#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_১৬
#সারিফা_তাহরিম
‘আমার হৃদয়াক্ষীকে পাওয়ার জন্য কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা প্রকাশ করা সম্ভব না। প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে থাকতাম, এই বুঝি হারিয়ে ফেলেছি তাকে! মাকে জানিয়েছিলাম আমি। মা বাবা প্রায় সময় স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। অবশেষে একসময় বিয়ের প্রস্তাব আর অনেক অনুরোধের পর আমার শ্বশুরকে বুঝিয়ে তাঁর মেয়েকে বিয়ে করেছি। আমার হৃদয়াক্ষীকে পেয়েছি আমি। কিন্তু তার হৃদয়ে জায়গা করতে গিয়ে প্রচুর রাগের স্বীকার হতে হয়েছে। ইশ! পূর্ণতা, কি বাঘিনী ছিলে তুমি! আমার মতো অবলা পুরুষটার উপর কত নির্যাতনই না করতে তুমি!’
অরিত্রের কথায় পূর্ণতা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বাহুতে একটা চাপড় দিয়ে বলল,
‘কি বললেন? আমি বাঘিনী! আমি তো খুব শান্ত আর ভালো একটা মেয়ে। আর আপনি অবলা কি করে হন? যে লোক আমার মতো ঐ পিচ্চি মেয়েকে দেখে এত এত চিন্তা করতে পারে সে কি করে অবলা হয়?’
অরিত্র বাহুতে হাত বুলিয়ে বাচ্চাদের মতো অসহায় চেহারা করে বলল,
‘পিচ্চি মেয়েকে ভালোবাসার সাইড ইফেক্ট হিসেবে এখন মার খেতে হচ্ছে!’
অরিত্রের কথায় পূর্ণতা হেসে দিল। অরিত্রও হাসলো। গৌধুলিবেলা সাক্ষী হলো তাদের কিছু রঙিন মুহূর্তের।
____
সন্ধ্যা নামতেই কুয়াশার বহরেরা হানা দিল ধরণীতে। হাসনাহেনা ফুলের সূক্ষ্ম একটা ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। কুয়াশারা কাঁচের জানালাকে ঝাপসা করে দিচ্ছে, তাদেরকে ছুঁয়ে দিলেই পানি হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। দিনা বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছে ঝাপসা জানালার কুয়াশাদেরকে। বিচিত্র সব আঁকা আঁকি করছে সে। দৃষ্টি কাঁচের জানালায় হলেও মনটা বহুদূরে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। ছাব্বিশ বছরের কোনো দায়িত্বশীল নারীর এমন কাণ্ড আসলেই অনর্থক। আসলে আমাদের জীবনে অনেক কিছুই অনর্থক হওয়া সত্বেও ঘটনাটা সত্যে উপনীত হয়। কখনো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস এসে হানা দেয়, আবার কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিরহ এসে জড়িয়ে ধরে বিনা বাঁধায়। কিন্তু মানুষের সেই সকল অনর্থক জিনিসের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে শেষ প্রহরের অপেক্ষা করতে হয়।
দিনার জীবনেও এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায় ছিল ইরাফ। ইরাফ নামক অধ্যায়টা দিনার জীবনে এমন এক অনুভূতি এবং এমন এক বিরহ যা সে কখনোই চায়নি। কিন্তু ভাগ্য তো আর কারোর চাওয়া বা না চাওয়ার উপর ভিত্তি করে আসে না। দিনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ইরাফের দেওয়া ধোঁকা তাকে এখনো পোড়ায়। কিন্তু সবশেষে সে এটা মনে করার চেষ্টা করে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার জন্য ভালো কিছু ঠিক করে রেখেছেন। বারবার তার মনে পড়ে কুরআনের সেই চার আয়াত,
‘ কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। অতএব, অবসর পেলেই ইবাদত করুন। এবং আপনার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ করুন।’
[সূরা- আলাম নাশরাহ, আয়াতঃ৫-৮]
মন সায়রে বিষন্নতার দাপট ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বগতিতে যাচ্ছে আজ। সে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে দু মাস হলো। গত ছয় বছরে ইরাফের বলা সবগুলো কথা হৃদয়ে গেঁথে সেও ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। যে মানুষটা তার ভবিষ্যতের জন্য দিবাকে ছেড়ে যেতে দুবার ভাবেনি, সেই মানুষটাকে মনে করে দিবা কেন কষ্ট পাবে! সবকিছু ভুলে নিজের ক্যারিয়ার গঠনে সকল পরিশ্রম দেওয়া শুরু করল। সবশেষে সে স্বাবলম্বী হতে পারল। কিন্তু আবেগ অনুভূতির হিসেবগুলো এখনো অপূর্ণ রয়ে গেল তার। দিনার ভাবনায় ছেদ পড়লো কারও ডাকে।
‘কিরে, এখনো রেডি হলি না? ওরা সবাই চলে এসেছে তো।’
দিনা পেছনে ফিরল। তার বড় ভাই রাফি দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে তাকে। দিনা বলল,
‘আমি রেডি।’
‘সেকি! এত সাদামাটা হয়ে যাবি? বিয়েতে বউ যদি এত সাদামাটা হয়ে থাকে তাহলে কি ভালো দেখাবে?’
‘ভাইয়া এমন কেন করছেন আমার সাথে? আম্মু আব্বু আর আপনার সাথে আমার তো রক্তের সম্পর্ক! তবুও আমার সাথে বেঈমানী করছেন! সবাই কি আমার সাথেই এমন কেন করে বলতে পারবেন?’
রাফি বোনের মাথায় হাত রেখে বলল,
‘আমদের সামনে ঘটে যাওয়া সবকিছু সত্যি হয় না। এর পেছনে অনেক বড় কারণ লুকিয়ে থাকে। বাবা মা কখনো তার ছেলেমেয়ের খারাপ চান না। তারা উপর থেকে কঠোরতা আর রাগ দেখালেও তা সত্যি হয় না। এর পেছনে লুকিয়ে থাকে সন্তানের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, মায়া আর যত্ন। বড় ভাইয়ের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তাই আমরা যা করছি তা বেঈমানী না।’
‘তাহলে কী?’
রাফি দিনার পাশে বসে নমনীয় কণ্ঠে বেশ কিছু কথা বলল। দিনা চুপচাপ শুনলো। কোনো কথা বলল না। সব কথা শোনার পর দিনা তার ভাইকে জড়িয়ে ধরল। যাই হোক না কেন বাবা মা ভাই বোনের মায়া খুব গাঢ় হয়। বিয়ের পর পুরো পরিবারকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবেই দিনার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। রাফি বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘বুঝতে পেরেছিস?’
দিনার মনে হাজারো তোলপাড় চললেও পরিবারকে কষ্ট দিতে চাইলো না। সে সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল,
‘হুম’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। তুই আম্মুর সাথে বাহিরে আসিস।’
রাফি বেরিয়ে যেতেই দিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ্যাঁ, আজ তার বিয়ে। বাবা মা ও ভাইয়ের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে। সব কথার শেষে রাফি যখন দিনাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তখন সে দ্বিতীয়বার না ভেবেই সম্মতি জানিয়েছিল। এখন পরিবারের সবার খুশির জন্য চুপ থাকাটাই সর্বশ্রেষ্ঠ। তাছাড়া সে তো এখন আর অন্যকাউকে নিয়ে ভাবে না। তাই অসম্মতি জানানোর মানে হয় না। দিনার মা এসে তার চেহারায় আরেকটু প্রসাধনী মাখিয়ে নিয়ে গেল বাহিরে। অল্প কয়েকজন মানুষ, আত্মীয় আর পূর্ণতারা ছাড়া তেমন কেউ নেই। আকদ্ সাদামাটাভাবে করার মনোভাব ছিল দুই পক্ষেরই। দিনাকে সোফায় নিয়ে বসানো হলো। মাঝখানে পাতলা লাল ওড়না দেওয়া হয়েছে। ওপাশে বসে আছে দিনার ভবিষ্যত জীবনের সঙ্গী। বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। দিনার দিকে রেজিস্ট্রি পেপার এগিয়ে দেওয়া হলো। দিনার চোখের কয়েকটি ফোটা অশ্রুতে ভিজে গেল রেজিস্ট্রি পেপারের কিছু অংশ। কাঁপা হাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে স্বাক্ষর করে দিল সে।
____
বিয়ের ঝামেলা কিছুটা শীথিল হয়ে এলো। ঘড়ির কাটায় রাত আটটা। এরুম থেকে ঐ রুমে দৌড়াদৌড়ি করছে তিন বছরের ছোট্ট অরুনিমা। তার পিছুপিছু দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে পূর্ণতা। এক সময় রাগ করে অরিত্রকে ডেকে বলল,
‘তোমার মেয়েকে নিয়ে আর পারছি না। সেই দুপুরে খেয়েছে, এখনো অবধি নাস্তা খাওয়াতে পারলাম না। বেড়াতে এসেও দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। তোমার মেয়েকে তুমি খাওয়াও।’
কথাটা বলেই নাস্তার প্লেটটা অরিত্রের হাতে ধরিয়ে দিল পূর্ণতা। এই শীতের মাঝেও তার নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। অরিত্র ভাবলো, আসলেই সন্তানকে বড় করতে মায়েরা কতটাই না কষ্ট করে! যে মেয়ে বিয়ের আগে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতো না, সে মেয়ে মা হওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্যও সন্তানের যত্ন নিতে ভুলে না। এই যেমন পূর্ণতা বান্ধবীর বিয়েতে এসেও মেয়ের যত্ন নিতে ভুলছে না। আসলেই পূর্ণতা একজন দায়িত্বশীল মেয়ে, বউ এবং মা। অরিত্র পূর্ণতাকে দেখে আবারও এক প্রশান্তির শ্বাস ফেলল। মেয়েটাকে পেয়ে আসলেই সে খুব খুশি। তারা আপাতত দিনার রুমে বসে আছে। এই মুহূর্তে কেউ নেই এই রুমে। অরিত্র পাঞ্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে নরম স্পর্শে পূর্ণতার নাকের ডগায় জ্বলজ্বল করতে থাকা ঘামটুকু মুছে দিল। কোমল কণ্ঠে বলল,
‘মেয়েকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমি নিলাম। কিন্তু আমার বউটা কি নাস্তা করেছে?’
‘হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। প্রেম উথলে পড়ছে!’
‘বারে! প্রেম উথলে পড়বে না! আমার বউয়ের সাথে প্রেম করার সবটুকু অধিকার আমার আছে। তাই তো বারবার হাজারবার তোমার প্রেমে পড়ি।’
‘আবারও শুরু হয়ে গেল! যাও তোমার মেয়েকে খাওয়ে আসো। আমি দিনার কাছে গিয়ে বসছি।’
‘যথা আজ্ঞা মহারাণী। ‘
আকস্মিক পূর্ণতার গালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেল অরিত্র। পূর্ণতা হতভম্ব হয়ে বসে রইল। ভাগ্যিস কেউ ছিল না। নাহলে কি পরিমাণ লজ্জায়ই না পড়তে হতো তার! অবশ্য কেউ থাকলে অরিত্র কখনো এমন কিছু করতো না তা পূর্ণতা জানে। সবার সামনে সবকিছু সোভা পায় না, সে যতই স্বাভাবিক হোক না কেন। এই বিষয়টা অরিত্র খুব মানে। সে তার স্ত্রীকে যথেষ্ট সম্মান করে। এমন কিছু কখনোই করবে না যাতে পূর্ণতা সবার সামনে অস্বস্তিতে পড়ুক। আর ভালোবাসা! সেই হিসেব রাখার মতো ক্ষমতা পূর্ণতার নেই। পূর্ণতা হালকা হেসে বসার ঘরে চলে গেল।
দিনা আর পাশে তার কয়েকজন কাজিন বসে আছে। পূর্ণতা দিনার পাশে গিয়ে বসল। কাঁধে হাত রাখতেই দিনা ছলছল চোখে তার দিকে তাকাল। পূর্ণতা চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করল, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। দিনার মন ভালো করার জন্য বলল,
‘এই মাফিন সবসময়ের মতো লেইট লতিফই রয়ে গেল। বিয়ে শেষ হয়ে গেল এখনো আসতে পারেনি ফকিন্নিটা।’
‘মিফতার পা মচকে গেছে। আসতে পারবে না বলেছে।’
‘কী বলিস! কবে মচকালো?’
‘কালকে।’
‘আহারে! তাহলে মিস করল বেচারি। ওকে ছাড়া আড্ডা তেমন জমে না।’
পূর্ণতার মন খারাপ হয়ে গেল। তখনই আগমন ঘটল মিফতার। জোরে করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,
‘সারপ্রাইজ!’
চলবে…