শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-০৬

0
1870

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৬

শুক্রবার মানেই ব্যস্ততম দিন। সবাই বাড়িতে থাকে আর অনেকটা সময় অব্দি ঘুমায়। সকালে নাস্তা খেতেও দেরি করে। তাই রান্না বান্নার দেরি হয়ে যায়। আর এই দিনে ইভানের মা একটু আয়োজন করে সবার পছন্দের রান্না করতে খুব ভালবাসেন। এক সাথে খেতেও। রান্নার হাতটা তার বরাবর খুব ভাল। এই কাজটা তিনি খুব ভালবাসেন বিধায় যত্ন সহকারে করেন। প্রতি বৃহস্পতি বার সন্ধ্যা থেকে ইউটিউব ঘেঁটে নতুন নতুন রেসিপি শিখে ফেলেন। আর শুক্রবার সেগুলো রান্না করেন। আজও তার ব্যতিক্রম না। তিনি বহু মনোযোগ দিয়ে আজ ভাপে ইলিশ রান্না করছেন। সকাল থেকে প্রস্তুতি চলছে তার। একজন সাহায্যকারী আছে তবুও তাকে একাই এসব কাজ করতে হয়। কারন তার কোন মেয়ে নেই। দুই ছেলে। ছেলেদের বিয়ে হলে তারপর বউ আসলে নাহয় এসবের দায়িত্ত নিবে। কিন্তু ততদিন তো তাকেই সামলাতে হবে। ইভান রান্না ঘরের দরজায় দাড়িয়ে কিছুক্ষন বুঝতে চেষ্টা করল কি চলছে। বুঝতে না পেরে অবশেষে জিজ্ঞেস করলো তার মাকে।
–কি রান্না হচ্ছে?

ইভানের মা এক গাল হেসে বললেন
–ভাপে ইলিশ। নতুন শিখেছি কাল।

ইভান ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলেই আবার বলল
–ইফতি এখনও ঘুম থেকে উঠেনি? আজ তো শুক্রবার। নামাজে যাবেনা?

ইভানের মা হতাশ হয়ে বলল
–এই ছেলেটাকে নিয়ে আমি আর পারিনা। অতিস্ট হয়ে যাচ্ছি। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় জানিস। এই ছেলেটাকে আমি জন্ম দিয়েছিলাম নাকি হসপিটালে আমি যখন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম তখন তোর বাবা বাচ্চা পালটে এনেছিল।

ইভান হেসে ফেলল মায়ের কথা শুনে। ইভানের মা হতাশ শ্বাস ছাড়ল। এর মাঝেই ইফতি এসে ইভানের পিঠে নিজের মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করেই ঘুম জড়ান কণ্ঠে বলল
–মা এক কাপ স্ট্রং কফি দাওনা। ঘুমটাকে তাড়াই। কিছুতেই যাচ্ছে না জানো।

ইভান হালকা ঘুরে একটু জোরেই কান টেনে দিলো। ইফতি ‘আহ’ শব্দে কান চেপে ধরে বলল
–ঘুম থেকে উঠেই এভাবে কেন অত্যাচার করছ ভাইয়া। মায়া হয়না তোমার। অসহায় বাচ্চাটার উপর এভাবে অত্যাচার কর।

ইভান একটু ধমক দিয়ে বলল
–রাতে সেই কখন ঘুমিয়েছিস। এখনও তোর ঘুম ভাঙ্গেনা কেন? আজ শুক্রবার সেটা কি ভুলে গেছিস? নামাজে যেতে হবে না।

ইফতি পাশে চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলল
–হবে না আবার কেন? যেতে হবে যাব। এখনও তো আজান দেয়নি। দিক আগে।

ইভান একটু বিরক্ত হয়ে বলল
–তোমার ছেলে মানুষ হবে না মা।

বলেই সোফায় গিয়ে বসলো। পেপারটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ইভানের মার সাহায্যকারী কলি নামের মেয়েটা এসে ইভানের সামনের টেবিলে চায়ের কাপ রাখল। সাথে কয়েকটা বিস্কিট। পেপারে মুখ ডুবিয়েই ইভান চায়ে একবার চুমুক দিয়ে আবার কাপটা সামনে রেখে দিলো।
–বড় মা।

পেপার থেকে মুখটা তুলে ইভান দরজার দিকে তাকাল। হালকা রঙের একটা কামিজ পরেছে ঈশা। ওড়নাটা মাথায় অরধেক টেনে দেয়া। সামনের ছোট চুলগুলো বের হয়ে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে। ঈশা দরজায় দাড়িয়েই আছে। ইফতি ভ্রু কুচকে বলল
–কারো অনুমতির অপেক্ষা করছ ঈশা আপু?

ঈশা ভিতরে ঢুকে হাতের বাটিটা ইফতির সামনে রেখে বলল
–অনুমতির অপেক্ষা করছিলাম না। অনুমতি ছাড়াই আমি এই বাড়িতে আসতে পারি যখন তখন। আর আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।

ইফতি দাত বের করে বলল
–ওহ! তাহলে ওখানে দাড়িয়ে দেখছিলে বুঝি? তো কাকে দেখছিলে? তোমার ওখান থেকে তো…।

থেমে আবার বলল
–বুঝেছি। ভাইয়াকে দেখছিলে।

ঈশা থতমত খেয়ে দাড়িয়ে থাকল। ইভান পেপারে মুখ ডুবিয়েই হাসল। ইভানের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে বাটিটা দেখে বলল
–এটাতে কি রে?

–মিষ্টি বড় মা। আমি বানিয়েছি। তাই নিয়ে আসলাম।

ইভানের মা হেসে ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–তুই বস আমি রান্না শেষ করে আসি।

ঈশা মাথা দুলিয়ে ইফতির সামনে থেকে একটা বিস্কিট নিয়ে মুখে দিলো। ইভানের মা রান্না ঘরে গেলো। ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। সে পেপার নিয়েই ব্যস্ত। ধির পায়ে সেদিকে গিয়ে তার পাশে বসে পড়ল। ইভান পেপারের দিকে তাকিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সেটা আবার সামনে রেখে দিলো। ঈশা আড় চোখে একবার ইভানের দিকে তাকাল। তারপর হুট করেই চায়ের কাপটা তুলে নিলো। তখনি রান্না ঘর থেকে ইভানের মায়ের আওয়াজ আসলো।
–ঈশা চা খাবি?

ঈশা চায়ের কাপটা মুখের কাছে ধরেই বলল
–না বড় মা। খেয়েছি একবার।

ইভান আড় চোখে ঈশার দিকেই তাকিয়ে আছে। বুঝতে চেষ্টা করছে তার মাথায় কি চলছে। ঈশা চায়ে পরপর দুই বার চুমুক দিয়ে কাপটা সামনে রেখে গলা তুলে অভিমানী কণ্ঠে বলল
–আমি বাসায় যাচ্ছি বড় মা। কাজ আছে। পরে আসব।

উঠে কিছুদুর যেতেই ইভানের মৃদু কণ্ঠ কানে এলো।
–মিষ্টিটা যে এতো কড়া হবে ধারনা ছিলনা। ধন্যবাদ ম্যাডাম। মিষ্টি মুখ করানোর জন্য।

–কিন্তু আমি তো চায়ে চিনি দিতেই ভুলে গেছি। তাহলে কড়া মিষ্টি হল কিভাবে?

ইভান ঈশা দুজনেই ঘুরে তাকাল। তার মা চিনির বয়াম হাতে দাড়িয়ে আছে। ইভান পেপারটা রেখে উঠে যেতে যেতে বলল
–মিষ্টি তো ঈশার কাছে সেটা তাকেই জিজ্ঞেস কর।

কথা শেষ করে ইভান ঘরে চলে গেলো। ইভানের মা ঈশার দিকে তাকালেন। ঈশা আমতা আমতা করে মিষ্টির বাটির দিকে ইশারা করে বলল
–ঐ যে মিষ্টি। ওটাই অনেক কড়া। চিনি বেশী দিয়ে ফেলেছি মনে হয়।

ইভানের মা একটু হেসে রান্না ঘরে চলে গেলো। ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলে ইভানের ঘরের দিকে একবার তাকাল। ইভান দরজায় হেলানি দিয়ে হাত গুজে মুখে হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা কঠিন চোখে তাকিয়ে ঘুরে বের হতে যাবে তখনি ইফতি বলল
–কিন্তু ভাইয়া তো মিষ্টিই খেলনা। তাহলে বুঝল কিভাবে কড়া না হালকা?

ঈশা পিছনে ঘুরে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। এগিয়ে এসে ইফতির সামনে মাথা ঝুকে গাল টেনে বলল
–তোকে কি ইনভেস্টিগেশনের জন্য মেডেল দেয়া হবে?

ইফতি না সুচক মাথা নাড়ল। ঈশা দাতে দাত চেপে বলল
–তাহলে নিজের কাজে মনোযোগ দে। আশে পাশে এতো মনোযোগী হওয়ার দরকার নেই তো। নাহলে আমি তোর প্রতি মনোযোগী হয়ে গেলে কিন্তু দুঃখ আছে কপালে।

ইফতি কি বুঝল কে জানে। কিন্তু ভয় পেয়ে শুকন ঢোক গিলে ফেলল। ঈশা চোখ তুলে আবারো ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো।

—————
শেষ বিকেলে চায়ের সাথে মুড়ি মাখার সংমিশ্রণটা বেশ। ইরিনাদের বাড়ির ছাদে ঈশা আর ইরিনা ছোট একটা বাটিতে মুড়ি আর হাতে চায়ের কাপ নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছে। ইরিনাদের বাড়িটা একদম মাঝে। বাম পাশে ইভানদের বাড়ি আর ডান পাশে ইলুদের বাড়ি। ইরিনা একাই। তার কোন ভাই বোন নেই। ঈশার ছোট চাচার মেয়ে সে। সেজো চাচার দুই ছেলে মেয়ে হচ্ছে ঈশান আর ইলু। ইরিনা হতাশ হয়ে বলল
–কতদিন বিয়ে খাইনা। আমাদের বাড়িতে কেউ বিয়ে করেনা কেন? সেদিন একটা বিয়ে হইল তাও আবার খাওয়ার মতো না। কি যে হইল বুঝতেই পারলাম না।

ঈশা সামনে তাকিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
–আসলেই। আমার মনে হয় সেজো মা সেজো বাবাকে বুঝিয়ে বললে তারা ঠিক রাজি হত। ইলু আপুর এভাবে বিয়ে করার প্রয়োজন ছিলনা। সায়ান ভাইয়া খুব ভাল একজন মানুষ। আর ইভান ভাইয়ার খুব ভাল বন্ধু হিসেবে বাসায় মোটামুটি সবাই জানে তার সম্পর্কে। কারো আপত্তি থাকার কথা না।

–ইভান ভাইয়ার বুদ্ধি ছিল সবটা। যদিও বা আমার ভাল লাগেনি কিন্তু ইভান ভাইয়া কিছু তো একটা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে যে কোন ভুল করতে পারেনা সেটা সবাই জানে ঈশা। কিছু তো ভেবেছে সে। আর সব কথাও যে সে সবাইকে বলবে তাও তো না। আমরা তো জানি ইভান ভাইয়া সবার কাছে তার মনের সব কথা প্রকাশ করতে পছন্দ করেনা। কেউ বুঝলে তবেই সেটা জানতে পারে।

ইরিনার কথা গুলো চুপচাপ শুনলেও ঈশার দৃষ্টি ইভানদের ছাদে স্থির। হালকা গোলাপি রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে ইভান। ওটা পরেই হয়ত নামাজ পড়তে গিয়েছিলো। এখনও খুলেনি। ছাদে রেলিঙ্গে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। বেশ হাসি খুশি। ঈশা একটু হেসে ইভানের দিকে তাকিয়েই ইরিনাকে বলল
–তুমি ঠিক বলেছ আপু। মানুষটা একদম অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। জাকে বলে এক কথায় পারফেক্ট!

ইরিনা কিছু না বুঝেই মাথা নাড়াল। ঈশা একটু এগিয়ে গেলো ছাদের কিনারে। এপাশ থেকে গলা তুলে বলল
–ইভান ভাইয়া।

হঠাৎ এমন ডাকে ইভান চমকে পাশ ফিরে তাকাল। ঈশাকে হাসি মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ফোনটা কানে ধরেই তার দিকে তাকিয়ে বলল
–পরে কথা বলছি।

ফোনটা রেখে ঈশার দিকে ভ্রু নাচিয়ে বলল
–কি চাই?

ঈশা মুচকি হেসে হাতের চায়ের কাপটা দেখিয়ে বলল
–চা খাবে?

ইভান ভ্রু কুচকে নিলো। কিছুক্ষন পর সাভাবিক ভাবেই বলল
–খেয়েছি। এখন খাবনা।

–আমি বানাই? তবুও খাবেনা?

ইভান এবার এগিয়ে আসলো। রেলিঙ্গে দুই হাত রেখে বলল
–আমার জন্য এতো কষ্ট আপনাকে করতে হবে না ম্যাডাম। আমার ইচ্ছা করলে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসব। এমনিতেও আমি এখন বাইরেই যাব।

–তা তো যাবেই। আমি কি তোমাকে আটকে রাখব নাকি? শুধু এক কাপ চা খাওয়াতে চেয়েছি। খুব বেশী কিছু না তো।

ইভান বেশ অবাক হল তার কথা শুনে। ঈশা পিছনে ঘুরে ইরিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–ইরিনা আপু আমি নিচে যাচ্ছি চা বানাতে। তুমি কি আরও এক কাপ খাবে?

–কিন্তু ইভান ভাইয়া তো খাবেনা। আর আমরা তো চা খেলাম। এখন থাক বানাতে হবে না। তুই বস। একটু পরেই সন্ধ্যা হবে। তখন নিচে গিয়ে আবার খাবো।

ঈশা প্রশস্ত হাসি হেসে মৃদু সরে বলল
–খাবে।

ইরিনা বধ হয় কোন রকমে শুনতে পেল। কিন্তু ঐ ছাদে ইভানের কান পর্যন্ত গেলই না। ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকিয়ে নিচে চলে গেলো। ঈশার এমন আচরনে ইভান বেশ অবাক হল।

বেশ কিছুক্ষন পর ঈশা চা বানিয়ে এনে দেখল ইভান ইরিনার সাথে বসে গল্প করছে। খুব সাভাবিক ভাবেই এগিয়ে গিয়ে একটা কাপ তুলে ইভানের দিকে এগিয়ে দিলো। যেন সে জানত ইভান আসবে। ইভান শান্ত দৃষ্টিতে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে কাপটা হাতে নিলো। ইরিনার ফোন বেজে উঠল। সে ফোন ধরতে চলে গেলো। ইভান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
–কিছু বলবি?

ঈশা একটু ভেবে বলল
–কেন তোমার মনে হল আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই?

ইভান সোজা হয়ে বসলো। ঈশার দিকে তাকাল গভির ভাবে। বেশ কিছুক্ষন পর শান্ত সরে বলল
–আমি হয়ত তোকে খুব ভাল মতো চিনি। তুই যে শুধু চা খেতে আমাকে ডাকিস নি সেটাও জানি। যা বলতে চাস বলতে পারিস। একদম নিশ্চিন্তে।

ঈশা করুন দৃষ্টিতে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান ঈশার দৃষ্টির মানে বুঝতে পারল না। কিন্তু এটা খুব ভালভাবে বুঝতে পারছে কিছু একটা বলতে চায়। ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশা ওভাবে তাকিয়েই বলল
–যদি কখনও চরম সত্যের মুখোমুখি হতে হয় তখন কি করবে?

ইভানের কপালের ভাজ সোজা হয়ে গেলো। অবাক চোখে তাকাল। মৃদু সরে বলল
–কেমন সত্য?

চলবে……।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে