে কী বলছি। আমার না সবকিছুই খুব অসংলগ্ন হয়ে যায় এখন। তা যা বলছিলাম। পিশাচ আমি৷ মানুষ দেখলে রক্ত তৃষ্ণা পায়। এখনও পাচ্ছে। একটু বেশিই পাচ্ছে। তুমি সঠিক জবাব দিলে নিজেকে আজও বশ করে নেবো। বলো তোমার মনিব কে?”

যুবক বলে না। নিকোলাসের নিস্প্রভ শান্ত চোখে হিংস্রতা ফুটে ওঠে। মুহূর্তে শ্বদন্ত বসিয়ে দেয় যুবকের গলায়। আর্তনাদ করে ওঠে যুবক। ভীত কণ্ঠে কেঁদে বলে,

“বলছি, দয়া করে মেরো না আমাকে।”

নিকোলাস মুখ তোলে। শ্বদন্ত বেয়ে ঠোঁটের দু’পাশে গড়িয়ে পড়ছে যুবকের তাজা রক্ত। পাশে সরে বসে ও। যুবক ঘাড় চেপে ধরে নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে বলে,

“ওয়াদা করো নাম বললে ছেড়ে দেবে।”

“ওয়াদা।”

যুবক গভীর শ্বাস নিয়ে বলল,

“ড্যামিয়ান।”

রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে নিকোলাসের। বিড়বিড় করে বলে,
“ড্যামিয়ান, হুঁ? ব্লাডি বাস্টার্ড।”

যুবক সুযোগ বুঝে পালাতে গেলে নিকোলাস ওর গলা চেপে ধরে। ভীত যুবক বলল,

“তুমি আমাকে ওয়াদা করেছিলে নাম বললে ছেড়ে দেবে।”

নিকোলাস দাঁত বের করে হাসে। বলে,
“ওয়াদা? গতকাল তুমিই তোমার বন্ধুকে বলেছিলে না? ওকে বিশ্বাস কোরো না বন্ধু। ভুলে গেলে এত তাড়াতাড়ি? মাই ডিয়ার লিটল আততায়ী, আমি মোটেও লয়াল পার্সন নই আমার শত্রুদের সাথে। ডোন্ট ওয়ারি, তোমাকে আমি কম কষ্টের মৃত্যু দেবো।”

যুবকের সকল অনুনয়, কান্না অগ্রাহ্য করে অনেকদিন পর তৃপ্তিতে রক্ত তৃষ্ণা মেটায় নিকোলাস। দুর্বল শরীরে শক্তি ফিরে পায়। দুদিন একটু চুপচাপ থেকেছে বলে শত্রুরা দুর্বল ভেবে নিয়েছে? নিকোলাস দুর্বল নয়। কিন্তু ওর মনটা ইসাবেলার মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে আছে। ইসাবেলার মৃত্যুর ধাক্কা ওর মনটা সহজভাবে নিতে পারেনি। দুরত্ব সবসময়ই বিচ্ছেদ ঘটায় না। মাঝে মাঝে দূরে চলে যাওয়া মানুষটা কত আপন ছিল তা বুঝিয়ে দেয়। তখনই অনুভব হয় তাকে ছাড়া জীবন মূল্যহীন, নিরস ও বিবর্ণ। নিকোলাস জীবিত না। ইসাবেলার সান্নিধ্যে ওকে ভুলিয়ে দিয়েছিল সেই কথা। প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে ও সাধারণ মানুষের মতো ভেবেছিল। জীবিত, জীবন্মৃত কোনো কালই ওকে ওই সুখ দেয়নি যে সুখ ইসাবেলা দিয়েছে। আজ ইসাবেলাও নেই, সুখও নেই। নিকোলাস জানত ওর হারানোর ভয় নেই। এই ভুল ধারণার কারণে ইসাবেলাকে হারিয়েছে। একটু যদি সতর্ক হতো। ইসাবেলাকে সাথে করে যদি নিয়ে যেত তবে আজ ও হয়তো বেঁচে থাকত। মৃত্যুর পূর্বরাতের কথা স্মরণ করে নিজেকে তিরস্কারে জর্জরিত করে। কত কষ্ট দিয়েছে ইসাবেলাকে ও। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে ওকে বারবার দূরে ঠেলে মন ভেঙেছে। ওর মৃত্যু দিয়ে কেউ যেন দারুন শোধ নিয়েছে তার। ইসাবেলা আর নেই এই ভাবনা ভেঙেচুরে কুঁজো করেছে ওকে। সবার চোখে আজ ও দুর্বল, করুণারপাত্র। এ ওর শাস্তি। ইসাবেলাকে একা ছেড়ে জার্মানি যাওয়ার, ওকে ব্যথা দেওয়ার শাস্তি পাচ্ছে। নিকোলাস মাথা পেতে নিয়েছে এই শাস্তি। এতেও যদি ইসাবেলাকে ফিরে পাওয়া যেত! যুবকের রক্তপানে দেহে অসীম শক্তি টের পাচ্ছে নিকোলাস। কিন্তু মন! মন যে ভীষণ রুগ্ন, দুর্বল। লোকে ভুল বলে। ভালোবাসা দুর্বলতা নয়। ভালোবাসা শক্তি। নিকোলাস সেই শক্তি হারিয়েছে।

পরদিন গলি দিয়ে যাওয়া কয়েকজন পথচারী ড্রেনের মধ্যে যুবকের লাশ দেখতে পেল। যুদ্ধের এই মুহূর্তে কেউ কাওকে নিয়ে ভাবছে না। যুবকের লাশ নিয়েও ওরা বেশিক্ষণ ভাবল না। নিজেদের গন্তব্যে পা বাড়াল। মানুষ উপেক্ষা করলেও গলির ক্ষুধার্ত কুকুর আর আকাশে উড়ে বেড়ানো শকুনেরা বড়ো আগ্রহ নিয়ে ভিড় জমায় যুবকের লাশের পাশে। সন্ধ্যা হওয়ার আগে লাশটা ওরা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। অন্ধকারে পড়ে থাকে হাড্ডিসার ছিন্নভিন্ন দেহটা। একটু অদূরে একটা কালো ছায়া এদিকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

নিকোলাস আজ আর দুর্গ ছেড়ে বাইরে যায়নি। জানালার পাশে বসে আছে। উদাস চোখে চেয়ে দেখছে টিমে টিমে তারকা খচিত ধূসর আকাশ৷ শুল্ক পক্ষের চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত জানালার বাইরেটা। প্রেমিকের চোখে এই রাত বড়ো মধুর, বড়ো সুন্দর। ঠিক প্রেয়সীর মতো। সুখের অতলে ডুব দেয় ওরা আজকে। কিন্তু নিকোলাসের ভেতরটা শূন্যতায় খা খা করে ওঠে। আনমনে বলে,

“আমি আঁধার, অন্তঃসারশূন্য। অথচ, এতদিন এই শূন্যতা আমি বিন্দুমাত্র টের পাইনি। আজকাল তোমার বিরহ আমায় তা টের পাইয়ে দেয়, বেলা। বড়ো অসহ্য মনে হয় শূন্যতা।”

নিকোলাস এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে ছিল যে, এ রুমে রিচার্ডের উপস্থিতি সহসা টের পেল না। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে রিচার্ড একদৃষ্টে ওকেই দেখছেন। পরশু নিকোলাস বিভৎস এক বৃদ্ধ ছিল। আজ ওর দেহজুড়ে যৌবনশ্রী। আগের মতো পেশিবহুল, সুঠামদেহি যুবক এখন নিকোলাস। রিচার্ডের ঈর্ষা হয়। নিকোলাসকে দুর্বল বৃদ্ধরূপে দেখে এতদিন ভেতরে ভেতরে পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছিলেন। আজ ঠিক তার বিপরীত অনুভব করছেন। কিন্তু সেটা নিকোলাসকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। গলা ঝেড়ে মেকি হেসে বললেন,

“তাহলে ফিরছো কমিউনিটিতে?”

নিকোলাস তাকাল না তাঁর দিকে। জবাবও দিলো না। রিচার্ড আরো কাছে গিয়ে দাঁড়ান।

“তুমি যে কোনো মেয়ের কারণে ট্রাজিক হিরোতে পরিণত হবে এ কিন্তু আশ্চর্যের বটে। মেয়েটার মধ্যে কিছু তো বিশেষ ছিল, নয়তো তোমার মতো কঠিন পাহাড়কে এমন করে টলাবে কার সাধ্য? প্রেমে একেবারে ডুবিয়ে নাকে-মুখে পানি তুলে ছেড়েছে।” শেষটা রসাত্মক সুরে বিড়বিড় করে বললেও নিকোলাস শুনতে পেল। তীব্র চোখে চেয়ে বলল,

“খোঁচা দিতে এসেছেন?”

“না, সে সাহস কী আমার আছে?”

“সাহস? হাসালেন আপনি।” কটাক্ষ করে হাসল নিকোলাস। তারপর বলল, “যে কারণে এসেছেন বলে চলে যান। কারো সঙ্গ এই মুহূর্তে চাচ্ছি না আমি।”

রিচার্ডের মেকি হাসি ম্লান হয়। জোর করে সেটাকে আগের মতো করে বলল,

“শুনলাম পরশুরাতে তোমার ওপর আবার হামলা করেছে ড্যামিয়ান?”

“ড্যামিয়ান? আপনি কী করে জানলেন হামলা ড্যামিয়ানই করেছে?”

একটু যেন বিব্রতবোধ করে রিচার্ড। নিকোলাসের সন্দেহ দৃঢ় হওয়ার আগেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

“তুমি আমার সন্তান নিকোলাস। তোমার চোখে আমি খারাপ পিতা হতে পারি। কিন্তু আমার কাছে তুমি আমার প্রিয় পুত্র।”

“প্রিয় পুত্র? এটা কী কৌতুক ছিল?” ভুরু তুলে বলল নিকোলাস। রিচার্ড রাগত গলায় বললেন,

“প্রেয়সীর মৃত্যু শোকে কমিউনিটির সকলের দায়িত্ব তুমি অবহেলা করতে পারো, কিন্তু আমি সেটা পারি না। গোপনে সব খবরই আমি রেখেছি। তোমার ওপরে করা হামলা ড্যামিয়ান করিয়েছে। প্রথমে তোমাকে তারপর আমাদের সবাইকে ও শেষ করে ফেলতে চায়। তুমি এবং কমিউনিটি দুটোই আমার দায়িত্ব।__”

রিচার্ডের কথা শেষ হয় না। ফোঁস করে ওঠে নিকোলাস,
“এই দায়িত্ব কে দিয়েছে আপনাকে?”

রিচার্ড বললেন,

“কমিউনিটির নিয়ম ভঙ্গ করে আমাকে এই দায়িত্ব নিতে বাধ্য করেছ তুমি। একের পর এক অন্যায় করছ আমাদের সাথে। নিজেকে শত্রুর জন্য সহজলভ্য করে আমাদের বিপদ ডেকে আনছ। তোমার কাছে এটা আমরা আশা করিনি নিকো। যা হোক, এসব কথা তোমাকে বলে লাভ নেই। আমি চিরদিনই তোমার চোখে খারাপলোক। যা বলতে এসেছি তাই বলি। গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি ড্যামিয়ান বর্তমানে রাশিয়ার রিগা শহরে আছে। এই মোক্ষম সুযোগ ওকে শেষ করার।”

নিকোলাসের সন্দিগ্ধ চাহনি দেখে মুখটা মলিন করে রিচার্ড বললেন,

“আমাকে বিশ্বাস না করলে কিছু করার নেই। যা বলার বলেছি এবার সিদ্ধান্ত তোমার। চলি।”

রিচার্ড দরজার কাছাকাছি যেতে নিকোলাস পিছু ডাকল,

“পলকে পাঠিয়ে দেবেন। এতদূরের পথে ওকে ছাড়া আর কাওকে আমি বিশ্বাস করি না।”

রিচার্ড হাসিমুখে তাকাতে নিকোলাস গম্ভীর গলায় বলল,

“আমাকে প্রতারণা করার, মিথ্যা বলার শাস্তি কিন্তু মওকুফ হয় না রিচার্ড। আপনজন ধোঁকা দিলে আমি কতটা নিষ্ঠুর হয়ে যাই তা বোধহয় আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। যান, সময় নষ্ট করবেন না।”

মুখ ঘুরিয়ে আবার আগেরমতো জানালার বাইরে মুখ করে বসল নিকোলাস। রিচার্ড থমথমে মুখে সেখান থেকে প্রস্থান করল।

চলবে,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৩
Writer তানিয়া শেখ

তাশাকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নামল তাতিয়ানা। মেয়েটাকে ঘুম পাড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না। কারণে অকারণে কেঁদে চলে। বিছানায় শায়িত মেয়ের শীর্ণকায় দেহটা দেখল। এই কদিনে আরো যেন শুকিয়ে গেছে ও। ডাক্তার, কবিরাজ কিছু বাদ রাখেনি, কিন্তু ফল শূন্য। ভীষণ চিন্তায় দিন কাটছে তাতিয়ানার। হঠাৎ ওর চোখ চলে গেল জানালার বাইরে। এখান থেকে গেস্টরুমটার জানালা দেখা যাচ্ছে। ওই ঘরে মাতভেই থাকে। ওকে পায়চারি করতে দেখা গেল। হারিকেনের মৃদু আলোতে দেওয়াল ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় তাতিয়ানা। রাত পৌনে বারোটা। এত রাতে পায়চারি করছে কেন মাতভেই? নিশ্চয়ই মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। শব্দ করে হাঁফ ছাড়ল তাতিয়ানা৷ মেরুন রঙের গোলাপি নাইটির রোবটা পরে নিয়ে নিঃশব্দে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সমস্ত বাড়ির ভেতর ভূতুরে নিস্তব্ধতা। বসার ঘরের হারিকেনের সলতে কমিয়ে রাখা হয় রাতে। আবছা আলোতে পায়ে পায়ে হেঁটে গেস্টরুমের দরজার সামনে এসে থামল। হঠাৎ মনে হলো এত রাতে কেন এসেছে এখানে? এই তো মাসখানেক আগেও মাতভেইকে ও চোখে সহ্য করতে পারত না। অথচ, আজ ওকে নিয়ে কত ভাবছে! এই ভাবনা কি দুর্বলতার লক্ষণ নয়? না, আর কোনো পুরুষের প্রতি দুর্বল হবে না ও। ঘুরে দাঁড়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য। দু’পা এগোতে গেস্ট রুমের দরজা খুট করে খুলে গেল। পেছনে মাতভেইর গলা শুনতে পায়।

“অ্যানা!”

নিরুপায় হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় আবার তাতিয়ানা। কী বলবে এখন ও? বেকায়দায় পড়ে গেল। তবুও একটুখানি নার্ভাস হেসে বলল,

“তোমার ঘরে আলো জ্বলতে দেখে___” তাতিয়ানার অস্বস্তি টের পাচ্ছে মাতভেই। ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দরজা পুরো খুলে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল,

“ভেতরে এসো।”

মাতভেইর সৌম্য মুখটার দিকে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে পাশ কেটে ভেতরে ঢুকলো ও। রুমের দরজা ভিজিয়ে পাশ থেকে চেয়ার টেনে মাতভেই বলল,

“বসো।”

তাতিয়ানা বাধ্য মেয়ের মতো বসল চেয়ারটাতে। ওর মুখোমুখি হয়ে বসে মাতভেই। তাতিয়ানা বলল,

“তাশাকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নামতেই তোমার রুমের দিকে চোখ পড়ল। এত রাতে পায়চারি করতে দেখে ভাবলাম নিশ্চয়ই মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করছ। তাই_”

“তাই আমার খোঁজ নিতে এলে?”

কানের পেছনে চুল গুঁজে মাথা নাড়ায় তাতিয়ানা। তারপর হাতদুটো কোলের ওপর রাখল। দৃষ্টি স্থির সেখানে। কেন যে বিচলিত হচ্ছে ও। মাতভেই ওর দিকে অনিমেষ চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তাতিয়ানার আর সহ্য হলো না এই নীরবতা ও মাতভেইর দৃষ্টির তপ্ততা। উঠে দাঁড়ায় হুট করে।

“আমি বরং এখন আসি।”

বলেই দরজার দিকে পা বাড়াল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। আচমকা মাতভেই ওকে টেনে ধরে গভীর চুম্বন দিলো ঠোঁটে। তাতিয়ানা বিস্ময়াহত হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। বিস্ময় কাটতে পায়ের পাতায় ভর করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে মাতভেইর গলা। কিছুসময়ের জন্য ওরা একে অপরকে ছাড়া আর কিছু মনে রাখে না। দুজনের শ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে একসময়। কপালে কপাল রেখে তাতিয়ানার আনত মুখের দিকে তাকায় মাতভেই। ধীরে ধীরে চোখ তোলে তাতিয়ানা। এতক্ষণে যেন ঘোর কাটল ওর। চোখে ভেসে ওঠে নানান অনুভূতি। ঠোঁট আলগা করতে মাতভেইর তর্জনী রেখে বলে,

“প্লিজ, কিছু বলো না অ্যানা।”

তাতিয়ানা বিরোধিতা করতে গিয়েও মাথা নাড়ে। সরে দাঁড়ায় মাতভেইর কাছ থেকে। কী যে হচ্ছে ওর সাথে। ভাবছে এক হচ্ছে আরেক। আবার মাঝে মাঝে ভাবনা চিন্তা ছাড়াই কাজ করছে। এই যে মাতভেই আচমকা চুমু খেয়ে বসল আর ও চুপচাপ তা হতে দিলো? এখানে আসাই ওর উচিত হয়নি। নিজের ওপর রাগ হলো। ওকে ঠোঁট উলটাতে দেখে মাতভেই মুচকি হাসে। ওর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে ঠোঁটের একপাশে চুমু দিয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। এবার আর চুপ থাকল না তাতিয়ানা। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

“তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছো আমি তোমাকে অপছন্দ করি।”

“একদম না।” টেবিলের ওপর রাখা এলোমেলো কাগজ গুছাতে গুছাতে বলল মাতভেই। তাতিয়ানা স্পষ্ট শুনতে পায় মাতভেই হাসি দমানোর চেষ্টা করছে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“বাস্টার্ড, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।”

মাতভেই ঘুরে দাঁড়ায়। এখনও ওর ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। ধীর পায়ে এগিয়ে তাতিয়ানার কাছে গিয়ে বলে,

“আর আমি তোমাকে ভালোবাসি অ্যানা। কেবল তোমাকে এবং সবসময় তোমাকেই ভালোবাসব। তুমি যতবার প্রত্যাখ্যান করবে ততবারই আমি এই একই কথা বলব।”

ক্ষোভে ফুঁসতে লাগল তাতিয়ানা। এত অপমানের পরও কেউ এভাবে ভালোবাসি বলতে পারে? কেন হার মানে না মাতভেই?

“কেন? কেন এত অপমানিত হচ্ছ তুমি? ভুলে যাও আমাকে মাতভেই। তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার।”

“কে বলেছে আমাকে দেওয়ার মতো কিছু নেই তোমার। তাশাকে দিয়েছ তো।”

“আর ভালোবাসা? ওটা চাও না আমার কাছ থেকে?”

মাতভেই ওর মুখটা দুহাতে তুলে বলে,

“ওটা কি চেয়ে পাওয়ার জিনিস? তোমার মনের দরজা আমার জন্য যখন খুলবে আমি ঠিক খুঁজে নেব ওটা।”

“যদি খুঁজে না পাও?”

“পাবো। আমার বিশ্বাস আমি পাবো। বলো, আমার জন্য একটুখানি মনের দরজা খুলবে অ্যানা?”

তাতিয়ানা মুখ নামিয়ে নেয়। কী জবাব দেবে সহসা ভেবে পায় না। মাতভেই হার মানবে না। তাতিয়ানার মুখটা আরো কাছে আনল।

“অ্যানা?”

চোখ তোলে তাতিয়ানা। ছলছল চোখে মাতভেইর চোখে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। খুলে দেয় ভাঙা হৃদয় আগলে রাখা দরজাটা। মাতভেইর চোখে মুখে বিজয়ীর হাসি। বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে তাতিয়ানাকে। তখনই তাশার আর্ত চিৎকারে দুজনে ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায়। ছুটে যায় ওর ঘরের দিকে। বাড়ির সকলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তাতিয়ানার ঘরের কাছাকাছি আসতে কান্নার শব্দ থেমে যায়। ওরা ঘরে ঢুকে দেখল কোথাও তাশা নেই। রুমের জানালা খোলা। তাতিয়ানার স্পষ্ট মনে আছে রাতে জানালা বন্ধ করে দিয়েছিল ও। তাশাকে সকলে যখন হন্যে হয়ে খুঁজছিল, তখনই বাড়ির পেছনের পুকুরপাড় থেকে ওর কান্নার গলা শোনা গেল আবার। ভ্লাদিমি আর মাতভেইর আগে বেরিয়ে এলো। ওদের পেছন পেছন বাড়ির বাকিরা। পুকুরপাড়ে এসে থমকে দাঁড়ায় সকলে। কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে অন্ধকারে পুকুরের পানি হীরের মতো চকচক করছে। ঠিক তার মাঝে ওদের চোখ পড়ল। কেউ যেন ডুবছে। ওরা ভালো করে বুঝে ওঠার আগে পানির বুদবুদ ছেড়ে শূন্যে ভেসে উঠল তাশার ক্ষীণ দেহটা। ওর ভয়ার্ত চিৎকারে রাতের নিস্তব্ধতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়। যেমনভাবে পানির তলা থেকে তাশার দেহটা শূন্যে উঠেছিল তেমন করেই আবার পানির তলায় অদৃশ্য হয়ে যায়। তাতিয়ানা চিৎকার করে সেখানেই জ্ঞান হারায়। ইসাবেলা নিজেকে সামলে নিয়ে বোনকে ধরল। মাতভেই আর ভ্লাদিমির কিছু ভাবার মতো অবস্থায় নেই। এক লাফে পানিতে নেমে এলো ওরা। আন্না মেরিও গলার রোজারিও ধরে ঈশ্বরের নাম জপছিলেন। আর সবার মতোই আতঙ্কিত তিনি। তাশা তার কতটা জুড়ে আছে তা শুধু তিনিই জানেন। অনেক খুঁজাখুজির পর তাশাকে কোলে তুলে পুকুর পাড়ে এলো মাতভেই। ওর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তাশার ফ্যাকাশে শরীর মাটির ওপর রাখা হলো। পেট থেকে পানি বের করার চেষ্টা করছে মাতভেই। তাতিয়ানার জ্ঞান ফিরে এসেছে। তাশার এমন অবস্থা দেখে পাগলের মতো বিলাপ করছে ও। ইসাবেলা কোনোমতে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না ইসাবেলা। তাশা ওদের পরিবারের জান পাখি। ঈশ্বরের কাছে ওর সুস্থতা কামনা করছে ও। বাড়ির চাকর-বাকর, পাড়া প্রতিবেশীরা ভিড় করেছে। সকলের চোখে পানি। মাতভেইর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। কাঁপছে থরথর করে। কাঁপা গলায় বার বার মেয়েকে ডাকছে। অনেকটা পানি পেটে গেছে তাশার। মুখে হাওয়া দিচ্ছে মাতভেই৷ অনেকক্ষণ পর তাশা শ্বাস নিলো। কাশতে কাশতে কেঁদে ওঠে। সকলে সমস্বরে ঈশ্বরের বন্দনা করে উঠল। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে প্রাণ ফিরে পায় যেন মাতভেই। তাতিয়ানা ছুটে এসে ওদের দুজনকে জড়িয়ে ধরল।

সেদিন রাতের পর থেকে একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন এলো তাশার মাঝে। একেবারে চুপ করে গেল তাশা। না কাঁদে আর না কথা বলে। ওর চোখে সারাক্ষণ আতঙ্ক খেলা করছে। প্রথমে বাড়ির সবাই ভেবেছিল হয়তো ভয় পাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে। কিন্তু সকল রকমের চিকিৎসা করানোর পরও অবস্থার উন্নতি হলো না। ওই ঘটনার পর থেকে তাশার প্রতি বাড়ির সবাই খুব বেশি সতর্ক হয়েছে। একা এক মুহূর্তের জন্যেও ওকে কেউ ছাড়ছে না। তাতিয়ানা এসবের জন্য নিজেকে দায়ী করে। সেদিন যদি ওকে একা ছেড়ে না যেত তবে এমনটা হতো না। কিন্তু মাতভেই ওকে বুঝায় এসবে ওর কোনো হাত নেই। সান্ত্বনা দেয় যা হয়েছে সবটাই দুর্ঘটনা। তবুও অনুতাপ যায় না তাতিয়ানার। ইসাবেলা এবং আন্না মেরিও মাতভেইর সাথে একমত নয়। যদিও খোলাখুলি দুজনের কেউ ই সেটা বলেনি। আন্না মেরিও মনে করেন তাশার সাথে ঘটা ওই ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। অশরীরী কোনো ছায়ার হাত রয়েছে এতে। অতটুকু মেয়ে এত রাতে পুকুরপাড়ে যাবে কী করে? এমনভাবে শূন্যেই বা উঠল কেন? গোপনে এ ব্যাপারে চার্চের ফাদারের সাথে আলাপ করেছেন। তাশাকে সুরক্ষার জন্য ফাদার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। আন্না মেরিও তা যথাযথভাবে পালন করছেন।

এদিকে ইসাবেলা সরাসরি অশরীরী নিয়ে ভাবছে না কিংবা মাথায় এই ব্যাপারটা সেভাবে আসেনি। সকলে যখন তাশাকে নিয়ে ঘরে ফিরল হঠাৎ করে ইসাবেলার যেন কিছু মনে পড়ে গেল সেদিন। ফিরে এলো পুকুর পাড়ে। আগের মতো কালো লাগছিল না চাঁদটা। মেঘের ফাঁক দিয়ে সভয়ে বুঝি উঁকি মারছিল সেটা৷ পুকুরের পানি তখনও জ্বলজ্বল করছিল। একটু খেয়াল করতে দেখতে পেল সেই বস্তুটি। বস্তু! না, ঠিক বস্তু নয়। এ যে সেই ফুলের পাপড়ির কয়েকটা। এত ম্লান আলো বেরুচ্ছে ওগুলো থেকে যে সহজে ঠাহর করা যায় না অন্ধকারে। ইসাবেলার বার বার মনে হচ্ছে ওই ফুলটার সাথে তাশার ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে। কিন্তু কী? দিনরাত ভেবেও যেন কূলকিনারা করতে পারছে না।

“বেলা, ঘরে আছিস মা?”

দরজার বাইরে আন্না মেরিওর গলা শুনে জানালার পাশ থেকে সরে এলো ইসাবেলা। জবাব দিলো,

“আছি মা। এসো।”

“কী করছিলি?” ভেতরে ঢুকে বললেন আন্না মেরিও। ইসাবেলা বলল,

“এই বসেছিলাম। কিছু বলবে মা?”

“তোর ছোটো কাকার শরীর শুনেছি ভালো যাচ্ছে না। তাশার এই অবস্থায় সবাই মিলে তাকে দেখতে যাওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তুমি বরং আজ তোমার দাদু দিদাকে নিয়ে কাকাকে দেখে এসো। আমরা কাল পরশু একদিন যাব।”

“ঠিক আছে মা।”

“দুপুর পড়ে এলো। এখনই বেরিয়ে পড়লে ভালো হয়। তুমি তৈরি হয়ে নিচে এসো। ভ্লাদিমিকে বলে গাড়ি বের করাচ্ছি আমি।”

আন্না মেরিও চলে যেতে ইসাবেলা তৈরি হয়ে নিলো। নিচে নেমে দেখল দাদু দিদা ইতোমধ্যে গাড়িতে চড়ে বসেছেন। তাশাকে একবার দেখতে গেল। ঘুমিয়ে আছে ও। পাশে তাতিয়ানা ঝিমাচ্ছে। মেয়ের চিন্তায় ওর খাওয়া ঘুম হারাম হওয়ার উপায়। মাতভেই নিঃশব্দে রুমে ঢুকলো। ওর মুখটা আরও শুকিয়ে গেছে। ইসাবেলাকে দেখে তবুও ম্লান হাসল। তাতিয়ানা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে পড়ে যাচ্ছিল। মাতভেই ওর মাথাটা আলগোছে কাঁধের ওপর রাখে। এত দুশ্চিন্তা, দুঃখের মাঝেও ইসাবেলার বড়ো ভালো লাগল এই দৃশ্য দেখে।

ইসাবেলার ছোটো কাকার বাড়ি প্রায় মাইল খানেক দূরে। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। কাকার পেটের রোগ আছে। ইদানীং সমস্যা প্রকট হয়েছে। কাকা-কাকির সাথে কথা বলে ইসাবেলা ছোটো তিন কাজিনকে সাথে করে বাড়ির পাশের ছোট্ট বাগানে এসে বসল। ওর কাজিনদের একজন ওর সমবয়সী যুবতি। বাকি দুজন বালক। বালক দুটোর একটা আবার ভীষণ চঞ্চল। একস্থানে বসে বসে আড্ডা দেওয়া ওর ঠিক জমে না। জেদ করতে শুরু করল ফার্মে যাবে৷ ওর প্রিয় ঘোড়াটাকে এখন যে করেই দেখবে ও। ইসাবেলাও অনেকদিন কাকার ফার্ম দেখেনি। কত রকমের পশু-পাখি পালা হয় সেখানে! ইসাবেলা রাজি হলো যেতে। ফার্মের কাছাকাছি যেতে বালক দুজন এক ছুটে সেখানে ঢুকে পড়ল। ইসাবেলার সমবয়সী কাজিনটাও ভাইদের সতর্ক করতে করতে ছুটল পেছনে। ওদের দেখে নিজের ছোটোবেলা মনে পড়ে গেল ইসাবেলার। মুচকি হাসতে হাসতে ফার্মের গেটের দিকে পা বাড়ায়। এমন সময় পাশের রাস্তা দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি গেল। সবই ঠিক ছিল যতক্ষণ না নাকে এসে লাগল সেই পরিচিত গন্ধটা। ইসাবেলার সর্ব শরীর মুহূর্তের জন্য জমে যায় বরফের ন্যায়। ঘোড়া দুটো বিকট শব্দে হ্রেষাধ্বনি তুলে থেমে গেল কিছুদূর গিয়ে রাস্তার ওপর। ইসাবেলার বুক ঢিপঢিপ করছে। ধীরে ধীরে ঘোড়ার গাড়িটির দিকে ফিরল ও। মন চাচ্ছে এক ছুটে গাড়িটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে৷ কিন্তু পা যে নড়ছে না৷ অবশেষে কি ওর বিরহের অবসান ঘটবে আজ? ঠোঁট কাঁপছে ভেতর থেকে ঠেলে আসা কান্নায়। এই যে সুখের ক্রন্দন। আকাশে গোধূলির রঙ মুছে গিয়ে দিকে দিকে আঁধার ছড়াতে লাগল। যত এগোচ্ছে ততই সোঁদা মাটির গন্ধ তীব্র হয়ে নাকে এসে লাগছে ইসাবেলার। গাড়ির কাছাকাছি যেতে দুটো পা বেরিয়ে এলো গাড়ির বাইরে। ইসাবেলা থমকে দাঁড়ায়। বলিষ্ঠ, দিঘল দেহটা গাড়ি ছেড়ে বাইরে নামল। দাঁড়াল ইসাবেলার সামনে। ওর মুখের ওপর সন্ধ্যার আঁধার জমে আছে। ইসাবেলা মুখ না দেখলেও চিনতে পারে নিকোলাসকে। আঁধার ঠেলে এগিয়ে এলো নিকোলাস। ইসাবেলা ছুটল ওর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে, কিন্তু নিকোলাস অদৃশ্য হয়ে যায়। মুখ থুবড়ে রাস্তার ওপর পড়ল ইসাবেলা। আহত সিক্ত চোখজোড়া তুলতে নিকোলাসকে আবার সামনে দেখতে পেল। নিস্প্রভ চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ ওর দিকে নিকোলাস। তারপর ইসাবেলা ওকে বলতে শুনল,

“তুমি আমার হৃদয় ভেঙেছ, বেলা। তুমি আমার হৃদয় ভেঙেছ।”

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৪
Writer তানিয়া শেখ

পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়েছে। ঘোড়ার গাড়ির কোচওয়ানের সিটে বসে আছে পল। দৃষ্টি স্থির সামনের পথের দিকে। ঘোড়াগুলোর দৌড় বাড়াতে হাতের চাবুকটা সপাং করে মারল ওদের পিঠে৷ তীব্র আর্তনাদ করে ওগুলো আরও জোরে ছুটতে লাগল। গাড়ির ভেতরে আধশোয়া হয়ে বসা নিকোলাস। চোখদুটো স্থির, নির্জীব। কিছুদূর গিয়ে পল বলে উঠল,

“মালিক, রিগা পৌঁছে গিয়েছি আমরা।”

“রিগা!” নিকোলাসের নির্জীব, স্থির দৃষ্টির বদলে যায়। জানালার বাইরে তাকায় উজ্জ্বল চোখে। গোধূলির রঙ ছড়িয়েছে আকাশে। গাড়ির গতির জন্য দ্রুত সরে যাচ্ছে আশপাশের স্থান। এই শহর ওর প্রেয়সীর জন্মস্থান। এ কারনেই এখন শহরটাকে এত আপন মনে হচ্ছে। এই শহরের বাতাসে কী এখনও ইসাবেলার গায়ের গন্ধ মিশে আছে? নিকোলাস লম্বা শ্বাস টানলো। ইসাবেলাকে হারানোর ব্যথা এই মুহূর্তে তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। ব্যথাতুর কণ্ঠে উচ্চারণ করে,

“আমি এসেছি তোমার শহরে, বেলা। এই শহরের বাতাসে খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমার ঘ্রাণ। তোমার জন্মভূমির আকাশতলে তুমি হীন ভগ্ন হৃদয়ে উদভ্রান্তের মতো ঘুরছি আমি। বেলা, বেলা, ফিরে এসো আমার কাছে। যদি মানুষ না হয়ে পারো তবে বাতাস হয়ে হলেও ফিরে এসো। আমি ছুঁয়ে দেখতে না পারি অনুভব তো করতে পারব। সেই বা কম কীসের?”

নিকোলাস বোঝে এই কথাগুলো কেবল কথা হয়েই থাকবে৷ সত্যি হবে না। এই বুঝ ওকে আরও ভাঙে। অসাড় হয়ে আসে সমস্ত শরীর। গা এলিয়ে দেয় সিটে। চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হঠাৎ ওর নাকে পরিচিত সেই সুবাস এসে লাগতে চকিতে তাকাল। প্রথমে মনের ভুল ভেবেছিল। কিন্তু তা নয়। বারকয়েক নাক টানতে সুবাসটার সত্যতা প্রমাণিত হলো। আনন্দে খানিক সময়ের জন্য স্তব্ধ মেরে বসে রইল। ইসাবেলা কী বাতাস হয়ে ফিরল ওর কাছে? সত্যি ফিরল?

“পল, গাড়ি থামা। এক্ষুনি।” কাঁপছিল নিকোলাসের গলার স্বর। পল দ্রুত ঘোড়ার লাগাম টানলো। মনিবের এহেন আচরণে অবাক কম হয়নি ও। নিকোলাস নেমে দাঁড়াতে ও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখতে পেল তখনই। ভালো করে দেখতে মেয়েটাকে চিনতে পারল।

“ইসাবেলা!” পল যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। থ মেরে বসে রইল সেখানে।

নিকোলাসের মনের নানান আশঙ্কা এক নিমেষে দূর হয়ে গেল অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা নারীমূর্তিটিকে দেখে। নিশ্চিত হলো ও। বাতাস নয় মানুষ রূপে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে ইসাবেলা। এ কী ওর চোখের ভ্রম? ইসাবেলা এগিয়ে এলো। ভ্রম নয়। এ যে ওর ইসাবেলা। নিকোলাসের আনন্দের সীমা থাকে না। পা বাড়ায় ওকে কাছে টানার জন্য। কিন্তু থেমে যায়। আন্দ্রেই যে বলেছিল ইসাবেলা আগুনে পুড়ে মরেছে। আন্দ্রেই মিথ্যা বলেছিল? কেন বলবে এতবড়ো মিথ্যা? ইসাবেলা ছুটে এলো ওকে জড়িয়ে ধরতে। নিকোলাস অদৃশ্য হয়ে যায়। ইসাবেলা কি জেনেশুনে নিকোলাসকে ত্যাগ করেছিল? ইসাবেলা আহত মুখে চেয়ে আছে ওর দিকে। নিকোলাসের ভাবনা বিক্ষিপ্ত। ভেতরের পিশাচটা বার বার বলছে,
“প্রতারিত হয়েছিস তুই। বেলা তোর সাথে প্রতারণা করেছে।”
ক্ষোভে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল নিকোলাস। কিছু বুঝার আগেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,

“তুমি আমার হৃদয় ভেঙেছ, বেলা। তুমি আমার হৃদয় ভেঙেছ।”

ওর কথার মানে বুঝতে সময় লাগল ইসাবেলার। যখন বুঝল লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

“না, না, আমি তোমাকে ভালোবাসি নিকোলাস। খুব ভালোবাসি।”

ইসাবেলা জড়িয়ে ধরলো ওকে শক্ত করে।নিকোলাসের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে ও৷ ওর দু বাহু ধরে টেনে নিজের থেকে সরিয়ে সরে দাঁড়ায় নিকোলাস। ইসাবেলার মুখ থেকে ভালোবাসি শোনার পর নিকোলাসের রাগ সামান্য কমলো। ক্ষুব্ধ মুখটা শান্ত হলো। চেয়ে রইল ওর চোখে একদৃষ্টে। কোনো ছল নেই, মিথ্যা নেই সেখানে। ইসাবেলা ক্রন্দনরত অবস্থায় আবার এগিয়ে এলো। নিকোলাসের রাগ বড়ো নির্মম। ইসাবেলার ভয় করছে। না, মৃত্যুর ভয় নয়। এত কাছে পেয়ে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভীত ও। সভয়ে নিকোলাসের ডান হাতটা ধরলো। নিকোলাস এখনও চুপচাপ চেয়ে আছে ওর দিকে। ইসাবেলা বলল,

“আমি তোমাকে ধোঁকা দিইনি নিকোলাস। বিশ্বাস করো আমাকে৷”

“বিশ্বাস! আমার স্থানে থাকলে তুমি করতে?”

নিকোলাস হাত ছাড়িয়ে ওর হাতটা শক্ত করে ধরলো। যেন সামান্য ঢিল দিলে ছুটে পালিয়ে যাবে ইসাবেলা। নিকোলাস অজান্তেই ইসাবেলাকে ব্যথা দিচ্ছে। ইসাবেলা তা বুঝতে দিলে তো?

“বিশ্বাস করাও আমাকে বেলা। বিশ্বাস করাও আমাকে তুমি ধোঁকা দেওনি। বিশ্বাস করাও এইমাত্র যা বলেছ সবটা সত্যি। তুমি আমাকে ভালোবাসো এ কথা সত্যি। বিশ্বাস করাও বেলা।” বলল নিকোলাস।

ইসাবেলা মাথা নিচু করে বলতে শুরু করল,

“সেদিন অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছিল বেনাসের বাড়িতে। আমি আর মাতভেই রুমে বসে মাদামের অপেক্ষা করছিলাম। শেষ প্রহরে মাদাম ফিরলেন, কিন্তু মুমূর্ষু অবস্থায়। মাতভেইর কোলেই প্রাণ ত্যাগ করলেন মাদাম।” তারপর সেই ফুলের ব্যাপারটা বলল। নিকোলাস মনোযোগ দিয়ে শুনছে ওর কথা। ইসাবেলা বলল,

“পুরো বাড়িতে আগুন ধরে গেল মুহূর্তে। মাতভেইকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।”

মাতভেইর নাম শুনে নিকোলাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ইসাবেলা টের পেয়ে বলল,

“ও আমার বোনের সন্তানের বাবা, নিকোলাস। তাতিয়ানাকে খুব ভালোবাসে মাতভেই। আমি ওদের এক করতে চেয়েছিলাম।”

“ওদের এক করতে গিয়ে আমাকে আলাদা করে এসেছিলে?”

“নিকোলাস!”

“জবাব দাও, বেলা।”

“আমার যে আর উপায় ছিল না তখন। বেনাসের বাড়ি আগুনে জ্বলছিল। জ্বলছিল ওরা সবাই। অজানা এক বিপদ আমাদের মাথার ওপর। তুমি সেখানে ছিলে না। কী করব বুঝতে পারছিলাম না আমি। মাতভেইকে বিপদমুক্ত করতে সেই মুহূর্তে ওই স্থান ত্যাগ ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না আমার নিকোলাস। আমি তোমাকে ওভাবে ছেড়ে আসতে চাইনি। ওখানকার অবস্থা তোমার অজানা নয়। চারিদিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা। রাস্তায় জার্মান আর্মির টহল। আমাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা ছিল না। মাতভেই বলল রিগা রওয়ানা দিলে ভালো হবে। আমি অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম বিশ্বাস করো। কিন্তু,,।”
ইসাবেলা এক হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। আর যে মিথ্যা বলতে পারছে না ও। আন্দ্রেইর কথা বলা সহজ হলেও ইসাবেলা বলল না। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না। নিকোলাস আন্দ্রেইকে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ইসাবেলা নতুন করে ওর মন ভাঙতে পারবে না।
“তুমিহীন এক মুহূর্ত আমার নরকসম ছিল নিকোলাস। আমার প্রতি প্রহরের অপেক্ষায় তুমি ছিলে। আমি তোমাকে ভালোবাসি নিকোলাস, সত্যিই ভালোবাসি।”

নিকোলাস ওর হাত ছেড়ে দেয়। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে ইসাবেলার কিছু লুকাচ্ছে। কী লুকাচ্ছে নিকোলাসকে জানতে হবে। অনেক প্রশ্নের উদয় হয় মনে৷ কিন্তু এখনই প্রশ্নগুলো করল না। তবে এখন ও এইটুকু নিশ্চিত হলো ইসাবেলা ওকে ধোঁকা দেয়নি। পুরোপুরি সত্যিও বলছে না। মুখ থেকে ওর হাতটা সরিয়ে নেয়। কেঁদে মুখ লাল করে ফেলেছে ইসাবেলা। হিচকি উঠছে। নিকোলাস আঁজলা ভরে ওর মুখটা তুললো। বৃদ্ধাঙুলে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। এই মেয়েটাকে ফিরে পাওয়ার জন্য কতই না ব্যাকুল হয়েছিল। আর ওকেই কি না এভাবে কাঁদাচ্ছে? মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করল নিকোলাস।
ইসাবেলা সম্মোহনী চোখে চেয়ে আছে। ধীরে ধীরে মুখটা কাছে আনল। দু জোড়া ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিৎ দুরত্ব। ওইটুকু ঘুচাতে চাইল ইসাবেলা। নিকোলাস হঠাৎই সরে দাঁড়ায়। ইসাবেলা এমনটা আশা করেনি। আহত মুখটা লজ্জায় নামিয়ে নিলো। ছলছল করে উঠল চোখ। ভগ্ন কণ্ঠে বলল,
“তুমি এখন আর চাও না আমাকে নিকোলাস?”

নিকোলাস চুপচাপ ওকে দেখছে। এই তো একটু আগেও এই মেয়েটিকে ফিরে পাওয়ার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে ছিল। এখন কাছে পেয়ে বার বার দূরে ঠেলে দিচ্ছে? নিকোলাসের দৃষ্টি স্থির হয় ইসাবেলা কম্পিত ঠোঁটের ওপর। ইসাবেলার ঠোঁটের আহ্বান উপেক্ষা করা সহজ ছিল না ওর জন্য। ওইটুকু নিয়ন্ত্রণ ইসাবেলার ভালোর জন্য ছিল। রক্তাক্ত ঠোঁট কিংবা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চায়নি বলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এতদিনের বিরহ এবং ইসাবেলার ভালোবাসা প্রকাশের পর ওকে না ছুঁয়ে থাকা একপ্রকার টর্চার ছাড়া কিছু না। ইসাবেলা ফুলের ন্যায়৷ যাকে আদর-আহ্লাদে, যত্নে, বড়ো কোমলভাবে ভালো না বাসলে বুঝি মূর্ছা যাবে। তাই কি হতে দিতে পারে নিকোলাস? অথচ, বোকা মেয়েটি ভাবছে ওকে নিকোলাস চায় না। ওকে যে নিকোলাস কতটা চায় তা শীঘ্রই বুঝিয়ে দেবে।

ইসাবেলা ওর জবাব না পেয়ে বলে,

“বুঝেছি। তোমার আর দোষ কী? এমন ভীরু, দুর্বল মেয়েকে কেই বা চাইবে? যে সামান্যতেই হার মেনে পালিয়ে আসে তাকে না চাওয়াই উচিত। ভালোবাসার জন্য লড়তে না জানলে তার ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই। তোমাকে পাওয়ার অধিকার আমারও নেই।”

ইসাবেলা বহুকষ্টে কান্না সংবরণ করে। নিকোলাস ওর থুতনি তুলে বলল,

“খবরদার যদি বলেছ আমাকে পাওয়ার অধিকার তোমায় নেই! আমি তোমার বেলা। একান্তই তোমার।”

নিকোলাস ওকে বুকে জড়িয়ে নিলো। ইসাবেলা পরম শান্তিতে ওর বুকে মাথা রাখে৷ আন্দ্রেই হেরে গেছে আজ। ইসাবেলা আবার ফিরে পেয়েছে নিকোলাসকে। ওর ভালোবাসা জয়ী হয়েছে আজ।এবার মৃত্যু ছাড়া আর কিছুতেই নিকোলাসের থেকে আলাদা হবে না ও। দু’ফোঁটা সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল চোখ দিয়ে। শুনতে পাচ্ছে নিকোলাসের হৃৎস্পন্দন তীব্র গতিতে বাজছে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে বেজে চলছে ওর নিজের হৃৎস্পন্দনও। হাত রাখল নিকোলাসের বা’পাশের বুকের ওপর।

“নিকোলাস।”

“হুম?”

“উম,,একটা চুমু খাবে?” বলেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠল। নিকোলাস মুচকি হেসে বলল,

“না।”

লজ্জা এবার অভিমানে রূপ নিলো। হঠাৎ কাজিনের ডাকে চমকে ওঠে ইসাবেলা। ভুলেই গিয়েছিল ওদের কথা। তাড়াতাড়ি নিকোলাসের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। ওর সমবয়সী কাজিন কৌতূহলে চেয়ে আছে ওদের দিকে। মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো ওর ছোটো ভাই। অচেনা পুরুষকে জড়িয়ে ধরতে দেখে ছেলেটিই ইসাবেলার নাম ধরে ডেকেছে। নিকোলাস মুখ নামিয়ে আনল ওর কানের কাছে।

“এবার বলো, খাবো চুমু?”

ইসাবেলা লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল।

“না, না।” ঠোঁটের ওপর হাত চেপে ধরে সজোরে মাথা নাড়াতে হো হো করে হেসে উঠল নিকোলাস। লজ্জায় অধোবদন হয়ে যায় ইসাবেলা। নিকোলাস হাসি থামিয়ে কপালে চুমো দিয়ে বলল,

“যাও, রাতে দেখা করতে আসব।”

এক চোখ টিপে মুচকি হাসতে হাসতে গাড়ির দিকে চলে গেল নিকোলাস। গাড়িতে ওঠার আগে আরেকবার ইসাবেলার দিকে তাকায়। ইসাবেলা লাজুক মুখে হাসল। গাড়ি দৃষ্টিসীমার আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল ও।

“যুবকটি কে?” জানতে চাইল ওর কাজিন। ইসাবেলার ঠোঁটের কোণে তখনও লেগে আছে প্রসন্ন হাসি। ও বলল,

“তোমার দুলাভাই।”

“হুঁ?”

“উম, না মানে আমার পরিচিত একজন।”

“পরিচিত না পরম আপনজন, হুম? আর হ্যাঁ, প্রথমটা কিন্তু শুনেছি আমি।”

“তোমার শ্রবণশক্তি খুব প্রখর। কাজিনদের শ্রবণশক্তি এত প্রখর হওয়া উচিত না।”

ইসাবেলা মেয়েটির কানের কাছে মুখ এনে আচমকা উচ্চৈঃস্বরে গান শুরু করে দেয়।

“ইসাবেল, ঈশ্বরের দোহাই এত জোরে গান গাওয়া বন্ধ করো। হায়! আমার শ্রবণশক্তি।”

মেয়েটি দু’হাতে কান বন্ধ করে ওকে থামাতে ব্যর্থ হয়ে বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগল। ইসাবেলাকে বহুদিন পর এমন পাগলামি করতে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে ও। ইসাবেলা কিন্তু ওর পিছু ছাড়ল না। মেয়েটির দুই ভাই এই দৃশ্য দেখে ভারি মজা পায়। হেসে গড়াগড়ি খায় ওরা।

চলবে,,,

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ