শেষ রাত পর্ব-১০+১১

0
893

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১০
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘কোথায় যাবেন ম্যাডাম? আপনি যেখানে যেতে চাইবেন সেখানেই আপনাকে নিয়ে যাবো।’

ধ্রুবর কথায় আমি বিস্মিত হলাম। বিস্ময়ের দৃষ্টি স্থির করলাম তার দিকে। ধ্রুব আমার হাত ধরে হাঁটছেন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। আমার থেকে এক দু পা এগিয়ে আছেন যার কারণে ওনার হাতের বাঁধন খানিকটা শক্ত হয়ে আমার হাতে টান পরছে। আমি হাঁটছি নিঃশব্দে ভাবলেশহীন হয়ে। চোখদুটো যেন জ্বলন্ত আঙ্গার। কান্নার ফলে ক্ষনে ক্ষনে ভারি উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছে বুক চিড়ে। মাথার মধ্যে কিছু অবাঞ্ছিত, অনুচিত অনুভূতি ঝটলা পাঁকিয়ে আছে নির্দ্বিধায়। আমি যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। দৃষ্টি নামিয়ে ক্ষীণ স্বরে থেমে থেমে বললাম-

‘বাসায় যাবো। তুলতুল অপেক্ষা করছে হয়তো।’

ধ্রুব ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে একঝলক তাকালেন। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে বললেন-

‘এখন তো বাসায় যাওয়া যাবে না মিসেস ধ্রুব হাসান। আর তুলতুলকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। আম্মু আছে ওর সাথে আর আমিও কিছুক্ষন আগে কল দিয়েছিলাম। তুলতুল এখন ঘুমাচ্ছে।’

‘কেন! বাসায় যাওয়া হবে না কেন?’

আমি ভীষণ কৌতুহল নিয়েই তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব থামলেন। হাত ছেড়ে পেছন ঘুরে দাঁড়ালেন আমার মুখোমুখি হয়ে। খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে স্থির চেয়ে থেকে নরম স্বরে বললেন-

‘কেঁদেকেটে নিজের যা হাল করেছেন, এই অবস্থা আপনাকে বাসায় নিয়ে গেলে আম্মুর হাজারো প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হবে। আর প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে না পারলে উনি ভাববেন আমি আপনাকে কাঁদিয়েছি। তার চেয়ে বরং আপনি নিজেকে পুরোপুরি স্বাভাবিক করে ঘন্টাখানেক পর বাসা যান। আর আমারও অফিসে কোনো কাজ নেই। তাই আপনাকে কোম্পানি দেওয়াই আমার জন্য ভালো মনে হচ্ছে।’

আমি চুপ থেকে ভাবলাম। ধ্রুবর কথা গুলো যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হলো। কান্নাকাটি করে নিজের যে হাল করেছি এই অবস্থায় বাসায় গেলে মনি মা তার প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসবেন নিশ্চিত। ওনার প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে ভালো কিছুক্ষন বাহিরে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়া। আমি মাথা তুলে ধ্রবর দিকে চাইলাম। আমার মতামত শোনার জন্যই হয়তো বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে বললাম-

‘আচ্ছা, আপনার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই নিয়ে চলুন।’

ধ্রুব অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন। তার হাস্যজ্বল মুখ নিয়ে এগিয়ে এলেন আমার কাছাকাছি। দু’হাত দিয়ে খুব যত্নসহকারে আমার মুখের উপর এসে পরা এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দিলেন। ওড়ানটাও খুব সচেতনতার সঙ্গে ঠিক করে দিয়ে সহজ গলায় বললেন-

‘একটু অগোছালো লাগছিল তবে এবার একদম পারফেক্ট। চলুন এখন যাওয়া যাক।’

ধ্রুব আমার প্রতিত্তোরে অপেক্ষা না করেই হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে লাগলাম। ধ্রুবর কাজে আমি হতবাক। হঠাৎ করেই আমার এত খেয়াল রাখছেন। নির্দ্বিধায় যখন তখন আমার হাত চেপে ধরে হাঁটছেন। কান্নার কারণ জানতে চেয়েও আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেন নি৷ কিন্তু কেন? এসব কেন করছেন তিনি? কিছুক্ষন আগে মনের ভেতর ছাড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনুভূতি গুলো অস্পষ্ট, ঝাপসা হতে লাগলো। মস্তিষ্কে ঘুরতে লাগলো নানানরকম প্রশ্ন আর কিছু নতুন অনুভূতি। এলোমেলো অশান্ত মনটা অবুঝের মতোই প্রশ্ন করল- ‘ধ্রুব কেন এমন করছেন? সব কিছু জেনেশুনেও কেন এতটা নির্লিপ্ত তিনি? কেন এমন স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন?’ অশান্ত মনটাকে শান্ত করার মতো কোনো জবাব মস্তিষ্ক থেকে খুঁজে পাওয়া গেল না। নিরুত্তর, হতাশ মন নিয়েই ধ্রুবর পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম।

ফেব্রুয়ারির শেষ সময়। ফাল্গুনের এক উজ্জ্বল দুপুর ধীরে ধীরেই আঁধারে নিমজ্জিত হলো। আকাশ হলো মেঘাচ্ছন্ন। শীতল ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগলো চারপাশে৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতেই এদিক ওদিকে ছুটোছুটি করে যেতে লাগল সবাই। মিনিট খানেকের মাঝেই খালি হয়ে এলো জনমানবে পরিপূর্ণ রাস্তা। আশেপাশের লোকজনের এত অস্থিরতার মাঝেও ধ্রুব নির্বিকার। তার মাঝে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না। বৃষ্টির পানি স্পর্শ করতে পারেনি তার নির্লিপ্ততাকে। আধভেজা শরীর নিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই আমার হাত ধরে হাঁটছেন। আজ হয়তো আমার হাত ছাড়া পাবে না। আজ সারাক্ষন আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে রাখার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন হয়তো। চলতে চলতেই আমার চোখ আটকে গেল। কিছুটা দূরে রাস্তার ডান পাশে একটা কদম গাছে। অসময়ের ছোট্ট ছোট্ট কদমফুল। বৃষ্টিস্নাত ভেজা কদম। আমার পূর্নাঙ্গ দৃষ্টি এবং মনোযোগ দুটোই স্থির হলো সেই গাছটায়।

‘খুব সুন্দর তাই না!’

ধ্রুবর কথায় আমি সেইদিকে দৃষ্টি দিয়েই ঘোর লাগা কন্ঠে বললাম-

‘হুম হুম। অনেক বেশিই সুন্দর।’

ধ্রুব আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমার হুশ ফিরলো। ধ্রুব দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ হাসি উপহার দিলেন তিনি। শীতল কন্ঠে বললেন-

‘একদম আপনার মতোই সুন্দর।’

ধ্রুব একটু থেমে কিছু একটা ভাবলেন। ভাবুকতার সঙ্গে বললেন-

‘দাঁড়ান আমি আসছি।’

ধ্রুব চলে গেল সেই গাছটার দিকে। ওনার গায়ে জড়ানো খয়েরী রঙের শার্ট। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ওনার শার্ট পুরোপুরি না ভিজলেও কাধের দিকটা ভিজে একদম চুপচুপে অবস্থা। আমাকে অবাক করে দিয়ে ধ্রুব কদম ফুল ছেঁড়ার চেষ্টা করতে লাগল। বেশি কষ্ট করতে হলো না। হাত উঁচু করে একবার লাফ দিতেই গাছের ডাল ওনার হাতের মুঠোয় চলে আসলো। অনেক গুলো ফুল থাকা স্বত্তেও তিনি মাত্র দুটি ফুল এনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মুখে সহজাত হাসি টেনে নিয়ে গাঢ় স্বরে বললেন-

‘গাছের ফুল গাছেই সুন্দর মানায়। কিন্তু বৃষ্টিস্নাত রমনীর হাতে ভেজা কদম ফুল থাকবে না এটা বড্ড বেশিই বেমানান। তবে আমি গাছ থেকে পারমিশন নিয়েই তার ফুল ছিঁড়েছি। গাছটা খুব গম্ভীর গলায় আমাকে অনুমতি দিয়েছে। বলেছে- দুজন মানুষের জন্য শুধু দুটো ফুল দেওয়া যাবে। এর বেশি নিতে চাইলে তার গাছের ফুল হ’ত্যার দায়ে আমাকে এই গাছের ডালেই ফাঁ’সিতে ঝুলতে হবে।’

ধ্রুবর কথা শুনে আমি ফিক করেই হেসে ফেললাম। খেয়াল করলাম। ধ্রুবর ঠোঁটের হাসি আরও প্রসারিত হলো। খানিকক্ষণ হাসার পর ফুল হাতে নিয়ে বললাম-

‘আপনি এসব আজগুবি চিন্তাভাবনা করেন কিভাবে? মাথায় আসে কিভাবে এসব!’

‘বিয়ের আগেই কিছু না করে এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেলাম। সেখানে এসব চিন্তাভাবনা করা তো খুবই তুচ্ছ ব্যাপার।’

ওনার দাম্ভিকতা পূর্ন কথায় আমার কপাল কুচকে এলো। ভ্রু জোড়া মাঝে সুতীক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠলো। ধ্রুবর বাহুতে হাল্কা আঘাত করে তিক্ত গলায় বললাম-

‘ছিঃ রাস্তাঘাটে এসব কি বলছেন আপনি!’

ধ্রুব এবার শব্দ করেই হাসলেন। প্রাণোচ্ছল হাসিতে ফেটে পরলেন তিনি। আমার হাত ধরে ফিরতি পথে হাঁটতে হাঁটতে বললেন-

‘আচ্ছা এবার চলুন। বাকি কথা না হয় আমাদের রুমে একা একা ফিসফিস করে বলবো।’

দমকা শীতল বাতাসে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল আমার অর্ধ ভেজা শরীর। বাতাসের সাথেই তাল মিলিয়ে ধ্রুবর ঝংকার তোলা হাসির শব্দে থরথর করেই কেঁপে উঠলো আমার ভেতরটা। লজ্জারা এসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আমাকে। অযাচিত লজ্জায় নুয়ে গেল আমার চোখ দুটো। আমি আটকাতে পারলাম না চোখের লজ্জা ভাব। চোখ তুলে চাইতে পারলাম না। ধ্রুবর এই অসহ্যকর হাসিতে লজ্জারা আরও বেশিই উৎসাহ পেতে লাগল। খুব ইচ্ছে করলো কান দুটো তালা দিয়ে রাখি। কিন্তু তা সম্ভব হলো না। আমাকে লজ্জার কাছে মাথা নত করতে হলো। আমাকে অসহায় করে দিয়ে ধ্রুব তার অসহ্যকর হাসিতে আমাকে লজ্জায় ফেলতে লাগলো।

‘পেছনের সিটে তোয়ালে আছে সেটা মাথাটা একটু মুছে নিন।’

ধ্রুবর কথা মতোই গাড়িতে বসে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে লাগলাম। ধ্রুব এসে ড্রাইভিং সিটে বসলেন। তার চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে। আমি তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বললাম-

‘নিন মাথা মুছে নিন। এখন কি বাসায় যাবেন নাকি অন্য কোথাও?’

ধ্রুব মাথা মুছতে মুছতেই উত্তর দিল,

‘নাহ একেবারে লাঞ্চ করেই ফিরবো।’

আমি আর কিছু বললাম না। ভেজা শরীর নিয়ে বাসায় ফেরাও ঠিক হবে না। তারচেয়ে বরং আর কিছুটা সময় পাড় হলেই যাওয়া ঠিক হবে। এখন ওনার কথা মতো চলাই শ্রেয় মনে হচ্ছে।

‘তুলতুলের আম্মু! আপনার কি অস্বস্তি লাগছে আমার সামনে বসে থাকতে? তখনকার ঘটনার জন্য আমি আপনাকে কিছু বলিনি এই নিয়েই হয়তো মনে মনে অস্বস্তিবোধ করছেন তাই না!’

আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে অনবরত কাটা চামচ দিয়ে খাবার নাড়তে লাগলাম। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে ইতস্তত করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। ধ্রুব মৃদু হাসলেন। টেবিলের উপরে দু’হাতে তুলে দিয়ে কিছুটা ঝুঁকে এলেন। শান্ত গলায় বললেন-

‘শুনন অনন্য৷ আমি আপনার উপর কোনো প্রকার চাপ সৃষ্টি করতে চাই না। আমি জানি আপনার জন্য এই মুহুর্ত গুলো খুবই কষ্টদায়ক। মনের ভেতরে কষ্ট পুষে রেখে প্রতিটি মুহুর্ত সবার সামনে স্বাভাবিকভাবে থাকা এটা নির্দ্বিধায় খুব কঠিন একটা কাজ। আপনি প্রতিনিয়ত এই কঠিন কাজটাই করে যাচ্ছেন। নিজেকে শক্ত রাখছেন। এর মধ্যে আমি আপনার প্রাক্তনের কথা তুলে আপনার মন ভাঙতে চাই না। ক্ষত জায়গায় নতুন করে আঘাত করতে চাই না। আমি চাইলেই পারতাম বিয়ে হওয়ার পর পরই আপনার উপর স্বামীর অধিকার খাটাতে। অতীত ভুলে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত আপনাকে চাপ দিয়ে বাধ্য করতে৷ কিন্তু এসব করে কি লাভ! আমি কোনো কাপুরুষ নই, যে মেয়েদের উপর জোর খাটাবো। সব কিছুতে জোর খাটানো গেলেও কারও মনের উপর জোর খাটানো যায় না। আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষ হারিয়েছেন বুঝলাম। এই সত্যটা মেনে নিয়ে নতুন করে সংসার করতেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন এটাও আমি বুঝি। কিন্তু আপনি সেই সময় টুকু পাননি। তাই আমি আপনাকে স্পেস দিচ্ছি। নিজের মতো করে থাকার সুযোগ দিচ্ছি। আপনি যেন নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারেন। অতীত মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। এবার নিশ্চয়ই বুঝেছেন কেন আমি আপনার ব্যাপারে উদাসীন, নির্লিপ্ত।’

আমি প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। ওনার কথা গুলো শুনে হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুব খানিকটা নেড়েচেড়ে আবারও বললেন-

‘আমার সাথে আপনি ফ্রেন্ডলি কথা বলতে পারেন। আমি আপনার হাসবেন্ড হিসেবে না আপনার পূর্বপরিচিত একজন হয়ে কথা বলছি। তোকে তো আমি ছোট থেকেই চিনি। সারাদিন আমার মা আর আপুর পেছনে লেগে থাকতি। আমার পেছনেও ঘুরতি আইসক্রিম খাওয়ার জন্য। তুই ভুলে গেলেও আমি কিন্তু ভুলিনি।’

ধ্রুব কথা গুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। কিন্তু শেষের কথা গুলো শুনেই হেসে ফেললাম। মানুষটা খুব দ্রুত কথা বলার ধরন পালটে ফেলতে পারেন। ওনার নির্লিপ্ততা এতদিন আমার রাগের কারণ হলেও আজ সব কিছু শুনে ওনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হলো। খানিকটা ভালো লাগার জন্ম নিলো মনে। আমি মুচকি হাসলাম৷ কিন্তু কিছু বললাম না৷ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসবো তখনই ধ্রুব চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে যেতে বললেন-

‘আমার হলে পুরোপুরি আমারই হতে হবে।’

ধ্রুব অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে চলছেন। আমি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। হঠাৎ করেই এই কথার কি মানে? কেন বললেন এই কথা?

রাত হতেই হু হু করে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে লাগলো। অসময়ের জ্বর কাবু করে নিলো আমাকে। শরীরের ভেতরটা যেন ভ্যাপসা গরমের সিদ্ধ হতে লাগল। চোখদুটো জ্বালা করছে খুব। চোখ মেলে চেয়ে থাকাটাও মুশকিল মনে হচ্ছে। আমি অলস ভঙ্গিতে চিঠি আর ম্যাপল পাতায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে চাপা দিয়ে রাখলাম ডায়েরির ভাঁজে। বারান্দা দিয়ে আসা হিমশীতল বাতাসে পুরো রুম যেন হিমঘরে পরিনত হয়েছে। খালি রুম। অন্য কেউ নেই রুমে। তুলতুল খেলতে খেলতে মনি মা’র রুমেই ঘুমিয়ে পরেছে৷ বাসায় আসার পর থেকেই আমার সাথে চিপকে লেগে ছিল পুরোটা সময়। যেন আমাকে ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাবো। রাতে ধ্রুব অফিস থেকে আসার পরেই আমাকে ছেড়েছে। ধ্রুবও হয়তো মনি মা’র রুমেই এখন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। টেবিলের ডয়ারে ডায়েরিটা রেখে উঠে দাঁড়ালাম। কি আশ্চর্য। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও যেন পাচ্ছি না। ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে যন্ত্রণা যে এখন পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরলো। সাদাফের বিষাক্ত ভালোবাসায় বিষিয়ে উঠলো আমার সারা দেহ।

চলবে….

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১১
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

বিষাক্ত ভালোবাসায় নিজেকে আক্রান্ত করেছি বিগত সাড়ে তিন বছর যাবত। ধীরে ধীরে সাদাফ নামক ভালোবাসার বিষ এরকম ভয়ংকর রূপ নিবে তার ধারণা ছিল না। গল্পের এক অসহায়, আঘাতে জর্জরিত চরিত্র আমি। আর সাদাফ সেই গল্পের অদ্ভুত, ভীষণ অদ্ভুত এক উদাসীন চরিত্র। আমার প্রতিটি বিষয়ে হিমালয় সমান তার উদাসীনতা। যখন দেখতে চেয়েছি তখন দূরে সরে গেছে। যখন কথা বলতে চেয়েছি তখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। ভালোবাসতে চেয়েছি সে এক আকাশ অভিমান ফিরিয়ে দিয়েছে। মানুষ ভালোবেসে কাছে আসতে চায়। অথচ সাদাফ দূর থেকে ভালোবাসা অনুভব করতে চায়। দূর থেকেই ভালোবাসার গভীরতা বাড়াতে চায়। ভালোবাসা হয় আনন্দ আর সুখের এক রঙিন অনুভূতি। তবে সাদাফের ভালোবাসা কষ্টের, অপেক্ষার, অভিমানের ধূসর রঙের অনুভূতি। এটা কি আধো ভালোবাসা ছিল? নাকি ভালোবাসা নামক বিষ ছিল। যে বিষ গ্রহণে শুধু এবং শুধুই যন্ত্রণা হয়। মরণ যন্ত্রণা। মনের অসুখ আর ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের মতোই দূর্বল হয়ে পরেছে আমার বলহীন দেহ। পালা দিয়ে বেড়েই চলছে দেহের তাপমাত্রা। চোখ দুটো জ্বলন্ত লাভার রূপ নিলো। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাত কপালে রাখলাম। বুঝলাম জ্বর খুব ভালো গতিতে বেড়ে যাচ্ছে।

‘সরি সরি একটু দেরি হয়ে গেল। আব্বুর সাথে অফিসের কাজ নিয়ে কথা বলছিলাম। সময়ের খেয়াল করিনি।’

আমি দাঁড়িয়ে থেকেই পিটপিট করে ধ্রুব দিকে চাইলাম। তিনি একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে অনুরোধের ভঙ্গিতে বললেন-

‘আমার ফোনটা দেখেছেন তুলতুলের আম্মু? কোথায় যেন রেখেছি মনে নেই। একটু কষ্ট করে খুঁজে দিবেন প্লিজ! আমার শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে তাই আপনাকে বলছি।’

শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে যাওয়া গলা দিয়ে আমি ক্ষীন স্বরে বললাম-

‘হুম দিচ্ছি।’

ধ্রুব খুশি হলেন। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তিময় হাসির রেখা আরেকটু প্রসারিত হলো৷ খানিকক্ষণের জন্য শারীরিক যন্ত্রণা ভুলে বলহীন শরীর নিয়েই এগিয়ে গেলাম ড্রেসিং টেবিলের দিকে। অফিস থেকে এসেই এখানে ফোন রেখেছেন। আর এখনই না-কি ভুলে গেছেন। কি অদ্ভুত! চোখের সামনেই তো ফোন। তবুই পাচ্ছে না এটা কেমন কথা! আমি ফোন নিয়ে ধ্রুরব কাছে আসতেই মাথা ঘুরে উঠলো। ঝিম ধরে গেল মাথা। চোখের সামনের পুরো দুনিয়াটাই যেন অন্ধকার হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকার আর কোনো শক্তি পেলাম না। তাল হারিয়ে ঢলে পরলাম ধ্রুব উপর। মিনিট খানেক ধ্রুবর বুকে ঝিম মে’রে পরে রইলাম। খানিকক্ষণ পর ধ্রুবর বুকে হাতের ভর দিয়ে মাথা তুলে তাকাই। ধ্রুবর ঝাপসা মুখের দিকে স্থির চেয়ে রইলাম। চোখদুটো ভয়ংকর রকম জ্বালা করছে। জ্বরে তীব্র উত্তাপ যেন চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

”Is it comfortable lying there?

ধ্রুবর কথায় আমার উত্তপ্ত চোখজোড়া বিস্ময়ে গোলাকৃতি হলো। ড্যাবড্যাব করেই চেয়ে রইলাম ধ্রুবর ভ্রু কুচকানো মুখের দিকে। আমাকে নড়তে না দেখে ধ্রুব তার আঙুল দিয়ে আমার ডান গালে পর পর দু’বার গুতো দিলেন। হাহাকার ধ্বনিতে বললেন-

‘আমার পারসোনাল বুক থেকে উঠুন না প্লিজ!’

আমি ফুস করেই তপ্ত শ্বাস ফেললাম। ওনার বুকে দু’হাতের ভর দিয়ে উঠে যেতে চাইলাম। তার আগেই ধ্রুব তার দু’হাতে আমার গাল চেপে ধরে বাধা দিলেন। ওনার বুকের উপর থেকে আমার ডান হাত নিয়ে নিজের গালে রাখলেন। সাথে সাথেই চমকে উঠলেন তিনি। অবাক কন্ঠে বললেন-

‘আপনার হাত এত গরম কেন? দেখি তো কপাল দেখি।’

ধ্রুব উত্তেজিত হয়েই আমার কপালে হাত রাখলেন। ধ্রুব চমকালেন আমার শরীরের তাপমাত্রা দেখে। আর আমি শিউরে উঠলাম ওনার ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে। ধ্রুব দ্রুত আমাকে তার জায়গায় শুয়িয়ে দিয়ে তিনি আমার নিচ থেকে উঠে বসলেন। অস্থির হয়ে বললেন-

‘আপনার এত জ্বর আর আপনি চুপচাপ বসে আছেন কেন? আমাকে বলেন নি কেন?

আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। তার আগেই ধ্রুব অপরাধীর ন্যায় গলারস্বর নামিয়ে বললেন-

‘আমার ভুলের জন্যই এমন হয়েছে। আমি আপনাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছি বলেই এমনটা হলো।’

আমি নেড়েচেড়ে উঠে বসতে চাইলাম। কিন্তু শরীরে সেই শক্তিটুকু পেলাম না। ক্লান্ত শরীরের পুরোপুরি ভর ছেড়ে দিলাম বিছানায়। অস্ফুটস্বরে বললাম-

‘আপনার কোনো দোষ নেই। বাসায় ফিরে একটু বেশি সময় নিয়ে গোসল করেছিলাম। এই জন্যই হয়তো জ্বর এসেছে।’

আমার কথা শুনে ধ্রুব তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষন চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ফুস করে একটা শ্বাস ফেলে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে কড়া গলায় বললেন-

‘ইচ্ছে করছে এক চড় দিয়ে মাথা থেকে সব ভূত বের করি। কিন্তু আফসোস সব ইচ্ছে পূরণ করতে নেই।’

আমি চেতন আর অচেতনের মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে শুয়ে রইলাম। আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই চোখ মেলে দেখার সুযোগ হলো না। মুখ ফুটে কিছু বলার শক্তি বোধ হলো না। তবে ধ্রুবর কথা গুলো শুনতে পেলাম স্পষ্ট। শেষ রাতে কেউ তো একজন বুঝতে পারলো আমার পরিস্থিতি। আমার কষ্ট, বিচ্ছেদের ব্যথা। অবশেষে কেউ তো একজন শাসন করছে আমার পাগলামিতে। কেন এতদিন কেউ খেয়াল করলো না আমাকে? কেন কেউ বুঝতে পারলো আমার ভালোবাসা হারানোর কষ্ট? কেন সবার সামনে আমাকে ভালো থাকার অভিনয় করে যেতে হলো? অবচেতন মনে আরও কত কত প্রশ্ন উঁকি দিল। মনে মনেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আওড়াতে লাগলাম। কিন্তু কোনো জবাব পেলাম না। মিনিট খানেক পরেই কপালে ঠান্ডা কিছু অনুভব করলাম। ধ্রুব জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছেন। আমার উত্তপ্ত মাথায় চলছে তার শীতল হাতের বিচরণ। মনে মনে কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করলো। একটু আগেই ধ্রুব বললেন তার ক্লান্ত লাগছে। এখন আবার আমার জন্য এতটা অস্থির হয়ে পরেছেন।

তীব্র শীতল বাতাসের স্পর্শে ঘুমের মধ্যেই কেঁপে উঠছে আমার শরীর। কপাল কুচকে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাই। চোখ খোলা মাত্রই জানালার দিকে নজর গেল। বাতাসের ঝাপটায় জানালার পর্দা গুলো হেলেদুলে উড়ছে। ঘুম জড়ানো ঝাপসা চোখে দেয়ালের ঘড়িটা স্পষ্ট দেখা হলো না। শরীর থেকে কম্বল সড়ে গেছে বলেই শীত করছে। ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাতেই ধ্রুবর ঘুমন্ত মুখে দৃষ্টি আটকালো। আমার মাথার নিচেই তার বা হাত বন্দী। আমার ক্লান্ত মস্তিষ্কে কিছুই ডুকলো না। জ্বরের ঘোরে কখন ওনার হাতে মাথা রেখে শুয়েছি তার বিন্দুমাত্র হদিস পেলাম না। আমি খুব সাবধানে ওনার হাত থেকে মাথা সরিয়ে নিতে চাইলাম। তার আগেই ধ্রুব নেড়েচেড়ে উঠলো। চোখ বন্ধ রেখেই ডান হাত দিয়ে কম্বল টেনে আমার গলা পর্যন্ত ঢেকে দিলো। কম্বলের উপরে আমার পেটের উপরে হাত রেখে ঘুম পারানোর মতো করে ওঠানামা করতে লাগলেন। আমি ঘুম জড়ানো চোখে স্থির তাকিয়ে রইলাম। ওনার কর্মকাণ্ড বোঝার চেষ্টা করলাম। উনি কি আমাকে তুলতুল মনে করছেন? তুলতুলকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতেই কি তার এমন অভ্যাস হয়েছে? আরও নানান কথা ভাবতে ভাবতেই আবারও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

‘তুলতুল পাখি মাম্মা অসুস্থ। মাম্মাকে কষ্ট দেয় না ঠিক আছে!’

ধ্রুবর কন্ঠস্বর আর তুলতুলের স্পর্শে আমার ঘুম ভাঙলো। সেই সাথে তুলতুলের মাথাটাও বুঝি আমার গলার দিকে আসলো। মোচড়ামুচড়ি করছে আমার গাঁয়ে গাঁ মিলিয়ে। খুব সম্ভবত মেয়েটা চাইছে আমি তাকে জড়িয়ে ধরি।

‘চুপচাপ শুয়ে থাকো তুলতুল পাখি। তুমি না ভালো মেয়ে একদম তোমার মাম্মার মতো! তাহলে পঁচা কাজ কেন করছো! নাড়াচাড়া করে না তুলতুল। তোমার মাম্মা ব্যাথা পেলে তোমাকে কিন্তু আর তার কাছে আসতে দিবো না।’

আমি এবার চোখ মেললাম। তুলতুলকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে মাথা হাত বুলিয়ে দিলাম। তুলতুল খুশি হয়ে আমার বুকে মুখ গুজিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলো। আমি ধ্রুবর দিকে চোখে ছোট ছোট করে সরু দৃষ্টিতে চাইলাম। ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘মেয়েকে বকা দিচ্ছেন কেন?’

আমার কথায় ধ্রুব ভীষণ অবাক হয়ে বললেন-

‘বকা কখন দিলাম? আমি ওকে বুঝিয়ে বলছিলাম।’

‘এইটুকু বয়সে মেয়েটা কি বুঝবে আপনার কথা? আর আপনি আমার কাছে ওকে আসতে দিবেন না বলেই তো হুমকি দিলেন। আবার বলছেন বকা দেননি।’

আমি ওনার দিকে ভ্রু জোড়া ঈষৎ উঁচু তাকাতেই ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। কন্ঠে উদাসীন ভাব এনে বললেন-

‘মা-মেয়ে মিলে আমার বিরুদ্ধে দল বানিয়েছেন তাই তো! সমস্যা নেই সবাই-ই তো আপনার দলেই আরেকটা বাবু হলে ওকে আমার পক্ষে করে নিব। তখন আমার দলও ভারি…’

ধ্রুব কথার মাঝেই থেমে গেলেন। আমি বিস্মিত হয়ে ওনার কথার ভাবার্থ বোঝার চেষ্টা করলাম। ধ্রুব থতমত খেয়ে অপ্রস্তুত গলায় বললেন-

‘আমি অফিস যাচ্ছি। আম্মুকে বলে রেখেছি আপনার খেয়াল রাখবে। আর হ্যাঁ আগামী দু’দিন আপনার ভার্সিটিতে যাওয়া নিষেধ।’

ধ্রুব হড়বড়িয়ে আলমারি থেকে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। ভীষণ হাতাশায় আমার মুখ চিমসে গেল। সামান্য জ্বরের জন্য দু’দিন ভার্সিটিতে যাওয়া নিষেধ এটা কেমন কথা! আহামরি কিছু তো আর হয় নি। সামান্য একটু জ্বর।

‘ভাবি! আবারও আসলাম ডাকপিয়নের দায়িত্ব পালন করতে। কি খবর আপনার ভাবি? কেমন আছেন?’

রাফিন ভাইয়ের কথা শুনে বিরক্তিতে ভাঁজ পরলো দুই ভ্রুর সংযোগ স্থলে। গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলাম জানালার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাফিন ভাইয়ের দিকে। মুখ ঘুরিয়ে পাশে বসে থাকা সানির দিকে চেয়ে ভারি কণ্ঠে বললাম-

‘সানি তুই ক্লাস কর। আমি এখন যাই। একটু পরেই তোর দুলাভাই আমাকে নিতে আসবে।’

সানির প্রতিত্তোরে অপেক্ষা না করেই আমি গাম্ভীর্যের সঙ্গে পা ফেলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলাম। দরজার কাছে আসতেই রাফিন ভাই অবাক হয়ে বললেন-

‘দুলাভাই নিতে আসবে মানে কি ভাবি? আপনি কিভাবে জানলেন?’

‘কি জানার কথা বলছেন?’

আমার পালটা প্রশ্নে রাফিন ভাই মিইয়ে গেলেন। আমি বিরক্তি ভাব নিয়েই ঘড়িতে টাইম দেখলাম। একদিন পর ভার্সিটিতে এসেছি। কিছুদিন পরেই এক্সাম তাই ক্লাস মিস দিতে চাইনি। ধ্রুবকে খুব করে রিকুয়েষ্ট করার পর তিনি রাজি হয়েছেন। তবে তার একটাই শর্ত। অসুস্থ শরীর নিয়ে আজ সব ক্লাস করা যাবে না। তিনটা ক্লাস করেই ওনার সাথে বাসায় ফিরতে হবে। বাধ্য হয়েই ওনার শর্ত মেনে নিয়েছিলাম।

‘ভাবি এই যে এটা আপনার জন্য। সাদাফ পাঠিয়েছে।’

আবারও চিঠি তবে এবার নীল রঙের। আমি হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিতেই রাফিন ভাই তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে মাঠের অন্য পাশে এশে একটু বসলাম। ধ্রুবর আসতে আরও অনেকটা সময় আছে৷ তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিঠি খুললাম।

অনুপাখি,

তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিকের উড়নচণ্ডী স্বভাবকে পরিবর্তন করার সময় এসেছে অনুপাখি। আমার ভালোবাসায় তোমার অভিমানকে ভেঙে গুরিয়ে দেওয়ার সুযোগ এসেছে। সময় এসেছে তোমার চোখের জল শুষে নেওয়ার। ভালোবাসা এবার রঙিন হবে। তোমার অপেক্ষার আবাসন ঘটবে। সকল দূরত্ব ঘুচে যাবে। আমার তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো এবার তোমাকে বউ সাজে দেখে নিজের তৃষ্ণা মেটাবে। মুছে দিবো আমি তোমার মনে থাকা সকল কষ্ট। তৈরি তো তুমি তোমার ইচ্ছে আর চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে?

ইতি,
তোমার বাউন্ডুলে প্রেমিক

চিঠি পড়া শেষ হতেই ফুস করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেললাম। অলস ভঙ্গিতে চিঠি ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিলাম। খুব করে চেষ্টা করলাম এসব নিয়ে না ভাবতে। চিঠির কথা গুলো মস্তিষ্ক থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। মন খারাপ করবো না। কিছুতেই না। কান্নাও করবো না আমি। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে তুলতুলের ছবি দেখতে লাগলাম। মেয়েটার মুখ দেখেই মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। বিচ্ছেদের দাহনে পুড়তে থাকা হৃদয়টা হঠাৎ করে শীতল হয়ে গেল। ভালো লাগায় ছেয়ে গেল চারপাশ।

‘অনুপাখি!!’

চিরচেনা সেই পুরনো কন্ঠস্বর শুনেই বুকটা ধক করে উঠলো। হাতুড়ি পেটার মতো ধুপধাপ করে লাফাতে লাগলো হৃদয়। ফোন থেকে দৃষ্টি তুলে সামনে তাকাতেই থমকে গেলাম আমি।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে