শঙ্খ চিলের জুটি পর্ব-০৪

0
964

#শঙ্খ_চিলের_জুটি 🦅🦅
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০৪

চোখের কোণ ঘেঁষে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ফ্রেমের উপর।চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে নিল ছবিটার উপর আদ্রিক আহম্মেদ।।আজ বন্ধুর কথা খুব মনে পড়ছে।। আনুমানিক পঁচিশ বছর আগে দুজন বন্ধুর,,, বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ হয়েছে।।তাও আবার অজানা একটা ছোট কারণে।। পঁচিশ বছর আগে আদ্রিক আহম্মেদ নিজের প্রান প্রিয় বন্ধুকে ফেলে বিদেশে গমন করেছেন।।সেখানে স্যাটেল হওয়ার পর বন্ধুর অনেক খোঁজ খবর করেছেন ,, কিন্তু খবর মেলে নি।। যখন বিদেশে পাড়ি জমান তখন তিনি বিয়ে করেন নি।।সেখানেই বন্ধুকে ছাড়া পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।।যখন বন্ধুকে বিয়ের খবর জানায় ,, তখন সে আনন্দিত হওয়ার বদলে আদ্রিক আহম্মেদের সাথে বন্ধুত্বের ইতি টানেন।।হয়তো বন্ধুর প্রতি চাঁপা অভিমান ,, আর অভিযোগ কাজ করছিলো।। ৫ বছর আগে বন্ধুর অভিমান ভাঙাতে পরিবার সহ দেশে ফিরেছেন।।আদ্রিক আহম্মেদের ভাবনার মাঝে রুমে ঢুকলেন তাহমিনা ।।হাত থেকে ফটো ফ্রেমটা নিয়ে যত্নসহকারে কাবার্ডে রেখে দিল।।আদ্রিক আহম্মেদের পাশে বসে পড়লো।। তাহমিনা কিছু বলার আগে মুখ খুললেন তিনি….

— “পাঁচ বছর ধরে ইমতিয়াজ কে খোঁজার চেষ্টা করছি ।।সব চেষ্টা বার বার বৃথা যাচ্ছে।। আমি কি আমার বন্ধুর দেখা কখনো পাবো না।। পারবো না ,, তার রাগ ভাঙাতে”??

— ”আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন তুমি তোমার প্রানের বন্ধুর দেখা ঠিক পাবে।। দেখো,,আল্লাহ তোমাকে আশাহত করবেন না”।।

— “তাই যেন হয় তা”হু!!(আশাহত গলায় আদ্রিক আহম্মেদ)

______________________

চৈত্র মাসের প্রথম লগ্ন।।কাঠ ফাটা রূর্যকিরণে এক মুহুর্ত শান্তিতে দম নেওয়া অসম্ভব ব্যাপার ।।গ্ৰামে দিনের বেলা বৃক্ষের নিচে বসে যে উচ্ছাস পাওয়া যায়।।তা শহরাঞ্চলে সম্ভব নয়।।হবে কিভাবে শহরে কোনো গাছের চিহ্ন নেই বিধায় ঠান্ডা সমীরন অনুভব করা সম্ভব নয়।। তাই তো মানুষ আজকাল যন্ত নির্ভর হয়ে উঠেছে।। কৃত্রিম যান্ত্রিক দিয়ে হিম আবরন তৈরি করছে।।মাঝে মাঝে বর্ষন হয়ে রাস্তাঘাট পিচ্ছিল করে তোলে ঠিকই কিন্তু গরমের আস্তরণ কমে না।।সেদিনের বর্ষনেও তার ব্যতিক্রম হলো না।।রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে নাজেহাল অবস্থা।।গাড়ি অতিক্রম করার সময় ,, চাকার নিচে পিসে যাওয়া পানিগুলো দুপাশে ছিটে ওঠে।। কখনো পথচারীর শরীরে ছিটে জামাকাপড় নষ্ট করে দিচ্ছে।। কখনো বা তার ব্যাতিক্রম হচ্ছে।। তবে রাস্তা ভালো না থাকায় খুব প্রয়োজন ছাড়া এই রাস্তায় গাড়ি চলাচল করে না।।মাঝে মাঝে দুই একটা দেখা যায়।। শুধুমাত্র মানুষের চলাফেরা জন্য ব্যবহার করা হয়।।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে গভীর আড্ডায় মেতেছে রৌধিক।। একটু পরপর ঠাস ঠাস চাপড় পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ‌।।ব্যস্ত মনে স্কুলে যাওয়ার জন্য ছুটছে স্কুল ছাত্রীরা।।পূর্ণরায় পানি ছিটকে তাদের শরীরে আসার উপক্রম হলে ,, হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে নিল ।।রৌধিক মুখে পানি নিয়ে আর গিলতে পারছে না ।।যখন ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে নিলো তখন কাঁদা পানির বদলে একজন সাদা ড্রেস পরিহিত মেয়েকে নজরে এলো।।সে আর কেউ না ইফা।।ইফা হাতের ওরনা দিয়ে বাচ্চাদের আড়াল করে রেখেছে।।যার ফলশ্রুতিতে,, বাচ্চাদের বদলে ইফার ওরনাটা কাঁদায় মাখো মাখো অবস্থা।। তবে হালকা কাঁদা বাচ্চার জুতোর উপরে পড়েছে।। বাচ্চাদের হাত ধরে রাস্তা পার করে দিল।।দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের গাড়ির কাছে এগিয়ে গেল।। কিন্তু পানির বোতল ফাঁকা।। আশেপাশে কিছুক্ষণ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল।।চোখ আটকে গেল রৌধিকের হাতে।।রৌধিক‌ বোতল নিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতেছে।। অপেক্ষা না করে রৌধিকের হাত থেকে পানির বোতল টা নিয়ে বাচ্চাদের জুতোয় ঢেলে দিল।। একটু ঝুঁকে টিস্যু পেপার দিয়ে জুতো গুলো পরিষ্কার করে দিলো।। আলতোভাবে এক এক করে দুজনের ললাটে অধর ছুয়ে দিল।। বিদায় দিয়ে ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালে হঠাৎ করেই মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হলো।।চটজলদি গাড়ির কাছে এসে ছাতা বের করে বাচ্চাদের কাছে ফিরে আসার আগেই বাচ্চাগুলো ভিজে কাক ভেজা হয়ে গেছে।।ইফা পূর্ণরায় ছাতাটা গাড়িতে রেখে ,, চেঁচিয়ে বললো…
— “তাড়াতাড়ি নাম ,, বৃষ্টিতে ভিজবো”!!!

সাথে সাথে সারা ,, রুহি আর সানফি নামলো।। জমাট বাঁধা পানির কাছে গিয়ে,, ছয় জন একসাথে দুমদাম শব্দ আস্ফালন করতে লাগলো।।

সেদিন রৌধিক প্রথমবারের মতো কোনো মেয়ের মায়াজালের মাঝে নিজেকে হারিয়েছে।। পুরোটা সময় সে ইফার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।। প্রতিদিন এসে সেখান বসে থাকতো ।। কিন্তু ইফার দেখা মিলতো না।। সেদিন যখন ইফার গাড়িটা এপার্টমেন্টের ভেতরে দেখছিলো ।।তখন প্রবল জোঁকে গাড়ির দুটো কাঁচ ভেঙ্গে ফেলেছিলো।।

________________

শরীরে পানি পড়তেই লাফ দিয়ে উঠে বসলো রৌধিক।। হঠাৎ তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটায় কি হচ্ছে বোধগম্য হতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগলো।।তার সামনে হাতে ব্রাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে‌ আদ্রিতা।ভাইকে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আঁটে ।।এখন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দুহাত বুকে গুজে দাড়িয়ে আছে।রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আদ্রিতার দিকে তাকালে,,ভয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।।জোরে জোরে চেচিয়ে বলে গেল,, ” মা তোমার ছেলেকে থামাও,, আমাকে মেরে ফেললো”” আদ্রিতা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো রৌধিক।। খুব আফসোস হচ্ছে একটু আগে কতো সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলো ,,সেটা তার বোন নষ্ট করে দিল।।

_______________
মাঝখানে কেটে গেছে পাঁচ দিন।।আগের তুলনায় এখন মোটামুটি সুস্থ ইফা।। আস্তে আস্তে হাঁটতে পারে‌।এতো গুলো দিন বাড়ির সবার যত্নে কোনো অংশে কমতি ছিল না।। বর্তমানে আহিরের ফ্লাটের উদ্দেশ্য বেরিয়েছে সে ।। প্রথমে আসতে রাজি হয়নি ইফা।। কিন্তু আহিরের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়েছে।।আজকেই শেষ দিন আহিরের সাথে দেখা করার।।
হঠাৎ শরীরটা কেমন ডেটোরিয়েট করছে।।মনে হচ্ছে আজকে না আসলেই ভালো হত।।নাকি ভয়ংকর কিছু লুকিং আছে সেখানে।।ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।। মাঝপথে ত্রিশ সেকেন্ডের রেড সিগন্যাল পড়লো।। বোতলে সাত দিন পূর্বের পানি ।।রোদের তাপে একদম গরম হয়ে আছে।। সিগন্যাল পড়াতে একদিকে ভালো হলো ইফার।। গাড়ির দরজা খুলে আস্তে আস্তে নেমে দাঁড়ালো সে।।রোড ক্রোশ করে পানির বোতল কিনে ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালো।।

–” দেখো তো মা একে কোথাও দেখেছো কিনা” ??(ছবিটা এগিয়ে দিয়ে)

কারো আকুল কন্ঠে ফিরে তাকালো ইফা।।তার কন্ঠে মিশে আছে অদ্ভুত আকুল আকাঙ্ক্ষা।।এদিকে সিগন্যাল প্রায় শেষের দিকে।। ইফা দ্রুত তালে একবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে নত সুরে বললো ..

— “সরি আঙ্কেল আমি তাকে কখনো দেখিনি”!!!

আর অপেক্ষা করলো না হনহন করে গাড়ি ভেতরে ঢুকে পড়লো।।ছিপ টা খুলে এক ঢোকে বোতলের অর্ধেকটা শেষ করে নিল।।চোখ বন্ধ করে নিজের ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছে।।তখনই কানের কাছে বেজে উঠলো একটু আগের কন্ঠ,,

— “আমি আদ্রিক আহম্মেদ।।আর আমার পাশে ইমতিয়াজ আমহৃদ।।যদি কখনো তার দেখা পাও ,, অনুগ্রহ করে আমার এড্রেস টা তাকে দিয়ে দিও।। ড্রেস….

— “সেই কখন সিগন্যাল পড়ে গেছে ,, এখনো গাড়িটা সরাচ্ছেন না কেন??দেখুন পেছনে ভিড় জমে গেছে।।(পেছনে থেকে)

চোখ খুলে তাকালো ইফা।।পেছনে অনেকগুলো গাড়ি জমে গেছে‌।। মাথায় শুধু লোকটার কথাগুলো ঘুরছে।। অনিচ্ছা থাকার সত্ত্বেও গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল।। চোখের সামনে ভাসছে সেই ছবিটা।। কিন্তু কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছে না।। অবশেষে মনে পড়েছে,, এটা ইফার বাবা ইমতিয়াজ আমহৃদ আর তার বন্ধু আদ্রিক আহম্মেদের ছবি।। ইয়াং বয়সের সাদা কালো ছবি।।যেটা কম করে হলেও প্রায় ৩০ বছর আগে তোলা হয়েছে।।তাহলে কি তাকেই ইমতিয়াজ আমহৃদ বড্ড মিস করেন!!

চলবে…🎀🎀

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে