সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব-১০

0
963

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১০
#সুমাইয়া_আফরিন

রাফাত নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,

‘ছিহ,,বাবা, তুমি এতটা নিচে কি করে নামতে পারলে?ওইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে এত নোংরা আর জঘন্য কাজ তুমি কি করে করতে পারলে?জগড়া লেগেছিল তোমাদের মধ্যে তাহলে একটা ছোট্ট মেয়েকে এর মধ্যে কেন জড়ালে?তুমি জানো একটা মেয়ের কাছে তার সম্মান নিজের জীবনের থেকেও বেশি মূল্যবান।আর তুমি সেই মূল্যবান জিনিসটাকে হাত দিলে? অনু কখনো এই অবুঝ সমাজের মাঝে মাথা উচু করে দাড়াতে পারবে না। প্রতিটা পদক্ষেপে তাকে মানুষের কটু কথা শুনতে হবে।আজ যদি ফারিহার বা আরিকার সাথে এমন কিছু একটা ঘটতো তাহলে কি তুমি মেনে নিতে বাবা?আমি ভাবতে পারছি না দাদু এত বড় একটা অন্যায় দেখে কি করে চুপ থাকতে পারলো?তাকে তো আমি আমার আইডেল ভেবেছিলাম। কিন্তু এক মুহূর্তে সব ভেঙেচুরে শেষ করে দিলে তোমরা।’

আবির চিৎকার করে কথাগুলো বলছে তার বাবাকে। আলি উদ্দিন চৌধুরি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন আবিরের সামনে। আবিরের চিৎকার শুনে কাকলি সরকার নিচে থেকে উপরে চলে আসলেন। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আবিরের দিকে। আবিরের চোখ রক্তবর্ণ ধারন করেছে। কাকলি বেগম আবিরের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললেন,

‘কি হয়েছে রাফাত?এমন চিৎকার করছো কেন তুমি?’

রাফাত বজ্রচোখে পেছন ঘুরে তাকালো তার মায়ের দিকে। আবিরের ভয়ানক রাগ দেখে কাকলি বেগম ভয় পেয়ে গেলেন। রাফাত দাঁত কিটমিট করে বললেন,

‘কি হয়েছে?কি হয়নি মম? অনুর সাথে আমার কেন বিয়ে দিয়েছো তোমরা?’

কাকলি সরকার বিষ্ফরিত চোখে তাকিয়ে রইল রাফাতের দিকে। মনের গহিনে অজানা ভয় বিরাজ করতে লাগলো তার। বুঝতে পারছে না কি উত্তর দেবেন তিনি। কি করে রাফাতকে বোঝাবে সবকিছু?দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করলেন তিনি।কাকলি সরকার শুকনো ঢক গিলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। রাফাতের দিকে শান্ত গলায় বললেন,

‘রাফাত আসলে অনু………

আর কিছু বলতে পারলেন না কাকলি সরকার। রাফাত তার আগেই বলে উঠল,

‘প্লিজ মম, তোমার মুখ থেকে আর একটাও মিথ্যা কথা শুনতে চাই না আমি।অনেক মিথ্যা কথা বলেছো তুমি, আর না। তুমি একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের সাথে হওয়া অন্যায় কি করে সহ্য করতে পারলে?মানছি বাবা তোমার হাজবেন্ট বাট বাবা যেটা করেছে সেটা কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। বাবাকে শাস্তি পেতেই হবে।’

রাফাত কথাগুলো বলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকল। রাফাতের কথা শুনে আলি উদ্দীন চৌধুরি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তার মনে ভয়ের বাসা বাধতে শুরু করল। যেই শাস্তি সে দশ বছর থেকে বেঁচে এসেছে আজ তাকে পেতে হবে। আলি উদ্দীন চৌধুরি ও কাকলি সরকার রাফাতকে অনেক রিকুয়েস্ট করল কিন্তু রাফাত কারো কথা শুনল না। রাফাত বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

রাফাত নিজের রুমে গিয়েই নিজের ফোন হাতে নিল। পুলিশ কমিশনারের নাম্বার খুজে বের করে ফোন দিয়ে কানে ধরল রাফাত। হঠাৎ তার বাবার ঘর থেকে তার মায়ের চিৎকার শুনতে পেল রাফাত। রাফাত যেন কিছুক্ষনের জন্য থেমে গেল। আলি উদ্দিন চৌধুরির ঘরে কি হচ্ছে জানার অগাধ ইচ্ছা জাগলো তার মনে। ফোন কেটে দিয়ে আবির পা বাড়ালো নিজের বাবার রুমের দিকে।

বাবার রুমের সামনে যেতেই আবিরের পৃথিবী থমকে গেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল তার। রাফাত নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। রাফাতের চোখের সামনে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কাকলি সরকারের হাত থেকে অজস্র রক্ত বয়ে যাচ্ছে। পাশেই কাচের ফুলদানি ভেঙে পড়ে আছে। রাফাত নির্বাক হয়ে গেছে নিজের মায়ের এমন কান্ড দেখে। রাফাত দৌড়ে গিয়ে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরল। নিজের চোখের সামনে মায়ের এমন অবস্থা দেখে রাফাত নিজেকে শান্ত তাখতে পারছে না।

আলি উদ্দিন চৌধুরি দৌড়ে গিয়ে ডাক্তারকে ফোন দিল। ডাক্তার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌছে যাবে রাফাতের বাড়িতে। রাফাত কাপড় দিয়ে তার মায়ের হাত শক্ত করে বেধে দিল যাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুতেই রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না।

ডাক্তার এসে রাফাতের মায়ের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। কাকলি সরকারের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। কাকলি সরকার খুব গভীরভাবে নিজের হাত কেটেছেন যার কারনে অনেক ব্লাড লস হয়ে গেছে। কাকলি সরকারের খেয়াল রাখার জন্য ডাক্তার একজন নার্সকে রাখার উপদেশ দিলেন। তিনি আরও বললেন যে কাকলি সরকার যা চায় তাই দিতে নয়তো তার মাথায় প্রচুর পরিমানে প্রেসার পড়বে। যা তাকে প্যারালাইসড করতে সময় নেবে না। রাফাত কাকলি সরকারের হাত ধরে পাশে বসে রইল।

প্রায় এক ঘন্টা পর কাকলি সরকারের জ্ঞান ফেরে। রাফাত কাকলি সরকারের জ্ঞান ফেরা দেখে খুশিতে মেতে ওঠে। কাকলি সরকার কান্না মিশ্রিত কন্ঠে রাফাতকে বলেন,

‘রাফাত কথা দে আমায় তুই পুলিশকে ফোন করবি না৷ নয়তো আমার মরা মুখ দেখবি তুই।’

কাকলি সরকারের এমন কথা শুনে চমকে যায় রাফাত। কি করবে এখন সে? নিজের মাকে কথা দেবে নাকি সেই অসহায় মেয়েটির পাশে থাকবে? রাফাত ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে থাকে তার মায়ের দিকে৷ কাকলি সরকার আবার বলে উঠলেন,

‘কি রে? কথা দিবি না আমায়?’

হঠাৎ কাকলি সরকার মাথায় হাত দিয়ে আর্তনাদ করে ওঠেন। রাফাত কাকলি সরকারের এমন অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে কথা দিয়ে দেয় কাকলি সরকারকে। রাফাতের গলায় গিয়ে সব কষ্টগুলো বদ্ধ হয়ে যায়। দম আটকে আসতে থাকে তার। নির্বিঘ্ন কন্ঠে রাফাত তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘তাহলে অনুকে এই বাড়িতে নিয়ে আসি মা?’

কাকলি সরকার বিষ্ফরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন রাফাতের দিকে। অনেক ভেবে চিন্তে তিনি উত্তর দিলেন,

‘তোমার এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি রাফাত। এখন অনুকে বউ করে নিয়ে আসার কোনো মানেই হয় না। তুমি পড়াশোনা শেষ করে আসো তারপর দেখা যাবে সবকিছু।’

রাফাত নিজের মায়ের কথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু রাফাত অনুর সাথে যে ব্যবহার করেছে তা প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে রাফাতকে। তাই রাফাত নিজের রুমে এসে অনুকে ফোন দেয়। কিন্তু ফোনে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রাফাত অনুকে অনেকগুলো সরি বলে মেসেজ দিল তাকে। বারবার ফোন দেওয়ার ট্রাই করতে থাকল অনুর নাম্বারে। কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হলো না। রাফাত তার মায়ের কাছ থেকে অনুর মায়ের নাম্বার নিয়ে ফোন দিল তাকে। কিন্তু তার নাম্বারেও সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রাফাত সিধান্ত নিল সে অনুর বাড়িতে যাবে কিন্তু তার আগেই রাফাতের মা তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিল।

রাফাত যখন পাঁচ বছর পর দেশে ফিরল তখন তখন তার একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট হয়। যার কারনে কাছাকাছি কোনো হাস্পাতালে তাকে এডমিট করা হয়। সেখানেই রাফাত একটি মেয়েকে দেখে। মেয়েটি নিজের জমানো টাকা দিয়ে একজন মহিলার ছেলের অপারেশনের ব্যবস্থা করে দেয়। মেয়েটির উদারতা দেখে রাফাত ভালোবেসে ফেলে তাকে। প্রথম দিকে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয় রাফাত।

___________

অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে রাফাতের চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দুই ফোটা নোনা জল। কারন তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ভুল বুঝেছে। ঘৃনা করে তাকে। এত বড় বেদনা সহ্য করতে পারছে না রাফাত। বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যাথা করে উঠছে তার। সাত বছর আগে যে অনুকে দেখেছিল রাফাত সে ছিল শ্যামলা বর্ণের মেয়ে এবং তার মধ্যে ভালো লাগার কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু পাঁচ বছর পর যে অনুকে সে দেখেছে সে অত্যান্ত সুন্দরী একজন মেয়ে। তার চোখ একজন ছেলেকে পাগল করতে যথেষ্ট।তাই রাফাত অনুকে কোনোভাবেই চিনতে পারেনি।

অনু নিজের দেশের বাড়ি থেকে চলে এসেছে প্রায় তিনদিন হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো মনের ক্ষতটি রয়ে গেছে তার। হঠাৎ দরজা ঠেস দিয়ে কেউ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল।অনু পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল,

চলবে,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে