শেষটা সুন্দর পর্ব-২৩+২৪

0
746

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩।

রাবীর গাড়ি থেকে নেমে মেহুলের কাছে আসে। সে অস্থির গলায় বলে,

‘কোথায়, মেহুল? ঐ লোকটা কোথায়?’

মেহুল তাকে হাতের ইশারা দিয়ে দেখায়। রাবীর সেদিকে চেয়ে দেখে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,

‘চলুন।’

রাবীর মেহুলকে নিয়ে রাস্তার ওপারে যায়। মেহুল তাকে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘শুনুন, একদম ধরে উড়াধুরা মাইর দিবেন।’

রাবীর তার দিকে চেয়ে মুচকি হাসে। সে ঐ ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটা চোখ মুখ কাচুমাচু করে বলল,

‘সালম স্যার।’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’

মেহুল হা করে চেয়ে আছে দুজনের দিকে। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। রাবীর তার দিকে চেয়ে বলল,

‘এই লোকটার উপর আপনার কেন সন্দেহ হয়েছে, মেহুল?’

‘আসলে, উনি তখন থেকে আমাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন। আর এখান থেকে যাচ্ছিলেনই না। তাই আমি ভেবেছি আরকি…’

পাশের ছেলেটি তখন অনুনয়ের সুরে বলল,

‘দুঃখিত ম্যাডাম, আসলে আমি আপনার খেয়াল রাখছিলাম। আমার তাকানোতে আপনার খারাপ লেগে থাকলে আমি সত্যিই দুঃখিত।’

মেহুল রাবীরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘উনি কে?’

‘উনি আপনার পার্সোনাল গার্ড। আর এখন থেকে উনি আপনার সাথে সাথেই থাকবেন।’

মেহুলের কথাটা শুনে একটু অন্যরকম লাগল। একটা লোক সারাক্ষণ তার পেছন পেছন ঘুরবে, এটা কেমন দেখায়। তাই সে রাবীরকে বলল,

‘কিন্তু, ব্যাপারটা কেমন না? আর আমার তো গার্ডের প্রয়োজন ছিল না। আমার এসবে অস্বস্তি লাগবে, রাবীর।’

‘আমি বুঝতে পারছি, মেহুল। কিন্তু, আপনার সুরক্ষার জন্য এইটুকু আপনাকে এখন মেনে নিতেই হবে। আমার পক্ষে সারাক্ষণ আপনার খেয়াল রাখাও সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আর উনি আমার খুব বিশ্বস্ত লোক। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।’

মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদু হাসল। সে আর কী বলবে। আজকাল যা হচ্ছে তাতে করে একটা নিরাপত্তার দরকার ছিল অবশ্য। রাবীর জিজ্ঞেস করল,

‘আপনার আর কোনো অসুবিধা নেই তো?’

‘না।’

‘ঠিক আছে, আমি…’

রাবীরের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তার ফোন বেজে উঠে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,

‘এক মিনিট।’

তারপর সে কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে,

‘স্যার, বাংলা বাজার গোডাউনে আগুল লেগেছে। এইদিকে শ্রমিকরা আহাজারি করছে। সবাই দিশেহারা হয়ে দিক বেদিক ছুটছে, স্যার। আমরা কাউকে সামলাতে পারছি না। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরাও এখনো আসেনি। মানুষের হৈ চৈ এ চারদিকের অবস্থা খুব খারাপ। কী করব বুঝতে পারছি না।’

রাবীর আতঙ্কিত হয়ে বলল,

‘কী বলছো এসব? ওখানে আগুন লাগল কী করে? আমার শ্রমিকদের দোকান। কীভাবে এসব হয়েছে?’

ওপাশের লোকটা তখন বলল,

‘স্যার, আমাদের যে দারোয়ানের ছিল সে বলেছে, আগুন এমনি এমনি লাগেনি কেউ লাগিয়েছে। কিন্তু, সে কে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। আপনি এক্ষুনি একবার এখানে আসুন।’

রাবীর অস্থির গলায় বলল,

‘ঠিক আছে, আমি আসছি।’

মেহুল রাবীরের অস্থিরতা আর আতঙ্কিত চোখ মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

‘আর বলবেন না, বাংলা বাজার গোডাউনে আগুন লেগেছে। আমার শ্রমিকদের দোকান সেখানে। চারদিকে হৈ চৈ লেগে গিয়েছে। আমার এক্ষুনি একবার যেতে হবে। আপনি সাবধানে বাড়ি যাবেন। পরে কথা হবে। আসছি এখন।’

মেহুল রাবীরের সামনে দাঁড়িয়ে ভীত সুরে বলল,

‘এত অস্থির হবেন না। যেখানেই থাকবেন সাবধানে থাকবেন। আর প্লিজ একটু সময় করে আমাকে ফোন দিয়ে আপডেট জানাবেন।’

‘হ্যাঁ, আপনি চিন্তা করবেন না। বাড়ি যান। আমি সাবধানেই থাকব।’

রাবীর আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায়নি। গাড়ি নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। মেহুলের বুকের ভেতরে খচখচ করছে। ভয় হচ্ছে। এখন রাবীরের জন্য বড্ড দুশ্চিন্তা হয় তার। চারদিকে যা বিপদ, লোকটা একটু সাবধানে থাকতে পারলেই সে বাঁচে।

মেহুল বাসায় ফিরে অল্প কিছু খেয়ে নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ে। ফোনটা হাতে নিয়ে ফেইসবুকে ঢুকতেই বাংলা বাজারে আগুনের একটা ভিডিও চোখের সামনে চলে আসে তার। চট করে উঠে বসে সে। আগুন তো ছোটখাটো ভাবে লাগেনি। বিশাল আগুন লেগেছে। মেহুলের মনে আরো ভয় জাগে। সে ছুটে টিভির রুমে যায়। টিভি ছেড়ে খবরের চ্যানলে গিয়ে দেখে সবখানেই এই আগুনের ফুটেজ’ই চলছে। আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। চারদিকে মানুষ ছোটাছুটি করছে। রামিনা বেগম সেই মুহূর্তে রুমে এসে বললেন,

‘দুপুর থেকেই দেখছি এই অবস্থা। এখনো নাকি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। কী যে হবে কে জানে?’

মেহুল মায়ের দিকে চেয়ে অসহায় সুরে বলে,

‘মা, ওখানে তো রাবীরও গিয়েছেন।’

রামিনা বেগম আঁতকে উঠে বলেন,

‘কী? কেন?’

‘এট নাকি উনার লোকদের গোডাউন। উনাকে ফোন দিয়ে বলেছেন আর উনিও চলে গিয়েছেন। আগুনের অবস্থা দেখেছো, আমার তো এখন ভয় করছে মা।’

‘না না, কিছু হবে না। জামাই নিরাপদেই থাকবেন। টিভিতে দেখ না। ঐ যে ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা কাজ করছে। আগুন নিভে যাবে।’

মেহুল টিভির সামনে থেকে আর নড়ল না। টানা দু ঘন্টা যাবত সে টিভির সামনেই বসে আছে। টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। সাংবাদিকদের সামনে এই মুহুর্তে রাবীর দাঁড়িয়েছে। তাকে সাংবাদিকরা নানা প্রশ্ন করছেন। আগুন কীভাবে লাগল, কিংবা কে লাগাল এইসকল বিষয়ে। মেহুল ক্ষিপ্ত হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলল,

‘আশ্চর্য, আগুন কীভাবে লেগেছে সেটা কি উনি জানেন নাকি? সাংবাদিকদের কি আর কোনো কাজ নেই? আজাইরা সব প্রশ্ন করেন।’

রামিনা বেগম বললেন,

‘জায়গাটা রাবীরের। আর এখানে কাজও করে তার লোকেরাই। তাই তাকেই এই প্রশ্নগুলো করা হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’

রাবীর বেশ সাবলীল ভাবে সব প্রশ্নের জবাব দিল। সে বলল, “তদন্ত চলছে। খুব শীঘ্রই তারা পুলিশের সহায়তা নিয়ে এই আগুনের রহস্য উদঘাটন করবে।”

সাংবাদিকের ব্রিফিং শেষ হতেই মেহুল রাবীরকে কল দেয়। কল রিসিভ করলে মেহুল বলল,

‘আপনি ঠিক আছেন?’

‘হ্যাঁ মেহুল, আমি ঠিক আছি। আপনি চিন্তা করবেন না।’

‘আমি আপনার লাইভ দেখছি। ওখানের আগুন কি পুরোপুরি এখনো নিভিনি?’

‘না, কিছু কিছু জায়গায় এখনো আছে।’

‘আচ্ছা, আপনার আর ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই। বিল্ডিংটা যেভাবে পুড়েছে ধসে পড়ার সম্ভবনা আছে। ঐখানের লোকগুলোকে সরে আসতে বলুন।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।’

মেহুল পুনরায় কিছু বলার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে কাউকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়,

‘স্যার, গোডাউনের পেছনের দেয়াল ভাইঙ্গা গেছে। আর ঐডার নিচে আমার কর্মচারী আটকা পড়ছে স্যার। এখন হে কোনোভাবেই বের হইতে পারতেছে না। কিছু করেন স্যার। ওরে বাঁচান।’

রাবীর ফোনের এপারে মেহুলকে বলল,

‘মেহুল, আমি আপনার সাথে পরে কথা বলছি।’

এই বলে সে কল কেটে দেয়। এমনিতেই মেহুল শান্তি পাচ্ছে না। এখন আবার এসব শুনে আরো বেশি অস্থির লাগছে তার। এই লোকটা কী থেকে কি করে বসে কে জানে। মেহুল সোফায় বসে বসে হাত কঁচলাতে থাকে। রামিনা বেগমও চোখ মুখ কুঁচকে ভীত চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন।

কিছুক্ষণ পর খবরে বলল, “বিপদের উপর আরেক বিপদ লেগেছে। আগুন নিভানোর জন্য যারা গোডাউনের ভেতরে গিয়েছিল তারা এখন বের হতে পারছে না। গোডাউনের একপাশের পুরো দেয়াল ধসে পড়েছে। অনেকে নাকি আবার সেই দেয়ালের নিচেই চাপা পড়েছে।”

এই কথা শুনে মেহুলের হাত পা এবার ঠান্ডা হয়ে আসছে। সে তাড়াহুড়ো করে রাবীরকে কল দেয়। কিন্তু তার ফোনে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলছে। মেহুলের ভয়, দুশ্চিন্তা সব বাড়তে থাকে। টিভিতেও আর তাকে দেখা যাচ্ছে না। বুকের ভেতরে ধুকধুক করছে তার। এই লোকটা আজ তাকে দুশ্চিন্তা দিতে দিতে হয়তো মেরেই ফেলবে। সে লাগাতার কল দিয়েই যাচ্ছে। আর রাবীরের ফোনও বারবার সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না’ই বলে যাচ্ছে। মেহুল যে কী করবে বুঝতে পারছে না। রামিনা বেগমও খুব অস্থির হয়ে উঠেছেন।

মেহুল রাবীরের সাথে আর কোনোভাবে যোগাযোগ করতে না পেরে এক পর্যায়ে তার মা’কে কল দেয়।

চলবে….

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪।

‘মা, আপনার ছেলে তো আমার কলও ধরছে না।’

‘টিভি তে তো দেখছ’ই কী অবস্থা, ও হয়তো ফোন ধরার অবস্থাতেই নেই।’

‘আমার উনার সাথে লাস্ট কথা হয়েছিল ঐ বিল্ডিংটার দেয়াল ধসে পড়ার আগে। এরপর থেকে এখন আর একবারও কথা হয়নি। আমার তো এখন খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে, মা।’

রাবীরের মা মৃদু হাসলেন। বললেন,

‘যাক, এখন আমার দুশ্চিন্তার ভাগ নেওয়ার জন্যও একজন চলে এসেছে। তবে এইতো কেবল দুশ্চিন্তার শুরু। এখনো তো পুরো জীবন পড়ে আছে এর জন্য।’

মেহুল সোফায় বসল। টিভির উপর থেকে চোখ সরছে না তার। কোনো নতুন আপডেটও পাচ্ছে না।
রাবীরের মা বললেন,

‘রাবীর ঠিক আছে। আমার আর তোমার ভালোবাসা আছে তো ওর সাথে। তুমি চিন্তা করো না।’

‘আচ্ছা মা, যদি আপনার সাথে কথা হয়, তাহলে আমাকে কিন্তু অবশ্যই বলবেন।’

‘ঠিক আছে।’

মেহুল কল কাটার পর রামিনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

‘বেয়ান কী বলেছেন?’

‘উনি ম্যান্টালি খুব স্ট্রং, মা। হয়তো দুশ্চিন্তা নিতে নিতে এখন আর এসব ছোট খাটো ব্যাপারে উনি এত অস্থির হন না। আমাকে বলেছেন, এ তো সবে শুরু। ভবিষ্যতে নাকি এমন দুশ্চিন্তা আরো নিতে হবে।’

‘হ্যাঁ, তা তো নিতে হবেই। নেতার বউ হয়েছিস, দুশ্চিন্তা কি আর এত সহজে পিছ ছাড়বে। তোকেও তোর শাশুড়ির মতোই স্ট্রং হতে হবে।’

মেহুল নিরস মুখে মৃদু আওয়াজে বলল,

‘হু।’

________

ঘড়িতে দশটা বাজে। মেহুলের চোখ মুখ ফুলে আছে। তার মা বাবা তার পাশেই বসে আছেন। একটু আগেই রাবীরের কল এসেছে। ফোন দিয়ে বলেছে, সব ঠিক আছে। সবাইকে ঠিকঠাক মতো বিল্ডিং এর ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যারা চাপা পড়েছিল তাদেরকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর এসবের মাঝে সেও বেশ অনেকটাই ব্যথা পেয়েছে। একজন লোককে বের করতে গিয়ে পায়ের অনেকটা অংশ ছিলে গিয়েছে তার। হাতেও জখম লেগেছে বেশ। এখন সে হসপিটালেই আছে। আর মেহুল এই কথা শোনার পর থেকেই কেঁদে কেটে অস্থির যে সে হসপিটালে যাবে। কিন্তু, রাবীর তাকে কোনোমতেই সেই অনুমতি দিচ্ছে না। হসপিটালে এই সময় অনেক সাংবাদিক আছেন। সে চায় না, তারা কেউ তার স্ত্রীকে এভাবে দেখুক। আর ঐদিকে মেহুলও জেদ দেখাচ্ছে। কিন্তু, রাবীরের কাছে এই মুহুর্তে এই জেদের কোনো মূল্য নেই। সে উল্টো বলেছে, ঐদিকের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সে নিজেই এসে মেহুলের সাথে দেখা করে যাবে।

তখন বারোটা বাজেনি। মেহুল খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছে। রাগ, জেদ, কষ্ট, অভিমান সবই লাগছে তার। মনে মনে তাই ঠিক করেছে রাবীরের সাথে কথাই বলবে না। এই লোকটার কাছে তার এত চিন্তার, এত অস্থিরতার কোনো মূল্যই নেই। আর একবারও তাকে কল দেয়নি। বলেছিল আসবে, তাও তো আসেনি। তাই সেও আর কল দিবে না, আর কোনো খোঁজ নিবে না। থাকুক সে তার মতো। তার এত এত দুশ্চিন্তার যার কাছে কোনো মূল্য নেই, সেও তাকে কোনো মূল্য দিবে না। এই বলে মেহুল চক্ষু মুদন করে। কিন্তু ঘুমাতে পারে কই। চোখের সামনে তো রাবীরের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। তার ক্লান্ত কন্ঠস্বর যে কানে বাজছে। এভাবে ঘুমানো যায়?

________

ঘুমের বাজেই মাথার ভেতরে ক্রিং ক্রিং করে একটা শব্দ বাজছে। মেহুলের তখন ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে। স্বপ্নে এমন অদ্ভুত শব্দ কোথ থেকে তৈরি হচ্ছে। মেহুল হাঁসফাঁস করছে। তবুও চোখ মেলে তাকাচ্ছে না। কিন্তু, সেই শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মেহুলের মস্তিষ্ক এক পর্যায়ে সেটা আর নিতে পারে না। মিটমিট করে তাকায় সে। বোঝার চেষ্টা করে শব্দটা কোথ থেকে আসছে। কিঞ্চিত সময় যেতেই সে বুঝতে পারে শব্দটা তার ফোনের। সে উঠে বসে। ফোনটা খুঁজে বের করে। তাকাতে পারছে না। তাও চোখ কচলিয়ে চেয়ে দেখে রাবীর কল করছে। সে কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে রাবীর বলে,

‘ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’

মেহুল বলে,

‘হু।’

‘আমি দরজার বাইরে। একটু কষ্ট করে এসে দরজাটা খুলতে পারবেন?’

মেহুল ফোনটা চোখের সামনে ধরে সময় দেখে। দেড়টা বাজছে। মেহুল আবার ফোন কানে নিয়ে অবাক হয়ে বলল,

‘আপনি এইসময় এখানে কেন এসেছেন?’

‘আপনি না আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। এখন একটু তাড়াতাড়ি এসে দরজাটা খুলুন। আমি আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।’

‘আচ্ছা দাঁড়ান, আসছি।’

মেহুল কোনোরকমে মুখটা ধুয়ে ওড়ানাটা গায়ে দিয়ে এক দৌড়ে দরজার সামনে যায়। তারপর আস্তে করে দরজাটা খুলে। রাবীরকে দেখে বিস্মিত হয় সে। তার হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ করা। রাবীর আস্তে আস্তে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। মেহুল দরজাটা আটকে দিয়ে রাবীরের পেছন পেছন যায়।

রাবীর ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গিয়ে বসে। মেহুল দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রাবীরের সাদা পাঞ্জাবীর আর এক অংশ সাদা রইল না। কপালে গালে কালো কালো ছাপ। চোখে মুখেও স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,

‘আপনাকে দুশ্চিন্তা দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। তখন এমন একটা পরিস্থিতিতে ছিলাম যে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। দাঁড়িয়ে আছেন কেন, এখানে এসে বসুন।’

‘না, মা’কে বলে আসি।’

‘এই না না, মা’কে এখন আর ডাকার কোনো দরকার নেই। মা বাবা জেগে যাবেন বলেই কলিং বেল না দিয়ে আপনাকে কল দিয়েছি। থাক উনাদের এখন আর জাগিয়ে কষ্ট দিবেন না।’

মেহুল তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রাবীরের দিকে চেয়ে আছে। রাবীর মৃদু হেসে বলে,

‘রেগে আছেন?’

মেহুল সেই প্রশ্নের জবাব দেয় না। জিজ্ঞেস করে,

‘পায়ে আর হাতে কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন?’

‘না, একটু ছিলে গিয়েছে শুধু।’

‘একটু ছিলে গেলে এত বড়ো ব্যান্ডেজ কেউ লাগায় না।’

মেহুলের কথা শুনে রাবীর বুঝতে পারে মেয়েটার অভিমান হয়েছে। তাই সে উঠে দাঁড়িয়ে মেহুলের কাছে যায়। মেহুল ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘উঠছেন কেন? বসে থাকুন।’

রাবীর তার কথায় সাড়া দেয় না। সে মেহুলের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মেহুল নিচের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাবীর কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে তার মুখের দিকে। তারপর হুট করেই জড়িয়ে ধরে তাকে। মেহুল হতভম্ব হয়ে যায়। রাবীর তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছে। রাবীরের এইটুকু স্পর্শেই যেন শরীর জমে গিয়েছে তার। সে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল। রাবীরের শরীরের উষ্ণতা যেন টের পাচ্ছে। সে ঢোক গিলে। রাবীর মৃদু স্বরে বলে,

‘আমার উপর রাগ করে থাকবেন না প্লিজ। আমি বুঝতে পারছি আপনার হয়তো এত দুশ্চিন্তা সহ্য করার অভ্যাস নেই। কিন্তু, এখন থেকে যে অভ্যাস করে নিতে হবে মেহুল। আমাদের জীবনটাই দুশ্চিন্তা দিয়ে ভরা। আর এখন তো আপনিও আমার জীবনেরই অংশ; তাই না চাইতেও এই দুশ্চিন্তার ভার আপনাকেও নিতে হবে। আমি নিরুপায় মেহুল, আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি।’

মেহুল স্তব্ধ। রাবীর হয়তো কোনো উত্তরের অপেক্ষা করছে। তবে মেহুল মুখে কিছু না বলে আলতো করে তাকে জড়িয়ে দেয়। রাবীরের যেন এইটুকুতেই শান্তি পায়। তার এত ক্লান্তি, এত অবসাদের মাঝেও যেন তৃপ্তি খুঁজে পায় সে। মেহুল চোখ বুজে নিশ্বাস ফেলে বলে,

‘আপনাকে বলেছিলাম, ঐ বিল্ডিংটার ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই। তাও আপনি গিয়েছেন। আর এত ব্যথাও পেয়েছেন। তারউপর তখন আমার ফোনও ধরছিলেন না। আরেকটু হলে তো আমাকেই হসপিটালে নিতে হতো।’

রাবীর ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। বলে,

‘ভাগ্যিস, আজ এত কিছু হয়েছিল। নাহলে বুঝতাম কী করে যে মিসেস মেহুল খান যে তার নেতা সাহেবকে এত ভালোবাসে।’

মেহুল এই কথা শুনে রাবীরকে ছেড়ে দাঁড়ায়। মুখ কালো করে বলে,

‘জি না, মোটেও আমি আপনাকে ভালোবাসি না।’

রাবীর ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,

‘আচ্ছা, তাহলে এত দুশ্চিন্তায় অস্থির কেন হয়ে উঠছিলেন শুনি?’

‘ওটা তো কেবল দায়িত্ববোধের খাতিরে। ঐসব ভালোবাসা টালোবাসা কিছুই না।’

রাবীর তখন তার দিকে কিছুটা এগিয়ে আসে। মেহুল পিছিয়ে দরজায় পিঠ ঠেকায়। রাবীর তার মুখ বরাবর মুখ এনে বলে,

‘কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা দায়িত্ববোধ এইটুকু বোঝার বয়স আমার আর আগেই হয়ে গিয়েছে, মিসেস মেহুল খান। তাই আপনাকে আর কষ্ট করে মিথ্যে বলতে হবে না।’

মেহুল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাবীর তার চোখ মুখ ভালোভাবে পরখ করে বলে,

‘চিন্তাই চিন্তাই তো চোখ মুখ বিষন্ন হয়ে গিয়েছে। নিজের একটু ভালোভাবে যত্ন নিবেন। আসছি আমি, দরজাটা এসে আটকে দিয়ে যান।’

‘আপনি চলে যাবেন?’

রাবীর ঘুরে তাকিয়ে বলে,

‘আপনি বললে থেকে যেতে পারি।’

‘না, দরকার নেই। মাও নিশ্চয়ই ঐদিকে টেনশন করছেন। সাবধানে বাড়ি যান।’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে