সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-১২(শেষ পর্ব)

0
1105

সেই মেয়েটি আমি নই
১২ পর্ব ( শেষাংশ )
লেখা:জবরুল ইসলাম

ইশতিয়াক হসপিটাল আছে শুনেই তুলি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল৷

– ‘মা ওর কি হয়েছে?’

– ‘তেমন কিছু না মা, হাত না-কি কেটেছে। এগুলো সমস্যা না ঠিক হয়ে যাবে।’

– ‘কোন হসপিটাল সে, আমি যাব।’

কলি হুস্না বেগমকে বললো,

– ‘আম্মু তুমি আর আপু যাও। পারলে আপুকে রেখে এসো।’

তুলি অস্থির হয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ মা চলো।’

– ‘আপু দাঁড়াও, তুমি থাকবে যেহেতু মোবাইল আর একটা ড্রেস নিয়ে যাও।’

– ‘মোবাইলে তো চার্জ নেই।’

– ‘ওইখানে গিয়ে চার্জ দিয়ে নেবে। তাছাড়া তোমার রুমে পাওয়ার ব্যাংক দেখলাম রাতে।’

– ‘ও হ্যাঁ তা আছে।’

– ‘আচ্ছা আমি সবকিছু নিয়ে আসছি দাঁড়াও।’

– ‘ড্রেস লাগবে না। শুধু মোবাইল পাওয়ার ব্যাংক আনলেই হবে।’

কলি খানিক পরেই একটা ভ্যানিটিব্যাগে পাওয়ার ব্যাংক আর মোবাইল নিয়ে এলো।

– ‘যাও আর আমাদের জানাবে কি অবস্থা উনার।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

তখনই আবার কল এলো। হুস্না বেগম দেখে বললেন,

– ‘তোর শ্বাশুড়ি।’

দাও আমি কথা বলছি, তুলি রিসিভ করে সালাম দিল, ওর ভয়েজ শুনেই তিনি চিনতে পারলেন।

– ‘তুলি, ডাক্তার বলছে ওর রক্ত লাগবে এখনই। আমরা চারদিকে কল দিচ্ছি এবি নেগেটিভ রক্ত নাই। তুমি দেখো তো মা আত্মীয় কারও আছে কি-না।’

তুলির গলা শুকিয়ে আসছে। বুক ধুকপুক করছে। সে অস্ফুটে বললো,

– ‘হ্যাঁ মা আমি দেখছি।’

তুলি ফোন রেখে বললো,

– ‘ওর এবি নেগেটিভ রক্ত লাগবে। কলি তুষার তোমাদের গ্রুপ কি?’

দু’জনই বললো তাদের রক্তের গ্রুপ জানে না।
তুলি তাদেরকেও সঙ্গে যেতে বললো। সবাই বাইরে গিয়ে একটা সিএনজিতে উঠে। গাড়িতে বসে ফেইসবুক-ইন্সটাগ্রাম সবকিছুতে এবি-রক্ত চেয়ে পোস্ট দেয়। আত্মীয়-স্বজন সবাইকে একে একে কল দিল কারও এবি নেগেটিভ রক্ত নেই। জ্যামজটের কারণে ঘণ্টা দুয়েক চলে গেল তাদের হসপিটাল পৌঁছাতে। তুলি বলার পর ইশতিয়াকের বাবা সঙ্গে সঙ্গে তুষার আর কলিকে পাঠালেন রক্তের গ্রুপ টেস্ট কর‍তে। ইতোমধ্যে একজন আগেই পাওয়া গেছে। ইশতিয়াকের ছোট ভাইয়ের বন্ধু। তার রক্ত এখন চলছে। ভাগ্যক্রমে মিলে গেল তুষারের সঙ্গেও। সেও এখন রক্ত দিচ্ছে। তারা সবাই বাইরে ব্রেঞ্চে বসে আছে।

তুলি মোবাইল পাওয়ার ব্যাংকে লাগিয়ে রেখেছিল গাড়িতেই। এখন অন করতেই টুংটাং শব্দ করে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ আসছে। হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে দেখে ইশতিয়াকের মেসেজ। সবগুলোই গতকাল রাতের।

– ‘আম্মুর অপমানে আমি একটুও কষ্ট পাইনি জানো? মনে হচ্ছে আমার পাহাড় সমান অপরাধের জন্য একটু হলেও শাস্তি হলো, শাসন হলো। যদি তুমিও এমন কিছু করতে। ভেতরের প্রবল রাগ, ক্ষোভ, কষ্টে আমাকে আঘাত করতে করতে নিঃশেষ করে দিতে। নিজের প্রতি ভীষণ ঘৃণা হচ্ছে তুলি৷ আমি শুধু মাফ চাইব, তোমাকে আর চাইব না। আমি তোমার মুখোমুখি আর দাঁড়াতে পারবো না লজ্জায়। আমি এটা কি করলাম। একেবারে নির্দোষ তোমার গায়ে হাত তুললাম৷ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করলাম। নিজেকে একটা হিং’স্র জা’নোয়ার মনে হচ্ছে আজকাল। জানো, লাস্ট যেদিন তোমাদের বাসা ভাড়া নিলাম। এর আগে বাড়ির সকলে আমাকে ডাক্তার দেখাতে চেয়েছিলেন হুটহাট এমন রেগে যাই কেন জানার জন্য। অনেকেই বলেন এগুলো না-কি মানসিক রোগ। আমি বাড়ির সবার উপর রেগে গেলাম সেদিন। আমাকে তারা সাইকো মনে করছে। কেন আমি কি অকারণ রাগী? আমার রাগের কারণ আছে। এগুলো না করলে তো রাগতাম আমি না। এইজন্য বাড়ি থেকেই বের হয়ে গেলাম। আমার এখন মনে হচ্ছে তুমি বা তোমরা সবাই হয়তো ঠিক। আমি হয়তো অস্বাভাবিক মানুষ। তুলি আমি বিয়ের পর এই ক’টা দিন সত্যিই ভীষণ সুখে ছিলাম। জীবনের প্রতিটি দিন আলাদা করলে তোমার সঙ্গে থাকা এই দিনগুলো ঝলমল করবে। আমি এগুলোর যোগ্য ছিলাম না। তোমার যোগ্য ছিলাম না। একজন নোংরা মানসিকতার অসুস্থ মানুষ যতই খোলস পড়ে থাকুক, তা হুট করেই বুঝি প্রকাশ পেয়ে যায়। আমারও পেয়েছে সেদিন। তুমি ওইদিন ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তোমার চোখে প্রবল ঘৃণা দেখেছি। তুলি আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। তার আগে বলো তুমি কি চাও। আমার কোনো প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ আছে কি-না। তুলি তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও কিছু ত্রুটি বের করে। যাতে কেউ তোমার দোষ ঘুনাক্ষরেও না ভাবে। তুমি এভাবে থাকলে লোকে কখনও জিজ্ঞেস করলে কি বলবে? আমি চাই তোমার কলংক মিটুক। তুমি নিজের মতো আলাদা হও।’

আবার ভোরে আরেকটা মেসেজ,

– ‘তুলি আমার খুব ইচ্ছা করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি। তোমার শরীরের যে স্থানগুলোতে আঘাত করেছি ভালোবাসার উষ্ণ পরশে তা ভুলিয়ে দেই। ওই পুরোদিন, ওই আঘাত পৃথিবীর বুক থেকে মূছে দিতে ইচ্ছা করছে। বাকি থাকুক শুধু আমাদের সুন্দর, স্নিগ্ধ, পবিত্র ভালোবাসার দিনগুলো। বাকি থাকুক কাশবনে কাটানো মুহূর্তগুলো। কিন্তু তা কি আদৌও সম্ভব তুলি? একটা নোংরা দিন আমাদের সকল সুন্দর দিনকে ম্লান করে দিয়েছে। তুলি ভীষণ ইচ্ছা করছে তোমাকে বলি ‘আর কখনও এমন হবে না। একটাবার আগের দিনগুলোতে ফিরে যাই। ভালোবেসে বাঁচি।’
কিন্তু ইচ্ছা করলেও আমি বলবো না, আমি চাই না৷ আমিও চাই, এমন নোংরা মানুষের স্পর্শ তুমি না পাও।’

আরেকটা মেসেজ,

– ‘তুলি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কি করলে যে একটু প্রায়শ্চিত্ত হবে। তুমি খুশি হবে। তোমার কষ্ট কমবে। জানো আমি মা-বাবার কাছে আজ এসেছি কেন? তাদের কাছে বলতে যে তুমি চরিত্রহীন না। তুমি নির্দোষ। আমার তুলি ভোরের প্রস্ফুটিত ফুলের মতো পবিত্র।’

আরেকটা মেসেজ,

– ‘আমি চাইলেই এখন অনায়াসে মরে যেতে পারি তুলি। নিজের প্রতি তিব্র ঘৃণা কাজ করছে। নিজের প্রতি অভিযোগ জমে জমে অভিযোগের মিনার হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দে আছি তোমার যদি কিছু বলার থাকে। তোমার যদি কোনো কাজে আসি। কোনো প্রায়শ্চিত্ত করার যদি কোনো সুযোগ পাই। সেই অপেক্ষাতেই আছি। কিন্তু তুমি মেসেজ দেখছোই না কেন তুলি। তোমার মোবাইল বন্ধ কেন। আমার খুব অস্থিরতায় আছি। আচ্ছা তুলি, মানুষ যখন কাউকে আঘাত করে, তখন সেও আঘাত করে৷ কেন করে? তার মানে তো সেও ব্যথা দিতে চায়। তাতে তার শান্তি। তুলি আমি তোমাকে যে আঘাত করেছি। অশ্রাব্য গালাগাল গালাগাল করেছি। তুমি আমাকে অশ্রাব্য গালাগাল করে আঘাত করতে ক্ষত-বিক্ষত করে দাও এসে। না হয় আমিই করি। যে দু’টো হাত দিয়ে তোমাকে আঘাত করেছি। সেই হাত আমি কেটে ফালাফালা করে ছবি পাঠাই। তুমি কি খানিক শান্তি পাবে? ক্ষোভ কমবে? মানুষের আদি স্বভাব তো সেটাই তাই না? তাকে কেউ আঘাত করলে সেও করে। ওর ক্ষতি চায়। তুলি আমি এখনই গিয়ে ব্লেড নিয়ে আসছি। একটু অপেক্ষা। বাসার কাছেই দোকান।’

এর খানিক পর অনেকগুলো রক্তাক্ত হাতের ছবি।

তুলির কান্না পাচ্ছে। ভীষণ কান্না। চারপাশে মানুষ৷ সে ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে রাখতে চাচ্ছে। পারলো না সে। দুই হাতে মুখ ঢেকে বোবা কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠলো। কলি দেখতে পেয়ে পাশে এসে বসে বুকে টেনে নিল তাকে।

– ‘কি হয়েছে আপু?’

– ‘বিশ্বাস কর কলি, ওর একা দোষ না। আমারও দোষ ছিল ওর সঙ্গে লুকোচুরি করা। শুরুতেই সব খুলে বললে হয়তো এমন দিন দেখতে হতো না। মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেলে নিজের হাত কাটে বল। এই মানুষটা অনায়াসে আমার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে কলি। এখন ওর কিছু হলে আমি কি করবো? নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না। কেন গতকাল রেগে চলে গেলাম। সে তো আমার কাছেই গিয়েছিল।’

তুলি পিঠে হাত রেখে ফিসফিস করে বলছে,

– ‘আপু কান্না বন্ধ করো। চারদিকে মানুষ। এটা হসপিটাল। সব ঠিক হয়ে যাবে। যখন বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে মানুষ আবদ্ধ হয়ে যায়৷ তখন অপর মানুষটার মাঝে মাঝে অনেক বড়ো বড়ো অপরাধ মুখবুজে মেনে নিতে হয়। দোষ-গুণ সবকিছু মানুষের স্বভাবেরই অংশ। পৃথিবীতে কত জঘন্য মানুষেরও পরিবার আছে। তাদের মা-বাবা আছে। কেউ কি তাদের ফেলে দেয়? খারাপ ছেলেকে মা-বাবা ফেলে দেয় না। ভাই-বোন কেউ কাউকে ফেলে দেয় না৷ দিনশেষে এক সঙ্গেই থাকে। স্বামী-স্ত্রীও তেমন। একটা পরিবার। এখানে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়। মাঝে মাঝে কেউ অতিরিক্ত করে ফেললে অপর মানুষ মুখবুজে সহ্য করলে একটা সময় তারও কষ্ট, অনুতপ্ত হয়। ইশ আমি অতিরিক্ত করেছি, সহ্য করেছে। এটাই মানব সম্পর্ক। এভাবেই ডালিমের বিচির মতো মানুষ গিজগিজ করে একত্রে বেঁচে থাকে। তোমাদের দু’জনেরই হয়তো প্রতিক্রিয়া বেশি ছিল৷ পার্কে ভাইয়ার প্রতিক্রিয়া হয়তোবা ছিল লাগামছাড়া। কিংবা তোমারও ভুল ছিল। এই সবকিছুই জীবনের অংশ। এগুলো মানিয়ে নিয়েও চলা যায়। আবার ছেড়ে গিয়েও চলা যায়৷ কিন্তু বিয়ে, সংসার করতে হলে এসব মানিয়ে নিতেই হয়। সংসার টিকে থাকার মন্ত্র এগুলোই। আদিকাল থেকেই এভাবে চলে আসছে একে অন্যের অসম্ভব বাড়াবাড়ি মেনে নিয়ে। এগুলো আবার খানিক পর ভালোবাসার পরশে আমরা একে অন্যকে ভুলিয়ে দেই বা ভুলে যাই। এই মন্ত্রগুলো আমরা মানি না বা জানি না বলেই এতো ডিভোর্স। এখন সংসার টিকে না থাকার কারণ এগুলোই আপু। ক্ষমা এক মহৎগুণ। তুমি যে আজ ক্ষমা করে দিয়েছো ভাইয়াকে। ভাইয়াও জানে সে ভুল বুঝে অনেক বড়ো অন্যায় করেছিল। এখন তার জীবনে অনেক বড়ো শিক্ষা হয়ে গেল। ভাইয়া এখন অনুতপ্ত। অনেক স্বামী আছে এখন ক্ষমা না চেয়ে বলতো, ‘আমি এই কারণে মেরেছি। দোষ ছিল ওর।’
এরকম নানান দোষ বের করে নিজের অহংকার নিয়েই থাকতো। কিন্তু উনি তো সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত। ক্ষমা চেয়েছে। নিজেই লজ্জা পাচ্ছে।’

– ‘তুই ঠিকই বলেছিস।’

তুলির এখন ভাবতেই লজ্জা লাগছে সেও ইশতিয়াকের গায়ে হাত তুলেছে। মানুষটা ভুল বুঝতে পেরে বাসায় গেল। মেসেজেও মাফ চাইল। নিজের হাতও কেটে ফেলেছে। সে তো একবারও অনুতপ্ত হয়নি। মাফ চাওয়া তো অনেকদূর। এখন যদি ওর কিছু হয়ে যায় সে নিজেকে ক্ষমা করবে কিভাবে?

– ‘কলি ডাক্তারদের গিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে আয় না বোন ওর অবস্থা কি?’

– ‘আচ্ছা আমি যাচ্ছি।’

কলি উঠে গেল। তুলি তাকিয়ে আছে বোনের দিকে৷ দু’জনের একই দিনে জন্ম হলেও তুলি আগে জন্ম নিয়েছে। দেখতেও তাকে বড়ো লাগে। আর কলিও তাকে আপু ডাকছে। আর সে ‘তুই’ করে। সবকিছু যেন অবচেতনভাবে হয়ে যাচ্ছে। কলিটা অনেক ছটফটে স্বভাবের বুঝাই যায়। আর কি বুঝ-বুদ্ধি হয়েছে। ওর মতো সেও বুদ্ধিমতী হলে হয়তো এই দিনগুলো দেখতে হতো না। মাও অতিরিক্ত করেছেন মানুষটার সাথে। তুলির নিজেরও লজ্জা লাগবে ওর সামনে দাঁড়াতে। এবার আল্লাহ সবকিছু ঠিকঠাক করে দিলে আর জীবনেও এমন হতে দেবে না সে। প্রচন্ড ভালোবাসায় বেঁধে রাখবে। কোনো ভুল বুঝাবুঝি চলবে না। ফেইসবুকে একদিন কোথাও দুইটা লেখা পড়েছিল। এখন ভীষণ উঁকি দিচ্ছে মাথায়,

– ‘দু’জনের মধ্যকার অনুরাগ থেকে যখন রাগের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়, তখন পরিণাম হয় ‘বিচ্ছেদ’। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে উভয়েরই পুরো জীবনভর প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি পরিস্থিতিতে রাগের কাছে অনুরাগকে জিতিয়ে যেতে হয়।

আরেকটা পড়েছিল,

‘যে মানুষটা একান্ত তোমার,
তাকে নিয়ে এঁটো করো না অভিযোগের মিনার।’

তুলির এই মুহূর্তে মনে হলো, আল্লাহ এবার সবকিছু স্বাভাবিক করে দিলে তার এই একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটির সঙ্গে আর কখনও রাগ, জেদকে জিততে দেবে না। অনুরাগ মৃত্যু অবধি হারিয়ে যাবে রাগকে। ইশতিয়াকও আর কোনোদিন এমন রাগবে না। অবশ্যই রাগবে না। ওকে ভালোবেসে এমনভাবে আগলে রাখবে সে পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। অবশ্যই আসবে।

কলি পাশে এসে বসে বললো, তোমার শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছি। ডাক্তার না-কি বলেছে ঠিক হয়ে যাবে। আশংকাজনক কিছু নেই। দুলাভাই না-কি হাত কেটেছিল ভোরে ঘুম থেকে উঠে।

তুলি জানে এসব, তবুও ডাক্তার যেহেতু বলেছে ঠিক হয়ে যাবে। এখন আরেকটু শান্তি পেল সে।

একটু পর তার শ্বাশুড়ি এসে তুলির পাশে বসলেন।

– ‘আল্লাহ তায়ালা রক্ষা করছেন মা। আমি যদি ভোরে না যেতাম কি যে হতো। ডাক্তার বললো হাত কাটার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে আসায় ক্ষতি হয়নি৷ না হলে ভয়াবহ কিছু হতে পারতো।
ভোরে আমি ডাকতে গিয়ে দরজা ভেজানো থাকায় ঢুকে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি বাসার সবাইকে ডেকে নিলাম। শুকনো পরিষ্কার কাপড় দিয়ে দুইহাত বেঁধে দ্রুত সবাই পাশের হসপিটাল নিয়ে এসেছি।
ডাক্তার খানিক আগে এসে জানিয়েছে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তীব্র ব্যথা এবং রক্ত ক্ষরণে দূর্বল হয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। এখন রক্ত চলছে। হাত বেন্ডেজ করে দিয়ে দেবে। চাইলে না-কি আজ সন্ধ্যায়ই তাকে নিয়ে বাসায় যেতে পারবো।’

তুলি উনাকে জড়িয়ে ধরে ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে ফেললো।

– ‘আর কখনও এমন হবে না মা। দেইখো আর কখনও এমন হবে না। আর এবার ওকে খুব বকা দেবো। আর আলাদা ফ্ল্যাটে নয়। দু’জন তোমাদের কাছে থাকবো। দেইখো এখন থেকে সেও রাগারাগি করবে না।’

– ‘আচ্ছা মা শান্ত হও। দেখো না আমি বয়স্ক মানুষ কত শান্ত। ছেলেকে হসপিটাল নিয়ে এসেছি তবুও কাঁদিনি। শান্ত হও। দোয়া করো।’

তুলি চোখের জল মূছে নিল। একটু পর কলি এসে বললো, আমরা দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে চলে যাই। তুমি থাকো।

– ‘দেখা করা যাবে?’

– ‘হ্যাঁ, তবে তুমি এখন দরকার নেই যাওয়ার। রক্ত চলছে শান্তশিষ্টভাবে থাকুক। আমরা চলে যাব তাই দেখা করে নিই।’

– ‘আমি গেলে কি হবে?’

– ‘আরে সে কথা বলবে। তোমরা কান্নাকাটিও যদি করো। দরকার নেই এখন।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

তারা তিনজনই ভেতরে গেল। ইশতিয়াক দেখে উঠে বসতে চাইল।
কলি এগিয়ে এসে বললো,

– ‘আরে আপনি উঠছেন কেন? রক্ত চলছে এখনও।’

– ‘আপনি কোত্থেকে জানলেন? বিনোদিনী না?’

– ‘হ্যাঁ, আপনি দেখছি আলাদা করতে পারছেন। যাইহোক শুয়ে থাকুন, উঠা লাগবে না।’

সে পুনরায় শুয়ে গেল। হুস্না বেগম পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত রেখে কেঁদে ফেললেন।

– ‘মনে কষ্ট পেলে মা মনে করে বাদ দিয়ে দিয়ো বাবা। আমি হঠাৎ করে রেগে গিয়েছিলাম। আমার মেয়েটাকে কোনোদিন ফুলের টোকাও দেইনি। তাই সহ্য করতে পারিনি..।’

কলি ব্যস্ত হয়ে বললো,

– ‘মা এসব কথা পড়ে বলা যাবে। উনি রেস্ট নিতে দিছে ডাক্তার।’

ইশতিয়াক ওর মা ডাক শুনে অবাক হয়ে তাকায়। সে বিনোদিনী হলে মা ডাকছে কেন? আর দেখেই বুঝা যাচ্ছে তুলি না। সে অন্তত এদের দু’জনকে আলাদা করতে পারবে। তুলির গায়ের গন্ধ অবধি তার চেনা। চোখের চাহনি চেনা। সে এদিকে আর মনযোগ না দিয়ে বললো,

– ‘এগুলো আমি মনে রাখিনি মা। বসুন আপনি। যা হয়ে গেছে তা বাদ।’

তুষার একটু পরে এসে ঢুকলো। কলি মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘সে ব্লাড দিয়েছে আপনাকে৷’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে ধন্যবাদ দিয়ে বললো বসতে। কলি হুস্না বেগমকে বললো,

– ‘আম্মু তুমি তুলি আপুর কাছে যাও এখন, এক সঙ্গে বেশি না থাকাই ভালো। আমরা আসছি।’

তিনি বাইরে যেতেই কলি পাশে বসে বললো,

– ‘তুলি আপুও এসেছে। কিন্তু আমরা ভেতরে আসতে দেইনি।’

– ‘দিচ্ছেন না কেন?’

– ‘আপনি রেস্ট নিন। তাকে রেখেই আমরা চলে যাব। সে আসবে একটু পর।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘হাত কাঁটায় তাহলে ভালোই হয়েছে দেখছি।’

কলি মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘হ্যাঁ, কাঁটা থেকে দারুণ কিছু হয়েছে।’

– ‘ও চাইলে আসুক। আমি তো সুস্থই এখন৷ হাঁটতেও পারবো।’

– ‘এতো তাড়া কেন। আপুও চলে আসতে চাচ্ছিল৷ একটু রেস্ট নিন আসবে। আর আমরা এখন যাচ্ছি।’

ইশতিয়াক মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তুষারও এগিয়ে এসে বললো,

– ‘যাচ্ছি ভাই পরে দেখা হবে।’

– ‘ব্লাড দিয়েছেন আপনি। একটু খেয়াল করে যাবেন।’

কলি বের হতে হতে বললো,

– ‘ওর জন্য আপনার চিন্তা করতে হবে না আমি আছি।’

ওরা চলে যাবার অনেক পরে তুলি এবং ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এলেন। ইশতিয়াক শুয়ে আছে। দরজার শব্দ শুনেই সে চোখ মেলে তাকায়। সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তুলি। কেমন ভেজা ভেজা চোখ। কি মায়াবী চেহারা। নিমিষেই যেন তার মনের ভেতর এক পশলা বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। ইশতিয়াকের মা কপালে হাত দিয়ে বললেন,

– ‘এখন কেমন লাগছে বাবা?’

– ‘অনেক ভালো মা, হাত কাঁটার আগে থেকে এখন ভালো আছি।’

কথাটা শুনেই তুলি মনে মনে লজ্জা পেল। এরকম কথা মা-বাবার সামনে কেউ বলে বুঝি। ওরা সবাই কথা বলে বের হয়ে গেলেন। তুলি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে মেঝেতে চোখ। ভীষণ লজ্জা লাগছে।

– ‘আমি তো উঠতে পারবো না। কোনো সমস্যা না থাকলে চেয়ার টেনে পাশে এসে বসো।’

– ‘সমস্যা থাকবে কেন।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘কোনো সমস্যা নেই?’

– ‘উহু।’

– ‘বাহ হাত কাঁটায় সত্যিই ভালো হয়েছে তাহলে।’

– ‘বাজে কথা একদম বলবেন না। আপনি হাত কেঁটে ঠিক করেননি।’

– ‘আচ্ছা তুমি তো আগে পাশে এসে বসো।’

তুলি গিয়ে পাশে বসে ওর কপালে হাত রেখে বললো,

– ‘স্যরি।’

– ‘তুমি স্যরি বলছো কেন?’

তুলির চোখে জল টলমল করছে। সে অস্ফুটে বললো,

– ‘এমনিই।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘আমি কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ। শুধু রক্ত দিচ্ছে বলে এরকম পড়ে থাকতে হচ্ছে৷ তুমি একটু কপাল এগিয়ে আনবে।’

তুলি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। আজ যেন প্রথম রাতের মতোই লজ্জা পাচ্ছে সবকিছুতে। সে কপাল নিয়ে ইশতিয়াকের ঠোঁটে স্পর্শ করালো।
তুলির কেমন বিব্রতবোধ হচ্ছে। তাই আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আমি এখন যাই?’

– ‘না, আমি একা শুয়ে থেকে কি করবো? তুমি থাকো।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘বিনোদিনী দেখলাম মা ডাকে আম্মুকে। তোমাকে ডাকে আপু। মনে হচ্ছিল যেন তোমাদের পরিবারের কেউ।’

তুলি মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘হ্যাঁ, সে আমার আপন বোন। ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। ওর নাম কলি।’

– ‘আরে কি বলো৷ সিনেমাটিক ব্যাপার দেখছি। যাক ভালোই হলো এই ভুল বুঝাবুঝি থেকে৷’

তুলি ঠোঁট টিপে হাসলো। ইশতিয়াক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘দেখে মনে হয় কামড় দেয়া যাবে। কিন্তু দেয়া যায় না।’

তুলি চোখ পাকিয়ে বললো,

– ‘কি?’

– ‘ডিমের কুসুমে কামড়।’

– ‘ধ্যাৎ, অসুস্থ অবস্থায়ও আপনার ফাজলামো যায়নি।’

পরিশিষ্ট: ইশতিয়াক হসপিটাল থেকে সোজা চলে যায় তার মা-বাবার কাছে। তারা সেখানেই এখন থেকে থাকবে। সংসার করবে।
তুষার তার ফুপুকে নিয়ে কলিদের বাসায় যায়। তুষারের ফুপু ইশতিয়াকের অফিসেরও কলিগ। সেখানে কলির আগের বাবা-মাও উপস্থিত হন। সবাই মিলে তুষারের ফুপুকে বুঝিয়ে বলেন ওর আসল পরিচয়। উনার বেশ পছন্দ হয়েছে সবকিছু জেনে, দেখে। বাসায় গিয়ে ভাইকে ফোনে সবকিছু খুলে বলেন। ওরাও রাজি হয়ে যায়। তারপর এখানে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করেন এসে। তুষার আর কলির বিয়ে হবে আগামী শুক্রবারে। তুষার এবং তার বাবা-মা ঢাকায়ই আছেন৷ শুক্রবারে বিয়ে শেষে কনে নিয়ে একেবারে কোমলগঞ্জ যাবেন।

____সমাপ্তি___

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে