স্পর্শতায় তুমি পর্ব-০৬

0
640

#স্পর্শতায় তুমি
#পর্ব_০৬
#অধির_রায়

ঋষিকে ছোঁয়ার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত করেছেন ছোঁয়ার শ্বাশুড়ি। ঋষির প্রতিটি কাজে ছোঁয়ার শ্বাশুড়ি মুগ্ধ। একাধারে মন দিয়ে সকল কাজ করে যাচ্ছে ঋষি৷ অজান্তা ঋষির তার কাজের তুলনায় অনেক বেশি কাজ দেয়৷ তবুও ঋষি পিছপা হয়নি৷ বরং সব কাজের সাথে মোকাবেলা করে কাজকে সহজ করে নিয়েছে৷ ছোঁয়ার কেবিনে অজান্তা প্রবেশ করতে করতে বলল,

“ছোঁয়া বউদি তোমার কাজ এখনও শেষ হয়নি? আরও কাজ করবে? শেষ কতে কতক্ষণ লাগবে?”

ছোঁয়ার অজান্তার দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল,

“কিছু বলবে? আমার তেমন কোন কাজ নেই৷ আমার প্রায় সব কাজ কমপ্লিট করে দিয়েছে মি.ঋষি রাজ৷ সেজন্য মি. ঋষিকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার৷”

ছোঁয়ার কথা বলা বাক্যটি ঋষির বুকে তীরের মতো লাগল৷ ঋষিকে কখনও ছোঁয়া ঋষি রাজ বলে ডাকেনি৷ সব সময় ঋষি বলে ডাকতো৷ ঋষি রাজ বলতে গিয়ে ছোঁয়া অবস্থা নাজেহাল হয়ে পড়েছিল৷ বন্ধ মহলে সবাই উচ্চস্বরে হেঁসে গড়াগড়ি খেয়েছে৷ আজ ছোঁয়া নির্বিকারে বলে যাচ্ছে ঋষি রাজ৷

অজান্তা আহ্লাদী স্বরে বলল,

” আজ আমরা কোথাও ঘুরতে যেতে পারি! আমার কাজ করতে ভালো লাগছে না৷ প্লিজ মানা করো না৷”

ছোঁয়া ঋষির দিকে এক পলক দৃষ্টি মেলে তাকায়৷ আহত কন্ঠে বলল,

“আমার জীবনের ডিকশিনারি থেকে ঘুরতে যাওয়া নামটা মুছে গেছে৷ কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করে না৷ ঘুরতে ভালো লাগে যদি পাশে কেউ থাকে৷ ভালোবাসার মানুষ ছাড়া সবকিছু বিষাদময় লাগে৷ আমি পারব না তোমার কথা রাখতে।”

অজান্তা জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। আফসোস কন্ঠে বলল,

“আজ দাদা তোমার সাথে থাকলে তোমার লাইফটা এমন হতো না৷ তোমার লাইফে অনেক পরিবর্তন হতো৷ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার লাইফে রং হারিয়ে গেছে।”

অজান্তার কথাগুলো ঋষির মাথার উপর দিয়ে গেল৷ কিছুই বুঝতে পারল না৷ অজান্তা কি বলল? ছোঁয়ার লাইফ থেকে রং হারিয়ে গেছে৷ ঋষির মাথায় এমন ভাবনা আসতেই ঋষির অগ্নি দৃষ্টিযুক্ত আঁখি জল ভরে উঠে৷ কৌতূহল নিয়ে আহত কন্ঠে বলল,

“ছোঁয়া ম্যামের জীবনে কি ঘটেছে? যার জন্য ছোঁয়ার ম্যান নিস্তব্ধ হয়ে গেছে৷ আপনি এ বিষয়ে কিছু জানেন? ম্যামের লাইফ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা করছে৷”

ছোঁয়া ছলছল নয়নে ঋষির দিকে তাকায়৷ দৃষ্টিতে জমা আছে অনেক অভিমান। ঋষির সাহস হলো না ছোঁয়ার চোখে চোখ রাখতে৷ ছোঁয়ার চোখে চোখ রাখলে এখনই ছোঁয়া কান্না করে দিবে৷ বিয়ের আগে ছোঁয়ার সাথে ঋষির সম্পর্ক ছিল, কেউ জানতে পারলে ছোঁয়াকে ভুল বুঝবে সবাই। পরিবারে অশান্তি হানা দিবে৷ অজান্তা কিছু বলার আগেই ছোঁয়া বলল,

“অজান্তা আমি বাহিরের লোকের সামনে পরিবার নিয়ে সমালোচনা করতে পারব না৷ তুমিও কোন সমালোচনা করবে না৷ মি. ঋষি আমার সম্পর্কে জানার কোন প্রয়োজন নেই৷ নিজের লিমিটের মাঝে থাকার চেষ্টা করেন৷ আমার ভালো লাগছে না৷ আমি বাসায় চলে যাচ্ছি৷ তুমি কষ্ট করে মাকে তোমার গাড়িতে তুলে নিও৷ যদি কোন সমস্যা হয় বাসায় যে গাড়ি আছে, সে গাড়ির ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে আসতে বলি৷”

অজান্তা মন খারাপ করে বলল,

“তার কোন প্রয়োজন পড়বে না৷ আমি মাকে ড্রব করে নিব৷ তোমায় এ নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না৷ তুমি বাসায় যেতে পারো।”

ছোঁয়া কথা দীর্ঘ না করে ল্যাপটপ নিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায়৷ সেখানে শত চেষ্টা করে চোখের জল আটকিয়ে রাখতে পারলেও গাড়িতে আটকিয়ে রাখতে পারল না৷ সারা রাস্তায় কান্না করতে করতে ছোঁয়া বাসায় চলে আসে৷ ঋষি চলে আসতে নিলেই অজান্তা ঋষির পথ আটকায়৷ ঋষি শুকনো ঢোক গিলে দুই পা পিছিয়ে যায়৷ ঋষি অজান্তার মতলব বুঝতে পারছে না৷ অজান্তা ঋষিকে বাজে কোন কাজে ফাঁসাবে না তো৷” অজান্তা মিহি নরম স্বরে বলল,

“অফিসের সামনে ক্যাফেডিয়ামে বসে কপি খেতে পারি!”

ঋষি নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

“ম্যাম আমার কাজ আছে৷ দ্রুত কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে হবে৷ ছোট বোনের বিয়ে সামনে। বাসায় অনেক কাজ আছে৷”

“ওয়াও৷ তোমার ছোটবোনের বিয়ে আমাদের ইনভাইট করলে না৷”

“অবশ্যই ইনভাইট করব৷ গতকাল রাতে তার বিয়ের কথা পাকা হয়েছে৷ এক সপ্তাহ পর তার বিয়ে৷ আপনাদের সবাইকেই ইনভাইট করব৷”

“আজ তোমায় কোন কাজ করতে হবে৷ একসাথে কফি খেতে খেতে তোমার বোনের বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানা যাবে৷”

না চাওয়া সত্ত্বেও ঋষি অজান্তার সাথে কফি খেতে রাজি হয়৷ ক্যাফেডিয়ামের টেবিলের দুই কর্ণারে বসে আছে৷ কারো মুখে কোন কথা নেই৷ নিরবতা বিরাজ করছে উভয়ের মাঝে৷ নিরবতা ভেঙে কেউ কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছে না৷ অজান্তা কফির কাপে চুমু দিয়ে বলল,

“তোমার বোনকে কার সাথে বিয়ে দিচ্ছো? ছেলে কি করে?”

“ছেলে ভার্সিটির লেকচারার হিসেবে আছে৷ তবে আশা রাখা যায় আগামী বছরেই প্রফেসর হিসেবে জয়েন্ট হবে৷ শিক্ষকতা খুব ভালো ডাকনাম আছে৷”

ঋষির কথা বলতে কোন ইচ্ছা করছে না৷ অজান্তার কথার শুধু উত্তর দিয়ে যাচ্ছে যাচ্ছে৷ ঋষির কাজ থেকে অজান্তা শুধু উত্তর পাচ্ছে হুম, হ্যাঁ৷ ঋষির কফি তাড়াতাড়ি শেষ করে বিল মিটিয়ে অজান্তাকে পাত্তা না দিয়ে চলে আসে৷

তিথি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“কু”ত্তা, হা’রা’মি, বে’ই’মা’ন। তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে আমরা জানি না৷ তোর বিয়ের কথা আমাদের জানানোর প্রয়োজনবোধটুকুও করলি না৷ তোর মতো হা’রা’মি বন্ধু দিয়ে কি করব? তোর বরের উপর ক্রাশ খাবো সে ভয়ে বলিস নি৷”

প্রকৃতি অসহায় কন্ঠে বলল,

“দোস্ত আমার বিয়ে আমিই জানি না৷ কার সাথে বিয়ে হচ্ছে সেটাও জানি না৷ আমি না জানলে তোদের কিভাবে জানাবো৷ সেজন্য তো দুইদিন ভার্সিটিত আসিনি৷”

প্রকৃতি ইচ্ছা করেই ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করল৷ প্রকৃতি এ মুহুতে কাউকে কিছু বলতে চাচ্ছে না৷ প্রকৃতি এতোদিন সবাইকে বলে আসছে তোর জামাই বুইড়া। এখন নিজের ভাগ্য বুইড়া না পড়লেও প্রকৃতির থেকে বয়সে মিনিমাম ১০ বছরের বড়৷ পুষ্প স্যারে এর সাথে প্রকৃতির বিয়ে হচ্ছে জানতে পারলে সারা ভার্সিটি ঢোল বাজাবে৷

অর্পি চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলল,

“মানে এই বিয়েতে তোর মত নেই৷ তোর অমতে এই বিয়ে হচ্ছে৷ ছোঁয়ার মতো তোর জীবনও শেষ হয়ে যাবে৷ তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি৷ আমরা থাকলে তোর অমতে কিছুতেই তোর বিয়ে হতে দিব না৷”

তিথি চিৎকার দিয়ে বলল,

“দোস্ত তুই এই প্রথম মনের মতো কথা বললি৷ হ্যাঁ আমরা কিছুতেই এ বিয়ে হতে দিব না৷ বিয়ে ভাঙার দায়িত্ব আমাদের।”

প্রকৃতি এদের রুম দেখে বুঝে ফেলছে সুনামী আসতে দেরি নেই৷ কথা কাটাতে হবে এদের থেকে৷ না হলে বন্ধু নামে বি’চ্ছু আমার ক্রাশের সাথে আমার বিয়ে হতে দিবে না৷ প্রকৃতি বলল,

“থামবি তোরা৷ বাজে কথা বন্ধ কর৷ আমি ছোঁয়া নয়৷ আমি প্রকৃতি। আমি যেখানে যাব সেখানেই নিজের রাজত্ব বানিয়ে নিব৷ আমার বিয়ে ভাঙ্গার কোন দরকার নেই৷ আমি তো আর কাউকে ভালোবাসিনি৷ আজ চেহারা খারাপ বলে কেউ পাত্তা দিল না৷ আমার বিয়ে ভাঙার কোন দরকার নেই৷ বরের অভাবে ফেসবুকে কাপল পিক পোস্ট করতে পারিনা৷ বেশি কথা বলবি তোদের কাউকে আমার বিয়ের দাওয়াত দিব না৷”

তিথি চিৎকার দিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল,

“তোর কাছ থেকে আমরা দাওয়াত চাইছি৷ রবিবারে তোর বিয়ে৷ আজ বাসায় যাওয়ার পর মা বাবাকে বলে সন্ধ্যায় তোদের বাড়িতে চলে আসছি৷ তোর বিয়ে হবে৷ তোর বিয়েতে আমরা তোর জামাই বাড়ি যাব৷ তারপর নিজের বাড়িতে ফিরে আসব৷”

প্রকৃতি আর কিছু বলল না। মনে মনে বলল,

“এখানে একটা কথা বলা মানে এক একটা বো’মা নিজের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া৷ এদের কাউকে বিশ্বাস নেই৷ এখন তাদের কথা না মেনে নিলে আমার কোনদিন বিয়েই হবে না৷ আমার ক্রাশ অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলবে৷ আমি এটা মেনে নিতে পারব না৷”

বিয়ের দিন সবার শেষে উপস্থিত হলো ছোঁয়া। ধীর পায়ে প্রকৃতির দিকে এগিয়ে গেল৷ সব ভুলে মুখরোচক গল্প শুরু করল৷ ছোঁয়ার কষ্ট কাউকে বুঝতে দিল না৷ ছোঁয়া এমন ভাব নিয়ে আছে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে দুনিয়ার সবথেকে সুখী মানুষ৷ সবার মাঝে অজান্তা বলে উঠল,

“বউদি তুমি এখানে? তুমি বললে তুমি বিয়েতে আসবে না। তুমি কি জানতে না, আজ ঋষির বোনের বিয়ে? তার মানেই ঋষির বোনই তোমার বান্ধবী।”

ছোঁয়া নিজের বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে জবাব দিল,

“অজান্তা আমি জানতাম না৷ আমি আমার বান্ধবীর বিয়েতে আসব বলেই তোমাদের সাথে আসিনি৷ আমি জানতাম না তোমরা এই বিয়ে বাড়িতে আসবে৷ আগে জানতে পারলে এক সাথে তোমাদের সাথে আসতাম৷ আর আমি জানি না প্রকৃতি মি. ঋষি রাজের বউ৷”

“এখন আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দাও৷ ঋষি কোথায় জানি চলে গেছে৷ আমি কাউকে চিনি না৷”

ছোঁয়া তার বান্ধবীদের সাথে অজান্তার পরিচয় করিয়ে দেয়৷ দেখতে দেখতে বিয়ে হয়ে যায় প্রকৃতির৷ কার সাথে বিয়ে হয়েছে কেউ দেখতে পেল না৷ সবাই মিলে দেখার অনেক চেষ্টা করেছে৷ দেখার মাঝে শুধু চোখ দু’টো দেখেছে৷ তিথি বলেই দিয়েছে এটা পুষ্প স্যার৷ সবাই মুখ দেখতে পেয়েছে তিথি, অর্পি কেন দেখতে পেল না? ছোঁয়া পর্যন্ত দেখে ফেলেছে৷ প্রকৃতি ছোঁয়াকে পুষ্প স্যারের ব্যাপারে বলতে মানা করেছে৷

বাসর ঘরে বসে আছে চার বান্ধবী। যত বাজে কথা আছে সব বলে যাচ্ছে প্রকৃতিকে৷ পুষ্প স্যারের বন্ধুরা পুষ্প স্যারকে আটকিয়ে রেখেছে৷ কিছুতেই তারা আজ পুষ্প স্যারকে বাসর ঘরে ঢুকতে দিবে না৷ পুষ্প স্যার তার ফ্রেন্ডদের টাকা দিয়ে বাসর ঘরে প্রবেশ করে৷ সব জায়গার নিজেকে লুকিয়ে রাখলেও এখন আর লুকিয়ে রাখতো পারল না৷ অর্পি, তিথির সামনে এসে পড়ল পুষ্প স্যার। পুষ্প স্যার আশা করেনি তারা এখনও রুমে আছে৷ পুষ্প স্যারে ভেবেছিল রুমে শুধু প্রকৃতি আছে৷ অর্পি তিথি এক সাথে বলল,

“পুষ্প স্যার আজ থেকে আমাদের দুলাভাই।”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে