#হৃদয়ের_ঠিকানা
৯ম ও শেষ পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
,
আমি আমার ছেলেকে নিয়ে আলাদা পৃথিবী গড়তে চেয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্য আমাকে আজ দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু একটা জিনিস আমার বোধগম্য হচ্ছেনা বাবা কেন আমার ছেলের কথা কাইফকে বলে দিলো!
অবশ্যই বলে দিয়েছে তা নাহলে এই বাড়ির নাম কিভাবে আমার ছেলের নামের সাথে মিলতে পারে। মামীর সাথে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলাম। পরী আমার হাত ধরে আমাকে একটা ঘরে নিয়ে গেলো। সমস্ত ঘরে পরীর ছবিতে ভর্তি। ছবিগুলো আমাকে দেখিয়ে বলল,
– দেখেছো আম্মু, পাপা আমাকে কত্তো ভালোবাসে! সারাঘরে আমার ছবি।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি আর পরী ঘরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ কেও আমার ঘাড়ে হাত রাখলো। পিছন ঘুরে দেখলাম মামী দাঁড়িয়ে আছে।
চোখের পানি মুছে মামীকে বললাম,
– কাইফ ভাইয়া পরীকে খুব ভালোবাসে তাইনা?
– হুম নিজের থেকেও বেশি।
– পরীর ঘটনা কি আমাকে বলবে মামী?
এরপর মামীকে পরীকে অন্য ঘরে গিয়ে খেলতে বলে। পরী চলে গেলে মামী আমাকে বলে,
– নিশ্চয়ই বলবো, তোর জানা উচিৎ। তুই চলে যাওয়ার পর আমার কাইফ একদম হতাশ হয়ে যায়। কয়েকমাস তোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ একদিন বলে, মা আমি বিয়ে করবো। যে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে তাকে আমি কেন মনে রাখবো, সে আমাকে ভুলে গেলে আমি কেন পারবোনা! সেদিন ওর গা থেকে মদের গন্ধ পেয়েছিলাম। বুঝেছিলাম তোর জন্য ও পাগল হয়ে যাবে তার থেকে বরং ওর জীবনে অন্যকাওকে ঢোকানো দরকার।
এরপর একদিন পরীর মায়ের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। মেয়েটা অনাথ ছিলো। বেশ মিষ্টি দেখতে, যেমনটা পরীকে দেখছিস।
মেয়েটাকে কাইফের অফিসে যোগ দেওয়ানোর সমস্ত কাজ করি আর সাথে তাকে বলেও দিই যেন আমার ছেলেটাকে সে নিজের ভালোবাসায় জড়াতে পারে।
– এরপর বুঝি তার আর কাইফ ভাইয়ার বিয়ে হয় আর তার গর্ভে পরীর জন্ম হয়?
– আমিও এটাই চেয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্য অন্যকিছু বলছিলো। তোকে তো পরীর মায়ের নামটাই বলা হয়নি। সন্ধ্যা নাম ছিলো তার। যায়হোক, এরপর কয়েক বছরের মধ্যে সন্ধ্যা কাইফের সাথে অনেক গাঢ় বন্ধুত্ব করে। কিন্তু কাইফ ওকে বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবতো না। মেয়েটা একসময় নিজের থেকেও ওকে ভালোবেসে ফেলে। বারবার কাইফকে নিজের মনের কথা বলে কিন্তু কাইফ ওকে পাত্তা দেয়না। কারণ ওর হৃদয়ে তোর নামই লেখা ছিলো জন্মজন্মান্তরেও যে সে নাম পাল্টানোর নয় এটা তো আমি জানতাম না। সন্ধ্যা একদিন বৃষ্টির সময় কাইফকে বলে তাকে ভালো না বাসলে সে যেদিকে চোখ যাবে সেদিকে চলে যাবে। কাইফ সেটা শুধু একটা ব্লাকমেইল ভেবে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু সন্ধ্যাকে খুজে পাওয়া যায়নি তারপর থেকে। অনেক খোজ করার পর তাকে খুজে পাই আমরা প্রায় ১৫ দিন পর। কয়েকটা অমানুষ তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। সেদিনের পর থেকে সন্ধ্যাকে আমার কাছে নিয়ে আসি।
মেয়েটা একদম চুপ হয়ে যায়। ওর ক্ষতির জন্য আমি নিজেকেই দায়ী করতে থাকি ওদিকে কাইফও নিজেকে দায়ী করতে থাকে। ওকে ওর প্রাপ্ত সম্মান দেওয়া যেন আমার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আমি ওকে কাইফের সাথে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবার, কাইফও এবার না করে না। কারণ মেয়ে নিজেকে শেষ করে দেবে যদি আমরা ওকে বাচার ইচ্ছা না জাগাই। সেদিন আমার ছেলের বুকফাটা কান্না দেখেছিলাম মা পাগলের মত কেদেছিলো। ভাবিস না সন্ধ্যার জন্য, শুধু তোর জন্য। তোর জায়গা অন্য কাওকে দেবে এটা যেন সে মেনেই নিতে পারছিলো না।
বাড়িতে কাজী ডাকা হয় কিন্তু সন্ধ্যা বলে সে এখন বিয়ে করবেনা। আমি ওকে জোর করিনা। ওর মত ওকে সময় দিই। কিন্তু হঠাৎ করেই জানতে পারি মেয়েটার গর্ভে বেড়ে উঠছে সেই অমানুষ গুলোর সন্তান। আমি ওর গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করে দিতে বলি কিন্তু ও রাজি হয়নি। এজন্য বিয়ের তড়িঘড়ি লাগিয়ে দিই কিন্তু আগের মতই সে রাজী হয়না। বলে, সন্তান হওয়ার পরই নাহয় বিয়েটা হোক, সবাই তো জানেই আমি ধর্ষিতা, এই কলঙ্ক ঢেকে ফেলা যাবেনা।
আমরাও আর কিছু বলিনা। ৯ মাস পর ফুটফুটে পরীর জন্ম হয়। দেখতে পরীর মত ছিলো তাই আমার কাইফ ওর নাম পরী রাখে।
ওদেরকে বাড়িতে আনি। এবারও বিয়ের জন্য সন্ধ্যাকে বলি, ও দুইদিনের সময় নেয়। কিন্তু পরদিন তাকে আর খুজে পাওয়া যায়নি। একটা চিঠি লিখে যায়,
মা,
তুমিই আমার মা। আমি চাইনা তোমার বাড়িতে মরতে। এতে তোমদের নামে কেস হতে পারে তাই আমি হয়তো কোনো ব্রিজের উপর থেকে লাফ দিয়ে হারিয়ে যাবো।
ভেবোনা তোমাদের উপর রাগ করেছি আমি একটুও রাগ করিনি। রাগ করিনি বলেই আমার মেয়েকে তোমাদের কাছে রেখে গেলাম।
আমি কাইফকে ভালোবাসি মা। কিন্তু ওর মনে যার নাম লেখা তার নাম আমি মুছে দিতে পারিনা। হয়তো ও নিজের দ্বায়িত্ববোধ থেকে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি ওর হৃদয়ের ঠিকানায় নিজের নাম পৌঁছে দিতে পারতাম না। ওটা অন্যকেও দখল করে আছে। তাই আমি চলে গেলাম। আমাকে খুজে লাভ হবেনা। যতক্ষণে চিঠি পড়ছো তখনে আমি আর দুনিয়াতে নেই।
ভালো থেকো।
ইতি
অভাগা সন্ধ্যা।
মামী সব কথা বলে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। আমারও চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। মেয়েটা চাইলেই তার জীবনকে সুন্দর করতে পারতো কিন্তু ভালোবাসার প্রতি তার কতই না সম্মান যে আমার জন্য সে কাইফকে বিয়েই করতে পারলোনা। আমি মামীর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলি,
– পরী এই বিষয়ে কিছুই জানেনা মামী?
– না ও কিছুই জানেনা। কাইফ ওকে শুধু চিনিয়েছে তুইই ওর মা। সন্ধ্যা নামক কেও ওর জীবনে নেই।
আমি আর একটা কথাও না বলে দৌড়ে পরী যে ঘরে খেলা করছে সেখানে চলে যায়। আমার চোখে পানি দেখে পরী আমার কাছে এগিয়ে এসে বলে,
– আম্মু তোমার গালে পাপ্পি দেবো? তুমি কাদছো যে!
হাটু গেড়ে বসে ওর সারামুখে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিই। আজকে থেকে আমার এক মেয়ে একছেলে।
মেয়েটা কতদিন আমার জন্য অপেক্ষা করেছে। আমি আর কখনো ওকে ছেড়ে যাবোনা৷ নিজের মনে মনেই শপথ করলাম।
আমার চোখে একজনকে খুজেই চলেছে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে তাকে খুজেই পাচ্ছিনা যেন। আমাকে হঠাৎ এমন দেখে পরী বলল,
– পাপার কাছে যাবে?
আমি মাথা বাচ্চাদের মত উপর নিচ করি। পরী আমার ধরে চলতে থাকে। বাড়ির পিছন দিকে ছোট্ট একটা গার্ডেন রয়েছে, তার মধ্যে একটা দোলনা। আর অন্যদিকে ফিরে সেখানে কেও যেন অধীর আগ্রহে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। পাশে তাকাতেই দেখলাম পরী নেই। এখন মানুষটার কাছে একাই যাওয়া লাগবে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। সে অন্যদিকে ফিরেই আছে। আমি ঠিক তার পিছনে গিয়ে দাড়ালাম। বললাম,
– কেমন আছো?
আমার দিকে একবারও তাকালো না সে। অন্যদিকে ফিরেই বলল,
– যেমনটা রেখে গেছিলে তেমনই আছি। শুধু অপেক্ষা করতে করতে বয়সটাই বেড়ে গেছে।
– আমার দিকে তাকাবেনা?
এবার সে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
– চোখের পাওয়ার কি কমে গেছে?
– হ্যা, বয়সটা আমারও বেড়েছে তো। এমনিতেই চোখের সমস্যা ছিলো আর এই সাত বছরে সেটা বেড়ে গেছে অনেকটা।
– তোমার বয়সটা কিন্তু কম। ৩২ কেবল এখনি খুব বয়স্ক মনে করো না।
আমি হাসি দিয়ে বললাম,
– ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলতে হবেনা। আমি তোমার পাশে বসছি।
এরপর আমি তার পাশে বসলাম। নিজের অজান্তেই তার কাধে মাথা রাখলাম। কি দরকার অভিমান করা, সব ভুলে নতুন শুরু করিনা। কি দরকার মাফ চাওয়া,ক্ষমা করা। সবতো ঠিকই আছে। আমার হৃদয়ে সে তার হৃদয়ে আমি।
– আমার ছেলের খবর তুমি কিভাবে জানো?
– ছেলেটা যে আমারও। কেন আমি জানবোনা। বাবা আমাকে বলেছে। সে চায়নি আমার থেকে আমার ছেলের খবর লুকিয়ে রাখতে। হয়তো অনেক পরে বলেছে, তবুও বলেছে।
– কবে বলেছে?
– মাত্র দুই বছর আগে। কালকে ওরা আসবে। আমার জীবন কি সাদা-কালোতেই থাকবে সাওদা নাকি রঙিন হবে।
– দিন বলে দেবে।
লজ্জা কেটে যাবে শীঘ্রই, মনের ঠিকানায় শুধু সেই বসে ছিলো সেই থাকবে। তার কাধে মাথা রেখে বড্ড ঘুমাতে ইচ্ছা করছে। শান্তির ঘুম, অনেক লম্বা একটা ঘুম।
পরদিন,
পরী, মামী, সরি মা তাকে আর মামী ডাকা গেলো না। তাই মা, পরী, কাইফ আর আমি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
পৌছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সাওয়াম আর বাবা পৌঁছে গেলো। আমি গাড়িতেই বসে থাকলাম। কাইফ মাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। বাবার কাছে পৌঁছে গিয়ে মাকে বাবার সামনে দাড় করিয়ে সাওয়ামকে কোলে নিয়ে গাড়িতে চলে এলো।
সাওয়াম আমাকে দেখে না দেখার ভান করেই থাকলো। বাবাকে পেয়ে যেন আমাকে ভুলেই গেছে। দেখাবো মজা ওকে বাড়িতে গিয়ে। খাইয়ে দেবে কে! আমি কাইফকে বললাম,
– বাবা মাকে রেখে আসলে কেন?
– তাদের যুগ যুগের অভিমান শেষ হোক তারপরই না হয় আসবে গাড়িতে।
– কিন্তু তাদের অভিমান কি নিয়ে ছিলো?
কাইফ মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
– আমাদের অভিমান যেমন আমাদের সন্তানরা জানতে পারবেনা কোনোদিন তাদেরটাও নাহয় আমাদের অজানাই থেকে যাক।
আমি একটা হাসি দিয়ে পরীকে আদর করতে লাগলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের অভিমানের পালা শেষ হলে আবার আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। পরী আমার কোলেই ঘুমাচ্ছে আর আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। অকারণে আমার জীবন থেকে সাত বছর হারিয়ে গেলো। তাকে ভালোবাসি তবুও তাকে কষ্ট দিলাম। আমি না গেলে হয়তো সন্ধ্যা নামক মেয়েটা কখনো কাইফের জীবনে আসতো না, তার জীবনও যেতো না। কাইফ বাম হাত আমার হাতের উপর রেখে বলল,
– যা হয়েছে তা হয়েছে। সামনের কথা চিন্তা করো। মিশন আরেকটা পরী।
যাহ! বাবা মায়ের সামনে এটা কি ধরনের কথা। ছিহ! লজ্জায় মরে যাই, মরে যাই।
আমার লজ্জা পাওয়া দেখে সবাই হাসতে লাগলো। আমি লজ্জায় আরও লাল হয়ে যেতে লাগলাম।
মনের ভিতর খুশিতে দোলা দিতে লাগলো। আমি সব পেয়েছি। হৃদয়ের ঠিকানায় যার নাম ছিলো সে কখনো মুছে যায়নি, আর যাবেও না। এই নিয়েই চলবে আমাদের সংসার, ভালোবাসার সংসার।
,
হৃদয়ের ঠিকানা
,
,
সমাপ্ত
বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।