শেষটা সুন্দর পর্ব-১১+১২

0
653

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১।

মেহুলের বাবার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। তবে উনাকে এখন কেবিনে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, আশংকা মুক্ত। রামিনা বেগম তার স্বামীর পাশেই বসে আছেন। দুশ্চিন্তার ছাপ যেন উনার চোখে মুখে এখনো রয়ে গিয়েছে। উনি দু চোখ মেলে না তাকানো পর্যন্ত উনি যেন শান্তি পাচ্ছেন না।
এতক্ষণ মেহুলও কেবিনেই ছিল। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। তাই সবার জন্য কফি নেওয়ার জন্য ক্যান্টিনের দিকে যায়। নিচ তলায় ক্যান্টিন। একটা প্লেটে তিনটা কফি নিয়ে লিফটের কাছে আসতেই রাবীরকে দেখে সে। রিসিপশনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মেহুল ভাবছে তাকে ডাকবে কী ডাকবে না। সে তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য আসছে কিনা সেটাও সে সিউর না। কারণ রাবীর তো আর এত কিছু জানে না। রাবীর রিসিপশনে কথা বলে সামনে এগুতেই মেহুলকে দেখে। সে ছুটে যায় তার কাছে। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

‘বাবা এখন কেমন আছেন, মেহুল?’

‘আপনি বাবার কথা কী করে জানলেন?’

‘আপনাকে কল দিয়েছিলাম, ধরেননি বলে মা’কে কল দিয়েছি। পরে উনিই সবকিছু বলেছেন। আমাকে একবার জানাতে পারতেন তো। একা একা এতকিছু করেছেন।’

‘আপনি তখন ব্যস্ত ছিলেন, তাই আর কল দিইনি।’

‘স্যরি, আপনার কল দেখেও তখন রিসিভ করতে পারিনি। ইম্পোরটেন্ট একটা মিটিং এ ছিলাম।’

‘সমস্যা নেই, আমি বুঝতে পেরেছি।’

‘বাবা এখন কেমন আছেন।’

‘ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। তবে এখনো জ্ঞান ফেরেনি।’

‘আচ্ছা চলুন, দেখা করে আসি।’

দুজনে একসঙ্গে কেবিনে গেল। রামিনা বেগম রাবীরকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,

‘ভালো আছেন, বাবা?’

‘জি মা, ভালো আছি। বাবার কথা শুনে আমারও ভীষণ খারাপ লেগেছে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না মা, বাবা একদম ঠিক হয়ে যাবেন।’

‘হ্যাঁ, ডাক্তার ও তো বললেন। কিন্তু, উনার তো এখনো জ্ঞান ফিরছে না।’

‘শরীরের উপর অনেক ধকল গিয়েছে তো, তাই হয়তো জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগছে। আপনি চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা বাবা। আপনি এখানে এসে বসুন।’

‘না না, সমস্যা নেই। আপনি বসুন, আমি এখানে ঠিক আছি।’

‘মেহুল, তোর হাতে কী?’

‘কফি এনেছিলাম, মা।’

‘জামাইকে দে তাহলে।’

‘না, আপনারা খান। অনেক পরিশ্রম করেছেন। কফি খেলে শরীরটা একটু হালকা হবে। মেহুল, আপনি মা আর চাচিকে কফি দিয়ে আসুন।’

মেহুল মা আর চাচিকে কফি দিল। আরেক গ্লাস কফি ছিল। সে এটা নিয়ে রাবীরের দিকে বাড়িয়ে দিতেই রাবীর মৃদু হেসে বলল,

‘আমি খাবো না, আপনি খান।’

‘না না, আপনি খান। আমার খেতে ইচ্ছে করলে আমি নিচে থেকে গিয়ে আবার নিয়ে আসব।’

‘মেহুল, আমার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেয়ে নিন।’

মেহুল আর জোর করল না। নিজেই কফিটা খেল।

________

সব শুনে রাবীর বলল,

‘পরে রক্ত কীভাবে জোগাড় করেছেন?’

রামিনা বেগম বললেন,

‘মেহুল একজনকে খুঁজে নিয়ে এসেছিল। ছেলেটা ফেরেশতার মতো এসে আমার স্বামীর প্রাণ বাঁচিয়েছে।’

‘যাক তাহলে, এখনো এমন ভালো মানুষ আছে বলেই না পৃথিবী টিকে আছে।’

মেহুল বলল,

‘হ্যাঁ, উনি আবার উনার কার্ডও দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, আবার রক্ত লাগলে উনাকে যেন জানায়।’

‘না, তার আর প্রয়োজন হবে না। প্রতিমাসে রক্তের ব্যবস্থা আমি করে দিব। আর আপনাদের এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এবার থেকে বাবার রক্তের দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে দিন। আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে রাখব।’

রাবীরের কথা শুনে সবাই খুব খুশি হয়। মেহুলও খুশি হয় খুব। ভরসা পায়। ভেতর থেকে শান্তি অনুভব করে। একবার হলেও মনে হয় তার, এই মানুষটাও কম ভালো না। একটু খানি ভরসা পাওয়ার জন্য এই মানুষটাই তার জন্য যথেষ্ঠ।

________

বাবার জ্ঞান ফিরেছে। তিনি মিটমিট করে চেয়ে সবাইকে দেখছেন। মেহুলের চোখ যেন ভিজে উঠে। ভরা গলায় ডেকে উঠে,

‘বাবা।’

তার বাবা ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে থাকে। জবাব দেয় না। রামিনা বেগমও কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু, তিনি অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়াতে সবার কথার বিপরীতে কিছু বলতে পারছেন না।

________

‘শুনছেন।’

রাবীর মেহুলের দিকে চাইল। বলল,

‘এভাবে ডাকলে কে না শুনবে, বলুন।’

‘আপনি এখন বাড়ি ফিরে যান। বাবা ঠিক আছেন, সকালেই আমরা বাবাকে বাড়ি নিয়ে যাব।’

‘আপনাদের এখানে একা রেখে আমি কী করে যাব। ঐদিকে মাও তো দুশ্চিন্তা করছেন। এখানে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, আমিই আনিনি। নয়তো উনিও এখানে থেকে যেতে চাইতেন।’

‘কিন্তু, এখানে আপনি এভাবে বসে বসে কী করে রাত কাটাবেন? আরেকটা কেবিন নিয়ে ফেললেও তো হয়।’

‘আপনি কি আমার সাথে সেই কেবিনে থাকবেন?’

মেহুল চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘ওটা হসপিটালের কেবিন, আপনার বেডরুম না যে আমি থাকব।’

রাবীর হাসে। বলে,

‘সেজন্যই বলেছি, আমি এখানে ঠিক আছি। আপনিও তো এখানে আমার সাথে আছেন। তাহলে আর চিন্তা কীসের?’

‘আপনি সারারাত না ঘুমিয়ে কালকে সারাদিন কাজ করতে পারবেন? শরীর খারাপ লাগবে না?’

‘এমন কত না ঘুমিয়ে থেকেছি। কিচ্ছু হবে না।’

মেহুল একটু শান্ত হয়ে বসে। রাবীর তার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বলে,

‘আজকাল আমাকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছেন আপনি।’

মেহুল তার দিকে তাকায়। বিরক্তর ভঙ্গিতে বলে,

‘আমাদের খাতিরে কষ্ট করছেন বলে ভাবছি। না হলে কখনোই ভাবতাম না।’

রাবীর মৃদু হাসে। বলে,

‘ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম।’

রাবীরের পি এ তখন আসে। হাতে কিছু ব্যাগ। এসে রাবীরের কাছে গিয়ে বলে,

‘স্যার, খাবার নিয়ে এসেছি।’

‘ভেতরে গিয়ে, সবগুলো পরিবেশন করুন। আমরা আসছি।’

পি এ তার কথা মতো ভেতরে যায়। মেহুল অবাক হয়ে বলে,

‘বাইরে থেকে খাবার আনার কী দরকার ছিল। আমরা ক্যান্টিনেই খেয়ে ফেলতে পারতাম তো।’

‘কিন্তু, আমি চাইনা আপনারা ক্যান্টিনে খান। তাই এনেছি। চলুন, একসাথে খাওয়া যাক তাহলে।’

________

সবাই ঘুমাচ্ছে। মেহুলের বাবা অল্প খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে এখন আবার ঘুমাচ্ছেন। মা সোফার এক কোণে বসে ঘুমাচ্ছেন। বাসায় বাচ্চাগুলো একা বলে চাচি চলে গিয়েছেন। মেহুল ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে কেবিনের ভেতরে লাইট অফ। মা আর বাবা ছাড়া আর কেউ নেই সেখানে। রাবীর কোথায়?

মেহুল কেবিনের দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বাইরে বের হয়। বাইরে গিয়েও দেখে রাবীর নেই। লোকটা কি চলে গেল? না, চলে গেলে অবশ্যই তাকে বলে যেত। মেহুল মুখ কালো করে বসার সিটে গিয়ে বসল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে রাবীরকে লিফট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল হাতে দু’টো কফির গ্লাস নিয়ে।

রাবীর কফি নিয়ে এসে তার পাশে বসে। মেহুলকে একটা কফির গ্লাস দেয়। মেহুল কফির গ্লাস নিয়ে বলে,

‘আপনি মাস্ক পরে আছেন কেন?’

‘আর বলবেন না, ক্যান্টিনে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এই সময় হয়তো মানুষ কম থাকবে। কিন্তু, গিয়ে দেখি অনেক মানুষ। এখন তাদের সামনে গেলেই সবাই আমাকে চিনে ফেলতো। আজকাল মানুষদের দিয়ে তো আর কোনো ভরসা নেই। কী থেকে কী ভিডিও বানিয়ে একটা ক্যাপশন দিয়ে ভাইরাল করতে তো দু মিনিটও লাগে না। তাই মাস্ক পরে সেইফ জোনে ছিলাম।’

মেহুল কফির কাপে চুমুক দিয়ে মজার ছলে বলল,

‘সেলিব্রেটি হলে কত ঝামেলা। তার চেয়ে আমরাই ঠিক আছি। যা খুশি করতে পারি, কাউকে এত পাত্তা দেওয়ার সময় নেই।’

‘আপনিও একদিন এসব ফেইস করবেন। বেশি দেরী নেই। সাংবাদিকরা সব আটঘাট বেঁধে বসে আছেন। কবে আমি আপনাকে নিয়ে মিডিয়ার সামনে যাব। আর কবে উনারা আমাদের বিয়ে নিয়ে নিউজ বানাবেন।’

মেহুল আঁতকে উঠে এই কথা শুনে। বলে,

‘না না, জীবনেও না। আমি ভুলেও এসব মিডিয়ার সামনে যাব না। আমি যেমন আছি তেমনই ভালো। কোনো সেলিব্রেটি হতে চাই না।’

‘এখন না চাইলেও তো কিছু করার নেই। আমার ওয়াইফ হিসেবে তো সবাই’ই আপনাকে দেখতে চাইছেন। এখন না দেখিয়ে আর কোনো উপায় আছে কি?’

মেহুল ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘আশ্চর্য তো! আপনার বউ, আপনি না দেখাতে চাইলে দুনিয়ার কারোর ক্ষমতা আছে, আমাকে এসে দেখার? আপনি সবাইকে সাফ বারণ করে দিবেন। আপনার বউ, আপনি কাউকে দেখাবেন না। পরে যদি সবাই আপনার বউয়ের উপর নজর লাগিয়ে দেয়? তখন কিন্তু আপনার সুন্দর বউ একদম বিচ্ছিরি হয়ে যাবে। তাই ভুলেও এমন করতে যাবেন না।’

রাবীর ঠোঁট চেপে হাসে। কফিটা শেষ করে বলে,

‘সেটা অবশ্য আমিও ভাবছিলাম। সুন্দরী বউ বিয়ে করলেও জ্বালা, সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে রাখতে হয়। ভয় হয়, যদি কেউ আবার আমার জিনিসের উপর নজর দিয়ে ফেলে।’

মেহুল তখন তার দিকে ফিরে চায়। মিহি সুরে বলে,

‘তখন না হয় আপনি সেই নজর একদম উপড়ে ফেলবেন।’

রাবীর চট করে চোখ মুখ শক্ত করে বলে,

‘তা তো অবশ্যই করব। আমার সম্পত্তির উপর কারোর অধিকার তো দূর, নজর পড়লেই সে আর দ্বিতীয়বার তাকানোর সুযোগ পাবে না।’

রাবীরের এমন চোখ মুখ দেখে মেহুল খানিক ভীত হয়। এই লোকটা যে তার ব্যাপারে প্রচন্ড পজেসিভ, সেটা আর তার বুঝতে বাকি থাকে না।

চলবে…

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২।

বাইরে মানুষের হৈ চৈ এ মেহুলের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে তাকিয়ে সে তার বর্তমান অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করল। চট করেই তখন তার মস্তিষ্ক বলল, ” আরে মেহুল, তুই তো রাবীরের কাঁধেই মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিস। আর কত ঘুমাবি, এবার উঠ।”

মেহুল তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে। রাবীর হালকা গলা ঝেড়ে বলে,

‘ঘুম হয়েছে?’

মেহুল বিব্রত বোধ করে। অস্বস্তি নিয়ে বলে,

‘আমি কি সারারাত এভাবেই ঘুমিয়েছি?’

‘জি।’

মেহুল আরো বেশি লজ্জা পায়। আশেপাশে কত মানুষ। সবাই নিশ্চয়ই তাদের দেখেছে। সে এবার আড়চোখে রাবীরের দিকে তাকায়। লোকটা এখনো মাস্ক পরে আছে। যাক তাহলে, কেউ অন্তত রাবীরকে আর চিনতে পারেনি। রাবীর বলল,

‘যান, ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।’

________

ডাক্তার সব চেকআপ করে বললেন,

‘উনাকে এখন নিয়ে যেতে পারেন। আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ আছেন। তবে খুব যত্নের মাঝে রাখবেন। খাবার আর ঔষধটা ঠিক টাইমে দিবেন।’

‘ঠিক আছে, ডাক্তার।’

রামিনা বেগম মেহুলের দিকে চেয়ে কিছু একটা ইশারা দিলেন। মেহুল চোখের ইশারায় বুঝাল, সে সবকিছু সামলে নিবে।

রাবীর মেহুলের বাবাকে নিয়ে গাড়িতে বসাল। রামিনা বেগমও গাড়িতে বসলেন। মেহুল আসেনি তখনও। রাবীর মেহুলকে খুঁজতে ভেতরে যায়। মেহুলকে সে দেখতে পায় রিসিপশনের সামনে। রাবীরও সেখানে যায়। রাবীরকে দেখে মেহুল জিজ্ঞেস করে,

‘আপনি সব টাকা দিয়ে দিয়েছেন কেন? আমরাই তো দিতাম।’

‘হ্যাঁ, দিতেন। তবে উনি তো আমারও বাবা। আর বাবার জন্য এইটুকু করা ছেলের দায়িত্ব। বুঝতে পেরেছেন?’

মেহুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘জি।’

________

মেহুল ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রাবীর শুয়ে আছে। মেহুল ভেবেছে, রাবীর হয়তো ঘুমে। সে আস্তে আস্তে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে। ড্রেসিং টেবিলটা বিছানার পাশেই। কিছুক্ষণ বাদেই রাবীর উঠে বসে। বলে,

‘আমি তো এমনিতেই গোসল করতাম। অযথা আপনার চুলের পানি দিয়ে গোসল করানোর কী দরকার, মেহুল?’

মেহুল চমকে পেছনে চেয়ে দেখে রাবীরের চোখ মুখ ভিজে আছে। সে এই মুহুর্তে হাসবে না অনুতপ্ত হবে বুঝতে পারছে না। তাও ঠোঁট চেপে হাসে সে। মৃদু সুরে বলে,

‘ভালো হয়েছে না, আপনাকে আর এখন কষ্ট করে গোসল করতে হবে না।’

রাবীর উঠে দাঁড়ায়। মেহুলের পেছনে এসে কাছাকাছি দাঁড়ায় সে। মেহুল ঢোক গিলে। আয়নার মধ্যে রাবীরের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে আছে। রাবীরের অমন দৃষ্টি দেখে মেহুলের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। কিছু বলতেও পারছে না। রাবীর মেহুলের কানের কাছে মুখ নেয়। ফিসফিসিয়ে বলে,

‘গোসলের পর আপনাকে এত মোহনীয় কেন লাগে বলুন তো?’

মেহুল বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ। মস্তিষ্কের নিউরন সব জমে গিয়েছে। রাবীরের দিকেও চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সে। হৃদকম্পন যেন বাড়ছে। রাবীর একটু সরে আসে। কিছুক্ষণ মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,

‘কী হলো, এমন স্তব্ধ হয়ে গেলেন কেন?’

মেহুল পেছন ফিরে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘আপনার কি আজকে আর কোনো কাজ নেই? এখনো এখানে বসে আছেন কেন? তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে, খেয়ে দেয়ে আপনার কাজে যান। অযথা আমাকে বিরক্ত করবেন না।’

রাবীর হাসে। বলে,

‘এই সামন্য কথাতেই কেউ এত লজ্জা পায়? এসব মিথ্যে রাগ দেখালে লজ্জা কমে না, মেহুল। লজ্জা ঢাকতে মুখ লুকাতে হয়। আর আপনার এই লজ্জামাখা মুখ লুকানোর জন্য আমার বক্ষ সর্বদা প্রশস্ত।’

মেহুল চোখ মুখ খিঁচে বলে,

‘আপনি কিন্তু আজকাল খুব বেশি কথা বলছেন। আমার কিন্তু এবার রাগ হচ্ছে বলে রাখলাম। আর আমি এখন রাগলে কিন্তু আপনার সাথে একদম কথা বলা বন্ধ করে দিব।’

রাবীর তার কথার বিপরীতে কেবল মৃদু হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়। রাবীর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেহুল বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে। আর মনে মনে বলে, “লোকটা কী মারাত্মক!”

________

রাবীর চলে গিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। মেহুল রুমে এসে বিছানায় বসতেই তার টেবিলের দিকে চোখ যায়। হলুদ রঙের কাগজটা চোখে পড়ে তার। মনে পড়ে কাগজটার কথা। ইশ, এটাতো রাবীরকে দেখানোই হলো না। তার একটা বিশাল সুযোগ হাতছাড়া হলো। এই কাগজটা দেখিয়ে সে রাবীরের অনেক মজা নিতে পারতো। ধুর, তখন একবারও কেন যে মনে পড়ল না।

সন্ধ্যা সাতটা,

রাবীরের অফিসে বেশ কয়জন সাংবাদিক এসেছেন। তারা ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করছেন। রাবীর তখনও অফিসে আসেনি। তার অফিসে আসতে আসতে আরো পনেরো মিনিট সময় লাগে। অফিসে এসেই সাংবাদিকদের দেখে ভ্রু কুঁচকে রাবীর পি এ’র দিকে চায়। পি এ নিচু স্বরে বলে,

‘স্যার, উনারা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান।’

‘এখন আবার কী ব্যাপারে কথা বলতে চান।’

‘জানি না, স্যার।’

‘ঠিক আছে। উনাদের ভেতরে পাঠিয়ে দিন।’

রাবীর তার কেবিনে বসার পর পরই একে একে সব সাংবাদিক তার কেবিনে প্রবেশ করেন। তারপর একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন,

‘জনাব রাবীর খান, অনেক তো হলো রাজনৈতিক প্রশ্ন; আজ আমরা আপনাকে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই।’

রাবীর বলল,

‘যদি তাই হয়, তবে আমি বলব, আমি এই ব্যাপারে একদমই আগ্রহী না। আমি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে মিডিয়ার সামনে কোনো কথা বলতে চাই না।’

সাংবাদিক হেসে বললেন,

‘কিন্তু, রাবীর সাহেব, আপনাকে যে আজকে কথা বলতেই হবে। এটা আমাদের দাবি না, এটা আমাদের দর্শকদের দাবি। বিশেষ করে আমাদের মেয়ে দর্শকদের। আপনার বিয়ের খবর শোনার পর থেকে তো চারদিকে একটা হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। মেয়েরা তো সব অস্থির হয়ে উঠেছে। এই ব্যাপারে আপনি কী বলতে চান?’

রাবীর নিশ্বাস নিল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘দেখুন, আমার বিয়ে নিয়ে আমি যথেষ্ঠ খুশী। আর দর্শকরা বা আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও নিশ্চয়ই এতে খুব খুশী হয়েছেন। বিয়ে পবিত্র জিনিস, এখানে কারোর কষ্ট পাওয়ার মতো তো কিছু হয়নি।’

‘কিন্তু, ঐ যে আপনার কিছু মেয়ে ক্রাশরা আছেন যারা আবার এই ব্যাপারে খুব দুঃখ প্রকাশ করছেন। সঙ্গে আবার তারা আপনার ওয়াইফকে দেখার জন্যও খুব উতলা হয়ে উঠেছেন। তা, আমরা কবে সেই কাঙ্খিত ব্যক্তির দেখা পাবো, মি. খান।’

‘সময় এলে সব কিছুই হবে। তাই আগে থেকেই কিছু বলা যাচ্ছে না।’

সাংবাদিক তখন বললেন,

‘তাহলে কি আমরা ধরে নিব, এত সহজেই মিসেস খানের দেখা কেউ পাবে না?’

‘বললাম তো, সময় এলেই সবকিছু হবে। এখন সেই নির্দিষ্ট সময়টা ঠিক কখন, সেটা আমিও জানি না।’

সাংবাদিকরা আর প্রশ্ন না করে নিজেদের মতো করে একটা রিপোর্ট বানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন।
তারা চলে যেতেই রাবীর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। আসলেই, একটু পরিচিত মুখ হলেই যত জ্বালা। তার চেয়ে সাধারণ মানুষই ভালো, কাউকে আর এত জবাবদিহি করতে হয় না।

________

‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার। স্যার, আমাদের রাবীর খানের সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু, উনি উনার ওয়াইফ সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেননি। আমার যতটুকু মনে হচ্ছে, এখনই হয়তো উনি উনার ওয়াইফকে নিয়ে মিডিয়ার সামনে আসবেন না।’

সাদরাজ হাসে। বলে,

‘বউ সুন্দরী হলে ছেলেদের এই দশা’ই হয়। সুন্দরী বউ তো, তাই ভয় পায় আরকি। যদি মিডিয়ার সামনে আনার পর, কেউ আবার তার বউয়ের উপর নজর দিয়ে ফেলে! কিন্তু, বেচারা রাবীর খান তো আর জানে না; শকুনের নজর যে তার পাখির উপর অলরেডি পড়ে গিয়েছে। এখন এই শকুনের কাছ থেকে সে তার পাখিকে কী করে বাঁচাবে, হু?’

কথাটা বলেই বেশ শব্দ করে হাসতে আরম্ভ করে সাদরাজ। মনে মনে এই সবকিছুর পরিকল্পনা করে যেন এক পৈশাচিক আনন্দ পায় সে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে