সাদা ফুল পর্ব-০৮

0
3495

পর্ব-৮(প্রথমাংশ)
#সাদা ফুল
#ফারিয়া_আক্তার_নূপুর সাদা কালো চেক শার্ট আর হাতে মোটা ফিতার কালো ঘড়ি পরে নেয় তীব্র। চুলগুলো পেছনে গুছিয়ে রাখলেও কপালের উপর কয়েকটি চুল এসে পরে,কপালের পাশে থাকা গাঢ় তিলটিকে লুকিয়ে ফেলে আলগোছে। ফর্সা রঙের গায়ে কালো রঙটা খুব ফুটে উঠেছে। সুঠাম দেহের এই সৌন্দর্য তীব্রকে করে তুলেছে সুদর্শন পুরুষ। মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরে শুভ্রতাদের বাড়ির উদ্দেশ্য।অনেকদিন পর প্রেয়সীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ। তীব্রের কাছে অমৃত পান করে তৃষ্ণা মেটানোর ন‍্যায় এই সুযোগ। – টেবিলে সব রকমের খাবার সাজিয়ে রেখেছেন শুহানা বেগম। রহমান মিয়া এইটা ওইটা এগিয়ে দিচ্ছেন খাওয়ার জন‍্য। কিন্তু তীব্রের খাবারের প্রতি অনিহা বেড়ে গেছে । যাকে একনজর দেখার জন‍্য সে এসেছে তাকেই স্বচক্ষে দেখতে পেলো না এখনো। তীব্রের খাওয়া প্রায় শেষ। তখন শুহানা বেগম মেয়েকে ডাকেন গ্লাস ভর্তি দুধ আনার জন‍্য। শুভ্রতা মাথায় উড়না ভালোভাবে দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। হাতে দুধের গ্লাস। টেবিলের উপর গ্লাস রেখেই প্রস্থান ঘটে শুভ্রতার। ওইটুকু সময়ই তীব্র তার দেখার তৃষ্ণা মিটিয়ে নেয়। তারপর রহমান মিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। – একতরফা ভালোবাসাগুলো একটু বেশি কষ্টের। আর যদি অনুভূতি প্রকাশ না করা যায় তাহলে তার কষ্ট নিশ্চিতরূপে দমবন্ধকর। না বলা যায় প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসি আর না তার থেকে পাওয়া যায় ভালোবাসার স্পর্শ । তীব্র ছাদের রেলিয়ের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ধচন্দ্রের আলোতে সামান‍্য অন্ধকার কেটেছে চারপাশের। মধ‍্যরাতে লোডশেডিং হওয়ার কারনে পুরো গ্রাম আধারের মেলায় বসেছে। আজকাল প্রায় তীব্রের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়।বুকের ভেতর ভারি কিছু অনুভব করে। একতরফা ভালোবেসে মস্তিষ্ক যেন তার ক্লান্ত। তবুও মন,সে তো আর মস্তিষ্কের নির্দেশ মেনে চলে না! ভয় হয় শুভ্রতা বুঝবে তো তার অনূভুতি। কিশোরী মনের খানিক আবেগ হতে চায় না তীব্র। চিরকালের জন‍্য তার হতে চায়। আর এর জন‍্য যদি আরও কত বছর অপেক্ষা করতে হয় তবে তাই হোক। ১০. নাইনের ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। শুভ্রতা পছন্দের বিভাগ অনুযায়ী বিজ্ঞান নিয়েছে আর লায়লা ব‍্যবসা শিক্ষা। শুভও সিক্স পেরিয়ে এবার সেভেনে উঠেছে। তবে বছরের শুরু থেকেই তীব্র ওদের পড়ানো শুরু করেছে। লায়লা আজকাল বেশ সেজেগুজে স্কুলে আসে। মুখে সারাক্ষণ হাসি লেপ্টেই থাকে। শুভ্রতা কিছুদিন যাবত এ’সবই লক্ষ‍্য করেছে। একদিন নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করে, “তোর কি হয়েছে বলতো? সারাক্ষণ এভাবে হাসিস কেনো?” লায়লা ভ‍্যাবাচেকা খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, “ক.. কই না তো কি বলিস” “এত না প‍্যাঁচিয়ে ব‍্যাপারটা বল। তোকে আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি বল কাহিনি কি?” “পূর্ব পাড়ার শাহেদ ভাই আমাকে প্রপোজ করেছে”, চোখে মুখে একধরনের লাজুকতা ভাব নিয়েই উত্তর দেয় লায়লা। অবাক হয়ে শুভ্রতা বলে, “কি বলিস! তুই উত্তরে কি বলেছিস? “হ‍্যা বলে দিয়েছি ” “এত সহজে হ‍্যা বলে দিলি? আর এইসব প্রেম ভালোবাসা একদম ভালো নয় ভেবে উত্তর দেওয়া উচিত ছিলো তোর।” “তোর মত নিরামিস ক’জন? চোখের সামনে এত হ‍্যান্ডসাম একজন থাকতেও তোর চোখে পরেনা। বিশ্বাস কর তীব্র ভাই যদি চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে না হতো সব ছেড়ে তাকেই আমি লাইন মারতাম” “শরম লজ্জা কি তোর সব উড়ে গেলো লায়লা?”,শুভ্রতা রাগী চোখে লায়লার দিকে তাকায় বলল। “শোন তোকে একটা কথা বলি আমার কি মনে হয় জানিস,তীব্র ভাই তোকে মাত্রাতিরিক্ত পছন্দ করেন”। “এইসব পাপ আর অসম্ভব !” “কোনটা পাপ আর অসম্ভব তা তীব্র ভাইকেই জিজ্ঞেস করিস!, মুখ ফুলিয়ে বলে লায়লা। শুভ্রতা কোনো প্রতিত্তর করেনি। কিশোরী মন তার ভেতর থেকে জানান দিচ্ছে ভালোবাসা পাপ। কিন্তু তবুও যেনো মূহুর্তেই কথাটি ভুল হিসেবে প্রমাণিত করতে চাচ্ছে শুভ্রতা। – সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে ক‍্যামেলিয়াকে নিয়ে রোজ দাঁড়িয়ে থাকে তীব্র। একবছরে ক‍্যামেলিয়া বেশ গুলুমুলু হয়ে গেছে। শুভ্রতা আজ আসার সময় একটি লাল ঘুঙুর দেওয়া চিকন বেল্ট আনে ক‍্যামেলিয়ার গলায় পরানের জন‍্য। তীব্রের হাত থেকে ক‍্যামেলিয়াকে নিয়ে বটগাছের উপরে বসে। তারপর বেল্টটি পড়িয়ে দেয়। তীব্র ক‍্যামেলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “বাহ! খুব মানিয়েছে তো ওকে।” শুভ্রতা উত্তরে মুচকি হাসি দেয়। একটু সময় যেতেই শুভ্রতা আচমকা বলে, “তীব্র সাহেব,ভালোবাসা কি পাপ?” হঠাৎ শুভ্রতার এহেন প্রশ্নে বেশ অবাক হয়ে যায় তীব্র। ভ্রূ কুচকে তাকিয়ে থাকে। শুভ্রতাও উত্তর আশায় নিশ্চুপ হয়ে থাকে। তারপর অতিবাহিত হয় অনেকখানি সময়। শুভ্রতা ভেবে নেয় উত্তর তার পাওয়া হবে না। হয়ত খুব অবঞ্চিত একটি প্রশ্ন সে করে ফেলেছে। ক‍্যামেলিয়াকে কোলে দিয়ে স্কুলের পথের দিকে পা বাড়াতেই তীব্র বলল, “ভালোবাসা পাপ নয়, তা আল্লাহর দেওয়া এক নির্মল,শুভ্র অনূভুতি। যা সবার ভিতরেই থাকে সুপ্তরূপে। তার রূপ,বিভিন্নতাও আলাদা। তবে আমরা মানুষরা সেই অনূভুতিকে কলঙ্কিত করি,ভালোবাসা কে নাম দিই অপবিত্র,মহাপাপ! বেশ মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি কথা শুনে শুভ্রতা। প্রতিটি কথা তার ভেতরে গিয়ে সারা দিচ্ছে। গভীর মোহনীয় কন্ঠে বলা বাক‍্যগুলোকে মনে হচ্ছে চিরসত‍্য। তীব্রের চোখের দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে ফেলে। সেই চাহনিতে যেনো ছিলো অন‍্য কিছুর মায়া যা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছে ডাকছিলো তাকে। হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক উঠানামা ঘটে। সে কারনেই দ্রুত পা চালিয়ে নিজেকে আড়াল করে ফেলে। তীব্র শুভ্রতার যাওয়ার পানেই তাকিয়ে থাকে। পঁচিশ বছরের এক যুবক সহজেই বুঝে যায় তার বিপরীতে থাকা কিশোরীর অবুঝ মনের ব‍্যাকুলতা। যদিও এই ব‍্যাকুলতা তাকে পাওয়ার জন‍্য নয় তবে তাকে ঘিরে বেড়ে উঠা এক লুকানো সুপ্ত অনূভুতির খোঁজ করার চেষ্টা । – শুভ্রতা চোখে ঘুম নেই। পাশেই জাহানারা বেগম বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। শুভ্রতার খুব ইচ্ছে করছে দরজা মেলে বাইরে বেরোতে। রাতের তারার সাথে জ্বলমলে আলো আদান প্রদানের বিলাসিতা করতে। মন আজ অজ্ঞাত কোনো কারনেই ফুরফুরে। আচ্ছা সে কারনগুলো সকালে তীব্রের বলা কথাগুলো নয়ত! এক প্রশ্নের উত্তর এত ঝাঝালো হয় কি করে যা পঞ্চাদশী এক কিশোরীর মনে তোলপাড় তুলে দেয়।

চলবে..

পর্ব-৮(দ্বিতীয়াংশ) #সাদা_ফুল #ফারিয়া_আক্তার_নূপুর ১১. ভার্সিটির কাজে দু’দিনের জন‍্য ঢাকা ফিরতে হয় তীব্রকে। যার কারনে স্কুল ছুটির পর আর পড়ার কোনো চাপ নেই দু’দিন। স্কুল ছুটির পর শুভ লায়লার সাথেই বাড়ি ফিরে শুভ্রতা। যাওয়ার পথে লায়লা বলে, “শুভ্র বিকেলে মেলায় যাবি?” শুভ তাৎক্ষনাত বলে উঠে “পূর্ব পাড়ার ওই মেলায়? না, একদম না।” শুভ্রতা ভ্রূ কুচকে শুভর দিকে তাকায় সাথে লায়লাও। নিজের উপর এরূপ চাহনিতে একটু ভীত হওয়ার ভান করে শুভ বলে, ” তোরা আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস ক‍্যান চোখ সরা নজর লাগবে তো”! শুভ্রতা শুভর মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল, “এই আমি আর লায়লা তোর থেকে মিনিমাম চার বছরের বড় তুই কোথায় আমাদের আপনি করে বলবি তা না তুই করে বলছিস” “চার বছরের বড় চৌদ্দ বছরের তো আর না” “এই তোরা চুপ করবি! রাস্তায় ঝগড়া শুরু করে দিছিস।” রাগান্বিত স্বরে বলে উঠে লায়লা। তারপর শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে, “শুভ্র তুই যাবি মেলায়? যদি যাস বিকেলে এসে আমি মামি’মাকে বলে নিয়ে যাবো তোকে।” “আম্মা যদি রাজি হয় তবে যাবো” শুভ্রতার কথা শুনে শুভ তার দিকে তাকায় তারপর বলে, “তাহলে আমিও যাবো তোদের সাথে।” লায়লা বলল, “তোর না ক্রিকেট ম‍্যাচ আছে আজকে তুই কেনো যাবি”? “আমার বোনকে আমি ওই পূর্ব পাড়ায় একা যেতে দিবো না তাই”, এই বলেই দ্রুত হেটে সামনে এগিয়ে চলে শুভ। সামনে থাকলে নিশ্চয় আরও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। শুভ্রতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শুভর যাওয়ার দিকে। ভেতর থেকে এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করল তার। পৃথিবীতে ভাই বোনের সম্পর্কটা বেশ জটিল। সারাদিন ঝগড়া মারামারি করলেও একে অপরের প্রতি থাকে অফুরন্ত ভালোবাসা, সম্মান আর শ্রদ্ধা। – বিকেলে শুভ্রতা, লায়লা আর শুভ পূর্ব পাড়ার মেলায় যায়। গ্রামের এই একটি মেলাই বসে তবে প্রতিবছর না। বিভিন্ন রকমের দোকান বসেছে। শুভ ওদের পিছু পিছু হাটছে । শুভ্রতা একটি চুরির দোকানে থামে। লাল খয়েরী একমুঠ চুরির ওপর নজর যেতেই তা খুলে হাতে পরে নেই। “খুব সুন্দর মানিয়েছে”। পাশ থেকে এক অচেনা পুরুষনালীর কন্ঠে ভেসে আসতেই কেঁপে উঠে সে সাথে ভর করে একরাশ বিরক্তি আর অস্বস্তি।পাশে তাকিয়ে দেখে অচেনা পুরুষের মুখশ্রী। অস্বস্তিতে চুরিগুলো রেখে লায়লার হাত ধরে সামনে পা চালায়। সৌরভও তাদের পিছু নেই। সূর্য নামার আগেই মেলা থেকে বের হয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয় তিনজন। পেছনে কারো উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। শুভ বেশ কিছুক্ষন ধরেই সৌরভকে লক্ষ‍্য করে। বাড়ির পথে এসে লায়লা নিজ বাড়িতে চলে যায় আর শুভ্রতা তাদের বাড়ি। শুভ বাড়িতে ঢুকে না। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের কাছে যায়। শুভকে দেখে চুর ধরার ন‍্যায় অবস্থায় পরে যায় সৌরভ। শুভ একটি হাসি দিয়ে বলে, “ঠিক কোন মেয়েটিকে ভালো লেগেছে ভাই?” সৌরভ খানিক অবাক হয়ে চুপ থাকে। একটু লজ্জাও পেয়েছে। তারপর লাজ শরম ফেলে অকপটে বলে, “বাদামী রঙের হিজাব পড়া মেয়েটা। তোমাদের এলাকার বুঝি!” “তীব্র ভাইকে চিনেন তো? তার হবু বউ। একটু দেখেশুনে মেয়ের পিছু নিবেন ভাই”, বলেই শুভ শিষ বাজাতে বাজাতে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে