হৃদয়াক্ষী পর্ব-০২

0
1667

#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_০২
#সারিফা_তাহরিম

গালে আবারও সেই শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শ পেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল পূর্ণতা। এইবার ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেল। কিন্তু নড়ল না। অরিত্র তো তখন বের হয়ে গিয়েছিল। এখন কি আবার ফিরে এসেছে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মস্তিষ্ক নেতিবাচক সায় দিল। অরিত্র আসার কোনো সম্ভাবনা তো নেই। কারণ সে যাওয়ার পরপরই পূর্ণতা দরজা লক করেছিল। স্পষ্ট মনে আছে পূর্ণতার। অরিত্র যদি না-ই হয়ে থাকে তাহলে এই মুহূর্তে কে বসে আছে? তখনই মনে হলো পূর্ণতার গালের উপর শীতল স্পর্শ হলো। গালটা ভিজে উঠলো। পূর্ণতা চমকে উঠলো। ঘুমের ভান করেই চোখ আলতো করে খুলল যাতে বুঝা না যায় যে সে জেগে গেছে।

ড্রিম লাইটের হলদে টিমটিমে আলোয় দেখতে পেল একটা আবছা অবয়ব তার গালে আদর করতে করতে হালকা হালকা কেঁপে উঠছে। পূর্ণতা আৎকে উঠলো। এ যে তার বাবা! বাবা এত রাতে এসে কান্না করছেন! তাও আবার গালে হাত বুলিয়ে! পূর্ণতা বুঝতে পারল দুপুরের সেই চড় দেওয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন। মুহূর্তেই পূর্ণতার অভিমানের পাহাড় ভেঙে গুড়িয়ে অশ্রুকণায় রূপান্তরিত হতে চাইল।

বাবা নামক মানুষগুলো এত যত্নশীল হয় কেন? সন্তানকে একটা চড় মেরে বাবা তো আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। পূর্ণতার মন সিক্ত হয়ে উঠলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু সে নিজেকে অতি কষ্টে সামলে নিল। বাবা যদি জানতে পারেন যে পূর্ণতা জেগে গেছে তাহলে তিনি হয়তো অস্বস্তিতে পড়ে যাবেন। কারণ নিজেদের কষ্টকে কখনো দৃশ্যমান হতে দেন না, বরং গাম্ভীর্যতা ও কঠোরতার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চায়। পূর্ণতা নিজের অশ্রুকণাকে আড়াল করতে থাকল। মঈনুল হাসান কিছুক্ষণ পর মেয়ের মুখে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলেন। প্রতিটা রুমের একটা এক্সট্রা চাবি তাঁর কাছে সবসময় থাকে। তাই পূর্ণতার রুমে আসতে কষ্ট হয়নি। মঈনুল হাসান বেরিয়ে যেতেই পূর্ণতা অপর পাশে ফিরে বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মনে মনে বারকয়েক একটা কথা আওড়াল যা কখনো প্রকাশ্যে বলা হয়নি। সেটা হচ্ছে,
‘আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি বাবা’

________

গ্রীষ্মের তীক্ষ্ণ রোদ আকাশের বুক চিড়ে উঁকিঝুঁকি মারছে ধরনীর বুকে। বাহারি রকমের ফুলের সুবাস ঘরময় বিচরণ করছে। বাড়ির পাশের ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে কয়েক জোড়া পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ছুটে গেল পূর্ণতার। জানালার পর্দা ভেদ করে আসা তীক্ষ্ণ আলোকরশ্মির কারণে চোখ মেলা দায় হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলল পূর্ণতা। আড়মোড়া ভেঙে দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলাতেই দেখল সকাল দশটা বেজে গেছে। পূর্ণতা ঘুমপ্রিয় মানবী হলেও ভার্সিটি যাওয়ার জন্য প্রায় সময় ই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে। আজও ভার্সিটি যাবে ভেবেছিল। সামনে পরীক্ষা তাই কোনো ক্লাসই মিস দিতে ইচ্ছুক নয় পূর্ণতা। কিন্তু গতকাল এত ধকল যাওয়ার পরে শরীর পুরোই নেতিয়ে পড়েছিল পূর্ণতার। তাই আর ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। আর মাও আজ তাকে ডাকল না! ভারি অবাক হলো পূর্ণতা। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরুতেই দেখল তার বাবা বসার ঘরে বসে পেপার পড়ছেন। চোখে চশমা, মুখে গাম্ভীর্যতা। ডাইনিং রুমে মা আর মৌনতা বসে গল্প করছে আর নাস্তা করছে। পূর্ণতা সেদিকে যেতেই মা খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল। মৌনতা বলল,

“আপু, বয় তাড়াতাড়ি। কত বেলা হয়ে গেল তুই এখনো কিছু খাসনি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমি পরোটা ভেজে আনছি দাড়া।”

মৌনতার কথার মাঝে পূর্ণতা চেয়ারে বসতেই মা উঠে চলে গেলেন রান্নাঘরে। ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না পূর্ণতার। মা কি তার উপর কোনো কারণে রেগে আছে? সে মৌনতাকে বলল,

“তোর কষ্ট করতে হবে না মনাপাখি। তুই বয়। আমি নিজেই পরোটা ভেজে আনছি। ”

পূর্ণতা পরোটা ভাজার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে গেলেও তার মূল উদ্দেশ্য মায়ের ভাব ভঙ্গিমা পরখ করে দেখা। সে রান্নাঘরে গিয়ে মাকে সবসময়ের মতো স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

“মা, খিদে পেয়েছে ভীষণ। পরোটা কোথায় রেখেছ? তাড়াতাড়ি বলো। খিদেয় পেটের ভেতর ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।”

অন্যদিন হলে এতক্ষণে পূর্ণতা বেশ কয়েকটা বকা শুনতো খাভারের অনিয়মের কারণে। কিন্তু মা আজ কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ পরোটা এনে পূর্ণতার সামনে দিলেন ভেজে নেওয়ার জন্য। মায়ের এমন নিরবতা মেনে নিতে পারল না পূর্ণতা। মা কী তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? গতকাল নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও বিয়েটা করেছে, বাবা মেরেছে কতটা ধকল গেছে! মানসিকভাবে ভালো নেই পূর্ণতা। কিন্তু বাবা মায়ের খুশির জন্য ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু তার বদলে মা তার সাথে এমন ব্যবহার করছে? তিনি কি আদৌ জানেন পূর্ণতার মনে কতটা কষ্ট হচ্ছে?

পূর্ণতা নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পরোটা ভেজে নিল। মাকে বলল,

“মা, চা টা তুমি বানিয়ে দাও না প্লিজ। আমার না ভীষণ আলসেমি লাগছে৷”

‘এই মেয়ের জ্বালায় শান্তি পাব না আমি। এত বড় ধাড়ী মেয়ে হয়ে গেল কিন্তু মায়ের উপর বসে খাওয়ার অভ্যাসটা গেল না। বলি কি, শ্বশুরবাড়িতেও কি মাকে সাথে নিয়ে যাবি নিজের কাজ করানোর জন্য? তখন নিজের কাজগুলো কে করে দিবে? শ্বাশুড়ি যদি বিচার নিয়ে আসে তাহলে কিন্তু আমি সামলাতে পারব না বলে দিলাম।’
পূর্ণতা প্রতিদিন সকালের মতো এমনই একটা উত্তর আশা করছিল। কিন্তু না, আজ আর তা হলো না। মা কোনো জবাব দিলেন না। চায়ের ফ্লাক্স এনে পূর্ণতার সামনে রাখলেন। মায়ের ব্যবহার অবাক হলো এবং কষ্টও পেল। মা এমন কেন করছে তার সাথে? কী দোষ তার? কান্না পেল পূর্ণতার। কিন্তু সে স্থির রইলো। খাবার টেবিলে মৌনতা পূর্ণতার বিয়ে সংক্রান্ত অনেক কথা বললেও পূর্ণতা আর তার মা শুধু শুনেই গেল। কেউ কোনো কথা বলল না। খাওয়া শেষে টেবিল থেকে ওঠার সময় নাজিবা হাসান পূর্ণতার উদ্দেশ্যে বললেন,

“আজ বিকেলে অরিত্রের পরিবার আসবে তোমাকে দেখতে। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই একটু পরিপাটি হয়ে থাকবে। সুন্দরভাবে কথা বলবে তাদের সাথে, বিশেষ করে অরিত্রের সাথে। কোনো ঝামেলা যেন না হয় আগেই বলে দিলাম।”

মায়ের কণ্ঠস্বর পেয়ে পূর্ণতা মনে মনে আলোড়িত হলেও তার কথা শুনে সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ল। আবারও সেই অসহ্যকর মানুষটার সাথে দেখা হবে? ভাবতে পারছে না সে। তার উপর মায়ের কথাগুলো কেমন যেন ছিল। কেমন কড়া কণ্ঠ, রাগী আর যত্নহীন মনে হলো। পূর্ণতা রুমে এসে পড়লো। তার চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সে আসলেই বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে এসব। এই অরিত্র নামক মানুষটা তার জীবনে আসার পর থেক্বি সবকিছু কেমন উলোট পালোট হতে শুরু করলো যেন। ফোন তীব্র স্বরে বেজে উঠলো। পূর্ণতা বিরক্ত হলো। অচেনা নাম্বার দেখে ফোন রিসিভ করলো না। আরও কয়েকবার ফোন আসার পর পূর্ণতা আকাশসম বিরক্তি নিয়ে ফোন রিসিভ করল।

“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি অরিত্র। কেমন আছেন মিসেস? এখনো অবধি আমার নাম্বার সেইভ করেননি?”

অরিত্রের কণ্ঠ শুনে গা জ্বালা করে উঠলো পূর্ণতার। যে মানুষটাকে এতক্ষণ রাগে গালি দিচ্ছিল সে মানুষটাই কিনা এখন কল করেছে। পূর্ণতার পাহাড়সম রাগ হলো। গম্ভীর আর কিছুটা রাগী স্বরে বলল,

“আপনি আমার জীবনে আসার পর যেমন থাকার কথা ঠিক তেমনই আছি। আর আপনার নাম্বার থেকে তো আমার নাম্বারে কখনো কল আসেনি তাই সেইভ করার প্রশ্ন আসছে না।”

অরিত্র স্মিত হাসলো। ফোনের এপাশ থেকে তা বোঝা গেল না। সে নরম সুরে বলল,

“ম্যাডাম রেগে আছেন বুঝি?”

পূর্ণতা প্রতুত্তর করল না। অরিত্র বলল,

“ইশ! কত্ত রাগ আমার পিচ্চি বউটার। এত পিচ্চি একটা মেয়ে হয়ে এত এত রাগ নিয়ে কিভাবে চলেন বলো তো। এত রাগ কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই রাগ করে না থেকে হাসো। রাগ ঝেড়ে ফেলো। তারপর দেখবে ভালো লাগছে।”

পূর্ণতা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

“তা রাগ কার উপর ঝাড়বো? আপনার উপর?”

অরিত্র আবারও হাসলো। অমায়িক সেই হাসি। সে নরম স্বরে বলল,
“বউটাও আমার, রাগটাও আমার উপর। তাই আমার উপরই রাগ ঝাড়ো। যত খুশি তত রাগ ঝাড়ো। আমি সবটা সয়ে নিব। তবুও তুমি দিন শেষে একটু মন খুলে কথা বলো, একটু হাসো, একটু নিজের মতো করে বাঁচো। এটাই চাই।”

পূর্ণতা কিছু বলল না। এই লোকটার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। মুখের উপর ফোন কেটেও দিতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর অরিত্র বলল,

“আজ তোমাদের বাসায় যাব। আমার রাগী বউটার পাহাড়সম রাগ গলানোর জন্য কী করতে হবে বলো।”

পূর্ণতা যেন এবার একটা সুযোগ পেল। বারান্দা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে বলল…

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে