পিশাচ পরিবার পর্ব-০৩

0
2146

#পিশাচ_পরিবার
#৩য়_পর্ব
©Tasmima Yeasmin
.
.
আমি দুহাতে মুখ চেপে বসে পরলাম আর লোকটা ধীরে ধীরে আমার দিকে এগোতে লাগলো। বড় আপার কথা আমার পরিবারের কথা আমার ভীষণ রকম মনে পড়ছে। লোকটা আমার মাথায় হাত রেখে বললো, “কি গো মেয়ে ভয় পেয়েছো নাকি? একা এই নির্জন জঙ্গলে তুমি কিভাবেই বা এলে?”
আমি মুখ তুলে লোকটার দিকে তাকালাম। উনি খানিকটা হাসার চেষ্টা করছে। হয়ত হেসে এটা বোঝাতে চাইছে, “আমার থেকে ভয়ের কিছু নেই।” লোকটা আমাকে আরো আস্বস্ত করতে আমার পাশেই বসে পড়লো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কে?”
“আমি ভবঘুরে মা। এই জঙ্গলই আমার বাড়িঘর।”
লোকটা উত্তর দিলো। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এখানে কেমন করে এলে। এদিকে তো কোনো মানুষজন আসে না?”
” কিছুদূর গেলে একটা বাড়ি আছে। সেখানে আমার বড় আপার বিয়ে হয়েছে। সেখনেই এসেছি তো তাই বাইরে ঘুরতে এলাম।” আমি উত্তর দিলাম।
“কি বলছো তুমি? কিছুদূর গেলে যে একটা পুরাতন জমিদারবাড়ি আছে সেখানে তুমি এসেছো? আবার তোমার বোনের বিয়ে হয়েছে ঐ বাড়িতে? কি সাংঘাতিক!” লোকটা অবাক হয়ে বললো।
“সাংঘাতিক কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“শোনো মেয়ে একসময় এই জঙ্গলের মাঝে খুব সুন্দর একটা গ্রাম ছিলো। অনেক ছোট্ট একটা গ্রাম। শহর থেকে অনেক দূরে ছিলো গ্রামটা। সেই গ্রামে ছিলো এক জমিদার। জমিদার এত রাগী আর শক্তিশালী ছিলো যে গ্রামের সব মানুষ তাকে সমীহ করে চলতো। জমিদারের একটাই দূর্বলতা ছিলো। তার কোনো সন্তান ছিলো না। আর সন্তান পাওয়ার লোভে সে কালোজাদু করেছিলো তার স্ত্রীর উপর।” এই পর্যন্ত বলে লোকটা চুপ করে যায়। অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকে দূরের একটা গাছের দিকে।
“তারপর? তারপর কী হয়েছিলো?”
“জমিদার কোনো একটা ভুল করেছিলো। ঠিক কি ভুল কেউ জানেনা। আর তারপর এই গ্রামের উপর অভিশাপ নেমে এলো। ধ্বংস হয়ে গেলো গ্রামটা। হয়ে উঠলো মৃত্যুপুরী। দিনের বেলা সব ঠিকঠাক কিন্তু রাত হলেই ভয়ংকর সব কান্ডকারখানা ঘটতে থাকে।” লোকটা বললো।
“কিন্তু ঐ পরিবারের সবাই বেঁচে গেলো কিভাবে?” জিজ্ঞেস করলাম।
“ঐ পরিবারের কেউ বেঁচে যায়নি মা। শুধুমাত্র যে কয়জন ঐ কালোজাদু জানতো তাদের আত্মা তাদের শরীরে বন্দি হয়ে আছে।”
“তাহলে আমাদের এখানে এনেছে কেন? কী চায় আমাদের থেকে? যদিও আমাদের সাথে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবহার করে।”
“তোমাদের কেন এখানে এনেছে সেটা আমি জানি। আমি আগেই জানতাম কোনো না কোনো মেয়ে আসবেই।”
“কিভাবে জানতেন?”
“শোনো মা ওদের একটা বাচ্চা দরকার সেইজন্য।”
“বাচ্চা দিয়ে কি করবে ওরা?”
“ওদের কারো ঔরস্যে হওয়া কোনো বাচ্চাকে শয়তানকে উৎসর্গ করতে হবে। তাহলে ওরা পুরোপুরি পিশাচ হয়ে যাবে। অমরত্ব পাবে। এখন রাতেই শুধু ওদের ক্ষমতা কাজ করে তখন দিনের বেলায়ও করবে।”
আমি লোকটার কথা শুনে রিতীমত চমকে উঠলাম। উনি আরো আবার বলতে শুরু করলো, “আমার মনে হচ্ছে সেই বাচ্চা তোমার বোনের গর্ভেই আসবে। তারজন্যই তোমাদের এখানে এনেছে।”
আমার লোকটার কথা এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছে না।
আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, “নিশ্চয়ই ভর দুপুরে একা পেয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন আপনি। আপনার এসব বানানো গল্প আমি বিশ্বাস করি না। আর ঐবাড়ির সবাই কত ভালো আপনি জানেন। তাছাড়া দুয়েকদিন পর আব্বা আমাকে নিতে আসবে।”
আমি চলে আসতে নিলে লোকটা আবার আমাকে ডাক দিলো। তারপর বললো, তোমার আব্বা কেন হয়তো কেউই তোমাদের খুঁজে পাবে না। খুঁজে পাবে কিভাবে জানবেই তো না তোমরা এখানে। আর নিশ্চয়ই তোমার বাবা মায়ের উপর ও কালোজাদু করেছে। তুমি বিশ্বাস না করলে করো না। কিন্তু আরেকটু শুনো সামনের তিন দিন পরে পূর্নিমা। পূর্নিমার রাতে ওদের শক্তি কোনো কাজ করবে না। চেষ্টা করলে সেদিন তোমরা বেঁচে যেতেও পারো।”
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি আবার বললেন, “কাজটা খুব সহজ আবার কঠিন। বাড়ির পেছনে একটা দিঘি আছে। সেই দিঘির কাছে একটা বকুল গাছ। বকুল গাছের নিচে এক হাতের মত মাটি খুড়লে একটা রূপোর বাক্স পাবে। সেই বাক্সের মধ্যে একটা রূপোয় বাঁধাই করা আয়না রয়েছে। আয়নাটা তোমাকে প্রথমে চাঁদের আলোর দিকে ধরতে হবে। তাহলে সে জাগ্রত হবে। তারপর সেই আয়নাটা ওদের সামনে ধরবে। সবশেষে দিঘির জলে ডুবিয়ে দেবে। কাজটা কঠিন এজন্য যে রাতের বেলা সব পিচাশ ঐ বকুল তলায় পাহারা দেয়। কিন্তু পূর্নিমা রাতে তাদের শক্তি কাজ করে না। আরেকটা কথা মা তোমায় কিন্তু আকাশে পূর্নিমার চাঁদ ওঠার পরেই ঐ বক্সটা তুলতে হবে। আর এই লকেটটা রাখো এটা তোমার বোনের গলায় পরিয়ে দেবে।” এই বলে লোকটা আমার হাতে সবুজ পাথরের একটা লকেট দিলেন। তারপর একরকম দুলতে দুলতে এখান থেকে চলে গেলেন।
আমি লকেটটা আমার হাতের মুঠোয় রেখে দিহান ছেলেটাকে আশেপাশে খুঁজতে লাগলাম। কোথাও খুঁজে না পেয়ে যেই পথে এসেছিলাম মনে করে করে সে পথ দিয়ে যেতে যেতে বাড়িতে চলে আসলাম।
.
.
আপা নিজের ঘরে কোনো একটা কাজ করছিলেন। আমি বললাম, “আপা তোর দেবর আমাকে জঙ্গলে একা ফেলে চলে এসেছে।”
“তাতে কি হয়েছে?” আপা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন।
“কি হয়েছে মানে? তুই এভাবে কথা বলছিস কেন আপা? যদি আমার কিছু হয়ে যেতো তাহলে?”
আপা চুপ করে রইলেন। আমি আবারো বললাম, “আপা দিহান যখন আমাকে ছেড়ে চলে এলো তখন একটা লোকের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। সেসব বলে দিয়েছে।”
“কি বলেছে?” আপা জিজ্ঞেস করলেন।
“এই বাড়ির রহস্য। তুই আমাকে সকালে যে কথা বলতে চেয়ে বলতে পারিসনি সেই কথা। এই বাড়ির কেউ মানুষ না আপা এই বাড়ির সব পিচাশ আর আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে। এখান থেকে বেরোনোর রাস্তা আমি পেয়ে গেছি।”
আপা আমার কথা শুনে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। তার চোখদুটো রাগে জ্বলছে। আমার কাছে এসে আমাকে জোড়ে ঝাঁকিয়ে বললেন, “আমরা এখান থেকে কোথাও যাবো না। এখানেই থাকবো সারাজীবন বুঝলি তুই।”
আপাকে দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। লকেটের কথাটা আর বলতে সাহস হলো না। নিজের ঘরে চলে এলাম।
.
.
সারাদিন আপার কথা ভাবলাম আমি। ওরা নিশ্চয়ই আপার উপর কোনো জাদু করেছে। আর সেই জাদুর প্রভাবে আপা এমন করছে। আমি বুঝতে পারছিনা কি করবো। বাড়িতে আম্মা আব্বার কি অবস্থা কে জানে। ভাবলাম আজ সারারাত জেগেই থাকবো। কিন্তু নানান চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পরলাম।
আজো শেষোরাতে কেউ একজন আমার পা ধরে টান দিলো। আমি জোরে টান দিতেও এলো না বরং আমি বিছানা থেকে পরে গেলাম মাটিতে। রুমের জানালাটা খুলে গেলো। দমকা হাওয়ায় নিভে গেলো মোমবাতি। আমি চিৎকার দিতে গিয়েও মুখ থেকে একটা শব্দও বের হলো না। হঠাৎ মনে হলো দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে হলো অনেকগুলো ছায়ামূর্তি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি অন্ধকারে বরফের মত জমাট বেঁধে নিশ্বাস আটকে বসে রইলাম। ছায়ামূর্তি গুলোর মাঝে কেউ একজন ফিসফিস করব বলে উঠলো, “আমাদের ধংস করবে তোমার মত এক সাধারণ মেয়ে।” গলার আওয়াজ শুনে আমি চমকে গেলাম। অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো, “আপা তুই।” ওপাশ থেকে হাসির শব্দ। কেউ একজন বললো, “তোমার সব প্লান আমি জেনে ফেলেছি যে তাই তোমাকে মৃত্যু দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমাদের।” একটা ছায়ামূর্তি একদম আমার কাছে এসে আমার গলা টিপে ধরলো। আমার দম আটকে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসলো। নিজের মৃত্যু চোখের সামনে দেখতে পেলাম।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে