হঠাৎ বৃষ্টি পর্ব-১১

0
579

#হঠাৎ_বৃষ্টি
পর্বঃ১১
জান্নাতুল নাঈমা

গৌধূলী বেলা। সূর্যের প্রকোপ কিছুটা কমেছে। চারদিকে হাজারো মানুষের আনাগোনা। এই ব্যস্ত নগরীর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে মেঘ। হসপিটালের ছাদ থেকে প্রতিটা মানুষকে ক্ষুদ্র দেখা যাচ্ছে। মেঘ সেদিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো,,’এখান থেকে মানুষকে যতটা ক্ষুদ্র দেখায়,মানুষের জীবন এর চেয়েও ক্ষুদ্র! যখন তখন মানুষের জীবনের মোড় পাল্টে দিতে পারে।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্বাস ফেললো মেঘ। স্বস্তির শ্বাস। শুভ্রতা এখন আগের চেয়েও ভালো আছে। কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙ্গেছে। কিন্ত মেয়েটাকে এখনও দেখতে পারে নি। তার আগেই বাবা,মা,ভাই এসেছে। ওদের রেখে নিজে দেখতে যাওয়া ঠিক দেখাবে না। তাই নিজের মনকে শ্বান্ত করতে এখানে আসা। কারণ দুনিয়ার সবাই ফিরিয়ে দিলেও প্রকৃতি কখনও ফেরায় না। তুমি প্রকৃতিকে ভালোবাসলে, প্রকৃতিও তোমায় ভালোবাসবে। কথাগুলো মেঘ শুভ্রতার থেকেই শিখেছিলো। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো অনেক সময় হয়ে গেছে। মেঘ তাই ধীর পায়ে নিচের দিকে অগ্রসর হলো।
শুভ্র রাঙা কেবিনে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে শুভ্রতা। সামনে মা,বাবা,ভাই। অনেকদিন পর নিজের পরিবারকে দেখে আনন্দের সীমা নেই। পাশেই মা মুখ চেপে কান্না করছে। বাবার চোখেও পানি টলটল করছে। শুভ্রতা ওদের শান্তনা দিচ্ছে ঠিকই কিন্ত মনের মধ্যে মেঘ নামক খচখচানি যে যাচ্ছে না। তার প্রেমিক পুরুষকে এক পলক দেখা ছাড়া যে কিছুই ভালো লাগছে না। ‘মেঘ আপনি কোথায়!’ নিজের মনে মনে আওড়ায় শুভ্রতা।
দরজায় কারো টোকা দেওয়ার আওয়াজে কেবিনে উপস্থিত সবার ধ্যান ভাঙ্গে। শুভ্রতা চোখ তুলে তাকাতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠে। ইসস কি অবস্থা হয়েছে ছেলেটার। শুভ্রতার মা-বাবা মেঘকে দেখে বলে,,’আসো বাবা। ভেতরে আসো!’
মেঘ তাদের কথায় ভেতরে প্রবেশ করে। ইনিয়েবিনিয়ে শুভ্রতাকে জিজ্ঞাস করে,,’এখন কেমন লাগছে!’
শুভ্রতা মাথা নাড়িয়ে বলে,,’ভালো!’

‘বাবা। তোমাকে যে আমরা কি বলে ধন্যবাদ জানাবো। তুমি না থাকলে আমার মেয়েটার যে কি হতো। সারাজীবনের জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম।’
শুভ্রতার বাবার কথায় মেঘ বলে,,’ছিহ ছিহ আংকেল কি বলছেন? এটা আমার দায়িত্ব ছিলো। আর ভূলটা আমার ছিলো কারণ আমি আরেকটু সচেতন হলে এইসব কিছু হতো না।’
‘ওই চেয়ারম্যানের পোলার জন্য আর কি কি যে সহ্য করতে হবে। আল্লাহ জানে!’
শুভ্রতার মায়ের কথায় মেঘ মুচকি হেসে বলে,,’আন্টি আর কোনো চিন্তা নেই। ওই আসিফকে উচিৎ শাস্তির ব্যবস্থা আমি করে এসেছি। ওর নামে অনেকগুলো কেস করা হয়ে গেছে। সাথে পুলিশ এরেস্টও করেছে। এটা আপনাদের গ্রামের থানা না ঘুষ খাইয়ে ছাড়ানোও যাবে না। জেলেই পচে মরবে।’
মেঘের কথায় শুভ্রতার মা-বাবা স্বস্তির শ্বাস ফেললো।
‘আপনে আমার জামাইবাবু হবেন? আপনিই তো আমার দুলাভাই!’ হঠ্যাৎ করে শুভ্রতার ভাইয়ের কথায় ভড়কে যায় উপস্থিত সবাই। কিন্ত এতে তার ভাবান্তর নেই। সেই একমনে পা নাচিয়ে বসে আছে। এইভাবে শান্ত ভাবে বোমা পাটানো যায় সেটা শুভ্রতার ভাইকে না দেখলে মেঘ বুঝতো না। শুভ্রতা আর মেঘ দুজনেই লজ্জা ফেলো। শুভ্রতার মা ছেলেকে ধমক দিয়ে বলে,,
‘এই কি বলছিস কি এগুলো? চুপ!’ অতঃপর মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,,’কিছু মনে করো না বাবা। ও একটু বেশী ফাজিল। তোমরা কথা বলো। আমরা বাইরে বসছি।’
‘না না আন্টি ঠিক আছে। আপনারা থাকুন।’ মেঘের কথায় শুভ্রতার বাবা মেঘের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,,
‘আমরা গরীব হয়তো কিন্ত নিজের সন্তানকে অসম্ভব ভালোবাসি। খেয়াল রেখো।’ কথাগুলো বলে উনারা বাইরে গেলেন। মেঘের খুশি দেখে কে। শুভ্রতার বাবার কথাতে মেঘ শিউর হয়ে গিয়েছে সবটা। তারপর শুভ্রতার দিকে একপলক তাকিয়ে পা চালিয়ে বেডে ধুম করে বসে পড়ে। আকস্মিক কান্ডে শুভ্রতা ভড়কে গেলো। বেডটা বেশ বড়সড়। আর শুভ্রতা খুব চিকন যার কারণে কাত হয়ে মেঘ বেডে শুয়ে গেলো।

মেঘকে এভাবে শুতে দেখে শুভ্রতা হেলান ছেড়ে উঠে বসে। তারপর দু আঙ্গুল দিয়ে মেঘের শার্ট পেছন থেকে টেনে বলে,,’কি হইছে? শরীর খারাপ লাগছে? আর নিজের চেহারার এই অবস্থা কেনো করেছন?’
মেঘ কোনো উত্তর দেয় না নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে থাকে। শুভ্রতা কপালে দুটো ভাজ ফেলে হালকা মেঘের দিকে ঝুকে বলে,,’কি হলো মেঘ। চুপ করে আছেন যে?’
মেঘের কি হলো কে জানে শুভ্রতার দিকে ফিরে শুভ্রতার হাত দুটো টেনে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। মেঘের চোখ দুটো কেমন ভিজে আছে। শুভ্রতা তা দেখে বলে,,’এই আপনি কাঁদছেন কেনো? ছেলেরা এইরকম ছিঁচকাঁদুনী হলে চলে? আর আমি কি মরে গেছি নাকি?’
শুভ্রতার কথায় মেঘ শুভ্রতার মুখে হাত দিয়ে বলে,,
‘এমন কথা আর কোনোদিন বলবে না শুভ্র! তুমি জানো কাল আমার কি অবস্থা হয়েছিলো। আমি তো ভয়ে মরেই যাচ্ছিলাম। তোমাকে খুঁজে না পেয়ে নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছিলো। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। আমার নিঃশ্বাস বন্ধু হয়ে আসছিলো। কি ভীষণ যন্ত্রণায় ছিলাম আমি।’
শুভ্রতা মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,’হুসস। চুপ করুন মেঘ। শান্ত হোন। আমার কিছু হয়নি। এভ্রিথিং ইজ অলরাইট!’
শুভ্রতার কথায় মেঘ শোয়া থেকে উঠে বসে বলে,,
‘শুভ্র আমায় বিয়ে করবে?’
হঠ্যাৎ মেঘের এমন কথার জন্য প্রস্তুত ছিলো না শুভ্রতা। যে ছেলে এখনও ভালোবাসি বলে উঠতে পারলো না। একরাতে বিয়ের কথা বলে ফেললো! শুভ্রতা হা করে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্ত মেঘকে দেখে এটা বুঝতে পেরেছে যে মেঘ সিরিয়াস! শুভ্রতা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
‘কি হলো শুভ্র কিছু বলছো না যে?’ মেঘের কথায় শুভ্রতা মাথা নিচু করে বলে,,
‘মেঘ আপনারা আমাদের থেকে অনেক উঁচু বংশীয়। আমি গ্রামের একটা সাধারণ মেয়ে। আমার বাবা কোনোমতে আমাদের সংসার চালায়। আর সেখানে আপনারা কোথায় আমরা কোথায়? আপনি পরিবার আমাকে কি করে মেনে নেবে? উনাদেরও তো একটা চাহিদা আছে নিজের ছেলের বউয়ের ব্যাপারে! আমি তেমন স্মার্ট বা সুন্দরী কোনোটাই নই।’

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকালো। মেঘের চোখ দুটো কেমন লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। কপালের রগটা কেমন ফুলে উঠেছে। মেঘকে শুভ্রতা কোনোদিন রাগতে দেখে নি। কিন্ত আজকে মেঘের রাগ দেখে কেমন ভয় লাগছে। ভয়ে ভয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘ শুভ্রতার দুবাহু খামছে ধরে বলে,,,’আর একটা বাজে কথা বলবে খু*ন করে ফেলবো শুভ্রতা! তোমার আমাকে লোভী মনে হয়? তোমার বাবার টাকা থাকুক বা না থাকুক আমার কি? আমার সুন্দর স্মার্ট মেয়েদের প্রতি লোভ দেখেছো কোনোদিন? আমি কোনোদিন তোমাকে এই ব্যাপারে কিছু বলেছি? কোনোদিন বলেছি তুমি সাজো? তুমি স্মার্ট হও? তোমার ড্রেসাপ নিয়ে কিছু বলেছি? তুমি যখন যেভাবে আমার সামনে এসেছো আমি তোমাকে এক্সেপ্ট করেছি। মুগ্ধ হয়েছি। কোনোদিন তোমার এডভান্টেজ নিয়েছি? প্রয়োজন ছাড়া তো তোমার হাত টাও ধরি নি! তুমি কি ভাবো আমি তোমার সাথে টাইমপাস করেছি? আমার সময়ের কোনো মূল্য নেই। কাল যখন তোমায় পাচ্ছিলাম না পাগলা কু*কু*রের মতো খুঁজে বেড়িয়েছি। রাস্তায় রাস্তায় দৌড়েছি। আর তুমি আমাকে বংশ, সৌন্দর্যের দোহাই দেখাও? আর ইউ কিডিং উইথ মি! তোমায় আমি বিয়ে করবো। তুমি থাকবে আমার সাথে। আমার পরিবার এখানে আসছে কেনো? আর তোমার আমার পরিবারকে লোভী মনে হয় যে আমার পরিবার তোমার বাবার টাকা দেখবে?’

মেঘ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে বেড থেকে নেমে যায়। দেয়ালে গিয়ে সজোরে একটা ঘুষি মারে। শুভ্রতা তা দেখে শব্দ করে কেঁদে দেয়। মেঘ কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। শুভ্রতা কয়েকবার ডাকে কিন্ত মেঘ সাড়া দেয় না। আকস্মিক মেঘকে এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে শুভ্রতার মা-বাবা শুভ্রতার রুমে ডুকে। মেয়েকে কাঁদতে দেখে উনারা অস্থির হয়ে যায়।
‘কিরে শুভ্রা? কি হয়েছে কাঁদছিস কেনো? মেঘ কিছু বলেছে?’
মায়ের কথায় শুভ্রতা মাথা নাড়িয়ে না বুঝায়। শুভ্রতার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,’তাহলে কি হয়েছে বল আমায়?’
‘উনি আমাকে বিয়ে করতে চান।’ শুভ্রতার কথায় শুভ্রতার বাবা হাসি মুখে বলেন,,’এটা তো ভালো কথা। ছেলেটা তোকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে নিজের সাথে রাখবে। আর ছেলেটা তো খুব ভালো। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তুইও তো ওকে পছন্দ করিস। তবে সমস্যা কোথায়?’

শুভ্রতা নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,,’কিন্ত বাবা আমরা যে ওদের সমানে সমানে না। ওর পরিবার আমায় কি মেনে নেবে? এই কথাগুলো বলেছিলাম বলে উনি রেগে বেরিয়ে গেলেন!’ শুভ্রতার কথায় মা-বাবা দুজনেই চুপ করে গেলেন। এই কথার বিপরীতে কি বলবেন খুঁজে ফেলেন না। কারণ আমাদের সমাজে মেয়ের বাবার যে টাকা থাকা জরুরি। মেয়ের গুণ না থাকলেও রুপ আর বাবার টাকা থাকা লাগে।

#চলবে?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে