Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"তিমিরে ফোটা গোলাপতিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৫০+৫১+৫২

তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৫০+৫১+৫২

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫০
Writer তানিয়া শেখ

মাতভেই কদিন ধরে লক্ষ্য করছে ইসাবেলা গুম মেরে আছে। সারাদিন কী যেন ভাবে। মুখশ্রীতে রাজ্যের বিষণ্নতার প্রলেপ পড়েছে। মেয়েটা শান্ত শিষ্ট হলেও একেবারে নির্বাক মূর্তির মতো থাকে না। মাতভেইর সাথে গল্প করতে বসলে চঞ্চলা কিশোরি হয়ে ওঠে। আজকাল ও আর তেমন কথা বলছে না। বেনাসের মেয়ে আর ওর দাসীর সাথেও আগে বেশ মিশতো, সময় কাটাতো। এখন রুম ছেড়েই বেরোচ্ছে না। ওরা ডাকলেও অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে শুয়ে আছে রুমের এককোনায়। অসুস্থ ও ঠিকই, কিন্তু রোগটা দেহের থেকে মনের বলে মনে হচ্ছে বেশি। প্রশ্ন করলে মলিন মুখে হেসে ভিন্ন কথা তোলে। যেন এড়িয়ে যেতে চায় প্রশ্নের জবাব। শুধু মাতভেই নয়, মাদাম আদলৌনাও ইসাবেলার এই পরিবর্তন খেয়াল করেছেন। আজও ভিক্টোরিজা ডেকে পাঠাল ইসাবেলাকে। বাড়ির মালিকের মেয়ের ডাক প্রতিদিন তো আর উপেক্ষা করতে পারবে না। ইসাবেলা যেতে মাদাম ছেলেকে বললেন,

“ইসাবেল যেন কেমন চুপচাপ হয়ে আছে, খেয়াল করেছ?”

মাতভেই মৃদুভাবে মাথা নাড়ায়। মাদাম হাতের শুকনো কাপড়টা ভাঁজ করে বললেন,

“আমি কাল জিজ্ঞেস করছিলাম। বলল, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ডাক্তার দেখানোর কথা তুলতে বলল, দুদিন পর এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। মেয়েটাকে মাঝে মাঝে আমি বুঝে উঠি না। মনে হয় কত সরল আবার পরক্ষণেই দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে ও।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মাদাম। কাপড়গুলো একপাশে রেখে রান্নাঘরে ফিরে গেলেন। মাতভেই একা বসে রইল বিছানার ওপর। হাতে একটা কবিতার বই। বইটা আর পড়া হলো না। এই ক্ষুদ্র জানালা বিশিষ্ট খুপরি মতো রুমে দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে বসে মাতভেইর মন এমনিতেই ভার হয়ে আছে। ইসাবেলার ভাবুক, বিষণ্ণ মুখ আর শূন্য চাহনি ওর ভেতরের ভারকে আরো ভারী করে তোলে।

প্রায় মিনিট পনেরো পর ইসাবেলা ফিরে এলো। দরজা খুলে এক চিলতে শুকনো হাসি হাসল মাতভেইর চোখে চোখ পড়তে। তারপর নিচে পাতা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। এইটুকু আসতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। ওর পিঠ মাতভেইর দিকে। দুটো মানুষ এই ছোট্ট রুমে, অথচ কঠিন এক নীরবতা নামে সেখানে। অসহ্য লাগল মাতভেইর। কথা বলার জন্য ছটফট করে ওঠে।

“বেল?”

“হুঁ?” পাশ ফিরল না ইসাবেলা। মাতভেই পা টেনে ওর দিকে ঘুরে বসল।

“কী হয়েছে তোমার, বেল? মিথ্যা বোলো না কিছু হয়নি। আমি জানি__”

“পাপ! কোনো স্বাভাবিক মানুষ কি জেনেশুনে পাপকে ভালোবাসতে পারে মাতভেই?”

ইসাবেলা সোজা হয়ে শোয়। ওর দৃষ্টি সিলিংএ স্থির। মাতভেই কিছুক্ষণ চুপ করে বলল,

“ভালোবাসা কি পাপপুণ্য দেখে, বেল? ভালোবাসা কেবল ভালোবেসে যায়। এ হচ্ছে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। বাচবিচার করা তো মস্তিষ্কের কাজ।”

ইসাবেলা চুপ করে রইল আবার। মাতভেই ওকে ঠিক বুঝে উঠছে না। হঠাৎ এ ধরনের কথা কেন বলছে? কিন্তু ওর মধ্যকার হতাশা ও আন্দাজ করতে পারে।

“বেল, কাছে এসো।” হাত বাড়িয়ে ডাকল মাতভেই। ইসাবেলা ওর হাতের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর উঠে এসে বসল বিছানার পাশের মেঝেতে, ঠিক মাতভেইর সামনে। মাতভেই ওর মাথার ওপর হাত রেখে পরম স্নেহের সাথে শুধায়,

“কেন এমন হয়ে যাচ্ছো? কোন কারণে এত বিষণ্ণতা তোমার মধ্যে? তোমার এই নীরবতা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, বেল। বোলো না কী হয়েছে?”

ছলছল করে ওঠে ইসাবেলার দুচোখ। ঠোঁট প্রকম্পিত হয়। মাতভেইর হাতটা মাথার ওপর থেকে এনে দুহাতের মাঝে নিলো। মুখটা হাতের ওপর রেখে অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল,

“আচ্ছা মাতভেই, ধরো কেউ এমন একজনকে ভালোবাসে যাকে এই সমাজ, ধর্ম স্বীকৃতি দেবে না। তার পরিবার মেনে নেবে না। তার মস্তিষ্ক বার বার সাবধান করছে, ও ঠিক নয় ওর জন্য। যে পুরুষের, যে জীবনের স্বপ্ন ও আজীবন দেখে এসেছে ও সে নয়। ও এক ঈশ্বরদ্রোহী, অভিশপ্ত প্রাণ। কিন্তু হৃদয় বলছে ভিন্ন কথা। সে সমাজ, ধর্ম মানতে নারাজ। সে পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে রাজি ওই মানুষটার জন্য, এমনকি ওই স্বপ্নগুলোও ভুলতে চায় যা ও এতদিন দেখে এসেছে। স্বেচ্ছায় পাপের বিষ গ্রহন করতে রাজি আজ সে। অভিশপ্ত হওয়ার ভয়ও আজ আর নেই। মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের এই শীতল যুদ্ধে সেই মানুষটা বড্ড কাহিল হয়ে আছে মাতভেই। কিছুতেই বুঝতে পারছে না কার পক্ষ নেবে। একদিকে ধর্ম, পরিবার, সমাজ অন্যদিকে ভালোবাসা। বিষম এই দোটানায় পড়লে তুমি কি করতে মাতভেই? কোন পক্ষকে বেছে নিতে?”

মাতভেই ওর কথাগুলো ভাবল চুপচাপ। ইসাবেলা দুচোখ মুদে আছে। নীরবতা ভেঙে মাতভেই বলল,

“যে ভালোবাসা আমাকে আমার আপনজন, ধর্ম ও আপন স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার পক্ষ আমি নেবো না, বেল। হৃদয় সবসময়ই অবুঝ হয়। ইতিহাস সাক্ষী, এই অবুঝ, একগুঁয়ে হৃদয়টার কারণে কত প্রেমিক উন্মাদ হয়েছে, কত প্রেমিকা বিষে বিষাক্ত হয়ে ত্যাগ করেছে প্রাণ বায়ু। এক ভালোবাসার কারণে তাঁরা সব ভুলেছে। এমনকি নিজেকেও। আমি চাই তুমি অবুঝ হৃদয়ের কথা শুনবে না বেল। তোমার মস্তিষ্ক যা বলছে তাই ঠিক। ও তোমার জন্য ঠিক নয়।”

মাথা তুলে তাকাল ইসাবেলা। মুখ জুড়ে অপ্রসন্ন অপ্রস্তুতভাব। মাতভেই হাতটা আবার ওর মাথায় রাখল।

“আমি জানি, এতক্ষণ যার কথা বলছিলে সেই মানুষটা তুমিই।”

“আমি এখন কী করব মাতভেই? তুমি বলছ মস্তিষ্কের কথা শুনতে। মস্তিষ্ক বলছে ও আমার জন্য ঠিক নয়, কিন্তু ওকে ছাড়া আমার পৃথিবী যে শূন্য মনে হয়। বেঁচে থাকাটা অর্থহীন লাগে। আমার বড়ো কষ্ট হচ্ছে মাতভেই। দমবন্ধ হয়ে আসছে। ভগ্নহৃদয়ে বেঁচে থাকা মৃত্যুসম মাতভেই, মৃত্যুসম।”

ইসাবেলা চোখের পানি ছেড়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। মাতভেইর বড়ো খারাপ লাগল ইসাবেলার দুরবস্থা দেখে। গভীর ভাবনায় বুঁদ হলো। ইসাবেলার নীরব কান্না আস্তে আস্তে শব্দ সৃষ্টি করে। বড়ো অসহায় লাগছে ওর। জীবন এত জটিল কেন? কেন ভালোবাসতে গিয়ে ও এত ব্যথা পায়। ভালোবাসাতে কি সুখ নেই? মাতভেইর হাতের স্পর্শে সিক্ত চোখে তাকাল। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চোখ মুছে দেয় মাতভেই। ইসাবেলার ডান হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল,

“আমিও প্রেমিক। প্রেমের পক্ষে থাকা উচিত আমার। তুমি পবিত্রপ্রাণা, সরলা ও নিষ্পাপ, বেল। যে ভালোবাসা তোমার পবিত্রতা, সরলতা আর নিষ্পাপতা ক্ষুণ্ণ করে তার পক্ষ নেওয়ার পরামর্শ আমি কিছুতেই দিতে পারি না। তবে হ্যাঁ, তাকে যদি শুধরানোর কোনো পথ থাকে তবে একটা পথ আমি দেখি। ভালোবাসা পবিত্র অনুভূতি বেল। লোকে বলে ভালোবাসা স্বয়ং ঈশ্বর। ঈশ্বরের ক্ষমতা অপরিসীম। তিনি সব অসাধ্য সাধন করতে পারেন। ভালোবাসাও এই একই গুনে গুণান্বিত। তুমি কি তাকে তোমার ভালোবাসা দিয়ে বদলাতে পারবে, বেল? তোমার পবিত্র, নিষ্পাপ ভালোবাসা দিয়ে তার পাপ ও শাপমোচন করতে পারবে? যদি এই দৃঢ়তা থাকে তবে আমি বলব, ভালোবাসো তাকে। সব ত্যাগ করে নয়, সব একপাশে রেখে কেবল তাকেই প্রাধান্য দাও। অতীতে যে স্বপ্ন তুমি দেখেছিলে, আজ ওই ব্যক্তিটাকে সেই স্বপ্ন বানিয়ে নাও। স্বপ্ন দেখলেই কিন্তু পূরণ হয় না, বেল। স্বপ্ন পূরণ করতে ধৈর্য, একাগ্রতা, সাধনার ভীষণ দরকার হয়। স্বপ্ন পর্যন্ত পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হবে শতসহস্র কণ্টকাকীর্ণ পথ।”

“সব পারব মাতভেই। নিকোলাসের পাপ ও শাপমোচন করতে এবং ওকে আমার করতে আমি সব পারব। আমি ওকে আমার প্রিয় স্বপ্ন বানিয়ে নেব। সেই স্বপ্ন পূরণে যে কোনো কঠিন পথ পাড়ি দিতে রাজি। তুমি ঠিকই বলেছ, ভালোবাসা ঈশ্বরের আরেক রূপ। ভালোবাসা সব পারে। আমি প্রমাণ করে দেবো সেটা।”

“নিকোলাস, এই তার নাম তাহলে?”

ইসাবেলা লজ্জায় অধোবদন হয়ে যায়। মাতভেই মুচকি হাসল।

“আমাকে বলবে না তার সম্পর্কে?”

“এখন না।”

“কেন?”

“কারণ এখন আমি অন্য একজনের কথা বলব। তোমার জনের।” চোখে তুলে তাকাল ইসাবেলা। মাতভেই ভুরু কুঁচকে বলল,

“আমার জনের?”

“হ্যাঁ, ওর নাম তাতিয়ানা, মাতভেই। আমার বড়ো বোন তাতিয়ানা।”

বিস্ময়াহত হয়ে যায় মাতভেই। গলা দিয়ে সহসা কথা বেরোলো না। কোনো রকমে বলল,

“কীভাবে বুঝলে?”

“ওই যে সেদিন ছবি দেখালে। ওই ছবি দেখেই চিনেছিলাম৷ সেদিন তোমাকে বলতে পারিনি। ভেবেছিলাম সময় সুযোগে বলব। তোমার ভালোবাসার মানুষটিই আমার বড়ো তাতিয়ানা, মাতভেই।”

প্রিয়তমার সন্ধান পাওয়ার আনন্দে ভাষা হারিয়ে বসে মাতভেই। ওর চোখের কোণে জমা হতে থাকে অশ্রু। অবশেষে সে প্রিয়তমার সন্ধান পেল! কিন্তু পরক্ষণেই নিজের অবস্থার কথা ভেবে শঙ্কিত হয়। তাতিয়ানা কি মেনে নেবে এই অবস্থায় ওকে? ইসাবেলার নজর এড়ায় না সেই শঙ্কা। শক্ত করে মাতভেইর হাতটা ধরে। কিছু বলবে তখনই দরজা খুলে গেল। মাদাম আদলৌনাকে রুমে ঢুকতে দেখে হাত ছাড়িয়ে নেয় মাতভেই। মাকে ও তাতিয়ানার কথা বলেনি। এখনো প্রস্তুত নয় বলার জন্য। ইসাবেলা ওর মুখ দেখে বুঝতে পারল বোধহয়। উঠে দাঁড়ায় ও। মাদাম আদলৌনা ওদের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ইসাবেলা হেসে এগিয়ে এসে বলল,

“আমার একটু দরকার ছিল জুজানির সাথে। আমি আসছি।”

ও যেতে মাদাম আদলৌনা ছেলেকে দেখলেন। নির্নিমেষ চোখে চেয়ে আছে সামনে।

“কিছু কি হয়েছে বাবা?”

“না তো।”

গলা ঝেড়ে জবাব দিলো মাতভেই। দরজার বাইরে একজন চাকর মাদামকে ডাকলেন। বাড়ির কর্ত্রী জরুরি কাজে তলব করেছেন। ছেলের চিন্তিত মুখ দেখে তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন জাগলো। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারলেন না। আগত চাকরের সাথে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মা বেরিয়ে যেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজল মাতভেই। বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় অস্থির। অস্ফুটে বলল,

“তাতিয়ানা, তাতিয়ানা।”

সেদিনের পর নিকোলাসের সাথে ইসাবেলা দেখা করেনি। নিজেকে রুমবন্দি করেছিল যেন নিকোলাসের সাথে দেখা না হয়। নিকোলাস যে ওর সাথে দেখা করার খুব চেষ্টা করেছে তা ইসাবেলা বেশ ভালোভাবেই জানে। রাতে রুমের ভেতর সোঁদা মাটির গন্ধও পেয়েছিল। মাদাম আর মাতভেইর উপস্থিতির কারণে ওই রুমে নিকোলাস স্বরূপে আবির্ভূত হয়নি। ইসাবেলা ঘুমের ভান ধরে পড়েছিল। তখন নিকোলাসের সামনে যেতে তৈরি ছিল না ও। আজ ইসাবেলা পুরোপুরি তৈরি। নিকোলাসকে ভালোবাসবে ও। ভালোবাসার শক্তিতে ওই পাপাত্মাকে পবিত্র করবে। ইসাবেলা সতর্কে ভাঁড়ার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। সামনে আবছা আঁধার। একটু আগে একটা কাজে জুজানি ওকে ভাঁড়ার ঘরে যেতে বলেছিল। ইসাবেলা অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে মানা করে এসেছে। ও জানে ওকে ভাঁড়ার ঘরে পাঠানোর প্লান নিকোলাসের। মানুষের মস্তিষ্কের ওপর ও সহজে প্রভাব খাটাতে পারে। ঠিক এই কারণেও এই কয়দিন দূরে ছিল ইসাবেলা। কিন্তু আজ মাতভেই ওকে পথ দেখিয়েছে। ওর দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটাতে সাহায্য করেছে। এখন নিকোলাসের মুখোমুখি হতে আর ভয় নেই। ওকে ভালোবাসতে ভয় নেই।

ভাঁড়ার ঘরের ভেতরে মিশমিশে অন্ধকার। নিজের অবয়বই দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধের মতো এদিক ওদিক হাতরে দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। এই বাড়িতে দিনের বেলাতে একমাত্র এখানেই নিকোলাসের সাথে দেখা করা নিরাপদ। এই জন্যই এটা ওটার ছুতো দিয়ে এই ঘরে পাঠাতে চায় ইসাবেলাকে সে। ইসাবেলা দেরি করে হলেও আজ এসেছে এখানে। নিকোলাস কি জানবে ওর আগমনের খবর? কেন যেন ওর মন বলেছে এখানেই এলেই নিকোলাসকে পাবে। ও অধীরভাবে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ সেই পরিচিত গন্ধটা পেল। বুকের ঢিপঢিপানি বেড়ে যায় সাথে সাথে। গন্ধটা ক্রমশ কাছে আসছে। ইসাবেলা অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। ও চোখ বন্ধ করে অনুভব করল নিকোলাসকে। খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নিকোলাস। খানিক সেই নৈঃশব্দ। ইসাবেলার কান দুটো কাতর হয়ে আছে একবার প্রিয় গলার স্বরটা শুনবে বলে। কিন্তু হলো উলটো। ক্ষিপ্র গতিতে ঘাড় ধরে কাছে টেনে আনল নিকোলাস। ভীষণ রেগে আছে। ইসাবেলা টের পাচ্ছে সেটা। নিকোলাসের মুখ ওর দিকে নেমে এলো। দুজনের ঠোঁটের মাঝে ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁক। ইসাবেলা চোখ মেলতে একজোড়া রক্তজবা চোখের সম্মুখীন হয়। ওর ঘাড়ের ওপর নিকোলাসের হাতটা শক্ত হলো। ব্যথায় ককিয়ে উঠল ইসাবেলা,

“নিকোলাস!”

“বেলা, আমাকে উপেক্ষা করার শাস্তি কতটা ভয়াবহ হয় জানো না তুমি।” কর্কশ গলায় বলল নিকোলাস। ইসাবেলা ফিসফিসিয়ে বলল,

“তাহলে জানাও।”

“হুঁ?” ভুরু তুলে ওর দিকে তাকিয়ে রইল নিকোলাস। ধীরে ধীরে ঠোঁটের কোণে জেগে ওঠে সম্মোহনী হাসি। ঘাড় ছেড়ে ইসাবেলার কোমরে হাত রাখে। কানের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় বলল,

“বড্ড সাহস বেড়েছে তোমার, বেলা। এত সাহস মোটেও ভালো নয়। পস্তাবে পরে।”

মুচকি হেসে পায়ের পাতায় ভর করে দুবাহুতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ইসাবেলা। তারপর ডান গালে চুমো দিয়ে কানে কানে বলল,

“কোনোদিন না, কোনোদিন না।”

চলবে,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫১
Writer তানিয়া শেখ

নিশুতিরাত। রুমের ভেতর জমাটবদ্ধ অন্ধকার। ইসাবেলার পাশে শায়িত মাদাম আদলৌনা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ইসাবেলা অপেক্ষা করছিল মাতভেইর ঘুমানোর। দিনভর এক জায়গায় বসে,শুয়ে থেকে রাতে ওর ঘুম আসতে চায় না। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। অনেকক্ষণ ওর ঘুমানোর অপেক্ষা করতে করতে ইসাবেলার ক্লান্ত শরীর একসময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়।

“বেলা।” কানের কাছে ফিসফিসানি ডাকে ইসাবেলা সুড়সুড়ি পেয়ে অন্যদিকে পাশ ফেরে। কিন্তু একটা হাত টেনে ওর ঘুমন্ত দেহটাকে ঘুরিয়ে আনল আগের পাশে। ওকে জড়িয়ে ধরে আছে হাতটা। ইসাবেলা ঘুমের মধ্যে শুঁকছে। গন্ধটা ওর পছন্দের। ঘুমের ঘোরে হাসল। অস্ফুটে বলল,

“নিকোলাস, নিকোলাস।”

উষ্ণতা পেতে আরো সরে এলো ও। বালিশ ছেড়ে মাথাটা শক্ত কিছুর ওপর রাখল। অনুভব করল মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঠিক তারপরেই কপালে ভেজা ঠোঁটের স্পর্শ। আবার নিজের নাম শুনতে পেল,

“বেলা, বেলা।”

পিটপিট করে চোখ খোলে ইসাবেলা। ঘুমে ঢুলছে চোখের পল্লব। মাথা সরিয়ে নিলো পেছনে। সেই অন্ধকারে একটা অস্পষ্ট মুখ দেখতে পায়। শীতের রাতের ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া গালটাতে উষ্ণ হাতের তালু ঘর্ষিত হলো। বেশ আরাম লাগল ইসাবেলার। চোখটা আবার বন্ধ করতে হাঁপ ছাড়ার শব্দ শুনল। ভুরু কুঁচকে গেল ওর। তখনই মনে পড়ল আজ রাতে নিকোলাসের সাথে দেখা করার কথা ছিল। সেদিন আবেগে ভেসে গিয়ে নিকোলাসের গাল চুম্বন করেছিল। যখন বুঝল কী কাণ্ড করেছে এক মুহূর্ত আর সেখানে থাকেনি। নিকোলাসের হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়া মুখটা স্মরণ করে সারাটাদিন মিটমিট করে হেসেছে। নিজের ওমন ধৃষ্টতা মনে করেও শরমে মরেছে। ওই লজ্জায় গত একটা দিন ও নিকোলাসকে এড়িয়ে গেছে। আজ ভেবেছিল লজ্জা-শরম ভুলে দেখা করবে। ওর লজ্জায় আত্মগোপন করাকে উপেক্ষা ভেবে রেগে আছে হয়তো নিকোলাস। কিন্তু কে জানত অধৈর্য নিকোলাস এই রুমে ওরই পাশে এসে শুয়ে থাকবে আজ রাতে।
এক নিমেষে ইসাবেলার ঘুম উড়ে যায়। চকিতে তাকাল। অন্ধকারে আস্তে আস্তে পরিষ্কার হলো নিকোলাসের মুখটা। মাথাটা একহাতের ওপর ভর করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। থতমত খেয়ে গেল ইসাবেলা। একবার মাতভেই, আবার মাদামের দিকে তাকাল। মাদাম তখনও নাক ডাকছেন। কিন্তু মাতভেই ঘুমিয়েছে কি না বুঝা গেল না। নিকোলাস হয়তো ওর ভয় আন্দাজ করল। ফিসফিসিয়ে বলল,

“ভয় নেই, ওরা গভীর ঘুমে নিমজ্জিত।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ইসাবেলা৷ তারপর সপ্রতিভ হয়ে বলল,
“আপনি এখানে কেন?”

নিকোলাস সেকথার জবাব না দিয়ে বলল,

“আবার আপনি?”

ইসাবেলা চোখ পাকিয়ে রইল। এখানে শুয়ে আপনি তুমি নিয়ে তর্ক চললে বাড়ির সবাই নিশ্চিত জেগে যাবে। লজ্জা, সংকোচের মাথা খেয়ে কটমট করে চাপা গলায় বলল,
“আচ্ছা, তুমি, তুমি এখানে কেন? কেউ টের পেয়ে গেলে?”

“আমি ওসবের পরোয়া করি না।”

নিকোলাস ওকে জড়িয়ে ধরে আরো কাছে নিয়ে এলো। ইসাবেলা সাথে সাথে ওর বুকে হাত রেখে দুরত্ব তৈরি করে। সতর্ক করল,

“নিকোলাস!”

নিকোলাস আহত মুখে বলল,

“আমাকে কেন বার বার উপেক্ষা করছ, বেলা? গতকাল থেকে তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি নিষ্ঠুর মানবী, আমার মন বোঝো না। তোমাকে দেখার অসুখে আমার হৃদয়টা ধুঁকে ধুঁকে নিষ্ক্রিয় হোক তাই বুঝি চাও?”

ইসাবেলা কথা খুঁজে পায় না। অদ্ভুত এক ভালো লাগা ছড়িয়ে যাচ্ছে দেহের অভ্যন্তরে। পিটার ওকে এমন করে কোনোদিন বলেনি৷ বড্ড অনভ্যস্তের মুহূর্ত কিন্তু অভিলাষী ছিল সবসময়ই। অপ্রতিভ হয়ে যায় তাই বার বার। ওর মাথার ওপর থুতনি রেখে নিকোলাস বলল,

“তোমাকে না দেখে আজকের দিনটাও শেষ হোক চাইনি বলে এসেছি।”

“রাত।”

“হ্যাঁ, ওই হলো। আমার দিনরাতে কোনো পার্থক্য নেই।”

ইসাবেলা মাথা দুদিকে নাড়িয়ে হাঁপ ছাড়ে। আবার ভুলে গিয়েছিল নিকোলাস মানুষ নয় পিশাচ। এই একটা কথা ওর সকল সুখ,স্বপ্নে গুন ধরিয়ে দেয় যেন। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। নিকোলাস ওর গালে মৃদুভাবে হাতের তালু ঘষে বলল,

“ভোর হতে এখনও ঘণ্টা তিনেক সময় আছে। এই সময়টা এখানে নয় অন্য কোথাও একান্তে কাটাতে চাই। যাবে?”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় ইসাবেলা। নিকোলাস খুশি হয়। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতে ইসাবেলা ওর হাত ধরে বলে,

“হুঁশ, শব্দ কোরো না। আগে তুমি যাও। আমি পরে আসছি।”

“যদি আবার ঘুমিয়ে পড়ো?”

“না, ঘুমিয়ে পড়ব না।”

“মনে থাকে যেন। বাইরে অপেক্ষা করছি। জলদি এসো।”

নিকোলাস ধোঁয়া হয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ইসাবেলা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। রুমের বাকি দুজন তখনও ঘুমিয়ে আছে। ইসাবেলা কাছে গিয়ে দুজনকে পর্যবেক্ষণ করে মনের ভয়টা দূর করল। ফ্রকের ওপর শীতপোশাক, পায়ে বুটজোড়া পরে সতর্কে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তারপর বাড়ির পেছনের দরজা খুলে গেল বাগানের দিকে। নিকোলাস আগে থেকে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ইসাবেলা ওর সামনে গিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“চলো।”

নিস্পৃহ গলায় বলল ইসাবেলা। নিকোলাসের মুখের হাসি একটু ম্লান হলো ইসাবেলার গম্ভীরতা দেখে। বলল,

“তুমি আমার ওপর রেগে আছো, বেলা?”

“না।”

“মিথ্যা বলবে না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি রেগে আছো তুমি। কেন?”

“কেন? তুমি ওভাবে রুমের ভেতর ঢুকে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? যদি ওরা দেখে ফেলত?”

“আগেও বলেছি, আমি ওদের পরোয়া করি না।”

“হুঁ!” চাপা ক্ষোভে গজগজ করছে ইসাবেলা। নিকোলাস খানিক রেগে গেল। ওর চোয়াল ধরে বলল,

“হুঁ কী হ্যাঁ?”

“ওই রুমে এখনও ওসব আছে নিকোলাস। যদি কিছু হয়ে যেত তোমার? মাদাম তোমাকে ভিক্টোরিজার সাথে দেখেছেন। তিনি কি ভাবতেন? মাতভেই না হয় জানে তোমার সাথে আমি প্রেম করি, কিন্তু_”

আচমকা নিকোলাসের বুকের ওপর আছরে পড়ল ও। এই আছরে পড়ার কারণটা অবশ্য নিকোলাস। বা’হাতে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। অন্য হাত চোয়াল ছেড়ে গাল আলতো ছুঁয়ে বলল,

“প্রেম? বেলা, আমরা তাহলে প্রেম করছি?”

লজ্জায় অধোবদন হয়ে যায় ইসাবেলা। নিকোলাস মুচকি হেসে ওর থুতনি তুলে বলে,

“তাকাও আমার চোখে।”

ইসাবেলা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানাতে নিকোলাস ঝুঁকে এলো। ওর ঠোঁট একদম ইসাবেলার ঠোঁটে আলতো ছুঁয়ে যায়। চমকে তাকায় তখনই ইসাবেলা। নীল চোখজোড়া ওকে আর পলক ফেলতে দেয় না। নিকোলাস এক হাতে ওর গালে হাল বুলাতে বুলাতে বলে,

“আমরা তবে প্রেম করছি, হুম?”

সম্মোহিতার মতো মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। ফর্সা মুখের ত্বক লাল রঙা আপেলের ন্যায় হয়ে উঠেছে। লাল রঙ নিকোলাসের ভীষণ পছন্দ, ভীষণ। নিকোলাসের হাতটা গাল থেকে ধীরে ধীরে ওর ঠোঁটের কোণে এসে স্থির হয়। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁটের নিচটা ছুঁয়ে বলে,

“প্রেম করলে চুমু খাওয়াতে দোষ নেই, জানো?”

চোখজোড়া বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে ইসাবেলার। এখন কী বলবে ও? ইসাবেলা নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। ওর বুকের ভেতর থরথর কাঁপছে। নিকোলাস আবার প্রশ্ন করে,

“জানো?”

ইসাবেলা অস্থিরভাবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতে গিয়ে অঘটন ঘটিয়ে বসল। নিকোলাসের নাকের ওপরে ওর কপাল এসে সজোরে আঘাত করতে সরে দাঁড়ায় নিকোলাস।

“বেলা!” বিরক্তি প্রকাশ করল নিকোলাস। ইসাবেলা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

“আমি ইচ্ছে করে করিনি, বিশ্বাস করো। সরি।”

ইসাবেলা অপরাধী মুখে তাকিয়ে আছে। নিকোলাস দেখল ওর হাত কাঁপছে। গতবার ঠোঁট চুম্বনের পর ইসাবেলা চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল। নিকোলাস জানে ওটা ইসাবেলার প্রথম পবিত্র চুম্বন ছিল। বলেছিল পিটারকে দেবে। কিন্তু ইসবেলা যখন নিকোলাসের তখন ওর প্রথম চুম্বনের অধিকারও সেই পাবে। এটাই তো নিয়ম। কার নিয়ম? অবশ্যই নিকোলাসের নিয়ম।
ইসাবেলা জ্ঞান হারানোর পর নিকোলাসের অনুতাপ হয়। মনে হয় ও যেন ইসাবেলার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে অনুমতি নিয়ে চুমো খেয়েছে। বেচারি এসবে অভ্যস্ত নয়। ওর জীবনের প্রথম সবকিছু স্মরণীয় হওয়া উচিত এবং স্বেচ্ছায় আনন্দের সাথে। এখন থেকে এই ব্যাপারে সতর্ক হবে। ওর অস্বস্তি হয় এমন কিছু করবে না। ইসাবেলা এখনো প্রস্তুত নয় এসবে। সময় দিতে হবে। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ওকে ততদিন। কিন্তু ইসাবেলা সামনে থাকলে সেটাই মুশকিল হয়ে যায় ওর জন্য। কপাল চুলকে এগিয়ে এসে ইসাবেলার কম্পিত হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল,

“আমি ব্যথা পাইনি। মন খারাপ কোরো না, ঠিক আছে?”

“হুম।”

ইসাবেলার হাতে চুম্বন দিলো। মৃদু হেসে বলল,

“চলো।”

বেনাসের বাগান ছেড়ে ইসাবেলাকে নিয়ে এলো একটি নতুন স্থানে। ইসাবেলা অভিভূত হয়ে গেল জায়গাটার সৌন্দর্য অবলোকন করে। নিকোলাস কেবল ওকেই দেখছে। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য এখন বিবর্ণ ওর কাছে। একমাত্র জাগ্রত, প্রানবন্ত ইসাবেলার হাসি।
ইসাবেলা নিকোলাসের উপস্থিতি যেন ভুলে গেল সামনের সৌন্দর্য দেখে। জমিনের ওপর সাদা বরফের গালিচা। এখানে ওখানে মাথা তুলে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ ইংলিশ প্রাইমরোজ, সিলা, স্নো ড্রপ আর টিউলিপসহ নানান রঙ বেরঙের ফুল। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি রেড বেরির গাছ। টকটকে লাল বেরির গায়ে গায়ে অযাচিতভাবে লেপ্টানো তুষার। একটু দূরে পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ পানির ঝিল। রুপোলি চাঁদের আলোয় ওর পানি চকচক করছে। ইসাবেলার অবলোকিত সৌন্দর্য প্রেম উচ্ছ্বাসে রূপান্তরিত হয় একটা ছোট্ট হরিণ শাবকের কারণে। রেড বেরি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে ওটা ঝিলের জলের ধারে যায়। ঝুঁকে জল পান করছে। ইসাবেলার বিমোহিত স্তব্ধ কণ্ঠ দিয়ে তখনই উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায়।

“নিকোলাস, হরিণ শাবক। ওহ ঈশ্বর! কী অপূর্ব, প্রীতিকর।”

ওর উচ্চ আওয়াজে ভয় পেয়ে হরিণ শাবক ছুটে পালিয়ে যায় মুহূর্তে। দুকাঁধ নত হয় হতাশায়।

“যা! পালিয়ে গেল।”

ইসাবেলা পেছন ফিরতে নিকোলাসকে পেল না। ভীত হয়ে ওঠে।

“নিকোলাস, নিকোলাস।”

না কোনো সাড়াশব্দ নেই। নিকোলাস ওকে এখানে একা ফেলে কোথায় যে গেল! ইসাবেলা কাছাকাছি দাঁড়ানো রেড বেরি গাছের তলে গিয়ে দাঁড়ায়। এই সৌন্দর্য এখন পানসে লাগছে ওর কাছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ও বার বার নিকোলাসকে খুঁজতে লাগল। একটু পরেই নিকোলাসের মানবরূপ ওর চোখে পড়ল। শুধু নিকোলাস নয়, ওর কোলে সেই হরিণ শাবক। ইসাবেলা সামনে এসে বলল,

“এই যে তোমার হরিণ শাবক। এবার খুশিতো?”

ইসাবেলা হা হয়ে দেখল ওর মুখ। তারপর নিজের বিস্ময় কাটিয়ে বলল,

“এটাকে আনতে গিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ, তোমার ভালো লেগেছিল না?”

“আমার ভালো লেগেছে বলে এটাকে তুমি ধরে আনবে?”

“অবশ্যই। তোমার যা ভালো লাগবে তাই এনে দেবো। প্রেমিক হিসেবে এ আমার দায়িত্ব।”

ইসাবেলার গাল আবার লাল হয়ে ওঠে। নিকোলাস মুচকি হেসে ওর কোলে হরিণ শাবক তুলে দেয়।

“প্রেমিক, হুঁ!”

বিড়বিড় করে বললেও নিকোলাস শুনতে পায়। কাছে এসে বলে,

“তোমার প্রেমিক বেলা, শুধু তোমার।”

টুপ করে ওর ডান গালে চুমো দিতে ইসাবেলা ওর চোখে চোখ রেখে সব ভুলে যায়। এই সুযোগে হরিণ শাবকও লাফিয়ে পড়ে ওর কোল থেকে। দৌড়ে আবার পালিয়ে যায়। নিকোলাস দু-হাত কোমরে রেখে বলে,

“ব্যাটা আবার পালাল।”

হরিণ শাবকের পেছনে নিকোলাস অদৃশ্য হতে ইসাবেলা গালে হাত রাখল। এত ঠাণ্ডাতেও ওর গাল বুঝিয়ে তপ্ত হয়ে উঠেছে। লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে মুচকি হেসে বলল,

“আমার প্রেমিক নিকোলাস, শুধু আমার।”

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৫২
Writer তানিয়া শেখ

তারকা খচিত রুপোলী সিংহাসনে বসে আছেন চন্দ্রদেবী। চিরযৌবনার অঙ্গজুড়ে ধূসররঙের ফ্লোরটাচ পোশাক। তাতেও ঝিকমিক করছে পীতবর্ণের তারকা। চন্দ্রদেবীর মাথার মুকুটের ওপর বক্র চন্দ্রটা আয়েশিত ভঙ্গিতে হেলে আছে। তাঁর কান্তিময় মুখশ্রী আগাথার আত্মা প্রসন্ন করে। তিনি বিনীতভাবে দাঁড়িয়েছেন চন্দ্রদেবীর সিংহাসনের সামনে। চন্দ্রদেবীর ডান হাতে চুম্বন করে দু কদম পিছিয়ে বললেন,

“দেবী, আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।”

দেবী প্রসন্নমুখে মাথা নাড়েন।

“আগাথা, বাছা আমার, বলো কী বলতে চাও?”

“দেবী, আমি আজ একবার পৃথিবীতে যেতে চাই।”

“তোমার মনে হয় না এ চাওয়া অপ্রয়োজনীয়? তুমি এবং ম্যাক্স যা চেয়েছ তা হচ্ছে। যে দিন দেখার জন্য শত শত বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলে সেই দিন সন্নিকটে। তোমার তো সেখানে এখন আর বোধহয় প্রয়োজন নেই বাছা।”

আগাথা জানেন দেবীর কথা সত্য। তাঁর পৃথিবীতে না গেলেও চলবে, কিন্তু মনটা যে কেমন কেমন করছে। ইসাবেলা কি নিকোলাসকে ভালোবেসে সৎ পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে? মাঝপথে যদি ওর ভালোবাসা শেষ হয়ে যায় নিকোলাসের প্রতি। পিশাচ আর মানবীর প্রেম যে সমাজ এবং ধর্মে নিষিদ্ধ! কত বাঁধা আসবে ওদের মাঝে। দুজনকে আলাদা করতে মরিয়া হয়ে উঠবে সকলে। ইসাবেলা কি পারবে ধৈর্য ধরতে? পারবে তখনও নিকোলাসকে ভালোবাসতে? যদি হার মেনে যায়? তখন আগাথার শত বছরের সাধনা ফের ধূলিসাৎ হবে। সন্তানদের শাপমোচন করতে না পারলে তাঁর যে স্বর্গে বসেও শান্তি নেই।

দেবী ওঁর মনের উচাটন বুঝতে পেরে বললেন,

“বাছা, আমি বুঝি তোমার চিন্তা। তবে তোমায় উপদেশ দেবো এখন তোমার সেখানে না যাওয়ায় ভালো। কিছু ব্যাপার তাদের ওপর ছেড়ে দাও। ওরা ঠেকে শিখুক। তাতে দুজনের মাঝের দুরত্ব ঘুচবে। নিজেদের ওরা আরো ভালো করে চিনবে, জানবে। তুমি শেখালে তা কিন্তু হবে না। সময় ওদের বুঝিয়ে দেবে ওরা একে অপরের কী। তুমি চেষ্টা করলেও তা পারবে না। উলটো তোমার উপস্থিতি আরো সংকট তৈরি করবে। তাই বলছি এই মুহূর্তে তোমার না গেলে ভালো হয়। আমার ওপর ভরসা রাখো, যা হবে ভালোই হবে।”

আগাথা দেবীর কথা মেনে নিলেন। ফিরে গেলেন তিনি। চন্দ্রদেবী সিংহাসন ছেড়ে নিজের জাদুই সাদা গোলকের সামনে দাঁড়ান। গোলকের ওপর হাত রেখে দুচোখ বন্ধ করে বললেন,

“ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ, আমায় বোলো, চিরমিলন না ট্রাজেডি!”
ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ, আমায় দেখাও, ইসাবেলা, নিকোলাসের পরিণতি।”

ধাতব কণ্ঠের ঝংকারে গোলক জবাব দেয়,

“ওফেলিয়া, ওফেলিয়া।”

দেবী গোলকের জবাবে ভুরু কুঁচকে চোখ মেলতে দেখলেন, গোলকের ধোঁয়াশায় এক স্বর্গীয় শিশুর মুখশ্রী ফুটে উঠছে। ছবিটা যত স্পষ্ট হয় দেবীর কপালে ভাঁজ ততই যেন বাড়ে।

পড়ন্ত বিকেল। আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। পাখিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে নীড়ের দিকে। অদূরের উইলো বনটা দেখতে দেখতে ঘন কুয়াশার চাদরে অস্পষ্ট হয়ে এলো। নিকোলাস নিজ কক্ষের ভেতরের টেবিলের পাশের চেয়ারটাতে বসে আছে। টেবিলটা জানালা মুখি। এক ধ্যানে ও বাইরের সন্ধ্যা নামা আকাশটা দেখছে। আগে ভোর হতে দুপুরের পূর্বপর্যন্ত বাদে বাকি দিনরাতে ও কোনো পার্থক্য দেখেনি। কিন্তু এখন ওর কাছে দিন আর রাতের পার্থক্য বেশ করে ধরা দিয়েছে। সারাদিন ধরে অপেক্ষা করে রাত নামার। ওই একটা সময়ই ইসাবেলাকে ও কাছে পায়। বাকি সময় ইসাবেলা যেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বেনাসের বাড়িতে গেলেও ইসাবেলাকে যখন তখন কাছে পাওয়া একরকম অমাবস্যার চাঁদ যেন। মেজাজ বরং খারাপ হয় সেখানে গেলে। ভিক্টোরিজার মতো কামুক নারীকে বিনীতভাবে বার বার হতাশ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। নিকোলাসকে বিছানায় নিতে ও যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ প্রয়োজন না হলে এই মেয়েকে নিকোলাস কবেই শেষ করে ফেলত। ইসাবেলা ছাড়া কোনো মেয়ের স্পর্শ এখন ওর কাছে সকালের তপ্ত সূর্য কিরণের মতো। সমস্ত শরীর ঝলসে যায় ঘৃণায়।
অপরদিকে ইসাবেলা মহা জেদি। এই মেয়ে দিনের বেলা কিছুতেই দেখা করতে চায় না। কারো চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত ও। মাঝে মাঝে ইসাবেলা এমন জেদি হয়ে ওঠে যে নিকোলাস বাধ্য হয় ওর কথা মানতে। মনে মনে একরাশ অভিমান জন্মে। ওকে সারাদিন না দেখতে পেয়ে ইসাবেলার কি খারাপ লাগে না? এই যে ভিক্টোরিজার সাথে দিনের পর দিন সময় কাটাচ্ছে, ইসাবেলার কি ঈর্ষা হয় না তাতে?

“ঈর্ষা হবে কেন? ও তো আর আমার মতো করে ভালোবাসে না। ওর মনে একা আমিই না, পিটার আছে, মাতভেই আছে। আর আমার মনে কেবল ও। আমার বিরহ ও কি বুঝবে।”

মনে মনে ভাবলো নিকোলাস। ভেতরে কী যে এক বিষম যন্ত্রণার উদ্রেক হলো তা বুঝি প্রকাশ করা দায়।

“ভাই!” কক্ষে আন্দ্রেই এসে উপস্থিত হয়। নিকোলাস গুম মেরে আছে। একটুখানিও নড়ল চড়ল না। আন্দ্রেই ভাবল নিকোলাস হয়তো শুনতে পায়নি। এগিয়ে এসে আবার ডাকল,

“ভাই, ভাই!”

“হুম?”

নিকোলাসের গম্ভীরতা নতুন নয় আন্দ্রেইর কাছে। মুখটা দেখতে না পেলেও ভাইয়ের খারাপ মেজাজ টের পেয়ে বিনীত গলায় বলল,

“ড্যামিয়ানের খোঁজ পেয়েছি।”

ড্যামিয়ানের নাম শুনে নিজের মনের অভিমান ভুলে গেল নিকোলাস। আন্দ্রেইর দিকে ঘুরে বলল,

“কোথায় জানোয়ারটা?”

“সূত্রমতে, সুইডেন থেকে আজই রওয়ানা হয়েছে ড্যামিয়ান। কাল লিথুনিয়া পৌঁছাবে। লিথুনিয়া আসলে ভিক্টোরিজার সাথে ও দেখা করবেই। হাজার হোক পুরোনো প্রিয় প্রেমিকা।”

আন্দ্রেই ক্রূর হাসল। নিকোলাস ঠোঁটের কোণও খানিক বেঁকে যায়।

“ব্লাডি সাইকো স্যাডিস্ট।”

“আর ইউ জেলাস, ভাই?”
বলেই জিহ্বা কাটল আন্দ্রেই। নিকোলাস রক্তচক্ষু নিয়ে ওর দিকে চেয়ে বলল,

“ওই জানোয়ারটাকে নিয়ে আমার কেন ঈর্ষা হবে?”

“ভিক্টোরিজার কারণে।”

“তোর কি ধারণা ভিক্টোরিজা কে আমি ভালোবাসি?”

“কখনোই না। তুমি ভালোবাসা মানে কি বোঝোই না। ওই অনুভূতির সিস্টেম তোমার মধ্যে নেই। হয়তো ভিক্টোরিজার সার্ভিসে অভ্যস্ত হয়ে গেছো। তোমাদের মাঝে ড্যামিয়ান এলে একটু হিংসে তো হবেই। তাছাড়া তোমরা দুজন বহুকালের প্রতিদ্বন্দ্বী।”

আন্দ্রেইর শেষের কথাগুলো উপেক্ষা করল নিকোলাস। রুষ্ট মুখে বলল,

“তুই বলতে চাস, আমার দ্বারা কাওকে ভালোবাসা অসম্ভব?”

“কতকটা তাই।”

“ভুল জানিস তুই। আমার দ্বারা ভালোবাসা সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। তুই নিজে কোনোদিন ভালোবাসিসনি বলে ওই কথাটা তোর মনে হয়েছে।”

“পিশাচরা ধ্বংস জানে ভাই, ভালোবাসতে না। আমি পিশাচ, আমার ভেতর কেবল স্বার্থপরতা, ধ্বংসাত্মক শক্তি আর নিষ্ঠুরতা ছাড়া কিছু নেই। ভালোবাসা মানুষের অনুভূতি, দুর্বলের অনুভূতি। আমরা মানুষ নই, দুর্বল নই।”

নিকোলাস ক্ষিপ্র হাতে ওর ঘাড় ধরে বলে,

“এই তো সেদিনও এই কথাগুলোর প্রবোধ দিয়েছিলাম নিজেকে। আজ দ্যাখ তোর এই কথার বিরোধিতা করছি, অস্বীকার করছি। আন্দ্রেই, আমরা জীবন্মৃত কিন্তু আমাদের হৃদয় এখনও জীবন্ত। জীবন্ত যা কিছু আছে সব ভালোবাসতে পারে। আমার সেই জীবন্ত হৃদয়ই আমাকে ভালোবাসতে শেখাবে।”

“আর তারপরে? তারপরে কী ভাই? বউ-বাচ্চা, সুখী সংসার? পিশাচের এসব হয়?”

আন্দ্রেইর কথাতে নিকোলাস চুপ করে যায়। আসলে তো! পিশাচের কী মানুষের মতো এসব হয়? বউ-বাচ্চা? সুখী সংসার? ইসাবেলার সাথে ওর ভবিষ্যৎ কী? ওদের ভালোবাসার পরিণতি কী?

আন্দ্রেইর বিদ্রুপের হাসিতে হুঁশ ফেরে নিকোলাসের। কিন্তু ভাবনার সুতো তখনো জড়িয়ে ধরে আছে।

“জবাব পেলে না তো! পাবেও না। তুমি ভুল করছ ভাই, চরম ভুল করছ। তোমার কাছে এই ভুল আশাতীত।” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল আন্দ্রেই। নিকোলাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু নিরুত্তর রইল।

ইসাবেলা নিকোলাসের প্রণয় এখন পিশাচ কমিউনিটির সকলের মুখে মুখে। প্রকাশ্যে না বললেও আড়ালে এই নিয়ে সকলে ক্ষুব্ধ। ঠিক এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে শত্রুপক্ষ। নিকোলাসকে ধ্বংস করার মতলব আঁটছে ওরা। অথচ, নিকোলাসের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দিনরাত ইসাবেলার ধ্যানে মগ্ন। আন্দ্রেইর এসব লক্ষণ মোটেও ভালো লাগছে না। আজ সে ইচ্ছে করে খোঁচা দিয়েছে নিকোলাসকে। নিকোলাসের এই পরিবর্তন মানতে পারছে না ও। এই পরিবর্তন আতঙ্কের। ভাই কোনো মানবীর প্রেমে পড়বে এ রীতিমতো আশ্চর্যের ব্যাপার ওর কাছে। প্রথমে বিশ্বাসই করেনি। কিন্তু এখন সবটা পরিষ্কার। নিকোলাস ইসাবেলাকে ভালোবাসে। ভাইয়ের চোখেমুখে সেই ভালোবাসা আজ আন্দ্রেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। নিকোলাস কোনোরূপ রাখডাকের চেষ্টাও করছে না। কেন করবে? ওর ভয় কীসের? নিকোলাস কাওকে ভয় পায় না। কিন্তু আন্দ্রেইর অনেক ভয়। এই ভাইয়ের জন্য ও পিতার এক কথাতে মায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করে পিশাচ হয়েছে। ভাইয়ের দিকে আগত সকল বিপদের মোকাবেলা করেছে। আজ আবার চোখের সামনে ভাইয়ের দিকে ধেয়ে আসা বিপদ ও দেখতে পাচ্ছে। ভাইকে সময় থাকতে মিথ্যা প্রেমের মোহজাল থেকে বের করে আনতে হবে। আন্দ্রেই সব সময়ই নিকোলাস আর ওর দিকে আগত বিপদের মাঝে ঢাল হয়ে অবস্থান করেছে।
সোফিয়া ছেলের কারণে নিকোলাসের ক্ষতির চিন্তা করতে শতবার ভাবে। কিন্তু পিতা রিচার্ডকে আন্দ্রেই বিশ্বাস করে না। এই লোক যে কাওকে ম্যানুপুলেট করতে পারে। গত কয়েকদিন ধরে নিকোলাসের বিপক্ষে উসকাচ্ছেন আন্দ্রেইকে তিনি। ভেবেছেন আন্দ্রেইকে আর সবার মতো ম্যানুপুলেট করতে পারবেন? আন্দ্রেই মনে মনে হাসল রিচার্ডের অভিসন্ধি ভেবে।

নিকোলাস আস্তে আস্তে গিয়ে বসল চেয়ারটাতে। আন্দ্রেইর কথা ওকে ভাবাচ্ছে। ভাইয়ের ভাবুক মুখ দেখে আন্দ্রেই বিরক্ত হলো। সামান্য একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে ভাই যেন নিজের লক্ষ্য ভুলে গেছে। নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে আনছে। আন্দ্রেই ঠিকই ভেবেছে, ভালোবাসা দুর্বলতার নামান্তর। এই যে ওর সামনেই সেই প্রমাণ। এই প্রেমিক নিকোলাসকে ধ্বংস করা খুব সহজ শত্রু পক্ষের জন্য। কিন্তু আন্দ্রেই কি তা হতে দেবে? ভাইয়ের মুখের দিকে শেষবার চেয়ে কক্ষের ভেতর থেকে অদৃশ্য হলো আন্দ্রেই। একটু পরে নিকোলাস সোজা হয়ে বসে। নীরবতা ভেঙে আপনমনে বলল,

“পরিণতি ভেবে কেউ ভালোবাসে রে আন্দ্রেই। তুই কি পরিণতি ভেবে আমাকে ভালোবেসেছিলি? সেই শিশু বয়সে ভেবেছিলি আমাকে ভালোবাসার কারণে একদিন তোকে পিশাচ হতে হবে? ভালোবাসা এমনই রে আন্দ্রেই, এমনই। আজ আমি ভেবে ভেবেও আমার আর বেলার ভালোবাসার পরিণতির কূল পাইনি, কিন্তু তাতে কী? আমি বেলাকে ভালোবাসা ছেড়ে দেবো? না, কোনোদিন না।”

মাতভেই ও মাদাম আদলৌনা ঘুমাতে ইসাবেলা বাগানে এসে দাঁড়ায়। আজ থেকে থেকে তুষার বৃষ্টি পড়ছে। পরনের মোটা শীতবস্ত্র স্বত্বেও ঠকঠক করে কাঁপছে ইসাবেলা। মাথার স্কার্ফের ওপরে তুষার জমছে। সেগুলো হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলছে একটু পর পর। প্রায় পাঁচ মিনিট হয়ে গেল তবুও নিকোলাসের দেখা নেই। এমন তো হয় না। সবসময় নিকোলাসই আগে উপস্থিত থাকে৷ আজ তবে কী হলো? ভীষণ চিন্তা হতে লাগল ওর। কী করবে এখন? বিড়বিড় করে বারকয়েক নিকোলাসের নাম নিলো। তাতেও এলো না। পাঁচ মিনিট পঁচিশ মিনিট গড়ায়। ইসাবেলা ওখানেই হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল। দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে কাঁপছে ঠাণ্ডায়। দাঁতে দাঁত লেগে যায়। সারা শরীর তুষারে ঢেকে গেলেও ও ওঠে না। ঠাণ্ডায় রক্ত জমে যাচ্ছে। শরীর অবশ অবশ হয়ে এলো। চোখজোড়া ঢুলছে। সেই সময় সামনে একজোড়া কালো জুতো দেখতে পেল আবছা আবছা চোখে। মুখ তুলে দেখল ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। কম্পনরত ডান হাতটা বাড়িয়ে বলল,

“নিকোলাস।”

নিকোলাস ওর দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে। ইসাবেলার গোলাপি পাতলা ঠোঁট ঠাণ্ডায় কালো হয়ে গেছে। কাঁপছে থরথর করে। চোখের পাতা, মুখের এখানে ওখানে জমে আছে তুষার। তীব্র অপরাধবোধের দহনে পুড়তে লাগল। ইসাবেলার হাতটা ধরে বসল ওর সামনে। মাথাটা বুকের ওপর জড়িয়ে নিয়ে সারা গায়ের তুষার পরিষ্কার করল। পাশের ছাউনির তলে নিয়ে বসায়। নিজের পরনের গরম সোয়েটার ওর গায়ে জড়িয়ে দুহাত ঘষে তপ্ত করে ওর ঠাণ্ডা গালে, হাতে তাপ দিতে লাগল। নিচু গলায় বলল,
“আমাকে ক্ষমা করো বেলা, ক্ষমা করো।”

ইসাবেলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরল নিকোলাসকে। জমে যাওয়া শীতল দেহ উষ্ণ হয়। নিকোলাস ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমো খেলো। ইসাবেলা স্মিত হেসে বলে,

“আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে এমনটা করোনি।”

নিকোলাসের অপরাধবোধ আরো বেড়ে যায়। ও ভুল করেছে। ভালোবাসাকে নিক্তিতে চড়িয়ে ভুল করেছে।

চলবে,,,

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ